Tuesday, November 10, 2015

চরমপন্থী মুসলিমদের ভুলগুলো

চরমপন্থী মুসলিমদের ভুলগুলো

রিয়াদুল হাসান
যারা আল্লাহর রসুলের বিরুদ্ধে, কোর’আনের বিরুদ্ধে কোনো অবমাননা দেখলেই বিক্ষুব্ধ হয়ে সহিংসতা শুরু করেন তাদেরকেই বলছি। লক্ষ করুন, দেশের সব মানুষ কিন্তু নাস্তিক হয়ে যায় নি, কিন্তু ধর্মবিদ্বেষী (মুখে ধর্মনিরপেক্ষ) পাশ্চাত্য সভ্যতা সারা পৃথিবীতে আধিপত্য বিস্তার করেছে। তাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি, দর্শন দ্বারা প্ররোচিত হয়ে নিজেদেরকে আধুনিকমনস্ক, প্রগতিশীল প্রমাণ করার জন্য আমাদের দেশেও একটি বড় সংখ্যার মানুষ আল্লাহ রসুলকে অবজ্ঞা করে গালি দিচ্ছে। তাদের এই সব ‘বেয়াদবিকে’ আপনারা সহ্য করতে না পেরে ক্ষেপে উঠছেন। তাদের ঘৃণার জবাব কেউ চাপাতি দিয়ে দিচ্ছেন, কেউ মিছিল, হরতাল, ভাঙচুর ইত্যাদি পন্থায় প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
আপনাদেরকে একটি বাস্তবতা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, বাঘ খাঁচায় বন্দী হলে তাকে খোঁচা দেওয়ার লোকের অভাব হয় না। বন্দী বাঘের তর্জন গর্জনই সার, সে যত ক্ষিপ্ত হয় তাকে নিয়ে ততই আমোদ প্রমোদ করা হয়। সুতরাং বিচ্ছিন্নভাবে দু একটি মানুষের কল্লা ফেলে দিয়ে লাভ নেই, মুসলিম জাতিকে তার বন্দীদশা থেকে উদ্ধার করার জন্য আল্লাহর দেওয়া পন্থায় অগ্রসর হতে হবে।
যারা বাস্তবতা স্বীকার না করে আবেগের দ্বারা সিদ্ধান্ত নেয় তারা তো অন্ধ। পুঁজিবাদী ভোগবাদী জীবনব্যবস্থা মানুষকে কোন স্তরে নামিয়ে দিয়েছে তা কি আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না? পিতা আজ পুত্রকে হত্যা করছে, সন্তান বাবা-মাকে হত্যা করছে, ছাত্র শিক্ষককে জুতা মারছে, সেখানে হাজার হাজার বছর আগের নবী-রসুলদেরকে এই বস্তুবাদী সভ্যতার মানুষ সম্মান করবে তা কী করে আশা করেন। ফেসবুকে অশ্লীলতার ছড়াছড়ি, শিল্পে, কাব্যে, গানে নোংরামিতে পূর্ণ। প্রতিটি নৈতিক মূল্যবোধকে অশ্রদ্ধা করা ফ্যাশন বলে মনে করা হচ্ছে। একটি জাতিকে ধ্বংস করার জন্য দুটি চক্রান্ত চিরন্তন- একটি মাদক আরেকটি অশ্লীলতায় আসক্তি। এর আক্রমণে জাতির তারুণ্য নিস্তেজ হয়ে যায়, অন্যায়বিরোধী মনোভাব হারিয়ে জুবুথুবু হয়ে যায় অথবা কামনার পূজারি হয়ে যায়। আজ সেটাই করে দেওয়া হয়েছে।
অন্য ধর্মের নবী রসুল অবতার বা ধর্মগ্রন্থগুলিকে নিয়ে যারা ব্যঙ্গচিত্র আঁকে বা চলচ্চিত্র বানায়, এই কাজগুলো যারা করে তারা আসলে সুস্থ মানুষ না। তারা সমাজের শত্র“ মানবতার শত্র“। যে কারও বাবা-মাকে নিয়ে অশোভন উক্তি করলে মানুষ তাতে ক্ষুব্ধ হবে এটা যেমন যুক্তিযুক্ত তেমনি প্রাণাধিক প্রিয় নবীকে নিয়ে কটূক্তি করলেও যারা তাঁর অনুসারী তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবে, এটাও যুক্তিযুক্ত। তবুও যারা এটা করে তারা মূলত একটি দাঙ্গাময় পরিস্থিতি সৃষ্টির হীন উদ্দেশ্যে কাজটি করে। পরে যখন কেউ সহিংসতা ঘটিয়ে ফেলে তখন পুরো মুসলিম জাতির উপর সন্ত্রাসের লেবেল এঁটে দেওয়া হয়। একটি ঘটনা যখন ঘটে তখন সেটা চলে যায় রাজনৈতিক ধান্ধাবাজদের নিয়ন্ত্রণে, তারা এর থেকে ফায়দা লোটার চেষ্টা করে। আমাদের কথা হচ্ছে, ভিন্ন ধর্মের কোনো বিষয় নিয়ে কারো বক্তব্য থাকলে সেটাকে যৌক্তিক তথ্য উপাত্ত ইতিহাস দিয়ে তুলে ধরার সব পথ খোলা আছে। কিন্তু তা না করে এভাবে কটাক্ষ করা হয় শুধুমাত্র একটি ইস্যু সৃষ্টির জন্য। শার্লি হেবদো পত্রিকাটি ছিল পেছনের সারির একটি অখ্যাত সাপ্তাহিক, সেটার নাম এখন বিশ্বের সবাই জানে, ৬০ লক্ষ কপিও নাকি ছাপা হয়েছে। এটাই হলো ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মের অপব্যবহার। আসুন, আমরা এসব কাজের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হই, জনসাধারণের ঐক্যের চেয়ে বড় কোনো শক্তি নেই।
পক্ষান্তরে যারা রসুলাল্লাহকে অপমান করলেই ফুঁসে উঠে হামলা চালিয়ে বসেন তাদেরকে আমরা রসুলাল্লাহর জীবনাদর্শ স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। রসুলাল্লাহর আড়ালে নয় একেবারে সামনে গালাগালি করা হয়েছে শত শতবার, তাঁর গায়ে থুথু ছেটানো হয়েছে, তাঁর পিঠে উটের নাড়ি-ভুঁড়ি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁকে মুরতাদ, কাফের, পাগল, জাদুকর, মিথ্যাবাদী ইত্যাদি বলে অপবাদ প্রচার করা হয়েছে। আল্লাহর রসুল কি পারতেন না তাঁর আসহাবদেরকে নির্দেশ দিয়ে রাতের অন্ধকারে আবু জেহেল, আবু সুফিয়ানের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিতে, বা তাদেরকে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে হত্যা করে ফেলতে? অবশ্যই পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি, তিনি দীর্ঘ ১৩ বছর অত্যাচারিত, নির্যাতিত হয়েও যুক্তি দিয়ে মানুষকে বুঝিয়ে গেছেন যে, আল্লাহর হুকুম ছাড়া আর কারও হুকুমে শান্তি আসবে না। এক সময় সত্যিই তাঁর আহ্বান মানুষ মেনে নিল, একদিন যারা তাঁর বিরোধিতা করেছে তারাই নবীর ডান হাত বাঁ হাতে পরিণত হলো। জোর করে রাষ্ট্রশক্তি দখল করার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই, সেখানে শান্তি আসে না। বার বার বিদ্রোহ হয়। কিন্তু মন জয় করার মধ্যে কৃতিত্ব আছে। রসুলাল্লাহ সেটা করেছিলেন, এজন্য আজও তাঁর জন্য মানুষ জীবন দিতে প্রস্তুত, আর ঐ আবু জেহেলদের বংশ নির্বংশ হয়ে গেছে। এই সত্যটি এসব জঙ্গিবাদীদেরকে বুঝতে হবে যে তারা রসুলাল্লাহর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করতে গিয়ে যা করছেন তাতে না ইসলামের