Saturday, July 30, 2016

জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ -মসীহ উর রহমান

জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ -মসীহ উর রহমান


আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ আজ জঙ্গিবাদে আক্রান্ত। আমরা বহু পূর্ব থেকেই এ আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছিলাম সামরাজ্রবাদী পরাশক্তি এবং স্বার্থান্বেষী একটা গোষ্ঠী ধর্মের নাম ব্যবহার করে যেভাবে সহিংসতা ঘটাচ্ছে তাতে এ দেশেও সিরিয়া ইরাক আফগানিস্তানের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হতে পারে। জঙ্গি ইস্যুকে ব্যবহার করে তারা একটার পর একটা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ধ্বংস করে দিচ্ছে।
সাম্প্রতিক টার্গেট কিলিং ও গুলশান হামলাসহ বেশ কিছু নৃশংস ঘটনায় ইসলাম ধর্মের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা মনে করি এই আক্রমণ শুধু আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নয় বরং সরাসরি ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে। বিশ্বময় জঙ্গিদের কাজের পরিণতিতে বিশ্ববাসীর মনে ইসলাম সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা ও ভীতি সৃষ্টি হয়েছে। শত শত ইসলামবিদ্বেষী মানুষ ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রমাগত অপপ্রচার চালিয়েও যে ক্ষতি করতে পারে নি, এই জঙ্গিবাদীরা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে, জবাই করে মানুষ হত্যা করে ইসলামের বহুগুণ বেশি ক্ষতিসাধন করেছে।
আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, আল্লাহ রসুলের ইসলাম আর বর্তমানে ইসলামের নামে যেটা চলছে সেটা এক নয়, বরং সম্পূর্ণ বিপরীত। সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে এখন অবশ্যই ইসলামের নামে চলা সকল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। আল্লাহ হক, রসুল হক, দীন হক, কেতাব হক, রসুল যে জাতি গঠন করেছিলেন সেই জাতিও হক। সুতরাং সত্যের স্বাভাবিক ফল হবে শান্তি, এজন্য ইসলাম অর্থই শান্তি। কিন্তু আজকে যে ইসলাম আমরা দেখছি তা আমাদের শান্তি দিতে পারছে না কেন? কারণ ইসলামের নামে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী মানুষের ঈমানকে ভুল পথে প্রবাহিত করে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার করছে, কেউ অপরাজনীতি করছে, কেউ জঙ্গিবাদী কর্মকা- করে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে, সাধারণ মানুষের ক্ষতি করছে।
আল্লাহ ও তাঁর রসুলের সেই প্রকৃত ইসলাম সকল জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে নিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল। প্রতিটি মানুষ নির্বিঘেœ নির্ভয়ে চলাফেরা ও জীবনযাপন করতে পারত। কারো বিশ্বাসের উপর কোনো জবরদস্তি ছিল না। মানুুষের জীবন-সম্পদ ও সম্মানের পূর্ণ নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর আজ জঙ্গিবাদীরা সাধারণ মানুষের মধ্যে নৃশংস উপায়ে মানুষ হত্যা করে ত্রাসের সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। আল্লাহ রসুলের ইসলাম ঐক্যহীন বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, শত্রুকে ভাই বানিয়েছিল আর আজকে ইসলামের নামে ঐক্যবদ্ধ জাতিকে ঐক্যহীন করা হচ্ছে, ভাইকে শত্রু বানানো হচ্ছে, এক মুসলিম জাতিকে হাজারো মাজহাব ফেরকায় ভাগ করা হচ্ছে। আল্লাহ রসুলের ইসলাম স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে মানবতার কল্যাণে উৎসর্গিকৃত প্রাণ মানুষে পরিণত করেছিল, সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ও সোচ্চার মানুষ তৈরি করেছিল। আর এদের ইসলাম সমাজের অন্যায় অশান্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে স্বার্থপরের মতো ব্যক্তিগত জীবন ও আমল নিয়ে ব্যস্ত থাকার শিক্ষা দিচ্ছে।
