Wednesday, March 30, 2016

ইসলামি অর্থনীতিতে দান

ইসলামি অর্থনীতিতে দান


এম আমিনুল ইসলাম
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আদম তথা আমাদেরকে সৃষ্টি করে তাঁর নিজের রূহ থেকে ফুঁকে দিলেন। যে কারণে আল্লাহর সমস্ত মহৎ গুণাবলী আমাদের ভিতরে চলে এসেছে যদিও খুবই সামান্য পরিমাণে। আল্লাহর অন্যতম একটি সিফতী নাম ওহাব অর্থাৎ মহা-দাতা। এই মহাসৃষ্টির প্রত্যেকটি অণু পরমাণু আল্লাহর দানেরই ফসল। যে কারণে স্বভাবগতভাবে মানুষ দানশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাছাড়াও দানের উদ্দেশ্য আকিদা ও গুরুত্বের বর্ণনার পাশাপাশি দান করার জন্য আল্লাহ সরাসরি হুকুম দিয়েছেন (সুরা নাহল- ৯০), যার মাধ্যমে দান করা মুমিনের জন্য ফরদ হয়ে যায়। রসুলাল্লাহ দানের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করছেন যে, “আল্লাহ বলেন, হে আদম সন্তান! তুমি দান কর, আমি তোমাকে দান করব [আবু হুরায়রাহ (রা:) থেকে বোখারী ও মুসলিম]।” হাদীসে আরও উল্লিখিত যে, হাশরের মাঠে দান মুমিনের জন্য ছায়াস্বরূপ হবে। এ ছাড়া দান আল্লাহর দেওয়া জীবন ব্যবস্থার অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দানের সংজ্ঞা: দান মানেই মানুষের কল্যাণার্থে কোনো কিছু বিনাশর্তে প্রদান করা, যা কখনোই ফেরত যোগ্য নয়। যদিও আল্লাহ তাঁর নিজ অনুগ্রহে বান্দার এই দানকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেন। শুধু নগদ অর্থ নয়, নিজের অধিকারভ্ক্তূ যেকোন কিছুই দানের বিষয়-বস্তু হতে পারে। রসুলাল্লাহর হাদিস মোতাবেক নিজের পোষ্যদের জন্য ব্যয় করা, আত্মীয়তা রক্ষার জন্য ব্যয় করা, মানুষকে বিপদে আশ্রয় দেওয়া, কারো জন্য দোয়া করা, কোনো ক্ষুধার্ত প্রাণীকে খাদ্য দেওয়া, পথ-সন্ধানীকে পথ দেখিয়ে দেওয়া, পতিত জমিতে আবাদ করা, কোনো মুমিন ভাইয়ের প্রতি হাস্যমুখ করা, কাউকে সৎ কাজের উপদেশ দেওয়া, অসৎ কাজ হতে নিষেধ করাও দান, পথের থেকে কাঁটা সরিয়ে দেওয়াও একটি দান। এককথায় বলতে গেলে, প্রত্যেক পুণ্য কাজই মুমিনের জন্য এক একটি দান যদি সেই কাজে আল্লাহর কোনো সৃষ্টি উপকৃত হয়।
দানের প্রতিদান: মানব জাতি তথা আল্লাহর সৃষ্টির কল্যাণ সাধনে প্রত্যেকটি কাজেরই আল্লাহ প্রতিদান দিয়ে থাকেন, এটা দুনিয়াতেও আখেরাতেও। দান যেহেতু আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা এবং জারি রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে সেহেতু দানের প্রতিদান আল্লাহ দিবেন এটা সহজ কথা। আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামে দানকে আল্লাহ করযে হাসানা হিসাবে উল্লেখ করেছেন এবং দানকারীকে দানের চেয়ে বহুগুণ বেশি পরিমাণে প্রতিদান দেওয়ার ওয়াদা দিয়েছেন (সুরা বাকারা- ২৪৫, হাদীদ- ১১)। তাছাড়া দানকারী পুরুষ ও নারীদেরকে বহুগণ বেশি ছাড়াও সম্মানজনক পুরস্কার প্রদান ও ক্ষমার আশ্বাস দিয়েছেন (সুরা হাদীদ ১৮, তাগাবুন- ১৭)। পক্ষান্তরে দানের বিপরীতে যারা নিজে কৃপণতা করে এবং অন্যকে কৃপণতার নির্দেশ দেয় তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, আল্লাহ অভাবমুক্ত (সুরা হাদীদ- ২৪), আল্লাহ তাদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন (সুরা নেসা- ৩৭), আর লোক দেখানো দানকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন না এবং শয়তানের সঙ্গী হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন (সুরা নেসা- ৩৮)। পাশাপাশি এটাও জানিয়েছেন যে, যারা আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, দানের কথা বলে বেড়ায় না এবং দান গ্রহণকারীকে খোটাও দেয় না তাদের পুরস্কারতো আছেই, তাদের কোনো ভয় নাই এবং তারা দুঃখিতও হবে না (সুরা বাকারা- ২৬২, ২৭৪)। যারা দানের কথা বলে বেড়ায় এবং দানগ্রহণকারীকে কষ্ট দেয় তাদের দানকে আল্লাহ নিষ্ফল করে দেন এবং লোক দেখানো দান বলে অখ্যায়িত করেছেন এমনকি আল্লাহ তাদেরকে মুমিন হিসাবেও স্বীকৃতি দেন নি। আর তাদের উপমা দিয়েছেন একটি মসৃণ পাথরের সাথে যার উপর কিছু মাটি থাকে; অতপর প্রবল বৃষ্টিপাতে উক্ত পাথরকে পরিষ্কার করে ফেলে, ফলে দানের কারণে তারা যা কিছু অর্জন করেছিল তা নিষ্ফল হয়ে যায় (সুরা বাকারা- ২৬৪)।
দানের উপকারিতা: দানের কারণে দৃশ্যমানভাবে সমাজের অস্বচ্ছল দরিদ্রশ্রেণি যেমন উপকৃত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে তেমনি অদৃশ্য অনেক উপকারিতাও আছে যা মুমিন মাত্রই বুঝতে সক্ষম। যেমন দানের কারণে আল্লাহ পাপ মোচন করেন (সুরা বাকারা- ২৭১), আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ হয়, দানকারীর আত্মা বলিষ্ঠ হয় (সুরা বাকারা- ২৬৫)। দানকারীদেরকে আল্লাহ মোত্তাকী এবং তাদের এই কাজকে সৎকর্ম হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন (সুরা এমরান- ১৩৩, ১৩৪)। দানকে আল্লাহর সান্নিধ্য ও রসুলের দোয়া লাভের উপায় হিসাবেও সাব্যস্ত করেছেন (সুরা তওবা- ৯৯)। আত্মশুদ্ধির জন্য দানকারীদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে দূরে রাখার ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের ঘোষণা দিয়েছেন (সুরা লাইল- ১৭-২১)। দানের উপকারিতা প্রসঙ্গে হুজুর (সা.) বলছেন, “দাতা ব্যক্তি আল্লাহর কাছে, জান্নাতের কাছে, মানুষেরও কাছে অথচ জাহান্নাম হতে দূরে এবং কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহ হতে দূরে, জান্নাত হতেও দূরে, মানুষ হতেও দূরে অথচ জাহান্নামের অতি কাছে। নিশ্চয় মূর্খ দাতা কৃপণ সাধক অপেক্ষা আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় (আবু হুরায়রাহ থেকে তিরমিযি)। দান আল্লাহ পাকের রোষ প্রশমিত করে এবং মন্দ মৃত্যু রোধ করে (আনাস রা. থেকে তিরমিযী)।”
উৎকৃষ্ট বস্তু দান করা: মহান আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে মানুষকে অকৃতজ্ঞ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ, মানুষের প্রতি আল্লাহ যে অফুরন্ত রহমত, বরকত, দয়া, করুণা বর্ষিত হয় সে মোতাবেক সে অল্পই আল্লাহকে স্মরণ করে। মানুষের অধিকারে থাকা প্রত্যেকটি সম্পদই আল্লাহর দান কিন্তু যখনই আল্লাহর পথে ব্যয় করার ডাক আসে তখন মানুষ তার সম্পদের নিকৃষ্টতম বস্তুটিই দান করতে এগিয়ে আসে। সে জন্য আল্লাহ উৎকৃষ্ট বস্তুই দান করতে এবং নিকৃষ্ট বস্তু দান করার সংকল্প করা থেকেও দূরে থাকতে (সুরা বাকারা- ২৬৭) এবং নিজেদের প্রিয় জিনিস দান করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন (সুরা আলে এমরান- ৯২)। যে জিনিস নিজে গ্রহণ করবে না, বা ইতস্তত করবে সেটা দান করা থেকে বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়। রসুলাল্লাহও এক মুমিনের প্রতি আরেক মুমিনের অধিকার বর্ণনা করতে যেয়ে নিজের জন্য যা পছন্দ করবে অপরের জন্যও তা-ই পছন্দ করার তাগিদ দিয়েছেন।
দান করার নীতি: মহান আল্লাহ আমাদেরকে ভারসাম্যপূর্ণ জাতি হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সৃষ্টির প্রত্যেকটি বিষয়বস্তুই ভারসাম্যপূর্ণ, প্রাকৃতিক। এই ভারসাম্য একদিকে নষ্ট হলে অপরদিকেও আঘাত করবে এবং আল্লাহর সৃষ্টিতে বিঘ্ন ঘটাবে। এ কারণে আল্লাহ দান করার ক্ষেত্রেও ভারসাম্য রক্ষা করতে বলেছেন, “তুমি তোমার হস্ত তোমার গ্রীবায় আবদ্ধ করে রেখো না এবং তা সম্পূর্ণ প্রসারিতও করো না। তাহলে তুমি তিরষ্কৃত ও নিঃস্ব হয়ে পড়বে (সুরা বনী ইসরাইল- ২৯)।” আবার একেবারে কড়ায় গণ্ডায় হিসেব করেও দান করতে রসুল নিষেধ করছেন, “দান করতে থাকবে এবং হিসাব করবে না যাতে আল্লাহ তোমাকে দান করতে হিসাব না করেন। ধরে রাখবে না যাতে আল্লাহ তোমার ব্যাপারে ধরে না রাখেন। তোমার সামর্থ্য অনুসারে সামান্য হলেও দান করবে (আসমা বিনতে আবু বকর থেকে বোখারী ও মুসলিম)।” আবার নগণ্য উসিলায় যেন দান করা থেকে বিরত না থাকে সেজন্য রসুলাল্লাহ বলছেন, “হে নারী সমাজ! তোমরা দান কর যদি তোমাদের গহনা হতেও হয় (যয়নব রা. থেকে বোখারী ও মুসলিম)।”
সম্পদ জমা করার প্রতিফল: ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। অর্থনীতি হলো জীবনব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ। ইসলামী অর্থনীতির মূল কথা হলো সম্পদ জমা করা নয়, খরচ করা, ব্যয় করা। কারণ, একটা সম্পদ যত বেশি লোকের হাতে যাবে ঐ সম্পদ দিয়ে ততবেশি লোক উপকৃত হবে। একারণে, ব্যয় না করে যারা জমা করে তাদের জন্য আল্লাহর কঠোর সতর্কবাণী যে, “আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের অগ্নিতে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাহাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে, সেদিন বলা হবে, এটাই হচ্ছে তা যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জিভূত করতে। সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভূত করেছিলে তা এবার আস্বাদন কর (সুরা তাওবা- ৩৪, ৩৫)। দুর্ভোগ প্রত্যেকের, যে পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে, যে অর্থ জমায় ও তা বার বার গণনা করে, সে ধারণা করে যে, তাহার অর্থ তাহাকে অমর করে রাখিবে, কখনও না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হুতামায় (সুরা হুমাযা- ১-৪)।”
