Thursday, January 28, 2016

মুসলিম জাতির ধ্বংসের কারণ

মুসলিম জাতির ধ্বংসের কারণ


মোহাম্মদ আসাদ আলী
কোর’আনে বর্ণিত বনি ইসরাইলদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা উল্লেখ করার মাধ্যমে আমার এই লেখাটি শুরু করতে চাই। ঘটনাটি হলো আল্লাহ বনী ইসরাইলদের একটি গরু কোরবানি করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই যদি তারা আল্লাহর হুকুম মোতাবেক একটি ভালো গরু কোরবানি করে দিত তাহলেই সব কাজ শেষ হয়ে যেত। কারণ কোরবানির গরুটা কেমন হবে আল্লাহ তার কোনো শর্ত উল্লেখ করেন নি। কিন্তু আল্লাহ কোরআনে বলছেন- বনী ইসরাইল তা করেনি। তারা মুুসা (আ.) এর মাধ্যমে আল্লাহকে প্রশ্ন করতে লাগলো- গরুটার বয়স কত হবে, গায়ের রং কী হবে, সেটা জমি চাষের জন্য শিক্ষিত কিনা, ওটার গায়ে কোনো খুঁত থাকতে পারবে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি (কোর’আন- সুরা আল বাকারা ৬৭-৭১)। তারা প্রশ্ন করে যেতে লাগল আর আল্লাহ একটার পর একটা উত্তর দিয়ে যেতে থাকলেন। তারপর যখন প্রশ্ন করার মতো আর কিছুই রইলো না তখন স্বভাবতঃই ঠিক অমন একটি গরু পাওয়া দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। একটা সহজ সরল আদেশ “একটা গরু কোরবানি কর” এটাকে খুচিয়ে খুচিয়ে এমন কঠিন করে ফেলা হলো যে, ঐ আদেশ পালন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে আমাদের ক্ষেত্রেও। বনী ইসরাইল আর আমাদের মাঝে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। হ্যাঁ আছে, একটি ব্যাপারে আছে, আর তাহলো বনী ইসরাইল ৭২ ফেরকায় বিভক্ত ছিল, আর এই মুসলিম নামধারী জাতিটি তাদের পাণ্ডিত্য জাহির করতে গিয়ে ৭৩ ফেরকায় বিভক্ত হয়েছে ( হাদিস আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে তিরমিযি, মেশকাত )।
আদম (আ.) থেকে শুরু করে শেষনবী (সা.) পর্যন্ত আল্লাহ যে জীবন বিধান মানুষের জন্য পাঠিয়েছেন, স্থান, কাল ভেদে সেগুলোর নিয়ম-কানুনের মধ্যে প্রভেদ থাকলেও সর্বক্ষণ ভিত্তি থেকেছে একটি মাত্র। সেটা হচ্ছে একেশ্বরবাদ (Monothism), তওহীদ, একমাত্র প্রভু, একমাত্র বিধাতা (বিধানদাতা) আল্লাহ। যার আদেশ নির্দেশ, আইন-কানুন ছাড়া অন্য কারো আদেশ, নির্দেশ, আইন-কানুন কিছুই না মানা। একেই আল্লাহ কোর’আনে বলেছেন দীনুল কাইয়্যেমা। আল্লাহ মানুষের কাছে এইটুকুই মাত্র চান। কারণ তিনি জানেন যে, মানুষ যদি সমষ্টিগতভাবে তিনি ছাড়া অন্য কারো তৈরি আইন কানুন না মানে, শুধু তারই আইন-কানুন মানে তবে শয়তান তার ঘোষিত উদ্দেশ্য অর্থাৎ মানুষকে দিয়ে অশান্তি, অন্যায় আর রক্তপাত অর্জনে ব্যর্থ হবে এবং মানুষ সুবিচারে, শান্তিতে (ইসলামে) পৃথিবীতে বসবাস করতে পারবে- অর্থাৎ আল্লাহ যা চান। কত সহজ। কাইয়্যেমা শব্দটা এসেছে কায়েম থেকে যার অর্থ চিরন্তন, শ্বাশ্বত, সনাতন। আল্লাহ এই দীনুল কাইয়্যেমার কথা বলে বলছেন- এর বেশি তো আমি আদেশ করিনি ( কোর’আন সুরা আল বাইয়েনাহ্ – ৫)। ‘এর বেশি তো আমি আদেশ করিনি’ তিনি বলছেন এই জন্য যে, তিনি জানেন যে, ঐটুকু করলেই অর্থাৎ তাঁর বিধান ছাড়া অন্য কোন বিধান মানুষ না মানলেই মানব জাতির মধ্যে পূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। এই সামান্য দাবিটুকুই তিনি মানুষের কাছে আদম থেকে আজ পর্যন্ত করে আসছেন। পূর্ববর্তী বিকৃত জীবন-ব্যবস্থাগুলিতেও আল্লাহর দাবি ছিল ঐ সহজ সরল দাবি- দীনুল কাইয়্যেমা, তওহীদ। ভারতীয় ধর্মের অনুসারীদের তারা কোন ধর্মে বিশ্বাসী জিজ্ঞাসা করলে তার জবাব দেবেন সনাতন ধর্ম। সনাতন এবং কাইয়্যেমা একার্থবোধক- যা চিরদিন প্রবহমান, চিরন্তন ও শাশ্বত, এবং তা ঐ তওহীদ। এর গুরুত্ব এত বেশি যে একে আল্লাহ আমাদের জন্য শুধু প্রতি সালাতে নয় প্রতি রাকাতে অবশ্য করে দিয়েছেন সুরা ফাতেহার মধ্যে। “আমাদের সেরাতুল মোস্তাকীমে চালাও” মোস্তাকীম অর্থ সহজ, সরল ও শ্বাশ্বত।
একটি জাতির মধ্যে চালাক, বোকা, শিক্ষিত, মেধাবী ইত্যাদি সব রকম লোকই থাকবে। তাই আল্লাহ ও তার রসুল যে জাতি সৃষ্টি করলেন তার ভিত্তি করলেন অতি সহজ ও সরল- তওহীদ, একমাত্র প্রভু হিসাবে তাকেই স্বীকার করে নেওয়া। এরই নাম সেরাতাল মোস্তাকীম। আর সহজ বলেই বিশ্বনবীর সৃষ্ট অত্যন্ত অশিক্ষিত জাতিটি, যার মধ্যে লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা হাতে গোনা যেতো তারাও ভিত্তি ও লক্ষ্য পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছিলেন এবং তা থেকে চ্যুত হননি। এতে করে তাদের মধ্যে যে সীসাঢালা প্রাচীরের মতো একতা সৃষ্টি হয়েছিল তার সামনে অর্ধ পৃথিবী মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছিল। এভাবে চলেছে ৬০/৭০ বছর যে কথা আল্লাহর রসুল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে তাঁর উম্মাহর আয়ু। বাস্তবিকই ৬০/৭০ বছর পর থেকেই শুরু হলো এই জাতির মৃত্যুর পর্ব, ধ্বংসের পর্ব। এই জাতির মধ্যেও সৃষ্টি হলো পুরোহিত, আলেম- মাওলানা, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, পীর, মাশায়েখ ইত্যাদি শত শত ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণির। অতি বিশ্লেষণের বিষময় ফলে ঐ দীনুল কাইয়্যেমা, সেরাতুল মোস্তাকীম হয়ে গেল অত্যন্ত জটিল, দুর্বোধ্য এক জীবন বিধান, যেটা সম্পূর্ণ শিক্ষা করাই মানুষের এক জীবনের মধ্যে সম্ভব নয়- সেটাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম তো বহু দূরের কথা। ফকিহ-মোফাস্সিরদের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণের ফলে জাতির মধ্যে ভয়াবহ বিভেদ সৃষ্টি হয়ে, বিভিন্ন মাযহাব ও ফেরকা সৃষ্টি হয়ে যে অনৈক্য সৃষ্টি হলো তার ফলে পুনরায় একতাবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করার সম্ভাবনাও শেষ হয়ে গেলো।
সেরাতুল মোস্তাকীমের সহজতার, সরলতার মহা গুরুত্ব উপলব্ধি করে রসুলাল্লাহ (সা.) এক হাদিসে বললেন- দীন সহজ, সরল (সেরাতুল মোস্তাকীম) একে নিয়ে যারা বাড়াবাড়ি করবে তারা পরাজিত হবে। অন্য হাদিসে বললেন, জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে ( হাদিস – আবু হুরায়রা (রা.) থেকে – মুসলিম )। এই সাবধান বাণীতেও আশ্বস্থ না হতে পেরে বিশ্বনবী (সা.) আরও ভয়ংকর শাস্তির কথা শোনালেন। বললেন- কোর’আনের কোন আয়াতের অর্থ নিয়ে বিতর্ক কুফর। এবং কোন অর্থ নিয়ে মতান্তর উপস্থিত হলে আমাদেরকে কি করতে হবে তারও নির্দেশ তিনি আমাদের দিচ্ছেন। বলছেন, কোন মতান্তর উপস্থিত হলে তা আল্লাহর উপর ছেড়ে দাও ( হাদিস- মুসলিম, মেশকাত )। অর্থাৎ দীনের ব্যাপারে যখনই মতান্তর উদ্ভব হবে তখনই চুপ হয়ে যাবে, কোন তর্ক-বিতর্ক করবে না। অর্থাৎ বিতর্কে যেয়ে কুফরি করবে না, এবং যে বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই সেই সেরাতুল মোস্তাকীম, দীনুল কাইয়্যেমাকে আঁকড়ে ধরে থাকো, এখানে লক্ষ্য করার একটা বিষয় আছে, দীনের ব্যাপার নিয়ে বিতর্ককে আল্লাহর রসুল (সা.) কোন পর্যায়ের গুনাহ, পাপ বলে আখ্যায়িত করছেন। চুরি নয়, হত্যা নয়, ব্যভিচার নয়, বলছেন- কুফর। যার চেয়ে বড় আর গোনাহ নেই, শুধু তাই নয় যা একজনকে এই দীন থেকেই বহিষ্কৃত করে দেয়। এতবড় শাস্তি কেন? শেষ নবীর (সা.) হাদিস থেকেই এর উত্তর পাওয়া যাবে। তিনি বলছেন- তোমরা কি জান, ইসলামকে কিসে ধ্বংস করবে? এই প্রশ্ন করে তিনি নিজেই জবাব দিচ্ছেন- শিক্ষিতদের ভুল, মোনাফেকদের বিতর্ক এবং নেতাদের ভুল ফতোয়া ( হাদিস- মেশকাত )। যে কাজ ইসলামকেই ধ্বংস করে দেয় সে কাজের চেয়ে বড় গোনাহ আর কী হতে পারে! তাই বিশ্বনবী (সা.) এই কাজকে কুফ্রি বলে সঠিক কথাই বলছেন।
এই জাতির মহা দুর্ভাগ্য। আল্লাহর ও তাঁর রসুলের (সা.) এতসব কঠোর সতর্কবাণী এই উম্মাহর পণ্ডিতদের কিছুই মনে নেই। তারা সারা জীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে কোর’আন-হাদিসের সূক্ষাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে বিরাট বিরাট ফেকাহ শাস্ত্র গড়ে তুলতে থাকলেন। এদের মনীষার, প্রতিভার, অধ্যবসায়ের কথা চিন্তা করলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে, কিন্তু তাদের ঐ কাজের ফলে এই উম্মাহ ছিন্ন-বিছিন্ন হয়ে ধ্বংস হয়ে গেলো, শত্র“র কাছে পরাজিত হয়ে গেলো। কাজেই বর্তমানের এই যে মুসলিমরা বিভিন্ন দলে- উপদলে, ফেরকা-মাযহাবে বিভক্ত হয়ে নিজেরা নিজেরা শত মুখী সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে, হানাহানি- মারামারি, বোমাবাজি করছে তার পেছনের জ্বালানী হিসেবে কাজ করেছে কে? তথাকথিত ধর্মব্যবসায়ী আলেম-পুরোহিতরাই নয় কি?

জঙ্গিবাদের ইতিবৃত্ত

জঙ্গিবাদের ইতিবৃত্ত


মাসুদ রানা
জঙ্গিবাদ সৃষ্টির কারণ: জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড একটি আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হয়। ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা থেকে এর জন্ম। ধর্মব্যবসায়ী মোল্লারা মাদ্রাসা, মক্তব, মিলাদ, মাহফিল, ওয়াজ, সভা-সম্মেলন ইত্যাদি করে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মানুভূতি জাগিয়ে তুলে অন্যায় পথে পরিচালিত করে। অধিকাংশ সময়ই রাজনৈতিক স্বার্থে জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে বোঝানো হয়- অমুক কাফের, অমুক নাস্তিক, অমুককে মারতে পারলে জান্নাত নিশ্চিত ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব বলে ধর্মব্যবসায়ী প্রতারকরা সাধারণ মানুষকে সহিংসতার পথে ঠেলে দেয়, যা এক সময় রূপ নেয় হৃদয়বিদারী ধ্বংসযজ্ঞে।
আরেক ধরনের জঙ্গি গ্রুপ রয়েছে যারা আরও ভয়াবহ। এরা আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে দেশে, পাহাড়ে-জঙ্গলে জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করে; সিনেমা হল, পর্যটন কেন্দ্র, পার্ক, স্কুল, অফিস-আদালত ইত্যাদি স্থানে বোমা হামলা করে, জনজীবনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এদের উত্থানের পেছনেও কোনো না কোনোভাবে ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণির যোগসাজস থাকেই, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঐ ধর্মব্যবসায়ীদের ব্যবহার করে প্রধান কলকাঠি নাড়ায় পশ্চিমারা। আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের ইতিহাস ও তথ্য-উপাত্ত পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়, এসব বড় বড় জঙ্গি গ্র“পগুলোকে পশ্চিমারা প্রাথমিকভাবে অস্ত্র, অর্থ, প্রশিক্ষণ দিয়ে, নিরাপত্তা দিয়ে তৈরি করে, অতঃপর তাদেরকে ব্যবহার করে বিভিন্ন অঞ্চলের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করে। এমনও হয়েছে যে, পশ্চিমা কুচক্রী মহল সরাসরি এদেরকে অস্ত্র সাহায্য দিয়ে তাদের শত্র“শক্তির বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে, অনেকটা শত্রু দিয়ে শত্রু ঘায়েলের মতো। তবে এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতিকদের স্বার্থের কারণেই হোক, আর পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্রেই হোক জঙ্গিরা সর্বদাই পরিচালিত হয়েছে আদর্শ দ্বারা, এবং সে আদর্শ হচ্ছে ইসলাম। তারা ইসলামকে, আল্লাহ-আল্লাহর রসুলকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে, যার কারণে বুকে মাইন বেঁধে শত্র“সমেত আত্মঘাতী হতেও তাদের আত্মা কাঁপে না, প্রাণের মায়া তাদের পথরোধ করতে পারে না। আল্লাহ-আল্লাহর রসুল, ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য তারা অকাতরে তাদের মূল্যবান জীবন বিসর্জন দেয়।
জঙ্গিবাদ নির্মূলের উপায়: দেড়যুগ ধরে জঙ্গিবাদ সারা বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে রক্তের বন্যায় লাল হয়ে গেছে পৃথিবীর মাটি, ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে আফগানিস্তান, ইরাক। পাকিস্তান, সিরিয়া, নাইজেরিয়াসহ বিশ্বের প্রায় সকল মুসলিম দেশেই জ্বলছে জঙ্গিবাদ নামক সহিংসতার আগুন। কেবল ইরাকেই মারা গেছে ১০ লক্ষ আদম সন্তান। বিশ্বের সুপার পাওয়ারগুলি তাদের সর্বাত্মক সামরিক শক্তি ও অর্থ বিনিয়োগ করেও এই সমস্যার কোনো কূল-কিনারা করতে পারে নি। জঙ্গিরা মরছে, বেঁচে থাকছে জঙ্গিবাদ। যতই তাদেরকে জোর করে দমনের চেষ্টা করা হচ্ছে, ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে ততই তাদের উগ্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে, এমন কি তারা আত্মঘাতীও হচ্ছে। এভাবে দিন দিন বেড়েই চলেছে ধর্মের নামে সহিংসতা, জনগণের দুর্ভোগ, কিন্তু কোনো সমাধান আসছে না। দীর্ঘ দেড় যুগের এত অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির পর অবশ্য এখন জ্ঞানী-গুণীরা একমত হচ্ছেন যে, শক্তিপ্রয়োগে, সামরিক কায়দায় জঙ্গিবাদ দমন করা সম্ভব নয়; কারণ জঙ্গিবাদ কোনো সাধারণ ও বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নয়, এটি একটি বিকৃত আদর্শ। এই আদর্শ যতদিন টিকে থাকবে, জঙ্গিবাদও ততদিন টিকে থাকবে। তাই একে মোকাবেলাও করতে হবে আদর্শ দিয়েই। সহজভাবে বলতে গেলে, ‘কোর’আন হাদিসের অপব্যাখ্যার মাধ্যমেই জঙ্গিবাদ নামক এই ভুল মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। এই আদর্শিক যুদ্ধে জয়ী হতে হলে কোর’আন হাদিসের সেই বিষয়গুলির সঠিক ব্যাখ্যা মানুষকে জানাতে হবে।’