কোনো উপকার হচ্ছে, না উম্মাহর কোনো উপকার হচ্ছে। উল্টো বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে দেশে দেশে মুসলমানরা নিজেদের বাসে ট্রেনে আগুন দিয়ে নিজেদের স¤পদই ধ্বংস করে ফেলছে, নিজের পায়ে কুড়াল মারা আর কাকে বলে? এর চেয়ে বড় মূর্খতা আর কী হতে পারে। সুতরাং এটা সঠিক পন্থা নয়। আগে তাদের নিজেদেরকে সত্যের পক্ষে, হকের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। তারপর প্রতিপক্ষের এ মন্তব্যগুলিকে যুক্তি দিয়ে ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রতিহত করা, মিথ্যা অভিযোগ খণ্ডন করা। সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়া যেহেতু প্রচলিত আইনেও বৈধ নয়, যারা এমন কাজ করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয়ও নেয়া যেতে পারে।
যতদিন আল্লাহর রসুল রাষ্ট্রশক্তি অর্জন করেন নি, ততদিন তিনি কাউকে দণ্ডও দেন নি, কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা অভিযানও প্রেরণ করেন নি। কেননা দণ্ডদান, যুদ্ধ ইত্যাদি সার্বভৌম ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত। যখন তিনি মদীনার রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন, তখন রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলা, জাতির ঐক্য-সংহতি রক্ষার জন্য যে কোনো পদক্ষেপ তিনি অবশ্যই গ্রহণ করতে পারেন।
এই মুসলমানরা যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বিক্ষোভ করে মুসলিম দেশে আগ্রাসন চালানোর প্রতিবাদে। কিন্তু তারা নিজেরাই যে নিজেদেরকে ধ্বংস করছে গত ১৩০০ বছর ধরে, এর সমাধান কে করবে? সিরিয়াতে কে কাকে মারছে, ইরাকে কে কাকে মারছে? সেখানে তো মুসলমান মুসলামনের বুকে গুলি চালাচ্ছে। গত পাঁচ বছরে সিরিয়াতে মারা গেল আড়াই লক্ষ মুসলমান। এই শিয়া বনাম সুন্নি দাঙ্গায় ইরাকে, আফগানিস্তানে, পাকিস্তানে কত কোটি মানুষ মারা গেছে আজ পর্যন্ত তার ইয়ত্তা নেই। এই চরমপন্থী জঙ্গিবাদীদের প্রতি কথা হচ্ছে, আগে দয়া করে ১৬০ কোটি মুসলিম জাতির মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করুন, শিয়া-সুন্নি, হানাফি-হাম্বলী নিয়ে হানাহানি বন্ধ করুন, সবাইকে নিয়ে একটি ই¯পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ জাতি গড়ে তুলুন, দেখবেন এসব কার্টুন আঁকা এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। এই জাতিটি ১৪০০ বছর আগে যখন একটি অখণ্ড জাতি ছিল তখন কি কেউ রসুলাল্লাহর বিরুদ্ধে কটূক্তি করার সাহস পেত? এটা হচ্ছে কবিগুরুর ভাষায়, নির্বিষ সর্পের ব্যর্থ ফণা আস্ফালন।