যারা কৃপণতা করে তাদের পরিণাম: আল্লাহ মানুষকে তাঁর রঙে রঙিন হতে বলেছেন তার মানে তাকে দয়া, মায়া, মমত্ববোধ, উদারতা, মহানুভবতা, দানশীলতা ইত্যাদি আল্লাহর গুণাবলীতে নিজেকে গুণান্বিত করতে হবে। তেমনি কৃপণতা, দারিদ্র্যের ভয়, হতাশা এগুলো হলো এবলিসের গুণ। যে কারণেই হোক, যারা কৃপণতা করবে তারা এবলিসের অনুসারী, তারা আল্লাহর লানতের পাত্র হবে। তাদের প্রতি আল্লাহ হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন যে, “তোমরাই তো তারা যাদেরকে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে বলা হয়েছে অথচ তোমাদের অনেকে কৃপণতা কোরছ। যারা কার্পণ্য করে তারা তো কার্পণ্য করে নিজেদের প্রতি। আল্লাহ অভাবমুক্ত এবং তোমরাই অভাবগ্রস্ত। যদি তোমরা বিমুখ হও, তিনি অন্য জাতিকে তোমাদের স্থলবর্তী করবেন, তারা তোমাদের মতো হবে না (সুরা মুহাম্মদ- ৩৮)।” কৃপণতাকে ধিক্কার দিয়ে রসুলাল্লাহ বলেছেন, “তোমরা কৃপণতা হতে বেঁচে থাকবে, কেননা, কৃপণতা ধ্বংস করেছে তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে। কৃপণতা তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছে রক্তপাতের প্রতি এবং হারামকে হালাল করার প্রতি, তারা দুনিয়া ও আখেরাত উভয়লোকে ধ্বংস হয়েছে (যাবের ইবনে আবদুল্লাহ থেকে মুসলিম)।”
সব দান সমান নয়: কারও দুঃসময়ে দান আর সুসময়ে দান এক নয়। আল্লাহ বলেন, “তোমরা আল্লাহর পথে কেন ব্যয় করবে না? আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মালিকানাতো আল্লাহরই। তোমাদের মধ্যে যারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে তারা এবং পরবর্তীরা সমান নয়। তারা মর্যাদায় তাদের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ যারা পরবর্তীকালে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে। তবে আল্লাহ উভয়ের কল্যাণের প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন (সুরা হাদীদ- ১০)।”
দানকারীর প্রতিদান ও কৃপণের সর্বনাশ: রসুলাল্লাহ বলেছেন, “যখনই আল্লাহর বান্দাগণ ভোরে জাগ্রত হয় তখন আকাশ হতে দুজন মালায়েক অবতীর্ণ হন। তাদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! তুমি দাতাকে প্রতিদান দাও এবং অপরজন বলেন, হে আল্লাহ! তুমি কৃপণকে সর্বনাশ দাও (আবু হুরায়রাহ (রা:) থেকে বোখারী ও মুসলিম)।”
কৃপণতা মুমিনের স্বভাব নয়: মর্যাদাবান প্রত্যেকটি বিষয়ের সাথে আল্লাহ এবং তাঁর রসুল যেমন সম্পর্কিত তেমনি আল্লাহর মুমিন বান্দাও সম্পর্কিত। কৃপণতা আল্লাহর স্বভাব নয়, রসুলের স্বভাব নয় তেমনি আল্লাহ ও রসুলের অনুগত কোনো মুমিনেরও স্বভাব নয়। তাই রসুলাল্লাহ বলছেন, “এ দু’টি স্বভাব মুমিনের মধ্যে একত্রিত হতে পারে না, কৃপণতা ও দুর্ব্যবহার (আবু সাইদ খুদরী থেকে তিরমিযি)। আমি কি তোমাদের বলব না সর্বপেক্ষা মন্দস্তরের ব্যক্তি কে? সে ব্যক্তি যার কাছে আল্লাহর নামে কিছু চাওয়া হয় আর সে তাঁর নামে কিছু দেয় না (ইবনে আব্বাস রা. থেকে আহমদ)।”
দান কাকে করবে: দানের মধ্যে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যয়কৃত দানকেই আল্লাহ ও তাঁর রসুল সর্বত্তোম দান হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং এই দানকে আল্লাহ করযে হাসানা হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এই দানকারীকেই আল্লাহ বহুগুণে বৃদ্ধি করা, পাপ মোচন করা, আল্লাহর সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টি অর্জন করা, আল্লাহর ক্ষমা ও মহাপুরস্কার প্রদানের ওয়াদা দিয়েছেন। কারণ, এই দানের কারণে আল্লাহ এবলিসের চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হন, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, আল্লাহর মহা-পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হয়, সর্বোপরি আল্লাহর অতি আদরের সৃষ্টি মানুষ সুখে শান্তিতে নিরাপত্তায় বসবাস করতে পারে। একারণে আল্লাহ দান পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, যিনি আল্লাহর পথে সংগ্রামে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত, আয় রোজগার করার সুযোগ নেই এবং মানুষের কাছে ভিক্ষাও করে না, আল্লাহর ভাষায়, “ইহা প্রাপ্য অভাবগ্রস্ত লোকদের; যারা আল্লাহর পথে এমনভাবে ব্যাপৃত যে, দেশময় ঘোরাফেরা করতে পারে না। যাঞ্চা না করার কারণে অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে অভাবমুক্ত বলিয়া মনে করে। তুমি তাহাদের লক্ষণ দেখিয়া চিনিতে পারিবে। তারা মানুষের নিকট নাছোড় হয়ে যাঞ্চা করে না (সুরা বাকারা- ২৭৩)।”
রসুলাল্লাহ এবং তাঁর আসহাবদের উল্লেখযোগ্য দান: মানব জাতির দুনিয়াতে শান্তি ও আখেরাতে মুক্তির জন্য আল্লাহ যে বিধান দিয়েছেন রসুলাল্লাহ সেটিই তাঁর নিজের ও আসহাবদের সামগ্রিক জীবনে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন যে, ইসলাম এটা, ইসলামের এই কাজ এভাবে করতে হয়। রসুলাল্লাহ একজন উৎকৃষ্ট দানশীল ছিলেন এ কথাটা অন্যভাবে বললে বলতে হয়, রসুলাল্লাহর মাধ্যমে তাঁর জাতি দানশীলতা দেখতে পেয়েছে এবং এই বিরল গুণটা অর্জন করতে পেরেছে। যিনি নিজের অর্জিত সহায় সম্পত্তি, তাঁর প্রথম স্ত্রী উম্মুল মুমিনিন খাদিজা (রা:) এর সম্পত্তি, নিজের পারিবারিক ঐতিহ্য, ইজ্জত, সম্মান, গুরুত্বপূর্ণ সময়, অক্লান্ত পরিশ্রম, অপরিসীম মেধা, আল্লাহর থেকে দেয়া যুদ্ধলব্ধ সম্পদ, এমনকি যুদ্ধের ময়দানে পবিত্র দেহের রক্ত ঝরানোসহ সকলকিছু দান করে গেছেন মানবতার কল্যাণের জন্য, মুক্তির জন্য, শান্তির জন্য। তাঁর পৃথিবী থেকে চলে যাবার সময়ে নয়টি তরবারিসহ কয়েকটি যুদ্ধের উপকরণ ছাড়া পার্থিব কোনো সম্পদ তিনি রেখে যান নি। দানের ক্ষেত্রে এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। যারা আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ রসুলের সাহাবী হয়েছেন তাদের চরিত্রেও একই ধারা প্রবাহিত হয়েছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। যেমন, রসুলের জীবনের সবচেয়ে বড় অভিযান হয়েছে তাবুক অভিযান। এই অভিযানে রসুলাল্লাহ তাঁর জাতির কাছে আল্লাহর রাস্তায় পূর্ণভাবে জান মাল দিয়ে অংশগ্রহণ করার প্রস্তাব দিলেন। সাহাবীদের সকলেই যথাসাধ্য রসুলাল্লাহর প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছেন কিন্তু আবু বকর (রা:) রসুলাল্লাহর এই প্রস্তাবে সাড়া দিলেন ভিন্ন আঙ্গিকে যা পরবর্তীদের জন্য একটি কালজয়ী উদাহরণ হয়ে থাকলো। তিনি ঘরে ব্যবহার্য পার্থিব যে সম্পদ ছিল (কয়েকটি হাড়ি পাতিল, থালা-বাসন ইত্যাদি) সবগুলো নিয়ে রসুলাল্লাহর দরবারে হাজির হলেন এবং বললেন যে, ঘরে আল্লাহ এবং তাঁর রসুলকে রেখে এসেছেন। যার আর্থিক মূল্যমান ছিল নগণ্য কিন্তু আত্মিক মূল্যমান ছিল বিশাল। এই দানের প্রকৃত মূল্য বুঝতে পেরেছিলেন রসুলাল্লাহ। যে কারণে অন্যান্য সাহাবীরা অনেক বেশি সম্পদ দিলেও দানে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন আবু বকর (রা:)। অথচ আমাদের সমাজে যারা রসুলের উত্তরসূরী (ওরাসাতুল আম্বিয়া) দাবী করেন, তাদের স্থাবর অস্থাবর অন্যান্য সম্পদের হিসাব যাই হউক না কেন শুধু শরীরে জড়িয়ে থাকা জামা কাপড়ের দামই কয়েক হাজার টাকা, তবুও তারা দান গ্রহণ করেন।
দান ব্যবসা-ধর্মব্যসার একটি শাখা: এখন যদি কোনো মানুষকে দানের মহিমা বোঝানো হয় তাহলে প্রথমেই সে চিন্তা করবে কোথায় দান করা যায়। এর জন্য তার সামনে যে বিকল্পগুলি দেখবে সেগুলি হচ্ছে, মসজিদ, এতিমখানা, মাদ্রাসায় ইত্যাদি। বর্তমানে ইসলাম ধর্মের পুরোহিতরা এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে দানের খাত হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। কিন্তু এগুলি আসলে তাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এখানে দান করলে আল্লাহর দরবারে যায় না, যায় ধর্মজীবীদের পেটে। কিন্তু ইসলাম কোনো ব্যবসায়িক পণ্য নয়, কোর’আন হাদীসের কোনো একটা শব্দের বিনিময়েও দুনিয়াবী কোনো স্বার্থ হাসিল করা নিষিদ্ধ, হারাম। যারা এই গর্হিত কাজ করবে তাদের জন্য আল্লাহ কঠিন শাস্তির হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন (সুরা বাকারা- ১৭৪, ১৭৫সহ বহু আয়াত ও হাদিস)। মসজিদ নির্মাণের জন্য এক মুষ্টি বালুর টাকা, একটি ইটের টাকা দিয়ে আখেরাতে জান্নাত লাভের প্রতিশ্রুতি দিতে দেখা যায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে। এই অর্থ যুগ যুগ ধরে তোলা হয়, মসজিদ আর হয় না। একইভাবে এতিমখানা, হেফজখানার নামেও চলে ভিক্ষাবৃত্তি। রমজান মাস বা কোরবানীর ঈদ যেন ধর্মব্যবসায়ীদেরই মৌসুম। ভিক্ষা করা হারাম, এক ভিক্ষুককে রসুলাল্লাহ কম্বল বিক্রি করিয়ে কুঠার কিনে কাঠ কাঠতে পাঠিয়েছেন, এই ঘটনা তারাই বর্ণনা করেও ধর্মজীবীরা দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করেন। আজকের সমাজে যারা হাজারো অপকর্ম করে, সুদের কারবার করে সমাজে প্রভাবশালী হন তারাই এই ধর্মব্যবসায়ীদের পোষক। কিন্তু এদের অপকর্মের ব্যাপারে কিন্তু ধর্মব্যবসায়ীরা নিশ্চুপ বরং পার্থিব সুবিধার (যেমন দাওয়াত খাওয়া) আশায় তাদের জন্য এরা দোয়াও করে। এই সকল ধর্মব্যবসায়ীদের প্রতি কথা যে, আপনারা নিজের হাতকে উপরে স্থাপন করুন, রসুলাল্লাহর আসহাবদের মতো শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করুন। কেননা, একদিন রসুলাল্লাহ বলেন, “উপরের হাত নীচের হাত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ (ইবনে ওমর রা. থেকে বোখারী ও মুসলিম)।”