ইহুদিবাদীদের চক্রান্ত

ইহুদিবাদীদের চক্রান্ত


এনামুল হক বাপ্পা
১৮৯৭ সনে ইহুদিবাদের (Zionism) অনুসারী চক্রান্ত বিশারদ ইহুদি নেতাগণ সারা দুনিয়ায় তাদের আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের এক কর্মসূচি বা প্রটোকল চূড়ান্ত করে যে সম্পর্কে বিশ্বরাজনীতি-সচেতন সকলেই জানেন। এই কর্মসূচিগুলিকে একত্রে বই আকারে বলা হয় The Protocols of the Elders of Zion. একথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায় যে, পাঠকমাত্রই বইখানা পড়ে বিস্ময়ে হতবাক হতে বাধ্য হবেন এবং ঐ পুস্তকে চক্রান্তজালের যে কর্মসূচি পেশ করা হয়েছে তা পাঠ করার সময় পাঠক অনুভব করতে বাধ্য হবেন যে, তিনি নিজেও এ ষড়যন্ত্রের নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে আছেন। গত এক শতকের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, পৃথিবীতে যে কয়টি বড় ধরনের ঘটনা বা দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, এবং মানবজাতি যেভাবে জীবনব্যবস্থা দ্বারা সৃষ্ট সঙ্কটের জটিল আবর্তে আটকে পড়েছে এর সবই প্রটোকল বইয়ে পূর্ব থেকেই ভবিষ্যদ্বাণীর মতো লিপিবদ্ধ রয়েছে।
ইহুদি শিক্ষিত জ্ঞানী ব্যক্তিরা তাদের প্রটোকলে এতই সুচতুরতা প্রকাশ করেছে যে, তারা গইমদের (অ-ইহুদিদের গইম বলে অভিহিত করা হয়) ‘নির্বোধ’ বলে অভিহিত করে। বইয়ের একটি অধ্যায়ের নামই GENTILES ARE STUPID. কমুনিস্ট আন্দোলনের মূলে যাদের মন-মগজ কাজ করছে তাদের সকলেই ইহুদি। কমুনিজমের জন্মদাতা কার্ল মার্কস মাতাপিতা উভয় দিক থেকেই ইহুদি! লেলিন এবং ট্রটস্কিও ইহুদি বংশেরই সন্তান। লেলিনের দাদা, মা এবং স্ট্যালিনের স্ত্রী ইহুদি ছিলেন।
এখন ইহুদিদের সুদূর প্রসারী শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে একটু বলি। বিশ্বব্যাপী ইহুদিবাদ যাতে করে নির্বিঘেœ পরিচালিত হতে পারে এবং তাদের এই ইহুদিবাদ তত্ত্ব যেন কেউ বুঝতে না পারে আর তাদের অজান্তেই যেন তারা একে সমর্থন করে এই সূত্র মাথায় রেখেই তারা বিশ্বব্যাপী শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করার জন্য পরিকল্পনা করে। তাদের প্রটোকল পুস্তকের Re-education বা “শিক্ষাব্যবস্থার নতুন রূপ” অধ্যায়ে এই বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। আমি উল্লেখযোগ্য কিছু অংশের ভাবানুবাদ তুলে ধরছি।
একমাত্র আমাদের ছাড়া দুনিয়ার যাবতীয় সমষ্টিগত শক্তি বিনষ্ট করার জন্য প্রথমেই আমরা সমষ্টির শিক্ষা যেখান থেকে আরম্ভ অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এক নবতর শিক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে বীর্যহীন (Emasculate) করে দেব। এ শিক্ষাগারের সকল অধ্যাপক ও কর্মচারীবৃন্দ একটা বিস্তারিত কার্যসূচী অনুসারে নতুন দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত হবেন। এবং কখনও এক চুল পরিমাণও (Iota) এদিক সেদিক নড়াচড়া করবেন না। বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে তাদের নিয়োগ করা হবে এবং তারা সরকারের উপর পরিপূর্ণরূপে নির্ভরশীল হবে।
রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন-কানুন ও রাজনীতি সংক্রান্ত অপরাপর প্রয়োজনীয় বিষয়াবলীকে আমরা পাঠ্য তালিকার বহির্ভূত করে দেব। গইমদের বিশ্বজোড়া শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি লক্ষ্য করলে তোমরা বুঝতে পারবে যে, রাষ্ট্র সংক্রান্ত ব্যাপারে ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী বিপুল জনতা অবান্তর কল্পনা বিলাসী ও অবাঞ্ছিত নাগরিক (Utopian dreamers and bad subjects) সৃষ্টি করে মাত্র। আমরা ক্ষমতা লাভ করার পর পাঠ্যতালিকা থেকে গোলযোগ সৃষ্টিকারী সকল বিষয় (Disturbing subjects) বাদ দিয়ে দেব এবং যুবসমাজকে শাসন কর্তৃপক্ষের অনুগত সন্তানে পরিণত করবো। আমরা ইতিহাসকে পাল্টে দেব। পূর্ববর্তী শতাব্দীগুলোর যেসব ঘটনা আমাদের জন্য অবাঞ্ছিত সেগুলোর স্মৃতি মানুষের স্মৃতিপট থেকে মুছে দেব। শুধু গইম সরকারের ভুল-ভ্রান্তির ইতিহাস তাদের স্মৃতিপটে জাগ্রত করে রাখার ব্যবস্থা করবো। আমরা শিক্ষা সম্পর্কিত যাবতীয় স্বাধীনতা বিলোপ করে দেব।
এক কথায় আমরা শত শত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পেরেছি যে, মানুষ কোনো না কোনো খেয়াল বা হুজুগ (Ideas) দ্বারা পরিচালিত হয় ও খেয়ালের নেশায়ই জীবনযাপন করে আর এসব খেয়াল মানুষের মন-মগজে শিক্ষার মাধ্যমেই বদ্ধমূল হয়ে যায়। বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্রময় পদ্ধতিতে আমরা মানুষের স্বাধীন চিন্তার শেষ বিন্দুটুকু পর্যন্ত তাদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মানুষগুলোকে আমাদের কাজে প্রয়োগ করবো। এটা করার উদ্দেশ্য হলো, গইম সমাজকে চিন্তাশক্তিহীন অনুগত পশুর (Unthinking submissive brutes) স্তরে নামিয়ে আনা যেন তাদের চোখের সামনে কোন কিছু পেশ না করা পর্যন্ত তারা নিজস্ব চিন্তার সাহায্যে কোন ধারণাই পোষণ করতে না পারে।

ধর্মগ্রন্থ ও শাস্ত্রের বিধানই মানুষকে শান্তি দিয়েছে

ধর্মগ্রন্থ ও শাস্ত্রের বিধানই মানুষকে শান্তি দিয়েছে


রিয়াদুল হাসান
বর্তমানে ইসলাম সম্বন্ধে দু’টি ভুল ধারণা প্রচলিত। একটি হলো মুসলিম বলে পরিচিত জাতিটি যে ধর্মে বিশ্বাস করে এটিকে বলা হয় ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্মকে অন্য বিভিন্ন নাম দেয়া হয়েছে। কিন্তু আসলে আল্লাহ আদম (আ.) থেকে শুরু করে শেষ নবী (সা.) পর্যন্ত যতবার যতভাবে জীবন-বিধান পাঠিয়েছেন সবগুলোরই ঐ একই নাম ইসলাম, শান্তি অর্থাৎ যে জীবন-বিধান অনুসরণ করে চললে মানুষ শান্তিতে সুখে বাস করতে পারবে আর অস্বীকার করলে তার অবধারিত পরিণতি অশান্তি, রক্তারক্তি, অবিচার। রাজনৈতিক আর্থ-সামাজিক অবিচার- যা মালায়েকরা বলেছিলেন।
দ্বিতীয়টি হলো এই ধারণা (আকীদা) যে, আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণের নাম ইসলাম। এটাও ভুল। কারণ আল্লাহ ইচ্ছা করলে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করবে। কোন অবিশ্বাসী, কোন সন্দেহকারী, কোন মুশরিক বা মোনাফেক থাকবে না (সুরা আল আনা’ম ৩৫, সুরা ইউনুস ১০০)। কাজেই তা নয়। আল্লাহ মানুষের মধ্যে তার নিজের আত্মা ফুঁকে দিয়েছেন অর্থ মানুষের মধ্যে যুক্তির শক্তি, বুদ্ধি, জ্ঞান ও সর্বোপরি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন, দিয়ে নবী পাঠিয়ে তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন, যে পথে চললে সে নিজেদের মধ্যে মারামারি, রক্তারক্তি না করে শান্তিতে থাকে। এরপর তিনি দেখবেন কে বা কারা তাঁর দেখানো পথে চলবে আর কে বা কারা তা চলবে না।
কাজেই আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণের নাম ইসলাম নয়। তাঁর দেয়া জীবন-ব্যবস্থাকে গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠা করার ফল হিসাবে যে শান্তি সেই শান্তির নাম ইসলাম। মানুষ যদি যেসব নিয়ম, আইনের মধ্যে এই জগত সৃষ্টি করা হয়েছে ও চলছে তা সব জানতো তবে হয়তো মানুষই নিজেদের জন্য এমন জীবন-ব্যবস্থা, ধর্ম তৈরি করে নিতে পারতো যা মেনে চললেও ঐ শান্তি ইসলাম আসতে পারতো। কিন্তু মানুষ তা জানে না- তাকে আল্লাহ অতখানি জ্ঞান দেন নি। তাই স্রষ্টা তাকে বলে দিয়েছেন কোন পথে চললে, কেমন জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করলে ঐ অভীষ্ট শান্তি, ইসলাম আসবে। বলে দিয়েছেন তাঁর নবীদের মাধ্যমে। রাজা মনু (নুহ্ আ.), শ্রী কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির, ইব্রাহীম (আ.), মুসা (আ.), ঈসা (আ.) এবং আরও অনেক অনেক নবী-রসুলদের মাধ্যমে এবং সর্বশেষে মোহাম্মদের (সা.) মাধ্যমে। [মনু (নুহ্ আ.) কৃষ্ণ (আ.), যুধিষ্ঠির (ইদরীস আঃ) এরা যে নবী ছিলেন তা আমার গবেষণার ফল, ব্যক্তিগত অভিমত। এ অভিমত আমি অন্য কাউকে গ্রহণ করতে জোর করছি না]। কোন প্রাণী হত্যা করবো না, কেউ আমার কোট চুরি করলে তাকে জোব্বাটাও দিয়ে দিবো, এ অর্থে এ ইসলাম নয়। যে ধর্ম ঐ শিক্ষা প্রচার করে তারা সংখ্যায় পৃথিবীতে অন্য সব ধর্মের চেয়ে বেশি কিন্তু সমস্ত পৃথিবী আজ ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি অশান্তি আর রক্তারক্তিতে লিপ্ত। শুধু তাই নয় ঐ মতে বিশ্বাসীরা এই শতাব্দীতেই দু’বার নিজেদের মধ্যে মহাযুদ্ধ বাঁধিয়ে প্রায় পনের কোটি মানুষ হত্যা করেছে, হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর দু’টি কয়েক লক্ষ মানুষসহ ধ্বংস করেছে এবং আজ পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে সম্পূর্ণ মানব জাতিটাকেই ধ্বংস করার মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে।
মানুষকে নিজেদের মধ্যে অশান্তি, অবিচার, মারামারি না করে শান্তিতে, ইসলামে থাকার জন্য জীবন বিধান দিয়ে আল্লাহ যুগে যুগে পৃথিবীর প্রতি স্থানে, প্রতি জনপদে, প্রতি জাতিতে তার প্রেরিতদের, নবীদের পাঠিয়েছেন (সুরা আন নহল ৩৬)। মানুষ জাতির কিছু অংশ তা গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠা করেছে, কিছু অংশ করে নি। যারা গ্রহণ করেছে তাদের সমাজের রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি জীবনের সমস্ত কিছুই ঐ ব্যবস্থার নির্দেশে পরিচালিত হয়েছে। তাদের সমাজের আইনের উৎস শুধু ঐ জীবন-বিধান বা ধর্মই ছিল না ঐ বিধানই আইন ছিল, ওর বাহিরের কোন আইন সমাজ গ্রহণ করত না। অনেক কারণে আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধান বদলিয়ে ফেলে বা ইচ্ছামতো তার ভুল ব্যাখ্যা করে তা চালানো হয়েছে। কিন্তু ঐ ভুল ও অন্যায় আইনকেও সেই ধর্ম বা দীনের আইন বলেই চালানো হয়েছে। তার বাহিরের, মানুষের তৈরি বলে চালানো যায় নি। পৃথিবীর ইতিহাসকে না তলিয়ে, শুধু এক নজরে যারা পড়েছেন তারাও এ কথা অস্বীকার করতে পারবেন না যে মানব সমাজ চিরদিন শাসিত হয়ে এসেছে ধর্মের আইন দিয়ে। যখন যেখানে যে নবী ধর্ম বা জীবন-বিধান প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেখানে রাজা বা শাসনকর্তা শাসন করেছেন সেই আইন দিয়ে- অন্য কোন কিছু দিয়ে নয়। আইনের নির্দেশ, উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন সমাজের বিজ্ঞেরা, পুরোহিতরা, আর তাকে প্রয়োগ করেছেন রাজারা, শাসকরা। ওর বাইরের কোন আইন, আদেশ চালাবার চেষ্টা করলে সমাজ তা গ্রহণ করত না, প্রয়োজনে বিদ্রোহ করত। উদাহরণ হিসাবে পশ্চিম এশিয়া নিন। ইহুদিদের আগে ওখানে আমন বা রা দেবতা থেকে শুরু করে অনেক রকম দেব-দেবীর ধর্মের আইন চলতো। ওগুলোও পূর্বতন কোন নবীর আনা দীনের বিকৃতির ফল ছিল। ইব্রাহীম (আ.) আবার আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, তওহীদ প্রতিষ্ঠা করার পর ইহুদিরা যতদিন মধ্য এশিয়ায় ছিল ততদিন ঐ আল্লাহ প্রেরিত দীনই ছিল তাদের জাতির আইন। ভারতের কথা ধরুন। রামায়ন, মহাভারতসহ ইতিহাস পড়ুন। দেখবেন রাজারা শাসন করেছেন শাস্ত্রানুযায়ী- অর্থাৎ ওটাই ছিল শাসনতন্ত্র (Constitution)। ঐশ্বরিক বইয়ের (Scripture) উপর ভিত্তি করে শাস্ত্র, সেই শাস্ত্রের বিধান দিতেন ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা এবং বিধান বা আইন জনগণের উপর প্রয়োগ ও তার রক্ষার দায়িত্ব ছিল ক্ষত্রিয় রাজাদের উপর। এই শাস্ত্রীয় বিধানের বিরুদ্ধে কোন আদেশ, নির্দেশ দেয়া রাজা বা শাসকের সাধ্য ছিল না। ইউরোপের অবস্থাও তাই ছিল। পোপের নির্দেশে রাজ্য শাসন করতেন রাজারা। কোন রাজা পোপের নির্দেশ অমান্য করতে পারতেন না- করলে তার দুরবস্থার সীমা থাকত না। মোট কথা পৃথিবীর কোথাও আইনের উৎস ধর্ম ছাড়া আর কোন কিছুকে গ্রহণ করা হয় নি।
এ পর্যন্ত যা বলে এলাম, তা সমস্তটা একত্র করলে আমরা একটা পরিষ্কার ছবি পাই। সেটা হলো- গোটা পৃথিবীটাকে পটভূমি হিসাবে নিয়ে মানুষ সৃষ্টির সময় থেকে যদি আরম্ভ করি তবে দেখতে পাই যে প্রথম মানব আদম (আ.) আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধান, দীন ইসলাম অনুযায়ী চলতে লাগলেন তার সন্তান-সন্তুতি নিয়ে এবং ফলে শান্তিতে বাস করতে থাকলেন। ইবলিস তার প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী চেষ্টা চালাতে লাগলো সেই জীবন ব্যবস্থা থেকে মানুষকে বিচ্যুত করতে। মানুষেরই ভেতরে বসে তাকে প্ররোচনা দিয়ে আইন ভঙ্গ করাতে। কাবলকে দিয়ে তার ভাই হাবলকে হত্যা করালো। তারপর আরো আইন ভাঙ্গার ফলে যখন ওটা যথেষ্ট বিকৃত হয়ে গেলো তখন আল্লাহ পাঠালেন দ্বিতীয় রসুল। তার ডাকে সাড়া দিয়ে অনেকে নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করলো অনেকে রয়ে গেলো সেই পুরোনো ব্যবস্থায়- যেটা ছিল আদমের (আ.) উপর দেয়া। সৃষ্টি হলো দু’টো দীন, দু’টো ধর্ম, দু’টো জীবনব্যবস্থা। এদিকে মানুষের বংশ বৃদ্ধি চলছেই। আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়লো আদম সন্তানরা পৃথিবীর চারিদিকে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যেখানেই তারা বসতি স্থাপন করলো সেখানেই আসতে লাগলেন প্রেরিত নবীরা আল্লাহর দেয়া দীনুল কাইয়্যেমা, সনাতন ধর্ম নিয়ে। উদ্দেশ্য সেই একই- মানুষ যেন নিজেদের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি না করে, রক্তপাত না করে শান্তি ও সুখে বাস করতে পারে। একই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নবী উপস্থিত ছিলেন। কেউ হয়তো চীনের এক প্রান্তে, কেউ দক্ষিণ আমেরিকায়, কেউ ইউরোপে, কেউ মধ্য এশিয়ায়, কেউ ভারতের কোন কোণে। আল্লাহ তাঁর দায়িত্ব এক মুহূর্তের জন্য ভুলে যান নি। যুগ বয়ে চলেছে, নবীরা মানুষের জন্য জীবন-ধর্ম দিয়ে চলে যাচ্ছেন, শয়তান মানুষকে প্ররোচনা দিয়ে সেগুলো বিকৃত, অকেজো করে ফেলছে। তারা আবার আসছেন আবার নতুন করে জীবন পথ দিচ্ছেন, নতুন ধর্ম সৃষ্টি হয়ে চলেছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই অতীতে হারিয়ে গেছেন। তারাও হারিয়ে গেছেন, তাদের মাধ্যমে প্রেরিত জীবনব্যবস্থা গুলিও হারিয়ে গেছে। আমরা পেছন দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই তাদের আনা ইসলামকেও দেখতে পাই। পাই, কিন্তু অত্যন্ত অস্পষ্টভাবে এবং মানুষের হস্তক্ষেপের ফলে বিকৃতভাবে।
এই হলো মানুষের প্রকৃত অতীত। ইতিহাসকে বহুলোক বহুভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু সত্য গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যান, ন্যায় ও অন্যায়ের অবিরাম দ্বন্দ্ব, সমষ্টি ও ব্যক্তিগতভাবে মানুষের আত্মাকে একদিকে ইবলিস অন্যদিকে আল্লাহর আত্মা, রুহাল্লাহর টানাটানি- এই হলো আদম (আ.) থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত মানুষের সত্যিকার অতীত। এবং এ শুধু অতীত নয় ভবিষ্যতও নিঃসন্দেহে এই-ই। এর কোন বিরতি, কোন চ্যুতি হয় নি, হচ্ছে না, হবে না।

তাহলে ধর্মজীবী মোল্লারা খাবেন কী করে???

তাহলে ধর্মজীবী মোল্লারা খাবেন কী করে???