এই জঙ্গিবাদকে সারা দুনিয়ায় শক্তি দিয়ে মোকাবেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা বলতে চাই, শুধু শক্তি দিয়ে হবে না, একটি বিকল্প আদর্শ লাগবে এবং কোর’আন হাদীসের প্রেক্ষিতে জঙ্গিবাদ যে ভুল তা প্রমাণ করে দিতে হবে। জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদ এগুলো কেন ইসলাম নয় তার যুক্তি-প্রমাণ আমরা জাতির সামনে তুলে ধরছি। আজকে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের চিন্তায় দিশাহারা। যদি মানুষের সামনে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা তুলে ধরা যায়, ধর্ম-অধর্মের পার্থক্য তুলে ধরা যায়, তাহলে স্বার্থান্বেষী ও জঙ্গিবাদীরা যেমন তাদের ভুল বুঝতে পেরে জেহাদের নামে সন্ত্রাস করার নৈতিক শক্তি হারাবে, তেমনি নতুন করেও কাউকে আর জঙ্গিবাদের দিকে নিয়ে যেতে পারবে না।
এখন যারা ইসলামকে ভালোবাসেন, দেশকে ভালোবাসেন, মানবজাতিকে ভালোবাসেন – জাতির জন্য ক্ষতিকর এই জঙ্গিবাদী ফেতনাকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দিতে হবে। আমাদের সবাইকে যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে দুটি কারণে সোচ্চার হতে হবে। প্রথমত, ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য বস্তুবাদী সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এ পর্যন্ত যতগুলো অস্ত্র প্রয়োগ করেছে তার মধ্যে জঙ্গিবাদ সবচাইতে সাংঘাতিক অস্ত্র বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তাই একে প্রতিহত করা আমাদের সকলের ঈমানী কর্তব্য।
দ্বিতীয়ত, দেশের নাগরিক হিসাবে, এই সমাজের সদস্য হিসাবে এটি আমাদের সামাজিক কর্তব্য। একাত্তরে আমরা পাকিস্তানী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করে স্বাধীন ভূখ- লাভ করেছি। সা¤্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলো চায় নিত্যনতুন যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করে সেখানে অস্ত্রব্যবসা করতে। আল্লাহ না করুক, বাংলাদেশে তারা যদি সেটা করতে পারে তাহলে আমাদের দাঁড়ানোর জায়গা থাকবে না, আমরাও লাখে লাখে মরব আর উদ্বাস্তু হয়ে যাব। তাই এ মাটিকে আমরা আর কারো পদানত হতে দিতে পারি না।
কিন্তু সেই পরিণতি এড়াতে হলে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ঐক্য অনৈক্যের উপরে বিজয়ী হয়, এটা প্রাকৃতিক নিয়ম। আমরা এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আন্দোলন হেযবুত তওহীদ ষোল কোটি মানুষকে সকল ন্যায়ের পক্ষে, সত্যের পক্ষে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসত্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান করছি। এ কাজে আমাদের কোনো পার্থিব স্বার্থ নেই। আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই অতীতের বিভেদ ভুলে, দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা পরিহার করে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি তাহলে এই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ থেকে আমাদের প্রিয় ধর্ম ইসলাম যেমন রক্ষা পাবে, তেমনি জাতিও রক্ষা পাবে, দেশও রক্ষা পাবে। আসুন আমরা ন্যায়ের পক্ষে, সত্যের পক্ষে, যাবতীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এক জাতি এক দেশ – ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি।