মুনাফিকরা সালাতে দাঁড়ায় ঢিলেঢালাভাবে

মুনাফিকরা সালাতে দাঁড়ায় ঢিলেঢালাভাবে


মাহবুব আলী:
এই দীনের নেতারা, ওলামা, আল্লামা, ফুকাহা, মোহাদ্দেসিন, মুফাস্সেরিন সবাই একমত যে আকিদা সহীহ অর্থাৎ সঠিক না হলে ঈমানেরও কোন দাম নেই এবং স্বভাবতই ঈমান ভিত্তিক সব আমল অর্থাৎ সালাহ্ (নামাজ), যাকাহ, হজ্ব, সওম (রোজা) এবং অন্যান্য কোন ইবাদতেরই আর দাম নেই, সব অর্থহীন। তাদের এই অভিমতের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু বর্তমানের এই বিকৃত ইসলামে আকিদার অর্থ করা হয় ঈমান। এটা ভুল। আকিদার প্রকৃত অর্থ হলো কোন বিষয় সম্বন্ধে সঠিক ধারণা। কোন জিনিস দিয়ে কী হয়, ওটার উদ্দেশ্য কী, ওটাকে কেন তৈরি করা হয়েছে তা সঠিক ভাবে বোঝা। সালাহ্ সম্বন্ধে সঠিক আকিদা কী? অত্যন্ত সংক্ষেপে সঠিক আকিদা হলো: আল্লাহ তাঁর শেষ রসুলকে পাঠালেন এই দায়িত্ব দিয়ে যে, তিনি যেন আল্লাহর দেয়া হেদায়াহ ও সত্যদীন পৃথিবীর অন্য সব দীনের ওপর প্রতিষ্ঠা করেন, এবং নিজে এই কথার সাক্ষী রইলেন (কোরান- সুরা ফাতাহ ২৮)। এই হেদায়াতই হলো তওহীদ, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, সিরাতুল মুস্তাকীম; এবং সত্যদীন হলো ঐ তওহীদের ওপর ভিত্তি করা জীবন-ব্যবস্থা, শরিয়াহ, দীনুল ইসলাম, দীনুল কাইয়্যেমাহ। এই কাজের অর্থাৎ এই সত্যদীনকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার তরিকা, প্রক্রিয়া অর্থাৎ কোন্ নীতিতে এই কাজ করা হবে তাও আল্লাহ নির্ধারিত কোরে দিলেন এবং সেটা হলো কেতাল, সশস্ত্র সংগ্রাম, যুদ্ধ। প্রশিক্ষণ ছাড়া, চরিত্র গঠন ছাড়া যুদ্ধ কোরে জয়লাভ সম্ভব নয়, থাম-খুঁটি, পিলার ছাড়া ছাদ রাখা সম্ভব নয়, কাজেই সেই চরিত্র গঠন ও প্রশিক্ষণের জন্য নির্ধারিত কোরে দিলেন সালাহ্ এবং এই সালাহ্-কেও ফরদে আইন অবশ্য কর্তব্য, (Must) কোরে দিলেন (সুরা বনি এসরাঈল ৭৮)।
আজ মুসলিম দুনিয়ায় সালাতের সম্বন্ধে আকিদা কী? সালাহ্ চরিত্র গঠনের মুখ্যত দুর্ধর্ষ, অপরাজেয় যোদ্ধার চরিত্র গঠনের প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়া; এই আকিদা বদলে একে অন্যান্য ধর্মের মতো ইবাদতের, উপাসনার শুধু আত্মিক উন্নতির প্রক্রিয়া বলে মনে করার ফলে আজ সেই যোদ্ধার চরিত্র গঠন তো হয়ই না এমন কি সালাতের বাহ্যিক চেহারা পর্যন্ত বদলে গেছে। আল্লাহর রসুলের বহুবারের দেওয়া তাগীদ- সাবধান বাণী- তোমাদের সালাতের লাইন ধনুকের ছিলার মতো সোজা কর, নাহলে আল্লাহ তোমাদের মুখ পেছন দিকে ঘুরিয়ে দেবেন, তাঁর আদেশ- তোমাদের মেরুদণ্ড, ঘাড় সোজা কোরে সালাতে দাঁড়াও এ সমস্ত কিছুই আজ ভুলে যাওয়া হয়েছে। এসব হুকুম না মুসুল্লীদের মনে আছে, না ইমামদের মনে আছে। কাজেই ঐ সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণের সালাহ্ আজ নুব্জ, বাঁকা লাইনের; বাঁকা পিঠের মুসুল্লী ও ইমামদের মরা সালাহ্। আল্লাহ কোর’আনে সুরা নিসার ১৪১-১৪২ নং আয়াতে মুনাফিকদের সালাতের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন- মুনাফিকরা শৈথিল্যের সাথে সালাতে দাঁড়ায়। আল্লাহ শব্দ ব্যবহার করেছেন ‘কুসালা’ যার অর্থ সাহস হারিয়ে ফেলা, অলসতা, ঢিলা-ঢালা ভাবে। বর্তমান বিশ্বের মুসলিম নামের এ জাতির সালাতের দিকে তাকালে কুসালা শব্দের অর্থ বুঝতে কারও কষ্ট হবে না। খুশু, খুজুর নামে এ জাতি ‘কুসালা’ শব্দের যথাযথ প্রয়োগ করছে। সমস্ত বিশ্বে বর্তমানে এই সাহসহীন সালাহ্-ই চলছে। এই মরা প্রাণহীন সালাতের পক্ষে বলা হয়- খুশু-খুজুর সাথে নামাজ পড়া উচিত। এই খুশু-খুজু কী? বর্তমানে বলা হয় সমস্ত কিছু থেকে মন সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন কোরে আল্লাহর প্রতি মন নিবিষ্ট করা হচ্ছে খুশু-খুজু; অর্থাৎ এক কথায় ধ্যান করা।
প্রশ্ন হচ্ছে, সালাতে আল্লাহকে ধ্যান করাই যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তবে আল্লাহ সালাতের প্রক্রিয়া, নিয়ম-কানুন এমন কোরে দিলেন কেন যাতে ধ্যান করা অসম্ভব। খুশু-খুজুু অর্থাৎ ধ্যান করাই আল্লাহর উদ্দেশ্য হলে সালাতের নিয়ম হতো পাহাড়-পর্বতের গুহায়, কিম্বা খানকা বা হুজরায় অথবা অন্ততপক্ষে কোন নির্জন স্থানে ধীর-স্থিরভাবে একাকী বোসে চোখ বন্ধ কোরে মন নিবিষ্ট কোরে আল্লাহর ধ্যান করা। সালাহ্ কি তাই? অবশ্যই নয়, সালাহ্ এর ঠিক উলটো। বহু জনসমাবেশের মধ্যে যেয়ে সেখানে ধনুকের ছিলার মতো সোজা লাইন কোরে দাঁড়িয়ে সৈনিকের, যোদ্ধার মতো ঘাড়, মেরুদণ্ড লোহার রডের মতো সোজা কোরে, ইমামের তকবিরের (আদেশের) অপেক্ষায় সতর্ক, তটস্থ, থাকা তারপর তকবিরের সঙ্গে সঙ্গে সকলে একত্রে রুকু, সাজদায় যাওয়া, ওঠা, সালাম দেয়া অর্থাৎ ইমামের (নেতার) আদেশ পালন করা। সালাতের প্রায় ১১৪ টি নিয়ম-পদ্ধতির প্রতি লক্ষ্য রেখে, সেগুলি যথাযথভাবে পালন কোরে ঐ খুশু-খুজুর সাথে অর্থাৎ ধ্যানের সাথে সালাহ্ সম্পাদন করা যে অসম্ভব তা সাধারণ জ্ঞানেই (Common sense) বোঝা যায়। অথচ ঐ নিয়ম-পদ্ধতি সঠিক ভাবে, যথাযথ ভাবে পালন না কোরে যেমন-তেমন ভাবে সালাহ্ পড়লে তা আল্লাহ গ্রহণ করবেন না। আল্লাহর রসুল বলেছেন- তোমরা পূর্ণভাবে সালাহ্ কায়েম করো, কেননা আল্লাহ পূর্ণ ব্যতীত সালাহ্ কবুল করেন না [আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে]। তিনি আরও বলেছেন- তোমাদের কাহারও সালাহ্ পূর্ণ (সঠিক) হবে না, যে পর্যন্ত না তোমরা আল্লাহ যেভাবে আদেশ করেছেন ঠিক সেইভাবে কায়েম করবে (আবু দাউদ)। আল্লাহ-রসুলের আদেশ মোতাবেক সমস্ত নিয়ম-কানুন যথাযথ পালন কোরে অর্থাৎ পূর্ণ সঠিকভাবে সালাহ্ কায়েম করলে বর্তমানে মুসুল্লীরা খুশু-খুজু বলতে যা বুঝেন তা অসম্ভব। খুশু-খুজুর প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে- মুমিন যখন সালাতে দাঁড়াবে তখন তার মন পৃথিবীর সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাগ্র হবে সালাতে; সে সমস্ত ক্ষণ সচেতন থাকবে যে সে মহামহীম আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে আছে, আল্লাহর বিরাটত্ব ও তার নিজের ক্ষুদ্রতা সম্বন্ধে সে থাকবে সর্বদা সচেতন, আর সেই সঙ্গে একাগ্র হয়ে থাকবে ইমামের (নেতার) তকবিরের (আদেশের) প্রতি, সালাহ্ সঠিকভাবে, নিখুঁতভাবে সম্পাদন করতে। এই হলো খুশু-খুজু।

সালাহ এসলামের কঙ্কাল

সালাহ এসলামের কঙ্কাল

(এসলামের প্রকৃত সালাহ বই থেকে)
লিখেছেন -এ যামানার এমাম এমামুয্যামান (The leader of
the time) জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী।
আল্লাহর রসূল বিভিন্ন সময়ে তাঁর আসহাবদেরকে এসলামের
প্রকৃত আকীদা বোঝাতে বিভিন্ন ধরণের উপমা বা উদাহরণ
ব্যবহার কোরেছেন৷ যেমন একটি ঘরের সাথে এসলামের
তুলনা কোরে তিনি জেহাদ ও সালাতের সম্পর্ক আসহাবদের
সামনে তুলে ধোরেছেন৷ তিনি বোলেছেন- এসলাম একটি ঘর,
সালাহ তার খুঁটি এবং জেহাদ হোল ছাদ [হাদীস- মুয়ায (রা:)
থেকে আহমদ, তিরমিযি, এবনে মাজাহ, মেশকাত]৷ এই
উপমাতে রসুলাল্লাহ সালাহ ও জেহাদের সম্পর্ক, এদের
উভয়ের প্রয়োজনীয়তা, এমনকি কোনটির প্রাধান্য
বেশী (Priority) তা নিখুঁতভাবে তুলে ধোরেছেন৷ ছাদবিহীন
একটি ঘরের কোনই মূল্য নেই, এমন কি সেই ঘর
যদি দামী আসবাবপত্র ও গৃহস্থালী সামগ্রী দিয়ে সুসজ্জিত
থাকে তবুও তা মূল্যহীন৷ এর
খুঁটিগুলো যদি হীরা দিয়ে তৈরী থাকে তবুও ঘরের উদ্দেশ্য পূরণ
হয় না; এ ঘরে কেউ বাস কোরতে পারবে না৷
বর্ত্তমানে মোসলেম নামক এই জাতিটি এসলামের
ভিত্তি আল্লাহর সার্বভৌমত্বের (তওহীদ) বদলে দাজ্জালের
সার্বভৌমত্বকে সার্বিক জীবনে স্বীকার কোরে নিয়েছে আর
ছাদ অর্থাত্ জেহাদ (আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার
সংগ্রাম) তাদের কাছে কেবল অপ্রয়োজনীয়ই নয়-অসহ্য৷
এখন তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবাদত হোচ্ছে সালাহ
বা নামাজ৷ জান্নাতের প্রকৃত চাবি আল্লাহর
সার্বভৌমত্বকে (হাদীস- মু'আজ এবনে জাবাল থেকে আহমদ)
ত্যাগ কোরে এই জাতি নামাজকে জান্নাতের
চাবী বানিয়ে নিয়ে সারা দুনিয়ায় লক্ষ লক্ষ সুদৃশ্য
মসজিদে কেবল শূণ্যের উপরই খুঁটি গেঁড়ে যাচ্ছেন৷ শুধু তাই নয়,
এ খুঁটিগুলির উদ্দেশ্য কি তাও তারা জানেন না৷ ছাদ নির্মাণ
না কোরে কেবল খুঁটি গাঁড়া যে কতটা নির্বুদ্ধিতার কাজ
তা বোঝার জ্ঞানটুকুও আল্লাহর লা'নতের ফলে এ জাতির
মধ্যে অবশিষ্ট নেই৷ ফলে এই সালাহ মোসলেম জাতির কোন
কাজেই আসছে না; এ সালাহ তাদেরকে সকল জাতির লাথি ও
ঘৃণা থেকে রক্ষা কোরতে পারছে না৷ ভিত্তি ও ছাদহীন
খুঁটি সর্বস্ব এ ঘর (যদিও এমন ঘর অসম্ভব) তাদেরকে কোনই
নিরাপত্তা দিতে পারছে না৷ এসলামের আকীদা বোঝাবার
চেষ্টায় আমি আরও একটি উপমা পেশ কোরছি৷
বই টি থেকে লেখা গুল তুলে ধরেছেন ,
বুলবুল আহাম্মেদ
আরো জানতে চাইলে যোগাযোগ করুন
০১৭১১০০৫০২৫, ০১৯৩৩৭৬৭৭২৫ , ০১৬৭০১৭৪৬৪৩ , ০১৫৫৯৩৫৮৬৪৭,

ধর্মগ্রন্থ ও শাস্ত্রের বিধানই মানুষকে শান্তি দিয়েছে


ধর্মগ্রন্থ ও শাস্ত্রের বিধানই মানুষকে শান্তি দিয়েছে


মোহাম্মদ আসাদ আলী:


বর্তমানে ইসলাম সম্বন্ধে দু’টি ভুল ধারণা প্রচলিত। একটি হলো মুসলিম বলে পরিচিত জাতিটি যে ধর্মে বিশ্বাস করে এটিকে বলা হয় ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্মকে অন্য বিভিন্ন নাম দেয়া হয়েছে। কিন্তু আসলে আল্লাহ আদম (আ:) থেকে শুরু করে শেষ নবী (সা.) পর্যন্ত যতবার যতভাবে জীবন-বিধান পাঠিয়েছেন সবগুলোরই ঐ একই নাম ইসলাম, শান্তি অর্থাৎ যে জীবন-বিধান অনুসরণ করে চললে মানুষ শান্তিতে সুখে বাস করতে পারবে আর অস্বীকার করলে তার অবধারিত পরিণতি অশান্তি, রক্তারক্তি, অবিচার। রাজনৈতিক আর্থ-সামাজিক অবিচার- যা মালায়েকরা বলেছিলেন।
দ্বিতীয়টি হলো এই ধারণা (আকীদা) যে, আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণের নাম ইসলাম। এটাও ভুল। কারণ আল্লাহ ইচ্ছা করলে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করবে। কোন অবিশ্বাসী, কোন সন্দেহকারী, কোন মুশরিক বা মোনাফেক থাকবে না (সুরা আল আনা’ম ৩৫, সুরা ইউনুস ১০০)। কাজেই তা নয়। আল্লাহ মানুষের মধ্যে তার নিজের আত্মা ফুঁকে দিয়েছেন অর্থ মানুষের মধ্যে যুক্তির শক্তি, বুদ্ধি, জ্ঞান ও সর্বোপরি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন, দিয়ে নবী পাঠিয়ে তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন, যে পথে চললে সে নিজেদের মধ্যে মারামারি, রক্তারক্তি না করে শান্তিতে থাকে। এরপর তিনি দেখবেন কে বা কারা তাঁর দেখানো পথে চলবে আর কে বা কারা তা চলবে না।
কাজেই আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণের নাম ইসলাম নয়। তাঁর দেয়া জীবন-ব্যবস্থাকে গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠা করার ফল হিসাবে যে শান্তি সেই শান্তির নাম ইসলাম। মানুষ যদি যেসব নিয়ম, আইনের মধ্যে এই জগত সৃষ্টি করা হয়েছে ও চলছে তা সব জানতো তবে হয়তো মানুষই নিজেদের জন্য এমন জীবন-ব্যবস্থা, ধর্ম তৈরি করে নিতে পারতো যা মেনে চললেও ঐ শান্তি ইসলাম আসতে পারতো। কিন্তু মানুষ তা জানে না- তাকে আল্লাহ অতখানি জ্ঞান দেন নি। তাই স্রষ্টা তাকে বলে দিয়েছেন কোন পথে চললে, কেমন জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করলে ঐ অভীষ্ট শান্তি, ইসলাম আসবে। বলে দিয়েছেন তাঁর নবীদের মাধ্যমে। মনু (আ:), কৃষ্ণ (আ:), যুধিষ্ঠির (আ:), ইব্রাহীম (আ:), মুসা (আ:), ঈসা (আ:) এবং আরও অনেক অনেক নবী-রসুলদের মাধ্যমে এবং সর্বশেষে মোহাম্মদের (সা.) মাধ্যমে। [মনু (নুহ্ আঃ) কৃষ্ণ (আ:), যুধিষ্ঠির (ইদরীস আঃ) এরা যে নবী ছিলেন তা আমার গবেষণার ফল, ব্যক্তিগত অভিমত। এ অভিমত আমি অন্য কাউকে গ্রহণ করতে জোর করছি না]। কোন প্রাণী হত্যা করবো না, কেউ আমার কোট চুরি করলে তাকে জোব্বাটাও দিয়ে দিবো, এ অর্থে এ ইসলাম নয়। যে ধর্ম ঐ শিক্ষা প্রচার করে তারা সংখ্যায় পৃথিবীতে অন্য সব ধর্মের চেয়ে বেশি কিন্তু সমস্ত পৃথিবী আজ ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি অশান্তি আর রক্তারক্তিতে লিপ্ত। শুধু তাই নয় ঐ মতে বিশ্বাসীরা এই শতাব্দীতেই দু’বার নিজেদের মধ্যে মহাযুদ্ধ বাঁধিয়ে প্রায় পনের কোটি মানুষ হত্যা করেছে, হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর দু’টি কয়েক লক্ষ মানুষসহ ধ্বংস করেছে এবং আজ পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে সম্পূর্ণ মানব জাতিটাকেই ধ্বংস করার মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে।
মানুষকে নিজেদের মধ্যে অশান্তি, অবিচার, মারামারি না করে শান্তিতে, ইসলামে থাকার জন্য জীবন বিধান দিয়ে আল্লাহ যুগে যুগে পৃথিবীর প্রতি স্থানে, প্রতি জনপদে, প্রতি জাতিতে তার প্রেরিতদের, নবীদের পাঠিয়েছেন (সুরা আন নহল ৩৬)। মানুষ জাতির কিছু অংশ তা গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠা করেছে, কিছু অংশ করে নি। যারা গ্রহণ করেছে তাদের সমাজের রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি জীবনের সমস্ত কিছুই ঐ ব্যবস্থার নির্দেশে পরিচালিত হয়েছে। তাদের সমাজের আইনের উৎস শুধু ঐ জীবন-বিধান বা ধর্মই ছিলো না ঐ বিধানই আইন ছিলো, ওর বাহিরের কোন আইন সমাজ গ্রহণ করতো না। অনেক কারণে আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধান বদলিয়ে ফেলে বা ইচ্ছামতো তার ভুল ব্যাখ্যা করে তা চালানো হয়েছে। কিন্তু ঐ ভুল ও অন্যায় আইনকেও সেই ধর্ম বা দীনের আইন বলেই চালানো হয়েছে। তার বাহিরের, মানুষের তৈরি বলে চালানো যায় নি। পৃথিবীর ইতিহাসকে না তলিয়ে, শুধু এক নজরে যারা পড়েছেন তারাও এ কথা অস্বীকার করতে পারবেন না যে মানব সমাজ চিরদিন শাসিত হয়ে এসেছে ধর্মের আইন দিয়ে। যখন যেখানে যে নবী ধর্ম বা জীবন-বিধান প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেখানে রাজা বা শাসনকর্তা শাসন করেছেন সেই আইন দিয়ে- অন্য কোন কিছু দিয়ে নয়। আইনের নির্দেশ, উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন সমাজের বিজ্ঞেরা, পুরোহিতরা, আর তাকে প্রয়োগ করেছেন রাজারা, শাসকরা। ওর বাইরের কোন আইন, আদেশ চালাবার চেষ্টা করলে সমাজ তা গ্রহণ করতো না, প্রয়োজনে বিদ্রোহ করতো। উদাহরণ হিসাবে পশ্চিম এশিয়া নিন। ইহুদিদের আগে ওখানে আমন বা রা দেবতা থেকে শুরু করে অনেক রকম দেব-দেবীর ধর্মের আইন চলতো। ওগুলোও পূর্বতন কোন নবীর আনা দীনের বিকৃতির ফল ছিলো। ইব্রাহীম (আ:) আবার আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, তওহীদ প্রতিষ্ঠা করার পর ইহুদিরা যতদিন মধ্য এশিয়ায় ছিলো ততদিন ঐ আল্লাহ প্রেরিত দীনই ছিল তাদের জাতির আইন। ভারতের কথা ধরুন। রামায়ন, মহাভারতসহ ইতিহাস পড়ুন। দেখবেন রাজারা শাসন করেছেন শাস্ত্রানুযায়ী- অর্থাৎ ওটাই ছিলো শাসনতন্ত্র (Constitution)। ঐশ্বরিক বইয়ের (Scripture) উপর ভিত্তি করে শাস্ত্র, সেই শাস্ত্রের বিধান দিতেন ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা এবং বিধান বা আইন জনগণের উপর প্রয়োগ ও তার রক্ষার দায়িত্ব ছিলো ক্ষত্রিয় রাজাদের উপর। এই শাস্ত্রীয় বিধানের বিরুদ্ধে কোন আদেশ, নির্দেশ দেয়া রাজা বা শাসকের সাধ্য ছিলো না। ইউরোপের অবস্থাও তাই ছিলো। পোপের নির্দেশে রাজ্য শাসন করতেন রাজারা। কোন রাজা পোপের নির্দেশ অমান্য করতে পারতেন না- করলে তার দুরবস্থার সীমা থাকতো না। মোট কথা পৃথিবীর কোথাও আইনের উৎস ধর্ম ছাড়া আর কোন কিছুকে গ্রহণ করা হয় নি।
এ পর্যন্ত যা বলে এলাম, তা সমস্তটা একত্র করলে আমরা একটা পরিষ্কার ছবি পাই। সেটা হলো- গোটা পৃথিবীটাকে পটভূমি হিসাবে নিয়ে মানুষ সৃষ্টির সময় থেকে যদি আরম্ভ করি তবে দেখতে পাই যে প্রথম মানব আদম (আ:) আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধান, দীন ইসলাম অনুযায়ী চলতে লাগলেন তার সন্তান-সন্তুতি নিয়ে এবং ফলে শান্তিতে বাস করতে থাকলেন। ইবলিস তার প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী চেষ্টা চালাতে লাগলো সেই জীবন ব্যবস্থা থেকে মানুষকে বিচ্যুত করতে। মানুষেরই ভেতরে বসে তাকে প্ররোচনা দিয়ে আইন ভঙ্গ করাতে। কাবলকে দিয়ে তার ভাই হাবলকে হত্যা করালো। তারপর আরো আইন ভাঙ্গার ফলে যখন ওটা যথেষ্ট বিকৃত হয়ে গেলো তখন আল্লাহ পাঠালেন দ্বিতীয় রসুল। তার ডাকে সাড়া দিয়ে অনেকে নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করলো অনেকে রয়ে গেলো সেই পুরোনো ব্যবস্থায়- যেটা ছিলো আদমের (আ:) উপর দেয়া। সৃষ্টি হলো দু’টো দীন, দু’টো ধর্ম, দু’টো জীবনব্যবস্থা। এদিকে মানুষের বংশ বৃদ্ধি চলছেই। আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়লো আদম সন্তানরা পৃথিবীর চারিদিকে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যেখানেই তারা বসতি স্থাপন করলো সেখানেই আসতে লাগলেন প্রেরিত নবীরা আল্লাহর দেয়া দীনুল কাইয়্যেমা, সনাতন ধর্ম নিয়ে। উদ্দেশ্য সেই একই- মানুষ যেন নিজেদের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি না করে, রক্তপাত না করে শান্তি ও সুখে বাস করতে পারে। একই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নবী উপস্থিত ছিলেন। কেউ হয়তো চীনের এক প্রান্তে, কেউ দক্ষিণ আমেরিকায়, কেউ ইউরোপে, কেউ মধ্য এশিয়ায়, কেউ ভারতের কোন কোণে। আল্লাহ তাঁর দায়িত্ব এক মুহূর্তের জন্য ভুলে যান নি। যুগ বয়ে চলেছে, নবীরা মানুষের জন্য জীবন-ধর্ম দিয়ে চলে যাচ্ছেন, শয়তান মানুষকে প্ররোচনা দিয়ে সেগুলো বিকৃত, অকেজো করে ফেলছে। তারা আবার আসছেন আবার নতুন করে জীবন পথ দিচ্ছেন, নতুন ধর্ম সৃষ্টি হয়ে চলেছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই অতীতে হারিয়ে গেছেন। তারাও হারিয়ে গেছেন, তাদের মাধ্যমে প্রেরিত জীবনব্যবস্থা গুলিও হারিয়ে গেছে। আমরা পেছন দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই তাদের আনা ইসলামকেও দেখতে পাই। পাই, কিন্তু অত্যন্ত অস্পষ্টভাবে এবং মানুষের হস্তক্ষেপের ফলে বিকৃতভাবে।
এই হলো মানুষের প্রকৃত অতীত। ইতিহাসকে বহুলোক বহুভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু সত্য গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যান, ন্যায় ও অন্যায়ের অবিরাম দ্বন্দ্ব, সমষ্টি ও ব্যক্তিগতভাবে মানুষের আত্মাকে একদিকে ইবলিস অন্যদিকে আল্লাহর আত্মা, রুহাল্লাহর টানাটানি- এই হলো আদম (আ:) থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত মানুষের সত্যিকার অতীত। এবং এ শুধু অতীত নয় ভবিষ্যতও নিঃসন্দেহে এই-ই। এর কোন বিরতি, কোন চ্যুতি হয় নি, হচ্ছে না, হবে না।

সমাজের প্রতি কর্তব্য পালনই মানুষের রক্ষাকবচ

সমাজের প্রতি কর্তব্য পালনই মানুষের রক্ষাকবচ


হাসিবুর রহমান শাওন

হে সমাজ, আমি জন্ম হতে তোমারই প্রদত্ত সকল সুবিধা ভোগ করে আসছি এবং মৃত্যু পর্যন্ত তোমারই প্রদত্ত সকল সুবিধা ভোগ করবো। আমি এই সমাজের শিক্ষালয়ে শিক্ষিত হয়েছি, এই সমাজের রাস্তাতেই যাতায়াত করছি, এই সমাজের মাধ্যমেই আমি আমার জীবিকা নির্বাহ করছি।
কিন্তু আমি এতটাই স্বার্থপর যে, তোমার কল্যাণ সাধনে এক মুহূর্ত সময় দিতে আমি প্রস্তুত নই। তোমার মঙ্গল সাধনের জন্য আমার যে, কিছু করণীয় আছে এমন চিন্তা ঘুণাক্ষরেও আমার মাথায় আসে না। আমি শুধু আমার ব্যক্তি জীবনের লাভ ক্ষতির হিসেব নিয়েই ব্যস্ত। আমার প্রতিটি কাজের পেছনে স্বার্থই একমাত্র চালিকা শক্তি। আমি সমাজের ক্ষুদ্রতম একক। আমার আর তোমার মধ্যে যদি বন্ধন না থাকে তাহলে কেবল স্বার্থের উপর ভিত্তি করে আমি আর তুমি একক ভাবে কেউই বেশী দিন টিকে থাকতে পারবো না। তাই আমি সামাজিক জীব। আজ আমার পাশের ফ্লাটে কে থাকে তার নামটিও বলতে পারি না। অথচ সে আমার প্রতিবেশী।
আমি যে তোমার সমাজে বাস করে নিজেকে মানুষ মনে করে গর্ববোধ করছি, আমি কি আদৌ মানুষ? আমার এই সমাজটা কি আদৌ মানুষের সমাজ? আমি তোমার জন্য ভালো কিছু তো করছিই না উল্টো তোমার ক্ষতি সাধন করে নিজে লাভবান হতে চাইছি, আজ আমি তোমার সম্পদ লুট করে ধনী ব্যক্তি হতে চাইছি, তোমার সম্পদে আগুন দিয়ে ক্ষমতায় যেতে চাইছি, নিজের সুখের জন্য তোমাকে বিক্রি করে দিচ্ছি। আমি আজ টাকার নেশায় খাদ্যে বিষ মেশাচ্ছি, ঔষধে ভেজাল দিচ্ছি, ডাক্তার হয়ে রোগীর সঙ্গে প্রতারণা করছি, পুলিশ হয়ে সাধারণ নিরাপরাদ মানুষের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করছি, কেউ দুর্ঘটনার শিকার হলে আমি তাকে বাঁচানোর পরিবর্তে তার পকেট থেকে মানিব্যাগ আর মোবাইল চুরি করছি। আমি কি মানুষ? এই সমাজ কি আমার পালক? তাহলে কি ভাবে এই সমাজের বুকে বাস করে করছি অন্যায়, অবিচার, হত্যা, গুম, শোষণ, বঞ্চনা, দমন-পীড়ন, প্রতারণা ইত্যাদি। করছি ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ভয়াবহ সব অপরাধ। আমরা যদি এসবের গভীরে তাকাই এবং নির্মোহ চিন্তা করি, দেখতে পাবো এই সকল অন্যায়-অপরাধের মূল কারণ হচ্ছে মানুষের ধর্মহীনতা।
আজ মানুষ নামের এই জীব তার ধর্ম হারিয়ে ফেলেছে। হারিয়ে ফেলেছে তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য, সে জানে না তার ধর্ম কি। আগুনের ধর্ম যেমন পোড়ানো। আগুন পোড়ানোর ক্ষমতা হারালে সে তার ধর্ম হারালো। তাহলে মানুষের প্রকৃত ধর্ম আসলে কি? মানুষের ধর্ম হচ্ছে মানবতা। আজ সেই মানবতা হারিয়ে গেছে। প্রচলিত ধারণা হচ্ছে যে ব্যক্তি নির্দিষ্ট লেবাস ধারণ করে সূরা-কালাম, শাস্ত্র মুখস্থ বলতে পারে, নামাজ- রোজা, প্রার্থনা করে সেই ধার্মিক। সেই ব্যক্তি ইসলামে আছে। আসলে নির্দিষ্ট কোন লেবাস ইসলাম নয় বরং শান্তি পূর্ণ সমাজ গঠনই ইসলাম। আজ যখন সমাজ নামক দেহ থেকে প্রাণ-প্রদীপ নির্বাপিত, সমাজের প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, তখন ধর্মের সুধা বলে মানুষকে বিষ খাওয়াতে উদ্যত হয়েছে ধর্মব্যবসায়ী এক শ্রেণির প্রতারক। যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথা বলছে, নিজেদেরকে ইসলামের পক্ষশক্তি বলে পরিচয় দিচ্ছে তারাই সমাজে আতঙ্কে সৃষ্টি করছে। ফল হচ্ছে এই যে, মানুষ ইসলামকে ভুল বুঝছে। যে ইসলামকে সাদরে গ্রহণ করে মুক্তির দিশা পেতে পারতো, সেই ইসলাম সম্পর্কে দিন দিন তারা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছে।
এর জন্য দায়ী কারা? নিশ্চয়ই যারা ধর্মের পক্ষশক্তি সেজে আছে তারাই। ধর্ম নিরপেক্ষতার বিষক্রিয়ায় আমাদের এই রোগাক্রান্ত সমাজের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ যত অকেজো হয়ে পড়েছে, তার জালা-যন্ত্রণা যত বাড়ছে, ততই তার গলদেশে নতুন নতুন বিষ ঢালা হচ্ছে। বিষ ঢালছে ধর্মনিরপেক্ষবাদী ও ধর্মবাদী উভয় পক্ষই। কিন্তু পার্থক্য হলো- ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা বিষ ঢালছে বিষের বোতল থেকে আর ধর্মবাদীরা বিষ ঢালছে ঔষধের বোতল থেকে। মানুষ ঔষধ মনে করে বিষ খাচ্ছে, প্রতারিত হচ্ছে, জীবন হারাচ্ছে ফলে কেউ সত্যিকার ঔষধ নিয়ে এলেও মানুষ তা খেতে অস্বীকার করছে। এর পরিণতি দাঁড়াচ্ছে আরও ভয়াবহ। অকৃতজ্ঞ সন্তান যেমন মায়ের প্রতি অনাচার, অবিচারে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হয় না, আজকের মানুষগুলোর ঠিক সেই অবস্থা।
সে তার সুখের জন্য, এতটুকু স্বাচ্ছন্দের জন্য, একে অপরের উপর প্রভাব বিস্তারের জন্য এমন সব কর্মকা- করে যাচ্ছে যা এই মাতাসমতুল্য সমাজকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের সমাজ আজ এক রুগ্ন বৃদ্ধার ন্যায় তার মৃত্যুর প্রহর গুণছে। আমরা মুষ্টিমেয় কিছু আত্মাহীন মানুষের অন্ধ অনুকরণ করে আমাদের শেষ রক্ষা করতে পারবো না। সুতরাং এই সমাজকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা আমাদের করতে হবে। কিছু মানুষের এই অসীম স্বেচ্ছাচারিতাকে রুখে দেয়ার জন্য আমাদের সমাজের প্রতিটি মানুষকে ন্যায়ের পক্ষে, সত্যের পক্ষে, মানবতার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
আজ সমাজের মানুষের চারিত্রিক অবনতি ও অবক্ষয় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পুলিশ পাহারা দিয়েও সমাজের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। উপরন্তু আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধেই ভয়াবহ রকমের সব অপরাধের অভিযোগ উঠছে একের পর এক। আমাদের বুঝতে হবে মানুষ শুধু দেহসর্বস্ব প্রাণী নয়, তার একটা আত্মাও আছে। তাই মানুষকে যদি আত্মিক শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করা হয়, তাদেরকে যদি নৈতিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, তবেই সে নিজে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে অপরাধ সংগঠন থেকে বিরত থাকবে। আজ সমাজের প্রতিটি মানুষকে ধর্মের সেই প্রকৃত শিক্ষা দিতে হবে। তবেই সে সমাজে মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে।
লেখক:
হাসিবুর রহমান শাওন,
আমীর, হেযবুত তওহীদ, সাভার, ঢাকা

