Thursday, June 30, 2016

সব বাদ-মতবাদ ভুলে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হোতে হবে

সব বাদ-মতবাদ ভুলে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হোতে হবে

-হেযবুত তওহীদ:

বর্তমানে কিছু স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক মহল সাধারণ জনগণের সাথে প্রতারণা কোরছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে নানা ভাগে বিভক্ত করে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে বোলছে, ওদের চেয়ে আমরা ভালো। যারা নানা অজুহাতে নিরীহ জনসাধারণকে একে অপরের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে, বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে টান টান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তাদের সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। আমরা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রাম কোরেছি ঐক্যবদ্ধ হোয়ে, এক জাতি, এক মত হোয়ে। তখন কিন্তু আমাদের মধ্যে এত দল-মতের প্রভাব ছিলো না। নিজেদের মধ্যে দল-মতের প্রভাব থাকলে আমরা কিন্তু স্বাধীন জাতি হোতে পারতাম না। কিন্তু অতি দুর্ভাগ্যের বিষয় হোল এক সময় আমাদেরকে নানা দলে, নানা তাবুতে বিভক্ত কোরতেই এখানে বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারা চালু করা হয়। তারপর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখা ও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য লড়াই কোরেছে, এতে বলি হোয়েছে সাধারণ জনগণের জীবন ও সম্পদ। ফলে কেউ নিহত হোয়েছে, আবার কেউ আহত হোয়ে সারাজীবন পঙ্গুত্ব বরণ কোরেছে, অনেকেই হারিয়েছে তাদের সম্পদ। কিন্তু নেতা বা নেত্রীদের কী হোয়েছে? নেতৃবৃন্দের সর্বোচ্চ শাস্তি বলতে গেলে জরিমানা, কাউকে বা জেলের ভিতর ভিআইপি মর্যাদায় কিছু সময় কাটাতে হোয়েছে। কিন্তু রাস্তায় যারা আন্দোলন সংগ্রাম কোরেছে তারা সর্বোচ্চ ত্যাগ অর্থাৎ মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছে। তাহোলে এই নেতাদের আসল উদ্দেশ্য কী? শুধু ক্ষমতার মসনদে বসা আর রাতারাতি অর্থ বিত্তের মালিক হওয়া, জাতিকে নিয়ে ভাববার সময় তাদের কোথায়? প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় এই সুবিধাভোগী জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার কতভাগ? মূলত সুবিধা ভোগ করে মোট জনসংখ্যার শতকরা তিন ভাগের মতো, যে দল যখন ক্ষমতাসীন হন সেদল বা দলের নেতৃস্থানীয়রাই অকল্পনীয় সুবিধা ভোগ করেন। পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসতে না পারলেও গচ্ছিত অর্থ দিয়ে বাকি সময়টা আরাম আয়েশে পার করে দিতে পারেন। সাধারণ রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাড়ি জমান। বিভিন্ন সভা-সমাবেশের নামে বিদেশ ঘুরে আসেন। এই অর্থ কোথা হতে আসে? তাদের অর্থের যোগান দেন সাধারণ জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ যা ট্যাক্সের মাধ্যমে আদায় করা হয়। রাষ্ট্রীয় অর্থ খরচ করার জায়গা হিসাবে তারা বেছে নেন বিদেশ ভ্রমণ! উন্নয়নের নামে হাজার হাজার প্রকল্প কাগজে কলমে কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। যেখানে প্রতিটা শিশু জন্ম নেয় সীমাহীন ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে, যে দেশের মানুষ দু’বেলা খেয়ে পরে কোন মতে বেঁচে আছে সে দেশের নেতা-নেত্রীরা কি করে বিলাস ব্যসনে মত্ত থাকেন অথচ জনগণের কল্যাণের কথা বলেই সভা-সমাবেশ করেন, জনতার নামেই সব চালান। কিন্তু যেই জনতার নামে চোলছে সব সেই জনতার খবর তারা রাখেন না। ১৬ কোটি জনতার মধ্যে তখন শুধুমাত্র দলীয় লোকেরাই হন প্রকৃত জনগণ। কি অদ্ভুত রাজনীতি! পাঁচ বছর পর পর আসে ভোট, যতো প্রকার ছলচাতুরী করা যায় ততোই ভালো, ভোটের বাক্স ভরে দিবে জনতা, কোন মতে পাস কোরলে পরবর্তী ৫ বছরে সাধারণ জনতা তাদের চৌকাট পার হবার ক্ষমতা থাকে না, নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে নেতার নিকট পৌঁছা বড়ই দুরূহ হোয়ে দাঁড়ায়। সাধারণ জনতার ক্ষমতা ঐ ভোটের দিন আর বাকি ৫ বছর ঐ একজনের, কি অদ্ভুত রাজনীতি! ভোটের আগে শত সহস্র প্রতিশ্র“তি থাকে সমাজ ও দেশের মানুষের কাছে, ভোট শেষ হলে প্রতিশ্র“তির কথা বেমালুম ভুলে যান নেতা-নেত্রীরা- এভাবেই চলছে যুুগের পর যুগ। আম জনতা বুঝেও কিছুই কোরতে পারছে না। কারণ সিস্টেমটাই এমন। আপনাকে যদি বলা হয়, আপনি বাঁচবেন, না মরবেন? তবে নিশ্চয় আপনি উত্তর দিবেন, “আমি বাঁচব” কিন্তু আপনাকে যখন প্রশ্ন করা হোচ্ছে- আপনি কি গলায় ফাঁস দিয়ে মরবেন? গুলি খেয়ে মরবেন? আগুনে ঝলসে মরবেন? নাকি পানিতে ডুবে মরবেন? তখন মৃত্যুর সহজ পথ বেছে নেওয়া ছাড়া আপনার আর উপায় থাকে না। গণতন্ত্র নামক এমনই এক সিস্টেমের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত আমরা যে, পাঁচ বছর পর পর আমাদের শুধু বেছে নিতে বলা হয় মৃত্যুর পন্থা। এভাবেই বহুদিন ধরে আমরা জাতিগতভাবে ধুকে ধুকে মরছি। কিন্তু আর না, সাধারণ জনগণের ভাববার সময় এসেছে, সিদ্ধান্ত নেবার সময় এসেছে। গণতন্ত্র নামক প্রচলিত এই ব্যর্থ, অকার্যকর, ভোগবাদী, নীতি-নৈতিকতাহীন সিস্টেম বা ব্যবস্থাকে বাদ দিয়ে ১৬ কোটি মানুষকে একটি জাতিতে পরিণত হোতে হবে। সকল বাদ-মতবাদ ভুলে, মত-পথ ভুলে, দল-গোষ্ঠী ভুলে, ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে ঐক্যবদ্ধ জাতি গড়ার ডাক দিচ্ছে যামানার এমামের অনুসারী তথা হেযবুত তওহীদ।

Tuesday, June 28, 2016

আল্লাহ প্রদত্ত পাঁচ দফা কর্মসূচির বাস্তবায়েন বাঙালিকে কোরবে পরাশক্তিধর জাতি

আল্লাহ প্রদত্ত পাঁচ দফা কর্মসূচির বাস্তবায়েন বাঙালিকে কোরবে পরাশক্তিধর জাতি

মসীহ উর রহমান:


