Monday, November 30, 2015

বাংলার মুসলমানদের সাহিত্য আন্দোলনে পন্নী পরিবারের ভূমিকা

মাননীয় এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর বাড়ি তথা করটিয়া জমিদার বাড়ির দক্ষিণে অবস্থিত এই মসজিদটি প্রায় ১৪৪ বছরের পুরনো মসজিদ। ১৮৭১ সালে এমামুযযামানের প্রপিতামহ হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। কারুকার্যশোভিত ত্রিকোণ মিনার, প্রাচীন আমলের ঝুলন্ত ঝাড়বাতি এবং সিন্দুক, তিনটি মেহরাব সকলেরই দৃষ্টি কাড়ে।


ইতিহাস একটি জাতির বর্তমান নির্মাণ করে আর বর্তমানের কর্ম নির্মাণ করে তার ভবিষ্যৎ। তাই অতীতকে অস্বীকার করে কখনোই সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা সম্ভব নয়। একাত্তর সনে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি স্বাধীনতার লক্ষ্যে শাসকের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। একইভাবে পূর্বেও বহুবার বাঙালি জাতি দেশ ও জাতির কল্যাণার্থে ঐক্য গঠন করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় একাত্তরের স্মৃতি আমাদের হৃদয়ে আজও অম্লান থাকলেও এর পূর্বের সংগ্রামগুলোর ইতিহাস সম্পর্কে আমরা তেমন অবগত নই। সেই ইতিহাসগুলোও আমাদের জানা থাকা জরুরি, অন্যথায় আমাদের অতীতজ্ঞান অসম্পূর্ণ থেকে যাবে এবং সেই ইতিহাসের শিক্ষা থেকে আমরা বঞ্চিত রয়ে যাব।
.
বর্তমানে আমরা যখন হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা মাননীয় এমামুযযামানের আদর্শকে মানুষের সামনে উপস্থাপন করছি, আমরা দেখতে পাচ্ছি অনেকেই সুলতানী যুগ থেকে শুরু করে অদ্যবধি এ দেশের স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশ, সাহিত্য, শিল্প, শাসন, রাজনীতি প্রতিটি অঙ্গনে পন্নী পরিবারের অসামান্য অবদান সম্পর্কে অবহিত নন।
.
এ কারণে আমরা ক্রমান্বয়ে একেকটি বিষয়ে এমামুযযামান এবং তাঁর পরিবারের গৌরবময় অতীত ও বর্তমানকে তুলে ধরার প্রয়াস করব। আজ আমরা মাননীয় এমামুযযামানের প্রপিতামত হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নীর সাংবাদিকতা ও সাহিত্য জগতের কিছু অবদানের কথা উল্লেখ করছি।
.
জাতীয় জাগরণে জনমত সৃষ্টিতে সংবাদপত্র সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে যে দুই শতাব্দব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছে তাতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে চেষ্টা করা হয়েছে। সনাতন ধর্মী ও মুসলিমদের মধ্যে বহু সংগঠন ও পত্রিকা হয়েছিল যেগুলো ধর্মীয় চেতনাকে স্বাধিকার আন্দোলনের পথে প্রবাহিত করেছে।
.
উনিশ শতকের শেষ দুই দশক এবং কুড়ি শতকের প্রথম ভাগে প্রকাশিত সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র এবং সমসাময়িক মুসলিম সাহিত্য সাধনা ও ইংরেজ ও তাদের আনুকূল্যপ্রাপ্ত বর্ণহিন্দুদের যৌথ শোষণ-লুণ্ঠন, ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্রের কারণে পিছিয়ে পড়া বাংলার মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
.
মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মুসলমানগণ মূলত এই জাগরণ প্রয়াসের কাণ্ডারি ছিলেন। তবে এ কাজে কয়েকজন সমাজহিতৈষী বিত্তবান মুসলমান বিশেষ যতœবান ছিলেন। তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অগ্রণী ছিলেন মোমেনশাহীর ধনবাড়ির জমিদার সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী (১৮৬৩-১৯২৯)। তাঁর কাছে বাংলার মুসলমানেরা নানাভাবেই ঋণী। তিনি ছিলেন হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা মাননীয় এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর মা মোসাম্মাৎ বিলকিস খানমের নানা।
.
এমামুযযামানের পূর্বপুরুষগণ ব্রিটিশ শাসনকে কোনোদিনই হৃদয় থেকে গ্রহণ করেন নি, বরং তারা সর্ব উপায়ে চেষ্টা চালিয়েছেন বাংলার মানুষের হৃদয়ে স্বাধিকার চেতনার অগ্নিকে প্রজ্জ্বলিত করে তুলতে। মোঘল আমল থেকেই ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল-বগুড়াসহ উত্তরবঙ্গের বিরাট এলাকার জমিদার ছিলেন তারা।
.
দেলদুয়ারের জমিদার গজনভী পরিবারের সঙ্গে তাদের আত্মীয়তার নিবিড় বন্ধন ছিল। এই উভয় পরিবারই মুসলিমদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার তথা ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের বিস্তারের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। সেই যুগে এমামুযযামানের দাদার বাবা করটিয়ার জমিদার হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী এই লক্ষ্যে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যার নাম ছিল ‘মাহমুদিয়া যন্ত্র’ বা ‘মাহমুদিয়া প্রেস’।
.
উল্লেখ না করলেই নয় যে, তিনি একজন দৃষ্টিহীন ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু দৃষ্টিহীনতা তাকে সমাজচিন্তা বা জ্ঞানসাধনা থেকে বিরত রাখতে পারে নি। তিনি সর্বদার জন্য জ্ঞানী-গুণীজনদের দ্বারা পরিবৃত থাকতে পছন্দ করতেন। তিনি শারীরিকভাবে অসম্ভব শক্তিশালী ছিলেন, তার অন্যান্য অনুভূতিগুলো দৃষ্টিমান ব্যক্তিদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষুরধার।
.
তার মেধা, চিন্তা ও বিচারক্ষমতা আজও প্রবাদতুল্য। তার প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত প্রেস থেকে বহু ঐতিহাসিক গ্রন্থ, পত্রিকা ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে। পন্নী পরিবারের প্রতাপ ও জনপ্রিয়তা এতই বিপুল ছিল তাদেরকে অবজ্ঞা করাও ব্রিটিশ শাসকদের পক্ষে সম্ভব হয় নি।
.
আব্দুল হালিম গজনভীর মা বিদ্যানুরাগী করিমুন্নেসার অর্থানুকূল্যে টাঙ্গাইল থেকে ১৮৮৬ সালে (শ্রাবণ ১২৯৩) আব্দুল হামিন খান ইউসুফজাই- এর সম্পাদনায় ‘আহমদী’ নামে অসাম্প্রদায়িক ও ন্যায়নিষ্ঠ একটা পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো। এর আগে ১৮৮৫ সনে এটি মাসিক পত্রিকা হিসাবে প্রকাশিত হয়। ১৮৮৯ সনে (১২৯৬ বাংলা সনে) স্থানীয় একটি পত্রিকার সঙ্গে একত্রিত হয়ে এটির নাম হয় ‘আহমদী ও নবরত্ন’।
.
টাঙ্গাইলের সুরুজ গ্রামের অধিবাসী মাওলানা মুহাম্মদ নঈমুদ্দিন হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নীর পৃষ্ঠপোষণে পবিত্র কোর’আনের টীকাসহ পূর্ণ অনুবাদ করেন যা ১৮৮৭ সনে করটিয়ার মাহমুদিয়া প্রেস থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল। কোর’আনের হাতে লেখা কপিটি এখনো সা’দত বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত আছে।
.
এর প্রকাশক ছিলেন মীর আতাহার আলী। তিনি বোখারি শরিফও অনুবাদ করেন এবং আরো প্রায় অর্ধশত গ্রন্থ রচনা করেন। এভাবেই হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী সর্বপ্রথম কোরা’আন ও বোখারি শরিফ অনুবাদ করিয়ে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন।
.
বাংলার মুসলমানদের সাহিত্য আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালনকারী পত্রিকা ‘আখবারে এসলামিয়া’ (১৮৮৪) প্রকাশিত হয় ‘মাহমুদিয়া প্রেস’ থেকে যার সম্পাদক ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ নঈমুদ্দিন।
.
১০ বছর টানা তিনি এই পত্রিকাটি প্রকাশ করেছেন। সে সময়ে করটিয়ার ‘আখবারে এসলামিয়া’ পত্রিকাটি ছাড়া সব ক’টি পত্রিকাই প্রকাশিত হয় কোলকাতা থেকে। বলা চলে, বাংলার মুসলিম সাংবাদিকতার এটাই ছিল সূচনা পর্ব। পরবর্তীতে ১৮৯০ সালে মীর মোশাররফ হোসেনের সম্পাদনায় কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়া থেকে পাক্ষিক ‘হিতকরী’ প্রকাশিত হতো সম্পূর্ণরূপে টাঙ্গাইলের হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নীর আর্থিক সহায়তায়।
.
সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ভাষাবিদ ও রাজনীতিবিদ আবুল কালাম শামসুদ্দীন এ বিষয়ে পরবর্তীতে লিখেছেন, “বাঙ্গালি মুসলমান কর্তৃক সংবাদপত্র প্রকাশের সত্যিকার চেষ্টা হয় সম্ভবত ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে। তখন কয়েকজন উদ্যমশীল মুসলমান সাহিত্যিকের আবির্ভাব হয়, যাদের সমাজ হিতৈষণা মুসলিম বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।” বলার অপেক্ষা রাখে না যে মাহমুদ আলী খান পন্নী ছিলেন এদেরই অন্তর্ভুক্ত।
.
তার নামের স্মৃতি বহন করছে করটিয়ার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এইচ. এম. ইনিস্টিটিউশন যা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার জ্যেষ্ঠপুত্র দানবীর ওয়াজেদ আলী খান পন্নী ওরফে চান মিয়া সাহেব। এসএসসি পর্যন্ত এ স্কুলেই পড়াশুনা করেছেন এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী।
দেলদুয়ার জমিদার
১৮৮৮ সালে ঢাকায় পূর্ববঙ্গের সম্ভ্রান্ত জমিদারদের সঙ্গে হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী (হলুদ বাক্স চিহ্নিত)