আরিফ মোহাম্মদ আলী আহসান
আমরা যখন প্রকৃত ইসলাম কী এবং কিভাবে প্রকৃত ইসলাম মানবজীবনে প্রতিষ্ঠা করতে হবে এই বিষয়গুলো মানুষের সামনে তুলি ধরি, তখন সঙ্গতভাবেই ধর্মব্যবসায়ী আলেমদের প্রসঙ্গ এসে যায়। কারণ তারাই প্রচলিত ইসলামের অভিভাবক ও ধ্বজাধারী সেজে আছে। অথচ প্রকৃত ইসলামে ধর্মব্যবসার কোন সুযোগ নেই, রসুলাল্লাহর সময় এই ধর্মজীবিদের কোন অস্তিত্বও ছিল না। দীনের বিকৃতি ঘটায় ও খ্রিস্টানদের ঔপনিবেশিক শাসনামলে চক্রান্তের ফাঁদে পড়ে এই পুরোহিত শ্রেণি একেবারে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। এ কারণে প্রকৃত ইসলামের কথা বললে ধর্মজীবীদের অবৈধ বাণিজ্যের বিষয়টি এড়ানোর কোন সুযোগ থাকে না। তাই আমাদেরকে অনেকে প্রশ্ন করেন- তাহলে তারা কী করে খাবেন? তারা কী করে খাবেন তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এখন তারা কী খাচ্ছেন? আল্লাহ বলছেন, আল্লাহ যা নাজেল করেছেন যারা তা গোপন করে এবং এর বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে তারা তাদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছু প্রবেশ করায় না। (সুরা বাকারা ১৭৪)। সুতরাং ধর্মজীবী আলেমরা জাহান্নামের আগুন দিয়ে উদর পূর্তি করছেন। প্রশ্ন হলো, জাহান্নামের আগুন না খেলে তারা খাবেন কী? এর জবাব হলো:
১। ধর্মব্যবসা আমারা নিষেধ করি নি, স্বয়ং আল্লাহ নিষেধ করছেন। শুধু নিষেধই করেন নি, ধর্মের কথা বলে বিনিময় নিলে তাকে তিনি জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। ক্ষুধার তাড়নায়, কোন উপায় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত পশু, শুকরের গোশত খেলেও আল্লাহ ক্ষমা করবেন কিন্তু কোন অবস্থাতেই দীনের কাজের বিনিময় নেয়া যাবে না একথা আল্লাহ কঠোরভাবে নিষেধ করে দিয়েছেন (সুরা বাকারা ১৭৩-১৭৫)। সুতরাং প্রশ্নটি আমাদের করে কী লাভ? বরং আল্লাহকেই প্রশ্নটি করা দরকার যেহেতু নিষেধটি স্বয়ং আল্লাহই করেছেন।
২। নামাজ পড়ানোর জন্য তারা যে সময় ব্যয় করেন- মুসুল্লীও সেই একই সময় ব্যয় করেন, ওয়াজ করে তিনি যে সময় ব্যয় করেন- যে ওয়াজ শোনেন সেও একই সময় ব্যয় করেন। মুসল্লীগণ ও ওয়াজ শুনতে আসা লোকজন কী করে জীবন ধারণ করেন? নিশ্চয় তারা সামাজে অন্য সকলের মতো ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প কারখানা, ক্ষেতখামার বা চাকুরী-বাকুরী করে জীবিকা নির্বাহ করেন? তাহলে ধর্ম নিয়ে কেন ব্যবসা করতে হবে? সকলের মতো তাদের জন্যও জীবিকা আহরণের পথ খোলা রয়েছে।
৩। সুরা জুম’আতে আল্লাহ বলেছেন নামাজ শেষে তোমরা কর্মে বেরিয়ে পড়? সুতরাং সকলের জন্যই জীবিকার নির্বাহ আবশ্যকীয়, অলসতার কোন সুযোগ নেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় রসুলাল্লাহও জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে একজন ইহুদির কূপ থেকে পানি তুলে দিতেন। প্রকৃত ইসলামের খলিফাগণও কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেছেন; বৃদ্ধ আবু বকর (র:) কাপড়ের গাট্টি মাথায় করে বাজারের দিকে ছুটেছেন, আলী (রা:) যবের আটা পিষে বিক্রি করেছেন এবং কুলির কাজ করেছেন। কিন্তু তাঁরা চাইলে খুব সহজেই ধর্মের বিনিময় নিতে পারতেন। খানকা, হুজরা, মসজিদ, মাদ্রাসা তৈরি করে সেখানে বসে এখনকার মোল্লাদের চেয়ে বেশি আয়-রোজগার করতে পারতেন, ওয়াজ করে কাড়ি কাড়ি টাকা কামাতে পারতেন (নাউযুবিল্লাহ)। কিন্তু তাঁরা তা করেন নি, বরং কঠোরভাবে আল্লাহর হুকুম মান্য করেছেন। তাহলে ধর্মজীবীদের অন্য সকলের মতো কাজ করে উপার্জনে বাধা কোথায়?
রসুলাল্লাহ বলেন হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি, জীবিকা নির্বাহের জন্য সম্ভাব্য সকল উপায়ে চেষ্টা করো এবং তোমাদের প্রচেষ্টার পরিপূর্ণতার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করো। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, কোন মুমিনের সত্তাকে দুনিয়ায় বেকার এবং অনর্থক সৃষ্টি করা হয় নি। বরং তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কর্ম ও কর্তব্যের সঙ্গে সংযুক্ত। কর্ম ও প্রচেষ্টার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অল্পে সন্তুষ্টি এবং আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার অর্থ এ নয় যে, হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা এবং নিজের বোঝা অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া। নিশ্চয়ই আল্লাহর উপর ভরসা করা আমাদের প্রধান কর্তব্য। কিন্তু রেযেক হাসিল করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা নিতান্তই জরুরী বিষয় (মহানবীর স. ভাষণ-ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)।
নায়েবে রসুলের দাবীদার ধর্মব্যবসায়ীরা ছাড়া রসুলের এ কথার বাইরে তো কাউকে দেখা যায় না। আল্লাহ ও তাঁর রসুলের নিষেধ অমান্য করে যারা ধর্মব্যবসা করছেন সেই সকল ধর্ম ব্যবসায়ীরা কী করে খাবেন এ প্রশ্ন করা শুধু অনুচিত নয় আল্লাহ ও তাঁর রসুলের বিরুদ্ধাচারণও বটে। তবে এ কথাও ঠিক যে, তাদেরকে প্রচলিত সিস্টেমের মাধ্যমেই হারাম উপার্জনের দিকে এক প্রকার ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা যখন পরিকল্পিতভাবে তাদের উপনিবেশগুলিতে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে সেখানে তারা কেবল ধর্মীয় বিকৃত জ্ঞানই শিক্ষা দেয়। তাদের সিলেবাসে অংক, ভূগোল, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার কোন কিছুই রাখা হয় না। ফলে মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে এই সমস্ত আলেমরা রুজি-রোজগার করে বেঁচে থাকার জন্য ধর্ম বিক্রী করে রোজগার করা ছাড়া আর কোন পথ থাকে না। তাই বাধ্য হয়ে তারা দীন বিক্রি করে উপার্জন করে এবং ওয়াজ নসিহতের মাধ্যমে ঐ বিকৃত ইসলামটা এই জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা দেয়। এ উপমহাদেশসহ খ্রিস্টানরা তাদের অধিকৃত সমস্ত মুসলিম দেশগুলিতে এই একই নীতি কার্যকরি করেছে এবং সর্বত্র তারা একশ’ ভাগ সফল হয়েছে। এই নিশ্চিত এবং সহজ জীবিকা, দাওয়াত, খানা-পিনা ও মান-ইজ্জত হারানোর ভয়ে এখন আলেম সাহেবরা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ধর্মব্যবসাকে জায়েজ করার জন্য বহু ফতোয়া আবিষ্কার করেছেন। এজন্যই আল্লাহ তাদের বিষয়ে বলেছেন, “আগুন সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্য্যশীল (সুরা বাকারা ১৭৪)।”
মনে রাখতে হবে, অন্যের করুণার দানের উপর যারা নির্ভর করে তাদের নৈতিক বল থাকে না। যারা তাকে ভিক্ষা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে তারা কোন অন্যায় করলে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে না। এজন্যই কোন ধর্মব্যবসায়ী সমাজের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেন না। অথচ উম্মতে মোহাম্মদীর দায়িত্ব হচ্ছে মানুষকে সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে বাধা প্রদান করা, এজন্য সবার আগে দরকার নৈতিক বল। তাই আলেম দাবি করেও যারা এখনও ধর্মব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছেন তাদের উচিৎ এই হারাম উপার্জন বন্ধ করা, যেহেতু তারাই সব সময় ওয়াজ করেন যে কোন ইবাদত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে হালাল রুজি আর যে শরীর পুষ্ট হয় হারাম উপার্জনের দ্বারা সে শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না।

সমগ্র মানবজাতি হোক এক পরিবার

সমগ্র মানবজাতি হোক এক পরিবার


আমিরুল ইসলাম
মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ দেখলেন, আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে মানুষ জ্ঞান-বুদ্ধি-যোগাযোগ-বিবেক-কৃষ্টি ইত্যাদি এক কথায় বিবর্তনের এমন একটা বিন্দুতে পৌঁছল যে সমগ্র মানব জাতির জন্য একটি মাত্র জীবন-বিধান গ্রহণ করা তখন সম্ভব হবে। এটা মহান স্রষ্টার মহা পরিকল্পনারই একটি অংশ, যে পরিকল্পনা তিনি তার প্রতিনিধি মানুষ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়ই করেছিলেন। মানুষ বিবর্তনের এই বিন্দুতে পৌঁছামাত্র আল্লাহ পাঠালেন মোহাম্মদ বিন আব্দাল্লাহকে (সা.)। পূর্ববর্তী প্রেরিতদের মতো তাঁর মাধ্যমেও আল্লাহ পাঠালেন সেই দীনুল কাইয়্যেমা-সিরাতুল মোস্তাকীম অর্থাৎ আল্লাহকেই একমাত্র বিধাতা, সার্বভৌম হুকুমদাতা হিসাবে স্বীকার করে নেওয়া। ঐ সেরাতুল মোস্তাকীমকে ভিত্তি করে যে সংবিধান এলো সেটা এবার এলো সমস্ত মানব জাতির জন্য (কোর’আন- সূরা আত-তাকভীর ২৭)। আগের মতো নির্দিষ্ট কোন জাতি বা গোষ্ঠীর জন্য নয়। এর পরিষ্কার অর্থ হলো এই যে, আল্লাহ চান বিভক্ত বিচ্ছিন্ন মানব জাতি নিজেদের ভেদাভেদ ভুলে আবার একটি মাত্র জাতিতে পরিণত হোক। কারণ, তারা আসলে গোড়ায় একই বাবা-মা, আদম-হাওয়ার (অফধস-ঊাব) সন্তান অর্থাৎ একই জাতি কারণ তারা একই বাবা মা থেকে সৃষ্ট। স্বাভাবিক কারণে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল কিন্তু এখন আবার সময় এসেছে এক হয়ে শান্তিতে বসবাস করার অর্থাৎ আল্লাহ চান তাঁর এই প্রিয় সৃষ্টি বনি আদম আবার সকল বর্ণ, সকল ভেদাভেদ ভুলে তারা একটি জাতিতে পরিণত হোক। একটি জাতিতে পরিণত করার জন্য তিনি এমন একটি জীবন-ব্যবস্থা দিলেন, যেটা সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতি নির্ভর অর্থাৎ দীনুল ফেতরাহ। প্রাকৃতিক উপাদান বায়ু থেকে অক্সিজেন, সূর্য্য থেকে উত্তাপ গ্রহণের ক্ষেত্রে যেমন পৃথিবীর কোন জাতি বর্ণের মধ্যে কোন বৈষম্য নেই, তেমনিভাবে এই দীনটিও সকল এলাকার সকল মানুষ সমানভাবে গ্রহণ করতে পারবে। এই জীবনব্যবস্থা সমানভাবে সকল এলাকার মানুষের প্রয়োজন পূরণ করতে পারবে। নতুন সংবিধানে তিনি বললেন, “হে মানব জাতি! আমি তোমাদের একটি মাত্র পুরুষ ও একটি মাত্র স্ত্রী থেকে সৃষ্টি করেছি। জাতি গোষ্ঠীতে তোমাদের পরিণত করেছি যাতে তোমরা নিজেদের চিনতে পার। তোমাদের মধ্যে যে যত বেশি ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে সতর্ক, অর্থাৎ মোত্তাকী আল্লাহর চোখে সে তত বেশি সম্মানিত। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছুই জানেন। সব কিছুরই খবর রাখেন (কোর’আন- সুরা আল-হুজরাত ১৩)। এখানে আল্লাহ তিনটি কথা মানুষকে বলেছেন। ক) মানুষকে তিনি মাত্র একটি দম্পতি থেকে সৃষ্টি করেছেন অর্থাৎ সমস্ত মানব জাতি একই বংশের একই রক্তের; সুতরাং একই জাতি। খ) দেহের গঠনে, চামড়ার রংয়ে, ভাষায় ইত্যাদিতে যে বিভক্তি এ শুধু পরিচয়ের জন্য, তার বেশি কিছুই নয়।
এই কথাটা একটু পরিষ্কার করা দরকার। একটি লোকের কয়েকটি সন্তান আছে। সন্তানরা কেউ কালো, কেউ ফর্সা, কেই বাদামী, কেউ লম্বা, কেউ খাটো, কেউ মোটা, কেউ পাতলা। এদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নাম রাখা হয়। কেন? নিশ্চয়ই পরিচিতির জন্য। আল্লাহ বলছেন ‘মানব জাতিকে শুধু ঐ পরিচিতির জন্যই বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীতে, গায়ের রংয়ে, ভাষায় ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তাছাড়া এটা আল্লাহর সৃষ্টি কৌশলতার এক অনন্য সৌন্দর্য্য। যদি সকল মানুষ সাদা হতো অথবা সকল মানুষ একই উচ্চতার হতো তাহলে সৌন্দর্য্যরে কোন মানদণ্ড থাকত না, যেমন হাতের ৫টি আঙ্গুল একেকটি একেক আকৃতির এবং প্রত্যেকটিরই আলাদা-আলাদা সৌন্দর্য্য এবং কার্যকারিতা রয়েছে। এর মানে এই নয় যে খাট আঙ্গুলটি শ্রীহীন ও কম গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে বিভিন্ন বর্ণের হলেও ঐ লোকটির সন্তানদের মতোই পুরো মানবজাতি ভাই-বোন, একই জাতি। অর্থাৎ আল্লাহ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ-বৈষম্য মিটিয়ে দিচ্ছেন। গ) মানুষে মানুষে তফাতের একটি মাত্র সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিলেন, সেটি হলো ন্যায়-অন্যায়। ভালো-মন্দ দেখে যে যত সতর্কভাবে চলবে কাজ করবে- অর্থাৎ যে যত বেশি উন্নত চরিত্রের- সে তত বেশি আল্লাহর কাছে সম্মানিত। এক কথায় আল্লাহ বলছেন মানুষ এক জাতি, কেউ কারো চেয়ে বড় নয়, ছোট নয়, সব সমান। ছোট-বড়র একটি মাত্র মাপকাঠি, সেটি হলো ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠি। সেখানে চামড়ার রংয়ের, ভাষার, কোন দেশে কার জন্ম বা বাস এসবের কোন স্থান নেই। এবং ঐ ন্যায়-অন্যায়ের সংজ্ঞা হচ্ছে সেটা, যেটা আল্লাহ তার সংবিধান কোর’আনে দিয়ে দিয়েছেন। এই আয়াতটি ছাড়াও আল্লাহ কোর’আনের বিভিন্ন স্থানে বলেছেন একই আদম-হাওয়া থেকে সৃষ্ট বলে সমস্ত মানব জাতি এক জাতি। সুতরাং এ কথা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, ভৌগোলিক বা গায়ের রং, ভাষা ইত্যাদি ভিত্তিক জাতি আল্লাহর দেয়া জীবন-ব্যবস্থার সরাসরি পরিপন্থী, উল্টো। একটা হচ্ছে আদর্শের উপর ভিত্তি করে, যে আদর্শ হচ্ছে সত্য ও ন্যায়ের, অন্যগুলি হচ্ছে মানুষের খেয়ালখুশি মতো পৃথিবীর বুকের উপর লাইন টেনে গায়ের রংয়ের উপর বা ভাষার উপর ভিত্তি করে। দু’টো একত্রে চলতে পারে না- অসম্ভব, একথা বুঝতে পণ্ডিত হবার দরকার নেই।
আজ সারা পৃথিবী জুড়ে চামড়ার রং, ভাষা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করা জাতিগুলি প্রত্যেকটি নিজেদের ছাড়া বাকী মানব গোষ্ঠী থেকে আলাদা, স্বতন্ত্রভাবে দেখে; শুধু স্বতন্ত্রভাবেই দেখে না বর্তমানে এক দেশ আর এক দেশের সঙ্গে শত্র“ভাবাপন্নে পরিণত হয়েছে। এর কারণ ঐ সব জাতিগুলির প্রত্যেকটির জাতীয় স্বার্থ বিভিন্ন অর্থাৎ একেক জাতির একেক স্বার্থ। তাদের প্রত্যেকেরই মনোভাব হচ্ছে যে কোন উপায়েই হোক নিজের স্বার্থ রক্ষা করতেই হবে, এতে পার্শ্ববর্তী দেশের কত মানুষ হত্যা করতে হবে, কত বাড়ী-ঘর, জনপথ ধ্বংস করা হবে তার কোন হিসাব করার প্রয়োজন নাই, কোন ন্যায়-নীতি, মানবতার বালাই নাই। নিজ দেশের সীমান্তে নদীর গতিপথে বাঁধ দিয়ে অন্যদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করে দেওয়া ন্যায়সঙ্গত করে নিয়েছে। মানুষ জীবিকা ও অন্য কোন প্রয়োজনে এই সীমানা অতিক্রমের চেষ্টা করলে সীমান্তরক্ষীদের গুলি তাদেরকে ঝাঁঝরা করে দেয়। অথচ পৃথিবীর এই মাটি থেকে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই মাটিতেই আবার সকল আদম সন্তানকে ফেরত যেতে হবে সুতরাং সৃষ্টিগতভাবেই এই মাটির উপর, এই পৃথিবীর উপর মানুষের পূর্ণ অধিকার, হক রয়েছে। মানুষ ইচ্ছা করলে এই পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে যেতে পারে, যে কোন জায়গায় বসবাস করতে পারে। এই পৃথিবী আল্লাহ মানুষের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেছেন মানুষ হচ্ছে পৃথিবীর বুকে তাঁর প্রতিনিধি, খলিফা। এখানে তিনি পৃথিবীর বুকে কোন বিভক্তিরেখা আরোপ করেন নি। সুতরাং এই সম্পূর্ণ পৃথিবীর উপর প্রতিটি মানুষের সৃষ্টিগত অধিকার। সেই অধিকারবলে এই মাটির সর্বত্র সে যেতে পারে- এই পৃথিবীর যে কোন জায়গায় ন্যায়সঙ্গতভাবে ফসল ফলাতে পারে, কেউ তাকে বাধা দিতে পারে না। এই পৃথিবীর বুকে আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা থেকে যার যা খেতে ইচ্ছা করবে তা খেতে পারে, কেউ বাধা দিতে পারে না। অন্যের কোন ক্ষতি না করে, অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না হয় এমন সব কাজ সে করতে পারে। মানুষের স্রষ্টা, প্রভু, রব, মালেক আল্লাহ মানুষকে এই অধিকার দিয়ে রেখেছেন, পাশ্চাত্য সভ্যতা এসে মানুষের যাবতীয় অধিকার হরণ করেছে বিভিন্ন সীমারেখা, বিধি-নিষেধ আরোপ করে। ফলে মানুষের মধ্যে স্থায়ী সংঘাত, সংঘর্ষের রূপ নিয়েছে, এই সংঘর্ষের প্রবণতা সব চেয়ে বেশি প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে, একথা যে কোন সময়ে পৃথিবীর রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইতিহাস লক্ষ্য করলেই পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। কারণ ঐ একই। ‘মানুষ এক জাতি’ আল্লাহর এই কথা অস্বীকার করে পৃথিবীর বুকের উপর খেয়ালখুশি মতো দাগ দিয়ে, লাইন টেনে, চামড়ার রংয়ের উপর ভাষার উপর ভিত্তি করে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে চিরস্থায়ী সংঘাত-সংঘর্ষ-রক্তপাত ও যুদ্ধের ব্যবস্থা করা। যতদিন মানুষের তৈরি এই জীবনব্যবস্থা পৃথিবীতে চালু থাকবে, ততদিন মানুষে-মানুষে, জাতিতে-জাতিতে অশান্তি, যুদ্ধ রক্তপাত কেউ বন্ধ করতে পারবেন না। শত লীগ অব নেশনসও (League of Nations) নয়, শত জাতিসংঘও (United Nations) নয়। মালায়েকরা মানুষ তৈরির বিরুদ্ধে যে যুক্তি দিয়েছিলেন; ইবলিস মানুষকে দিয়ে যা করাবে বলে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে- অর্থাৎ সেই ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা- অশান্তি, অন্যায়, রক্তপাত ও যুদ্ধ যাতে চলতে থাকে সেজন্য শয়তানের হাতে যত অস্ত্র আছে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান অস্ত্র হচ্ছে এই ভূগোল, চামড়ার রং, ভাষা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে মানব জাতিকে বিভক্ত করা। এবং এই জন্যই এই ব্যবস্থা শেষ ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এই ব্যবস্থা মানুষ জাতির কত অশান্তি, অন্যায়, অবিচার, রক্তপাত, যুদ্ধ, অশ্র“ ও ভগ্ন হৃদয়ের কারণ হয়েছে- হচ্ছে, তা সমুদ্রের মত সীমাহীন।

