Tuesday, March 1, 2016

জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় ধর্মবিশ্বাস

জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় ধর্মবিশ্বাস


শফিকুল আলম উখবাহ
জঙ্গিবাদ বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংকট। বাংলাদেশেও জঙ্গিবাদ হানা দিয়েছে। জঙ্গিবাদের ইস্যুতে বিশ্বের বহু দেশে এই মুহূর্তে যুদ্ধ চলছে। আমাদের দেশেরও ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলিম এবং সমগ্র বিশ্বে মুসলিমদেরকেই সন্ত্রাসী হিসাবে পরিচিত করে তুলতে ব্যাপক প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে যার প্রভাব সুস্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে।
জঙ্গিবাদের মোকাবেলায় যত বেশি শক্তিপ্রয়োগ করা হচ্ছে ততই জঙ্গিবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা অনুমাননির্ভর কথা নয়, এটা পরিসংখ্যান।
শক্তিপ্রয়োগ অপরাধ দমনের অন্যতম উপায়, তবে প্রধান উপায় হচ্ছে শিক্ষা। এ কারণে শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়। সুশিক্ষা একটি জাতিকে নৈতিক বলে বলীয়ান করে তোলে যা চরিত্রের মধ্যে প্রোথিত হয়ে তাকে অপরাধ থেকে ফিরিয়ে রাখে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা মানবসভ্যতা অনাদিকাল থেকে পাপ, গোনাহ, অপরাধ ও আইনভঙ্গ থেকে ফিরিয়ে রেখে মানবতা, দেশপ্রেম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। জঙ্গিবাদ কোনো সাধারণ অপরাধ নয়, এটি একটি আদর্শিক সন্ত্রাসবাদ যার প্রতিবিধানের জন্য রাষ্ট্রগুলোর হাতে শক্তিপ্রয়োগ ব্যতীত অন্য কোনো পন্থা নেই; উপরন্তু যে ধর্ম মানুষকে অপরাধ থেকে বিরত রাখার কথা সেই ধর্মের অপব্যাখ্যা দ্বারাই মানুষ জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের পন্থা যে ফলপ্রসূ হচ্ছে না, এর জন্য অন্য উপায় লাগবে এ কথাটি এখন অনেকেই অনুভব করছেন। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকগণ বলছেন যে, জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে, সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, জঙ্গিবাদের বিপরীতে তাদেরকে অনুপ্রাণিত ও প্রণোদিত (গড়ঃরাধঃব) করতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে কী বললে জঙ্গিরা তাদের পথ পরিত্যাগ করবে এবং নতুন করে কেউ আর জঙ্গি হবে না? এবং কীভাবে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা যাবে?
যে কোনো সমস্যার সমাধানের জন্য তার উৎপত্তি সম্পর্কে আগে জানতে হয়। এটা যদি একটা অসুখের মতো হয় এবং এর জন্য ডাক্তার দেখানো হয়, সেক্ষেত্রে ডাক্তারের প্রথম কাজ কী হবে? তিনি প্রথমে রোগীর লক্ষণগুলো দেখবেন যে এ রোগের ফলে রোগী কী ধরনের আচরণ করছে এবং এ আচরণের ফলে তার এবং তার আশেপাশের মানুষের কী ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। তারপরই তিনি ভাববেন এটার উৎপত্তির কারণ কী? উৎপত্তির কারণ না জেনে চিকিৎসা করলে ওষুধপত্র দিয়ে সাময়িকভাবে রোগের লক্ষণ (যেমন জ্বর) দূর করা গেলেও রোগ নির্মূল করা যাবে না, সেটা বার বার হবে। একইভাবে জঙ্গিদেরকে যদি জঙ্গিবাদ থেকে ফেরাতেই হয় তাহলে তা করতে হবে জঙ্গিবাদের উৎপত্তিস্থল থেকে। জঙ্গিবাদের উৎপত্তি কোথা থেকে হয়েছে? ধর্মের বিকৃত শিক্ষা থেকে। অতএব, যারা জঙ্গিদেরকে ধর্ম থেকেই যুক্তি তুলে ধরে বোঝাতে হবে যে, এটা সঠিক পথ নয়। রোগের ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিষেধক জরুরি। জঙ্গিবাদের প্রতিকার করার ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা আছে বটে কিন্তু প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আদর্শের কোনো বিকল্প নেই।