যুক্তি আর তথ্যই ধর্ম ব্যবসায়ীদের পথে বসানোর জন্য যথেষ্ট

যুক্তি আর তথ্যই ধর্ম ব্যবসায়ীদের পথে বসানোর জন্য যথেষ্ট


যুগ যুগ ধরে চালিয়ে যাওয়া জারিজুরি প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় কতিপয় উগ্রপন্থী ধর্ম ব্যবসায়ী দল ও তথাকথিত পীরেরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে প্রতিশোধে উন্মত্ত হয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও বিস্তৃতি পাওয়া “নাস্তিকতা ও উদার ধর্মনীতি” নিয়ে আলোচনা ও গবেষণাকে একটি গর্হিত অপরাধ হিসেবে ব্যাপকভাবে চিহ্নিত করছে। এটা একদিক দিয়ে ভালো যে, লোক-দেখানো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান দিয়েও এরা নিজেদের কুশ্রী চেহারাটা ঢেকে রাখতে পারছে না। ব্লগ, জাতীয় দৈনিক আর টিভির মাধ্যমে দেশ থেকে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে এদের ধর্মবিরোধী কর্মকাণ্ড।
কিন্তু সমস্যা হলো বর্তমান সরকার ও দেশের তথাকথিত উদারপন্থী মুসলিমরা এইসব ধর্ম ব্যবসায়ীদের বয়কট বা তাদের অনৈসলামিক ও অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডের বিচার করছে না। না করে বরং মধ্যপন্থা অনুসরণ করছে। এসব ভণ্ডদের শত্রু মানে নাস্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষদের কর্মকাণ্ডকে আরেক পাল্লায় রেখে মাপছে তারা। তবে সেই মাপ নিতে গিয়ে দুইনাম্বারীর আশ্রয় নিচ্ছে তারা।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ৯০ ভাগের বেশি মানুষ মুসলিম হলেও তাদের অধিকাংশই অন্যান্য ধর্ম ও নাস্তিকতা নিয়ে উদারপন্থী মনোভাব রাখে। এর কারণ বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি, লালন ও সুফিবাদের প্রভাব।
উগ্রপন্থী মুসলিম নেতারা কোরআনের অপব্যাখ্যা করছে এবং অনেক ক্ষেত্রে কোরআনকে পাশ কাটিয়ে সুবিধা-মাফিক হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে অদূর ভবিষ্যতে এদেশে কট্টর ইসলামী শাসন ও সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বিনা বাধায় সহিংসতার রূপ দিচ্ছে। কেমন হবে সেই সমাজ তার ধারণা দেওয়া হচ্ছে খুনখারাবী আর প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে; ওয়াজ-মাহফিল ও বিভিন্ন ইস্যুতে সমাবেশ ও মিছিল থেকে। আর তাদের কাওলা করা মসজিদ-মাদ্রাসা তো আছেই। মাথামোটা হেফাজতি ও জঙ্গিদের পেছন থেকে তেল দিচ্ছে জামায়াত, বিএনপির নেতা; বঙ্গবন্ধুর খুনি ও তাদের সমর্থক; জাকির নায়েক, আনজেম চৌধুরী আর বিলাল ফিলিপসের মতো আন্তর্জাতিক মানের জিহাদি নেতা; সৌদি আরব, তুরস্ক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান আর ইয়েমেনের সরকার ও উগ্রপন্থী গ্রুপ; আর সরকারের ভেতরে কিছু মন্ত্রী-এমপি, ডিজিএফআই, র‍্যাব ও ডিবি পুলিশের কিছু কর্মকর্তা।
এমতাবস্থায়, সরকার আছে দোটানায়। একদিকে মিশ্র প্রকৃতির সংবিধান অন্যদিকে টাকার লোভ এবং ভোট ও ক্ষমতা রক্ষার রাজনীতি। ফলে তথাকথিত ইসলামবিরোধী কেউ খুন হলে বা কেউ হুমকি পেলে বা বিদেশীরা উদ্বিগ্ন হলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের লোকজন ও দলীয় নেতারা কিছু লোকদেখানো ও রুটিন কাজ করে; পুলিশ ও গোয়েন্দাদের বলা হয় নজরদারী বাড়াতে ইত্যাদি। এরপর আসামীদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করা ও তদন্তে ধীরগতি সৃষ্টি করে বিষয়গুলোকে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখানো হয়। অন্যদিকে সরকারও উগ্রপন্থীদের সুরে বলতে শুরু করেছে যে, যেহেতু দেশের ৯২ ভাগ মানুষ মুসলিম এবং ইসলামের শত্রুরা সারা বিশ্বে আল্লাহ, রসুল ও কোরআনকে অবমাননা করে চলেছে, সেহেতু দেশের ভেতরেও এ ধরণের কর্মকাণ্ড তারা বরদাস্ত করবে না। আবার সেই মিশ্র সংবিধানের জন্য তাদেরকে এটাও বলতে হয় যে, মুমিনরা যেন আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়। তারা যেন মসজিদের মাইক ব্যবহার করে দুই-একজন তথাকথিত নাস্তিকের উপর হামলে না পড়ে; মসজিদে বসে যেন সশস্ত্র জিহাদের পরিকল্পনা না করে; দল নিষিদ্ধ হলে যেন প্রকাশ্যে কোন কর্মকাণ্ড না করে ইত্যাদি।
মিশ্র সংবিধান বললাম কারণ এদেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি এবং রাষ্ট্রধর্ম প্রথা তথা ধর্ম-ব্যবসা বৈধ। অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা তথা ধর্মীয় সহনশীলতা এই সংবিধানের চারটি মূলমন্ত্রের একটি।
সহিংস জঙ্গিদের সাথে কলম-কিবোর্ডধারীদের এই অসম তুলনা ঠিক মিলছে না। কেননা জঙ্গিদের উপর সশস্ত্র হামলা হচ্ছে না– না নাস্তিকদের পক্ষ থেকে, না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে। এক কথায় বলতে গেলে, কোন বাধা না পেয়ে চলমান সহিংস ও ভয়-উদ্বেগকারী এই ইসলামী গণবিপ্লব একপেশে হয়ে যাচ্ছে।
তবে এই লড়াইয়ে লজ্জাজনক অসম অবস্থাকে আড়াল করে এদের মোটাদাগে দুই দলে ভাগ করে উভয়কেই উগ্রপন্থী হিসেবে দেখানো হচ্ছে। আর এই গুরুদায়িত্ব পালনে জঙ্গি ও তাদের মদদদাতাদের সহযোগীতা করছে খোদ প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর পুলিশ প্রধান।
কিভাবে? এর শুরু ২০১৩-তে।
ব্লগার-স্থপতি রাজীব হায়দারের মৃত্যুর পর খুনিদের মারফত জানা গেলো সে ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মকে অবজ্ঞা করে লিখত এবং তা ব্লগ ও ফেসবুকে প্রকাশ করতো। হুম.. এইসব ভয়াবহ তথ্য জানা গেলো জামায়াত-শিবিরের আন্ডারগ্রাউন্ড আদর্শে বিশ্বাসী নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীর হাতে সে খুন হবার পর।
এজন্যেই এসব তথ্যকে বিশ্বাস হয় না; সত্যিই যদি হত তাহলে আগে আপনারা কই ছিলেন?
ঈশ্বরে অবিশ্বাসী এবং যুক্তিবাদী লেখক ও কার্টুনিস্টদের মধ্যে যারা ধর্ম নিয়ে সমালোচনা ও গবেষণা করে তাদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন এমন ভাষা ব্যবহার করে যা ভণ্ড ধর্ম ব্যবসায়ীদের অব্যাখ্যা ও হুমকির ভাষাকেও হার মানায়।
আরে ভাই! সেক্যুলারিজম ইতিমধ্যেই অনেক দেশে সংখ্যাগুরুতে পরিণত হয়েছে। আর বিভিন্ন ধর্মের উদারপন্থীরা নিজ নিজ ধর্ম ও স্রষ্টার অলৌকিক ক্ষমতার অসারতা বুঝতে পেরে ধর্মনিরপেক্ষতার বাণীতে মুগ্ধ হয়ে ফেলে আসা ধর্মের অন্ধ ও উগ্র অনুসারীদের প্রতি সমর্থন উঠিয়ে নিচ্ছে, এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে সেসব ভণ্ডদের সমালোচনা করছে।
ঠিক কবে থেকে জানি না, তবে নাস্তিকদের মধ্যে কিছু নেতা-গোছের কর্মী নিজেদের উগ্র মানসিকতা ও প্রতিশোধপরায়নতার কারণে ধর্ম নিয়ে সমালোচনা করতে গিয়ে অশ্রাব্য ভাষার ব্যবহার করে চলেছে যা দেশের সাধারণ মানুষ ও বিদেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশের নাস্তিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার সমর্থকদের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। অন্যদিকে ধর্ম ব্যবসায়ীরা তাদের জারিজুরি চালু রেখে সাধারণ ধার্মিক ও উদারপন্থীদের সহমর্মিতা পাচ্ছে।