ঘুমিয়ে থাকাই কলিকাল এগিয়ে চলার নামই সত্য-যুগ

ঘুমিয়ে থাকাই কলিকাল এগিয়ে চলার নামই সত্য-যুগ

রাকীব আল হাসান
‘ঘুমিয়ে থাকাই ‘কলিকাল’ জাগিলেই দ্বাপর, উঠে দাঁড়ানো ত্রেতা এবং এগিয়ে চলার নামই সত্য-যুগ। অতএব অগ্রগামী হও, অগ্রগামী হও (ঋগ্বেদ-ঐতরেয় ব্রাহ্মণ)।
আমরা আজ এমন কাল ঘুমে ঘুমিয়েছি যে আমাদের চোখের সামনে হাজারও অন্যায় হতে দেখেও আমরা নীরব থাকি, অন্যায়ের প্রতিবাদ করি না, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হই না। আমরা সমাজের চিন্তা, দেশের চিন্তা, বিশ্বমানবতার চিন্তা বাদ দিয়ে শুধু আত্মচিন্তায়, স্বার্থচিন্তায় বুদ হয়ে আছি। আমাদের এই কাল ঘুমই ডেকে এনেছে ঘোর কলিযুক। এই যুগে পাপাচার ও পাপী দুটোই সত্য ও সততাকে ছাপিয়ে সৃষ্টির বিনাশ ডেকে আনবে বলে আমরা জানি। ভাগবতে বলা আছে ছলনা, মিথ্যা, আলস্য, নিদ্রা, হিংসা, দুঃখ, শোক, ভয়, দীনতা প্রভৃতি হবে এযুগের বৈশিষ্ট। সন্তান মাতা-পিতাকে মানবে না। পুত্র পিতৃহত্যা বা পিতা পুত্র হত্যা করতে টুণ্ঠিত হবে না। আজ আমাদের সমাজেও তা-ই হচ্ছে।
জনাকীর্ণ পরিবেশে একজন মানুষকে পিটিয়ে-পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে, কেউ তার জীবন রক্ষায় এগিয়ে আসছে না। হামলা প্রতিহত করা তো দূরের কথা, হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পর আহত লোকটিকে যে হাসপাতালে নেবে, সে ন্যূনতম দায়িত্ববোধও মানুষ দেখাচ্ছে না। আমরা দেখেছি পকেট মার বা ছিঁচকে চোর বাগে পেলে কী হিংস্র আক্রোশে তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে এই কলিযুগের মানুষ। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতেও তারা দুর্বলের বিরুদ্ধে ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারে। কিন্তু যখন জনসমাগমপূর্ণ স্থানে সকলের চোখের সামনে মাত্র দু’-একজন সন্ত্রাসী বোমাবাজী করে মানুষ হত্যা করছে, দেশের সম্পদ ধ্বংস করছে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে মানুষকে হত্যা করছে এমনকি জনগণের নিরাপত্তাদানকারী প্রশাসনের লোকদেরকেও পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে অথচ তাদেরকে প্রতিরোধ না করে আক্রান্ত মানুষগুলোকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে শত শত মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে, পালাচ্ছে। এমন দৃশ্য বাঘের আক্রমণে ভেড়ার পালের বেলায় মেনে নেওয়া গেলেও মানুষের বেলায় কীভাবে মানা যায়? তার তো কথা ছিল নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও অন্যের বিপদে এগিয়ে আসার। কথা ছিল সমাজের একটি মানুষের দুঃখ, দুর্দশায় পুরো সমাজের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠার। তাহলে কীসে মানুষকে তাদের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখছে? এর কারণ হলো আমরা হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকলেই ধর্মের মূল শিক্ষাকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র কিছু উপাসনা ও আনুষ্ঠানিকতাকে আকড়ে ধরে বসে আছি। ধর্মের মূল যে মানবতা সেই মানবতা, মনুষ্যত্বের কথা চিন্তা না করে আমরা কেবল ব্যক্তি জীবনে কিছু উপসনাকেই ধর্মজ্ঞান করছি, সেটাই মেনে চলার চেষ্টা করছি। কিন্তু সামষ্টিক জীবনে ধর্মহীন বস্তুবাদী পাশ্চাত্য সভ্যতার জীবনধারাকে পদে পদে অনুসরণের চেষ্টা করছি। পশ্চিমা বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’র প্রভাবে অনাদিকাল থেকে সহযোগিতার ভিত্তিতে পরিচালিত মানবসমাজ এখন পরিচালিত হচ্ছে স্বার্থচিন্তা ও আর্থিক লেনদেনের ভিত্তিতে। কিন্তু সমাজের এই দিক পরিবর্তনের সাথে সাথে যে সকলের ভাগ্যও পরিবর্তিত হচ্ছে, সকলের জীবনও যে অনিরাপদ হয়ে উঠছে সে হিসাব রাখছেন কয়জন? অন্যায়, অবিচার, হিংসা, বিদ্বেষ, রক্তপাত সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে, ভবিষ্যৎকে করছে আরও বিপজ্জনক। মানবসমাজে পারস্পরিক আস্থা বিকল্পহীন একটি অমূল্য সম্পদ, অথচ আজ কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। এখন আমরা যদি এই ঘোর কলিযুগকে পায়ে পিষে দ্বাপর জুগকে অতিক্রম করে ত্রেতা যুগের উপর দিয়ে সত্যযুগ আনতে চাই তবে এখন আমাদেরকে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে হবে, দাঁড়াতে হবে, এগিয়ে যেতে হবে, অগ্রগামী হতে হবে। সনাতন ধর্মমতে ঘোর কলিযুগের পর আবার সত্যযুগ আসবে। সেই সত্যযুগ আমরাই আনতে পারি। অবতার শ্রীকৃষ্ণ (যাকে অনেকে ভগবানও বলে থাকেন) মহাভারতে পঞ্চপাণ্ডবদের উদ্দেশ্যে বলেন, সংসারে যখন দুঃখ বৃদ্ধি পায়, সংসারে স্বল্প মানুষ সুখ অনুভব করে আর অধিকতর মানুষ দুঃখ অনুভব করে তখন সংসার রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এরূপ সময় সেই রোগের নিরাময় করতেই হয়। নিজে নিজেকে বলিদান দিয়েও অধর্মের বিনাশ করা অনিবার্য হয়ে পড়ে। এরূপ সময় না সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ আর না প্রেম গুরুত্বপূর্ণ। না তো স্বার্থ দেখতে হয় আর না সুখের আশা করতে হয়। এইরূপই সময় এখন আপনাদের সবার সামনে। সিদ্ধান্ত আপনাদের সবার। ফলের স্বাদ বৃক্ষের প্রাপ্তি হয় না, কদাচিৎ সেইরূপে এই বলিদান থেকে আপনাদের লাভ নাও হতে পারে। নিজের হৃদয়ে উকি দাও, এতটা করুণা কি রয়েছে ওখানে, এতটাই কি ধর্ম রয়েছে আত্মায় যে, সমগ্র সমাজের জন্য নিজের বলিদান নিশ্চিত করতে পার। এই বিষয়ে আপনারা সবাই চিন্তা করুন।

Wednesday, January 27, 2016

শুধুমাত্র শক্তি-প্রয়োগে জঙ্গিবাদ নির্মূল সম্ভব নয়

জঙ্গিবাদ নির্মূলে যামানার এমামের প্রস্তাবনার বিকল্প নেই



গত দেড়যুগ ধরে জঙ্গিবাদ সারা বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে রক্তের বন্যায় লাল হয়ে গেছে পৃথিবীর মাটি, ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া। পাকিস্তান, নাইজেরিয়াসহ বিশ্বের প্রায় সকল মুসলিম দেশেই জ্বলছে জঙ্গিবাদ নামক সহিংসতার আগুন। কেবল ইরাকেই মারা গেছে ১০ লক্ষ আদম সন্তান। বিশ্বের সুপার পাওয়ারগুলি তাদের সর্বাত্মক সামরিক শক্তি ও অর্থ বিনিয়োগ করেও এই সমস্যার কোন কূল কিনারা করতে পারে নি। জঙ্গিরা মরছে, বেঁচে থাকছে জঙ্গিবাদ। যতই তাদেরকে জোর করে দমনের চেষ্টা করা হচ্ছে, ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে ততই তাদের উগ্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে, এমন কি তারা আত্মঘাতীও হচ্ছে। এভাবে দিনকেদিন বেড়েই চলেছে ধর্মের নামে সহিংসতা, জনগণের দুর্ভোগ কিন্তু কোন সমাধান আসছে না। দীর্ঘ দেড় যুগের এত অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির পর অবশ্য এখন জ্ঞানী-গুণীরা একমত হচ্ছেন যে, শক্তিপ্রয়োগে, সামরিক কায়দায় জঙ্গিবাদ নির্মূল করা সম্ভব নয়; কারণ জঙ্গিবাদ কোন সাধারণ ও বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নয়, এটি একটি বিকৃত আদর্শ। এই আদর্শ যতদিন টিকে থাকবে, জঙ্গিবাদও ততোদিন টিকে থাকবে। তাই একে মোকাবেলাও করতে হবে আদর্শ দিয়েই।
জঙ্গিবাদের পেছনে কোটি কোটি ডলার ব্যায় করেও মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল সম্ভব হচ্ছে না বরং পাকিস্তানে প্রতিদিনই প্রায় জঙ্গি হামলায় সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে, ইরাক, সিরিয়া প্রায় সম্পূর্ণটায় জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ এটা অনস্বীকার্য যে শক্তি প্রয়োগে জঙ্গিবাদ নির্মূলের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
এবার আসি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। এয়ার কমোডর (অব:) ইশফাক ইলাহী বলেন, “জঙ্গিবাদ দূরীকরণে বাংলাদেশ সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা যথেষ্ট নয়। কারণ জঙ্গিবাদ হচ্ছে একটি আদর্শগত যুদ্ধ। সে হিসেবে বাংলাদেশ সরকার এখনো কিছুই করে নি।”
একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে “বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা”-র উপর একটি অনুষ্ঠানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, “জঙ্গি কর্মকাণ্ডের পেছনে একটি আদর্শ থাকে। আদর্শকে আদর্শ দিয়েই মোকাবেলা করতে হবে।”
তাদের বক্তেব্যে একটা বিষয় পরিষ্কার হচ্ছে যে, কোর’আন হাদিসের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে জঙ্গিবাদ নামক যে ভুল মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে সেই আদর্শিক যুদ্ধে জয়ী হতে হলে কোর’আন হাদিসের উক্ত বিষয়গুলির সঠিক ব্যাখ্যা মানুষকে জানাতে হবে।
ঠিক এই কথাটিই কয়েকবছর পূর্বে বলেছিলেন যামানার এমাম জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী। তিনি ২০০৯ সনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র, তারাই সামরিক শক্তি দিয়ে জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করতে পারছে না সেখানে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্রতম একটি দেশের জন্য এটা আরও অসম্ভব”। তিনি সরকারকে আদর্শিক যুদ্ধের মাধ্যমে জঙ্গিদমনে সহায়তা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কারণ এই আদর্শিক যুদ্ধে জঙ্গিদের পরাজিত করতে হলে তাদের আদর্শের বিপরীতে কোর’আন ও সুন্নাহ ভিত্তিক যে অলঙ্ঘনীয় যুক্তি ও প্রমাণ দরকার, সেই যুক্তি প্রমাণ আল্লাহ তাঁকে দান করেছেন। জঙ্গিদমনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সরকারগুলি নির্ভর করছে আলেম শ্রেণিটির উপর। আমাদের দেশের সরকার এ ব্যাপারে নির্ভর করছেন মাদ্রাসা শিক্ষিত মসজিদের ইমাম আর বিভিন্ন সরকারি ধর্মীয় গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানের উপর।
কিন্তু জঙ্গিদেরকে আদর্শিক যুদ্ধে পরাজিত করার সামর্থ্য কি এই ধর্মজীবী আলেম শ্রেণির রয়েছে?
এক কথায় এ প্রশ্নের উত্তর হলো: নেই। বাংলাদেশে কেবল নয়, দেড় যুগ আগে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটার পর থেকেই আলেমদেরকে দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই জঙ্গিবাদ বিরোধী প্রচারণা (Campaign) চালানো হয়েছে। তারা ইতোমধ্যেই অসংখ্য বই লিখেছেন, ওয়াজ করেছেন, টিভি চ্যানেলে সেগুলি বছরের পর বছর প্রচারিত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। এই বাস্তবতা এখন স্বীকার করে নেওয়ার সময় এসেছে যে, এই আলেমদের কাছে এমন কোন যুক্তি প্রমাণ নেই যা দিয়ে তারা জঙ্গিবাদকে ভ্রান্ত প্রমাণ করতে পারেন।
সত্যিকার যুক্তি প্রমাণ না থাকা ছাড়াও তাদের দ্বারা জঙ্গিদমনে কার্যকরী কোন ভূমিকা রাখা সম্ভব নয় কারণ মাদ্রাসা শিক্ষিত এই আলেম নামধারী শ্রেণিটি ধর্মকে তাদের জীবিকার উপকরণ হিসাবে গ্রহণ করেছেন, ইসলামের কাজ করে পার্থিব সম্পদ ও সুখ-সুবিধা হাসিল করছেন যা আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে কঠোরভাবে হারাম করেছেন (সুরা বাকারা ১৭৪ সহ বহু আয়াত)। যে তাদেরকে টাকা দেয়, ভাড়াটে আলেমরা তার পক্ষেই কথা বলেন, সামান্য পার্থিব স্বার্থে তারা কোর’আন হাদিসের বিকৃত ব্যাখ্যা করে মিথ্যা ফতোয়া প্রদান করেন। তাদের এসব ব্যাখ্যায় সত্য-মিথ্যার কোন ভেদাভেদ থাকে না। হারাম ভক্ষণকারীর কোন চরিত্র থাকে না, নৈতিক মেরুদণ্ড ও সত্যের প্রতি অটলতা থাকে না, অর্থের লোভে তারা যে কোন মিথ্যার সঙ্গে আপস করে। তাদের এই স্বভাবের কারণে আমাদের সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা একেবারেই কমে গেছে।
তাঁছাড়া যামানার এমাম প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, এই তথাকথিত আলেমরা প্রকৃত ইসলামের অনুসারী নন। তাদের কাছে যে ইসলামটি আছে সেটা একটি বিকৃত এবং বিপরীতমুখী ইসলাম। যে কোন জিনিস বিকৃত হয়ে গেলে সেটা বিভিন্ন আকৃতি-প্রকৃতি ধারণ করে। এই আলেম-পুরোহিত শ্রেণি হচ্ছে বিকৃত ইসলামের একটি শাখা আর জঙ্গিবাদ হচ্ছে বিকৃত ইসলামের আরেকটি শাখা। এই ধর্মজীবী আলেমদের কাছে সঠিক ইসলাম থাকলে তারা নিজেরা যেমন ধর্মব্যবসা করতেন না, তেমনি এ সমাজে জঙ্গিবাদেরও জন্ম হতো না। জঙ্গিবাদের জন্মও দিচ্ছেন আরেক শ্রেণির আলেম। বিকৃত ইসলামের অনুসারী ধর্মজীবী আলেমরা অন্ধ ও পথভ্রষ্ট, অপরপক্ষে জঙ্গিরাও আরেক দিকে অন্ধ ও পথভ্রষ্ট। একজন পথভ্রষ্ট অন্ধ কি কখনও আরেক পথভ্রষ্ট অন্ধকে পথ দেখাতে পারে? পারে না। তাই ধর্মজীবী, প্রচলিত ইসলামের আলেমদেরকে দিয়ে জঙ্গিবাদের মোকাবেলা করার চেষ্টা কেবল পণ্ডশ্রম; এতে সময় ও সরকারি অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই হবে না।
তাছাড়া পত্রপত্রিকার মাধ্যমে যতটুকু জানা যায়, মাদ্রাসা-শিক্ষিত শ্রেণি থেকেই অধিকাংশ জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান হচ্ছে। কাজেই মাদ্রাসা-শিক্ষিত আলেমদেরকে দিয়ে জঙ্গিবিরোধী প্রচারণা চালানো একটি স্ববিরোধী সিদ্ধান্ত। তবে মাদ্রাসা থেকেই শুধু জঙ্গি তৈরি হয় তা কিন্তু নয়। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যেও এই প্রবণতা রয়েছে। এই প্রবণতা কেবল গ্রেফতার, রিমান্ড, কারাদণ্ড, ফাঁসি দিয়ে রোধ করা সম্ভব নয়। এরাও একটি ভুল আদর্শকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সঠিক পথ মনে করে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন।
এটাই যদি চূড়ান্ত কথা হয়ে থাকে তবে এ প্রসঙ্গে আমাদের সুস্পষ্ট কথা, যদি মাদ্রাসা শিক্ষিত ও সরকারি আলেমদেরকে দিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আদর্শিক লড়াই চালানো হয় সেটা অতীতে যেমন কোন সুফল বয়ে আনে নি, ভবিষ্যতেও আনবে না। এটা উপলব্ধি করেই মাননীয় এমামুযযামান এগিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, যে আদর্শে দীক্ষিত হয়ে মানুষ নিজের জীবন-সম্পদ সব তুচ্ছ করে অনিশ্চিত জীবন বেছে নেয়, এমন কি বুকে বোমা বেঁধে আত্মঘাতী হয়, ইসলাম প্রতিষ্ঠার সেই পদ্ধতিকে ভুল প্রমাণ করতে যে শক্তিশালী যুক্তি, তথ্য ও প্রমাণ প্রয়োজন তা তাঁর কাছে আছে। তাঁকে যদি সুযোগ দেওয়া হয় তবে তিনি কোর’আন ও হাদিসভিত্তিক সেই যুক্তি ও প্রমাণগুলি তুলে ধরে জঙ্গিদেরকে, ইসলামের নামে সহিংসতা সৃষ্টিকারীদেরকে ভ্রান্তপথ থেকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন এনশা’আল্লাহ। সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯ এ সন্ত্রাসবাদের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে সে অনুযায়ী শুধু ইসলামের নামে বোমাবাজিই কিন্তু জঙ্গিপনা, সন্ত্রাস বা Terrorism নয়, যে কোন কারণেই হোক মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি বা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে অস্ত্র বা বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার করল তারা হচ্ছে সন্ত্রাসী। এই হিসাবে গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আদর্শের যে দলই হোক না কেন, কেউ যদি বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, মানুষ হত্যা করে সেটাও সন্ত্রাস। সর্বপ্রকার সন্ত্রাস থেকে আমরা মানবজাতিকে মুক্ত করতে চাই। আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি যারা যামানার এমামের শিক্ষা সর্ব রকমের জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ থেকে, সর্ব রকম অন্যায় থেকে মানবজাতিকে মুক্তি দিতে পারবে এনশা’আল্লাহ। আজ যখন রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল পদে আসীন ব্যক্তিগণ অনুভব করছেন যে তাদের আদর্শিক যুদ্ধে অন্যদেরও এগিয়ে আসা, অংশ নেওয়া প্রয়োজন তখন এমামুযযামানের সেই প্রস্তাবনাটি বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পুনর্বিবেচনা করার জন্য প্রস্তাব কোরছি। আমরা আশা কোরব, সরকার যদি সত্যিই জঙ্গিবাদ সমস্যার সমাধান চান তবে আমাদের এই প্রস্তাবনাটি বিবেচনায় রাখবেন।