হজ্ব¡ কোনো তীর্থযাত্রা নয় মোসলেম উম্মাহর বার্ষিক মহাসম্মেলন

হজ্ব¡ কোনো তীর্থযাত্রা নয় মোসলেম উম্মাহর বার্ষিক মহাসম্মেলন




মোহাম্মদ রিয়াদুল হাসান : ইসলামের অন্য সব কাজের মতোই আজ হজ্ব সম্বন্ধেও এই জাতির আকীদা (Concept) বিকৃত হয়ে গেছে। এই বিকৃত আকীদায় হজ্ব আজ সম্পূর্ণরূপে একটি আধ্যাত্মিক ব্যাপার, আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করার পথ। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে- আল্লাহ সর্বত্র আছেন, সৃষ্টির প্রতি অণু-পরমাণুতে আছেন, তবে তাঁকে ডাকতে, তাঁর সান্নিধ্যের জন্য এত কষ্ট করে দূরে যেতে হবে কেন? তাঁর নিজের আত্মা তিনি মানুষের দেহের মধ্যে ফুঁকে দিয়েছেন (সূরা আল-হিজর ২৯)। অর্থাৎ প্রতিটি মানুষের মধ্যে তিনি রয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি বলেছেন-নিশ্চয়ই আমি তোমাদের অতি সন্নিকটে (সূরা আল-বাকারা ১৮৬, সূরা সাবা ৫০, সূরা আল-ওয়াকেয়াহ ৮৫), তারপর আরও এগিয়ে গিয়ে বলছেন- আমি (মানুষের) গলার রগের (রক্তবাহী ধমনীর) চেয়েও সন্নিকটে (সূরা কাফ ১৬)। যিনি শুধু অতি সন্নিকটেই নয়, একবারে গলার রগের চেয়েও নিকটে তাকে ডাকতে, তার সান্নিধ্যের আশায় এত দূরে এত কষ্ট করে যেতে হবে কেন? যদি তর্ক করেন যে আল্লাহ চান যে আমরা তার ঘরে যাই, তবে জবাব হচ্ছে প্রথমতঃ ঘরের মালিকই যখন সঙ্গে আছেন তখন বহু দূরে তার পাথরের ঘরে যাবার কী প্রয়োজন আছে, দ্বিতীয়তঃ আসল হজ্ব হয় আরাফাতের ময়দানে, আল্লাহর ঘর কাবায় নয়। তার ঘর দেখানোই যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তবে কাবাকে হজ্বের আসল কেন্দ্র না করে কাবা থেকে অনেক দূরে এক খোলা মাঠকে কেন্দ্র করলেন কেন? তৃতীয় প্রশ্ন হচ্ছে- ধরে নিলাম আল্লাহ আরাফাতের ময়দানেই বসে আছেন। সেখানে যেয়ে তার সামনে আমাদের উপস্থিত হবার জন্য তিনি বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত করে দিয়েছেন কেন? আমাদের সঙ্গে না থেকে তিনি যদি আরাফাতের মাঠেই থেকে থাকেন তবে যে যখন পারে তখন সেখানে যেয়ে তো তার সামনে লাব্বায়েক বলে হাজিরা দিতে পারে। তা না করে তিনি আদেশ দিয়েছেন বছরের একটা বিশেষ মাসে, একটা বিশেষ তারিখে তার সামনে হাজির হবার। একা একা যেয়ে তাকে ভাল ভাবে ডাকা যায়, নাকি সম্পূর্ণ অপরিচিত জায়গায়, অপরিচিত পরিবেশে, লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রচণ্ড ভিড়ের ধাক্কাধাক্কির মধ্যে দাঁড়িয়ে তাকে ভাল ভাবে, মন নিবিষ্ট করে ডাকা যায়? কিন্তু অবশ্য কর্তব্য ফরদ করে দিয়েছেন একা একান্তে তাকে ডাকা নয়, ঐ বিশেষ তারিখে লক্ষ লোকের ঠেলাঠেলির মধ্যে।
শেষ নবীর (সা.) মাধ্যমে ইসলামের যে শেষ সংস্করণটি আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠালেন সেটার উদ্দেশ্য, উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়া অর্থাৎ সামগ্রিক রূপ যাদের মস্তিষ্ক থেকে বিদায় নিয়েছে, এক কথায় যাদের আকিদা বিকৃত হয়ে গেছে, তাদের কাছে এ সব প্রশ্নের জবাব নেই। দীন শব্দের অর্থ জীবন-ব্যবস্থা, জীবন-বিধান। যে আইন-কানুন, নিয়ম দণ্ডবিধি মানুষের সমষ্টিগত, পারিবারিক, সামাজিক রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করবে সেটারই একত্রিত, সামগ্রিক রূপ হচ্ছে দীন। এ দীন আল্লাহর সৃষ্টও হতে পারে, মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূতও হতে পারে, দু’টোই দীন। মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত যে দীন তা স্বভাবতঃই ভারসাম্যহীন, কারণ তা অতি সীমিত জ্ঞান থেকে তৈরি। আর আল্লাহ যে দীন সৃষ্টি করেছেন তা ভারসাম্যযুক্ত (সুরা বাকারা ১৪৩)। আল্লাহর সৃষ্ট দীন অর্থাৎ ইসলাম মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, আইন দণ্ডবিধি ইত্যাদি মানুষের জীবনের সমষ্টিগত ও তার আত্মার যত রকমের প্রয়োজন তার সব কিছুরই একটা ভারসাম্যপূর্ণ মূল-নীতি নির্দেশনা। সুতরাং এই শেষ দীনের অন্যান্য সব বিষয়ের মতো হজ্বও ভারসাম্যপূর্ণ। এতে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ইত্যাদির যেমন অংশ আছে তেমনি আত্মার উন্নতির, পরিচ্ছন্নতারও অংশ আছে, দু’টোই আছে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায়, এর যে কোন একটির গুরুত্ব কমিয়ে দিলেই আর সেই ভারসাম্য থাকবে না, তা আর দীনে ওয়াসাতা থাকবে না, তা আজকের এই বিকৃত ইসলাম হয়ে যাবে। যে কারণে আল্লাহর প্রতি মন-সংযোগ জামাতের সালাতের চেয়ে নির্জনে অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও ফরদ হচ্ছে ঐ জামাতে যোগ দেওয়া, ঠিক সেই কারণে নির্জনে বোসে আল্লাহকে ডাকায় বেশি মন-সংযোগ, নিবিষ্টতা (Concentration) হওয়া সত্ত্বেও আদেশ হচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের কোলাহলে, জনতার সাথে একত্র হয়ে তার সামনে হাজির হওয়া। কারণ অন্যান্য বিকৃত ধর্মগুলির মতো শেষ ইসলামের আকিদা শুধু একতরফা অর্থাৎ আত্মার ধোয়ামোছা, পরিষ্কার পবিত্রতা নয়।
আল্লাহর খলিফা মানুষ তৈরির বিপক্ষে মালায়েকরা অর্থাৎ ফেরেশতারা যে যুক্তি দেখিয়েছিলো তা হল এই যে- হে আল্লাহ তোমার এই সৃষ্টি, এই খলিফা পৃথিবীতে ফাসাদ (অন্যায়, অবিচার, অশান্তি) ও সাফাকুদ্দিমা (মারামারি, রক্তপাত, যুদ্ধ-বিগ্রহ) করবে। মালায়েকেরা যে দুটি শব্দ ব্যবহার করলো সে দু’টোই সমষ্টিগত, ব্যক্তিগত নয়। অর্থাৎ মূল প্রশ্ন, মূল সমস্যাই সমষ্টিগত। এ মূল সমস্যার সমাধান আল্লাহ দিলেন- দীনুল ইসলাম, এটাও সমষ্টিগত। ব্যক্তির স্থান এখানে নগণ্য। ব্যক্তির মূল্য শুধু এটুকুই যে ব্যক্তি দিয়েই সমাজ, জাতি গঠিত; ব্যক্তি জাতির একটি একক (unit), এর বেশি নয়। সমষ্টির এই একক হিসাবে ব্যক্তির যেমন মূল্য আছে, তেমনি সমষ্টির বাইরে এর কোন দাম নেই। উদাহরণ হিসাবে একটি সামরিক বাহিনীকে নেয়া যায়। একটি একটি সৈনিক নিয়েই বাহিনীটি গঠিত। ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি সৈন্য যত ভাল যোদ্ধা হবে, বাহিনীর জন্য তত ভাল। সেনাপতি চেষ্টা করবেন যাতে তার বাহিনীর প্রতিটি সৈনিক দক্ষ যোদ্ধা হয়, যদি তিনি দেখেন যে কয়েকটি সৈনিক তেমন ভাল করছে না তবে স্বভাবতই তিনি তাদের প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেবেন, তাদের শিক্ষার ওপর বিশেষ চাপ দেবেন। এমনকি যদি তিনি একটি মাত্র সৈন্যকেও দেখেন যে তার রাইফেলের গুলি লক্ষ্যস্থলে লাগছে না, তাহলে তাকে আরো ভাল করে শেখাবেন কেমন করে গুলি করলে লক্ষ্যস্থলে লাগবে, অভ্যাস করার জন্য আরও গুলি সরবরাহ করবেন। কিন্তু ঐ বাহিনীর বাইরে ঐ একক সৈন্যের কোন মূল্য নেই। ঐ সামরিক বাহিনী যদি ঐক্যবদ্ধ, শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে, সেনাপতির পরিকল্পনা অনুযায়ী যুদ্ধ না করে সৈন্যরা এককভাবে যুদ্ধ শুরু করে তবে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ঐ বাহিনী শত্র“র আক্রমণের সম্মুখে অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রতিটি সৈন্য যদি অতি দক্ষ যোদ্ধাও হয় তবুও তাই হবে।
