Wednesday, November 25, 2015

নূরুর জীবনে সত্য রয়েছে তবে রুদ্র মূর্তিতে -কাজী নজরুল ইসলাম

ভাই রেবা,
…..
মনসূর যখন বিশ্বের ভণ্ড-মিথ্যুকদের মাথায় পা রেখে বলেছিল, – “আনাল হক্”- আমিই সত্য-সোহহম্, তখন সে-সব বক-ধার্মিক তাঁকে মারবার জন্য হৈ-হৈ রৈ-রৈ করে ছুটেছিল, এ লোকগুলো যে তাদেরই বংশধর। এ মিথ্যা ধার্মিকের দলই তো সেদিনে ঐ মহর্ষি মনসূরের কথা, তাঁর সত্য বুঝতে পারে নি, আজও পারছে না, আর পরেও পারবে না; এদের এই রকম একটা দল থাকবেই। কিন্তু যারা সত্যকে পেতে চলেছে, যাদের লক্ষ্য সত্য, যারা সত্যের হাত-ছানি দেখছে তাদের এইসব শক্তিহীন হীনবীর্য লোক কি থামাতে পারে? সত্য ছাড়া বিদ্রোহী হওয়াও তো একটা মস্ত শক্তির কথা। লক্ষ লক্ষ লোক যে জিনিসটাকে সত্য বলে রেখে দিয়েছে, চিরদিন তারা যে পথ ধরে চলেছে তাকে মিথ্যা বলে ভুল বলে তাদের মুখের সামনে বুক ফুলিয়ে যে দাঁড়াতে পারে, তার সত্য নিশ্চয়ই গতানুগতিক পথের পথিকদের চেয়ে বড়।
এই বিদ্রোহীর মনে এমন কোন্ শক্তি মাথা তুলে প্রদীপ্ত চাওয়া চাইছে যার সংকেতে সে যুগ-যুগান্তরের সমাজ, ধর্ম, শৃঙ্খলা, সব-কিছুকে গা-ধাক্কা দিয়ে নিজের জন্যে আলাদা পথ তৈরি করে নিচ্ছে। কই হাজারের মধ্যে আর নয়শ’ নিরানব্বই জনতো এমন করে দাঁড়াতে পারে না? তুমি কি বল, নয়শ’ নিরানব্বই জনই তা হলে সত্যকে পেয়ে বসে আছে? যে মরণকে ধ্বংসকে পরোয়া না করে না-চলার পথ দিয়ে চলে, কত বড় দুর্জয় সাহস তার? আর সত্যের শক্তি অন্তরে না থাকলে তো সাহস আসে না।….. তা ছাড়া, প্রত্যেকের আত্মারও তো একটা স্বতন্ত্র গতি আছে। আর সকলের মত একজন গড্ডালিকা-প্রবাহে যদি না চলে, তা বলে কি তার পথ ভুল? বিশেষ করে বিদ্রোহী হবার যেমন শক্তি থাকা চাই, তেম্নি অধিকারও থাকা চাই। কই, আমিতো বিদ্রোহী হতে পারিনে, তুমিতো হতে পার না; আমাদের মাঝে সে যে বিপুল সহ্য-শক্তি নেই।
…… বিদ্রোহটা তো অভিমান আর ক্রোধেরই রূপান্তর। ছেলে যদি রেগে বাপকে বাপ না বলে, বা মা’কে মা না বলে, কিম্বা বলে যে এরা তার বাপ-মা নয়, তা হলে কি সত্যি সত্যি তার পিতার পিতৃত্ব, মাতার মাতৃত্ব মিথ্যা হয়ে যায়? যে ক্ষুব্ধ অভিমান তার বুকে জাগে, তার শেষ হলেই মায়ের ক্ষ্যাপা ছেলে ফের মায়ের কোলেই কেঁদে লুটিয়ে পড়ে! কিন্তু এই যে অভিমান, এই যে আক্রোশের অস্বীকার, তা দিয়ে হয় কি? – না, সে তার বাপ-মাকে আরো বড় করে চেনে, বড় করে পায়। এই রকম করে হঠাৎ একদিন চিরন্তনী মাকেও হয়তো তার পক্ষে পাওয়া বিচিত্র নয়। তাছাড়া তার যে অধিকার আছে এই অভিমান করবার, এই বিদ্রোহী হবার, কেননা সে তার মায়ের øেহটাকে এত নিবিড় করে পেয়েছে যা দিয়ে সে জানে যে, তার সমস্ত বিদ্রোহ সমস্ত অপরাধ মা ক্ষমা করবেনই। যে øেহে, যে ভালবাসায় অভিমান