এখন এই বিষয়টি জনগণকে বোঝাতে হলে যেসব বিষয়বস্তু, তথ্য প্রমাণ, ধর্মীয় যুক্তি দরকার যা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করবে তা বর্তমান ধর্মীয় শিক্ষায় নেই, সাধারণ শিক্ষায়ও নেই। কিন্তু সেই আদর্শ আমাদের কাছে আছে। আমাদের এমামুয্যামান তাঁর অভিমত ২০০৯ সনে একটি পত্রের মারফত বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জঙ্গিবাদ ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যার ফল। শক্তিপ্রয়োগের পাশাপাশি সঠিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হলে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা সম্ভব। তিনি এই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকারকে সহযোগিতা করার প্রস্তাব করেছিলেন।
একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ইদানীং আল্লাহ-রসুলের সম্পর্কে কটূক্তিকারীদেরকে গোপনে ও প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে। যারা রসুলাল্লাহকে নিজেদের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসেন, তাদের অনুভূতিকে অবজ্ঞা করার কোনো উপায় নাই, ঠিক একইভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির অভিলাসী বাম আদর্শকেও আমরা অবজ্ঞা করতে পারি না। যে কোনো নিঃস্বার্থ আদর্শকে অস্বীকার করাই অনৈতিক, যদিও সব আদর্শ পরিণামে মানুষকে শান্তি দিতে সফল হয় না। যাহোক যারা এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাচ্ছে তাদেরকে আমরা বলতে পারি, তুমি যে রসুলকে গালাগালি করার কারণে তাকে মেরে ফেললে এটা কি রসুলাল্লাহর রেখে যাওয়া আদর্শ, পন্থা (সুন্নাহ) মোতাবেক সঠিক হলো? যদি না হয়ে থাকে তাহলে তোমার এই কাজে আল্লাহও সন্তুষ্ট হবেন না, রসুলাল্লাহও সন্তুষ্ট হবেন না। আগে তোমাকে বুঝতে হবে এই কাজের ক্ষেত্রে রসুলাল্লাহর নীতি কি? রসুলাল্লাহর ১৩ বছরের মক্কী জীবনে তাঁকে কী নির্যাতন, অপমান, অপদস্থই না করা হয়েছে, তিনি কি পারতেন না তাঁর অনুগত আসহাবদেরকে দিয়ে বিরোধী নেতৃবৃন্দকে গুপ্তহত্যা করাতে, জ্বালাও পোড়াও, ভাঙচুর করাতে? তিনি তা করেন নি। আমাদের দেশের একটি ধর্মান্ধ শ্রেণি প্রায়ই ইসলামবিদ্বেষীদের কর্মকাণ্ডে মূর্খের ন্যায় উত্তেজিত হয়ে নিজ দেশের সম্পদ, রাস্তাঘাট ভাঙচুর করেন, নিজেদের ক্ষতি নিজেরাই করেন। কিন্তু আল্লাহর রসুল তা করেন নি। তিনি অটল, অনড়, সংশপ্তক হয়ে সত্যের প্রচার ও প্রকাশ ঘটিয়ে গেছেন। একটা সময় তাঁর জীবনে এসেছে যখন ঐ বিরোধীরা নবীর প্রচারিত সত্যকে গ্রহণ করে তাঁরই অনুসারী হয়ে গেছেন। আর যারা বিরোধিতায় অটল ছিল তারা কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে। তাই গুপ্তহত্যা ও সন্ত্রাস সৃষ্টির মতো নিষ্ফল প্রয়াস না করে কার্যকর পদক্ষেপ হলো জাতিকে ন্যায়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করা, জাতি ঐক্যবদ্ধ হলে প্রাকৃতিক নিয়মেই বিজয় তাদেরকে অনুসরণ করবে। গত তেরশ বছর ধরে মুসলিম জাতিটির মধ্যে শিয়া-সুন্নী দাঙ্গা করে লক্ষ-কোটি মুসলিম দাবিদার মারা যাচ্ছে। আজও সিরিয়া, ইরাক, ইয়ামেন, আরব, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশে শিয়া-সুন্নী দাঙ্গা অব্যাহত আছে। গত ৫ বছরে সিরিয়াতে আড়াই লক্ষ মানুষ এই অন্তর্কোন্দলে নিহত হয়েছে। মসজিদে হামলা চালিয়ে এক মুসুল্লি আরেক মুসুল্লিকে হত্যা করছে। জাতির এই যখন অভ্যন্তরীণ অবস্থা তখন ইসলাম-বিদ্বেষী শ্রেণি ইসলামের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চালাতেই পারে। এই সুযোগ থাকবে না যদি এই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা যায়। তাই রসুলের সুন্নাহ হচ্ছে সেটা করা। জঙ্গিদেরকে বোঝাতে হবে যে, তোমরা যে কাজ করছ তা দ্বারা তোমরা একূল ওকূল দু’টিই হারাচ্ছো। এতে তোমার সওয়াব হবে না বরং গুনাহ হবে। আর ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর যে এজেন্ডা পশ্চিমা বিশ্ব নিয়েছে সেটা তাতে আরো বৃদ্ধি পাবে। তাদের কাছে আছে বিরাট বিশাল সামরিক শক্তি, এবং আছে প্রভূত পার্থিব সম্পদ। পক্ষান্তরে এই ক্ষুদ্রসংখ্যক জঙ্গিদের