প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদীর সালাহসালাতের উদ্দেশ্য

প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদীর সালাহসালাতের উদ্দেশ্য


এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী
আল্লাহ তাঁর শেষ নবীকে পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত দীন (জীবন-ব্যবস্থা) অবলুপ্ত করে দিয়ে এই সঠিক দিক নির্দেশনা (তওহীদ, সেরাতাল মোস্তাকিম) ও এই সত্যদীন (জীবন-ব্যবস্থা, শরিয়াহ) প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দিলেন- এই সত্য আমরা পাচ্ছি প্রত্যক্ষ, সরাসরি কোর’আনে তিনটি আয়াত থেকে (কোর’আন- সুরা তওবা ৩৩, ফাতাহ ২৮, সফ ৯), এবং পরোক্ষভাবে সমস্ত কোর’আনে শত শত আয়াতে। প্রশ্নটি হচ্ছে- আল্লাহ শেষ নবীকে এই বিশাল দায়িত্ব দিলেন কিন্তু কেমন করে, কোন নীতিতে তিনি এ কাজ করবেন তা কি আল্লাহ তাঁকে বলে দেবেন না? আল্লাহ সোবহান, অর্থাৎ যার অণু পরিমাণও খুঁত, ত্র“টি, অক্ষমতা, অসম্পূর্ণতা বা চ্যুতি নেই। কাজেই তাঁর রসুলকে আল্লাহ এক বিরাট, বিশাল দায়িত্ব দিলেন কিন্তু কেমন করে, কোন্ প্রক্রিয়ায় তিনি তা করবেন তা বলে দেবেন না, তা হতেই পারে না। কাজেই আল্লাহ তাঁর নবীকে ঐ দায়িত্বের সঙ্গে ঐ কাজ করার নীতি ও প্রক্রিয়া অর্থাৎ তরিকাও বলে দিলেন। সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর তওহীদ ভিত্তিক দীন প্রতিষ্ঠার নীতি হিসাবে আল্লাহ তাঁর রসুলকে দিলেন জেহাদ ও কেতাল- অর্থাৎ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও সশস্ত্র সংগ্রাম; এবং ঐ নীতির ওপর ভিত্তি করে একটি পাঁচদফার কর্মসূচি। ঐ পাঁচ দফা হলো- ১) ঐক্য, ২) শৃঙ্খলা, ৩) আনুগত্য, ৪) হেজরত, ৫) জেহাদ, যুদ্ধ (হাদিস- তিরমিযী, মুসনাদে আহমেদ, আহমদ, বাব-উল-এমারাত)। পৃথিবীতে প্রচলিত অন্য সমস্ত জীবন ব্যবস্থাকে নিষ্ক্রিয় করে আল্লাহর দেয়া সঠিক দিক-নির্দেশনা ও সত্যদীনকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ তাঁর শেষ নবীকে যে নীতি ও তরিকা (প্রক্রিয়া, কর্মসূচি) দিলেন সেটা দাওয়াহ নয়; সেটা কঠিন জেহাদ, সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
এর প্রমাণ আল্লাহর কোর’আন এবং তাঁর রসুলের জীবনী, কথা ও কাজ। আল্লাহ তাঁর কোর’আনে সশস্ত্র সংগ্রাম অর্থাৎ যুদ্ধকে মো’মেন, মুসলিম ও উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য ফরদে আইন করে দিয়েছেন সুরা বাকারার ২১৬ ও ২৪৪ নং আয়াতে, আনফালের ৩৯ নং ও আরও বহু আয়াতে। শুধু তাই নয় মো’মেন হবার সংজ্ঞার মধ্যেই তিনি জেহাদকে অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- শুধু তারাই সত্যনিষ্ঠ মো’মেন যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের ওপর ঈমান এনেছে এবং তারপর আর কোন দ্বিধা-সন্দেহ করেনি এবং প্রাণ ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করেছে (কোর’আন- সুরা হুজরাত ১৫)। এই আয়াতে আল্লাহ মো’মেন হবার জন্য দু’টি শর্ত রাখছেন। প্রথমটি হলো আল্লাহ ও তাঁর রসুলের উপর ঈমান; এটির অর্থ হলো জীবনের সর্ব অঙ্গনে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, জাতীয়-আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, অর্থনীতি, শিক্ষা- এক কথায় যে কোন বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কোন বক্তব্য আছে, আদেশ-নিষেধ আছে সেখানে আর কাউকে গ্রহণ না করা, কারো নির্দেশ না মানা যা পেছনে বলে এসেছি এবং এ ব্যাপারে বাকি জীবনে কোন দ্বিধা, কোন সন্দেহ না করা অর্থাৎ তওহীদ। দ্বিতীয়টি হলো আল্লাহর ঐ তওহীদ, সার্বভৌমত্বকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন ও সম্পদ দিয়ে সংগ্রাম, যুদ্ধ করা। কারণ ঐ তওহীদ এবং তওহীদ ভিত্তিক দীন, জীবন-ব্যবস্থা যদি পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা না হয় তবে দীনই অর্থহীন, যেমন বর্তমানের অবস্থা। এই দু’টি শর্ত হলো মো’মেন হবার সংজ্ঞা। যার বা যাদের মধ্যে এই দু’টি শর্ত পূরণ হয়েছে সে বা তারা প্রকৃত মো’মেন আর যে বা যাদের মধ্যে এই দু’টির মধ্যে একটি বা দু’টিই শর্ত পুরণ হয় নি, সে বা তারা প্রকৃত মো’মেন নয়; (৬ষ্ঠ পৃষ্ঠায় দেখুন) এবং মো’মেন নয় মানেই হয় মোশরেক না হয় কাফের।
সরাসরি হুকুম ছাড়াও সমস্ত কোর’আনে আল্লাহ ছয়শত বারের বেশি সশস্ত্র সংগ্রামের উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর এই নীতির প্রতিধ্বনি করে তার রসুল বোললেন- আমি আদিষ্ট হয়েছি পৃথিবীর মানুষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম (যুদ্ধ) চালিয়ে যেতে যে পর্যন্ত না তারা সাক্ষ্য দেয় যে আল্লাহ ছাড়া এলাহ নেই এবং আমি মোহাম্মদ আল্লাহর রসুল এবং সালাহ প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত দেয় [হাদিস- আবদুল্লাহ এবনে ওমর (রা:) থেকে বোখারী]। এছাড়াও আল্লাহ তাঁর কোর’আনে এবং আল্লাহর রসুল তাঁর জীবনের কাজে ও কথায় সন্দেহাতীত ভাবে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন যে আল্লাহর তওহীদ ভিত্তিক এই দীনুল ইসলাম, দীনুল হককে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার নীতি হচ্ছে সামরিক, অর্থাৎ জিহাদ, কেতাল। আল্লাহ নীতি হিসাবে যুদ্ধকে নির্দ্ধারণ করেছেন বলেই তার নির্দেশে তাঁর রসুল মাত্র সাড়ে নয় বছরের মধ্যে কম করে হলেও ১০৭টি যুদ্ধ করেছেন।
দীন প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ তাঁর রসুলকে যে পাঁচ দফা কর্মসূচি দিয়েছেন তার প্রথম চার দফা অর্থাৎ ১) ঐক্য, ২) শৃঙ্খলা, ৩) আনুগত্য, আদেশ প্রতিপালন, ৪) হেজরত এই চারটি হলো জেহাদ করার পস্তুতি এবং পঞ্চম দফা হচ্ছে জেহাদ, যুদ্ধ। প্রথম চার দফা ছাড়া যুদ্ধ করা যাবে না। জেহাদকে, সশস্ত্র সংগ্রামকে আল্লাহ নীতি হিসাবে নির্দ্ধারণ করেছেন বলেই এই দীনে শহীদ ও মোজাহেদদের সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন, জান্নাত নিশ্চিত করে দিয়েছেন (কোর’আন- সুরা সফ ১০-১২), এমন নিশ্চয়তা এই জাতির, উম্মাহর আর কোন শ্রেণি বা প্রকারের মানুষকে তিনি দেন নি। আল্লাহর এই নীতি নির্দ্ধারণ তাঁর রসুল বুঝেছিলেন বলেই তিনি ২৩ বছরের কঠোর সাধনায় যে সংগঠন গড়ে তুললেন সেটার ইতিহাস দেখলে সেটাকে একটি জাতি বলার চেয়ে একটি সামরিক বাহিনী বলাই বেশি সঙ্গত। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে এই বাহিনী তার জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে প্রায় একশ’ বছর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন সশস্ত্র সংগ্রাম করে গেছে; এর সর্বাধিনায়ক (আল্লাহর রসুল) থেকে শুরু করে সাধারণ সৈনিক (মোজাহেদ) পর্যন্ত একটি মানুষও বোধহয় পাওয়া যেতনা যার গায়ে অস্ত্রের আঘাত ছিল না; হাজারে হাজারে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেয়ার কথা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না।
তাহোলে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে তওহীদ, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ভিত্তিক এই দীনকে সমস্ত পৃথিবীতে কার্যকর করে মানব জাতির জীবন থেকে সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার ও রক্তপাত দূর করে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা করার জন্যই আল্লাহ তাঁর রসুলকে পৃথিবীতে পাঠালেন এবং ঐ কাজ করার নীতি হিসাবে নির্দ্ধারিত করে দিলেন সংগ্রাম ও সশস্ত্র সংগ্রাম এবং জেহাদ ভিত্তিক একটি ৫ দফার কর্মসূচি। তাঁর রসুল ঐ নীতি ও কর্মসূচির অনুসরণ করে গড়ে তুললেন এক দুর্দম, দুর্ধর্ষ, অপরাজেয় সামরিক বাহিনী যার নাম হলো উম্মতে মোহাম্মদী। এই উপলব্ধি (আকিদা) থেকে আজ আমরা লক্ষকোটি মাইল দূরে অবস্থান নিয়েছি।
এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে সশস্ত্র সংগ্রাম করে পৃথিবীতে আল্লাহর দেয়া দিক নির্দেশনা ও সত্যদীনকে প্রতিষ্ঠার মত বিশাল ও কঠিন কাজের জন্য আল্লাহর হুকুমে তাঁর রসুল যে বাহিনী গঠন করলেন, যার নাম হলো উম্মতে মোহাম্মদী তার চরিত্র গঠন ও প্রশিক্ষণের জন্য কি ব্যবস্থা করা হলো? এটা হতে পারেনা যে আল্লাহ তাঁর রসুলকে উম্মাহ গঠন করতে আদেশ দিলেন, যুদ্ধকে ফরদে আইন করে দিলেন, পৃথিবীতে দীন প্রতিষ্ঠার নীতি ও প্রক্রিয়া হিসাবে যুদ্ধকেই নির্দিষ্ট করে দিলেন, কিন্তু তাদের জন্য যুদ্ধের কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা দিলেন না। যে কথাটা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায় যে কোন কাজ করতে গেলেই সেই কাজের প্রশিক্ষণ অত্যাবশ্যক, আল্লাহ সোবহানুতায়ালা কি এই কথাটা বোঝেন নি? তাহোলে এই দীনে সেই প্রশিক্ষণ কোথায়?
সেই মহাগুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ হলো- সালাহ
প্রত্যেক জাতিরই সামরিক বাহিনী আছে এবং প্রত্যেকেরই যুদ্ধের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। তাদের দৈনিক প্যারেড, কুচকাওয়াজ, অস্ত্রের ব্যবহারের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। ওগুলো ছাড়া কোন সামরিক বাহিনী নেই। তাহোলে আল্লাহর রসুল যে সামরিক বাহিনী গঠন করলেন, যে বাহিনী যুদ্ধ করে ৯ বছরের মধ্যে সমস্ত আরব উপদ্বীপ জয় করল, তারপর মাত্র ৬০/৭০ বছরের মধ্যে তৎকালীন পৃথিবীর দুই বিশ্বশক্তির সুশিক্ষিত বিশাল সামরিক বাহিনীগুলিকে যুদ্ধে পরাজিত করে অর্দ্ধেক পৃথিবীতে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করল তারা এ সব কিছু প্রশিক্ষণ ছাড়াই করল? এ হতে পারে? অবশ্যই নয়। একথা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায় যে, যে দীনে, জীবন-ব্যবস্থায় যুদ্ধকে ফরদে আইন, অবশ্য করণীয় করে দেয়া হয়েছে (কোর’আন- সুরা বাকারা ২১৬) সে দীনে প্রশিক্ষণকেও অবশ্য করণীয়, ফরদে আইন করে দেয়া হবে। আল্লাহ ভুল করেন নি, তিনি সোবহান, তিনি সামান্যতম ভুলও করতে পারেন না, আর এতবড় ভুল তো কথাই নেই। তাহোলে সে প্রশিক্ষণ কোথায়?
আল্লাহর রচনা করা এই অমূল্য কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে যে চরিত্র প্রয়োজন, যে চরিত্র ছাড়া এই কর্মসূচির বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, সেই চরিত্র অর্জন করার প্রধান উপায় হচ্ছে সঠিকভাবে সালাহ কায়েম করা। সালাহ এবং এই কর্মসূচির মধ্যে একটি অভূতপূর্ব মিল আছে। কর্মসূচির প্রথম দফা হলো ঐক্যবদ্ধ হওয়া, সালাহরও প্রথম কাজ হলো সালাহর জন্য সকলে একত্রিত হওয়া। কর্মসূচির দ্বিতীয় দফা হলো শৃঙ্খলাবদ্ধ হওয়া (Descipiline), সালাতের জন্য একত্রিত হওয়ার পর দ্বিতীয় কাজটি হলো কতগুলি নিয়ম অনুসারে দাঁড়ানো অর্থাৎ নিজেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা। এই নিয়মগুলি হচ্ছে, লাইন করে দাঁড়াতে হবে এবং লাইনটি হতে হবে ধনুকের ছিলার মত সোজা, (ধনুকের ছিলার চেয়ে বেশি সোজা আর কোন জিনিস পৃথিবীতে নেই), শরীর হতে হবে রডের মত সোজা এবং শক্ত, দৃষ্টি থাকবে সম্মুখে নিবদ্ধ, হাত হতে হবে মুষ্ঠিবদ্ধ, মন হতে হবে এমামের হুকুম শোনার সঙ্গে সঙ্গে পালন করার জন্য তীক্ষè সচেতন ইত্যাদি অনেক কিছু। কর্মসূচির তৃতীয়টি হলো এতায়াহ। সালাতেও তৃতীয় কাজ হচ্ছে এতায়াহ অর্থাৎ ঐরকম শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সতর্ক হওয়ার পর এমামের তাকবীর বা হুকুমের আনুগত্য করা। এই আনুগত্যের মধ্যে কোথাও বিন্দুমাত্র শিথিলতা থাকবে না, কোন প্রশ্ন থাকবে না। এমাম যদি রুকুতে বা সেজদায় যেয়ে বা যেকোন অবস্থানে এক ঘণ্টাও থাকেন সেক্ষেত্রে মোক্তাদীরও এক ঘণ্টা সেই অবস্থায় থাকতে হবে, এর ব্যতিক্রম করলে তার সালাহ পণ্ড হয়ে যাবে। এখানে কোন প্রশ্ন করা চোলবে না যে, আপনি কেন সেজদায় বা রুকুতে গিয়ে এত সময় আছেন? কর্মসূচির চার নম্বর হলো হেজরত। একইভাবে সালাতে যারা আসবে তারাও পূর্বের জীবনের সমস্ত শেরক, কুফর থেকে হেজরত করে অর্থাৎ ওগুলো পরিত্যাগ করে সালাতে আসবে। সুতরাং কর্মসূচিকে বাস্তবায়ন করতে গেলে যে চরিত্রের প্রয়োজন তা গঠন করবে ঐ সালাহ। কোর’আনে আল্লাহ সালাহ সম্বন্ধে সর্বদাই বলেছেন, সালাহ কায়েম কর, তিনি বলেন নাই যে সালাহ পড়, বা সালাহ আদায় কর, বলেছেন কায়েম কর। কায়েম শব্দের অর্থ কোন জিনিস বা বিষয় স্থায়ী, দৃঢ়, শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করা। সালাহ তাহোলে কোথায় প্রতিষ্ঠিত করবে? করবে নিজেদের চরিত্রে, অর্থাৎ সালাহ যে গুণগুলি সৃষ্টি করে তা নিজেদের চরিত্রের ভেতর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ কায়েম করে পাঁচ দফার কর্মসূচিকে বাস্তবায়ন করবে। তবেই যে উদ্দেশ্যে এই কর্মসূচি আল্লাহ প্রণয়ন করে আমাদের দিয়েছেন সেটা অর্জনে সফলতা আসবে, নইলে আল্লাহর সাহায্যও আসবে না, সাফল্যও আসবে না। মনে রাখতে হবে, যে লোক সারা জীবন, দিন রাত্রি সালাহ কায়েম করল, প্রত্যেক ওয়াক্তের প্রথম ভাগেই সালাহ পড়ল বা আদায় করল কিন্তু তার চরিত্রে কঠিন ইস্পাতের মত ঐক্য, কঠিন শৃঙ্খলা, প্রশ্নহীন আনুগত্য ও শেরক-কুফর-জুলম-নাফাক-ফিসক ইত্যাদি থেকে মুক্তি আসলো না (হেজরত), তার সমস্ত জীবনের সালাহই অর্থহীন, নিষ্ফল। আবার ঐ সঙ্গে এও মনে রাখতে হবে যে, যে লোক সালাহর মাধ্যমে এই সমস্ত গুণ অর্জন এবং সুদৃঢ়ভাবে কায়েম করল কিন্তু তার ঐ চারিত্রিক গুণগুলি নিয়ে কর্মসূচির পাঁচ দফা অর্থাৎ হেদায়াহ ও দীনুল হককে পৃথিবীতে বিজয়ী করার সংগ্রামে (জেহাদ) ঐক্যবদ্ধ হয়ে লিপ্ত হলো না তার ঐ চারিত্রিক সফলতাও অর্থহীন, মূল্যহীন।
বর্তমানে পৃথিবীতে অসংখ্য আন্দোলন-সংগঠন রয়েছে যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার জেহাদে রত। তাদের আল্লাহর নসর না পাওয়া এবং সফল না হওয়ার কারণ প্রধানত দুইটি। প্রথমত তারা যেটাকে ইসলাম বলে প্রতিষ্ঠা করতে চায় সেটি আল্লাহ-রসুলের ইসলাম নয়, দ্বিতীয়ত তাদের কর্মসূচি আল্লাহর রচিত নয় অর্থাৎ তারা কর্মসূচির চরিত্র অর্জন না করেই জেহাদ করছে। পক্ষান্তরে হেযবুত তওহীদকে আল্লাহ তাঁর প্রকৃত ইসলাম দান করেছেন এবং এই দীনকে প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর স্বরচিত কর্মসূচিও দান করেছেন।
প্রথম চার দফার চরিত্র ছাড়া অর্থাৎ গলিত সীসার প্রাচীরের মত ঐক্য, পিঁপড়ার মত শৃঙ্খলা, মালায়েকের মত শর্তহীন-প্রশ্নহীন- দ্বিধাহীন আনুগত্য এবং সাহাবীদের মত হেজরত অর্জন না করে কেউ যদি আল্লাহর রাস্তায় জীবন ও সম্পদ ব্যয় করতে চায়, তবে করতে পারবে কিন্তু তারা দীন প্রতিষ্ঠার সেই জেহাদে আল্লাহর নসর পাবে না, ফলে বিজয়ী হতে পারবে না। ফলে তাদের ঐসব কাজ করা না করা সমান হবে, পণ্ডশ্রম হবে। কাজেই নিজেদের চরিত্রের মধ্যে চার দফার গুণগুলি পূর্ণভাবে কায়েম করতে হবে এবং পাশাপাশি যত বেশি সম্ভব দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। তবে বড় কথা হলো যতটুকু কাজই করা হোক, সেই কাজের মধ্যে যেন ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্য ও হেজরত পূর্ণ ও অটুটভাবে বজায় থাকে, নয়তো ঐ কাজ কোন ফল বয়ে আনবে না।