ফলে দেখা যাচ্ছে ভণ্ড মোল্লাদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে সেসব উচ্চাকাঙ্ক্ষী নাস্তিকরা নিজের অজান্তে বা জেনেশুনেই এদেশে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। যার জন্য দাম দেবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের অনেক নিরীহ উদারপন্থী মানুষ।
সাধারণ উদারপন্থী ধার্মিক (ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বিরোধী) এবং ধর্মনিরপেক্ষদের (অলৌকিকতায় অবিশ্বাসী ও অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি সহনশীল) প্রায় সবাই ধর্ম নিয়ে সমালোচনা, গবেষণা ও তর্ক-বিতর্ক এড়িয়ে চলে। কারণ তারা জানে, ধর্ম নিয়ে কচলালে তা সহিংসতা উগড়ে দেয়। কেননা, প্রায় সব ধর্মই নিজেরটাকে শ্রেষ্ঠ মনে করে আর বাকিদেরটাকে খারিজ করে তাদের উপর সকল নির্যাতনকে জায়েজ করে।
নাস্তিকরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেনা, আর প্রচলিত বিশেষ করে জনপ্রিয় ধর্মকে চ্যালেঞ্জ করে প্রচারণা চালায়। সেইসব যুক্তি ও তথ্যনির্ভর সমালোচনাই ধর্ম ব্যবসায়ীদের ব্যবসা নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। তাই আমাদের আরো বেশি সচেতন ও কৌশলী হতে হবে।

Friday, July 1, 2016

মানুষ এনেছে গ্রন্থ, -গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো

মানুষ এনেছে গ্রন্থ, -গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো

আতাহার হোসাইন


কমনসেন্স বা সাধারণ জ্ঞান এমন একটি বিষয় যা কারো ভিতরে না থাকলে অন্য কেউ তা ঢুকিয়ে দিতে পারে না। ধর্মের ব্যাপারে যখন সেই কমনসেন্স হারিয়ে যায় তখন গোটা ধর্মই তার মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে। তখন ধর্মের শরীয়াহ, বিধিবিধান কার্যকর থাকলেও সেসব অর্থহীন হয়ে যায়। পাশাপাশি সেই ধর্ম মানুষকে শান্তি না দিয়ে বরং অশান্তিই উপহার দেয়, এমতাবস্থায় ধর্মের আনুষ্ঠানিকতাই মুখ্য হয়ে উঠে। কথায় আছে ধর্ম মানুষের জন্য কিন্তু ধর্মের জন্য মানুষ নয়। ধর্মের ব্যাপারে এই কমনসেন্স হারিয়ে গেলে তখন মানুষের জন্য ধর্ম নয়, বরং ধর্মের জন্যই মানুষ-এটা প্রকট হয়ে উঠে। তখন ধার্মিকরা মানুষ মেরে ধর্মপালন করতেও দ্বিধাবোধ করে না।

বিষয়টি আরো একটু পরিষ্কার করতে স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী থেকে একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। একবার একদল তরুণ স্বামী বিবেকানন্দের আশ্রমে গিয়ে বলল, ‘স্বামীজি, বিহারে ভয়ানক মরণঘাতী গো-মড়ক দেখা দিয়েছে। আমরা এই কটি তরুণপ্রাণ গো-মড়ক রোধ করার জন্য প্রাণপাত করব বলে আপনার আশীর্বাদ ভিক্ষা করতে এসেছি।’ স্বামী বিবেকানন্দ তরুণদের আকুতি শুনে বললেন, ‘তোমরা দেশের গো-সম্পদ রক্ষার জন্য উদ্যোগী হয়েছ দেখে আমি যারপরনাই আনন্দিত হলাম। তবে, তোমরা জান না, পূর্ববাংলার অনেক এলাকায় মরণঘাতী কলেরা দেখা দিয়েছে। সেখানে প্রতিদিন বহু মানুষ মারা যাচ্ছে। আমি বলি কি, তোমরা মানুষের প্রাণ রক্ষার জন্য আগে পূর্ববাংলায় ছুটে যাও। কলেরা আক্রান্ত অসহায় মানুষের সেবায় আমার তরফ থেকে যা কিছু সাহায্যের প্রয়োজন তার সবই তোমরা পাবে।’ স্বামী বিবেকানন্দের কথা শুনে স্বেচ্ছাসেবী দলের নেতা গোছের এক তরুণ হায় হায় রব ছেড়ে বলল, ‘স্বামীজি, এ আপনি কি বলছেন। বিহারে গো-মড়কে গো-মাতা মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রোগাক্রান্ত গো-মাতার সেবা ফেলে আপনি আমাদের মানুষের সেবায় পূর্ববাংলায় যেতে বলছেন? সব শুনে স্বামীজি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘তা ঠিক। গো-মাতা বিনে এমন নির্বোধ সন্তান জগতে কে আর প্রসব করবে?’
