Monday, November 30, 2015

জঙ্গি আছে-জঙ্গি নেই: বিতর্কে বাংলাদেশ

রাকিব আল হাসান: বিকৃত ধর্মবিশ্বাস যে বৃহৎ সমস্যাগুলি সৃষ্টি করে তার মধ্যে অন্যতম ধ্বংসাত্মক মতবাদ হলো জঙ্গিবাদ। বর্তমান পরিস্থিতিতে জঙ্গিবাদ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু দেশসহ পৃথিবীর বহু দেশ আজ এই জঙ্গিবাদ নামক ক্যান্সারে আক্রান্ত।
আমাদের দেশেও এই জঙ্গিবাদের তৎপরতা অতীতে বেশ ভালোভাবেই দেখা গেছে। বর্তমানে আমাদের দেশে জঙ্গি তৎপরতা আছে কি নেই এ বিষয়টি নিয়ে চরম বিতর্ক চলছে। কেউ বলছেন বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে আবার কেউ বলছেন আমাদের দেশে জঙ্গি নেই।
.
এসএসএফ- এর ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘বিশ্বে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কৌশল পরিবর্তন হচ্ছে দিন দিন। নানা ধরনের সংঘাত বাড়ছে। বাংলাদেশকে আমরা এই সংঘাত থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছি। বিষয়টি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।’
.
এরপর সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে প্রকারান্তরে সমর্থন করেই বললেন, গত দুই বছরে ইরাক, সিরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জঙ্গি তৎপরতার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের নানা কার্যক্রমে এ দেশেও জঙ্গি তৎপরতায় অনেকে উৎসাহিত হচ্ছে। আর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি তিনি বলেছেন তা হলো, জঙ্গিবাদ এ দেশ থেকে একেবারে নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে আমাদের (আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর) অভিযানের কারণে তা নিয়ন্ত্রণে আছে। (প্রথম আলো অনলাইন, ২৮.০৭.২০১৫)।
এদিকে গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বেগের সঙ্গে বলেন, ব্রিটেনের জিহাদিরা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশে (বাংলাদেশ) জঙ্গিবাদকে উসকে দিচ্ছে। (সমকাল, ১৭ সেপ্টেম্বর, ’১৫)।
বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদ দমনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। ‘ওয়াশিংটন টাইমস’ নামের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি পত্রিকায় গত মাসের ১৫ তারিখে একটি প্রবন্ধ লিখে তিনি এ আহ্বান জানান।
এই বক্তব্যগুলো প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের আশঙ্কা রয়েছে। জঙ্গিবাদ আমাদের জন্য একটি ভয়ানক হুমকি। কিন্তু এদিকে সম্প্রতি জঙ্গি হামলার অশঙ্কার কথা বলে যখন অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ক্রিকেট দল বাংলাদেশ সফর স্থগিত করে তখন নানা মহল থেকে বলা হয় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের কোনো আশঙ্কা নেই।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, দেশে জঙ্গি উত্থানের কোনো আশংকা নেই। উপমহাদেশের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটতে পারে নি (যুগান্তর, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫)। সংসদে থাকা বিরোধী দল এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও অ-সংসদীয় বিরোধী দল বিএনপি এ বিষয়ে একমত পোষণ করে বলেছিলেন, “বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের কোনো অস্তিত্ব নেই।” নির্ধারিত সময়ের আগে টেস্ট সিরিজ খেলতে অস্ট্রেলিয়া তাদের ক্রিকেট দলকে সফরে পাঠাবে বলেও আশা প্রকাশ করে। এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মুখপাত্র ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক স¤পাদক আসাদুজ্জামান রিপন এই কথা বলেন। (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫)।