দাজ্জাল আবির্ভূত হয়েছে; দাজ্জাল শারীরিক দানব নয়

দাজ্জাল আবির্ভূত হয়েছে; দাজ্জাল শারীরিক দানব নয়


এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী
চৌদ্দশ’ বছর থেকে মুসলিম উম্মাহর ঘরে ঘরে দাজ্জাল সম্বন্ধে আলোচনা চলে আসছে। আল্লাহর শেষ রসুল মানবজাতির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে যেসব কথা বলে গেছেন, পৃথিবীতে কী কী ঘটনা ঘোটবে সেগুলি সম্বন্ধে আভাস ও সরাসরি যা জানিয়ে দিয়েছেন সেগুলির মধ্যে দাজ্জাল সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণীগুলি যেমন চিত্তাকর্ষক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ও উদ্বিগ্নকর। উদ্বিগ্নকর ও ভীতিপ্রদ এই জন্য যে দাজ্জালের শক্তি, প্রভাব ও প্রতিপত্তি সমগ্র মানবজাতির উপর প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেবে, সমস্ত মানবজাতিকে বিপথে চালাবার চেষ্টা করবে। শুধু চেষ্টা নয়, বেশ কিছু সময়ের জন্য দাজ্জাল তার শক্তি ও প্রভাব বিস্তার করে গোটা মানবজাতিকেই বিপথে পরিচালিত করবে। কাজেই দাজ্জালকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার বা অবজ্ঞা করার উপায় নেই।
আল্লাহর রসুল বলেছেন আদমের সৃষ্টি থেকে কেয়ামত পর্যন্ত এমন কোনো বিষয় বা ঘটনা হবে না, যা দাজ্জালের চেয়ে গুরুতর ও সংকটজনক (হাদীস- এমরান বিন হুসাইন (রা.) থেকে মুসলিম)। তিনি এ কথাও বলেছেন যে- নুহ (আ.) থেকে নিয়ে কোনো নবীই বাদ যান নি যিনি তাঁর উম্মাহকে দাজ্জাল সম্বন্ধে সতর্ক করেন নি (হাদীস- আবু ওবায়দা বিন র্যারাহ (রা.) ও আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রা.) থেকে আবু দাউদ, বোখারী, মুসলিম ও তিরমিযি)। শুধু তাই নয়, আল্লাহর নবী নিজে দাজ্জালের সঙ্কট (ফেত্না) থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়েছেন (হাদিস- আয়েশা (রা.) থেকে বোখারী)।
যে ব্যাপারটা মানবজাতির সৃষ্টি থেকে নিয়ে ধ্বংস পর্যন্ত যা কিছু ঘোটবে সে সমস্ত কিছুর চেয়ে বড়, সেটা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ আর আমরা সে সম্বন্ধে কতটুকু সজাগ ও সচেতন? বাস্তব অবস্থা এই যে আমরা মোটেই সজাগ নই এবং দাজ্জাল সম্বন্ধে আমাদের কোনো মাথাব্যথাই নেই। যে ঘটনাটিকে আখেরি নবী আদম (আ.) থেকে কেয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য সবচেয়ে গুরুতর ও সাংঘাতিক ঘটনা বলে চিহ্নিত করেছেন সেই মহা-গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে আমাদের সমাজের আলেম সাহেবরাও কোনো গভীর গবেষণা করেন নি। এই মহা-প্রয়োজনীয় ব্যাপারটাকে বোঝার জন্য যতটুকু শ্রম দিয়েছেন তার চেয়ে লক্ষ গুণ বেশি শ্রম ও সময় দিয়েছেন দাড়ি-মোছ, টুপি-পাগড়ী, পাজামা, মেসওয়াক, কুলুখ আর বিবি তালাকের মতো তুচ্ছ ফতওয়ার বিশ্লেষণে।
দাজ্জাল সম্বন্ধে মহানবীর হাদিসগুলি প্রধানত দুই রকমের। একটা ভাগ দাজ্জালের আবির্ভাবের গুরুত্বের ব্যাপারে, অন্যটি দাজ্জালের পরিচয়জ্ঞাপক। মানবজাতির জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, সর্ববৃহৎ বিপদের সম্বন্ধে মানুষ বেখেয়াল ও নিরুদ্বেগ। যারা ধর্মের ব্যাপারে মহা-আলেম হয়েছেন ও ধর্মচর্চার মধ্যে ডুবে আছেন তারাও সংকীর্ণ ও প্রায়ান্ধ দৃষ্টির জন্য দেখতে ও বুঝতে সক্ষম হন নি যে দাজ্জালের আবির্ভাব মানবজাতি ধ্বংসকারী নুহের (আ.) মহাপ্লাবনের চেয়েও, প্রলয়ঙ্করী বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও কেন বড় (আকবর) ঘটনা; কেন মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের (যদি সে ঘটনা সত্য হয়ে থাকে) চেয়েও সাংঘাতিক, যে যুদ্ধে আঠারো অক্ষৌহিণী অর্থাৎ প্রায় এক কোটি আদম সন্তান নিহত হয়েছিল। অন্য ভাগের হাদিসগুলিতে আল্লাহর শেষ রসুল মানবজাতি যেন দাজ্জালকে ঠিকভাবে চিনতে পারে ও সাবধান হয়, দাজ্জালকে প্রত্যাখ্যান করে, তার বিরোধিতা করে, সে জন্য তার পরিচিতির চিহ্নগুলি বলেছেন। কিন্তু তার সময়ের মানুষের শিক্ষার স্বল্পতার জন্য তাঁকে বাধ্য হয়ে দাজ্জালকে রূপকভাবে বর্ণনা করতে হয়েছে। কিন্তু সে রূপক বর্ণনা আজ পরিষ্কারভাবে ধরা দিয়েছে, যদিও আমাদের প্রায়ান্ধ দৃষ্টির জন্য সে বর্ণনাও আমরা বুঝতে সক্ষম হচ্ছি না, দাজ্জালকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে ও দাজ্জালের পায়ে সাজদায় পড়ে থেকেও বুঝতে পারছিনা যে এই সেই বিশ্বনবী বর্ণিত দাজ্জাল, মাসীহ উল কায্যাব।
প্রথমেই দাজ্জালের নামটাকে নেয়া যাক। আল্লাহর রসুল একে দাজ্জাল নামে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এটা কোনো নাম নয়, এটা একটা বর্ণনা, অর্থাৎ বিষয়টার বর্ণনা। যেমন এমাম মাহ্দী কোনো নাম নয়- বর্ণনা। মাহ্দী অর্থ হেদায়াহ প্রাপ্ত, যিনি সঠিক পথ, হেদায়াহ পেয়েছেন, তাঁর নিজের অন্য নাম থাকবে সবার মতো। তেমনি দাজ্জাল শব্দের অর্থ চাকচিক্যময় প্রতারক, যেটা বাইরে থেকে দেখতে খুব সুন্দর কিন্তু ভেতরে কুৎসিত। যেমন মাকাল ফল, দেখতে অতি সুন্দর, মনে হবে খেতেও অতি সুস্বাদু, কিন্তু আসলে খেতে বিস্বাদ, তিক্ত। ‘দাজ্জাল’ কোনো দৈত্য-দানব নয়, ‘দাজ্জাল’ ইহুদি-খ্রিষ্টান বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’। পাশ্চাত্য যান্ত্রিক সভ্যতা বাইরে থেকে দেখতে চাকচিক্যময়, এর প্রযুক্তিগত সাফল্য মানুষকে মুগ্ধ করে ফেলে, চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, কিন্তু এর প্রভাবাধীন পৃথিবী সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অবিচারে, দুঃখে, ক্রন্দনে, অশ্রুতে ভরপুর। বিগত শতাব্দীতে এই ‘সভ্যতা’ দুইটি বিশ্বযুদ্ধ করে চৌদ্দ কোটি আদম সন্তান হতাহত করেছে এবং তারপর থেকে বিভিন্ন ছোট খাটো যুদ্ধে আরও দুই কোটি মানুষ হত্যা করেছে। আহত বিকলাঙ্গের সংখ্যা ঐ মোট সংখ্যার বহুগুণ। বিধবা, সন্তানহারা, গৃহহারা, দেশত্যাগীদের কোনো হিসাব নেই। আর এই নতুন শতাব্দীতে শুধু এক ইরাকেই হত্যা করেছে দশ লক্ষ মানব। ইরাক ছাড়াও আফগানিস্তানসহ আরও অনেকগুলো দেশে তার এই হত্যাযজ্ঞ আজও চলছে। এই ‘সভ্যতা’র অধীনস্থ সমস্ত পৃথিবীতে খুন, চুরি, ডাকাতি, হাইজ্যাক, ধর্ষণ, অত্যাচার সীমাহীন এবং প্রতিদিন প্রতি দেশে ধাঁ ধাঁ করে বেড়ে চলেছে। তাই এর নাম দাজ্জাল, চাকচিক্যময়, চোখ ধাঁধানো প্রতারক।
আল্লাহর রসুল কর্তৃক বর্ণিত আখেরী যামানার দাজ্জাল কোনো দৃশ্যমান (Visible) বা শরীরী (Physical) দানব নয়, তখনকার দিনের মানুষদের বোঝাবার জন্য এটি একটি রূপক (Allegorical) বর্ণনা। এর পরও যদি কেউ জোর করে বলতে চান যে, না, এক চক্ষুবিশিষ্ট, বিরাটকায়, জলজ্যান্ত একটি অশ্বারোহী দানবই আসবে, তাহলে আমার বক্তব্য হচ্ছে, ধরুন আপনার কথামতো এক চক্ষুবিশিষ্ট এক বিশাল দানব পৃথিবীতে উপস্থিত হলো, তার বাহন ঘোড়া বা গাধার দুই কানের ব্যবধানই সত্তর অর্থাৎ বহু সহস্র হাত [আবু হোরায়রা (রা.) থেকে-বায়হাকী, মেশকাত], তাহলে কি কারো মনে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকবে যে এটাই রসুল বর্ণিত সেই দাজ্জাল? চোখের সামনে প্রায় পৃথিবীর সমান আয়তনের এক দানবকে দেখে প্রথমেই সকলের মনে প্রশ্ন আসবে, এই বিরাট দানব আসলো কোত্থেকে! তাকে দেখে কেবল মুসলিমরাই নয়, অ-মুসলিমরাও এক মুহূর্তে চিনে ফেলবে যে, এই তো ইসলামের নবীর বর্ণিত দানব দাজ্জাল। সকল মানুষেরই তখন আমাদের নবীর উপর এবং ইসলামের উপর ঈমান এসে যাবে।
দ্বিতীয়ত, আল্লাহর রসুল বলেছেন, দাজ্জাল ইহুদি জাতি থেকে উদ্ভূত হবে এবং আমার উম্মতের সত্তর হাজার (অসংখ্য) লোক দাজ্জালের অনুসরণ করবে [ইবনে হানবাল (রা.) থেকে মুসলিম]।
দাজ্জাল যদি রসুলের বর্ণনা অনুযায়ী সত্যিই জ্যান্ত কোনো দানবীয় প্রাণী হয় তাহলে কি করে এমন দানব মানব সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ইহুদি জাতির মধ্য থেকে আসতে পারে? আর মুসলিমরাই কী করে আল্লাহকে ছেড়ে একটি দানবকে অনুসরণ করতে পারে?
তৃতীয়ত, আল্লাহর রসুল বলেছেন, দাজ্জালের দুই চোখের মাঝখানে (অর্থাৎ কপালে) কাফের লেখা থাকবে। শুধু মো’মেন, বিশ্বাসীরাই তা দেখতে এবং পড়তে পারবে; যারা মো’মেন নয়, তারা পড়তে পারবে না [ আবু হোরায়রা (রা.), আবু হোযায়ফা (রা.) এবং আনাস (রা.) থেকে বোখারী ও মুসলিম]।
অর্থাৎ কিছু লোক (মো’মেন) দাজ্জালকে কাফের বলে বুঝতে পারবে আর কিছু লোক (যারা মো’মেন নয়) দাজ্জাল যে কাফের তা বুঝতে পারবে না, এবং বুঝতে পারবে না বলেই বহু সংখ্যক লোক তাকে রব বলে মেনে নেবে। দাজ্জাল যদি শরীরী কোনো দানবই হয় তাহলে সবাই তাকে প্রথম দর্শনেই দাজ্জাল বলে চেনার কথা। তারপরও সে কাফের কি কাফের নয় এ নিয়ে মানুষের মধ্যে দ্বিমত হওয়া সম্ভব? ধরুণ কোনো লোকালয়ে বা জনবহুল স্থানে হঠাৎ একটি বাঘ এসে পড়ল; সেখানের অবস্থাটা কি হবে ভাবুন। ছেলে, বুড়ো, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সবাই প্রাণ বাঁচাতে যে যেদিকে পারবে দৌঁড়ে পালানোর চেষ্টা করবে, তাই নয় কি? অথচ অকল্পনীয় বিরাট, ভয়ঙ্কর একটি দানব, যার বাহনের এক পা পৃথিবীর এক প্রান্তে আরেক পা পৃথিবীর অপর প্রান্তে, তাকে সামনা সামনি দেখেও কেউ চিনবে- কেউ চিনবে না, কেউ তাকে অনুসরণ করবে- কেউ করবে না, কেউ তার কপালের কাফের লেখা পড়তে পারবে- কেউ পারবে না এ কি হতে পারে?
তাহলে আর সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে দাজ্জাল কোনো শরীরী বা বস্তুগত দানব নয়, এটি একটি বিরাট দানবীয় শক্তির রূপক বর্ণনা; সেই সাথে এ কথাতেও সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে ঐ বিরাট শক্তিটিই হচ্ছে বর্তমান দুনিয়ার পাশ্চাত্য ইহুদি খ্রিষ্টান বস্তুবাদী যান্ত্রিক ‘সভ্যতা’।
[সমস্ত পৃথিবীময় অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ ও রক্তপাত ইত্যাদি নির্মূল করে ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৫ সনে এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী হেযবুত তওহীদ নামক আন্দোলনটি প্রতিষ্ঠা করেন। আল্লাহ তাঁকে প্রকৃত ইসলামের যে জ্ঞান দান করেছেন তা তিনি যতটা সম্ভব হয়েছে বই-পুস্তক লিখে, বক্তব্যের মাধ্যমে প্রচারের চেষ্টা করেছেন। এই লেখাটি মাননীয় এমামুয্যামানের লেখা “দাজ্জাল? ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতা!” বইটি থেকে সম্পাদিত। দাজ্জালের মতো এত ব্যাপক একটি বিষয় এইটুকু লেখার মধ্যে ফুটিয়ে তোলা কষ্টকর, তাই ‘দাজ্জাল’ সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে যামানার এমামের লেখা “দাজ্জাল? ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতা!” বইটি পড়–ন এবং এর উপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রটি দেখুন।