আল্লাহর শেষ রসুলের আগমন ও সংগ্রামের উদ্দেশ্য ছিল সকল দল, মত, পথ, ভৌগোলিক ও ভাষাগত জাতীয়তার ব্যবধান ঘুঁচিয়ে পুরো মানবজাতিকে, আদম ও হাওয়ার সকল সন্তানকে একটি মহাজাতিতে পরিণত করা। সমগ্র মানবজাতির স্রষ্টা এবং ন্যায়সঙ্গত হুকুমদাতা (এলাহ) একজন, সুতরাং তাদের জীবনব্যবস্থাও হবে একটি। সেটার নাম আল্লাহ দিয়েছেন দীনুল হক বা সত্য জীবনব্যবস্থা। সমগ্র মানবজাতির জীবনকে শান্তি, ন্যায় ও সুবিচারে পূর্ণ কোরে দিতে আল্লাহ তাঁর শেষ রসুলের মাধ্যমে এই জীবনব্যবস্থা দান কোরেছেন আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে। সেটা প্রতিষ্ঠা করার পদ্ধতি হিসাবে আল্লাহ রসুলাল্লাহ এবং তাঁর জাতি উম্মতে মোহাম্মদীকে পাঁচ দফার একটি কর্মসূচি দান কোরেছিলেন। ঐ পাঁচ দফা হোল- ১) ঐক্য, ২) শৃঙ্খলা, ৩) আনুগত্য, ৪) হেজরত, ৫) জেহাদ (হাদীস- তিরমিযী, মুসনাদে আহমেদ, বাব-উল-এমারাত, মেশকাত)।
প্রকৃতপক্ষে এই পাঁচ দফাই হোচ্ছে মানবজাতিকে একটি জাতিতে পরিণত করার কর্মসূচি। আজ আমরা পৃথিবীর যে অংশে বসবাস কোরছি অর্থাৎ বাংলাদেশ। এখানে বর্তমানে ১৬ কোটি মানুষ বসবাস করে। এই ১৬ কোটি মানুষকেও যদি আজ ঐক্যবদ্ধ হোতে হয় তবে আল্লাহর দেওয়া এই পাঁচ দফার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কোন পন্থা নেই, কারণ আল্লাহর দেওয়া পন্থা থেকে কোন পন্থা শ্রেষ্ঠ হওয়া সম্ভব নয়।
আল্লাহর রসুল তাঁর জাতিকে সঙ্গে নিয়ে ঐ কর্মসূচি মোতাবেক কঠিন সংগ্রাম কোরে আরব ভূখণ্ডে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠা কোরলেন। ফলে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হোল চূড়ান্ত শান্তি ও নিরাপত্তা। এরপর বাকি পৃথিবীর দায়িত্ব তিনি তাঁর জাতিটির উপর অর্পণ কোরে আল্লাহর কাছে গেলেন। তাঁর জাতি সংগ্রাম কোরে, সর্বস্ব ত্যাগ কোরে ৬০/৭০ বছরের মধ্যে অর্ধ দুনিয়াতে সেই দীনকে প্রতিষ্ঠা কোরল। এই দীনটি প্রতিষ্ঠার ফলে অর্ধপৃথিবীতে মানুষের জীবন এবং সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা, ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হোল। সেই সমাজে একজন সুন্দরী যুবতী সারা গায়ে অলঙ্কার পরে একা শত শত মাইল পথ ভ্রমণ কোরতে পারতো, তার মনে কোন ক্ষতির আশঙ্কাও জাগ্রত হোত না। শ্রমিকের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগেই সে তার ন্যায্য পারিশ্রমিক পেয়ে যেত, অর্থনৈতিক মুক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, দান অথবা যাকাতের টাকা গ্রহণ করার কেউ ছিলো না। নারীরা পূর্ণ সম্মান ও মর্যাদার সাথে জাতীয় ও সামাজিক প্রয়োজনে নিশ্চিন্তে, নির্বিঘেœ যে কোন ভূমিকা রাখতে পারতো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরবর্তীতে আকিদা ভুলে যাওয়ার কারণে এই জাতি তার মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হোল, তারা সেই পাঁচ দফা কর্মসূচি এবং সংগ্রাম দুটোই ত্যাগ কোরল।
এভাবে আমরা প্রকৃত এসলাম এবং সেটি প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি থেকে বঞ্চিত ছিলাম দীর্ঘ তেরশ’ বছর। আল্লাহর অশেষ দয়া যে তিনি আবার তাঁর প্রকৃত এসলাম এবং তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য আল্লাহর রসুলের দিয়ে যাওয়া সেই পাঁচ দফা কর্মসূচিও তাঁরই এক প্রিয় বান্দা এ যামানার এমাম জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর মাধ্যমে আবার আমাদেরকে দান কোরেছেন। আমরা চেষ্টা কোরে যাচ্ছি আবার এই শতধাবিচ্ছিন্ন জাতিকে সত্য ও ন্যায়ের উপরে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য। আসুন দেখা যাক এই কর্মসূচির প্রতিটি দফার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি।
ঐক্য
কর্মসূচির প্রথমটি হোচ্ছে ঐক্য। তাই এই উম্মতে মোহাম্মদী জাতিটির এখন প্রথম কাজই হোচ্ছে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হোতে হবে। হুজুর পাক (স:) আরবের তৎকালীন আইয়্যামে জাহেলিয়াতের পরস্পর দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত ঐক্যহীন, ভ্রাতৃত্বহীন একটি জাতিকে আল্লাহর সত্যদীনের আওতায় এনে এমন একটি জাতিতে রূপান্তরিত কোরলেন যাদেরকে আল্লাহ কোর’আনে সীসাঢালা প্রাচীরের সঙ্গে তুলনা কোরেছেন। রসুলাল্লাহ (দ:) বিদায় হজ্বের ভাষণে জাতির ঐক্য বিনষ্টকারী কাজকে কুফর বোলে আখ্যায়িত কোরেছেন। আজ এই জাতির মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, হানাহানি, জ্বালাও পোড়াও চোলছে তার পেছনে মূলত দায়ী আমাদের ঐক্যহীন হওয়ার প্রবণতা। ধর্মকে নিয়ে যারা ব্যবসা কোরছে, ধর্মকে যারা রুটি রুজির উপায় বানিয়ে নিয়েছে তারাই ধর্মের মধ্যে বিভিন্ন রকম তরিকা, ফেরকা, মাজহাব, মত-পথ সৃষ্টি কোরে জাতিকে হাজার হাজার ভাগে বিভক্ত কোরে রেখেছে, উম্মতে মোহাম্মদীর নামক জাতির ঐক্যকে ধ্বংস কোরে দিয়েছে। আর পশ্চিমা পরাশক্তিগুলি আমাদেরকে শোষণ ও শাসন করার উদ্দেশ্যে তাদের তৈরি করা কিছু রাজনৈতিক মতবাদ আমাদের উপরে চাপিয়ে দিয়েছে। তাদের চাপিয়ে দেওয়া সেই তন্ত্র, মন্ত্র, বাদ মতবাদের উপর ভিত্তি কোরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে, উপদলে আমরা বিভক্ত হোয়ে আছি। একটু আগেই বোলেছি, অনৈক্যের পরিণাম হোচ্ছে পরাজয়। এই অবস্থা থেকে বাঁচতে হোলে এখন আমাদের সামনে একটাই পথ, আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হোতে হবে। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হোই, তাহোলে পৃথিবীর বুকে আমরা হবো একটি পরাশক্তি। সমস্ত বিশ্বকে আমরা নেতৃত্ব দেবো এনশা’আল্লাহ।
শৃঙ্খলা
আল্লাহর দেওয়া কর্মসূচির দ্বিতীয় দফা হোচ্ছে শৃঙ্খলা। আরবীতে এই দ্বিতীয় দফাটি হোচ্ছে ‘সামেয়ু’ বা শোনা। সতর্কতার সাথে কোন বিষয়ে সদা, সর্বদা সচেতন হোয়ে থাকা বোঝায়। যখন কিছু মানুষ কোন বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হবে তখন সর্বপ্রথম যেটা প্রয়োজন- তাদের মধ্য যিনি নেতা থাকবেন তার কথা প্রত্যেকে শুনবে। এই শৃঙ্খলা ছাড়া ঐ ঐক্য এক মুহূর্তও টিকবে না। জাতির লোকজন তাদের রুজি রোজগার, জীবিকা নিয়ে যতই ব্যস্ত থাকুন, অতন্দ্র প্রহরীর মত তাদের কান পেতে রাখতে হবে তাদের নেতা কখন কি আদেশ, কি নির্দেশ দেন। সকলকে উপলব্ধি কোরতে হবে যে, সৃষ্টিজগতের বিধাতা একজন হওয়ার কারণেই কোথাও কোন বিশৃঙ্খলা নেই। তেমনি সমগ্র মানবজাতিরও বিধাতা একজন থাকতে হবে, একজন নেতার হুকুম তাদেরকে শুনতে হবে, নয়তো কখনোই শৃঙ্খলা আসবে না।
আনুগত্য
কর্মসূচির অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোচ্ছে আনুগত্য। আনুগত্য হোচ্ছে একটি পরিবার, গোষ্ঠী বা জাতির মেরুদণ্ড, এটা যেখানে দুর্বল সেখানেই অক্ষমতা এবং ব্যর্থতা। আল্লাহ কোর’আনে আদেশ কোরেছেনÑ আল্লাহর আনুগত্য করো, তাঁর রসুলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের মধ্য থেকে আদেশকারীর (নেতার) আনুগত্য করো (সুরা নেসা ৫৯)। নেতার আনুগত্যের ব্যাপারে রসুলাল্লাহ বলেন, ‘কোন ক্ষুদ্রবুদ্ধি, কান কাটা, নিগ্রো, ক্রীতদাসও যদি তোমাদের নেতা নিয়োজিত হয়, তবে তার কথা বিনা প্রশ্নে, বিনা দ্বিধায় শুনতে ও মানতে হবে।’ কারণ ঐ ব্যক্তি আল্লাহ এবং রসুলের প্রতিনিধি। তার আদেশ প্রকারান্তরে আল্লাহরই আদেশ। নির্দেশ পালন না করা হোলে ঐক্য ও শৃঙ্খলা যতই নিখুঁত হোক সেটা অর্থহীন। কথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই বিরোধিতা অপ্রত্যাশিত বা অবৈধ কিছু নয় বরং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত। এর পরিণতিতে প্রায়শই দেখা যায়, কোন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান যখনই তার জাতিকে কোন আদেশ বা বিধান দেন, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় এর বিরুদ্ধাচারণ ও সমালোচনা, ফলে সর্বক্ষণ সমাজে চোলতে থাকে বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা ও রাষ্ট্রের অবাধ্যতা।
হেজরত
হেজরত শব্দের অর্থ শুধু দেশ ত্যাগ করা নয়। হেজরত শব্দের অর্থঃ- “সম্পর্কচ্ছেদ করা, দল বর্জন করা, স্বদেশ পরিত্যাগ করিয়া ভিন্নদেশে গমন করা” (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ)। আল্লাহয় বিশ্বাসী অথচ মোশরেক আরবদের মধ্যে আবির্ভূত হোয়ে বিশ্বনবী যখন প্রকৃত তওহীদের ডাক দিলেন তখন যারা তাঁর সাথে যোগ দিলেন তারা আরবদের ঐ র্শেক ও কুফর থেকে হেজরত কোরলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টিকারী বিভিন্ন দল, মত ও তন্ত্র-মন্ত্র থেকে আমাদের হেজরত কোরতে হবে। পরাশক্তিগুলির চাপিয়ে দেওয়া এই তন্ত্র-মন্ত্রগুলি আমাদের মধ্যে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্বস্তির পরিবর্তে অন্যায়, অবিচার, মারামারি, অনৈক্য, বিভেদ, হানাহানি ইত্যাদি বাড়িয়েই চলেছে। আমরা যদি শান্তি চাই তাহোলে এই সব মতবাদগুলি থেকে আমাদের হেজরত কোরতে হবে। আল্লাহর নিষেধ থাকা সত্ত্বেও আমাদের সমাজের একটি শ্রেণি ধর্মকে রুটি রুজির মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছে। আরেকটি দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ধর্মকে নিজেদের ইচ্ছামত রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার কোরছে, এই সমস্ত ধর্মব্যবসায়ীদের থেকেও আমাদের হেজরত কোরতে হবে।
জেহাদ
কর্মসূচির প্রথম চারটি দায়িত্বের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যই হোল জেহাদ করা। জেহাদ শব্দের অর্থ হোচ্ছে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। আল্লাহর রসুল এসেছেন মানবজাতিকে শান্তিময় জীবনব্যবস্থার অধীনে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য। তাই আমাদেরকে মানবজাতির জীবনে শান্তি আনার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আমাদেরকে জেহাদ কোরতে হবে সমাজে প্রচলিত সকল অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, মিথ্যা ইত্যাদির বিরুদ্ধে। এই সংগ্রাম চালানোই আমাদের উদ্দেশ্য আর কর্মসূচির প্রথম চার দফা এই সংগ্রামের জন্য অপরিহার্য। জেহাদ বাদ দিয়ে কর্মসূচির প্রথম চারটি দফা পালন করা অর্থহীন।
আমরা সত্যিই যদি একটি শান্তিময় পার্থিব ও পরকালীন জীবন পেতে চাই, তবে আমাদেরকে আল্লাহর দেওয়া এই পদ্ধতি গ্রহণ কোরতে হবে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে আমাদেরকে কয়েকটি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে যে, কোন অজুহাতেই আমরা অন্যের বা দেশের সম্পদের ক্ষতি কোরব না; আমরা অন্যের সম্পত্তি নষ্ট কোরব না; আমরা অন্যায় উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার কোরব না, কারও প্ররোচণায় জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর ও সহিংসতা কোরব না। আমরা আমাদের জীবনে, কাজে কর্মে চিন্তায় ব্যবহারে হবো সুশৃঙ্খল। আমরা আল্লাহর হুকুমের আনুগত্য কোরব। আমরা সকল প্রকার মিথ্যা, অন্যায় মতবাদের অপ-রাজনীতি পরিত্যাগ কোরব। আমরা মৃত্যু পর্যন্ত সকল অন্যায় অবিচার ও অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কোরে যাবো এনশা’আল্লাহ।