সুতরাং এ দীনেও ব্যক্তির মূল্য ঐ সেনাবাহিনীর একটি সৈনিকের চেয়ে বেশি নয়। যে পাঁচটি স্তম্ভের (ফরদে আইন) ওপর এই দীন স্থাপিত তার চারটিই সমষ্টিগত, জাতিগত। তওহীদ, (ফরদ) সালাহ, যাকাত, হজ্ব এই চারটিই সমষ্টিগত, জাতিগত; শুধুমাত্র রোযা ব্যক্তিগত। বর্তমানে বিকৃত, বিপরীতমুখী যে দীন আমরা মেনে চোলেছি তাতে তওহীদকে সমষ্টিগতভাবে বুঝা অনেকের পক্ষে অসুবিধাকর হতে পারে। তাদের বুঝার জন্য সংক্ষেপে বলছি- আল্লাহ যে তওহীদকে স্বীকৃতি দেবেন, গ্রহণ করবেন, সে তওহীদ সর্বব্যাপী, মানুষের জীবনের সর্বস্তরের সমস্ত অঙ্গনের তওহীদ; তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আইন, দণ্ডবিধি, শিক্ষা, অর্থনীতি ইত্যাদি সমস্ত কিছুর উপর তওহীদ; অর্থাৎ সমষ্টিগত তওহীদ। জীবনের ক্ষুদ্রতম কোন বিষয়ও তা থেকে বাদ থাকবে না। এর নিচে কোন তওহীদ সেই সর্বশক্তিমান স্রষ্টা গ্রহণ করবেন না। বর্তমানে আমাদের তওহীদ জীবনের শুধু ব্যক্তিগত ভাগে ছাড়া আর কোথাও নেই। এই আংশিক ও ক্ষুদ্র তওহীদ আল্লাহর পক্ষে গ্রহণ করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। প্রকৃত তওহীদ সমষ্টিগত, জাতিগত। আল্লাহ কোর’আনে বার বার বোলেছেন- আসমান ও জমিনের সার্বভৌমত্ব আল্লাহর। তিনি মানব জাতির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক জীবন পরিচালনার জন্য যে সংবিধান (কোর’আন) ও ঐ সংবিধানের ওপর ভিত্তি করে যে আইন-কানুন, দণ্ডবিধি দিলেন সেটার সার্বভৌমত্ব হল আল্লাহর। বৃহত্তর ও সমষ্টিগত জীবনে গায়রুল্লাহর সার্বভৌমত্বকে স্বীকার ও গ্রহণ করে নিয়ে শুধুমাত্র ব্যক্তিজীবনের সার্বভৌমত্বটুকু আমরা আল্লাহর জন্য রেখেছি। সেই জাল্লে-জালাল, আযিজুল জব্বার, স্রষ্টা ভিক্ষুক নন যে তিনি এই ক্ষুদ্র তওহীদ গ্রহণ করবেন। তাছাড়া ওটা তওহীদই নয়, ওটা র্শেক ও কুফর।
সুতরাং শেষ ইসলামের প্রথম ও মুখ্য দিকটা হচ্ছে জাতীয়, রাষ্ট্রীয়; ব্যক্তিগত দিকটা গৌণ যদিও ভারসাম্যযুক্ত। তাই ফরদ অর্থাৎ অবশ্যই করণীয়, যেটা না করলে চলবে না, সেই ফরদ সালাহ কায়েমের আদেশ জামাতে, সবার সঙ্গে, হজ্ব করার আদেশ হচ্ছে বিশাল জন সমাবেশে। আর নফল সালাহ অর্থাৎ ব্যক্তিগত সালাহ যা অবশ্য করার নয়, ব্যক্তির ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এ থেকেই তো পরিষ্কার হয়ে যায় যে ইসলামে জাতীয় বিষয়ই প্রধান ও মুখ্য। ফরদ অর্থাৎ জাতীয় বিষয়গুলিকে বাদ দিয়ে নফল অর্থাৎ ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে থাকলে তা জায়েজ হবে না, যেমন জায়েজ হবে না ফরদ সালাহ বাদ দিয়ে রাত ভর নফল সালাহ পড়লে। সালাহ যেমন জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্যযুক্ত হজ্বও তেমনি। বলা যায় জামাতে সালাহ্’রই বৃহত্তম সংস্করণ হজ্ব। এই দীনের সমস্ত জাতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হচ্ছে এবাদতের স্থানগুলি অর্থাৎ মসজিদ, কারণ মোসলেমের জীবনের, জাতীয় ও ব্যক্তিগত উভয় জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য এবলিসের চ্যালেঞ্জে আল্লাহকে জয়ী করানো ও পৃথিবীতে ন্যায় বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা। সুতরাং মোসলেমের জীবনে ইহজীবন ও পরজীবনের, দেহের ও আত্মার কোন বিভক্তি থাকতে পারে না কারণ দেহ থেকে আত্মার পৃথকীকরণ বা আত্মা থেকে দেহ পৃথকীকরণের একটাই মাত্র পরিণতি-মৃত্যু। তাই এই জাতির সমস্ত কর্মকাণ্ড এক অবিচ্ছিন্ন এবাদত। জামাতে সালাতের উদ্দেশ্য হল মোসলেম পাঁচবার তাদের স্থানীয় কর্ম-কাণ্ডের কেন্দ্র মসজিদে একত্র হবে, তাদের স্থানীয় সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা পরামর্শ করবে, সিদ্ধান্ত নেবে, তারপর স্থানীয় ইমামের নেতৃত্বে তার সমাধান করবে। তারপর সপ্তাহে একদিন বৃহত্তর এলাকায় জামে মসজিদে জুমা’র সালাতে একত্র হয়ে ঐ একই কাজ করবে। তারপর বছরে একবার আরাফাতের মাঠে পৃথিবীর সমস্ত মোসলেমদের নেতৃস্থানীয়রা একত্র হয়ে জাতির সর্বরকম সমস্যা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ইত্যাদি সর্বরকম সমস্যা, বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে, পরামর্শ করবে, সিদ্ধান্ত নেবে। অর্থাৎ স্থানীয় পর্যায়ে থেকে ক্রমশঃ বৃহত্তর পর্য্যায়ে বিকাশ করতে করতে জাতি পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু মক্কায় একত্রিত হবে। একটি মহাজাতিকে ঐক্যের সুদৃঢ় বন্ধনে বেঁধে রাখার কী সুন্দর প্রক্রিয়া।
আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা.) এ অপূর্ব সুন্দর প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট করে দিলেও তা এই জাতির ঐক্যকে ধরে রাখতে পারলো না আকিদার বিকৃতির কারণে। এই দীনের অতি বিশ্লেষণ করে, সূক্ষ¥াতিসূক্ষ্ম মসলা-মাসায়েল উদ্ভাবন করে জাতিটাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে একে এক মৃতপ্রায় জাতিতে পরিণত করে দেওয়ার পরও এর সব রকম, অর্থাৎ জাতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র মসজিদ ও কাবাই ছিলো, কারণ তখনও এই দীনকে জাতীয় ও ব্যক্তিতে বিভক্ত করা হয় নি। তারপর যখন ঐ ঐক্যহীন, ছিন্ন-বিছিন্ন জাতিটাকে আক্রমণ করে ইউরোপীয় জাতিগুলি দাসে পরিণত করে খণ্ড খণ্ড করে এক এক জাতি এক এক খণ্ড শাসন ও শোষণ করতে শুরু করলো তখন ঐ শাসনের সময় জাতির জীবনকে জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনে ভাগ করা হল অর্থাৎ দেহ থেকে আত্মাকে বিচ্ছিন্ন করা হল এবং অবশ্যম্ভাবীরূপে জাতি একটি মৃত জন-সংখ্যায় পরিণত হল। সালাহ ও হজ্ব হয়ে গেলো ‘এবাদত’ ব্যক্তিগত উপাসনা, যেখানে রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক কোন কিছুর স্থান নেই। আল্লাহর আইন ও দণ্ডবিধির তো কোন প্রশ্নই উঠে না, কারণ সেগুলোকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে সেখানে ইউরোপীয় খ্রিস্টান ইহুদিদের তৈরি আইন, অর্থনীতি, দণ্ডবিধি, শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হল। ঐ সময় থেকেই দুই এলাহ গ্রহণ করার ফলে এই জাতি কার্যতঃ মোশরেক ও কাফের হয়ে আছে। যদিও আকিদার বিকৃতির কারণে তা উপলব্ধি করার মতো বোধশক্তিও অবশিষ্ট নেই।
যামানার এমামের লেখা থেকে সম্পাদিত।
[যোগাযোগ: হেযবুত তওহীদ, ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৯৩৩৭৬৭৭২৫, ০১৭৮২১৮৮২৩৭, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩]