অনুরূপভাবে আমরা বলতে চেয়েছি যে এই মুহূর্তে মুসলিম বিশ্ব যখন চরম দুরাবস্থায় পতিত, মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে যখন চরম ঐক্যহীন অবস্থার কারণে নিজেরা নিজেরা মারামারি, গৃহযুদ্ধ কিংবা ভীন জাতির আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে, যখন মাথার উপর প্রতিনিয়ত বোমারু বিমান চক্কর দিচ্ছে, বোমার আঘাতে দেহ খ–বিখ- হয়ে যাচ্ছে, যখন প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে মুসলমানরা নিজের দেশ থেকে পালিয়ে ছোট ছোট নৌ-যানে করে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে মরছে, ইউরোপের রাস্তায় রাস্তায় আশ্রয়ের খোঁজে দিন কাটাচ্ছে, ঠিক এই সময়ে এই জাতিরই অন্য সদস্য অর্থাৎ অন্য মুসলমানরা কিভাবে ঈদের আনন্দ উৎসব করে তা আমাদের মাথায় আসে না। মাথায় আসেনা লাখ লাখ টাকা খরচ করে কিভাবে তারা হজ্জ করতে যায়! এই দুর্ভোগে পতিত মানুষের জন্য তাদের কি কোন ভূমিকাই নেই?
আমাদের এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে অনেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে অনেকে আমাদেরকে ইসলামের প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রচার চালান। তারা আরো বলেন যে, হজ্জ কিংবা কোরবানী আল্লাহর হুকুম, ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। সুতরাং এসব করতেই হবে। এইসব প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকারীদের উদ্দেশ্যে আমাদের বক্তব্য হচ্ছেঃ হজ্জ কিংবা কোরবানী যে আল্লাহর হুকুম, ইসলাামের অন্যতম স্তম্ভ তা আমাদের অবশ্যই জানা আছে। কিন্তু আমারই স্বজাতি ভাইয়েরা যখন না খেয়ে মরছে, উদ্বাস্তু শিবিরে মানবেতর জীবন-যাপন করছে, সাগরে ডুবে মরছে, আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, তখন আমি কি করে আনন্দ-উৎসব করি? কিভাবে আমার মুখে অন্ন উঠে? কিভাবে আমার মুখে হাসি আসে? কিভাবে আমি বত্রিশ পাটি দন্ত বিকশিত করে গরুর সাথে ফেসবুকে ‘কাউফি’ আপলোড করি?
ভালো কথা যে- হজ্জ, কোরবানী ইত্যাদি আল্লাহর হুকুম। তা অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু ইসলাম কি এও বলেনি যে, প্রতিবেশীকে ক্ষুধার্ত রেখে যে উদরপূর্তি করে খায় তার নামাজ-রোজা করে সবই অর্থহীন হয়ে যায়? সুরা মাউন পড়ে দেখুন সেখানে আল্লাহ কি বলছেন।
আল্লাহ বলছেন: “আপনি কি দেখেছেন তাকে, যে বিচারদিবসকে মিথ্যা বলে?