Saturday, June 25, 2016

মানুষ এনেছে গ্রন্থ, -গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো

মানুষ এনেছে গ্রন্থ, -গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো

আতাহার হোসাইন


কমনসেন্স বা সাধারণ জ্ঞান এমন একটি বিষয় যা কারো ভিতরে না থাকলে অন্য কেউ তা ঢুকিয়ে দিতে পারে না। ধর্মের ব্যাপারে যখন সেই কমনসেন্স হারিয়ে যায় তখন গোটা ধর্মই তার মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে। তখন ধর্মের শরীয়াহ, বিধিবিধান কার্যকর থাকলেও সেসব অর্থহীন হয়ে যায়। পাশাপাশি সেই ধর্ম মানুষকে শান্তি না দিয়ে বরং অশান্তিই উপহার দেয়, এমতাবস্থায় ধর্মের আনুষ্ঠানিকতাই মুখ্য হয়ে উঠে। কথায় আছে ধর্ম মানুষের জন্য কিন্তু ধর্মের জন্য মানুষ নয়। ধর্মের ব্যাপারে এই কমনসেন্স হারিয়ে গেলে তখন মানুষের জন্য ধর্ম নয়, বরং ধর্মের জন্যই মানুষ-এটা প্রকট হয়ে উঠে। তখন ধার্মিকরা মানুষ মেরে ধর্মপালন করতেও দ্বিধাবোধ করে না।
বিষয়টি আরো একটু পরিষ্কার করতে স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী থেকে একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। একবার একদল তরুণ স্বামী বিবেকানন্দের আশ্রমে গিয়ে বলল, ‘স্বামীজি, বিহারে ভয়ানক মরণঘাতী গো-মড়ক দেখা দিয়েছে। আমরা এই কটি তরুণপ্রাণ গো-মড়ক রোধ করার জন্য প্রাণপাত করব বলে আপনার আশীর্বাদ ভিক্ষা করতে এসেছি।’ স্বামী বিবেকানন্দ তরুণদের আকুতি শুনে বললেন, ‘তোমরা দেশের গো-সম্পদ রক্ষার জন্য উদ্যোগী হয়েছ দেখে আমি যারপরনাই আনন্দিত হলাম। তবে, তোমরা জান না, পূর্ববাংলার অনেক এলাকায় মরণঘাতী কলেরা দেখা দিয়েছে। সেখানে প্রতিদিন বহু মানুষ মারা যাচ্ছে। আমি বলি কি, তোমরা মানুষের প্রাণ রক্ষার জন্য আগে পূর্ববাংলায় ছুটে যাও। কলেরা আক্রান্ত অসহায় মানুষের সেবায় আমার তরফ থেকে যা কিছু সাহায্যের প্রয়োজন তার সবই তোমরা পাবে।’ স্বামী বিবেকানন্দের কথা শুনে স্বেচ্ছাসেবী দলের নেতা গোছের এক তরুণ হায় হায় রব ছেড়ে বলল, ‘স্বামীজি, এ আপনি কি বলছেন। বিহারে গো-মড়কে গো-মাতা মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রোগাক্রান্ত গো-মাতার সেবা ফেলে আপনি আমাদের মানুষের সেবায় পূর্ববাংলায় যেতে বলছেন? সব শুনে স্বামীজি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘তা ঠিক। গো-মাতা বিনে এমন নির্বোধ সন্তান জগতে কে আর প্রসব করবে?’
অনুরূপভাবে আমরা বলতে চেয়েছি যে এই মুহূর্তে মুসলিম বিশ্ব যখন চরম দুরাবস্থায় পতিত, মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে যখন চরম ঐক্যহীন অবস্থার কারণে নিজেরা নিজেরা মারামারি, গৃহযুদ্ধ কিংবা ভীন জাতির আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে, যখন মাথার উপর প্রতিনিয়ত বোমারু বিমান চক্কর দিচ্ছে, বোমার আঘাতে দেহ খ–বিখ- হয়ে যাচ্ছে, যখন প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে মুসলমানরা নিজের দেশ থেকে পালিয়ে ছোট ছোট নৌ-যানে করে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে মরছে, ইউরোপের রাস্তায় রাস্তায় আশ্রয়ের খোঁজে দিন কাটাচ্ছে, ঠিক এই সময়ে এই জাতিরই অন্য সদস্য অর্থাৎ অন্য মুসলমানরা কিভাবে ঈদের আনন্দ উৎসব করে তা আমাদের মাথায় আসে না। মাথায় আসেনা লাখ লাখ টাকা খরচ করে কিভাবে তারা হজ্জ করতে যায়! এই দুর্ভোগে পতিত মানুষের জন্য তাদের কি কোন ভূমিকাই নেই?
আমাদের এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে অনেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে অনেকে আমাদেরকে ইসলামের প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রচার চালান। তারা আরো বলেন যে, হজ্জ কিংবা কোরবানী আল্লাহর হুকুম, ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। সুতরাং এসব করতেই হবে। এইসব প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকারীদের উদ্দেশ্যে আমাদের বক্তব্য হচ্ছেঃ হজ্জ কিংবা কোরবানী যে আল্লাহর হুকুম, ইসলাামের অন্যতম স্তম্ভ তা আমাদের অবশ্যই জানা আছে। কিন্তু আমারই স্বজাতি ভাইয়েরা যখন না খেয়ে মরছে, উদ্বাস্তু শিবিরে মানবেতর জীবন-যাপন করছে, সাগরে ডুবে মরছে, আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, তখন আমি কি করে আনন্দ-উৎসব করি? কিভাবে আমার মুখে অন্ন উঠে? কিভাবে আমার মুখে হাসি আসে? কিভাবে আমি বত্রিশ পাটি দন্ত বিকশিত করে গরুর সাথে ফেসবুকে ‘কাউফি’ আপলোড করি?
ভালো কথা যে- হজ্জ, কোরবানী ইত্যাদি আল্লাহর হুকুম। তা অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু ইসলাম কি এও বলেনি যে, প্রতিবেশীকে ক্ষুধার্ত রেখে যে উদরপূর্তি করে খায় তার নামাজ-রোজা করে সবই অর্থহীন হয়ে যায়? সুরা মাউন পড়ে দেখুন সেখানে আল্লাহ কি বলছেন।
আল্লাহ বলছেন: “আপনি কি দেখেছেন তাকে, যে বিচারদিবসকে মিথ্যা বলে?
সে সেই ব্যক্তি, যে এতীমকে গলা ধাক্কা দেয়
এবং মিসকীনকে অন্ন দিতে উৎসাহিত করে না।
অতএব দুর্ভোগ সেসব নামাযীর,
যারা তাদের নামায সম্বন্ধে বে-খবর;
যারা তা লোক-দেখানোর জন্য করে
এবং নিত্য ব্যবহার্য্য বস্তু অন্যকে দেয় না।”
অর্থাৎ যেসব মুসুল্লী এতীমকে গলা ধাক্কা দেয় এবং নিত্য ব্যবহার্য বস্তু অন্যকে দিয়ে সহযোগিতা করে না তারা প্রকৃতপক্ষে বিচার দিবসে অবিশ্বাসী। তাদেরকে আল্লাহ দুর্ভোগ আক্রান্ত হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন। আল্লাহ যাকে দুর্ভোগ আক্রান্ত বলেন তার অবস্থান কোথায়? সে কি আদৌ মো’মেন-মুসলিম থাকতে পারে? অপর দিকে রসুলাল্লাহ বলেছেন, মুসলিম জাতি একটি দেহের ন্যায়। দেহের কোন একটা অংশ ব্যথিত হলে যেমন সারা শরীর ব্যথা অনুভব করে তেমনি একজন মুসলিম আক্রান্ত হলেও সকল মুসলিম ব্যথিত হবে। আল্লাহ রসুলের বক্তব্য অনুযায়ীই সেই কাউফি আপলোডকারী, মহাসমারোহে একাধিক গরু কোরবানীকারীদের অবস্থান আজ কোথায়? লাখ লাখ টাকা খরচ করে হজ্জকারীর হজ্জই বা জাতির জন্য কী কল্যাণ বয়ে আনছে? তাদের নামাজ, তাদের কোরবানী, তাদের হজ্জ তাহলে তাদেরকে কী শিক্ষা দিল? তারা কি সত্যিকার অর্থে মানবিক হতে পেরেছে?
পাঠক খেয়াল করে দেখবেন ধর্মের আইন, হুকুম কোনটাই মানবিকতার উর্ধ্বে নয়। আপনি মসজিদের পানে নামাজের জন্য ছুটছেন। এমতাবস্থায় দুর্ঘটনা আক্রান্ত কোন মুমূর্ষু ব্যক্তি যদি কাতরাতে থাকে তাহলে আপনি কি আগে আল্লাহর হুকুম পালন করতে মসজিদে ছুটবেন নাকি তাকে বাঁচানোর জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাবেন? যদি আপনি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান সেটাই হবে উত্তম কাজ। ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন ঈসা (আ)। মুসার (আ) আনীত দীনের শরীয়া পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করলেও সে সময়ের ইহুদিরা ধর্মের প্রাণ অর্থাৎ মানবিকতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। শনিবারে দুনিয়াবী কোন কাজ করা যাবে না- এটা ছিল শরীয়াহর অংশ। কিন্তু এই দীনে অন্ধের চোখ ভালো করা কিংবা অন্যের উপকার করার মত মানবিক কাজগুলো সে শরীয়াহর অন্তরায় নয় তা বোঝাতে তিনি ঠিক সেই শনিবারেই এক জন্মান্ধের চোখে হাত বুলিয়ে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিলেন। আজকের কমনসেন্সবিহীন জাতির মত তখনকার ইহুদিরাও তাতে প্রচুর গোস্বা করে ঈসাকে (আ) ধর্মদ্রোহী হিসেবে আখ্যা দিয়ে তাঁর বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছিল। একইভাবে আমরা যখন বলার চেষ্টা করছি যে ধর্মের জন্য মানুষ নয় বরং মানুষের জন্য ধর্ম, আনুষ্ঠানিক এবাদতের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আর্ত-পীড়িতকে উদ্ধার করা তখন কমনসেন্স হারানো মানুষগুলো আমাদের সামনে আল্লাহর হুকুমের কথা তুলে ধরছেন, আমাদেরকে নাস্তিক, ইসলামবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। পরিশেষে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা মানুষ কবিতার দুটো লাইন তুলে ধরছি।
“মানুষেরে ঘৃণা করি
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি
ও মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে ।
পুজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল! মুর্খ্যরা সব শোনো
মানুষ এনেছে গ্রন্থ,-গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।”
এরপরেও যাদের হুঁশ ফিরবেনা স্বয়ং আল্লাহ ছাড়া আর কেউ তাদের হুঁশ ফিরাতে পারবে বলেও মনে হয় না।

তওহীদ জান্নাতের চাবি

তওহীদ জান্নাতের চাবি
মাহবুব আলী

মহানবী (সা.) বলেছেন- “জান্নাতের চাবি হচ্ছে- আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা (ইলাহ) নেই” (মুয়াজ বিন জাবাল থেকে আহমদ, মেশকাত)। অপর হাদিসে এসেছে- যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে “আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা (ইলাহ) নেই এবং মোহাম্মদ (সা.) তাঁর প্রেরিত” তার জন্য জাহান্নাম হারাম হয়ে যাবে। (ওবাদাহ বিন সামিত থেকে মুসলিম, মেশকাত)। এছাড়াও অনেক হাদীস থেকে দেখানো যাবে যে, তওহীদই জান্নাতের চাবি। কালিমা তথা তওহীদের স্বীকৃতি না দিলে যেমন মুমিন মুসলিম থাকা যায় না ঠিক তেমনই স্বীকৃতি দানের পর আবার তওহীদের ওপর থেকে সরে গেলেও আর মুমিন মুসলিম থাকা যায় না, আর এটা সবাই জানে যে, মুমিন মুসলিম না থাকলে সে জান্নাতে যেতে পারবে না, সে যতই ইবাদত করুক। দীনুল হকের ভিত্তি হচ্ছে তওহীদ অর্থাৎ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এই কালিমাটি, এ নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। তওহীদ ব্যতীত কোনো ইসলামই হতে পারে না, তওহীদই ইসলামের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, মুসলিম বলে পরিচিত এই জনসংখ্যাটি তওহীদ সম্পর্কে যে ধারণা (আকিদা) পোষণ করে তা ভুল। তাদের কাছে তওহীদ মানে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করা এবং তাঁর ইবাদত বা উপাসনা করা। ‘তওহীদ’ এবং ‘ওয়াহদানিয়াহ্’ এই আরবি শব্দ দু’টি একই মূল থেকে উৎপন্ন হলেও এদের অর্থ এক নয়। ‘ওয়াহদানিয়াহ্’ বলতে বোঝায় মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ যে একজন তা বিশ্বাস করা (একত্ববাদ-Monotheism), পক্ষান্তরে ‘তওহীদ’ মানে ঐ এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়া, তাঁর ও কেবলমাত্র তাঁরই নিঃশর্ত আনুগত্য করা। আরবের যে মুশরিকদের মধ্যে আল্লাহর শেষ রসুল এসেছিলেন, সেই মুশরিকরাও আল্লাহর একত্বে, ওয়াহদানিয়াতে বিশ্বাস করত, কিন্তু তারা আল্লাহর হুকুম, বিধান মানত না অর্থাৎ তারা আল্লাহর আনুগত্য করত না। তারা তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সামষ্টিক জীবন নিজেদের মনগড়া নিয়ম-কানুন দিয়ে পরিচালনা করত। এই আইনকানুন ও জীবন ব্যবস্থার উৎস ও অধিপতি হিসাবে ছিল বায়তুল্লাহ, কা’বার কুরায়িশ পুরোহিতগণ। মূর্তিপূজারী হওয়া সত্ত্বেও তাদের এই ঈমান ছিল যে, এ বিশ্বজগতের স্রষ্টা আল্লাহ একজনই এবং তাদের এই ঈমান বর্তমানে যারা নিজেদেরকে মুমিন মুসলিম বলে জানে এবং দাবি করে তাদের চেয়ে কোনো অংশে দুর্বল ছিল না (সুরা যুখরুফ ৯, আনকাবুত ৬১, লুকমান ২৫)। কিন্তু যেহেতু তারা আল্লাহর প্রদত্ত হুকুম মানত না, তাই তাদের ঐ ঈমান ছিল অর্থহীন, নিষ্ফল এবং স্বভাবতঃই আল্লাহর হুকুম না মানার পরিণতিতে তাদের সমাজ অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, নিরাপত্তাহীনতা, সংঘর্ষ ও রক্তপাতে পরিপূর্ণ ছিল, এ জন্য আরবের ঐ সময়টাকে আইয়্যামে জাহেলিয়াত বলা হয়। আল্লাহর হুকুমের প্রতি ফিরিয়ে আনার জন্যই তাদের মধ্যে রসুল প্রেরিত হয়েছিলেন। রসুলও সে কাজটিই করেছিলেন, ফলশ্রুতিতে অন্যায় অশান্তিতে নিমজ্জিত সেই সমাজটি নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার, সুখ-সমৃদ্ধিতে পূর্ণ শান্তিময় (ইসলাম অর্থই শান্তি) একটি সমাজে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং আল্লাহর আনুগত্য না করাই ছিল তাদের কাফের মুশরিক হওয়ার প্রকৃত কারণ। বর্তমানের মুসলিমরা উপলব্ধি করতে পারছে না যে প্রাক-ইসলামিক যুগের আরবের কাঠ পাথরের মূর্তিগুলিই এখন গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদির রূপ ধরে আবির্ভূত হয়েছে এবং মুসলিম জনসংখ্যাটি আল্লাহর পরিবর্তে এদের তথা এদের প্রবর্তক ও পুরোধা ‘পুরোহিতদের’ আনুগত্য করে যাচ্ছে। এই প্রতিটি তন্ত্র আলাদা আলাদা একেকটি দীন (জীবনব্যবস্থা), ঠিক যেমন দীনুল হক ‘ইসলাম’ও একটি জীবনব্যবস্থা। পার্থক্য হলো, এই মানবরচিত দীনগুলি মানবজীবনের বিশেষ কিছু অঙ্গনের, বিশেষ কিছু বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে, কিন্তু সঠিক সমাধান দিতে পারে না আর ইসলাম মানবজীবনের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় থেকে শুরু করে সামষ্টিক অঙ্গনের সকল বিষয়ে সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা দিয়ে থাকে। বর্তমানের মুসলিম নামক জনসংখ্যাটি এই সকল মানবরচিত তন্ত্রের প্রতিমার আনুগত্য করে সেই পৌত্তলিক আরবদের মতই মুশরিক ও কাফেরে পরিণত হয়েছে। আল্লাহর রসুল এসে মুশরিক আরবদেরকে আল্লাহর তওহীদের ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি সেখানে আল্লাহর একত্ববাদ (ওয়াহদানিয়াত) প্রতিষ্ঠা করেন নি, কারণ আল্লাহর একত্ববাদের বিষয়ে সেই মুশরিকদের আগে থেকেই সুদৃঢ় ঈমান ছিল (সুরা ইউসুফ- ১০৬)। তারা তাদের দেবদেবীর কোনোটিকেই আল্লাহ মনে করত না, স্রষ্টা বা প্রভুও ভাবত না, তারা সেগুলির পূজা করত এই বিশ্বাসে যে সেগুলি তাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সাহায্য করবে এবং তাদের হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে (সুরা ইউনুস- ১৮, সুরা যুমার- ৩)। সুতরাং মূর্তি পূজার নেপথ্যে তাদের প্রকৃত উপাস্য আল্লাহই ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে যে মতবাদগুলির আনুগত্য করা হচ্ছে এর মধ্যে কোথাও আল্লাহর স্থান নেই, এগুলি আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কেই সম্পূর্ণ নির্বিকার। ফলে বর্তমানের মুমিন মুসলিম হবার দাবিদারগণ যে শেরক ও কুফরে লিপ্ত তা নিঃসন্দেহে ১৪০০ বছর আগের আরবদের শেরক ও কুফরের চেয়েও নিকৃষ্টতর।

‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ যে ‘আনুগত্য করা’, উপাসনা করা নয় তা কোর’আনের বহু আয়াত থেকে বোঝা যায়। সুরা ফাতাহ’র ১৭নং আয়াতে আল্লাহ বলছেন, ‘যে আল্লাহ এবং তাঁর রসুলের আনুগত্য করে আল্লাহ তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ এখানে জান্নাতে যাওয়ার পূর্বশর্ত আল্লাহ দিলেন, যে আনুগত্য করে, বললেন না যে, ‘ইবাদত, উপাসনা করে।’ এখানে তিনি অন্য কোনো আমলের কথাও বললেন না, না সালাহ কায়েম, না যাকাত প্রদান, না হজ্ব, না সওম, অন্যান্য ছোটখাটো আমলের তো কথাই নেই। তিনি জান্নাত প্রদানের ওয়াদা করলেন শুধুই তাঁর এবং তাঁর রসুলের আনুগত্যের বিনিময়ে। সুরা নেসার ৬৯নং আয়াতটি দেখুন, আল্লাহ বলছেন, ‘যে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের হুকুম মান্য করবে সে নবী, শহীদ, সিদ্দিক ও সালেহীনদের সঙ্গে (অর্থাৎ জান্নাতে) থাকবে।’ এখানেও ‘আনুগত্য করা’ ছাড়া আর কোনো শর্ত আল্লাহ দেন নি। সুতরাং কালিমায় ব্যবহৃত ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ ‘উপাস্য’ হওয়া সম্ভব নয়, এর অর্থ অবশ্যই ‘যার আনুগত্য করা হয়, হুকুম পালন করা হয়’। আল্লাহর দাবি হচ্ছে, প্রথমে মানুষকে এই অঙ্গীকারে আবদ্ধ হতে হবে যে আল্লাহ যা হুকুম করবেন তাই সে মেনে নিবে এবং তাঁর আনুগত্য করবে। তারপর এই চুক্তি বাস্তবায়নকল্পেই সে আল্লাহর ইবাদত করতে বাধ্য, কারণ আল্লাহর হুকুম হচ্ছে একমাত্র তাঁরই ইবাদত করা। তাহলে বোঝা গেল, প্রথম কাজ আল্লাহর আনুগত্য মেনে নেওয়া, তারপরে তাঁর ইবাদত করা। সুরা আম্বিয়ার ২৫ নং আয়াতটি দেখুন, আল্লাহ বলছেন, “আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই, সুতরাং তাঁর ইবাদত করো।” যদি ইবাদত করাই প্রথম ও প্রধান কাজ হোত তাহলে আয়াতটি হোত এমন যে, “আল্লাহ ছাড়া মা’বুদ (ইবাদত, বন্দনা পাওয়ার অধিকারী) কেউ নয়, সুতরাং তাঁরই আনুগত্য করো”, আরবিতে লা মা’বুদ ইল্লাল্লাহ, ফা আত্তাবিয়্যুহু। কিন্তু কোর’আনে এমনটা একবারও বলা হয় নি। সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ ‘ইলাহ’ এবং ‘মা’বুদ’ শব্দ দু’টি ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন কারণ এদের অর্থও সম্পূর্ণ আলাদা।
মোটকথা, এই ১৫০ কোটির জনসংখ্যাটি, যারা নিজেদেরকে কেবল মুসলিমই নয়, একেবারে মুমিন ও উম্মতে মোহাম্মদী বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, তারা এগুলির কোনোটিই নয়, তারা কার্যত মুশরিক এবং কাফের। আল্লাহ বলছেন, ‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা হুকুম (বিচার ফায়সালা) করে না তারা কাফের, জালেম, ফাসেক (সুরা মায়েদা ৪৪, ৪৫, ৪৭)। এই আয়াতগুলিতে ‘হুকুম’ শব্দটি দিয়ে কেবল আদালতের বিচারকার্যই বোঝায় না, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক অর্থাৎ সামগ্রিক জীবন তাঁর নাযিল করা বিধান অর্থাৎ কোর’আন (এবং সুন্নাহ) মোতাবেক পরিচালনা করাকেও বোঝায়। মুমিন মুসলিম হবার দাবিদারগণ এখন আর একটি সু-সংহত উম্মাহরূপে নেই, তারা ভৌগোলিকভাবে পঞ্চাশটিরও বেশী জাতিরাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে ইউরোপীয় খ্রিষ্টান, ইহুদি ও পৌত্তলিকদের দাসে পরিণত হয়েছে, তাই তারা তাদের সামষ্টিক কার্যাবলী আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে ফায়সালা করে না। ফলশ্রুতিতে তারা ফাসেক (অবাধ্য), জালেম (অন্যায়কারী) এবং কাফেরে (প্রত্যাখ্যানকারী) পরিণত হয়েছে। আল্লাহ প্রদত্ত বিধানগুলিকে অপাংক্তেয় করে রেখে তারা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের আইন, কানুনগুলি নিজেদের দেশে প্রবর্তন করে তা দিয়ে সামষ্টিক কার্যাবলী পরিচালনা করছে।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই আমরা পরিস্কারভাবে বুঝতে পেরেছি যে তওহীদ ও দীন যে দুটি ভিন্ন বিষয় এবং এ দুটির তফাৎ কী। তওহীদ হচ্ছে ভিত্তি এবং দীন হচ্ছে এই ভিত্তির উপর নির্মিত অবকাঠামো, দালান। তওহীদ হচ্ছে, “একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য সকল সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করা এবং প্রতিটি বিষয়ে তাঁর হুকুমের আনুগত্য করা। সংক্ষেপে জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁর ও তাঁর রসুলের (স:) হুকুম মানা, প্রতিটি বিষয়ে যেখানেই তাঁর কোনো বক্তব্য আছে তা বিনা প্রশ্নে, বিনা দ্বিধায় মেনে নেওয়া। যে বিষয়ে তাঁর অথবা তাঁর রসুলের কোনো বক্তব্য নেই সে বিষয়ে, তা ব্যক্তিগত হোক বা সমষ্টিগত, আমরা স্বাধীনভাবে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি।”
এখন আমরা যদি মুক্তি পেতে চাই, জান্নাতে যেতে চাই, মুমিন-মুসলিম হতে চাই তবে আমাদের আগে কালিমাতে ফিরে আসতে হবে, আমাদেরকে আগে স্বীকৃতি দিতে হবে, “যেখানেই আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কোনো হুকুম, নির্দেশনা আছে সেখানে আর কারো হুকুম মানি না।” আর এই কালিমার ভিত্তির উপর আমাদের একতাবদ্ধ হতে হবে।