ঠিক এরপরই ইতালীয় নাগরিক চেজারে তাভেল্লাকে গুলশান-২ এর ৯০ নম্বর সড়কে গুলি করে হত্যা করা হয়। এবং পরদিন ২৯ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে সংবাদ আসে, “ঢাকার ইতালীয় নাগরিককে খুনের দায় ইসলামিক স্টেট (আইএস) স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে জঙ্গি হুমকি পর্যবেক্ষণকারী ওয়েবসাইট ‘সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্র“প’।” (বিডি নিউজ ২৪ ডটকম, ২৯ সেপ্টেম্ববর)।
এ বিষযে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দাবি করেন বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠন আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই। দেশে আইএস না থাকলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন সময় আইএস জঙ্গি সন্দেহে বিভিন্নজনকে গ্রেফতার করছে কেন এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, বিদেশ থেকে অনেকে বাংলাদেশে আসে। তারা সদস্য সংগ্রহ ও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করলে তাদের গ্রেফতার করা হয়। (সমকাল, ৩০ সেপ্টেম্বর)। এর আগে গত বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছিলেন, বাংলাদেশে জামায়াতুল মুজাহিদীনসহ (জেএমবি) কোনো জঙ্গি সংগঠনের আস্তানা বা অস্তিত্ব নেই। বাংলাদেশের অবস্থান যেকোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিপক্ষে। (প্রথম আলো, ১১ অক্টোবর, ১৪)।
এভাবে কখনো প্রমাণ করতে চাওয়া হচ্ছে দেশে চরমভাবে জঙ্গি উত্থানের আশঙ্কা রয়েছে আবার কখনো প্রমাণ করতে চেষ্টা করা হচ্ছে যে দেশে কোনো জঙ্গি নেই, জঙ্গি উত্থানের কোনো আশঙ্কাও নেই। এখন কথা হচ্ছে যদি ধরে নেওয়াও হয় যে, দেশে প্রকৃত অর্থে জঙ্গি নেই তবুও কি আমরা জঙ্গি সমস্যা উপেক্ষা করে থাকতে পারব? প্রথম কথা হচ্ছে অতীতে এদেশে জঙ্গি ছিল, তারা বিভিন্ন নাশকতা ঘটিয়েছে, অনেকে গ্রেফতার হয়েছে, অনেকে বিচারের মুখোমুখি হয়েছে কিংবা অনেকেই বিচারাধীন আছে এবং ইতোমধ্যে অনেকের ফাঁসিও হয়ে গেছে।
২০০৫ সালের ১৭ই আগস্ট বাংলাদেশের মোট ৬৪ জেলার ৬৩ টিতেই একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে জঙ্গিদের শক্তির জানান দিয়েছিল জেএমবি। তাছাড়া ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে সেই সময়ের বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। হামলায় শেখ হাসিনা আহত না হলেও বোমার আওয়াজে তার শ্রবণযন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে নিহত হন আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন। জানা যায়, এই হামলা চালায় মুফতি হান্নানের হরকাতুল জিহাদ।
এর আগেও ঢাকার রমনা বটমূল এবং যশোরে উদীচী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে জঙ্গি হামলা চালিয়েছিল হরকাতুল জিহাদ। জেএমবি ১৭ আগস্টের পর সারাদেশে একের পর এক আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ, সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাসহ ৩৩ জন জনকে হত্যা করে। প্রশাসন যে সবাইকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে কিংবা বিচারের সম্মুখীন করতে পেরেছে তা নয়। অনেকেই এখন ঘাপটি মেরে বসে আছে। উপযুক্ত সময় পেলেই তারা স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হবে। এখন কথা হচ্ছে সেই উপযুক্ত সময় কোনটা?