সে সেই ব্যক্তি, যে এতীমকে গলা ধাক্কা দেয়
এবং মিসকীনকে অন্ন দিতে উৎসাহিত করে না।
অতএব দুর্ভোগ সেসব নামাযীর,
যারা তাদের নামায সম্বন্ধে বে-খবর;
যারা তা লোক-দেখানোর জন্য করে
এবং নিত্য ব্যবহার্য্য বস্তু অন্যকে দেয় না।”
অর্থাৎ যেসব মুসুল্লী এতীমকে গলা ধাক্কা দেয় এবং নিত্য ব্যবহার্য বস্তু অন্যকে দিয়ে সহযোগিতা করে না তারা প্রকৃতপক্ষে বিচার দিবসে অবিশ্বাসী। তাদেরকে আল্লাহ দুর্ভোগ আক্রান্ত হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন। আল্লাহ যাকে দুর্ভোগ আক্রান্ত বলেন তার অবস্থান কোথায়? সে কি আদৌ মো’মেন-মুসলিম থাকতে পারে? অপর দিকে রসুলাল্লাহ বলেছেন, মুসলিম জাতি একটি দেহের ন্যায়। দেহের কোন একটা অংশ ব্যথিত হলে যেমন সারা শরীর ব্যথা অনুভব করে তেমনি একজন মুসলিম আক্রান্ত হলেও সকল মুসলিম ব্যথিত হবে। আল্লাহ রসুলের বক্তব্য অনুযায়ীই সেই কাউফি আপলোডকারী, মহাসমারোহে একাধিক গরু কোরবানীকারীদের অবস্থান আজ কোথায়? লাখ লাখ টাকা খরচ করে হজ্জকারীর হজ্জই বা জাতির জন্য কী কল্যাণ বয়ে আনছে? তাদের নামাজ, তাদের কোরবানী, তাদের হজ্জ তাহলে তাদেরকে কী শিক্ষা দিল? তারা কি সত্যিকার অর্থে মানবিক হতে পেরেছে?
পাঠক খেয়াল করে দেখবেন ধর্মের আইন, হুকুম কোনটাই মানবিকতার উর্ধ্বে নয়। আপনি মসজিদের পানে নামাজের জন্য ছুটছেন। এমতাবস্থায় দুর্ঘটনা আক্রান্ত কোন মুমূর্ষু ব্যক্তি যদি কাতরাতে থাকে তাহলে আপনি কি আগে আল্লাহর হুকুম পালন করতে মসজিদে ছুটবেন নাকি তাকে বাঁচানোর জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাবেন? যদি আপনি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান সেটাই হবে উত্তম কাজ। ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন ঈসা (আ)। মুসার (আ) আনীত দীনের শরীয়া পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করলেও সে সময়ের ইহুদিরা ধর্মের প্রাণ অর্থাৎ মানবিকতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। শনিবারে দুনিয়াবী কোন কাজ করা যাবে না- এটা ছিল শরীয়াহর অংশ। কিন্তু এই দীনে অন্ধের চোখ ভালো করা কিংবা অন্যের উপকার করার মত মানবিক কাজগুলো সে শরীয়াহর অন্তরায় নয় তা বোঝাতে তিনি ঠিক সেই শনিবারেই এক জন্মান্ধের চোখে হাত বুলিয়ে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিলেন। আজকের কমনসেন্সবিহীন জাতির মত তখনকার ইহুদিরাও তাতে প্রচুর গোস্বা করে ঈসাকে (আ) ধর্মদ্রোহী হিসেবে আখ্যা দিয়ে তাঁর বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছিল। একইভাবে আমরা যখন বলার চেষ্টা করছি যে ধর্মের জন্য মানুষ নয় বরং মানুষের জন্য ধর্ম, আনুষ্ঠানিক এবাদতের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আর্ত-পীড়িতকে উদ্ধার করা তখন কমনসেন্স হারানো মানুষগুলো আমাদের সামনে আল্লাহর হুকুমের কথা তুলে ধরছেন, আমাদেরকে নাস্তিক, ইসলামবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। পরিশেষে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা মানুষ কবিতার দুটো লাইন তুলে ধরছি।
“মানুষেরে ঘৃণা করি
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি
ও মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে ।
পুজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল! মুর্খ্যরা সব শোনো
মানুষ এনেছে গ্রন্থ,-গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।”
এরপরেও যাদের হুঁশ ফিরবেনা স্বয়ং আল্লাহ ছাড়া আর কেউ তাদের হুঁশ ফিরাতে পারবে বলেও মনে হয় না।