কাছে ওসব কিছুই নেই, তাদের পার্থিব সম্পদ, তেল গ্যাস ইত্যাদিও তাদের হাতে নেই, সেগুলো তাদের সরকারগুলোর হাতে, যারা ইতোমধ্যেই পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোর পায়ে সাজদায় প্রণত হয়ে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে কার্যত অস্বীকার করে পশ্চিমা শক্তি ও জীবনদর্শনকেই প্রভু ও বিধাতা বলে স্বীকার করে নিয়েছে। সুতরাং মরিয়া হয়ে তারা ভুল কাজ করছেন। তারা এখানে ওখানে বোমা ফাটাচ্ছেন, পর্যটন কেন্দ্রগুলি ধ্বংস করছেন। তাতে পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর কোন ক্ষতি না হওয়ায় তারা শরীরে বোমা বেঁধে আত্মঘাতি হচ্ছেন। এতে প্রতিপক্ষের কী ক্ষতি হয়েছে? ধরতে গেলে কিছুই না। টুইন টাওয়ার গেছে তাতে কী হয়েছে? এখন ঐ স্থানেই সেই টুইন টাওয়ারের চেয়েও বড় টাওয়ার তৈরি করেছে। বরং এতে প্রতিপক্ষের লাভই হচ্ছে। পৃথিবীর মানুষকে সে বলছে যে দেখ! এরা কী রকম সন্ত্রাসী। এরা নিরীহ নিরপরাধ মানুষ, স্ত্রীলোক, শিশু হত্যা করছে। এদের ধর, মার, জেলে দাও, ফাঁসি দাও। পৃথিবী তার এ কথা মেনে নিয়েছে এবং তার নির্দেশ মোতাবেক তা-ই করছে, কারণ ইংরাজি প্রবাদ বাক্য গরমযঃ রং ৎরমযঃ অর্থাৎ মহাশক্তিধরের কথাই ঠিক।
এই কথাগুলো জঙ্গিবাদীদেরকে বোঝাতে হবে যে, তোমাদের এই কাজের দ্বারাই তোমাদের প্রতিপক্ষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবে। সেই ঐক্যের সামনে তোমরা দাঁড়াতেই পারবে না। যেমনটা হয়েছে শার্লি হেবদোর ঘটনায়। যে পত্রিকা কেউ চিনত না, সেটার নাম এখন পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের মুখে মুখে। সুতরাং এই ভুল পন্থা ছাড়ো। এই ব্যাপারটি বোঝানোর পরের কাজ দুইটি।
প্রথমত, যারা ইতোমধ্যেই জঙ্গি হয়ে গেছে তারা নৈতিক বল হারিয়ে ফেলবে, তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে আর একাজে যাবে না। তারা সবাই হুট করেই পূর্ণভাবে নিবৃত হয়ে যাবে এটা আমরা বলছি না। কিন্তু তারা অধিকাংশই নিজেদের কাজ সম্পর্কে দ্বিধান্বিত হয়ে যাবে। তারা একটা মধ্যবর্তী অবস্থায় উপনীত হবে। এই দ্বিধাই তাদেরকে বেপরোয়া হতে বাধা দেবে।
দ্বিতীয়ত, আরেকটা ভাগ রয়ে যাবে যারা তারপরও ওই ধরনের কর্মকাণ্ড করতেই থাকবে। কিন্তু তখন তাদের সংখ্যা হবে কম। তখন তাদেরকে নিবৃত্ত করতে রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রয়োজন পড়বে। জনগণ প্রকৃত শিক্ষা পেলে স্বভাবতই সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে উঠবে, তারা সরকারকে জঙ্গিদমনে সহযোগিতা করবে, জঙ্গিদের রিক্রুটমেন্টও বন্ধ হবে। জঙ্গিদের সংখ্যা কম থাকলে রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগে তা নির্মূল করা সম্ভব হবে। এই শিক্ষা দিতে হবে সর্বতোভাবে, উভয়প্রকার শিক্ষাব্যবস্থায় এবং গণমাধ্যমের দ্বারা। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একটি শিক্ষাকে আমরা উদাহরণ হিসাবে দিলাম, এমন বহু বিষয় আছে যা জঙ্গিবাদ ও এর উৎপত্তির প্রতিটি পথ বন্ধ করে দিতে সক্ষম হবে এটা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি।
কিন্তু এখন যদি রাষ্ট্র বলপ্রয়োগ করে উগ্রপন্থী ইসলামিস্টদের দমন করতে চায় তাহলে জনসাধারণের ধর্মানুভূতি, ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার সুযোগ পাবে। কারণ তাদের আছে ধর্মনেতার ভাবমূর্তি। তারা সাধারণ জনগণকে বলবে দেখ আমরা রসুলের জন্য এতোকিছু করছি অথচ সরকার আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। অতএব সরকার ইসলামবিরোধী, নাস্তিক, তার বিরুদ্ধে জেহাদ করার ফতোয়াও তারা দিয়ে দিতে পারে। আমাদের দেশে অতীতে এটা বহুবার হয়েছে। প্রতিবারই জনগণ তাদের কথায় প্রভাবিত হয়েছে।
কাজেই এখন বল শুধুমাত্র বল প্রয়োগের যে পন্থা নেওয়া হয়েছে তা থেকে সরে এসে এদর্শিক এই লাড়াই চালাতে হবে।

No comments:

Post a Comment