Thursday, June 23, 2016

ইলাহ অর্থ: যাঁর হুকুম মানতে হবে

ইলাহ অর্থ: যাঁর হুকুম মানতে হবে

মাননীয় এমামুযযামানের লেখা থেকে সম্পাদিত

‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এই বাক্যটি হচ্ছে দীনুল হকের ভিত্তি। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, মুসলিম বলে পরিচিত এই জনসংখ্যাটি তওহীদ সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে (আকিদা) তা ভুল। তাদের কাছে তওহীদ মানে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করা এবং তাঁর এবাদত বা উপাসনা করা। ‘তওহীদ’ এবং ‘ওয়াহদানিয়াহ্’ এই আরবি শব্দ দু’টি একই মূল থেকে উৎপন্ন হলেও এদের অর্থ এক নয়। ‘ওয়াহদানিয়াহ্’ বলতে বোঝায় মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ যে একজন তা বিশ্বাস করা (একত্ববাদ-Monotheism), পক্ষান্তরে ‘তওহীদ’ মানে ঐ এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়া, তাঁর ও কেবলমাত্র তাঁরই নিঃশর্ত আনুগত্য করা। এই আনুগত্য কেবল ধর্মীয় কাজে নয়, মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারাবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, আইন-কানুন, দ-বিধি, প্রশাসনিক অর্থাৎ যে কোনো অঙ্গনেই হোক, আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কোনো হুকুম বা অভিমত থাকলে সে বিষয়ে আর কারও কোনো কথা মানি না, এটাই হচ্ছে তওহীদের মর্মবাণী।
আরবের যে মোশরেকদের মধ্যে আল্লাহর শেষ রসুল এসেছিলেন, সেই মোশরেকরাও আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করত, কিন্তু তারা আল্লাহর হুকুম, বিধান মানতো না অর্থাৎ তারা আল্লাহর আনুগত্য করত না। তারা তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সামষ্টিক জীবন নিজেদের মনগড়া নিয়ম-কানুন দিয়ে পরিচালনা করত। এই আইনকানুন ও জীবন ব্যবস্থার উৎস ও অধিপতি হিসাবে ছিল বায়তুল্লাহ, কা’বার কোরায়েশ পুরোহিতগণ। মূর্তিপূজারী হওয়া সত্ত্বেও তাদের এই ঈমান ছিল যে, এ বিশ্বজগতের স্রষ্টা আল্লাহ একজনই এবং তাদের এই ঈমান বর্তমানে যারা নিজেদেরকে মো’মেন মুসলিম বলে জানে এবং দাবি করে তাদের চেয়ে কোনো অংশে দুর্বল ছিল না (সুরা যুখরুফ ৯, আনকাবুত ৬১, লোকমান ২৫)। কিন্তু যেহেতু তারা আল্লাহর প্রদত্ত হুকুম মানতো না, তাই তাদের ঐ ঈমান ছিল অর্থহীন, নিষ্ফল এবং স্বভাবতঃই আল্লাহর হুকুম না মানার পরিণতিতে তাদের সমাজ অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, নিরাপত্তাহীনতা, সংঘর্ষ ও রক্তপাতে পরিপূর্ণ ছিল। তাদের স্রষ্টা আল্লাহর হুকুমের প্রতি ফিরিয়ে আনার জন্যই তাদের মধ্যে রসুল প্রেরিত হয়েছিলেন। রসুলও সে কাজটিই করেছিলেন, ফলশ্রুতিতে অন্যায় অশান্তিতে নিমজ্জিত সেই সমাজটি নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার, সুখ-সমৃদ্ধিতে পূর্ণ শান্তিময় একটি সমাজে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং আল্লাহর আনুগত্য না করাই ছিল তাদের কাফের মোশরেক হওয়ার প্রকৃত কারণ। বর্তমানের মুসলিমরা উপলব্ধি করতে পারছে না যে প্রাক-ইসলামিক যুগের আরবের কাঠ পাথরের মূর্তিগুলিই এখন গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদির রূপ ধরে আবির্ভূত হয়েছে এবং মুসলিম জনসংখ্যাটি আল্লাহর পরিবর্তে এদের তথা এদের প্রবর্তক ও পুরোধা ‘পুরোহিতদের’ আনুগত্য করে যাচ্ছে এবং তারাও সেই পৌত্তলিক আরবদের মতোই মোশরেক ও কাফেরে পরিণত হয়েছে।
যদি এ জনসংখ্যাটি সত্যিই মো’মেন, মুসলিম ইত্যাদি হয়ে থাকে তাহলে কোর’আনের অনেক আয়াত মিথ্যা হয়ে যায়, যা হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। আল্লাহ ওয়াদা করেছেন- তোমরা যদি মো’মেন হও তবে পৃথিবীর কর্তৃত্ব তোমাদের হাতে দিব যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে দিয়েছিলাম (সুরা নূর ৫৫)। তাঁর ওয়াদা যে সত্য তার প্রমাণ নিরক্ষর, চরম দরিদ্র, সংখ্যায় মাত্র পাঁচ লাখের উম্মতে মোহাম্মদীর হাতে তিনি অর্ধ-পৃথিবীর কর্তৃত্ব তুলে দিয়েছিলেন। প্রশ্ন হলো, আমরা নিজেদের মো’মেন বলে দাবি করি, তাহলে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পৃথিবীর কর্তৃত্ব, আধিপত্য আমাদের হাতে নেই কেন? সেই সর্বশক্তিমান কি তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে অসমর্থ (নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক)? তিনি আরও বলেছেন, তিনি মো’মেনদের ওয়ালী (বাকারা ২৫৭)। ওয়ালী অর্থ- অভিভাবক, বন্ধু, রক্ষক ইত্যাদি। আল্লাহ যাদের ওয়ালী তারা কোনোদিন শত্রুর কাছে পরাজিত হতে পারে? তারা কোনোদিন পৃথিবীর সর্বত্র অন্য সমস্ত জাতির কাছে লাঞ্ছিত, অপমানিত হতে পারে? তাদের মা-বোনরা শত্রুদের দ্বারা ধর্ষিতা হতে পারে? অবশ্যই নয়। এর একমাত্র জবাব হচ্ছে- আমরা যতই নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, যতই হাজার রকম এবাদত করি, যতই মুত্তাকী হই, আমরা মো’মেন নই, মুসলিম নই, উম্মতে মোহাম্মদী হবার তো প্রশ্নই ওঠে না।
এই জনসংখ্যাটি কিভাবে ইসলামের ভিত্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ থেকে সরে গেছে তা ব্যাখ্যা করছি। আদম (আ.) থেকে শুরু করে শেষ নবী মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত এ কলেমায় কখনোই “ইলাহ” শব্দটি ছাড়া অন্য কোনো শব্দ ব্যবহৃত হয় নি। নিসন্দেহে আল্লাহই আমাদের একমাত্র উপাস্য মা’বুদ, স্রষ্টা, পালনকর্তা, তবে এগুলি স্বীকার করে নেওয়া এই দীনের ভিত্তি নয়, কলেমা নয়। বরং কলেমা হচ্ছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। আল্লাহকে ইলাহ হিসাবে না মেনে কেউ মো’মেন হতে পারবে না।
কলেমায় ব্যবহৃত ‘ইলাহ’ শব্দের প্রকৃত অর্থ, ‘যাঁর হুকুম মানতে হবে’ (He who is to be obeyed)। শতাব্দীর পর শতাব্দীর কাল পরিক্রমায় যেভাবেই হোক এই শব্দটির অর্থ ‘হুকুম মানা বা আনুগত্য’ থেকে পরিবর্তিত হয়ে ‘উপাসনা, বন্দনা, ভক্তি বা পূজা করা (He who is to be worshiped) হয়ে গেছে। বর্তমানে সারা দুনিয়ায় খ্রিষ্টানদের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলিতে কলেমার অর্থই শেখানো হয় – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মানে আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। কোর’আনের ইংরেজি অনুবাদগুলিতেও কলেমার এই অর্থই করা হয় (is none to be worshiped other than Allah)। অসঙ্গতিটি দিবালোকের মতো পরিষ্কার। ‘উপাস্য’ কথাটির আরবি হচ্ছে ‘মা’বুদ’, তাই “আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই” এই বাক্যটিকে আরবি করলে দাঁড়ায় “লা মা’বুদ ইল্লাল্লাহ’, যা ইসলামের কলেমা নয়। কোনো অমুসলিম এই সাক্ষ্য দিয়ে মুসলিম হতে পারবে না। কলেমার ‘ইলাহ’ শব্দটির অর্থ ভুল বোঝার ভয়াবহ পরিণতি এই হয়েছে যে সম্পূর্ণ মুসলিম জনসংখ্যাটি এই দীনের ভিত্তি থেকেই বিচ্যুত হয়ে বিপদগামী হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ পাল্টে যাওয়ায় এই মুসলিম জনসংখ্যার কলেমা সংক্রান্ত ধারণাই পাল্টে গেছে। বর্তমানে এই জাতির আকিদায় আল্লাহর হুকুম মানার কোনো গুরুত্ব নেই, তাঁর উপাসনাকেই যথেষ্ট বলে মনে করা হচ্ছে। কলেমার অর্থ সম্পর্কে এই ভুল আকিদা এই জনসংখ্যার আত্মায় এবং অবচেতন মনে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে। ফলে সারা দুনিয়াতে এমন কোনো দল নেই, এমন কোনো রাষ্ট্র নেই যারা তাদের সামষ্টিক, জাতীয় জীবনে আল্লাহর হুকুম মেনে চলছে, যা কিনা ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর আদেশ নিষেধ মানার চেয়ে বহুগুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য। জাতীয় জীবনে আল্লাহকে অমান্য করে তার বদলে উপাসনা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি দিয়ে আসমান জমিন ভর্তি করে ফেলা হচ্ছে, কিন্তু সেই পর্বত সমান উপাসনাও বিশ্বময় তাদের করুণ দুর্দশার প্রতি দয়াময় আল্লাহর কৃপাদৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে, বিজাতির হাতে তাদের অবর্ণনীয় নিপীড়ন, লাঞ্ছনা, পরাজয়, অপমান, নিগ্রহ বন্ধ তো হচ্ছেই না, বরং দিন দিন আরো বেড়ে চলছে।
এই ১৬০ কোটির জনসংখ্যাটি, যারা নিজেদেরকে কেবল মুসলিমই নয়, একেবারে মো’মেন ও উম্মতে মোহাম্মদী বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, তারা এগুলির কোনোটিই নয়, তারা কার্যত মোশরেক এবং কাফের। আল্লাহ বলছেন, ‘আল্লাহ যা নাযেল করেছেন সে অনুযায়ী যারা হুকুম (বিচার ফায়সালা) করে না তারা কাফের, জালেম, ফাসেক (সুরা মায়েদা ৪৪, ৪৫, ৪৭)। এই আয়াতগুলিতে ‘হুকুম’ শব্দটি দিয়ে কেবল আদালতের বিচারকার্যই বোঝায় না, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক অর্থাৎ সামগ্রিক জীবন তাঁর নাযেল করা বিধান অর্থাৎ কোর’আন (এবং সুন্নাহ) মোতাবেক পরিচালনা করাকেও বোঝায়। মো’মেন মুসলিম হবার দাবিদারগণ এখন আর একটি জাতি হিসাবে নেই, তারা ভৌগোলিকভাবে পঞ্চাশটিরও বেশি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে কার্যত ভিনজাতির দাসে পরিণত হয়েছে, তাই তারা তাদের সামষ্টিক কার্যাবলী আল্লাহর নাযেলকৃত বিধান দিয়ে ফায়সালা করে না। ফলশ্রুতিতে তারা ফাসেক (অবাধ্য), জালেম (অন্যায়কারী) এবং কাফেরে (প্রত্যাখ্যানকারী) পরিণত হয়েছে। আল্লাহ প্রদত্ত বিধানগুলিকে অকার্যকর রেখে তারা ভিনজাতির আইন, কানুনগুলি নিজেদের দেশে প্রবর্তন করে তা দিয়ে সামষ্টিক কার্যাবলী পরিচালনা করছে।
এমতাবস্থায়, মহান আল্লাহ আবার মানবজাতিকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় হিসাবে যামানার এমাম জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীকে আবার সেই প্রকৃত তওহীদের জ্ঞান দান করেছেন। তিনি ১৯৯৫ সনে হেযবুত তওহীদ আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করে এর মাধ্যমে মানুষকে তওহীদ গ্রহণের আহ্বান জানাতে শুরু করেন। এখন এ জাতির সামনে পার্থিব ও পারলৌকিক মুক্তির জন্য একটি মাত্র পথ খোলা আছে, তা হলো এ যামানার এমামের এই ডাকে সাড়া দিয়ে তওহীদের চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হবে অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য সকলকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে হুকুমদাতা, অর্থাৎ সার্বভৌম হিসাবে অস্বীকার করতে হবে এবং এই তওহীদকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জেহাদ (সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, সংগ্রাম) করতে হবে।

হেদায়াহ্হীন তাকওয়া অর্থহীন

হেদায়াহ্হীন তাকওয়া অর্থহীন

মোফাজ্জল হোসাইন সর্দার

দীনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বুনিয়াদী বিষয় আকিদা ও ঈমানকে যেমন একই বিষয় করে ফেলা হয়েছে তেমনি হেদায়াহ ও তাকওয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে এ দু’টি বিষয়কেও এক করে ফেলা হয়েছে।
আমাদের বর্তমান বিকৃত আকিদায় আমরা ইসলামকে যে দৃষ্টিতে দেখি তাতে ‘ধর্মকর্ম’ করে না এমন একটি লোককে যদি উপদেশ দিয়ে নামাজ রোজা করানো যায়, যাকাত দেয়ানো যায়, মিথ্যা পরিহার করানো যায়, সত্য কথা বলানো যায়, এক কথায় সব রকম অন্যায়-মিথ্যাচার থেকে তাকে বাঁচিয়ে পবিত্র জীবন-যাপন করানো যায়, তবে বলা হয় লোকটি হেদায়েত হয়েছে। ভুল বলা হয়, সে হেদায়াত হয় নি, সে তাকওয়া অবলম্বন করেছে অর্থাৎ মুত্তাকী হয়েছে। হেদায়াত ও তাকওয়া দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। হেদায়াত অর্থ সঠিক পথে চলা। আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা.) যে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন, যে গন্তব্য স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন সেই পথে চলা। সেটা কোন্ পথ? সেটা হলো ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’’ সহজ-সরল পথ। ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ কী তা তাকওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পরিষ্কারভাবে জেনে নেওয়া দরকার।
ইবলিস আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করল যে মাটি দিয়ে তৈরি তোমার খলিফা আদমকে (মানবজাতিকে) তোমার দেখানো পথ থেকে বিচ্যুত করে তাকে তার নিজের তৈরি করা পথে নিয়ে যাবো যে পথে চলার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হবে মানুষের জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে অশান্তি, অবিচার এবং যুদ্ধ ও রক্তপাত (ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা)। আল্লাহ ইবলিসের ঐ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন এবং তাকে বললেন, আমি মানুষ জাতির মধ্যে আমার নবী-রসুল পাঠিয়ে এমন পথ দেখাব- যে পথে চললে তারা তোমার ঐ অশান্তি-অবিচার, অত্যাচার ও রক্তপাতের মধ্যে যেয়ে পড়বে না। আমার নবী-রসুলদের দেখানো পথে চললে তারা সুবিচার ও শান্তির মধ্যে বাস করবে। এই পথের নাম দিলেন তিনি সিরাতুল মুস্তাকীম; সহজ সরল পথ। এই সহজ সরল পথ কী? এটা হলো “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ, হুকুমদাতা, বিধানদাতা নেই; উপাস্য নেই, প্রভু নেই, কাজেই আর কারো আদেশ নিষেধ না মানা; জীবনের কোনো ক্ষেত্রে আর কারো আইন-কানুন না মানা অর্থাৎ প্রকৃত তওহীদ। আল্লাহ তার প্রদর্শিত পথ এত সহজ কেন করলেন? এই জন্য করলেন যে মানুষ যদি তার আইন, আদেশ নিষেধ ছাড়া অন্য কোনো আইন, জীবন-বিধান না মানে তবেই ইবলিস পরাজিত হবে। সে আর মানুষকে অন্য কোনো পথে পরিচালিত করতে পারবে না এবং মানুষও অশান্তি, অবিচার আর রক্তপাতের মধ্যে পতিত হবে না। কাজেই মানবজাতির মধ্যে যারা এই সিরাতুল মুস্তাকীমে চলবে তারা আল্লাহর দলে, আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য যে কোনো জীবন-বিধানকে স্বীকার করবে সেটা সম্পূর্ণই হোক বা আংশিকই হোক, তারা ইবলিসের দলে। বিকৃত আকিদায় তারা ব্যক্তি জীবনে সারারাত নামাজ পড়লেও সারা বছর রোজা থাকলেও সেই ইবলিসের দলে। এই সহজ সরলতাকে বোঝাবার জন্য রসুলাল্লাহ (সা.) বলেছেন- মানুষের সাথে আল্লাহর চুক্তি হচ্ছে এই যে, মানুষ আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ইলাহ বলে স্বীকার করবে না, আল্লাহর পক্ষ থেকে চুক্তি হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তাকে জান্নাত দেবেন। এখানে নামাজ, রোজা, হজ্ব ইত্যাদির কোনো শর্ত আল্লাহ রাখেন নি। এই হলো সহজ সরল পথ, সিরাতুল মুস্তাকীম। এই পথে চলা হলো হেদায়াতের পথে চলা, এই হলো আল্লাহর দেয়া দিক-নির্দেশনা।
এখন তাকওয়া অর্থ কী? তাকওয়ার অর্থ সাবধানে জীবনের পথ চলা। কোথায় পা ফেলছেন তা দেখে পথ চলা। অর্থাৎ জীবনের পথ চলায় ন্যায়-অন্যায়, ঠিক-অঠিক দেখে চলা, অসৎ কাজ পরিহার করে সৎ কাজ করে চলা। কোর’আনের অনুবাদগুলিতে তাকওয়া শব্দের অনুবাদ করা হয়েছে, ‘আল্লাহভীতি’ দিয়ে, ইংরেজিতে “Fear of God” দিয়ে। তাতে প্রকৃত অর্থ প্রকাশ পায় না। কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায় এর মাপকাঠি আসবে কোথা থেকে? এর মাপকাঠি অবশ্যই আল্লাহ ন্যায়-অন্যায়ের যে মাপকাঠি দিয়েছেন সেইটা, অন্য কোনো মাপকাঠি নয়। কাজেই সে হিসাবে আল্লাহভীতি এবং Fear of God শব্দগুলো চলে এবং সেই হিসাবেই তাকওয়া শব্দের অনুবাদে ওগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। ইংরেজি অনুবাদে আল্লামা ইউসুফ আলী অনুবাদ করেছেন Fear of God বলে এবং মোহাম্মদ মারমাডিউক পিকথল করেছেন Mindful of duty to Allah অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি কর্তব্য সম্বন্ধে চেতনা বলে। প্রকৃত পক্ষে তাকওয়া শব্দের মর্ম হলো আল্লাহ ন্যায়-অন্যায়ের যে মাপকাঠি নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, সেই মাপকাঠি মোতাবেক জীবনের পথে চলা। যারা অমন সাবধানতার সঙ্গে পথ চলেন তাদের বলা হয় মুত্তাকী। তাহলে দেখা যাচ্ছে তাকওয়া ও হেদায়াত দু’টো আলাদা বিষয়। তাকওয়া হচ্ছে সাবধানে পথ চলা আর হেদায়াত হচ্ছে সঠিক পথে চলা। আরও পরিষ্কার করার চেষ্টা করছি। আপনি আপনার গন্তব্য স্থানের দিকে দু’ভাবে যেতে পারেন। অতি সাবধানে পথের কাদা, নোংরা জিনিস এড়িয়ে, গর্ত থাকলে গর্তে পা না দিয়ে, কাঁটার উপর পা না ফেলে চলতে পারেন। ওভাবে চললে আপনার গায়ে ময়লা লাগবে না, আছড়ে পড়ে কাপড়ে কাদামাটি লাগবে না। আবার পথের ময়লা, গর্ত, কাঁটা ইত্যাদির কোনো পরওয়া না করে সোজা চলে যেতে পারেন। ওভাবে গেলে আপনি আছাড় খাবেন, গায়ে-কাপড়ে ময়লা কাদামাটি লাগবে। আর হেদায়াত হচ্ছে আপনি এ উভয়ভাবের যে কোনও ভাবে যে পথে চলছেন সে পথ সঠিক হওয়া, অর্থাৎ সে পথ আপনাকে আপনার প্রকৃত গন্তব্য স্থানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে কিনা। পথ যদি সঠিক না হয়ে থাকে অর্থাৎ হেদায়াত না থাকে তবে আপনার শত সাবধানে পথ চলা অর্থাৎ শত তাকওয়া সম্পূর্ণ বিফল, কারণ আপনি আপনার গন্তব্যস্থানে পৌঁছবেন না। আর যদি সঠিক পথে অর্থাৎ হেদায়াতে থাকেন ও চলেন তবে তাকওয়া না করেও গায়ের কাপড়ে কাঁদামাটি লাগিয়ে আপনি আপনার গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যাবেন আপনি সফলকাম হবেন। অর্থাৎ তাকওয়া এবং হেদায়াতের মধ্যে বুনিয়াদেই পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। সেই সাথে এটাও দেখা যাচ্ছে যে- হেদায়াহ না থাকলে তাকওয়া অর্থহীন এবং সেই হেদায়াত, সঠিক পথটি হলো সিরাতুল মুস্তাকীম, সহজ সরল পথ, জীবনের কোনো ক্ষেত্রে এক আল্লাহ ছাড়া কারো বিধান না মানা, তওহীদ।