Thursday, March 24, 2016

কিভাবে যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতেন সাংবাদিকেরা?

কিভাবে যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতেন সাংবাদিকেরা?



আর দু’দিন পরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে।
১৯৭১ সালে নয় মাস বাংলাদেশে যুদ্ধের ভয়াবহতা আড়ালে রাখতে, তৎকালীন পাকিস্তানি সরকার সব ধরনের চেষ্টাই করেছিল।
যার মধ্যে অন্যতম ছিল সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেয়া।
যুদ্ধের নয় মাসে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন অনেক সাংবাদিকও।
তা স্বত্ত্বেও যুদ্ধের খবরাখবর প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
১৯৭১ এর সেই অবরুদ্ধ সময়ে সাংবাদিকেরা কিভাবে যুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ করতেন?
৭ই মার্চের ভাষণের পরই বোঝা যাচ্ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি কোন দিকে এগুচ্ছে।
অনেক বিদেশী সাংবাদিক খবরাখবর সংগ্রহের জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসতে থাকেন।
২৫শে মার্চ ঘুমন্ত ঢাকাবাসীর উপর গণহত্যা চালায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী।
এই খবর যাতে দেশের বাইরে প্রচারিত না হয় সেজন্য বন্দুকের মুখে সকল বিদেশী সাংবাদিককে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল আটকে রাখা হয় এবং ধরে করাচি পাঠিয়ে দেয়া হয়।
ব্রিটেনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার ২৬ বছর বয়সী সাইমন ড্রিং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর চোখ এড়িয়ে থেকে যেতে সক্ষম হন।
পরে তিনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে ব্যাংককে গিয়ে যে প্রতিবেদন পাঠান সেটি ১৯৭১ সালের ৩০শে মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ছাপা হয়।
বাংলাদেশ জেনোসাইড এন্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস বইতে অনূদিত সে রিপোর্টের কয়েকটি লাইন তুলে ধরা হলো...
“আমি নিরাপত্তা রক্ষীদের তল্লাশী ফাঁকি দিয়ে মুহুর্তের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানগামী বিমানে উঠতে সমর্থ হই। তারপরও আমাকে দু’দুবার আটক করা হয় এবং ব্যাগেজসহ আমাকে তন্নতন্ন করে তল্লাশীর মুখে পড়তে হয়। তবুও আমার এ প্রতিবেদন তৈরীর নোট ব্যাংকক পর্যন্ত অক্ষত ছিল"।
"ঢাকা এখন ধ্বংস এবং ভীতির নগরী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঠান্ডা মাথায় ২৪ ঘন্টাব্যাপী অবিরাম শের বর্ষনে সেখানে সাত হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়েছে। ছাত্রাবাসে নিজেদের বিছানাতেই ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে।বাজারগুলোতে কসাইদেরকে নিজেদের দোকানের পিছনে হত্যা করা হয়েছে"।



২৫ এবং ২৬শে মার্চে ঢাকায় বেশ কয়েকটি পত্রিকা আক্রান্ত হবার পর অনেক সাংবাদিক আত্নগোপনে ছিলেন।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি বড় পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। অন্যরা তখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।
হত্যাযজ্ঞের খবর ছাপানোর কোন উপায় নেই।
তিনমাস বন্ধ থাকার পর স্বল্প পরিসরে বেরিয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাক।
পত্রিকার তৎকালীন প্রতিবেদক সৈয়দ শাহজাহান জানালেন তখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রন এতাটাই জোড়ালো ছিল যে যুদ্ধের খবর ছাপানোর কোন উপায় নেই।
সদ্য স্বাধীনতা ঘোষণাকারী অবরুদ্ধ বাংলাদেশের খবরাখবর তখনও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছিল।
২৫শে মার্চের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে জোরপূর্বক সব বিদেশী সাংবাদিকদের বের করে দেয়া হলেও এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিনিধি ড্যান কগিনস ভারত সীমান্ত পার হয়ে কুষ্টিয়ায় পৌঁছান।
২৬শে মার্চ সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা কিভাবে প্রতিরোধ যু্দ্ধ শুরু করে তার বর্ণনা দিয়েছেন মি: কগিনস। ১৯শে এপ্রিল টাইম সাময়িকীতে সেটি প্রকাশিত হয় ...
“সান্ধ্য আইনের পুরো ৪৮ ঘন্টাই কুষ্টিয়া শহরটি নীরব ছিল।কারফিউয়ের সময় রাস্তায় বের হবার অপরাধে পাক সৈন্যদের গুলিতে নিহত হয় সাতজন। এদের অধিকাংশই কৃষক।ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতো না তারা। ২৮শে মার্চ সকালে কারফিউ তুলে নেয়া হয়। সাথে সাথেই প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সংঘবদ্ধ হতে থাকে এলাকাবাসী"।



এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বিবিসি’র মার্ক টালি বাংলাদেশে এসেছিলেন।
তিনি তখন দু’সপ্তাহ এখানে ছিলেন।
সেই প্রথম এবং শেষ বারের মতো পাকিস্তানী সরকার দু’জন সাংবাদিককে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দিয়েছিল।
মার্ক টালি বলছিলেন ১৯৭১ সালের সেই সফরে তিনি ঢাকা থেকে সড়ক পথে রাজশাহী গিয়েছিলেন।
“পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যখন সীমান্ত এলাকা পর্যন্ত পৌঁছালো এবং তারা মনে করলো যে পরিস্থিতির উপর তাদের নিয়ন্ত্রন আছে, তখনই তারা আমাদের আসার অনুমতি দিয়েছিল। আমার সাথে তখন ছিলেন ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ পত্রিকার যুদ্ধ বিষয়ক সংবাদদাতা ক্লেয়ার হলিংওয়ার্থ। আমরা যেহেতু স্বাধীনভাবে ঘুরে বেরিয়ে পরিস্থিতি দেখার সুযোগ পেয়েছি সেজন্য আমাদের সংবাদের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ হয়েছে। আমি ঢাকা থেকে রাজশাহী যাবার পথে সড়কের দু’পাশে দেখেছিলাম যে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে"।
মার্ক টালির আগে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানী সরকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সে দেশের আটজন সাংবাদিককে পূর্ব বাংলায় নিয়ে আসে।
উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব বাংলায় যে তাদের ভাষায় সব কিছুই স্বাভাবিক সেটি তুলে ধরা।
এদের মধ্যে সাতজন সাংবাদিক পাকিস্তানী সরকারের চাহিদা অনুযায়ী রিপোর্ট করেন।



কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম ঘটে করাচির মর্নিং নিউজের সাংবাদিক এবং ব্রিটেনের সানডে টাইমস পত্রিকার পাকিস্তান সংবাদদাতা এন্থনি মাসকারেনহাস-এর ক্ষেত্রে।
তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে পাকিস্তান ছেড়ে ১৮ই মে লন্ডনে সানডে টাইমসের দপ্তরে হাজির হয়ে জানান যে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি একটি প্রতিবেদন লিখতে চান।
কিন্তু এ প্রতিবেদন লিখলে তার পক্ষে পাকিস্তানে থাকা সম্ভব হবেনা বলে তিনি আশংকা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে তার স্ত্রী এবং সন্তানদের বের করে না আনা পর্যন্ত এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা যাবেনা।
সেই প্রতিবেদনে মি: মাসকারেনহাস উল্লেখ করেন "পূর্ব বাংলার শ্যামল প্রান্তর জুড়ে আমি আমার প্রথম চাহনিতেই জমাট রক্তপুঞ্জের দাগ দেখতে পেয়েছিলাম। এই সংঘবদ্ধ নীপিড়নের শিকার কেবলমাত্র হিন্দুরাই নয়। বরং হাজার হাজার বাঙালী মুসলমানও এ নির্মমতার শিকার”।
১৯৭১ সালের এপ্রিল-মে মাসের পর যুদ্ধক্ষেত্র আর কোন সরেজমিন প্রতিবেদন হয়নি।
এরপর মূলত কূটনৈতিক তৎপরতা, শরণার্থী ক্যাম্পের অবস্থা, বিশ্লেষণ এবং সম্পাদকীয়ই ছিল মুখ্য।
যুদ্ধ চলাকালীন কলকাতা থেকে বেশ কয়েকটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতো যাতে বাংলাদেশের যুদ্ধের খবরা-খবরই ছিল মুখ্য।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক এবং সাংবাদিক আফসান চৌধুরী বলছেন সাংবাদিকতার স্বাভাবিক নিয়মে যেভাবে খবর যাচাই-বাছাই করতে হয়, তখন সে পরিস্থিতি ছিলনা।
তিনি বলেন ১৯৭১ সালে গণমাধ্যম দৃশ্যত দুটো ভাগে ভাগ হয়েছিল।
একটি অংশ পাকিস্তানের পক্ষে। অন্যটি পাকিস্তানের বিপক্ষে অর্থাৎ নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে।
যুদ্ধের সময় তখন বিবিসি নিয়মিত অবরুদ্ধ বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে খবর এবং বিশ্লেষণ দিয়েছে।