আক্রান্ত মুসলিম বিশ্ব, ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

আক্রান্ত মুসলিম বিশ্ব, ঝুঁকিতে বাংলাদেশ






মোহাম্মদ আসাদ আলী:  ঠিক যে মুহূর্তে আমাদের দেশে ‘ঈদুল আযহা’ উপলক্ষে আনন্দ-উল্লাসের জোয়ার বইছে, সেই মুহূর্তেই আন্তর্জাতিক গতিপ্রকৃতি ঘোষণা করছে এমন এক করুণ বাস্তবতা, যা সমস্ত পৃথিবীর মুসলিম নামধারী জাতিটির ভবিষ্যৎকে ভয়াবহ অন্ধকারে নিপতিত করেছে। মহামারীর মতো একের পর এক মুসলিম দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে জঙ্গিবাদ, যার পেছনে পেছনে রক্তলোলুপ সাম্রাজ্যবাদ তার ডালপালা বিস্তৃত করে রেখেছে। এই অশুভ শক্তির অপঘাতে আজ ক্ষত-বিক্ষত ইরাক, মিশর, উত্তর আফ্রিকা, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া ও তুরস্কের মতো মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রগুলো। জঙ্গিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের শিকার হয়ে এসব দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে ঈদের আনন্দ। যেখানে জীবন বাঁচানোই দুরূহ, চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় লাশের স্তুপ, আকাশ থেকে পড়ে বোমাবৃষ্টি, প্রতিটি মুহূর্ত যেখানে এক একটি আতঙ্কের নাম, সেখানে ঈদ কোনো আনন্দের বার্তা বয়ে আনবে না, বরং যে কোনো প্রকারের আনন্দ-উচ্ছ্বাসই সেখানে বিলাসিতা হিসেবে পরিগণিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। ইরাক-সিরিয়ার মাটি থেকে উদ্বাস্তু হওয়া লক্ষ লক্ষ মুসলমানের ঈদ কাটছে শরণার্থী শিবিরের নোংরা পরিবেশে, উত্তাল সমুদ্রের বুকে, অথবা খুব ভালো হলে ইউরোপের ফুটপাত-রাস্তাঘাটে। মুসলিম দুনিয়ায় এতবড় মানবিক বিপর্যয় ইতিহাসে দেখা যায় নি।
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম মুসলিম প্রধান দেশ। এখানেও জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি রয়েছে। এ আশঙ্কা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ব্যক্ত করেছেন। এসএসএফ- এর ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন যে, ‘বিশ্বে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কৌশল পরিবর্তন হচ্ছে দিন দিন। নানা ধরনের সংঘাত বাড়ছে। বাংলাদেশকে আমরা এই সংঘাত থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছি। বিষয়টি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।’ গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও বলছেন, গত দুই বছরে ইরাক, সিরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জঙ্গি তৎপরতার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনদের নানা কার্যক্রমে এ দেশেও জঙ্গি তৎপরতায় অনেকে উৎসাহিত হচ্ছে। (প্রথম আলো অনলাইন, ২৮.০৭.২০১৫)। চলতি মাসের ১৬ তারিখে বিবিসি সংবাদে প্রকাশ, ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এদেশে জঙ্গিবাদ দমনে ব্রিটিশ সরকারকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
আক্রান্ত মুসলিম বিশ্ব, ভয়াবহ ভবিষ্যতের হাতছানি:
কেউ স্বীকার করুক আর না করুক, এটা প্রমাণিত সত্য যে, বর্তমান পৃথিবীতে এক নম্বর ইস্যু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে জঙ্গিবাদ। কিছুদিন পূর্বেও পৃথিবীব্যাপী মিডিয়াগুলোর আলোচ্য বিষয় ছিল তালেবান ও আল কায়েদা, সে স্থান এখন পুরোপুরি ‘আইএস’ এর দখলে। আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাসের নিয়ন্ত্রণ, জমজমাট অস্ত্রব্যবসা এবং ক্ষমতা প্রদর্শনের সাম্রাজ্যবাদী পটভূমিতে হঠাৎ প্রবেশ করে রাতারাতি সারা পৃথিবীর আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে সংগঠনটি। অবশ্য বর্তমানে অনেকেই তাদেরকে সংগঠন বলতে রাজি নয়। কারণ এখন তাদের ভূখণ্ড আছে, অস্ত্র আছে, অর্থ আছে, এমনকি অল্প দিনেই তারা একটি রাষ্ট্রকাঠামোও গড়ে তুলেছে। এই ‘আইএস’ই এখন মুসলিম বিশ্বের ভয়ানক চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকলেই বুঝতে সক্ষম হচ্ছেন। ওদিকে নিউনেশিয়া, সোমালিয়া, নাইজেরিয়া, মরোক্ক, মিশর ইত্যাদি দেশগুলোতে কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম ও পশ্চিমাদের সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র ও শাষক শ্রেণির দমন-পীড়ন সব মিলিয়ে এক বিভিষীকাময় পরিস্থিতি চলছে। মধ্যপ্রাচ্যে যে অশান্তি ও রক্তপাত এখন অনেকাংশে সিরিয়া-ইরাকের ভূমিতেই সীমাবদ্ধ আছে, তা ছড়িয়ে পড়তে পারে সমগ্র মুসলিম দুনিয়ায়। যদি তা হয় তবে ইরাক-সিরিয়ার মতো ভাগ্য বরণ করতে হবে অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোকেও। এ আশঙ্কা এখন অনেক বিশ্লেষকই করছেন।
‘আইএস’ যে কারণে অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়তে পারে:
ক. ‘আইএস’ এর মূল শক্তি ইসলামের জেহাদী চেতনা। এই চেতনাকে কাজে লাগিয়ে তারা এতদূর এসেছে। ইসলামের নাম ব্যবহার করে সমগ্র বিশ্বের জেহাদী চেতনাধারী মানুষের কাছে আইএস ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করেছে। আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা সব জায়গা থেকে জেহাদীরা ইরাক-সিরিয়ার পানে ছুটছে। বর্তমানে ‘আইএস’ এর হয়ে লড়াই করছে প্রায় ৫০ হাজার যোদ্ধা, যাদের মধ্যে প্রায় ২৫ হাজারই বিদেশি। এই বিদেশি যোদ্ধার সংখ্যা দিন দিন হু হু করে বাড়ছে।
খ. মুসলিম দুনিয়ায় পবিত্র কোর’আনের পরেই যে গ্রন্থ অবশ্যই মান্য বলে বিবেচিত হয় তা হাদিস। সেই হাদিস দেখে দেখে, শেষ যামানা সম্পর্কে রসুলের ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে ‘আইএস’ যোদ্ধারা নিজেদের কর্মকাণ্ডকে এমনভাবে মিলিয়ে মিলিয়ে পদক্ষেপ ফেলছে যাতে মুসলিমমাত্রই বিভ্রান্ত হবে। তারা তাদের খলিফার নামটি পর্যন্ত মনোনীত করেছে হাদিস মিলিয়ে। ফল হয়েছে যে, সারা বিশ্বের ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ ‘আইএস’কেই প্রকৃত মুসলিম বলে মনে করছে এবং, পৃথিবীব্যাপী ইসলাম ও মুসলিমদের দুর্দিনে ‘আইএস’কে তাদের পরিত্রাণদাতা বলে জ্ঞান করছে। এ বিশ্বাস ধারণ করে অনেকেই জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে, যা সংগঠনটির ক্রমাগত শক্তিবৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
গ. পরিসংখ্যান বলছে- অতীতে কোনো জঙ্গি বা সন্ত্রাসীগোষ্ঠী এতটা অর্থের মালিক হতে পারে নি, যতটা অর্থ-সম্পদ এখন পর্যন্ত আইএস এর হাতে এসেছে। সংগঠনটির দুই বিলিয়ন ডলার অর্থসম্পদ আছে। ইরাক-সিরিয়ার বিশাল তেলসমৃদ্ধ অঞ্চল তাদের নিয়ন্ত্রণে। এত অর্থনৈতিক সাপোর্ট এর আগে কোনো জঙ্গি সংগঠন লাভ করে নি। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী, জেহাদী চেতনায় উজ্জীবিত, ইসলামের নামে পরিচালিত এমন একটি ভূখণ্ড সারা পৃথিবীর জেহাদী চেতনাধারী মুসলমানকে আকৃষ্ট করবে- এতে অবাক হবার কিছু নেই।
ঘ. আইএস যে কল্পিত নিয়ন্ত্রণরেখা প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, তাদের লক্ষ্য তারা নির্দিষ্ট করেছে মুসলিম দেশগুলোর দিকে। পাশ্চাত্য দেশগুলো সম্পর্কে আল কায়েদা বা তালেবানের মতো হিংসাত্মক বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে পশ্চিমাদের খেপিয়ে তোলার ইচ্ছা ‘আইএস’ এর এখনও নেই। সম্ভবত তারা অতীতের ইরাক-আফগান প্রেক্ষাপট থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেই এবারের কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে। আর এটাও ঠিক যে, ‘আইএস’ যে হারে শক্তি সঞ্চয় করছে, তা যদি আর কয়েক বছর অব্যাহত থাকে তবে তাদের উত্থান ঠেকানোর সক্ষমতা আরব-অনারব নির্বিশেষে কোনো মুসলিম দেশেরই থাকবে না। মুসলিম দেশগুলো যদি ‘আইএস’কে প্রতিরোধ করতে চায় তাহলে সামরিক শক্তির পাশাপাশি এসব দেশের সরকারের পক্ষে জনসমর্থনের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো- এসব মুসলিমপ্রধান অধিকাংশ দেশের সরকারেরই জনসমর্থন নেই, তারা কোনো রকমে অস্ত্রবলে, শক্তিবলে ক্ষমতা ধরে রেখেছে। অর্থাৎ যে কোনো বহিঃশত্র“র আক্রমণ প্রতিহত করতে চাইলে এই সরকারগুলোর পক্ষে জনগণের সহায়তা পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। এমতাবস্থায়, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার আগেই ‘আইএস’ এর মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিতে পারে একমাত্র পশ্চিমা শক্তিই। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে কতটা আগ্রহী তাতে সংশয়ের অবকাশ আছে। কারণ এখন পর্যন্ত যে চিত্র আমরা দেখে এসেছি তার উপর নির্ভর করে বলা যায়, আইএস থেকে পশ্চিমাদের কোনো ক্ষতি তো নেই-ই, বরং উপকার হয়েছে, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। আইএস যতই শক্তি-সামর্থ্য অর্জন করবে, নতুন নতুন ভূ-খণ্ড দখল করবে ততই যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর অস্ত্রব্যবসা জমজমাট হবে। ইতোমধ্যেই ‘আইএস’ এর ভয় দেখিয়ে আরব দেশগুলোতে অস্ত্রবিক্রির রমরমা ব্যবসা শুরু হয়েছে। সুতরাং ‘আইএস’ আমেরিকার শত্র“ বটে, তবে প্রয়োজনীয় শত্র“ (টংবভঁষ ঊহবসু)। আল কায়েদা বা তালেবান যতদিন সেই প্রয়োজনীয় শত্র“র ভূমিকা পালন করে এসেছে ততদিন ‘আইএস’ এর দরকার ছিল না, তাই আইএস সৃষ্টি হয় নি, এখন তালেবান-আল কায়েদা ছিবড়ে হয়ে গেছে, দরকার নতুন শত্র“, নতুন আতঙ্ক, তাই আইএস সৃষ্টি হলো। ‘আইএস’কে যারা নিজেরাই গর্ত থেকে টেনে বার করল, তারা শতভাগ সুবিধা আদায় না করেই কোন কারণে তাকে প্রতিরোধে নামবে?