ধর্মব্যবসায়ীদের অর্থদান করা কেন অর্থহীন এবং অন্যায়?

ধর্মব্যবসায়ীদের অর্থদান করা কেন অর্থহীন এবং অন্যায়?



মসীহ উর রহমান

ধর্ম নিয়ে যারা ব্যবসা করে, পার্থিব স্বার্থে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ও সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে সমাজে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করে তারাই হলো ধর্মব্যবসায়ী। রসুলাল্লাহ অক্লান্ত চেষ্টা করে যে উম্মতে মোহাম্মদী জাতি গঠন করেছিলেন সেই জাতির মধ্যে আজকের মতো আলেম-মাওলানা, পীর-দরবেশ, মোহাদ্দেস, ফকীহ, মুফতি, মোফাসসের ইত্যাদি টাইটেলধারী কেউ ছিল না। জাতির প্রতিটি সদস্যই ছিল আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিতপ্রাণ মোজাহেদ বা যোদ্ধা। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে কিছুদিন পরেই জাতি তার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ভুলে গিয়ে দীন প্রতিষ্ঠার জেহাদ ত্যাগ করে। এই সময় জাতির মধ্যে জন্ম নেয় দীনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকারী তথাকথিত আলেম শ্রেণি। তারা দীনের বিধানাবলী নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ, মতভেদ ও অবিশ্রান্ত কূটতর্কে লিপ্ত হয়ে জাতিকে শত শত ফেরকায় মাজহাবে বিভক্ত করে ফেলে। এদেরই উত্তরসূরি হচ্ছেন আজকের ধর্মব্যবসায়ী আলেম-মোল্লারা। খ্রিষ্টানদের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় খ্রিষ্টানদের শেখানো ইসলাম শিখে সেটাকে ব্যবহার করে পার্থিব স্বার্থ হাসিল করাই এই শ্রেণির জীবনের উদ্দেশ্য। এরা সমাজের একটি পরাশ্রয়ী, পরজীবী ও পরভোজী শ্রেণি। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে তাদের কষ্টার্জিত ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা কুক্ষিগত করাই তাদের পেশা। সুরা তওবার ৩৪ নং আয়াতে আল্লাহ এই কথাটি বলেছেন যে, হে মো’মেনগণ! প-িত এবং সুফীবাদীদের মধ্যে অনেকেই মানুষের ধন অন্যায়ভাবে ভোগ করে থাকে এবং মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে নিবৃত্ত করে।’ আল্লাহর এই বাণীকে উপেক্ষা করে আমরাও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বিশ্বাস করে আসছি যে এই আলেম শ্রেণি আল্লাহর খুব প্রিয়পাত্র। তাদেরকে খুশি রাখতে পারলে, তারা দোয়া করলে ওপারে নাজাত নিশ্চিত। তাই ধর্মপ্রাণ মানুষ এদের পেছনে অকাতরে ধন-সম্পদ ব্যয় করছে, এদের হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে ভাবছে আল্লাহর রাস্তায় দান করলাম, হাজার হাজার টাকায় তাদেরকে ভাড়া করে আনছে ওয়াজ করার জন্য, বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলে, মুষ্টির চাল সংগ্রহ করে মসজিদের এমাম সাহেবের বাসায় পৌঁছে দিচ্ছে। হাঁস-মুরগীর প্রথম ডিমটা, গাছের প্রথম কাঁঠালটা ‘হুজুর’-এর জন্য বরাদ্দ, কারণ তিনি যে আল্লাহর ‘খাস বান্দা’। কিন্তু আসলেই কি এই অর্থদান আখেরাতে তাদের কোনো কাজে আসবে? আসুন দেখা যাক:
(১) আমাদের কারও অজানা নেই যে, সমাজের আলেম-মাওলানা হিসেবে পরিচিত একটি পুরোহিত শ্রেণি যাবতীয় ধর্মকর্ম করে থাকে অর্থের বিনিময়ে। ওয়াজ ও মিলাদ-মাহফিল, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, জুমার নামাজ, তারাবীর নামাজ, ঈদের নামাজ, জানাজার নামাজ, জিকির-আসগার, কুলখানি, বিয়ে, কোর’আন খতম ইত্যাদি ধর্মীয় কাজ বলতে আজ যা বোঝানো হয় তার কোনোটাই অর্থব্যয় ছাড়া হয় না। কিন্তু দীনের বিনিময়ে অর্থ-সম্পদ গ্রহণ আল্লাহ হারাম করেছেন। আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহ যে কেতাব অবতীর্ণ করেছেন যারা তা গোপন করে এবং বিনিময়ে তুচ্ছমূল্য গ্রহণ করে তারা
নিজেদের পেটে আগুন ছাড়া কিছুই পুরে না,
কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না,
আল্লাহ তাদের পবিত্রও করবেন না,
তারা ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় করেছে,
তারা হেদায়াতের পরিবর্তে পথভ্রষ্টতা বা গোমরাহী ক্রয় করেছে,
তারা দীন সম্পর্কে ঘোরতর মতভেদে লিপ্ত আছে
আগুন সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্যশীল”। (সুরা বাকারা ১৭৪-১৭৫)
অর্থাৎ যাদেরকে সাধারণ মানুষ ধর্মের কা-ারি বলে বিশ্বাস করে, তাজীম করে তারা পার্থিব জীবনেই জাহান্নামের আগুন ভক্ষণ করছে, সুতরাং তাদেরকে পোষণ ও তোষণ করলে যে জাহান্নামেই যেতে হবে সেটা বোধ করি বলার প্রয়োজন পড়ে না। তথাপি আল্লাহ বলছেন- অনুসরণ করো তাদের, যারা বিনিময় নেয় না এবং হেদায়াহপ্রাপ্ত (সুরা আল ইয়াসীন- ২১)। তাহলে যাদেরকে অনুসরণ করাই অবৈধ তাদেরকে অর্থ-কড়ি প্রদান করা কীভাবে বৈধ বা পূণ্যের কাজ হতে পারে? সুতরাং নিশ্চয়ই এই ধর্মজীবী আলেম-মাওলানাদের আর্থিক সাহায্য দেওয়া মানেই হলো- আল্লাহর হুকুম অমান্য করা। যদি কেউ মানবতার খাতিরে দান করতে চান তবে এমন কাউকে দান করুন যে অন্তত ধর্মকে বিক্রি করে না এবং অভাবগ্রস্ত, দরিদ্র। মনে রাখবেন, ধর্মব্যবসায়ীরা মানবতার শত্রু, ইসলামের শত্রু।
(২) ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করলে বা ধর্মকে পণ্যের মতো বেচা-কেনা করলে সেটা বিকৃত হবেই। পণ্যকে যেমন ক্রেতার চোখে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য আকর্ষণীয় মোড়ক ব্যবহার করা হয়, রং দেওয়া হয়, প্রয়োজনে ফর্মালিন-কার্বাইড জাতীয় বিষাক্ত কেমিক্যাল প্রয়োগ করা হয় তেমনভাবে ধর্মকে নিয়ে যখন ব্যবসা করা হয় তখন ধর্মকেও অতিরঞ্জিত করা হয়। ধর্মকেও একেকজন ক্রেতার কাছে একেকরূপে ক্রেতার রুচিমাফিক রঙ-রস দিয়ে উপস্থাপন করা হয়। ঠিক এই প্রক্রিয়াতেই ধর্মজীবীরা যুগে যুগে স্থান-কাল-পাত্রভেদে দীনের যোগ-বিয়োগ করেছেন, হালালকে হারাম আর হারামকে হালাল করেছেন, গুরুত্বের ওলট-পালট করেছেন। আর সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ এই ধর্ম বিকৃত-কারীদেরকেই নবী-রসুলের উত্তরসূরি জ্ঞান করে সম্মানের স্থানে বসিয়েছে। নিজেরা না খেয়ে থেকে তাদেরকে অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়ে দিয়েছে। এভাবে সাধারণ মানুষ যুগে যুগে ধর্মজীবীদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছে।
(৩) রসুলাল্লাহ কঠিন সংগ্রাম করে একটি জাতি গঠন করেছিলেন। সেই জাতির নেতা ছিল একজন, লক্ষ্যও ছিল মাত্র একটি। ইতিহাস সাক্ষী যতদিন সেই জাতি তাদের ঐক্যকে ধরে রেখেছিল ততদিন তাদের সামনে কোনো শক্তি দাঁড়াতে পারে নি। তারা সরল-সঠিক পথের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু যখনই জাতির মধ্যে ধর্মজীবীদের আবির্ভাব ঘোটল, ধর্ম নিয়ে অতি বিশ্লেষণ শুরু হলো তখনই মতভেদ হয়ে জাতি বিভক্ত হয়ে গেল। জন্ম হলো শিয়া-সুন্নী, হাম্বলী, মালেকী, আহলে হাদিস, ওয়াহাবী, হানাফী, শাফেয়ী, পীর-ফকীর, দরবেশ ইত্যাদির। এদের এক এক ফেরকার আকিদা এক এক রকম। এই ফেরকাগুলোতে অনুসারীরও কোনো অভাব নেই। যেটা তর্ক-বিতর্কের কোনো বিষয়ই নয়, দেখা যাচ্ছে সেটাকে বিশ্লেষণ-অতি বিশ্লেষণ করে জাতি শুধু যে বিভক্তই হয়েছে তাই নয়, নিজেরা নিজেরা মারামারি, হানাহানি, রক্তপাত ঘটাচ্ছে। এই ফেরকা মাজহাব কি সাধারণ মানুষেরা সৃষ্টি করেছে নাকি ধর্মের লেবাসধারী আলেম-ওলামারা সৃষ্টি করেছেন? এর উত্তর সবাই জানেন। যখন থেকে ধর্মজীবীদের আবির্ভাব ঘটেছে তখন থেকেই মুসলিম জাতির মধ্যে বিভক্তি ও পরিণামে অধঃপতন শুরু হয়েছে। আর এই পতনের ধারবাহিকতায় তারা আজ অন্য জাতির দাসত্ব করে যাচ্ছে। এতকিছুর পরও এই ১৬০ কোটির মুসলিম জনসংখ্যার ঘুম ভাঙে নি। তারা এখনও টাকা-পয়সা খরচ করে ওয়াজকারী ভাড়া করে আনছে, পীরের দরবারে সোনা-দানা দিয়ে আসছে। তারা বুঝতে পারছে না যে, এই অর্থ সম্পদ তাদেরই জাহান্নামের ইন্ধন হবে।
(৪) ধর্মজীবীরা তাদের স্বার্থের পথে বিঘœ সৃষ্টিকারীকে নাজেহাল করার জন্য ধর্মকে অপব্যবহার করে। যখনই কেউ তাদের মিথ্যার মুখোস খুলে দিতে চায়, এদের অবৈধ কর্মকা-গুলির প্রতিবাদ করে তখনই তারা ঐ লোকের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিতে শুরু করে। পরিবেশ বুঝে যখন যাকে ইচ্ছা নাস্তিক, কাফের, মুরতাদ, খ্রিষ্টান ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে মানুষকে সহিংসতা দাঙ্গা-ফাসাদে লিপ্ত করে।
আমরা চাই, ধর্মের নামে এই অরাজকতা ও যথেচ্ছাচার বন্ধ হোক, ধর্মকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠির স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার না করে একে মানবতার কল্যাণে ব্যবহার করা হোক। এজন্য সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজের যারা সওয়াবের আশায় ধর্মব্যবসায়ীদেরকে পৃষ্ঠপোষণ করছেন তারা নিজেরা অন্যায়ের প্রশ্রয়দাতা। অন্যায়ের প্রশ্রয় দিলে তার পরিণতিও ভোগ করতে হয়। চোর, ডাকাত, সুদখোর, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজকে প্রশ্রয় দেওয়া যদি অন্যায় হয় তবে ধর্মব্যবসাকে প্রশ্রয় দেওয়া তার চেয়ে বড় অন্যায়।

