মানুষ হইয়া মানুষকে কুকুর বিড়ালের মত এত ঘৃণা করা- মনুষ্যত্বের ও আত্মার অবমাননা করা নয় কি? আত্মাকে ঘৃণা করা আর পরমাত্মাকে ঘৃণা করা একই কথা। সেদিন নারায়ণের পূজারী বলিয়াছিলেন, “ভাই, তোমার সে-পরম দিশারী তো হিন্দুও নয়, মুসলমানও নয়,- সে যে মানুষ!” কি সুন্দর বুকভরা বাণী! এ যে নিখিল কন্ঠের সত্য-বাণীর মূর্ত প্রতিধ্বনি! যাঁহার অন্তর হইতে এই উদ্বোধনী-বাণী নির্গত হইয়া বিশ্বের পিষ্ট ঘৃণাহত ব্যথিতদের রক্তে রক্তে পরম শক্তির সুধা ছড়াইয়া দেয়, তিনি মহা-ঋষি, তাঁহার চরণে কোটি কোটি নমস্কার! যদি সত্যিকার মিলন আনিতে চাও ভাই, তবে ডাক-ডাক, এমনি করিয়া প্রাণের ডাক ডাক। দেখিবে দিকে দিকে অবহেলিত জন-সঙ্ঘ তোমার এই জাগ্রত মহা-আহ্বানে বিপুল সাড়া দিয়া ছুটিয়া আসিবে। যাহারা স্বার্থপর, তাহারা মাথা কুটিয়া মরিলেও তো প্রাণের সাড়া কোথাও পাইবে না, যাহাকে পাইয়া তাহারা উল্লাসে নৃত্য করিবে তাহা বাহিরের লৌকিক “ডিটো” দিয়া মাত্র। অন্তরের ডাক মহা ডাক। ডাকিতে হইলে প্রথমে বেদনায়- একেবারে প্রাণের আর্ত তারে গিয়া এমনি করিয়া ছোঁওয়া দিতে হইবে। আর তবেই ভারতে আবার নূতন সৃষ্টি জাগিয়া উঠেবে। হিন্দু হিন্দু থাক, মুসলমান মুসলমান থাক, শুধু একবার এই মহাগগন-তলের সীমা-হারা মুক্তির মাঝে দাঁড়াইয়া-মানব! -তোমার কন্ঠে সেই সৃষ্টির আদিম বাণী ফুটাও দেখি! বল দেখি, “আমার মানুষ ধর্ম।” দেখিবে, দশদিকে সার্বভৌমিক সাড়ার আকুল স্পন্দন কাঁপিয়া উঠিতেছে। এই উপেক্ষিত জন-সঙ্গকে বুক দাও দেখি, দেখিবে এই দেহের ঈষৎ পরশ পাওয়ার গৌরবে তাহাদের মাঝে ত্যাগের একটা কি বিপুল আকাক্সক্ষা জাগে! এই অভিমানী-দিগকে বুক দিয়া ভাই বলিয়া পাশে দাঁড় করাইতে পারিলে ভারতে মহাজাতির সৃষ্টি হইবে, নতুবা নয়। মানবতার এই মহা-যুগে একবার গণ্ডী কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বল যে, তুমি ব্রাহ্মণ নও, শূদ্র নও, হিন্দু নও, মুসলমান নও, তুমি মানুষ-তুমি সত্য।
মহাত্মা গান্ধীজী ধরিয়াছেন এই মহা সত্যকে, তাই আজ বিক্ষুদ্ধ জনসঙ্ঘ তাঁহাকে ঘিরিয়া এমন আনন্দের নাচ নাচিতেছে। তোমরা রাজনীতিক যুক্তি-তর্কের চটক দেখাইয়া লেখাপড়া-শেখা ভণ্ডদের মুগ্ধ করিত পার, কিন্তু অমন ডাকটি আর ডাকিতে পারিবে না। আমরা বলি কি সর্বপ্রথম আমাদের মধ্য হইতে এই ছুঁৎমার্গটাকে দূর কর দেখি, দেখিবে তোমার সকল সাধনা এক দিনে সফলতার পুষ্পে পুষ্পিত হইয়া উঠিবে। হেন্দু মুসলমানকে ছুঁইলে তাঁহাকে øান করিতে হইবে, মুসলমান তাঁহার খাবার ছুঁইয়া দিলে তাহা তখনই অপবিত্র হইয়া যাইবে, তাঁহার ঘরের যেখানে মুসলমান গিয়া পা দিবে সেস্থান গোবর দিয়া (!) পবিত্র করিতে হইবে, তিনি যে আসনে বসিয়া হুঁকা খাইতেছেন, মুসলমান সে আসন ছুঁইলে তখনই হুঁকার জলটা ফেলিয়া দিতে হইবে, -মনুষ্যত্বের কি বিপুল অবমাননা! হিংসা, দ্বেষ, জাতিগত রেষারেষির কি সাংঘাতিক বীজ রোপণ করিতেছ তোমরা! অথচ মঞ্চে দাঁড়াইয়া বলিতেছ, “ভাই মুসলমান এস, ভাই ভাই এক ঠাঁই, ভেদ নাই ভেদ নাই!” কি ভীষণ প্রতারণা! মিথ্যার কি বিশ্রী মোহজাল! এই দিয়া তুমি একটা অখণ্ড জাতি গড়িয়া তুলিবে? শুনিয়া শুধু হাসি পায়। এসো, যদি পার, তোমার স্বধর্মে প্রাণ হইতে নিষ্ঠা রাখিয়া আকাশের মত উদার অসীম প্রাণ লইয়া এসো। এসো তোমার সমস্ত সামাজিক বাধাবিঘœ দু’ পায়ে দলিয়া মানুষের মত উচ্চ শিরে তোমার মুক্তবিথার নাঙ্গা মনুষ্যত্ব লইয়া। এসো, মানুষের বিরাট বক্ষঃ লইয়া। সে মহা আহ্বানে দেখিবে আমরা হিন্দু-মুসলমান ভুলিয়া যাইব। আমাদের এই তরুণের দল লইয়া আমরা আজ কালাপাহাড়ের দল সৃষ্টি করিব। আমরাই ভারতে আবার অখণ্ড জাতি গড়িয়া তুলিব। যে-রক্ষণশীল বৃদ্ধ এতটুকু “টু” করিবে, তাহার গর্দান ধরিয়া এই মুক্তির দিনে বাহির করিয়া দাও। সে আমাদের পথে দাঁড়াইবে, তাহার টুঁটি টিপিয়া ধরিয়া ফেল। শুধু মানুষ বাঁচিয়া থাক ভাই, -ভারতে শুধু চিরকিশোর মানুষেরই জয় হউক!
(কাজী নজরুল ইসলামের প্রবন্ধের সংকলন-গ্রন্থ যুগবাণী থেকে)