সুতরাং পশ্চিমারা আইএস এর অগ্রযাত্রায় কার্যত কোনো বাধাই সৃষ্টি করবে না। অপরদিকে মুসলিম দেশগুলো আর কিছুদিন গেলে শত ইচ্ছা থাকলেও এই দৈত্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। অর্থাৎ পরিণতি অনুমানযোগ্য, অচীরেই হয়তো সাম্রাজ্যবাদ তথা স্বার্থবাদের লীলাভূমি সিরিয়া-ইরাকের রক্তরঞ্জিত মাটি থেকে উদ্গত এই বিষবৃক্ষের বিষফল ভোগ করতে হবে মুসলিমপ্রধান অন্যান্য দেশগুলোকে।
প্রেক্ষিত বাংলাদেশ:
আইএস যোদ্ধারা এখন কার্যত সারা বিশ্বের জঙ্গি ও জঙ্গিসমর্থকদের আদর্শিক ‘হিরো’তে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি ‘আইএস’ মহানবীর ভবিষ্যদ্বাণীকৃত হাদিস (যদিও অনেক হাদিসের বিশুদ্ধতা নিয়ে খোদ হাদিসবেত্তাদেরই প্রচুর মতভেদ রয়েছে, হাদীসের নামে বহু দয়ীফ, জাল বা ভুয়া হাদিস প্রচলিত আছে) মিলিয়ে মিলিয়ে ইসলামী খেলাফতের নামে এমন একটি কৃত্রিম কাঠামো দাঁড় করিয়ে ফেলছে যে, ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের মধ্যে একটি বড় অংশ মনে করছে ‘আইএস’ এর মাধ্যমেই বিশ্বে শান্তি আসবে, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে এবং পাশ্চাত্যের দুঃশাসন থেকে মানুষ চূড়ান্তভাবে মুক্তিলাভ করবে। ইতোমধ্যেই হাজার হাজার যুবক এই ধ্যানধারণা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে কথিত জেহাদ করছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষ ছুটছে ইরাক-সিরিয়ার পথে, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
১৫ কোটি মুসলমানের মাতৃভূমি হিসেবে বাংলাদেশও সমান ঝুঁকিতে রয়েছে, যা নির্মম সত্য। এ দেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। তারা আল্লাহ, আল্লাহর রসুল ও ইসলামকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। ‘জেহাদী তামান্না’ বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও আছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। অতীতে এ দেশে জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের নজিরও আছে। ব্যাপক প্রশাসনিক তৎপরতার মুখে জঙ্গিদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে বটে, তবে নির্মূল করা সম্ভব হয় নি এবং সম্ভব নয়ও যে কথা কিছুদিন পূর্বেই এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন। এখন আইএস এর এই উত্থানপর্ব থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এ দেশের জঙ্গিবাদীরাও যে নতুনভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে না তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না, বরং সে সম্ভাবনাই বেশি। এমনিতেই বিভিন্ন সময়ে উন্মাদনা সৃষ্টি করে কথিত জেহাদী তামান্না সৃষ্টি করা হয় বাংলাদেশে যা বার বার আমরা দেখেছি। ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার ঘটনা এ দেশে অহরহ ঘটে। এছাড়াও রয়েছে মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত অর্থোপার্জনের দৃষ্টান্ত। এক কথায় আমাদের দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের ঈমানকে হাইজ্যাক করে থাকে এক শ্রেণির স্বার্থবাদী। তার উপর এই জঙ্গিবাদের অশুভ ছায়া। ধর্মের বিবিধ অপব্যবহারের এই সংস্কৃতি এবং আন্তর্জাতিক গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এ কথা বলায় দোষের কিছু থাকে না যে, বাংলাদেশও এই সঙ্কটে পড়তে পারে বা পড়ার আশঙ্কার বাহিরে নয়।
এই আশঙ্কা থাকত না যদি আমরা অন্তত ১৬ কোটি মানুষ সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ থাকতাম। একজন সত্যনিষ্ঠ নেতার কথা মান্য করতাম। একটা আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হতাম, কিন্তু তা তো নয়। আমাদের দেশের ১৬ কোটি মানুষ আজ নানা দল-মত-পথে বিভক্ত। যখন-তখন যে কোনো ইস্যু নিয়ে শুরু হয় দাঙ্গা-হাঙ্গামা, রক্তপাত। একদল আরেকদলকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য এক পায়ে খাড়া। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য বৈদেশিক পরাশক্তিদের আহ্বান করা হয়ে থাকে। এমন পরিস্থিতি দেশের জন্য খুবই বিপজ্জনক।
আমাদের করণীয় কী?
এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় বুঝতে হলে কীভাবে সিরিয়া বা ইরাকের মতো সমৃদ্ধিশালী দেশগুলো ধ্বংস হলো সেটা পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। যেদিন প্রথম সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটে, কেউ কি ভেবেছিল তার পরিণতি এতদূর গড়াতে পারে? সিরিয়ানরা কি ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছিল অচীরেই তাদের জীবন-স¤পদ নিয়ে পরাশক্তিগুলো নোংরা খেলায় মেতে উঠবে? বস্তুত তারা ছিল নির্বিকার। সরকারবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রথমে জাতির মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি হলো, এখানে ওখানে বিচ্ছিন্ন কিছু সংঘর্ষ হলো, সরকার দমন-পীড়ন চালাতে থাকল, আন্দোলনকারীরা ক্রমেই সহিংসতার পথে ধাবিত হলো, আর দেশের প্রায় প্রধান যে জনসংখ্যাটি তারা এসব কিছুকে অবলীলায় এড়িয়ে যেতে থাকল। তারা খবর পড়েছে, প্রাত্যহিক আহত-নিহতের পরিসংখ্যান দেখেছে, কিন্তু দেশের অতবড় বিপর্যয়কর মুহূর্তে নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হয় নি, জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার হতে দেখেও সে দেশের সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, শিক্ষক, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও আপামর জনগণ মুখ বুঁজে বসে ছিল। হয়তো ভেবেছিল, এতে তাদের দায় নেই, সরকার ও সরকারবিরোধীদের বিবাদ তারাই মীমাংসা করুক। কিন্তু, তাদের সেই নি¯পৃহতা ও নির্লিপ্ততার পরিণতি তারা শেষাবধি এড়াতে পারল না। আজ যারা যুদ্ধবিধ্বস্ত মাতৃভূমি সিরিয়া ছেড়ে অচেনা-অজানা দেশগুলোতে আশ্রয়ের আশায় ছুটে চলছে তারা কারা? তারা কি কেবলই নিুবিত্ত শ্রেণি? না, শুধু নিুবিত্তরাই নয়, প্রাণ বাচাতে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে এককালের বাঘা বাঘা শিল্পপতিরাও। রয়েছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চাকরিজীবী, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক সকলেই। আজ তারা এক কাতারে এসে দাড়িয়েছেন। তাদের এক নামে ডাকা হচ্ছে। এক বিশেষণে বিশেষায়িত করা হচ্ছে, সেটা হলো রিফিউজি, তাদের কোথাও জায়গা নেই। অথচ এই মানুষগুলোই যদি কয়েক বছর পূর্বে যাবতীয় অন্যায়, অপশাসন, জঙ্গিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক কাতারে দাঁড়াতে পারত, আজকের সিরিয়াকে এমন দুর্ভাগ্য বরণ করতে হতো না।
বাংলাদেশকেও যদি আমরা তেমন পরিণতি ভোগ করা থেকে ফেরাতে চাই, তবে একমাত্র উপায় ধর্ম-বর্ণ-দল-মত নির্বিশেষে ১৬ কোটি বাঙালির ঐক্যবদ্ধ হওয়া। এ ক্ষেত্রে আমাদের ১৬ কোটি মানুষের ধর্মবিশ্বাসই বর্ম হয়ে যাবতীয় অপশক্তির কবল থেকে জাতিকে রক্ষা করতে পারে। আন্তর্জাতিক এই ক্রান্তিকালে সমস্ত মুসলিম দুনিয়া যখন আক্রান্ত হয়ে পড়েছে বা আক্রান্ত হবার পথে, চরম ঝুঁকির মুখে রয়েছে মাতৃভূমি বাংলাদেশ, তখন ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