সে সময়ে বাংলাদেশের মানুষের কাছে বিবিসি’র মার্ক টালির নাম লোকমুখে।
যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কিভাবে খবর সংগ্রহ করতেন?
মার্ক টালি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন “যুদ্ধকালীন অধিকাংশ সময় আমি লন্ডনেই অবস্থান করেছি। তখন সেখানে বসে যুদ্ধের নানাদিক নিয়ে বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য লিখেছি এবং প্রচার করেছি। যেসব খবরাখববের উপর ভিত্তি করে এসব লিখতাম তার বেশিরভাগই আসতো কলকাতা থেকে"।
"যখন শরণার্থী সংকট শুরু হলো তখন তাদের কাছ থেকে নানা ধরনের খবরাখবর পাওয়া যেত। নিজামউদ্দিন নামের আমাদের বেশ ভালো একজন সংবাদদাতা ছিলেন। তিনি দেশের ভেতরেই অবস্থান করছিলেন। তিনিও খবরা-খবর পাঠাতেন। যুদ্ধের শেষের দিকে তাকে হত্যা করা হয়"।
"এছাড়া আমাকে অনেক সহায়তা করেছিল লন্ডনে অবস্থিত বিবিসি বাংলা বিভাগের সহকর্মীরা। তাদের অনেকেরই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব দেশে থাকতো। তাদের সাথে বাংলা বিভাগের সহকর্মীরা যোগাযোগের চেষ্টা করতেন বিভিন্ন উপায়ে। সেসব তথ্য আমার কাজে লাগতো"।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী বলছেন যুদ্ধের সময় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের গণমাধ্যমে কিংবা অবরুদ্ধ ঢাকায় সংবাদপত্র পাঠ করে, রেডিও শুনে কিংবা টিভি দেখে পরিস্থিতি আঁচ করার কোন উপায় ছিলনা।
কারণ ছিল পাকিস্তানী সরকারের কঠোর বিধি-নিষেধ। কিন্তু তাতে সাধারন মানুষের জণ্য খবর থেমে থাকেনি বলে উল্লেখ করেন আফসান চৌধুরী।
সাংবাদিক এবং গবেষকরা বলছেন যুদ্ধ শুরু হবার কিছু দিনের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে ধীরে-ধীরে যে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে উঠেছিল তার কারণ হচ্ছে বিদেশী পত্র-পত্রিকার খবর।
পাকিস্তানী শাসকরা নৃশংসতা এবং যুদ্ধের খবর চেপে রাখার জোর চেষ্টা করলেও সেটি সফল হয়নি। বিভিন্ন ফাঁক গলে খবর ঠিকই বেরিয়েছে।

বুলবুল আহাম্মেদ

ইলাহ অর্থ: যাঁর হুকুম মানতে হবে

ইলাহ অর্থ: যাঁর হুকুম মানতে হবে


এমামুয্যামানের লেখা থেকে সম্পাদিত


‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এই বাক্যটি হচ্ছে দীনুল হকের ভিত্তি। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, মুসলিম বলে পরিচিত এই জনসংখ্যাটি তওহীদ সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে (অর্থাৎ আকীদা) তা ভুল। তাদের কাছে তওহীদ মানে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করা এবং তাঁর ইবাদত বা উপাসনা করা। ‘তওহীদ’ এবং ‘ওয়াহদানিয়াহ্’ এই আরবি শব্দ দু’টি একই মূল থেকে উৎপন্ন হলেও এদের অর্থ এক নয়। ‘ওয়াহদানিয়াহ্’ বলতে বোঝায় মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ যে একজন তা বিশ্বাস করা (একত্ববাদ- Monotheism, পক্ষান্তরে ‘তওহীদ’ মানে ঐ এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়া, তাঁর ও কেবলমাত্র তাঁরই নিঃশর্ত আনুগত্য করা। এই আনুগত্য কেবল ধর্মীয় কাজে নয়, মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারাবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, আইন-কানুন, দ-বিধি, প্রশাসনিক অর্থাৎ যে কোনো অঙ্গনেই হোক, আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কোনো হুকুম বা অভিমত থাকলে সে বিষয়ে আর কারও কোনো কথা মানি না, এটাই হচ্ছে তওহীদের মর্মবাণী আরবের যে মুশরিকদের মধ্যে আল্লাহর শেষ রসুল এসেছিলেন, সেই মুশরিকরাও আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করত, কিন্তু তারা আল্লাহর হুকুম, বিধান মানতো না অর্থাৎ তারা আল্লাহর আনুগত্য করত না। তারা তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সামষ্টিক জীবন নিজেদের মনগড়া নিয়ম-কানুন দিয়ে পরিচালনা করত। এই আইনকানুন ও জীবন ব্যবস্থার উৎস ও অধিপতি হিসাবে ছিল বায়তুল্লাহ, কা’বার কোরায়েশ পুরোহিতগণ। মূর্তিপূজারী হওয়া সত্ত্বেও তাদের এই ঈমান ছিল যে, এ বিশ্বজগতের স্রষ্টা আল্লাহ একজনই এবং তাদের এই ঈমান বর্তমানে যারা নিজেদেরকে মুমিন মুসলিম বলে জানে এবং দাবি করে তাদের চেয়ে কোনো অংশে দুর্বল ছিল না (সুরা যুখরুফ ৯, আনকাবুত ৬১, লোকমান ২৫)। কিন্তু যেহেতু তারা আল্লাহর প্রদত্ত হুকুম মানতো না, তাই তাদের ঐ ঈমান ছিল অর্থহীন, নিষ্ফল এবং স্বভাবতঃই আল্লাহর হুকুম না মানার পরিণতিতে তাদের সমাজ অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, নিরাপত্তাহীনতা, সংঘর্ষ ও রক্তপাতে পরিপূর্ণ ছিল। তাদের আল্লাহর হুকুমের প্রতি ফিরিয়ে আনার জন্যই তাদের মধ্যে রসুল প্রেরিত হয়েছিলেন। রসুলও সে কাজটিই করেছিলেন, ফলশ্রুতিতে অন্যায় অশান্তিতে নিমজ্জিত সেই সমাজটি নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার, সুখ-সমৃদ্ধিতে পূর্ণ শান্তিময় একটি সমাজে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং আল্লাহর আনুগত্য না করাই ছিল তাদের কাফের মুশরিক হওয়ার প্রকৃত কারণ। বর্তমানের মুসলিমরা উপলব্ধি করতে পারছে না যে প্রাক-ইসলামিক যুগের আরবের কাঠ পাথরের মূর্তিগুলিই এখন গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদির রূপ ধরে আবির্ভূত হয়েছে এবং মুসলিম জনসংখ্যাটি আল্লাহর পরিবর্তে এদের তথা এদের প্রবর্তক ও পুরোধা ‘পুরোহিতদের’ আনুগত্য করে যাচ্ছে এবং তারাও সেই পৌত্তলিক আরবদের মতোই মুশরিক ও কাফেরে পরিণত হয়েছে।
এই জনসংখ্যাটি কিভাবে ইসলামের ভিত্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ থেকে সরে গেছে তা ব্যাখ্যা করছি। আদম (আ:) থেকে শুরু করে শেষ নবী মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত এ কলেমায় কখনোই “ইলাহ” শব্দটি ছাড়া অন্য কোনো শব্দ ব্যবহৃত হয় নি। নিসন্দেহে আল্লাহই আমাদের একমাত্র উপাস্য মা’বুদ, স্রষ্টা, পালনকর্তা, তবে এগুলি স্বীকার করে নেওয়া এই দীনের ভিত্তি নয়, কলেমা নয়। বরং কলেমা হচ্ছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। কলেমায় ব্যবহৃত ‘ইলাহ’ শব্দের প্রকৃত অর্থ, ‘যাঁর হুকুম মানতে হবে’ (He who is to be obeyed)। শতাব্দীর পর শতাব্দীর কাল পরিক্রমায় যেভাবেই হোক এই শব্দটির অর্থ ‘হুকুম মানা বা আনুগত্য’ থেকে পরিবর্তিত হয়ে গেছে ‘উপাসনা, বন্দনা, ভক্তি বা পূজা করা (He who is to be obeyed) । বর্তমানে সারা দুনিয়ায় খ্রিষ্টানদের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলিতে কলেমার অর্থই শেখানো হয় – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মানে আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। কোর’আনের ইংরেজী অনুবাদগুলিতেও কলেমার এই অর্থই করা হয় (There is none to be worshiped other than Allah)। অসঙ্গতিটি দিবালোকের মতো পরিষ্কার। ‘উপাস্য’ কথাটির আরবি হচ্ছে ‘মা’বুদ’, তাই “আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই” এই বাক্যটিকে আরবি করলে দাঁড়ায় “লা মা’বুদ ইল্লাল্লাহ’, যা ইসলামের কলেমা নয়। কোনো অমুসলিম এই সাক্ষ্য দিয়ে মুসলিম হতে পারবে না। কলেমার ‘ইলাহ’ শব্দটির অর্থ ভুল বোঝার ভয়াবহ পরিণতি এই হয়েছে যে সম্পূর্ণ মুসলিম জনসংখ্যাটি এই দীনের ভিত্তি থেকেই বিচ্যুত হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ পাল্টে যাওয়ায় এই মুসলিম জনসংখ্যার কলেমা সংক্রান্ত ধারণাই পাল্টে গেছে। বর্তমানে এই জাতির আকিদায় আল্লাহর হুকুম মানার কোনো গুরুত্ব নেই, তাঁর উপাসনাকেই যথেষ্ট বলে মনে করা হচ্ছে। কলেমার অর্থ সম্পর্কে এই ভুল আকিদা এই জনসংখ্যার আত্মায় এবং অবচেতন মনে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে। ফলে সারা দুনিয়াতে এমন কোনো দল নেই, এমন কোনো রাষ্ট্র নেই যারা তাদের সামষ্টিক, জাতীয় জীবনে আল্লাহর হুকুম মেনে চলছে, যা কিনা ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর আদেশ নিষেধ মানার চেয়ে বহুগুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য। জাতীয় জীবনে আল্লাহকে অমান্য করে তার বদলে উপাসনা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি দিয়ে আসমান জমিন ভর্তি করে ফেলা হচ্ছে, কিন্তু সেই পর্বত সমান উপাসনাও বিশ্বময় তাদের করুণ দুর্দশার প্রতি দয়াময় আল্লাহর কৃপাদৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে, বিজাতির হাতে তাদের অবর্ণনীয় নিপীড়ন, লাঞ্ছনা, পরাজয়, অপমান, নিগ্রহ বন্ধ তো হচ্ছেই না, বরং দিন দিন আরো বেড়ে চলছে।
আল্লাহ বলছেন, ‘আল্লাহ যা নাযেল করেছেন সে অনুযায়ী যারা হুকুম (বিচার ফায়সালা) করে না তারা কাফের, জালেম, ফাসেক (সুরা মায়েদা ৪৪, ৪৫, ৪৭)। এই আয়াতগুলিতে ‘হুকুম’ শব্দটি দিয়ে কেবল আদালতের বিচারকার্যই বোঝায় না, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক অর্থাৎ সামগ্রিক জীবন তাঁর নাযেল করা বিধান অর্থাৎ কোর’আন (এবং সুন্নাহ) মোতাবেক পরিচালনা করাকেও বোঝায়। মুমিন মুসলিম হবার দাবিদারগণ এখন আর একটি জাতি হিসাবে নেই, তারা ভৌগোলিকভাবে পঞ্চাশটিরও বেশি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে ইউরোপীয় খ্রিষ্টান, ইহুদি ও পৌত্তলিকদের দাসে পরিণত হয়েছে, তাই তারা তাদের সামষ্টিক কার্যাবলী আল্লাহর নাযেলকৃত বিধান দিয়ে ফায়সালা করে না। আল্লাহ প্রদত্ত বিধানগুলিকে অকার্যকর রেখে তারা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের আইন, কানুনগুলি নিজেদের দেশে প্রবর্তন করে তা দিয়ে সামষ্টিক কার্যাবলী পরিচালনা করছে।

রাষ্ট্র ও সমাজের দ্বন্দ্ব: গলদ কোথায়???

রাষ্ট্র ও সমাজের দ্বন্দ্ব: গলদ কোথায়???