পুলিশ বিভাগের দুর্নীতি ও অসৌজন্যমূলক আচরণ: সমাধানের পথ নিকটেই

পুলিশ বিভাগের দুর্নীতি ও অসৌজন্যমূলক আচরণ: সমাধানের পথ নিকটেই

 মসীহ উর রহমান
সম্প্রতি পুলিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অশোভন আচরণের অভিযোগ তীব্র হওয়ায় এর প্রতিবিধানকল্পে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার তার অধীনস্থ সকল পুলিশ কর্মকর্তাকে লিখিত নির্দেশ প্রদান করেছেন যেন তারা তাদের অধীনস্থ থানা ও ইউনিটের পুলিশ সদস্যদেরকে মানুষের সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণ করতে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসনের আলোকে উদ্বুদ্ধ করেন। রাষ্ট্রীয় কল্যাণে ধর্মবিশ্বাসকে কাজে লাগানোর এই উদ্যোগকে আমরা অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন করি।
এক্ষেত্রে তাদেরকে কী বক্তব্য দিয়ে প্রণোদিত করলে তা ফলপ্রসূ হবে সে বিষয়ে আমরা হেযবুত তওহীদ পুলিশ বিভাগকে জাতীয় স্বার্থে সহযোগিতা করতে আগ্রহী। এখানে দুটি প্রসঙ্গ আসে যথা ধর্মীয় অনুশাসন ও সামাজিক দায়িত্ববোধ। প্রথমত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরকে অবগত করা যে তাদের ধর্মীয় কর্তব্য কী, তারা যে জনগণের জান-মাল-সম্পদ হেফাজতের দায়িত্ব নিয়েছেন ধর্মীয় দৃষ্টিতে সেটা কত বড় কাজ। ইসলামের সত্যনিষ্ঠ খলিফাগণ রাত জেগে যেভাবে মানুষের নিরাপত্তাবিধান ও দুঃখ কষ্ট দূর করার জন্য পরিদর্শন করতেন পুলিশ সদস্যরা সেই কাজটিই করছেন। কিন্তু ধর্ম সম্পর্কে আজ সর্বত্র ভুল ধারণা বিরাজিত, ফলে পুলিশ সদস্যরাও কাজের মাহাত্ম্য অনুধাবন করতে সক্ষম নন। তাই সর্বাগ্রে তাদেরকে বুঝাতে হবে ধর্ম কী?
ধর্ম শব্দের অর্থ ধারণ করা। কোনো বস্তু, প্রাণী বা শক্তি যে বৈশিষ্ট্য বা গুণ ধারণ করে সেটাই হচ্ছে তার ধর্ম। আগুনের ধর্ম যেমন পোড়ানো। তেমনি মানুষের ধর্ম হচ্ছে মানবতা, কিন্তু প্রতিটি ধর্ম থেকে আজ মানবতা হারিয়ে গেছে। আজকে নির্দিষ্ট লেবাস ধারণ করে সুরা কালাম পড়তে পারলে, নামায-রোযা করলে তাকে ধার্মিক বলে। এটা সঠিক ধারণা নয়। বরং মানুষের দুঃখ দুর্দশা দেখে যার হৃদয়ে কষ্ট অনুভব হয় এবং দূর করার চেষ্টা করে সে হলো প্রকৃতপক্ষে ধার্মিক। সেই হিসেবে পুলিশ বাহিনীতে যারা কাজ করছেন তারা যে ধর্মের মূল যে কাজ তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ সত্য অনুধাবন করলে তারা পেশাগত কাজ করার ক্ষেত্রেও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আত্মিক প্রেরণা পাবেন তাই সুযোগ পেলেও অসদুপায় অবলম্বন করবেন না।
দ্বিতীয়ত তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে এবাদত কী। এবাদত হচ্ছে যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে সেই কাজটি করা। যেমন আল্লাহ সূর্য সৃষ্টি করেছেন আলো তাপ দেওয়ার জন্য, সেটা দেওয়াই সূর্যের এবাদত। তেমনি আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে (সুরা বাকারা-৩০)। অর্থাৎ সমগ্র সৃষ্টিকে আল্লাহ যেভাবে সুশৃঙ্খল, শান্তিপূর্ণ রেখেছেন ঠিক সেভাবে এ পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল রাখাই মানুষের এবাদত। ঐ কাজের জন্য যে আত্মিক, শারীরিক ও মানসিক চরিত্র দরকার তা অর্জনের প্রশিক্ষণ হচ্ছে নামাজ, রোজা, হজ্ব ইত্যাদি। যদি আসল দায়িত্ব পালন না করে কেবল আনুষ্ঠানিকতাই করে যান তাহলে বহু আমল থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ তা পরিত্যাগ করবেন। এবাদতের অর্থ ভুল বোঝার কারণে সব আমলই ব্যর্থ হয়ে যাবে এ কথাটি আল্লাহর রসুলই বলে গেছেন। তিনি বলেন, ‘এমন সময় আসবে যখন মানুষ রোজা রাখবে কিন্তু না খেয়ে থাকা হবে, রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়বে কিন্তু ঘুম নষ্ট করা ছাড়া কিছুই হবে না’। সুতরাং আসল যে এবাদত তা করার সুযোগ পুলিশ সদস্যগণ লাভ করেছেন।
তৃতীয়ত তাদের ভিতরে এই চিন্তা জাগ্রত করতে হবে যে, মানুষ দেহ এবং আত্মার সমন্বয়ে একটা সৃষ্টি, সে অন্যান্য প্রাণীর মতো নয়। তার শুধু ইহকাল নয়, পরকালও আছে। তার একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন যিনি মানুষকে একটি নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন। তিনি তার প্রতিটি কাজ ও চিন্তা পর্যবেক্ষণ করেন। সে যদি অন্যায় আচরণ করে, কারো প্রতি অবিচার করে, নিজ দায়িত্ব অবহেলা করে, দুর্নীতির আশ্রয় নেয় সেগুলোর পুংখানুপুংখ হিসাব একদিন স্রষ্টার কাছে তাকে দিতে হবে। আল্লাহর উপস্থিতির এই অনুভূতি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অগোচরেও পুলিশ সদস্যদের অপরাধপ্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ করবে।
ধর্মীয় অনুশাসনের পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্ববোধ দ্বারাও উদ্বুদ্ধ করা অপরিহার্য। এই সমাজের প্রতিটি মানুষের সামাজিক কর্তব্য হলো সমাজকে রক্ষা করা, কারণ সমাজ তাকে রক্ষা করে। সমাজের বাইরে তার অস্তিত্বের কোনো মূল্য নেই, ঠিক যেভাবে সমুদ্রের বাইরে তরঙ্গের কোনো মূল্য নেই। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ সমাজ থেকে সুবিধা গ্রহণ করে। সে সমাজের শিক্ষালয়ে শিক্ষিত হয়, সমাজের রাস্তায় যাতায়াত করে, সমাজের মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু এসবের বিনিময়ে সে সমাজের কল্যাণ সাধনে এক মুহূর্ত সময় দিতেও প্রস্তুত নয় বরং সমাজের ক্ষতি সাধন করেও সে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে। এর পরিণামে একটা সময় সমাজ বলতে কিছুই থাকে না, তখন প্রতিটি মানুষ অনিরাপদ হয়ে যায়। পুলিশ সদস্যরাও যদি সমাজকে ধ্বংস করে দিয়ে স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত থাকেন তাহলে একদিন তারাও অসহায় হয়ে পড়বেন, তার সন্তান, ভাই বোন, আত্মীয় পরিজনও এই সমাজে হয়রানির শিকার হবে। সমাজ একটি দেহের ন্যায়। দেহের রোগ সারানোর জন্য যেমন চিকিৎসা করাতে হয় তেমনি সমাজ যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে নানারূপ জটিল সমস্যায় ভোগে তখন সবাইকে উদ্যোগী হতে হয় সমাজকে সুস্থ করে তোলার জন্য। সেই হিসেবে সমাজে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বে যারা আছেন, জনগণের রক্ষায় যাদের ভূমিকা, জনগণ যাদের উপর নির্ভর করে তারা যদি সমাজের শান্তি রক্ষার কাজ করে, সমাজ বিনির্মাণের কাজ করেন তাহলে সমাজ রক্ষা পাবে, সেও রক্ষা পাবে। এটা তার সামাজিক কর্তব্য।
ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে পুলিশ সদস্যদেরকে তাদের দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য পুলিশ প্রশাসনকে আমরা সাধুবাদ জানাই এবং এই কাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে তাদেরকে সহযোগিতা করতে আগ্রহী। কারণ আমাদের কাছে সেই আদর্শ আছে যা দ্বারা এই বাহিনীর সদস্যদের মানসিক পরিবর্তন সাধন সম্ভব হবে এবং যা আমাদের সমাজকে শান্তিপূর্ণ করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
লেখক: প্রকাশক ও সম্পাদক, বাংলাদেশেরপত্র ডটকম; চেয়ারম্যান, জেটিভি অনলাইন ও আমির, হেযবুত তওহীদ

মানুষের প্রকৃত ধর্ম কী???

মানুষের প্রকৃত ধর্ম কী???


রাকীব আল হাসান
ধর্ম শব্দের আভিধানিক অর্থ- ‘স্বভাব, শক্তি, গুণ’ অর্থাৎ বস্তুর অভ্যন্তরস্থ সেই নীতি যা সে মেনে চলতে বাধ্য থাকে। প্রতিটি পদার্থ, প্রতিটি প্রাণীরই সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতিগত কিছু গুনাগুণ থাকে যাকে উক্ত পদার্থ বা প্রাণীর ধর্ম বলে। যেমন আগুনের ধর্ম পোড়ান, উত্তাপ দেওয়া, আলো দেওয়া। আগুনের এই গুণ সনাতন, শাশ্বত। লক্ষ বছর আগেও আগুন পোড়াত, লক্ষ বছর পরও পোড়াবে। এটাই তার ধর্ম। এখন যদি আগুন কোনো কারণে পোড়াতে ব্যর্থ হয়, উত্তাপ না দেয়, আলো নির্গত না করে তবে ঐ আগুনকে কি আগুন বলা যাবে? সে তো শুধু আগুনের প্রতিচ্ছবি, অর্থাৎ শুধুমাত্র আগুনের অবয়ব ধারণ করে আছে। একইভাবে হীরক যদি তার কাঠিন্য, ঔজ্জ্বল্য ও সৌন্দর্য হারায় তবে তাকে আপনি কী বলবেন? বাঘ যদি তার হিংস্রতা, ক্ষিপ্রতা, গতিশীলতা, শক্তি, সাহস হারায় তবে সে বড় দেহধারী বিড়াল ছাড়া আর কী? একইভাবে মানুষেরও কিছু প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য, গুণাগুণ, ধর্ম রয়েছে; এই ধর্মগুলির কারণেই সে মানুষ, তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। তাহলে মানুষের সেই ধর্মগুলি কী? মানুষের ধর্ম হলো মানুষের অভ্যন্তরস্থ মানবীয় গুণাবলী। সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতি, দয়া, মায়া, ভালোবাসা, মনুষ্যত্ব, মানবতা, সৌহার্দ্যতা, বিবেক, সহমর্মিতা, ঐক্য, শৃঙ্খলা ইত্যাদি মানবীয় গুণাবলী হলো মানুষের ধর্ম। যতক্ষণ একজন মানুষ অন্যের ব্যথায় ব্যথিত হয়, অন্যের দুঃখে দুঃখী হয়, অন্যের আনন্দে আনন্দিত হয়, অপরকে সহযোগিতা করে, আর্তপীড়িতের পাশে দাঁড়ায় ততক্ষণ সে ব্যক্তি ধার্মিক হিসেবেই পরিগণিত হবার যোগ্য। এতে সে স্রষ্টার পূজা-উপাসনা-আর্চনা, নামাজ, রোজা, স্রষ্টার প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করুক আর না করুক। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যখন হারিয়ে যায় তখন তার কোনো ধর্ম থাকে না। সে তখন ধর্মহীন হয়ে যায়। তার মধ্যে মনুষ্যত্ব থাকে না, পশুতে পরিণত হয়। এটাই আল্লাহ কোর’আনে বলেছেন- তারা চতুষ্পদ জন্তু-জানোয়ারের মতো, বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট (সুরা আ’রাফ- ১৭৯)।
কাজেই পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে, যে কোনো ধর্মের মানুষ এমনকি ধর্ম অস্বীকারকারীও (যাদেরকে নাস্তিক বলা হচ্ছে) যদি দুঃখ-কষ্টের মধ্যে পতিত হয় তবে তার সমপরিমাণ দুঃখ সকলের অনুভব করা উচিৎ। হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিস্টান অথবা মুসলিম যে ধর্মেরই অনুসারী হোক বর্তমান পৃথিবীর নির্যাতিত ফিলিস্তিনি শিশুদের রক্তস্রোত যদি কারোর চক্ষুকে অশ্র“সিক্ত না করে, আফ্রিকার হাড্ডি-কঙ্কালসার মানুষগুলোর ক্ষুধা, দুঃখ, দারিদ্র্য যদি কারোর বিবেককে আন্দোলিত না করে, ভারতের ধর্ষিতা নারীর আর্তনাদ যদি কারোর কর্ণকুহরে না পৌঁছে, পৃথিবীব্যাপী মানুষে মানুষে যুদ্ধ-বিগ্রহ, রক্তপাত, হানাহানি চললেও যদি কেউ ভালোই থাকে তবে এটা বলতে দ্বিধা নেই যে সে তার মানবীয় ধর্ম হারিয়েছে। সুতরাং সে আর মানুষ নেই, পশুতে পরিণত হয়েছে। আর এমন মানুষ দিয়ে যখন সমাজ পরিপূর্ণ হয়ে যায় তখন সেই সমাজকে আর মনুষ্যসমাজ না বলে শ্বাপদসংকুল অরণ্য বলাই যুক্তিযুক্ত হবে। যদি সে স্রষ্টার উপাসনা-এবাদত, পূজা অর্চনা করে আকাশ-পাতাল পরিপূর্ণও করে ফেলে তথাপি সে ধার্মিক হতে পারবে না। দাহ্যশক্তিহীন আগুন যেমন ধর্মহীন, মূল্যহীন, তেমনি মনুষ্যত্বহীন বিবেকহীন, মানবতাহীন মানুষও ধর্মহীন, মূল্যহীন।

ঈমানবিহীন আমল অর্থহীন

ঈমানবিহীন আমল অর্থহীন


নিজাম উদ্দীন
যে কোন আমলের পূর্বশর্ত হচ্ছে ঈমান। ঈমান ছাড়া আমল অর্থহীন। একজন কাফের, মোশরেক ঈমান আনয়নের পূর্বে যতই আমল করুক এতে তার কোন পুণ্য হয় না। যেমন- আবু জেহেল, আবু লাহাবরাও অনেক ভালো কাজ করেছে কিন্তু তাদের কোনো আমলই কি কাজে আসবে?
এখন এই ঈমান কী? ঈমান হলো- “লা এলাহা এল্লাল্লাহ মোহাম্মদুর রসুলাল্লাহ, আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই এবং মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রসুল” এই কলেমাতে স্বীকৃতি দেওয়া। অর্থাৎ ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে জাতীয়, আন্তর্জাতিক এক কথায় জীবনের সর্ব অঙ্গনে যেখানে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কোন আদেশ, নিষেধ আছে সেখানে আর কারো আদেশ, নিষেধ মানি না- এই স্বীকৃতিই হচ্ছে ঈমান। স্বীকৃতির পরবর্তী কাজ হলো আল্লাহর রাস্তায় জীবন ও সম্পদ দিয়ে এই হুকুম বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা, সর্বাত্মক প্রচেষ্টা তথা জেহাদ। এটিই হলো সর্বপ্রথম এবং প্রধান আমল। এটি ছাড়া মো’মেন হওয়া যায় না। (সুরা হুজরাত-১৫)। যখন জাতীয়, আন্তর্জাতিক জীবনে আল্লাহর হুকুম প্রত্যাখ্যান করে ইহুদি খ্রিষ্টান ‘সভ্যতা’ দাজ্জালের দেওয়া হুকুম বিধান প্রতিষ্ঠিত এবং ফলশ্র“তিতে সমাজ অন্যায়, অবিচারে পরিপূর্ণ তখন সার্বিক জীবনে আল্লাহর হুকুম বিধান বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজ থেকে সকল প্রকার অন্যায় অবিচার দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বাদ দিয়ে যত আমলই করা হোক তা নিরর্থক হবে। কিন্তু আজ এই নিরর্থক আমলই করা হচ্ছে সর্বত্র। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে আজ ইহুদি-খ্রিষ্টান ‘সভ্যতা’ দাজ্জালের হুকুম বিধান প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আমরা একটা দৃশ্য সর্বত্র দেখতে পাই, শহর-গ্রাম, পাড়া-মহল্লাসহ সব জায়গাতেই মানুষ টুপি-পাঞ্জাবী পরে টাখনুর উপর পাজামা তুলে মসজিদে নামাজ পড়তে যাচ্ছে, কোরবানি করছে, হজ্ব করে আসছে, ওয়াজ-মাহফিল শুনছে, কোর’আন তেলাওয়াত করছে, যিকির-আসগর করছে। অর্থাৎ আমরা বুঝাতে চাইছি আমরা পাক্কা মুসলমান। কিন্তু কিভাবে? এই যে নামাজ পড়ছি, কোর’আন পড়ছি, টুপি পাঞ্জাবী পরছি, কেউ কেউ হজ্ব করে আসছি। আমাদেরকে কে বলে দেবে এই জাতি আল্লাহর হুকুম, বিধান বাদ দেওয়ার কারণে এরা মো’মেনই না মুসলিমই না? এই সরল প্রশ্নের উত্তর কে দেবে যে, তাদেরকে আল্লাহ মো’মেন, মুসলিম এর খাতা থেকে বাদ দিয়েছেন বহু আগে। বর্তমানে আল্লাহর হুকুম প্রত্যাখ্যান করে এই জাতি কার্যত কাফের, জালেম, ফাসেক হয়ে গিয়েছে। (সুরা মায়েদা- ৪৪,৪৫,৪৭)
কাজেই এখন আগে আল্লাহর কলেমা, তওহীদ অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দিয়ে মো’মেন হওয়া জরুরি। তারপরে যত পারা যায় ঐসব আমল। আমরা মুখে দাবি করি মুসলমান, আইন-বিধান, হুকুম মানি এবং অনুসরণ করি ইহুদি খ্রিষ্টান সভ্যতা দাজ্জালের। এজন্য আল্লাহ এই জাতির উপর লানৎ দিয়েছেন। এখন এই লানৎ, শাস্তি থেকে পরিত্রাণের একটাই পথ আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া। সেই প্রকৃত, অনাবিল, শান্তিদায়ক, নিখুঁত, ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা কোথায় পাওয়া যাবে?
সেটা আল্লাহ হেযবুত তওহীদকে দান করেছেন। আজ সারা পৃথিবীতে যে ইসলামটি চর্চা করা হচ্ছে, মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তবে, খানকায় যে ইসলামটা শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে সেটা আল্লাহর দেওয়া প্রকৃত ইসলাম নয়। এই ইসলাম ১৬০ কোটির এই জনসংখ্যাকে শান্তি দিতে পারে নি, অন্য জাতির গোলামি থেকে রক্ষাও করতে পারে নি। আমরা এমন এক ইসলামের কথা বলছি, যে ইসলাম সমস্ত মানবজাতিকে পরিপূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তা দিতে পারবে, সমস্ত মানবজাতিকে একটি পরিবারে পরিণত করবে, এনশা’আল্লাহ।