জঙ্গি আছে-জঙ্গি নেই: বিতর্কে বাংলাদেশ

রাকিব আল হাসান: বিকৃত ধর্মবিশ্বাস যে বৃহৎ সমস্যাগুলি সৃষ্টি করে তার মধ্যে অন্যতম ধ্বংসাত্মক মতবাদ হলো জঙ্গিবাদ। বর্তমান পরিস্থিতিতে জঙ্গিবাদ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু দেশসহ পৃথিবীর বহু দেশ আজ এই জঙ্গিবাদ নামক ক্যান্সারে আক্রান্ত।
আমাদের দেশেও এই জঙ্গিবাদের তৎপরতা অতীতে বেশ ভালোভাবেই দেখা গেছে। বর্তমানে আমাদের দেশে জঙ্গি তৎপরতা আছে কি নেই এ বিষয়টি নিয়ে চরম বিতর্ক চলছে। কেউ বলছেন বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে আবার কেউ বলছেন আমাদের দেশে জঙ্গি নেই।
.
এসএসএফ- এর ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘বিশ্বে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কৌশল পরিবর্তন হচ্ছে দিন দিন। নানা ধরনের সংঘাত বাড়ছে। বাংলাদেশকে আমরা এই সংঘাত থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছি। বিষয়টি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।’
.
এরপর সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে প্রকারান্তরে সমর্থন করেই বললেন, গত দুই বছরে ইরাক, সিরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জঙ্গি তৎপরতার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের নানা কার্যক্রমে এ দেশেও জঙ্গি তৎপরতায় অনেকে উৎসাহিত হচ্ছে। আর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি তিনি বলেছেন তা হলো, জঙ্গিবাদ এ দেশ থেকে একেবারে নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে আমাদের (আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর) অভিযানের কারণে তা নিয়ন্ত্রণে আছে। (প্রথম আলো অনলাইন, ২৮.০৭.২০১৫)।
এদিকে গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বেগের সঙ্গে বলেন, ব্রিটেনের জিহাদিরা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশে (বাংলাদেশ) জঙ্গিবাদকে উসকে দিচ্ছে। (সমকাল, ১৭ সেপ্টেম্বর, ’১৫)।
বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদ দমনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। ‘ওয়াশিংটন টাইমস’ নামের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি পত্রিকায় গত মাসের ১৫ তারিখে একটি প্রবন্ধ লিখে তিনি এ আহ্বান জানান।
এই বক্তব্যগুলো প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের আশঙ্কা রয়েছে। জঙ্গিবাদ আমাদের জন্য একটি ভয়ানক হুমকি। কিন্তু এদিকে সম্প্রতি জঙ্গি হামলার অশঙ্কার কথা বলে যখন অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ক্রিকেট দল বাংলাদেশ সফর স্থগিত করে তখন নানা মহল থেকে বলা হয় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের কোনো আশঙ্কা নেই।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, দেশে জঙ্গি উত্থানের কোনো আশংকা নেই। উপমহাদেশের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটতে পারে নি (যুগান্তর, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫)। সংসদে থাকা বিরোধী দল এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও অ-সংসদীয় বিরোধী দল বিএনপি এ বিষয়ে একমত পোষণ করে বলেছিলেন, “বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের কোনো অস্তিত্ব নেই।” নির্ধারিত সময়ের আগে টেস্ট সিরিজ খেলতে অস্ট্রেলিয়া তাদের ক্রিকেট দলকে সফরে পাঠাবে বলেও আশা প্রকাশ করে। এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মুখপাত্র ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক স¤পাদক আসাদুজ্জামান রিপন এই কথা বলেন। (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫)।
ঠিক এরপরই ইতালীয় নাগরিক চেজারে তাভেল্লাকে গুলশান-২ এর ৯০ নম্বর সড়কে গুলি করে হত্যা করা হয়। এবং পরদিন ২৯ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে সংবাদ আসে, “ঢাকার ইতালীয় নাগরিককে খুনের দায় ইসলামিক স্টেট (আইএস) স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে জঙ্গি হুমকি পর্যবেক্ষণকারী ওয়েবসাইট ‘সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্র“প’।” (বিডি নিউজ ২৪ ডটকম, ২৯ সেপ্টেম্ববর)।
এ বিষযে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দাবি করেন বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠন আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই। দেশে আইএস না থাকলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন সময় আইএস জঙ্গি সন্দেহে বিভিন্নজনকে গ্রেফতার করছে কেন এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, বিদেশ থেকে অনেকে বাংলাদেশে আসে। তারা সদস্য সংগ্রহ ও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করলে তাদের গ্রেফতার করা হয়। (সমকাল, ৩০ সেপ্টেম্বর)। এর আগে গত বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছিলেন, বাংলাদেশে জামায়াতুল মুজাহিদীনসহ (জেএমবি) কোনো জঙ্গি সংগঠনের আস্তানা বা অস্তিত্ব নেই। বাংলাদেশের অবস্থান যেকোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিপক্ষে। (প্রথম আলো, ১১ অক্টোবর, ১৪)।