অনেকে অভিযোগ করেন, আমরা হেযবুত তওহীদ কেন কোনো প্রতিবাদ, বিক্ষোভ করি না? করি না, কারণ আমাদের দৃষ্টিতে এগুলো অন্তঃসারশূন্য ও অর্থহীন। ১০০ বছর আগেও রসুলাল্লাহর নামে বহু অপপ্রচার করা হয়েছে, তখনো অনেক বিক্ষোভ হয়েছে। এখনো হয়। এসব করে কি অপপ্রচার কমেছে? না। বরং আরো বেড়েছে। তাই এ পথে আরো হাজার বছর চেষ্টা চালিয়ে লাভ হবে না, উল্টো ক্ষতি হবে। আমরা মনে করি, সত্যটা তুলে ধরা, সত্যের পক্ষে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করাই আমাদের মুখ্য কর্তব্য। আর যারা ধর্মব্যবসা করেন তাদের তো রসুলাল্লাহর পবিত্র নামই মুখে আনা উচিত নয়। যে কাজ আল্লাহ হারাম করেছেন তারা সেটাকেই ধর্ম বানিয়ে নিয়েছেন। তারা যখন রসুলাল্লাহকে অবমাননা করার প্রতিবাদ করে সেটাকে বক ধার্মিকতা আর নিজেদের জাহির করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই আমরা মনে করি না।
এখন তাহলে মুসলিম জাতির করণীয় কী? সেটা হচ্ছে নিজেরা আগে সত্যকে বোঝা, ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য বোঝা, নিজেদেরকে সত্য মিথ্যার মানদণ্ড সম্পর্কে, ধর্ম-অধর্ম, ইসলাম-অইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। নয়তো কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল তা মাসলা-মাসায়েলের গোলকধাঁধায় গুলিয়ে ফেলব। ইসলাম আজ বহুরূপে আমাদের সামনে উপস্থিত, কিন্তু এক সত্যের বিবিধ রূপ হতে পারে না। পীর সাহেব যেটা বলবে সেটাও সত্য, দরবারী আলেম যেটা বলবে সেটাও সত্য, জঙ্গিবাদী আলেম সাহেব যেটা বলবে সেটাও সত্য, ভোটবাদী ইসলামিক দল যেটা বলবে সেটাও সত্য এটা হতে পারে না। সত্যের রূপ সব সময় একটিই হয়। সেই সত্যকে চিনতে হবে, তারপর সেই সত্যের উপর দণ্ডায়মান হতে হবে। সেই সত্য আল্লাহ হেযবুত তওহীদকে দান করেছেন। জ্ঞানের অহঙ্কারে মদমত্ত না হয়ে স্থির মস্তিষ্কে, সত্যসন্ধানের উদার হৃদয় নিয়ে হেযবুত তওহীদের বক্তব্য জানুন।
মানবজাতি যখন এমন বড় কোনো সংকটে পতিত হয় যে তা থেকে সবাই মিলে শত চেষ্টা করেও আর উন্নীত হতে পারে না, তখন আল্লাহ স্বয়ং হস্তক্ষেপ করেন। ধর্মসমূহের বিকৃতি আর পাশ্চাত্যের বস্তুবাদ-ধর্মহীনতার শত শতবর্ষব্যাপী দ্বন্দ্বের পরিণামে মানবজাতি আজ এমনই সঙ্কটে পতিত হয়েছে যা বর্তমানে তাদেরকে ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে এসেছে।
আল্লহর শোকর যে এই চরম ক্রান্তিকালে বিশ্ব মানবতার মুক্তির জন্য তিনি স্বয়ং হস্তক্ষেপ করেছেন। হেযবুত তওহীদ হচ্ছে বর্তমান পৃথিবীতে স্বয়ং আল্লাহর হস্তক্ষেপ, আল্লাহর প্রকাশ। আল্লাহর নবী রসুলদেরকেও মানুষ প্রথমে গ্রহণ করে নি, তবে এক সময় করেছে। সেই নবী-রসুলদের সঠিক আদর্শ প্রচারকারী হেযবুত তওহীদকেও মানুষ বহু বিরোধিতার পর ২০ বছর পরে এসে বুঝতে পারছে এবং গ্রহণ করে নিচ্ছে।
লেখক: সাহিত্য সম্পাদক, দৈনিক বজ্রশক্তি

No comments:

Post a Comment