বৈশ্বিক পরিবেশ কি দ্রুতই জঙ্গিদের সেই কাক্সিক্ষত সুযোগের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে না? আফগানিস্তানে তালেবানদের পুনরায় জয়-জয়কারের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে আইএস গজিয়েছে। তারা সংখ্যায়, আয়তনে, সপদে এবং অস্ত্রে এখন এতটাই শক্তিশালী যে মধ্যপ্রাচ্যের একক কোন দেশই তাদেরকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম নয়। আইএস কোন জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সংগঠন কিংবা রাজনৈতিক দল নয়। তারা নির্ধারিত একটি ভূ-খণ্ড নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকবে না। তারা অবশ্যই অন্যান্য দেশের সমমনাদেরকে ফুসলানী দিয়ে সে সব দেশেও এই আদর্শের বিস্তার ঘটাতে চাইবে। সেটার নমুনা ইতোমধ্যেই আমরা দেখতে পাচ্ছি। আইএস মারফত জানা গেছে উপমহাদেশেও তাদের শাখা গঠিত হয়েছে। তাছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশের কূটনৈতিক ইটালির নাগরিক তাভেলা চেজার ও রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও খুনের দায় স্বীকার করেছে আইএস- এমন সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে।
অবশ্য দাবি করা হচ্ছে আইএস- এর দায় স্বীকার বানোয়াট। কিন্তু এ ঘটনায় আইএস জড়িত না থাকলেও অর্থাৎ তাদের দায় স্বীকারের ঘটনা বানোয়াট হয়ে থাকলেও কি আমরা বেঁচে যাব? কিংবা আমাদেরকে কি শান্তিতে থাকতে দেওয়া হবে? তাই ফিরে আসি প্রথম কথায়, বাংলাদেশে জঙ্গি থাক বা না থাক, এখানে জঙ্গিদের উত্থান ঘটানো হবে বলে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
বাংলাদেশের শত্র“রাই সেটা করবে। বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট টিমের আসা স্থগিত করা, পশ্চিমা দেশেগুলোর হাতে জঙ্গি নাশকতার সম্ভাব্য তথ্য থাকা, ইতালির কূটনীতিক হত্যা, জপানি নাগরিক হত্যা, অনেক দেশের নাগরিকদেরকে সতর্ক হয়ে চলাচল করা তার একটা অংশবিশেষও হতে পারে বলে বিজ্ঞজনেরা মনে করছেন।
সুতরাং বাংলাদেশে আইএস নেই এবং আইএস আসার সম্ভাবনাও নেই এই চিন্তা করে যদি আমরা কানে তুলো দিয়ে ঘুমিয়ে থাকি, স্বীকার অস্বীকার নিয়ে টালবাহানা করতে থাকি তাহলে আমরা বাঁচতে পারব না। ঘুমন্ত অবস্থায়ই একদিন দেখব আমাদের পরিণতি হয় গেছে সিরিয়ার মতো কিংবা ইরাকের মতো একটি দেশে। সুতরাং এখন উপায় কী? অস্ত্রব্যবসায়ী সাম্রাজ্যবাদী ও শত্র“স্থানীয় শক্তিশালী দেশগুলো যদি বাংলাদেশকে জঙ্গিদের অভয়ারণ্য হিসেবে প্রমাণ করতে তৎপর হয় তবে আমরা তাদেরকে কী দিয়ে তাদের এই ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে পারি? এর একমাত্র উপায় হচ্ছে জাতীয় ঐক্য।
আমরা দেশের ষোলো কোটি মানুষ যদি জঙ্গিবাদকে ঘৃণা করি, জঙ্গিবাদকে যদি প্রতিহত করার চেষ্টা করি, প্রচার-প্রচারণা চালাই তবে গুটিকয়েক ঘাপটি মেরে থাকা মানুষ এদেশে বিশৃঙ্খলা করতে পারবে না। জনগণই তাদেরকে প্রতিহত করবে। পাশাপাশি আমরা সাম্রাজ্যবাদীদের সকল অপচেষ্টাকে রুখেও দিতে পারব ইনশাল্লাহ। সুতরাং সরকারি দল, বিরোধী দল সবাইকে এই একটি ব্যাপারে এক হয়ে সম্ভাব্য এই ঝুঁকিকে মোকাবেলা করতে হবে। না হলে এদেশে কে সরকারী দল, কে বিরোধী দল, কে সংসদ সদস্য, কে বুদ্ধিজীবী, কে আইনজ্ঞ, কে বিচারক, কে ডাক্তার, কে সাংবাদিক তার কোনো পরিচয় অবশিষ্ট থাকবে না, সবার পরিণতিই হবে এক। সবার পরিচয় হবে রিফিউজি। তবে রিফিউজি হতে পারাটাও হবে সৌভাগ্যের বিষয়। এই ঘনবসতিপূর্ণ দেশে অধিকাংশই বেঘোরে প্রাণ হারাবে। লাখে লাখে মারা পড়বে একেকটি হামলায়।

No comments:

Post a Comment