Monday, November 30, 2015

হে জ্ঞানীরা! তোমরা কি তোমাদের জ্ঞানকে কাজে লাগাবে না???

হে জ্ঞানীরা! তোমরা কি তোমাদের জ্ঞানকে কাজে লাগাবে না? -রিয়াদুল হাসান


সব খাদ্য শরীরের জন্য যেমন উপকারী নয় তেমনি সব কথা মনের জন্য উপকারী নয়। যা কিছু মানুষের ক্ষতি সাধন করে তাই হারাম। যা কিছু মানুষের কল্যাণ সাধন করে তাই হালাল। স্রষ্টা চিরন্তন ধর্মে এই নীতিকেই হালাল-হারামের ভিত্তি করেছেন।
এই সাধারণ জ্ঞান লুপ্ত হয়ে গেলেই মানুষ ভাস্কর্য আর প্রতিমার পার্থক্য বুঝতে পারে না, শিল্প আর অশ্লীলতার পার্থক্য বুঝতে পারে না। তখন তার হালাল হারাম বুঝতে মাসলা খুঁজতে হয়। আল্লাহ আমাদের প্রতিপালক। তিনি তার অতি আদরের সৃষ্টি মানুষ যেন কোনো কষ্টে না পড়ে তাই শরীয়াহ দিয়েছেন যেভাবে একজন পিতা তার সন্তানকে ভালো মন্দের জ্ঞান দিয়ে থাকেন। তিনি বলেছেন মানুষকে তার জ্ঞানকে কাজে লাগাতে, মানুষ যেন প্রতিটি কাজ কেন করছে তা যেন বুঝে করে। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (র.) থেকে বর্ণিত, ‘আল্লাহর রসুল (দ:) বললেন- ‘কোন মানুষ নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, ওমরা (ইবনে ওমর (রা:) উল্লেখ কোরছেন যে ঐগুলি তিনি একে একে এমন বলতে লাগলেন যে, মনে হলো কোন সওয়াবের কথাই তিনি (দ:) বাদ রাখবেন না) ইত্যাদি সবই করলো, কিন্তু কিয়ামতের দিন তার আকলের বেশি তাকে পুরস্কার দেয়া হবে না (আহমদ, মেশকাত)। রসুলাল্লাহ (দ:) শব্দ ব্যবহার কোরেছেন আকল, যে শব্দটাকে আমরা বাংলায় ব্যবহার করি ‘আক্কেল’ বোলে, অর্থাৎ মানুষের বুদ্ধি, সাধারণজ্ঞান, যুক্তি ইত্যাদি।
আল্লাহর কোর’আন যিনি ভাসাভাসা ভাবেও একবার পড়ে গেছেন তিনিও লক্ষ্য না করে পারবেন না যে- চিন্তা-ভাবনা, যুক্তির উপর আল্লাহ কত গুরুত্ব দিয়েছেন। “তোমরা কি দেখ না? তোমরা কি চিন্তা করো না?” এমন কথা কোর’আনে এতবার আছে যে সেগুলোর উদ্ধৃতি কোন প্রয়োজন করে না। চিন্তা-ভাবনা, কারণ ও যুক্তির উপর আল্লাহ অতখানি গুরুত্ব দেওয়া থেকেই প্রমাণ হয়ে যায় যে এই দীনে অন্ধ বিশ্বাসের কোনো স্থান নেই। তারপরও তিনি সরাসরি বলছেন-“যে বিষয়ে তোমাদের জ্ঞান নেই (অর্থাৎ বোঝ না) তা গ্রহণ ও অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয়ই তোমাদের শোনার, দেখার ও উপলব্ধির প্রত্যেকটিকে প্রশ্ন করা হবে” (সুরা বনি ইসরাইল ৩৬)। কোর’আনের এ আয়াতের কোন ব্যাখ্যা প্রয়োজন করে না। অতি সহজ ভাষায় আল্লাহ বলছেন জ্ঞান, যুক্তি-বিচার না করে কোন কিছুই গ্রহণ না করতে। অন্য বিষয় তো কথাই নেই, সেই মহান স্রষ্টা তার নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধেও কোর’আনে বহুবার বহু যুক্তি দেখিয়েছেন।
প্রতিটি বস্তু বা বিষয় ভালো না মন্দ, বৈধ না অবৈধ, হালাল না হারাম তা নির্ভর করে ঐ বস্তুর ব্যবহারের উপর। একটি কলম দিয়ে আমি সত্য লিখতে পারি, মিথ্যাও লিখতে পারি। এখানে মিথ্যা লেখার অপরাধে যদি কলমকেই হারাম বলে মনে করি সেটা কি মূর্খতা নয়? তাহলে তো কলমেই শিরোশ্চ্ছেদ করতে হয়।
তেমনি গান কলমের মতই একটি মাধ্যম। এই গানের দ্বারা আমি আল্লাহর রাস্তায় মানবতার কল্যাণে সংগ্রাম করার জন্য মানুষকে উজ্জীবিত করে তুলতে পারি, আবার এই গান দিয়ে মানুষকে অশ্লীল কাজের দিকে আকৃষ্ট করতে পারি। আমি কোনটা করব সেটা আমার ব্যাপার। এখানে গানকেই হারাম বলে ফতোয়া দেওয়া নির্বুদ্ধিতা। আপনি গানের অপব্যবহারকে হারাম বলতে পারেন।
সঙ্গীত, শিল্পচর্চা মানুষের মনকে আনন্দে ভরে দেয়, সুর তার হৃদয়ে প্রশান্তি তৃপ্তি দেয় ঠিক যেভাবে খাদ্য মানুষের শরীরের চাহিদা পূরণ করে। মানুষ তো শুধু দেহ নয় তার আÍা আছে, সেই আÍার খোরাকও আছে। সবার সব খাদ্য যেমন পছন্দ নয় তেমন সবার আÍার খোরাকও এক নয়। এর ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি আল্লাহ করেন নি।
বর্তমান সময়ে মানুষের জীবন ভোগবাদী। তারা গান-বাজনা, আনন্দ-ফুর্তিকেই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বানিয়ে নিয়েছে। কোনো কিছুই অতিরিক্ত ভালো নয়। লবণ খাদ্যকে সুস্বাদু করে, কিন্তু অতিরিক্ত হলে তা খাদ্যের মূল উদ্দেশ্যকেই ধ্বংস করে। আল্লাহর রসুলের জীবনটা ছিল অন্যরকম। তিনি ছিলেন এক মহা বিপ্লবী নবী। তাঁর এত সময় ছিল না যে গান বাজনা শিল্পচর্চা নিয়ে মেতে থাকবেন, সেটা তার জীবনের মূল কাজ হতে পারত না। তার মানে এই নয় যে তিনি সেগুলো হারাম করেছেন।
আরবের উৎসবের দিনগুলোতে ছেলে মেয়েরা গান করত, সে সময়ে যে বাদ্যযন্ত্র ছিল সেগুলো দিয়েই গান করত, নাচত। তিনি সেগুলোতে কোনো বাধা দেন নি। তবে যে গানে ছবিতে আল্লাহর বিরুদ্ধে বলা হয়, অশ্লীলতা করা হয় তিনি সেগুলোর বিরুদ্ধে স্বভাবতই কঠোর ছিলেন। কারণ সেগুলো জাতির আÍাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। জাতির কল্যাণ-অকল্যাণই ছিল তার প্রতিটি কাজের উদ্দেশ্য।
আমরা নিজেদের জ্ঞানকে ফতোয়ার বইয়ের কাছে বন্ধক দিয়ে সেই জ্ঞানের মালিক স্রষ্টা ও তাঁর রসুলের অপমানই করছি। পাগলা কুকুর যখন আপনার দিকে ধেয়ে আসে তখন কি আপনি মাসলা খোঁজেন যে এখন কী করণীয়? তখন নিজের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে আÍরক্ষার চেষ্টা করেন। কিন্তু ‘ইসলাম’ শব্দটি শোনার সঙ্গে সঙ্গেই কেন একটি শ্রেণির কাছে নিজের সকল বিবেক জ্ঞানবুদ্ধিকে বিসর্জন দিয়ে দেন? মনে রাখবেন, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই আল্লাহর রূহ বাস করে, সেই রূহ সেই মানুষকে অবশ্যই প্রতিটি সিদ্ধান্তের সময় সঠিক ও ভুল, ভালো ও মন্দের পার্থক্য নির্দেশ করতে থাকে।
আল্লাহর সেই রূহকে কথিত আলেম ও ফতোয়ার কেতাবে বন্দী না করে জাগিয়ে তুলুন, দেখবেন আল্লাহর আসল অভিপ্রায় কী বুঝতে সক্ষম হবেন। তখন ইসলাম অত্যন্ত সরল, সু¯পষ্ট ও যৌক্তিক হয়ে আপনার সামনে আবির্ভূত হবে। কেননা আল্লাহই এই দীনের নাম রেখেছেন সহজ সরল পথ বা সেরাতুল মুস্তাকীম।

No comments:

Post a Comment