দীন বা ধর্মের বিনিময় নেবার বিরুদ্ধে নবী-রসুলদের কঠিন ভূমিকা

দীন বা ধর্মের বিনিময় নেবার বিরুদ্ধে নবী-রসুলদের কঠিন ভূমিকার কিছু বিবরণ পবিত্র কোর’আনে বর্ণিত হয়েছে। যেমন:
১। নূহের (আ:) এর ঘোষণা: হে আমার সম্প্রদায়! এর পরিবর্তে আমি তোমাদের নিকট ধন সম্পদ চাই না। আমার পারিশ্রমিক আল্লাহর নিকট। [সুরা হুদ-২৯, সুরা শুআর
া – ১০৯, সুরা ইউনুস – ৭২]
২। হুদের (আ:) ঘোষণা: হে আমার সম্প্রদায়! আমি এর পরিবর্তে তোমাদের নিকট কোনো মজুরি চাই না। আমার পারিশ্রমিক তাঁরই নিকট যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তোমরা কি তবুও বুঝতে চেষ্টা করবে না? [হুদ-৫১, সুরা শুআরা – ১২৭]
৩। সালেহ (আ:) এর ঘোষণা: আমি তোমাদের নিকট এর জন্য কোনো পারিশ্রমিক চাই না। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে। [শুয়ারা-১৪৫]
৪। লুতের (আ:) ঘোষণা: এর জন্য আমি কোনো মজুরি চাইনা। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে। [শুয়ারা-১৬৪]
৫। শোয়েবের (আ:) ঘোষণা: আমি এর জন্য তোমাদের নিকট কোনো মূল্য চাই না। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে। [শুয়ারা-১৮০]
৬। মোহাম্মদ (দ:) এর প্রতি আল্লাহর হুকুম:
ক. এবং তুমি তাদের নিকট কোনো মজুরি দাবি কোর না। এই বাণী তো বিশ্বজগতের জন্য উপদেশ মাত্র। [ইউসুফ – ১০৪]
খ. বল! আমি এর জন্য তোমাদের নিকট কোনো পারিশ্রমিক চাই না। এবং যারা মিথ্যা দাবি করে আমি তাদের দলভুক্ত নই। [সাদ – ৮৬]
গ. তাদেরকেই (নবীদেরকেই) আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেছেন। সুতরাং তুমি তাদের পথ অনুসরণ কর; বল! এর জন্য আমি তোমাদের কাছে কোনো মজুরি চাই না। [আনআম – ৯০]
ঘ. বল! আমি এর বিনিময়ে তোমাদের কাছ থেকে প্রেম-ভালোবাসা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার ব্যতীত অন্য কোনো মজুরি চাই না। [শুরা – ২৩]
ঙ. আমি তাদেরকে দিয়েছি উপদেশ, কিন্তু তারা উপদেশে থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অথবা তুমি কি তাদের নিকট কোনো প্রতিদান চাও? তোমার প্রতিপালকের প্রতিদানই তো শ্রেষ্ঠ এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ রেযেকদাতা। [২৩: সুরা মো’মেনুন: ৭১-৭২]
চ. তবে কি তুমি উহাদের নিকট পারিশ্রমিক চাচ্ছো যা ওরা একটি দুর্বহ বোঝা মনে করে? [৫২: সুরা তুর: ৪০]
সুতরাং কোর’আনের ভাষ্যমতে দীনের, ধর্মের কোনো কাজ কোরে নবী ও রসুলরা যেমন পারিশ্রমিক গ্রহণ কোরতেন না, তেমনি তাঁদের উম্মাহর জন্যও পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বৈধ নয়।.

এবাদত কী???

এবাদত কী???


কাজী মাহফুজ
আল্লাহর এবাদত করার জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে (সুরা যারিয়াত ৫৬)। এবাদত হচ্ছে যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে সেই কাজটি করা। গাড়ি তৈরি হয়েছে পরিবহনের কাজে ব্যবহারের জন্য, এটা করাই গাড়ির এবাদত। ঘড়ি তৈরি করা হয়েছে সময় দেখানোর জন্য সুতরাং সময় দেওয়াই ঘড়ির এবাদত। একইভাবে দূরবর্তী মানুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য মোবাইল তৈরি করা হয়েছে কাজেই যোগাযোগ রক্ষা করাই মোবাইলের মৌলিক কাজ বা এবাদত।
আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর প্রতিনিধি (Representative) হিসাবে (সুরা বাকারা-৩০)। অর্থাৎ সমগ্র সৃষ্টিকে আল্লাহ যেভাবে সুশৃঙ্খল, শান্তিপূর্ণ রেখেছেন ঠিক সেভাবে এ পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল রাখাই মানুষের এবাদত। মানুষের মধ্য থেকে সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, যুদ্ধ, রক্তপাত ইত্যাদি দূর করে শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের প্রচেষ্টাই হলো মানুষের এবাদত। মানুষের মধ্য থেকে সকল প্রকার অন্ধত্ব, গোঁড়ামী, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, অশ্লিলতা ইত্যাদি দূর করে স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা, প্রগতি, সুশাসন, সহযোগিতা, ভ্রতৃত্ব, প্রেম, সৌহার্দ্য ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবসমাজে শান্তি নিশ্চিত করাই মানুষের প্রধান কর্তব্য তথা এবাদত। ধরুন আপনি গভীর রাত্রে প্রার্থনায় মগ্ন। হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে ‘আগুন আগুন’ বলে আর্তচিৎকার ভেসে এল। আপনি কী করবেন? দৌড়ে যাবেন সাহায্য করতে নাকি চোখ-কান বন্ধ করে প্রার্থনা চালিয়ে যাবেন। যদি আগুন নেভাতে যান সেটাই হবে আপনার এবাদত। আর যদি ভাবেন- বিপন্ন ব্যক্তি অন্য ধর্মের লোক, তাহলে আপনার মধ্যে মানুষের ধর্ম নেই, আপনার নামায-রোযা, প্রার্থনা সবই পণ্ডশ্রম।
প্রকৃতপক্ষে এবাদত হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব। মুসার (আ.) দায়িত্ব অর্থাৎ এবাদত কী ছিল তা আল্লাহ তাঁকে জানিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ফেরাউনের নিকট যাও, সে দারুণ উদ্ধত হয়ে গেছে (সুরা ত্বা-হা: ২৪)। আল্লাহ তাঁকে ফেরাউনের কাছে পাঠালেন অত্যাচারিত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত ইহুদি জাতিকে দাসত্বের কবল থেকে মুক্ত করে তাদের মানবাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য, মানবতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
এবাদতের সঠিক অর্থ না বোঝার কারণে নির্যাতিতের হাহাকার, ক্ষুধার্তের ক্রন্দন মহা ধার্মিকদের কানে প্রবেশ করে না। এগুলোকে দুনিয়াবি কাজ বলে এড়িয়ে যাবার মতো পাশবিক মনোবৃত্তি তাদের তৈরি হয়েছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কি নামায, রোযা, হজ্ব করতে হবে না? হ্যাঁ, অবশ্যই করতে হবে, কিন্তু আকিদা বুঝে। মানুষের কল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার শারীরিক সক্ষমতা ও আত্মিক শক্তি ও প্রবণতা সবার থাকে না। এটা সৃষ্টির প্রশিক্ষণ (Training) হচ্ছে নামায, রোযা, হজ্ব ইত্যাদি। এগুলো উদ্দেশ্য অর্জনের প্রশিক্ষণ, উদ্দেশ্য হচ্ছে শান্তি। যে মানবতার কল্যাণে সংগ্রাম করবে না, অন্য মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ঘোঁচাতে সম্পদ ব্যয় করবে না, তার তাহাজ্জুদ হবে ঘুম নষ্ট করা, রোযা হবে না খেয়ে থাকা; অন্য আমলের কী দশা হবে ভেবে দেখুন। আল্লাহর রসুল ও তাঁর সাহাবীরা আজীবন মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে গেছেন, এটা করতে গিয়ে তাঁরা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। সকল ধর্মের অবতার ও মহামানবদের জীবনেও রয়েছে শান্তিময় সমাজ বিনির্মাণে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। অথচ আজকের সমাজে মানুষের ধর্মীয় জীবনের নেতৃত্ব দানকারী ধর্মব্যবসায়ী আলেম-পুরোহিতরা মানুষকে কেবল পরকালমুখী হতে শিক্ষা দেন। ফলে দেখা যায় যে যত বড় ধার্মিক সে তত বেশি নির্বিরোধী। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ইচ্ছা বা সাহস কোনোটাই তাদের থাকে না। কারণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোকে তারা এবাদত মনে করেন না, এবাদত বলতে কেবল নামায-রোযাই বোঝেন। এ জন্য উপাসনালয়ের চার দেওয়ালের অভ্যন্তরকেই তারা বেছে নিয়েছেন। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো লেবাস ধারণ করাই ইসলাম নয়, বরং শান্তিপূর্ণ সমাজই হচ্ছে ইসলাম।

Tuesday, January 26, 2016

ধর্মের অধিকাংশ অনুষ্ঠান স্বার্থের দ্বারা টিকে আছে

ধর্মের অধিকাংশ অনুষ্ঠান স্বার্থের দ্বারা টিকে আছে

শরিফুল ইসলাম
ত্যাগের আড়ালে ভোগ আল্লাহর সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই না। খেয়াল করলে দেখবেন ধর্মের সেই অংশটুকুই আজও মহা সমারোহে টিকে আছে যার সঙ্গে কারো না কারো পার্থিব স্বার্থ ও ভোগের সুবিধা জড়িত।
১. শবে বরাতের সঙ্গে গোশত রুটি হালুয়া আর মিলাদ জড়িত।
২. মিলাদের সঙ্গে মিষ্টি আর আলেম সাহেবের হাদিয়া জড়িত।
৩. ঈদের সঙ্গে তুমুল খাওয়া দাওয়া, কেনাকাটা আর ইমাম সাহেবের হাদিয়া জড়িত।
৪. কোরবানির সঙ্গে গোশত খাওয়ার মহোৎসব, মোল্লার হাদিয়া আর লিল্লাহ বোর্ডিং এ দানের চামড়া জড়িত।
৫. নামাজের সঙ্গে ইমাম সাহেবের বেতন জড়িত, আযানের সঙ্গে মোয়াজ্জেনের বেতন জড়িত।
৬. হজ্বের সঙ্গে হাজি সাহেবের সামাজিক মর্যাদার প্রমোশন আর আরবের পর্যটন ব্যাবসা জড়িত।
৭. মৃত্যুর পরে জানাজার নামাজ ও চেহলামের সঙ্গেও ইমাম সাহেবের হাদিয়া জড়িত।
৮. রোযার সঙ্গে ইফতারের বিচিত্র আয়োজন ও তুমুল খাওয়া দাওয়া জড়িত।
৯. বিয়ে শাদি ধর্মীয় কাজ এবং এখানে খাওয়ার গুরুত্ব এতটাই বেশি যে বর বধু বিয়ে করে আর আÍীয় স্বজনে বিয়ে খায়।
মো’মেন হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে নিজের জীবন ও স¤পদ কোরবানি করে মানবতার মুক্তির জন্য সংগ্রাম করা। অর্থাৎ ত্যাগের মাধ্যমেই মো’মেন হতে হয়। কিন্তু আপনিই বলুন, সমাজে এমন কোন ধর্মীয় কাজটি রয়েছে যেখানে সত্যিকার অর্থে মানুষকে ত্যাগ স্বীকার করতে হয় এবং কোনো পার্থিব বা আর্থিক লেনদেন সংঘটিত হয় না। এই স্বার্থগুলোই প্রকৃতপক্ষে ধর্মের এই অংশটিকে জীবিত রেখেছে, ঠিক যেভাবে
আর যদি এমন কোনো ধর্মীয় কাজ বা উপাসনা পাওয়াও যায়, খেয়াল করলে দেখবেন সেগুলোতেও সমাজ কল্যাণের কোনো ধারণা থাকে না। সেখানে কেবল ব্যক্তির ব্যক্তিগত আখেরাতের স্বার্থ জড়িত থাকে।
একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে, আল্লাহ মো’মেনের জীবন ও স¤পদ জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন এই জন্য যে মো’মেন মানবতার কল্যাণে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করবে।তাই ত্যাগস্বীকার না করে আল্লাহর কাছ থেকে জান্নাত লাভের আশা করা বৃথা।

ভারসাম্যহীন জীবনব্যবস্থা ও ধর্মবিশ্বাসকে ভুল খাতে প্রবাহিত করাই সকল অশান্তির কারণ

ভারসাম্যহীন জীবনব্যবস্থা ও ধর্মবিশ্বাসকে ভুল খাতে প্রবাহিত করাই সকল অশান্তির কারণ


শফিকুল আলম উখবাহ
বর্তমানে বিশ্বময় এমন একটা সিস্টেম চলছে যা না গণতন্ত্র না রাজতন্ত্র। সবাই এক বাক্যে বলছে এটি হল স্বৈরতান্ত্রিক পুঁজিবাদী একটা গণতন্ত্র যার অধীনে যাদের বিত্ত-বৈভব আছে তারা ক্ষমতার কেন্দ্রভাগে অবস্থান করে। কাজেই এখানে সুবিধাবাদ ছাড়া অপর কোনো ব্যবস্থা নেই। ভারসাম্যহীন এজন্যই বলা হচ্ছে কারণ মানুষ কেবল দেহ নয়, তার আত্মাও আছে। কিন্তু বর্তমানের প্রচলিত জীবনব্যবস্থাগুলোতে কেবল জড়ের দিক, দেহের দিক, বৈষয়িক দিকগুলোই আলোচনা করে। এই ভারসাম্যহীন জীবনব্যবস্থায় মানুষগুলো যেন আত্মা হারিয়ে পশুতে পরিণত হয়েছে। তাদের নির্মমতায় তাদের পাশবিকতায় জীবনের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এখন তাদের ভিতর বাহির শূন্য। বাহিরে তারা ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে আর ভিতরে দেউলিয়া।
আল্লাহ ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা দিয়েছেন। সেটা হলো এই দীনুল কাইয়্যেমা অর্থাৎ শ্বাশ্বত, সনাতন জীবনব্যবস্থা। একে দীনুল ফেতরা বা প্রাকৃতিক জীবনব্যবস্থাও বলা হয়। আমরা যদি এটা গ্রহণ করি তাহলে আমাদের সামাজিক রাজনৈতিক ব্যক্তি পরিবার সকল ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ একটা জীবনধারা আমরা লাভ করব। সিরিয়ায় জাহাজভর্তি করে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজ বাসভূমি ত্যাগ করে এমনকি ধর্ম ত্যাগের জন্যও প্রস্তুত হয়ে আছে। এদিকে আরেক দল মানুষ হজ করতে গিয়ে ক্রেনের নিচে চাপা পড়ে মরছে।
একদিকে মানুষ সন্তানাদি নিয়ে জীবন রক্ষার জন্য ছুটে যাচ্ছে ইউরোপের সেই দেশগুলোতে যাদের বিরুদ্ধে একসময় মুসলিমরা কয়েক শতাব্দী ধরে ক্রুসেড করেছে, অপরদিকে হাজীরা ছুটছেন হজ্ব করে নিষ্পাপ হওয়ার জন্য। এই হাজীদের কয়জনের মনে আছে যে এদেরকে রক্ষা করা, এদেরকে আশ্রয় দেওয়া তাদের মুখ্য কর্তব্য ছিল। কিন্তু তারা সেটা উপলব্ধি করতে পারছেন না, কারণ তাদের ধর্মবিশ্বাসকে ভুল খাতে প্রবাহিত করে আত্মকেন্দ্রিকতার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এই বৃহৎ সমস্যার সমাধান ততদিন করা যাচ্ছে না, যতদিন তাদের ধর্ম বিশ্বাসকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করা হয়। এই সমস্যরা সৃষ্টিও হয়েছে যে জঙ্গিবাদের থেকে সেই জঙ্গিবাদও ধর্মবিশ্বাসকে ভুল পথে চালিত করার ফল। মানুষ ঈমান দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েই এই সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে, একে তারা জেহাদ ও কোরবানি মনে করছে। কিন্তু তাদের এই কাজ না তাদের উপকারে আসছে, না মানবজাতির উপকারে আসবে। যে বিশ্বাস বা ঈমান দুনিয়ার কাজে লাগে না, সেই ঈমান দিয়ে আখেরাতেও তাদের কোনো উপকার হবে না। এখন সময় এসেছে ঈমানকে মানবতার কল্যাণে সঠিক পথে প্রবাহিত করা। সেই পথ প্রদর্শন করছি আমরা হেযবুত তওহীদ। যারা মুক্তি চান তারা আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হোন।
[মতামতের জন্য: ০১৭৮২১৮৮২৩৭, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩]