Saturday, July 30, 2016

যুক্তি আর তথ্যই ধর্ম ব্যবসায়ীদের পথে বসানোর জন্য যথেষ্ট

যুক্তি আর তথ্যই ধর্ম ব্যবসায়ীদের পথে বসানোর জন্য যথেষ্ট


যুগ যুগ ধরে চালিয়ে যাওয়া জারিজুরি প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় কতিপয় উগ্রপন্থী ধর্ম ব্যবসায়ী দল ও তথাকথিত পীরেরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে প্রতিশোধে উন্মত্ত হয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও বিস্তৃতি পাওয়া “নাস্তিকতা ও উদার ধর্মনীতি” নিয়ে আলোচনা ও গবেষণাকে একটি গর্হিত অপরাধ হিসেবে ব্যাপকভাবে চিহ্নিত করছে। এটা একদিক দিয়ে ভালো যে, লোক-দেখানো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান দিয়েও এরা নিজেদের কুশ্রী চেহারাটা ঢেকে রাখতে পারছে না। ব্লগ, জাতীয় দৈনিক আর টিভির মাধ্যমে দেশ থেকে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে এদের ধর্মবিরোধী কর্মকাণ্ড।
কিন্তু সমস্যা হলো বর্তমান সরকার ও দেশের তথাকথিত উদারপন্থী মুসলিমরা এইসব ধর্ম ব্যবসায়ীদের বয়কট বা তাদের অনৈসলামিক ও অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডের বিচার করছে না। না করে বরং মধ্যপন্থা অনুসরণ করছে। এসব ভণ্ডদের শত্রু মানে নাস্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষদের কর্মকাণ্ডকে আরেক পাল্লায় রেখে মাপছে তারা। তবে সেই মাপ নিতে গিয়ে দুইনাম্বারীর আশ্রয় নিচ্ছে তারা।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ৯০ ভাগের বেশি মানুষ মুসলিম হলেও তাদের অধিকাংশই অন্যান্য ধর্ম ও নাস্তিকতা নিয়ে উদারপন্থী মনোভাব রাখে। এর কারণ বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি, লালন ও সুফিবাদের প্রভাব।
উগ্রপন্থী মুসলিম নেতারা কোরআনের অপব্যাখ্যা করছে এবং অনেক ক্ষেত্রে কোরআনকে পাশ কাটিয়ে সুবিধা-মাফিক হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে অদূর ভবিষ্যতে এদেশে কট্টর ইসলামী শাসন ও সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বিনা বাধায় সহিংসতার রূপ দিচ্ছে। কেমন হবে সেই সমাজ তার ধারণা দেওয়া হচ্ছে খুনখারাবী আর প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে; ওয়াজ-মাহফিল ও বিভিন্ন ইস্যুতে সমাবেশ ও মিছিল থেকে। আর তাদের কাওলা করা মসজিদ-মাদ্রাসা তো আছেই। মাথামোটা হেফাজতি ও জঙ্গিদের পেছন থেকে তেল দিচ্ছে জামায়াত, বিএনপির নেতা; বঙ্গবন্ধুর খুনি ও তাদের সমর্থক; জাকির নায়েক, আনজেম চৌধুরী আর বিলাল ফিলিপসের মতো আন্তর্জাতিক মানের জিহাদি নেতা; সৌদি আরব, তুরস্ক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান আর ইয়েমেনের সরকার ও উগ্রপন্থী গ্রুপ; আর সরকারের ভেতরে কিছু মন্ত্রী-এমপি, ডিজিএফআই, র‍্যাব ও ডিবি পুলিশের কিছু কর্মকর্তা।
এমতাবস্থায়, সরকার আছে দোটানায়। একদিকে মিশ্র প্রকৃতির সংবিধান অন্যদিকে টাকার লোভ এবং ভোট ও ক্ষমতা রক্ষার রাজনীতি। ফলে তথাকথিত ইসলামবিরোধী কেউ খুন হলে বা কেউ হুমকি পেলে বা বিদেশীরা উদ্বিগ্ন হলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের লোকজন ও দলীয় নেতারা কিছু লোকদেখানো ও রুটিন কাজ করে; পুলিশ ও গোয়েন্দাদের বলা হয় নজরদারী বাড়াতে ইত্যাদি। এরপর আসামীদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করা ও তদন্তে ধীরগতি সৃষ্টি করে বিষয়গুলোকে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখানো হয়। অন্যদিকে সরকারও উগ্রপন্থীদের সুরে বলতে শুরু করেছে যে, যেহেতু দেশের ৯২ ভাগ মানুষ মুসলিম এবং ইসলামের শত্রুরা সারা বিশ্বে আল্লাহ, রসুল ও কোরআনকে অবমাননা করে চলেছে, সেহেতু দেশের ভেতরেও এ ধরণের কর্মকাণ্ড তারা বরদাস্ত করবে না। আবার সেই মিশ্র সংবিধানের জন্য তাদেরকে এটাও বলতে হয় যে, মুমিনরা যেন আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়। তারা যেন মসজিদের মাইক ব্যবহার করে দুই-একজন তথাকথিত নাস্তিকের উপর হামলে না পড়ে; মসজিদে বসে যেন সশস্ত্র জিহাদের পরিকল্পনা না করে; দল নিষিদ্ধ হলে যেন প্রকাশ্যে কোন কর্মকাণ্ড না করে ইত্যাদি।