জাগতে পারে- রাগ জন্মাতে পারে, সে øেহ-ভালবাসা কত বড় কত উচ্চ একবার ভাব দেখি! এতে মা’র অপমান না হয়ে তাকে যে আরো বড় করে দেওয়া হয় রে! তাই মা ঝোঁক নেওয়া, ক্ষ্যাপা ছেলের ঝোঁক নেওয়া দেখে ছেলের হাতের মার খেয়েও গভীর øেহে চেয়ে চেয়ে হাসেন! এ-দৃশ্য বলে বোঝাবার নয়! ছেলের হাতের এ-মার খাওয়াতেও যে মায়ের কত আনন্দ কত মাধুরী তা তো বাইরের লোক বুঝতে পারে না। তারা মনে করে, কি বদমায়েশ দুরন্ত ছেলে বাবা! কিন্তু যে ছেলে মায়ের এত øেহ পায় নি, এমন অধিকার পায় নি, সে মাকে মারা তো দূরের কথা, তার কাছে ভাল করে কাছ ঘেঁষে একটা আবদারও করে পারে না।
….. তাই প্রথমে বলেছিলাম যে, এই বাধন-হারা নূরু যেন বিশ্ব-মাতার বড় øেহের দুলাল- ঠিক ‘কোল-পোছা’ ছেলের মতন আব্দেরে একজিদ্দে একরোখা- আর তোদের কথায় বিদ্রোহী! অনেক ছেলে মরে মরে যাবার পর যে এই ক্ষ্যাপাটে মায়ের মড়াচে ঝোঁকদার ছেলে! দেখবি, এ শিশু আবার হাসতে হাসতে মায়ের স্তন্য-ক্ষীর পান করছে আর আপন মনেই খেলছে! ….. মা যখন তার দুষ্ট ছেলেকে স্লান করাবার সময় সাবান দিয়ে তোয়ালে দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করেন, তখন তার কান্না আর রাগ দেখেছিস্ তো? সে তখন হাতে-দাঁতে মায়ের চুল ছিড়তে থাকে, কিল-চাপড় বর্ষণ করেত থাকে আর চেঁচিয়ে আকাশ ফাটিয়ে ফেলে। মা কিন্তু হাসতে হাসতে তার কাজ করে যান। তাকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে নীলাম্বরী ধুতিটি পরিয়ে দিয়ে চোখে কাজল কপালে টিপটি দিয়ে যখন মুখে ঘন ঘন চুমো খান তখন আবার সেই দুরন্ত ছেলে প্রাণভরা হাসি দেখেছিস্? – নুরুটারও এখন হয়েছে তাই। বিশ্ব-মাতা এখন তাকে ধুয়ে-মুছে রগ্ড়ে সাফ করে নিচ্ছেন, আর সেও তাই হাত-পা জুড়ে কান্না জুড়ে দিয়েছে। মা যেদিন কোলে নিয়ে চুমো খাবেন, সেদিন কোথায় থাকবে ওর ভূতোমি আর কোথায় থাকবে এই কান্না আর লাফালাফি। তখন সব সুন্দর-সুন্দর! এ শুভ দিন তার জীবনে জাগ্বেই ভাই, দেখে নিস্ তুই? তবে তার হয়তো এখনও অনেক দেরি। তার জীবনে সত্য রয়েছে, তবে রুদ্র মূর্তিতে। এর পরেই যখন কল্যাণ জাগ্বে তখন জীবন দেখবি কত সুন্দর হয়ে গিয়েছে। ছেড়ে দে বোন্, ওকে ছেড়ে দে! চলুক ও নিজের একরোখা পথ দিয়ে- কল্যাাণকে আপনিই ও খুঁজে নিবে। কল্যাাণ নিজেই ওর পিছু পিছু মালা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সময় বুঝলেই সে এই পাগলার গলায় মালা দিয়ে ওকে ভুজ-বন্ধনে বেঁধে ফেলবে। তুই লাল কালিতে ডগ্ডগে করে লিখে রেখে দে এই কথা। আমি জানি, আমার এই ভবিষ্যদ্বাণী ফলবেই ফলবে, যদিও আমি পয়গম্বর নই।
(নজরুলের বিখ্যাত পত্রোপন্যাস বাঁধন-হারাতে রাবেয়ার উদ্দেশে লেখা চিঠির অংশবিশেষ)

No comments:

Post a Comment