যৌনশক্তির মহৌষধ মেথি

যৌনশক্তির মহৌষধ মেথি



মেথিকে সাধারণত মশলা হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু মেথি শুধুমাত্র মশলা নয়, এটি খাবার ও পথ্য। রক্তে কোলেস্টেরল বা চর্বির মাত্রা কমানো, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে মেথি বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখে। রক্তে চিনির মাত্রা কমানোরও বিস্ময়কর শক্তি রয়েছে মেথিতে। আর পুরুষদের যৌনশক্তি বৃদ্ধিতে মেথির রস এক মহৌষধ!
আনুমানিক ৩০টি দেশের ২৫ হাজার পুরুষের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়। যেসব পুরুষ তাদের যৌনশক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন তাদের মেথির রস দিনে দু’বার পরিমাণ মতো সেবন করতে দেওয়া হয় ওই পরীক্ষায়। এতে আশ্চর্য রকম সুফল পাওয়া যায়। প্রতিদিন পরিমিত মেথির রস সেবনে তাদের দাম্পত্য জীবন সুখময় হয়ে উঠে।
হতাশা বা অবসাদ, অতিরিক্ত শারীরিক ওজন ও অ্যালকোহল পানে অসুস্থতা, ডায়াবেটিস ইত্যাদি বহু অসুখ ও শারীরিক সমস্যার জন্যও মেথির রস বেশ উপকারী। মেথির রসে ‘সাপোনিস’ বা ‘ডাইওসজেনিন’ নামে এক ধরনের যৌগ পদার্থ আছে, যা মানবদেহের হরমোন স্তর বা এর পরিমাণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
প্রতিদিন সকালে খালি পেটে মেথি চিবিয়ে খেলে বা এক গ্লাস পানিতে মেথি ভিজিয়ে রেখে সেই পানি পান করলে শরীরের রোগ জীবাণু দূর হয়। বিশেষত কৃমি মরে যায় এবং রক্তে চিনির মাত্রা কমে, রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল বা চর্বির মাত্রা কমে যায়। বার্ধক্যকে দূরে ঠেলে দিয়ে তারুণ্যকে দীর্ঘস্থায়ী করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে মেথি।
গবেষণায় দেখা গেছে, যে ডায়াবেটিক রোগীরা নিয়মিত মেথি খান, তাদের ডায়াবেটিসজনিত অসুখগুলো কম হয় এবং স্ট্রোক হওয়ার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে কম। এক কথায় ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য মেথি শ্রেষ্ঠ পথ্য।
যাদের ডায়াবেটিস নেই মেথি তাদের জন্যও জরুরি। মাতৃদুগ্ধ বৃদ্ধির জন্য কালো জিরার মতো মেথি পিষে খাওয়াটাও যথেষ্ট উপকার। তবে খেয়াল রাখতে হবে, মেথি ভেজে পিষলে পুষ্টি সব নষ্ট হয়ে যাবে। রৌদ্রে শুকিয়ে নিয়ে খেতে মচমচে লাগবে। তবে মেথির স্বাদ তিতা ধরনের। মেথি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, শরীরকে রাখে সতেজ। রক্তের উপাদানগুলোকে করে কর্মক্ষম। ফলে মানুষের কর্মোদ্দীপনাও বৃদ্ধি পায়।
তবে ছয় সপ্তাহে অন্তত দিনে দু’বার করে এর রস নিয়মিত পান না করলে তেমন উপকারিতা পাওয়া যাবে না। আপনি যদি মেথি সরাসরি খেয়ে ফেলেন তবে এটি আপনার ডায়েটে সহায়তা করবে। এ ছাড়া প্রতিদিনের ফেসপ্যাকে মেথি গাছের নির্যাস ব্যবহার করলে মুখের ব্রণ, কালো দাগ এবং ফুসকুড়ি নিরাময় হয়। সূত্র : ইন্টারনেট।

Wednesday, June 22, 2016

নতুন চুল গজাতে কীভাবে মাথায় পেঁয়াজের রস ব্যবহার করবেন?

আমরা সবাই জানি, পেঁয়াজের রস Onion Juice নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে, চুলপড়া কমায় এবং চুলের গোড়া শক্ত করে। কিন্তু অনেকেই জানি না কীভাবে মাথায় পেঁয়াজের রস ব্যবহার করবেন। এই রসের সঙ্গে অন্য প্রাকৃতিক উপাদান মেশালে এর কার্যকারিতা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
১. পেঁয়াজ কেটে ভালো করে ব্লেন্ড করে নিন। এবার এর রস বের করে নিয়ে মাথার ত্বকে লাগান। ৩০ থেকে ৪০ মিনিট অপেক্ষা করুন। এবার মাইল্ড শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন।
২. পেঁয়জের রসের সঙ্গে হালকা গরম পানি মিশিয়ে নিন। গোসলের পর এই পানি দিয়ে মাথা ভালো করে ধুয়ে নিন। একদিন পর শ্যাম্পু করে ফেলুন। এতে মাথা head থেকে পেঁয়াজের গন্ধ আসতে পারে। তবে চুলের জন্য এই পানি বেশ উপকারী।
৩. পেঁয়াজের রসের সঙ্গে নারকেল তেল ও কয়েক ফোটা এসেনশিয়াল অয়েল মিশিয়ে মাথার ত্বকে লাগান। এক ঘণ্টা পর শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলুন।
৪. দুই চা চামচ পেঁয়াজের রসের সঙ্গে এক চা চামচ মধু মিশিয়ে মাথার ত্বকে লাগান। ১৫ থেকে ২০ মিনিট অপেক্ষা করুন। এবার শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে অন্তত একদিন এই প্যাক মাথায় লাগান।
৫. পেঁয়াজ বেটে এর সঙ্গে অলিভ অয়েল মিশিয়ে মাথার ত্বকে লাগান। দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করুন। এবার শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলুন।

Friday, June 17, 2016

মানুষকে আল্লাহ যে একটিমাত্র শর্ত দিলেন সেটা কি ???

মানুষকে আল্লাহ যে একটিমাত্র শর্ত দিলেন সেটা কি ???



এলাহ অর্থাৎ জীবন-বিধাতা বোলে স্বীকার করা অন্য সর্বরকম বিধান অস্বীকার করা
মানুষকে আল্লাহ এই যে একটিমাত্র শর্ত দিলেন অর্থাৎ শুধু একমাত্র তাকেই প্রভু, এলাহ অর্থাৎ জীবন-বিধাতা বোলে স্বীকার করা অন্য সর্বরকম বিধান অস্বীকার করা, এই যথেষ্ট।
এটা কেন?
এত সংক্ষিপ্ত, এত সহজ, এত ছোট্ট একটি শর্ত, একটা দাবী, এ কেন?
এটা এই জন্য যে-
াত্র স্রষ্টা ছাড়া আর কেউ তৈরী কোরতে পারবে না, অসম্ভব। স্রষ্টাকেই একমাত্র বিধান দাতা বোলে স্বীকার কোরে না নিলে তার বিধান মানার প্রশ্ন আসে না। তাই তার শর্ত ও দাবী মানুষের প্রতি এই যে আমাকে ছাড়া আর কাউকে বিধান দাতা, এলাহ বোলে মানবে না খ) একবার তাকে একমাত্র এলাহ বোলে স্বীকার কোরে জাতীয় জীবনে তার দেওয়া আইন (রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, দণ্ডবিধি সব রকম) প্রতিষ্ঠার পর ব্যক্তিগত অপরাধ নিজে থেকেই প্রায় লোপ পেয়ে যাবে। ব্যক্তিগত অপরাধের নিয়ন্ত্রণের জন্য তার দেওয়া আইনই যথেষ্ট। কাজেই সর্বপ্রথম ও সব চেয়ে প্রয়োজনীয় হোচ্ছে জাতীয় জীবনের তাকে একমাত্র এলাহ বোলে স্বীকার কোরে নেওয়া। এটা করা হোলে বাদ বাকি আর সব নিজে থেকেই ঠিক হোয়ে যাবে। তাই আল্লাহ বিচারের দিন যার মধ্যেই সাচ্চা তাওহীদ পাবেন তাকেই সমস্ত গুনাহ মাফ কোরে দেবেন, অর্থাৎ জান্নাতে প্রবেশ কোরবে। এ ব্যাপারে অগুনতি হাদীস ও হাদীসে কুদসী রোয়েছে। এমন কি চুরি ও ব্যভিচারের মত কবিরা গোনাহকারীও জান্নাতে যাবে, যদি সে সাচ্চা, সত্য সত্যই বিশ্বাস করে যে এলাহ, বিধানদাতা, আল্লাহর ছাড়া আর কেই নেই [হাদীস- আবু যর (রাঃ) থেকে বুখারী, মুসলিম) ও মেশকাত]। অর্থাৎ জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনে সে আর কারু তৈরী আইন-কানুন নিয়ম নির্দেশ মানতে পারে না। অন্যদিকে আল্লাহ কোরানে বহুবার বোলছেন আমার ইচ্ছা হোলে আমি আমার বান্দার সব গোনাহ মাফ কোরে দেবো কিন্তু শেরক অর্থাৎ আমার দেওয়া বিধান, আইন-কানুন বাদ দিয়ে অন্যের তৈরী আইন-কানুন গ্রহণকারীকে আমি কখনই মাফ কোরবো না (কোরান- সূরা আন নিসা ৪৮)।
আজ পৃথিবীর 'অতি মুসলিমরা' নামাযে, রোযায়, হজ্বে, তাহাজ্জুদে, তারাবিতে, দাড়িতে, টুপি-পাগড়ীতে, পাজামায়, কোর্তায় নিখুঁত। শুধু একটিমাত্র ব্যাপারে তারা নেই, সেটা হলো তাওহীদ, ওয়াহদানীয়াত। যে আংশিক অর্থাৎ ব্যক্তিগত ওয়াহদানীয়াত ঐ অতি মুসলীমদের মধ্যে আছে তা আল্লাহ আজও যেমন ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান কোরে রেখেছেন, হাশরের দিনও তেমনি ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান কোরবেন। কারণ তিনি বোলে দিয়েছেন যে আল্লাহর কেতাবের কোন অংশে বিশ্বাস আর কোন অংশে অবিশ্বাসের শাস্তি শুধু যে কেয়ামতের দিনে ভয়াবহ হবে তাই নয়, এই দুনিয়ার জীবনেও অপমান, লাঞ্ছনা (কোরান- আল বাকারা ৮৫)।

