Sunday, May 31, 2015

পলাশী থেকে একাত্তর: ঐক্যের জয় ও অনৈক্যের পরাজয়ের ইতিহাস

পলাশী থেকে একাত্তর: ঐক্যের জয় ও অনৈক্যের পরাজয়ের ইতিহাস

মোখলেছুর রহমান

এদেশের ইতিহাস সম্পর্কে যারা সামান্যও পড়েছেন, তারাও নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ও পলাশীর যুদ্ধের ঘটনা সম্পর্কে অবগত আছেন। পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়েই বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যায় যা পরবর্তীতে সমস্ত উপমহাদেশকে আচ্ছন্ন করে। উপমহাদেশকে সেই গোলামির গ্লানি বয়ে বেড়াতে হয়েছে  তিন শত বছর। এটা মানুষের স্বভাবজাত একটি বৈশিষ্ট্য, সে একদিকে তার বিজয়ের ইতিহাস নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগে, অন্যদিকে পরাজয়ের ইতিহাস নিয়ে মাতম করে। কিন্তু ইতিহাস থেকে সে শিক্ষা নেয় খুব কম। আমাদের মত একটি নিস্পৃহ জাতির ক্ষেত্রে এই সত্যটি আরো প্রকট। পলাশীর প্রান্তরে বাংলার নবাবের পরাজয় এই জাতির জন্য এক বিরাট শিক্ষা। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হচ্ছে সেই ঐতিহাসিক পরাজয় থেকে এই জাতি ন্যূনতম শিক্ষাও অর্জন করেনি। পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের পেছনে ঐতিহাসিকগণ জাফর আলি খান তথা মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতাকে দায়ি করলেও সেটাই একমাত্র ও প্রধান কারণ ছিল না।  এর পেছনে ছিল আরো গভীর ও অন্তর্নিহিত কারণ। ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন ব্যক্তি মাত্রই জানেন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা যখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন তখন নবাবের অধীনে সৈন্য সংখ্যা ছিল ৫০,০০০। আর ইংরেজ কর্ণেল রবার্ট ক্লাইভের অধীনে ব্রিটিশ ও এদেশীয় মিলিয়ে সর্বসাকুল্যে মাত্র ৩,০০০ সৈন্য। যে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে নবাবের পরাজয় ঘটেছিল বলে উল্লেখ করা হয়, তার অধীনে ছিল ১৬,০০০ সৈন্য যারা নবাব বাহিনীর সাথে ইংরেজদের যুদ্ধের সময় সেনাপতির হুকুমে নীরব দর্শকের মত দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়। এরপরও নবাবের হাতে যে বিপুল সংখ্যক সৈন্য ছিল, ইংরেজদের পরাজিত করে এদেশ থেকে বিতাড়িত করা ছিল তার জন্য বাম হাতের কাজ। এমনকি মীর জাফর তার অধীনস্ত ১৬,০০০ সৈন্য নিয়ে নবাবের বিপক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতো তথাপি নবাবের বিজয় হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বাংলার নবাব পরাজিত হয়েছেন এবং জীবন দিয়েও প্রিয় জন্মভূমিকে দাসত্বের নির্মম শৃঙ্খলে বন্দি হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারেন নি। কিন্তু কেন? যেখানে সৈন্যসংখ্যা, অস্ত্রসম্ভার, রসদ, ও বাহন সবকিছু ছিল বিদেশীদের তুলনায় অনেক বেশি, তাছাড়া আপন প্রকৃতি, পরিবেশ সবই ছিল নিজেদের অনুকূলে, তথাপি এই ঐতিহাসিক পরাজয়ের কারণ ছিল জাতির অনৈক্য। সেদিন শুধু মীর জাফর নয়, ইয়ার লতিফ, জগৎ শেঠ, রায় দুরলভসহ সিরাজের বেশ কয়েকজন সেনাপতি তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। সাম্রাজ্যবাদীদের সামান্য প্রলোভনে নিজ মাতৃভূমির সাথে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতার একমাত্র কারণ ছিল নিজেদের মধ্যকার অনৈক্য, ক্ষমতার কাড়াকাড়ি, হানাহানি। এই অনৈক্য তাদের এতটা দুর্বল করে দিয়েছিল যে মাত্র ৩,০০০ সৈন্যের কাছে পরাজিত হয়েছিল ৫০,০০০ সৈন্যের অধিপতি নবাব। সিরাজ-উদ-দৌলার এই পরাজয় আমাদের জন্য এক বিরাট শিক্ষা। আজ আমরা ১৬ কোটি মানুষের এক বিশাল জাতি। অথচ পৃথিবীতে আমরা কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারছি না, বরং অন্যসব জাতির করুণার পাত্র হয়ে আমরা বেঁচে আছি। কারণ নিজেদর মধ্যকার সেই অনৈক্য আমরা আজও জিঁইয়ে রেখেছি। আজও আমাদের নেতা-নেত্রীদের ক্ষমতার কাড়াকাড়ি, স্বার্থ হাসিলের রক্তক্ষয়ী কোন্দ্বলে জাতি ক্ষত-বিক্ষত, খণ্ডিত-বিখণ্ডিত। পশ্চিমা প্রভূদের দেওয়া বিভিন্ন রকমের তন্ত্র-মন্ত্রের উপর ভিত্তি এবং ধর্মব্যবসায়ী মোল্লাশ্রেণির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ১৬ কোটির জনসংখ্যার এই জাতিটি আজ শতধা বিভক্ত হয়ে একে অন্যের রক্ত পানে লিপ্ত। এই অনৈক্য জাতিকে এতটা বিপর্যস্ত করে রেখেছে যে বিদেশি প্রভুদের ঋণ ও অনুদান এক দিনের জন্য বন্ধ থাকলে আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে। অথচ এই বাংলার মাটি এক অফুরন্ত সম্পদের ভান্ডার। এই মাটিতে পুষ্ট হয় না এমন বীজ পৃথিবীতে খুব কমই আছে। এদেশের আবহাওয়া ও ভৌগোলিক অবস্থান পৃথিবীর যে কোন দেশের তুলনায় উৎকৃষ্ট। এই উর্বর সোনা ফলানো মাটির পাশাপাশি জালের মতো ছড়ানো যে নদী-নালা আর দক্ষিণে যে সমুদ্র আছে তার মত সুনিপুন বিন্যাস পৃথিবীতে আর কোথাও আছে বলে আমাদের জানা নেই। যে কারণে এই মাটির প্রতি যুগে যুগে বেনিয়া ও সাম্রাজ্যবাদীদের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে। অথচ এই মাটির সন্তানদের আজ বেঁচে থাকার জন্য মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় এমন সব জাতির প্রতি যারা কয়েকশ’ বছর আগেও নিজ দেশে খাবার ও সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হত। এই নির্মম সত্য আজ মেনে নিতে হচ্ছে, কারণ আমরা আজও একটি ঐক্যহীন, বিশৃঙ্খল জাতি। সম্রাজ্যবাদীরা চলে যাওয়ার সময় এই জাতি যেন আর কোন দিন ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে সেই উদ্দেশ্যে গণতন্ত্র নামক একটি জীবনব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়ে যায়। তাদের সেই ষড়যন্ত্র জাতি আজও উপলব্ধি করতে পারেনি। তাদের দেওয়া জীবনব্যবস্থাকে মেনে নিয়ে ফলশ্র“তিতে নিজেদের মধ্যে অনৈক্য, মারামারি, হানাহানি করে অস্তিত্বকেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। আজ সাম্রাজ্যবাদিরা আর আক্রমণ করে, শক্তি খরচ করে আমাদের পরাজিত করার প্রয়োজনবোধ করে না। কারণ ঐক্যহীন এই জাতি নিজ তাগিদেই তাদের চাটুকারিতা ও গোলামি করে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাদের দারস্থ হয়। অথচ পলাশীর প্রান্তরে আমরা ঐক্যহীনতার যে আত্মঘাতি রূপ দেখেছি, ’৭১ এ  দেখেছি তার বিপরীত দৃশ্য, ঐক্যের বিজয়। অস্ত্রহীন, প্রশিক্ষণহীন, ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কাতর, শারীরিক সামর্থ্যহীন সাড়ে ৭ কোটি জনসংখ্যার এই জাতির অল্প কিছু মানুষ বাকিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় বিদেশী যালেম শাসকদের কাছ থেকে স্বাথীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল একমাত্র ঐক্যের জোরে। এক, অভিন্ন ও সুনির্দিষ্ট লক্ষে ঐক্যবদ্ধ সেই জাতিকে কোন সীমাবদ্ধতায় স্তব্ধ করতে পারেনি। পলাশী থেকে একাত্তর, ঐক্যের গৌরবময় বিজয় আর অনৈক্যের গ্লানিময় পরাজয়ের এই অকাট্য দলিল থেকে শিক্ষা নেওয়ার সময় এসেছে। আজও যদি ১৬ কোটি মানুষের এই জাতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করে তবেই রচিত হবে নতুন এক বিজয়ের ইতিহাস। ক্ষুধার্ত, জরাজীর্ণ এই জাতিটিই হয়ে ওঠবে  এক সমৃদ্ধ, প্রভাব বিস্তারকারী, অপরাজেয় জাতি। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে ঐক্যই হতে পারে মুক্তির একমাত্র পথ।

No comments:

Post a Comment