এভাবে কখনো প্রমাণ করতে চাওয়া হচ্ছে দেশে চরমভাবে জঙ্গি উত্থানের আশঙ্কা রয়েছে আবার কখনো প্রমাণ করতে চেষ্টা করা হচ্ছে যে দেশে কোনো জঙ্গি নেই, জঙ্গি উত্থানের কোনো আশঙ্কাও নেই। এখন কথা হচ্ছে যদি ধরে নেওয়াও হয় যে, দেশে প্রকৃত অর্থে জঙ্গি নেই তবুও কি আমরা জঙ্গি সমস্যা উপেক্ষা করে থাকতে পারব? প্রথম কথা হচ্ছে অতীতে এদেশে জঙ্গি ছিল, তারা বিভিন্ন নাশকতা ঘটিয়েছে, অনেকে গ্রেফতার হয়েছে, অনেকে বিচারের মুখোমুখি হয়েছে কিংবা অনেকেই বিচারাধীন আছে এবং ইতোমধ্যে অনেকের ফাঁসিও হয়ে গেছে।
২০০৫ সালের ১৭ই আগস্ট বাংলাদেশের মোট ৬৪ জেলার ৬৩ টিতেই একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে জঙ্গিদের শক্তির জানান দিয়েছিল জেএমবি। তাছাড়া ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে সেই সময়ের বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। হামলায় শেখ হাসিনা আহত না হলেও বোমার আওয়াজে তার শ্রবণযন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে নিহত হন আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন। জানা যায়, এই হামলা চালায় মুফতি হান্নানের হরকাতুল জিহাদ।
এর আগেও ঢাকার রমনা বটমূল এবং যশোরে উদীচী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে জঙ্গি হামলা চালিয়েছিল হরকাতুল জিহাদ। জেএমবি ১৭ আগস্টের পর সারাদেশে একের পর এক আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ, সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাসহ ৩৩ জন জনকে হত্যা করে। প্রশাসন যে সবাইকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে কিংবা বিচারের সম্মুখীন করতে পেরেছে তা নয়। অনেকেই এখন ঘাপটি মেরে বসে আছে। উপযুক্ত সময় পেলেই তারা স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হবে। এখন কথা হচ্ছে সেই উপযুক্ত সময় কোনটা?
বৈশ্বিক পরিবেশ কি দ্রুতই জঙ্গিদের সেই কাক্সিক্ষত সুযোগের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে না? আফগানিস্তানে তালেবানদের পুনরায় জয়-জয়কারের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে আইএস গজিয়েছে। তারা সংখ্যায়, আয়তনে, সপদে এবং অস্ত্রে এখন এতটাই শক্তিশালী যে মধ্যপ্রাচ্যের একক কোন দেশই তাদেরকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম নয়। আইএস কোন জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সংগঠন কিংবা রাজনৈতিক দল নয়। তারা নির্ধারিত একটি ভূ-খণ্ড নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকবে না। তারা অবশ্যই অন্যান্য দেশের সমমনাদেরকে ফুসলানী দিয়ে সে সব দেশেও এই আদর্শের বিস্তার ঘটাতে চাইবে। সেটার নমুনা ইতোমধ্যেই আমরা দেখতে পাচ্ছি। আইএস মারফত জানা গেছে উপমহাদেশেও তাদের শাখা গঠিত হয়েছে। তাছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশের কূটনৈতিক ইটালির নাগরিক তাভেলা চেজার ও রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও খুনের দায় স্বীকার করেছে আইএস- এমন সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে।
অবশ্য দাবি করা হচ্ছে আইএস- এর দায় স্বীকার বানোয়াট। কিন্তু এ ঘটনায় আইএস জড়িত না থাকলেও অর্থাৎ তাদের দায় স্বীকারের ঘটনা বানোয়াট হয়ে থাকলেও কি আমরা বেঁচে যাব? কিংবা আমাদেরকে কি শান্তিতে থাকতে দেওয়া হবে? তাই ফিরে আসি প্রথম কথায়, বাংলাদেশে জঙ্গি থাক বা না থাক, এখানে জঙ্গিদের উত্থান ঘটানো হবে বলে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
বাংলাদেশের শত্র“রাই সেটা করবে। বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট টিমের আসা স্থগিত করা, পশ্চিমা দেশেগুলোর হাতে জঙ্গি নাশকতার সম্ভাব্য তথ্য থাকা, ইতালির কূটনীতিক হত্যা, জপানি নাগরিক হত্যা, অনেক দেশের নাগরিকদেরকে সতর্ক হয়ে চলাচল করা তার একটা অংশবিশেষও হতে পারে বলে বিজ্ঞজনেরা মনে করছেন।
সুতরাং বাংলাদেশে আইএস নেই এবং আইএস আসার সম্ভাবনাও নেই এই চিন্তা করে যদি আমরা কানে তুলো দিয়ে ঘুমিয়ে থাকি, স্বীকার অস্বীকার নিয়ে টালবাহানা করতে থাকি তাহলে আমরা বাঁচতে পারব না। ঘুমন্ত অবস্থায়ই একদিন দেখব আমাদের পরিণতি হয় গেছে সিরিয়ার মতো কিংবা ইরাকের মতো একটি দেশে। সুতরাং এখন উপায় কী? অস্ত্রব্যবসায়ী সাম্রাজ্যবাদী ও শত্র“স্থানীয় শক্তিশালী দেশগুলো যদি বাংলাদেশকে জঙ্গিদের অভয়ারণ্য হিসেবে প্রমাণ করতে তৎপর হয় তবে আমরা তাদেরকে কী দিয়ে তাদের এই ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে পারি? এর একমাত্র উপায় হচ্ছে জাতীয় ঐক্য।
আমরা দেশের ষোলো কোটি মানুষ যদি জঙ্গিবাদকে ঘৃণা করি, জঙ্গিবাদকে যদি প্রতিহত করার চেষ্টা করি, প্রচার-প্রচারণা চালাই তবে গুটিকয়েক ঘাপটি মেরে থাকা মানুষ এদেশে বিশৃঙ্খলা করতে পারবে না। জনগণই তাদেরকে প্রতিহত করবে। পাশাপাশি আমরা সাম্রাজ্যবাদীদের সকল অপচেষ্টাকে রুখেও দিতে পারব ইনশাল্লাহ। সুতরাং সরকারি দল, বিরোধী দল সবাইকে এই একটি ব্যাপারে এক হয়ে সম্ভাব্য এই ঝুঁকিকে মোকাবেলা করতে হবে। না হলে এদেশে কে সরকারী দল, কে বিরোধী দল, কে সংসদ সদস্য, কে বুদ্ধিজীবী, কে আইনজ্ঞ, কে বিচারক, কে ডাক্তার, কে সাংবাদিক তার কোনো পরিচয় অবশিষ্ট থাকবে না, সবার পরিণতিই হবে এক। সবার পরিচয় হবে রিফিউজি। তবে রিফিউজি হতে পারাটাও হবে সৌভাগ্যের বিষয়। এই ঘনবসতিপূর্ণ দেশে অধিকাংশই বেঘোরে প্রাণ হারাবে। লাখে লাখে মারা পড়বে একেকটি হামলায়।