ঐক্যবদ্ধ ও উন্নত জাতি গঠনের মূলমন্ত্র

ঐক্যবদ্ধ ও উন্নত জাতি গঠনের মূলমন্ত্র


নিজাম উদ্দিন

শুষ্ক মরুভূমি, উত্তপ্ত বালুকারাশি। মাঝে মাঝেই সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যাচ্ছে মরুঝড়। মানুষের হৃদয়গুলিও শুষ্ক, মেজাজ উত্তপ্ত। কারণে অকারণে মানুষ-খুন, হানাহানি, দাঙ্গা, যুদ্ধ। একবার যুদ্ধ বেধে গেলে যেন আর থামেই না। মানুষগুলো কেমন যেন অসভ্য-জানোয়ার প্রকৃতির। কারো জীবনের নিরাপত্তা নেই এতটুকু। নারীদের ন্যূনতম সম্মানটুকু নেই। যুলুম-নির্যাতন সীমা ছাড়িয়েছে। আপন লোককে হত্যা করা, গোত্রে গোত্রে বছরের পর বছর যুদ্ধ করা, পরস¤পদ লুট করা, নারীদের অমর্যাদা করা- এগুলো যেন কোনো অপরাধই না।
ব্যক্তিজীবনে ন্যূনতম শৃঙ্খলা নেই। চুল-দাড়ি উস্কখুস্ক, মুখ দুর্গন্ধযুক্ত, পোশাকগুলো অপরিচ্ছন্ন। অযৌক্তিক অন্ধবিশ্বাসই তাদের ধর্ম। সত্য ধর্মকে বিকৃত করে কিছু প্রথার মধ্যে আবদ্ধ করে ব্যবসা করে খাচ্ছে এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ীরা। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত তাদের জীবন। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি তাদের অন্যতম পেশা। অশিক্ষিত, অবজ্ঞাত, উপেক্ষিত বর্বর আরব বেদুইন জাতি। আইয়্যামে জাহেলিয়াতের সেই আরব বেদুইনদের মাঝেই শান্তির সুশীতল বাতাস ছড়িয়ে দিতে এসেছিলেন আমার প্রাণপ্রিয় নবী মোহম্মাদুর রসুলাল্লাহ (সা.)।
সেই জাতিকে আমার নবী (সা.) সারা জীবনের অক্লান্ত পরিশ্রম, ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর অটল অধ্যবসায়ের মাধ্যমে এমন এক জাতিতে পরিণত করলেন যারা অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে অর্ধ-পৃথিবীতে অনাবিল শান্তি, পূর্ণ নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত করে শ্রেষ্ঠ জাতির আসনে আসীন হলো। সেই অবজ্ঞাত, উপেক্ষিত, অবহেলিত, অশিক্ষিত আরব বেদুইনরাই হয়ে গেল শিক্ষকের জাতি। সেই জাতিকে রসুলাল্লাহ (সা.) এমন শিক্ষা দিলেন যে সমস্ত দিক দিয়ে তাঁরা উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করল। দুই-দুইটা পরাশক্তি রোমান ও পারস্যকে একই সাথে সামরিকভাবে পরাজিত করল। সারা পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখল তাদের কীর্তি।
কিন্তু সেই জাতি গঠনের মূলমন্ত্র কী ছিল? কোন জাদুর কাঠির পরশে জাতির এমন পরিবর্তন হলো? খুব সহজ। রসুলাল্লাহ (সা.) আইয়্যামে জাহেলিয়াতের অন্ধকারে নিমজ্জিত সেই জাতির কাছে প্রথম যে আহ্বান করেছিলেন, যে বালাগ দিয়েছিলেন তা হলো- তোমরা এই কথার উপর সাক্ষ্য দাও যে, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ” (সা.) অর্থাৎ “আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা (ইলাহ) নেই এবং মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রসুল।” এটাই হলো সেই অপরাজেয় জাতি গঠনের মূলমন্ত্র, জান্নাতে যাওয়ার চাবি, মোমেন হওয়ার প্রথম শর্ত।
মহানবী (সা:) বলেছেন- “জান্নাতের চাবি হচ্ছে- আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা (ইলাহ) নেই” (মুয়াজ বিন জাবাল থেকে আহমদ, মেশকাত)। অপর হাদীসে এসেছে- যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে “আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা (ইলাহ) নেই এবং মোহাম্মদ (সা:) তাঁর প্রেরিত” তার জন্য জাহান্নাম হারাম হয়ে যাবে। (ওবাদাহ বিন সাবেত থেকে মুসলিম, মেশকাত)। এছাড়াও অনেক হাদীস থেকে দেখান যাবে যে, তওহীদই জান্নাতের চাবি। কালিমা তথা তওহীদের স্বীকৃতি না দিলে যেমন মুমিন মুসলিম থাকা যায় না ঠিক তেমনই স্বীকৃতি দানের পর আবার তওহীদের ওপর থেকে সরে গেলেও আর মুমিন মুসলিম থাকা যায় না, আর এটা সবাই জানে যে, মুমিন মুসলিম না থাকলে সে জান্নাতে যেতে পারবে না, সে যতই ইবাদত করুক। দীনুল হকের ভিত্তি হচ্ছে তওহীদ অর্থাৎ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এই কালিমাটি, এ নিয়ে কারো কোন দ্বিমত নেই। তওহীদ ব্যতীত কোনো ইসলামই হতে পারে না, তওহীদই ইসলামের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সেই শিক্ষকের জাতি আজ আবার ঘৃন্য দাসে পরিণত হয়েছে। সারা পৃথিবীব্যাপী অন্য জাতিগুলোর কাছে মার খাচ্ছে, অপমানিত হচ্ছে, ধর্ষিতা হচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে তবু একটু প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে পারছে না, অথচ এরা সংখ্যায় ১৬০ কোটি। এর মূল কারণ হচ্ছে সেই মূলমন্ত্র ছেড়ে দেওয়া। আল্লাহ তওহীদ থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে মুসলিম নামক এই জাতি। মুসলিম জাতিটি আজ তাদের সৃষ্টির যে উদ্দেশ্য ছিল সেটাই ভুলে গিয়েছে। সেই উদ্দেশ্য ছিল সমস্ত পৃথিবীময় আল্লাহর তওহীদভিত্তিক (সার্বভৌমত্ব) সত্যদীন, জীবনব্যবস্থা, দীনুল হক প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে মানবজীবন থেকে যাবতীয় অন্যায় অবিচার অশান্তি দূর করার সংগ্রাম করা। যতদিন না মানবজীবন থেকে যাবতীয় অশান্তি দূরীভূত না হয়, ততদিন মুসলিম জাতির উপর আল্লাহর অর্পিত এই পবিত্র দায়িত্ব বহাল থাকবে। সেই দায়িত্ব এই জাতি ভুলে গিয়ে ব্যক্তিগত আমল করে জান্নাতে যাওয়ার কোশেশ করছে। আর আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে প্রত্যাখান করে পশ্চিমা সভ্যতার সার্বভৌমত্বকে গ্রহণ করে নিয়েছে।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, মুসলিম বলে পরিচিত এই জনসংখ্যাটি তওহীদ সম্পর্কে যে ধারণা করে (আকীদা) তা ভুল। তাদের কাছে তওহীদ মানে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করা এবং তাঁর ইবাদত বা উপাসনা করা। ‘তওহীদ’ এবং ‘ওয়াহদানিয়াহ্’ এই আরবী শব্দ দু’টি একই মূল থেকে উৎপন্ন হলেও এদের অর্থ এক নয়। ‘ওয়াহদানিয়াহ্’ বলতে বোঝায় মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ যে একজন তা বিশ্বাস করা (একত্ববাদ-গড়হড়ঃযবরংস), পক্ষান্তরে ‘তওহীদ’ মানে ঐ এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়া, তাঁর ও কেবলমাত্র তাঁরই নিঃশর্ত আনুগত্য করা। আরবের যে মুশরিকদের মধ্যে আল্লাহর শেষ রাসুল এসেছিলেন, সেই মুশরিকরাও আল্লাহর একত্বে, ওয়াহদানিয়াতে বিশ্বাস করতো, কিন্তু তারা আল্লাহর হুকুম, বিধান মানতো না অর্থাৎ তারা আল্লাহর আনুগত্য করতো না। তারা তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সামষ্টিক জীবন নিজেদের মনগড়া নিয়ম-কানুন দিয়ে পরিচালনা করতো। এই আইনকানুন ও জীবন ব্যবস্থার উৎস ও অধিপতি হিসাবে ছিল বায়তুল্লাহ, কা’বার কুরাইশ পুরোহিতগণ। মূর্তিপূজারী হওয়া সত্ত্বেও তাদের এই ঈমান ছিল যে, এ বিশ্বজগতের স্রষ্টা আল্লাহ একজনই এবং তাদের এই ঈমান বর্তমানে যারা নিজেদেরকে মুমিন মুসলিম বলে জানে এবং দাবি করে তাদের চেয়ে কোনো অংশে দুর্বল ছিল না (সুরা যুখরুফ ৯, আনকাবুত ৬১, লোকমান ২৫)। কিন্তু যেহেতু তারা আল্লাহর প্রদত্ত হুকুম মানতো না, তাই তাদের ঐ ঈমান ছিল অর্থহীন, নিষ্ফল এবং স্বভাবতঃই আল্লাহর হুকুম না মানার পরিণতিতে তাদের সমাজ অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, নিরাপত্তাহীনতা, সংঘর্ষ ও রক্তপাতে পরিপূর্ণ ছিল, এ জন্য আরবের ঐ সময়টাকে আইয়্যামে জাহেলিয়াত বলা হয়। আল্লাহর হুকুমের প্রতি ফিরিয়ে আনার জন্যই তাদের মধ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন শেষ রসুল মোহাম্মদ (সা.)। রাসুলও (সা.) সে কাজটিই করেছিলেন, ফলশ্রুতিতে অন্যায় অশান্তিতে নিমজ্জিত সেই সমাজটি নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার, সুখ-সমৃদ্ধিতে পূর্ণ শান্তিময় (ইসলাম অর্থই শান্তি) একটি সমাজে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং আল্লাহর আনুগত্য না করাই ছিল তাদের কাফের মুশরিক হওয়ার প্রকৃত কারণ। বর্তমানের মুসলিমরা উপলব্ধি করতে পারছে না যে প্রাক-ইসলামিক যুগের আরবের কাঠ পাথরের মূর্তিগুলিই এখন গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদির রূপ ধরে আবির্ভূত হয়েছে এবং মুসলিম জনসংখ্যাটি আল্লাহর পরিবর্তে এদের তথা এদের প্রবর্তক ও পুরোধা ‘পুরোহিতদের’ আনুগত্য করে যাচ্ছে। এই প্রতিটি তন্ত্র আলাদা আলাদা একেকটি দীন (জীবনব্যবস্থা), ঠিক যেমন দীনুল হক ‘ইসলাম’ও একটি জীবনব্যবস্থা। পার্থক্য হলো, এই মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত দীনগুলি মানবজীবনের বিশেষ কিছু অঙ্গনের, বিশেষ কিছু বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে, কিন্তু সঠিক সমাধান দিতে পারে না আর ইসলাম মানবজীবনের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় থেকে শুরু করে সামষ্টিক অঙ্গনের সকল বিষয়ে সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা দিয়ে থাকে। আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য দীন ইসলাম। এটা ছাড়া আল্লাহ কোনো কিছুই গ্রহণ করবেন না। আল্লাহ বলেছেন, “ আজ আমি তোমাদরে জন্যে তোমাদরে দ্বীনকে র্পূনাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদরে প্রতি আমার নিয়ামত সর্ম্পূণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদরে জন্যে দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম” (সুরা মায়েদা- ৩)। অথচ বর্তমানের মুসলিম নামক জনসংখ্যাটি এই সকল মানবরচিত তন্ত্রের প্রতিমার আনুগত্য করে সেই পৌত্তলিক আরবদের মতই জাতিগতভাবে শিরক ও কুফরে নিমজ্জিত। এখন হেযবুত তওহীদ এই শতধাবিচ্ছিন্ন জাতিকে এক কলেমার উপরে, তওহীদের ভিত্তির উপরে ঐক্যবদ্ধ হবার জন্য আহ্বান করছে, অর্থাৎ সবাই বলবে আমরা আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম, সার্বভৌমত্ব মানবো না। ইসলামের বহু বিষয়ে বহু মতভেদ থাকলেও ১৬০ কোটি মুসলিম আজও এক কলেমার উপরে বিশ্বাসী। আর কলেমার উপরে ঐক্যবদ্ধ করাই আল্লাহর হুকুম ও রসুলাল্লাহর (সা.) সুন্নাহ। হেযবুত তওহীদ সেই চেষ্টাই করছে।