মিশ্র সংবিধান বললাম কারণ এদেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি এবং রাষ্ট্রধর্ম প্রথা তথা ধর্ম-ব্যবসা বৈধ। অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা তথা ধর্মীয় সহনশীলতা এই সংবিধানের চারটি মূলমন্ত্রের একটি।
সহিংস জঙ্গিদের সাথে কলম-কিবোর্ডধারীদের এই অসম তুলনা ঠিক মিলছে না। কেননা জঙ্গিদের উপর সশস্ত্র হামলা হচ্ছে না– না নাস্তিকদের পক্ষ থেকে, না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে। এক কথায় বলতে গেলে, কোন বাধা না পেয়ে চলমান সহিংস ও ভয়-উদ্বেগকারী এই ইসলামী গণবিপ্লব একপেশে হয়ে যাচ্ছে।
তবে এই লড়াইয়ে লজ্জাজনক অসম অবস্থাকে আড়াল করে এদের মোটাদাগে দুই দলে ভাগ করে উভয়কেই উগ্রপন্থী হিসেবে দেখানো হচ্ছে। আর এই গুরুদায়িত্ব পালনে জঙ্গি ও তাদের মদদদাতাদের সহযোগীতা করছে খোদ প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর পুলিশ প্রধান।
কিভাবে? এর শুরু ২০১৩-তে।
ব্লগার-স্থপতি রাজীব হায়দারের মৃত্যুর পর খুনিদের মারফত জানা গেলো সে ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মকে অবজ্ঞা করে লিখত এবং তা ব্লগ ও ফেসবুকে প্রকাশ করতো। হুম.. এইসব ভয়াবহ তথ্য জানা গেলো জামায়াত-শিবিরের আন্ডারগ্রাউন্ড আদর্শে বিশ্বাসী নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীর হাতে সে খুন হবার পর।
এজন্যেই এসব তথ্যকে বিশ্বাস হয় না; সত্যিই যদি হত তাহলে আগে আপনারা কই ছিলেন?
ঈশ্বরে অবিশ্বাসী এবং যুক্তিবাদী লেখক ও কার্টুনিস্টদের মধ্যে যারা ধর্ম নিয়ে সমালোচনা ও গবেষণা করে তাদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন এমন ভাষা ব্যবহার করে যা ভণ্ড ধর্ম ব্যবসায়ীদের অব্যাখ্যা ও হুমকির ভাষাকেও হার মানায়।
আরে ভাই! সেক্যুলারিজম ইতিমধ্যেই অনেক দেশে সংখ্যাগুরুতে পরিণত হয়েছে। আর বিভিন্ন ধর্মের উদারপন্থীরা নিজ নিজ ধর্ম ও স্রষ্টার অলৌকিক ক্ষমতার অসারতা বুঝতে পেরে ধর্মনিরপেক্ষতার বাণীতে মুগ্ধ হয়ে ফেলে আসা ধর্মের অন্ধ ও উগ্র অনুসারীদের প্রতি সমর্থন উঠিয়ে নিচ্ছে, এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে সেসব ভণ্ডদের সমালোচনা করছে।
ঠিক কবে থেকে জানি না, তবে নাস্তিকদের মধ্যে কিছু নেতা-গোছের কর্মী নিজেদের উগ্র মানসিকতা ও প্রতিশোধপরায়নতার কারণে ধর্ম নিয়ে সমালোচনা করতে গিয়ে অশ্রাব্য ভাষার ব্যবহার করে চলেছে যা দেশের সাধারণ মানুষ ও বিদেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশের নাস্তিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার সমর্থকদের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। অন্যদিকে ধর্ম ব্যবসায়ীরা তাদের জারিজুরি চালু রেখে সাধারণ ধার্মিক ও উদারপন্থীদের সহমর্মিতা পাচ্ছে।
ফলে দেখা যাচ্ছে ভণ্ড মোল্লাদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে সেসব উচ্চাকাঙ্ক্ষী নাস্তিকরা নিজের অজান্তে বা জেনেশুনেই এদেশে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। যার জন্য দাম দেবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের অনেক নিরীহ উদারপন্থী মানুষ।
সাধারণ উদারপন্থী ধার্মিক (ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বিরোধী) এবং ধর্মনিরপেক্ষদের (অলৌকিকতায় অবিশ্বাসী ও অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি সহনশীল) প্রায় সবাই ধর্ম নিয়ে সমালোচনা, গবেষণা ও তর্ক-বিতর্ক এড়িয়ে চলে। কারণ তারা জানে, ধর্ম নিয়ে কচলালে তা সহিংসতা উগড়ে দেয়। কেননা, প্রায় সব ধর্মই নিজেরটাকে শ্রেষ্ঠ মনে করে আর বাকিদেরটাকে খারিজ করে তাদের উপর সকল নির্যাতনকে জায়েজ করে।
নাস্তিকরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেনা, আর প্রচলিত বিশেষ করে জনপ্রিয় ধর্মকে চ্যালেঞ্জ করে প্রচারণা চালায়। সেইসব যুক্তি ও তথ্যনির্ভর সমালোচনাই ধর্ম ব্যবসায়ীদের ব্যবসা নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। তাই আমাদের আরো বেশি সচেতন ও কৌশলী হতে হবে।

No comments:

Post a Comment