আরিফ মো. আলী আহসান
সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য থাকা চলে না। বিশেষ করে চিন্তাধারা, বিশ্বাস ও উপলব্ধিতে সমাজ ও রাষ্ট্রকে অভিন্ন হতেই হবে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যদি একটি সিড়ির আলাদা আলাদা ধাপ হয়, তাহলে সমাজের পরের ধাপটাই হচ্ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের সাথে তাই ব্যক্তির দূরত্ব থাকতে পারে, কিন্তু সমাজের দূরত্ব মানা যায় না। চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবোধে রাষ্ট্র সমাজ থেকে যত দূরে সরে যাবে একটি জাতির উন্নতি ও প্রগতির সিড়ি ততটাই অকার্যকর হয়ে পড়বে। জাতি গতি হারিয়ে ফেলবে।
রাষ্ট্র হচ্ছে সমাজের বৃহত্তর পরিসর। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে উদ্ভূত সমস্যা, রীতি-নীতি, প্রথা-পরম্পরা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, অনুষ্ঠান ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে সমাজ। আর তা করতে গিয়ে কোনো প্রশ্নে সিদ্ধান্তের দরকার হলে সমাজ তার সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যে যখন সমাধান দিতে পারে না, তখনই কেবল দরকার পড়ে রাষ্ট্রের। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সাথে সমাজের তফাৎ যদি থাকে সেটা ক্ষমতায়; বিশ্বাসে নয়। বিশ্বাসের পার্থক্য রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করে, যার পরিণতি বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি।
দুর্ভাগ্যক্রমে বর্তমানে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র সেই বিশৃঙ্খলা ও অশান্তির মধ্যেই নিপতিত হয়েছে। এর কারণ ধর্মবিশ্বাস। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের সমাজ বিশ্বাসকেন্দ্রিক। ব্যক্তি থেকে আরম্ভ করে পরিবার ও সমাজের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ ও আচরণের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে ধর্মবিশ্বাস। অন্যদিকে রাষ্ট্রকে করা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ, কার্যত ধর্মহীন। ফলে দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি ইত্যাদি প্রধান প্রধান সেক্টরগুলো এমনভাবে তৈরি হয়েছে যার সাথে সমাজের বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার কোনো সুসম্পর্ক নেই, বরং তা সামাজিক বিশ্বাসের পরিপন্থীও বলা চলে। সমাজ যদি বলে কালো, রাষ্ট্র বলছে সাদা, সমাজ যদি বলে সাদা রাষ্ট্র বলে কালো। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্র যেহেতু সমাজের উপর কর্তৃত্বশীল, সুতরাং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র তার সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে সমাজকে বাধ্য করছে। যেমন সুদ। ধর্ম সুদকে নিষিদ্ধ করেছে, সুদের সাথে সম্পর্কিত যে কোনো কর্মকাণ্ড ধর্মে অবৈধ। ফলে শতাব্দীর পর শতাব্দী আমাদের সমাজ সুদ আদান-প্রদানকে অতি গর্হিত কাজ বলেই জেনে এসেছে। যদি কেউ সুদের লেনদেন করে সমাজ তাকে ঘৃণা করে। মানুষ মনে মনে হলেও সুদখোরকে ধিক্কার দেয়। অথচ সেই সুদ আজ রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির মূলভিত্তি এবং বিভিন্ন পদ্ধতিতে সুদকে সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ফলে সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে রাষ্ট্র।
সমাজে ধর্মের শতভাগ প্রভাব বজায় রেখে রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণভাবে ধর্মমুক্ত করার এই সাংঘর্ষিক ও অপ্রাকৃতিক সিদ্ধান্তের পরিণতি দাঁড়াচ্ছে এই যে, সমাজে দানা বাধছে ক্ষোভ। দূরত্ব তৈরি হচ্ছে রাষ্ট্রের সাথে সমাজের। সূত্রপাত হচ্ছে সংঘাত ও বিশৃঙ্খলার।
রাষ্ট্রের হাতে আছে সামরিক শক্তি, প্রশাসনিক শক্তি। রাষ্ট্রের হাতেই অর্থনীতি। সুতরাং সমাজ যতই রাষ্ট্রের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়–ক, রাষ্ট্রের আনুগত্য থেকে হাত গুটাতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। এদিকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যম অবিশ্রান্ত প্রচারণা চালাচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে। সেখানে ধর্ম অবহেলিত ও অবজ্ঞাত, মধ্যযুগীয় বর্বরতার প্রতীক। সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মবিশ্বাস এসব প্রচারমাধ্যমের কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। তারা বরং ব্যস্ত থাকে রাষ্ট্রকে ধর্মের যে কোনো সংস্পর্শ থেকে মুক্ত রাখতে।
শিক্ষাব্যবস্থাও তৈরি করা হয়েছে ধর্মকে সচেতনভাবে এড়িয়ে। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মের বিশেষ জায়গা নেই। এই শিক্ষায় শিক্ষিতরা কিছু নাস্তিক ও সংশয়বাদী হয়, আর অধিকাংশই ধর্ম সম্পর্কে সীমাহীন অজ্ঞতা ও হীনম্মন্যতা নিয়ে দিনাতিপাত করে। অন্যদিকে মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে যেগুলো সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সেগুলোতে সচেতনভাবে ধর্মের রাষ্ট্রসম্পর্কিত দিকটিকে ছেটে ফেলে ব্যক্তিগত আচার-আচরণ, এবাদত-উপাসনাকে অতি গুরুত্ব দিয়ে উপরে উঠানোর প্রচেষ্টা চলে। আর যেগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে সেখানে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা, মূল্যবোধ ও চিন্তাধারার বিপরীত চর্চা চলে। ওইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সরকার যতটা আতঙ্কিত, সমাজ কিন্তু ততটাই আন্তরিক। এখানে এসে সমাজ ও রাষ্ট্র পুনরায় মুখোমুখি।
ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি মোতাবেক ধর্মমতে অবৈধ জ্ঞান করা হয় এমন কোনো কাজ করলেও রাষ্ট্র কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়, সুতরাং কোনো ধর্মবিশ্বাসী গোষ্ঠী ধর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে যদি কোনো কারণে রাষ্ট্রকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চায়, রাষ্ট্র তাদের প্রতি শত্র“ভাবাপন্ন হয়ে ওঠে। সেই শত্র“ভাবকে কাজে লাগিয়ে ধর্মবিশ্বাসী মানুষকে উস্কানি দিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার ঘটনাও অহরহ ঘটে। ফলে পরিস্থিতি যে রক্তাক্ত পরিণতির দিকে গড়ায়, তাকে না ধর্মবিশ্বাস দ্বারা বৈধতা দেওয়া যায়, না ধর্মনিরপেক্ষতা দ্বারা।
ধর্মনিরপেক্ষতার তীর্থভূমি ইউরোপে কিন্তু এ ধরনের ঘটনা কল্পনাও করা যায় না, যদিও সেখানকার সমাজ ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। ইউরোপের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের মূল উৎসভূমি যে ধর্ম তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেখানে রাষ্ট্রের সাথে ধর্মবিশ্বাসী সমাজের দ্বন্দ্ব এত প্রবল নয় যতটা প্রবল আমাদের মতো প্রাচ্যের দেশগুলোতে। তাই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক- যে ব্যবস্থা ইউরোপের রাষ্ট্র ও সমাজকে স্থিতিশীল রাখতে পারছে, সেই একই ব্যবস্থা আমাদের রাষ্ট্রকে সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে কেন? এর কারণ- আমাদের সমাজ এমন একটি ধর্মবিশ্বাসের ধারক যা নিছক উপাসনা বা আচার-অনুষ্ঠাননির্ভর নয়। এতে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সকল অঙ্গনের নীতিমালা সুনির্দিষ্ট রয়েছে। এমনকি শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা, পররাষ্ট্রনীতি সব বিষয়ে এতটা স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে এবং তা লঙ্ঘন করার ক্ষেত্রে জোরালো নিষেধাজ্ঞা রয়েছে যে, ধর্মের সেই সমষ্টিগত ভাগটাকে বাদ দিলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। অন্যদিকে ইউরোপ যে ধর্মবিশ্বাস থেকে পরিচালিত তাতে সমষ্টিগত জীবনের দিক-নির্দেশনা নেই, আছে ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবনের নৈতিক বা আত্মিক শিক্ষা। তাই ইউরোপের জন্য রাষ্ট্রকে ধর্মমুক্ত বা ধর্মহীন করে ফেলা যতটা সহজ, আমাদের জন্য ততটাই কঠিন।
বাংলাদেশকেই উদাহরণ হিসেবে নেয়া যাক। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ইসলামের প্রধান ধর্মগ্রন্থ আল কোর’আন, যেখানে মহান আল্লাহ মুসলিমদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতীয় জীবনের নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। একজন মুসলিম যখন ইসলামের ইতিহাস পড়ে, সে জানতে পারে এক সময় ইসলামই ছিল মুসলিমদের সমষ্টিগত জীবনের নিয়ন্ত্রক, প্রাণশক্তি। ইসলামের শাসনে অতীতে এমন শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, সমাজে কোনো অপরাধ ছিল, শোষণ ছিল না, দারিদ্র্যও ছিল না। রাতের অন্ধকারে একা অলংকার পরিহিত যুবতি নারী মাইলের পর মাইল পথ চলতো, তার মনে কোনো ভয় জাগ্রত হতো না। কোথাও চুরি ছিল না, ডাকাতি ছিল না। সে বোঝে বর্তমানে সমাজের এত অন্যায়, অবিচার, অনিরাপত্তা, অশান্তির কারণ হলো জাতীয় জীবন থেকে ধর্মকে বিতাড়িত করা হয়েছে। সে তার জন্য দায়ী মনে করে রাষ্ট্রকে। একইভাবে কেউ যখন কোর’আন খোলে সে তার জাতীয় জীবনের করণীয় দিকগুলোকে চাক্ষুষ দেখতে পায় এবং এও জানতে পারে যে, আল্লাহ চান মানুষ তার দেওয়া বিধি-ব্যবস্থা অনুযায়ী নিজেদের পরিচালিত করুক। অথচ বাস্তবে ঘটছে সম্পূর্ণ উল্টো। এর জন্য একদিকে সে যেমন রাষ্ট্রকে দোষারোপ করে, অন্যদিকে নিজেকেও অপরাধী ভাবতে থাকে, অনুতপ্ত হয়। সেই অপরাধী মনোভাব থেকে সঞ্চারিত হয় ক্ষোভ। ক্ষোভ থেকে সৃষ্টি হয় হিংসা ও হিংস্রতা, যার সমাপ্তি ঘটে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের মাধ্যমে।
এভাবে আমাদের সমাজে এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে, বিশ্বাসকে মূল্য দিতে গেলে রাষ্ট্র প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, রাষ্ট্রকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করতে গেলে বিশ্বাসের বন্ধনে চিড় ধরছে। ধর্মহীন রাষ্ট্র ও ধর্মাবৃত সমাজ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার বদলে পথ চলছে ব্যাপক অনাস্থা ও অসহযোগিতা নিয়ে। বলা বাহুল্য, ধর্মনিরপেক্ষ ইউরোপকে কিন্তু এই দ্বান্দ্বিক অবস্থার মধ্যে পড়তে হয় নি।
লেখক: গোপালগঞ্জ জেলা আমীর, হেযবুত তওহীদ।

Tuesday, March 22, 2016

পবিত্র কোরআন খতমের বিনিময়ে হাদিয়া দেওয়া-নেওয়া হারাম

পবিত্র কোরআন খতমের বিনিময়ে হাদিয়া দেওয়া-নেওয়া হারাম


পূর্বেকার যুগে মুসলমানগণ সচেষ্ট থাকতেন যাবতীয় ইবাদত যেন যথাযথভাবে আদায় হয়। ইবাদতের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার ত্রুটি বা দুর্বলতা না থাকে। যেকোনো ইবাদতে ব্যতিক্রমী কিছু মনে হলে তা ফকিহ, মুফতি ও মুহাদ্দিসগণ থেকে জেনে নিয়ে শুধরে নিতেন। এ যুগেও ওই বাস্তবতা ও চিন্তাধারা বিদ্যমান। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন সামাজিক প্রথা ইবাদতে প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যায় বর্তমান সমাজে। এ দিকটি বড়ই আফসোসের এবং হতাশার। ইবাদত হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর হুকুম পরিপালনের উদ্দেশ্যে। এতে না কোনো দুনিয়াবি স্বার্থ জড়িত থাকবে, না সামাজিক কোনো প্রথা ইবাদতকে প্রভাবিত করবে। এর ব্যতিক্রম হলে ইবাদত অপরিপূর্ণ হয়, সাওয়াব কমে যায়, অনেক সময় একেবারেই সাওয়াব হয় না, অনেক ক্ষেত্রে ইবাদতটাও সহিহ হয় না।
পবিত্র রমজান মাসের বিশেষ আমলগুলো সিয়াম সাধনার পর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো তারাবির নামাজ। মুসলমানগণ তারাবির নামাজকে যথাযথভাবে আদায় করে তার পরিপূর্ণ ফজিলত অর্জনের জন্য সচেষ্ট থাকেন। অনেক সময় পরিপূর্ণ জ্ঞানের অভাব বা পরিবেশ পরিস্থিতি ও সামাজিকভাবে প্রচলিত প্রথার চাপের মুখে তারাবির মতো আমলে কিছু ত্রুটিবিচ্যুতির অনুপ্রবেশ ঘটে থাকে। যার কারণে তারাবির ফজিলত থেকে পুরোপুরিভাবে বঞ্চিত রয়ে যেতে হয় তাদের। যেমন- তারাবির নামাজ সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পবিত্র কোরআনের খতম। কোরআন খতমের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে একটি হলো যে হাফেজ পবিত্র কোরআন তারাবিতে খতম করবেন, তিনি এর বিনিময় চাইতে পারবেন কি না? হাফেজের কোনো দাবি ছাড়া মুসল্লিগণ তাঁকে বিনিময় প্রদান করতে পারবেন কি না? বিনিময় নয়, হাদিয়া বা উপহারণস্বরূপ কিছু লেনদেন করতে পারা যাবে কি না? ওই হাফেজ যদি কোরআন খতমের পাশাপাশি মসজিদে আজান দেন বা কয়েক ওয়াক্ত নামাজ পড়ান, তখন ওই হাফেজকে বিনিময় দেওয়া যাবে কি না ইত্যাদি।
বিষয়টি ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। যার কারণে শরিয়তের মূল চাওয়াকে পাশ কাটিয়ে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে একে ব্যাখ্যা করে থাকেন। শেষ পর্যন্ত মুসল্লিগণ, যারা আন্তরিকভাবে হাফেজদের খেদমত করতে আগ্রহী, হাফেজ সাহেবদের কিছু আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে মূল্যায়ন করতে চান, রমজান ও তারাবির ফজিলত পরিপূর্ণভাবে পেতে আকাঙ্ক্ষী, তাঁরা স্বয়ং তারাবির নামাজের মতো মহৎ ইবাদতের ফজিলতটুকু অর্জনেও ব্যর্থ হন। এ কারণে তারাবির নামাজে কোরআন খতম করে বিনিময় নেওয়া ও দেওয়ার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় বিধান জানা থাকা আবশ্যক।
তারাবির নামাজের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় শরিয়ার দিক থেকে লক্ষণীয়। প্রথমত, তারাবির নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা। দ্বিতীয়ত, তারাবির নামাজে পুরো এক খতম কোরআন পাঠ করা। শরিয়তের দৃষ্টিতে দুটি বিষয়ের বিধান ভিন্ন ভিন্ন।
তারাবির নামাজ জামাত সহকারে আদায় করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা কিফায়া। কোথাও তারাবির জামাত অনুষ্ঠিত না হলে সবাই গোনাহগার হবে। তারাবির নামাজে পুরো এক খতম কোরআন পাঠ করা সুন্নাতে জায়েদা। যদিও এটি অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি আমল। তবুও বাধ্যতামূলক নয়। তাই খতমে তারাবি সম্ভব না হলে সুরা তারাবি হলেও পড়তে হবে।
ইবাদতের বিনিময়সংক্রান্ত শরিয়তের নীতিমালা : ইবাদতের বিনিময় গ্রহণসংক্রান্ত শরিয়তের নীতিমালা হলো নিরেট ইবাদত তথা ইবাদতে মকসুদা যেমন- নামাজ, রোজা, ইতিকাফ ইত্যাদির ক্ষেত্রে বিনিময় গ্রহণ করা সম্পূর্ণ হারাম। ইসলামের শুরু থেকে যত দিন ইসলামী খেলাফত অবশিষ্ট ছিল, তত দিন এই নীতি বহাল ছিল। ইমামগণ ইমামতি করে বিনিময় গ্রহণ করতেন না। কোরআন শিক্ষা দিয়ে বিনিময় নিতেন না। রাষ্ট্রীয়ভাবে এসবের ব্যবস্থা করা হতো। ইসলামী খেলাফত বিলুপ্তির পর রাষ্ট্রীয়ভাবে শরিয়তের বাধ্যতামূলক ইবাদতগুলোর ব্যবস্থাপনা না থাকায় পরবর্তী ফুকাহাগণ শরিয়তের প্রয়োজনে ইমাম, মুয়াজজিন, কোরআন শিক্ষার মুয়াল্লিমদের বিনিময় গ্রহণে ছাড় দেন। অর্থাৎ এগুলোর ক্ষেত্রে ডক্ট্রিন অব নেসেসিটির ভিত্তিতে বৈধতা প্রদান করেন।
এবার আসা যাক তারাবির বিষয়ে। শরিয়ত মতে, তারাবির নামাজ বাধ্যতামূলক হলেও তারাবিতে খতমে কোরআন বাধ্যতামূলক নয় বিধায় তারাবিতে খতমে কোরআনের বিনিময় এই বৈধতার আওতায় পড়ে না।
তারাবিতে কোরআন খতমের বিনিময়ে হাদিয়া দান ও গ্রহণের হুকুম : ওই নীতিমালার ভিত্তিতে খতম তারাবিতে হাফেজদের বিনিময় বা হাদিয়া দেওয়া-নেওয়া মুসলিম উম্মাহর ফকিহ, মুহাদ্দিসগণ ঐকমত্যের ভিত্তিতে নাজায়েজ বলেছেন। এতে না কোনো মাজহাবের মতবিরোধ আছে, না পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ফকিহগণের মাঝে কোনো মতভেদ আছে। ইমামতির জন্য বেতন ঠিক করা এবং তা আদায় করা যদিও পরবর্তী ফকিহগণের দৃষ্টিতে জায়েজ; কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ফকিহ খতমে তারাবির বিনিময় বা হাদিয়া নেওয়া-দেওয়ার অনুমতি দেননি।
সুতরাং খতমে তারাবির বিনিময় দেওয়া-নেওয়া উভয়ই নাজায়েজ ও হারাম। হাদিয়া হিসেবে দিলেও জায়েজ হবে না। এক মাসের জন্য নিয়োগ দিয়ে কয়েক ওয়াক্ত নামাজ পড়িয়ে বেতন হিসেবে দিলেও জায়েজ নয়। এটা যেভাবেই দেওয়া হোক, তা কোরআন খতমের বিনিময় হিসেবেই স্বীকৃত হবে। এতে কোনো প্রকার হিলা বা কৌশল করার অবকাশ নেই। (ফতোয়ায়ে শামী ৬/৫৭, আল-বাহরুর রায়েক ৮/২৩, মাজমাউল আনহুর ৩/৫৩৩, ফতওয়ায়ে হামিদিয়া ২/১৩৭-১৩৮, শিফাউল আলীল ওয়া বাল্লুল গালিল ১/১৫৪-১৫৫, আল ইখতিয়ার লিতালীল মুখতার ২/৬২)
পবিত্র কোরআন-সুন্নাহর আলোকে ফকিহদের মতামত : এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট বিধানাবলি এবং এর ভিত্তিতে ফকিহগণ কী মত পোষণ করেন, তার প্রতিও সামান্য আলোকপাত করা হলো-
* আবদুর রহমান ইবনে শিবল (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তোমরা কোরআন পড়ো। তবে তাতে বাড়াবাড়ি করো না। এর প্রতি বিরূপ হয়ো না। কোরআনের বিনিময় ভক্ষণ করো না এবং এর দ্বারা সম্পদ কামনা করো না। (মুসনাদে আহমদ ৩/৪২৮, হাদিস : ১৫৫২৯; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৫/২৪০)
* ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তোমরা কোরআন পড়ো এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করো। তোমাদের পরে এমন জাতি আসবে, যারা কোরআন পড়ে মানুষের কাছে প্রার্থনা করবে। -(মুসনাদে আহমদ ৪/৪৩৭, হাদিস : ১৯৯১৭)
* আবদুল্লাহ ইবনে মা'কাল (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি এক রমজানে লোকদের নিয়ে তারাবি পড়ালেন। এরপর ঈদের দিন উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদ (রা.) তাঁর কাছে একজোড়া কাপড় এবং ৫০০ দিরহাম পাঠালেন। তখন তিনি কাপড় জোড়া এবং দিরহামগুলো এই বলে ফেরত দিলেন, আমরা কোরআনের বিনিময় গ্রহণ করি না। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৫/২৩৭, হাদিস : ৭৮২১)
এরূপ আরো বহু হাদিস ও দলিল প্রমাণের আলোকে উম্মতের ফকিহগণ তারাবিতে পবিত্র কোরআন খতমের বিনিময়ে বা হাদিয়া দেওয়া-নেওয়া সম্পূর্ণরূপে হারাম বলেছেন।
প্রখ্যাত ফকিহদের মতামত : ১. হজরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী বলেন, তারাবিতে যে পবিত্র কোরআন পড়ে এবং শোনে তাদের বিনিময় দেওয়া হারাম। (ফতোয়ায়ে রশীদিয়া ৩৯২)
২. হজরত খলিল আহমদ সাহারানপুরী (রহ.) বলেন, বিনিময় দিয়ে পবিত্র কোরআন শোনা জায়েজ নয়। দানকারী এবং গ্রহণকারী উভয় গোনাহগার হবে। (ফতোয়ায়ে খলিলিয়া ১/৪৮)
৩. হজরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বলেন, বিনিময় লেনদেন হয় এমন খতম তারাবি শরিয়তপরিপন্থী। এরূপ খতমের দ্বারা সাওয়াবের ভাগী হওয়া যাবে না বরং গোনাহের কারণ হবে। (এমদাদুল ফতোয়া ১/৪৮)
৪. মুফতি কেফায়াতুল্লাহ (রহ.) বলেন, তারাবিতে পবিত্র কোরআন শোনানোর বিনিময় গ্রহণ করা জায়েজ নেই। (কেফায়াতুল মুফতি ৩/২৬৫)
৫. হজরত মুফতি আযীযুর রহমান (রহ.) বলেন, বিনিময় গ্রহণ করে কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করা জায়েজ নেই। যাদের নিয়তে দেওয়া-নেওয়া আছে, তাও বিনিময়ের হুকুমে হবে। এমতাবস্থায় শুধু তারাবি আদায় করাই ভালো। বিনিময়ের কোরআন শরিফ না শোনা উত্তম। কিয়ামুল লাইলের সাওয়াব শুধু তারাবি পড়লেই অর্জন হয়ে যাবে। (ফতোওয়া দারুল উলুম ৪/২৪৬)
৬. হজরত মাওলানা মুফতি শফী (রহ.) বলেন, ছোট ছোট সুরা দিয়ে তারাবি পড়ে নিন। বিনিময় দিয়ে কোরআন শুনবেন না। কারণ কোরআন শোনানোর মাধ্যমে বিনিময় গ্রহণ করা জায়েজ নেই। (জাওয়াহেরুল ফিকহ ১/৩৮২)
৭. তারাবিতে কোরআন পড়ার বিনিময় গ্রহণ করা জায়েজ নেই। দানকারী এবং গ্রহণকারী উভয়েই গোনাহগার হবে। যদি বিনিময়বিহীন কোরআন শোনানোর মতো হাফেজ পাওয়া না যায়, তবে ছোট ছোট সুরা দিয়ে তারাবি পড়ে নেওয়াই উত্তম। (ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া ৭/১৭১)
৮. খেদমতের নামে নগদ টাকা বা কাপড়চোপড় ইত্যাদি দেওয়াও বিনিময়ের মধ্যে শামিল। বরং তা বিনিময় ধার্য করা থেকেও জঘন্য। কারণ তাতে দুটি গোনাহ একত্রিত হয়। একটি কোরআনের বিনিময় গ্রহণের গোনাহ। দ্বিতীয়টি হলো, যে বিনিময় হচ্ছে তা না জানার গোনাহ। (আহসানুল ফতোওয়া ৩/৫১৪)
এ বিষয়ে বেরলভি সম্প্রদায়ের মতামত : বিশিষ্ট বেরলভি মুফতি আমজাদ আলী কাদেরী আজমী এক ফতোয়ায় লেখেন, বর্তমানে অধিক প্রচলন দেখা যায়, হাফেজ সাহেবকে বিনিময় দিয়ে তারাবি পড়া হয়। যা জায়েজ নেই। দানকারী ও গ্রহণকারী উভয়ই গোনাহগার হয়। এটুকু নেব বা এটুকু দেবে- এটিই শুধু বিনিময় নয়। বরং যদি জানা থাকে যে এখানে কিছু পাওয়া যায়, যদিও তা নির্দিষ্ট নয়, তা নাজায়েজ। কারণ জানা থাকাও শর্তকৃতের মতো। (বাহারে শরিয়ত ৪/৬৯২)
লা-মাজহাবি সম্প্রদায়ের ফতোয়া : লা-মাজহাবিদের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুর রহমান মোবারকপুরী লেখেন, ইমাম আহদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর কাছে বিনিময় নিয়ে তারাবি নামাজে ইমামতকারী ইমামের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি, সেরূপ ইমামের পেছনে কে বা কারা নামাজ আদায় করবে? আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক বলেন, আমি বিনিময় নিয়ে নামাজ পড়ানোকে মাকরূহ মনে করি এবং আমার ভয় হয়, ওই সব লোকের নামাজ আবার পড়তে হবে কি না, যারা এমন ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করে। এরপর তিনি বলেন, আমার মত হলো, বিনিময় গ্রহণ করা যাবে না। (ফতোয়ায়ে নজিরিয়া ১/৬৪২)
* মাওলানা আব্দুল্লাহ আমরতসরী লেখেন, বিনিময়ের মাধ্যমে তারাবিতে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করা বা বিনিময় নির্ধারণ করা সম্পূর্ণ হারাম। বরং এরূপ লোকের পেছনে তারাবিও হয় না। (ফতোয়ায়ে আহলে হাদিস ২/৩০২)
এ আলোচনার পর স্পষ্ট হয়ে গেল, খতম তারাবি পড়িয়ে কোনো প্রকার বিনিময়-হাদিয়া লেনদেনের কোনো অবকাশ দ্বীন ইসলামে নেই। এটি পুরো উম্মতের দল-মত নির্বিশেষে ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত। সুতরাং এ ব্যাপারে অপরিণামদর্শী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন হীলা-বাহানার অবতারণা করে বিষয়টিকে জটিল করার কোনো সুযোগ আর বাকি থাকে না। আল্লাহ আমাদের সত্য বোঝা ও মানার তাওফিক দান করুন আমিন।
হাফেজদের প্রতি ভক্তি-ভালোবাসা ও তাদের খেদমত করার পদ্ধতি : তার পরও একটি বিষয় থেকে যায়, তাহলো মুসলমানগণের আবেগ, হাফেজদের মূল্যায়ন করা তাদের খেদমত করা, তা কিভাবে সম্ভব? মুসলমানদের এরূপ আবেগ, ভক্তি-ভালোবাসা থাকা স্বাভাবিক। কারণ পবিত্র কোরআনের হাফিজের অগণিত ফজিলত হাদিস শরিফে এসেছে। তাই হাফেজদের মূল্যায়ন করা, মুহাব্বত করা, তাদের যথাসম্ভব খেদমত করা সব মুসলমানের জন্য জরুরি বিষয়। শরিয়তে এরও পদ্ধতি ভিন্নভাবে আছে। রমজানসহ সারা বছর তাদের খিদমত করার সুযোগ আছে। যেমন ১. এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের সর্বপ্রথম দ্বীনি দায়িত্ব হলো পবিত্র কোরআনের হাফিজকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসা ও ভক্তি করা। এই ভালোবাসা ও ভক্তি সব সময়ের জন্য, সারা বছরের জন্য। শুধু রমজানের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। ২. পবিত্র কোরআন ও হাফেজে কোরআনের মুহাব্বত তখনই প্রকাশ পাবে, যদি অন্তরে নিজের সন্তানকে হাফেজে কোরআন বানানোর ইচ্ছা করা হয় এবং চেষ্টা করা হয়। ৩. রমজান মাসে যে হাফেজের পেছনে তারাবি পড়া হবে, তার খানাপিনার ক্ষেত্রে সর্বোন্নত ব্যবস্থা করা যায়। ৪. তাদের যাতায়াতের জন্য সবচেয়ে উন্নত গাড়ি ব্যবহার করা যায়। ৫. সারা বছর যারা পবিত্র কোরআন হিফজ করার কাজে নিয়োজিত, এরূপ ছাত্র-শিক্ষকদের যেকোনো খেদমত যেকোনো সময় আঞ্জাম দেওয়া যায়। নিজের সাধ্যমতো হাফেজদের খোঁজখবর রাখা, তাদের জরুরত পূরণ করা। তাদের খানাপিনার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
এভাবে হাফেজদের যথাযথ খিদমত আঞ্জাম দেওয়া ও আন্তরিক ভালোবাসা দিয়ে তাদের অভিভাবকত্ব করার ফজিলত অপরিসীম। আল্লাহ আমাদের বৈধ পদ্ধতিতে হাফেজদের যথাযথ মূল্যায়ন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, মাসিক আল-আবরার, ঢাকা