সুন্দর প্রস্ফুটিত ভোরের অপেক্ষায়

সুন্দর প্রস্ফুটিত ভোরের অপেক্ষায়





কিশোর কারুণিক
আমি একটি সুন্দর প্রস্ফুটিত ভোরের অপেক্ষায়
উন্মুখ হয়ে বসে আছি।
রক্তিম আভায় লাল হয়ে উঠবে সবদিক
থাকবে না হানাহানি, থাকবে না হিংসা বিদ্ধেষ
গুণগুণ করবে পাখি মানবিক কোলাহলে সবত্র
প্রতিদিন ঘুম ভাঙে
রবির আলোতে দেখি রক্তের হোলি খেলা
হত্যা, হাঙ্গামা নষ্ট হবার সব কিছু
বুকের ভেতরটা কেদেঁ ওঠে ;
আমি জানি, নষ্টরা আমাকে বলবে
ও দূর্বল, কেড়ে নেবার ক্ষমতা নেই ওর ।
ওদের কথায় আমি গুরুত্ব দিই না
ওরা অবুঝ, বারংবার প্রার্থনা করি
মানুষ করো ওদের প্রভু সুবুদ্ধি দাও ।
নষ্টরা সবকিছু নষ্ট করতে চায় ।
সব জায়গায়, সর্ব ক্ষেত্রে ওদের বিচরণ
অনেক ভেবেছি, অনেক সয়েছি
সুবুদ্ধি ওদের হয় নি;
ধীরে ধীরে সব কিছু গ্রাস করতে চায় ওরা
শরীরের পবিত্রতা, চিন্তার সাবলীলতা ।
বামে ডানে অন্ধকার সামনে যেন মহাদূর্যোগ ।
আর বসে থাকা নয়, আর ভিরুতা নয়
এবার সম্মুখ প্রতিরোধ ।
যে অবস্থায় থাকা সেখান থেকেই
এখনই সম্মুখ প্রতিরোধ
প্রতিরোধের বলিষ্ট সময় এখনই ।

ধর্ম কি কাঁচের ঠুনকো গ্লাস যে, একটুতেই ভেঙ্গে যাবে???

ধর্ম কি কাঁচের ঠুনকো গ্লাস যে, একটুতেই ভেঙ্গে যাবে???





কাজী নজরুল ইসলাম: 
হ্যাঁ, ধর্ম সম্বন্ধে আমার আর একটু বলবার আছে। আমি তো পূর্বেই বলেছি যে, সব ধর্মেরই ভিত্তি চিরন্তন সত্যের উপর- যে সত্য সৃষ্টির আদিতে ছিল, এখনো রয়েছে, অনন্তেও থাকবে। এই সত্যটাকে যখন মানি, তখন আমাকে যে ধর্মে ইচ্ছা ফেলতে পারিস। আমি হিন্দু, আমি মুসলমান, আমি খ্রীস্টান, আমি বৌদ্ধ, আমি ব্রাহ্ম।
আমি তো কোনো ধর্মের বাইরের (সাময়িক সত্যরূপ) খোলসটাকে ধরে নেই। গোঁড়া ধার্মিকদের ভুল তো ঐখানেই। ধর্মের আদত সত্যটা না ধরে এরা ধরে আছেন যতসব নৈমিত্তিক বিধি-বিধান। এরা নিজের ধর্মের উপর এমনি অন্ধ অনুরক্ত যে, কেউ এতটুকু নাড়াচাড়া করতে গেলেও ফোঁস করে ছোবল মারতে ছুটেন। কিন্তু একটু বোঝেন না তারা যে, তাদের ‘ঈমান’ বা বিশ্বাস, তাদের ধর্ম কত ছোট কত নীচ কত হীন যে, তা একটা সামান্য লোকের এতটুকু আঁচড়ের ঘা সইতে পারে না।
ধর্ম কি কাঁচের ঠুনকো গ্লাস যে, এক্টুতেই ভেঙ্গে যাবে? ধর্ম যে বর্মেরই মতন সহ্যশীল, কিন্তু এসব বিড়াল তপস্বীদের কাণ্ড দেখে তো তা কিছুতেই মনে করতে পারিনে। তাদের বিশ্বাস তো ঐ এতটুকু বা সত্যের জোরও অমনি ক্ষুদ্র যে, তার সত্যাসত্য নিরূপনের জন্যে তোমায় আলাদা পথে যেতে দেওয়া তো দূরের কথা, তা নিয়ে একটা প্রশ্নও করতে দিবেন না।
… এইসব কারণেই ভাই, আমি এইরকম ভণ্ড আস্তিকদের চেয়ে নাস্তিকদের বেশি ভক্ত, বেশি পক্ষপাতী। তারা সত্যকে পায়নি বলে সোজা সেটা স্বীকার করে ফেলে বলে বেচারাদের হয়েছে ঘাট। অথচ তারা এই সত্যের স্বরূপ বুঝতে, এই সত্যকে চিনতে এবং সত্যকে পেতে দিবা-রাত্তির প্রাণপণ চেষ্টা করছে- এই তো সাধনা- এইতো পূজা, এই তো আরতি। এই জ্ঞান-পুষ্পের নৈবেদ্য চন্দন দিয়ে এরা পূজা করবে আর করছে, তবু দেবতাকে অন্তরে পায়নি বলে মুক্তকণ্ঠে আবার স্বীকারও করছে যে, কই দেবতা? কাকে পূজা করছি? আহা! কি সুন্দর সরল সহজ সত্য! এদের ওপর ভক্তিতে আপনিই যে মাথা নুয়ে পড়ে। এরা যাই হোক, এরা তো মিথ্যুক নয়, এরা বিবেকের বিরুদ্ধে কথা বলে না- এরা যে সত্যবাদী। অতএব এরা সত্যকে পাবেই পাবে; আজ না হয় কাল পাবে।
আর এই বেচারারা অন্ধ বিশ্বাসীর দল? বেচারারা কিছু না পেয়েই পাওয়ার ভাণ করে চোখ বুজে বসে আছে। অথচ এদের শুধোও, দেখবে দিব্যি নাকি-কান্না কেঁদে লোক-দেখানো ভক্তি-গদগদ কণ্ঠে বলবে, -“আঁহাঁ হাঁ! -মঁরিঁ মঁরিঁ! ঐঁ ঐঁ ঐঁ দেঁখঁ তিঁনিঁ!” মিথ্যার কি জঘন্য অভিনয় ধর্মের নামে- সত্যের নামে! ঘৃণায় আপনিই আমার নাক কুঁচকে আসে। তাই তো আমি বলি যে, এই পথ-হারানোটা পথ খুঁজে পাওয়ারই রূপান্তর। তবে যা কিছু বুঝবার ভুল। গুরুদেব সত্যি-সত্যিই গেয়েছেন,-
“ভাগ্যে আমি পথ হারালেম পথের মধ্যখানে!”
(নজরুলের বিখ্যাত পত্রোপন্যাস বাঁধন-হারাতে রাবেয়ার উদ্দেশে লেখা চিঠির অংশবিশেষ)

আধুনিক প্রগতিবাদী ও মুক্তমনাদের প্রতি

আধুনিক প্রগতিবাদী ও মুক্তমনাদের প্রতি


মোহাম্মদ আসাদ আলী  :
সম্প্রতি বাংলাদেশে ‘ব্লগার-প্রকাশক হত্যাকাণ্ড’ ও ‘বিদেশি হত্যাকাণ্ড’ সংঘটিত হবার পেছনে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠার পর দেশের প্রখ্যাত গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, সুশীল শ্রেণি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তারা কেউ এ ধরনের ঘটনাকে নেয়ায়েত বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়েই দিচ্ছেন। কেউ ‘জঙ্গি আছে জঙ্গি নেই’ এই বিতর্কের পালে হাওয়া দিচ্ছেন। আবার একটি বিশাল শ্রেণী এই ইস্যুতে এতটাই ভীত-সন্ত্রস্ত ও আশাহত হয়ে পড়েছেন যে, তারা পারেন তো আজই দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান। তারা কথায় কথায় ‘এই দেশ আমার দেশ না’ টাইপের বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে কার্যত জাতির এই দুর্যোগকালীন মুহূর্তে নিজেদের দায়বদ্ধতাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছেন। যেন এই অবস্থা সৃষ্টির পেছনে তাদের কোনো দায় নেই, এখান থেকে জাতির মুক্তি নিশ্চিত করার চেষ্টা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তাদের মধ্যে কেউ সম্পূর্ণ দোষ চাপাচ্ছে সরকারের উপর, কেউ জঙ্গিদের উপর, কেউবা খোদ ধর্মের উপরেই। অতঃপর এমন একটা ভাবাবেগ সৃষ্টি করছেন যে, বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে তারা বড্ড ভুল করে ফেলেছেন, এখানকার নাগরিকত্ব বড়ই লজ্জার। এই দেশ তাদের দেশ নয়। এখানে ফ্রি-থিংকিং বাধাগ্রস্ত। বিজ্ঞানবাদিতা বাধাগ্রস্ত। গোঁয়ার বাঙালি জাতি পশ্চিমা ধর্মহীনতা ও বিজ্ঞানবাদিতার মাহাত্ম বুঝল না। তাই তারা আশাহত। জাতির চিন্তা ছেড়ে তারা এখন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়েই চিন্তিত, শঙ্কিত।
যারা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন বলে হীনম্মন্যতায় ভুগছেন, এই দেশের আচার-প্রথা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ধ্যান-ধারণা ও ধর্মবিশ্বাস যাদের মনপুত নয়, তাদের আরও আগেই এ দেশ ছাড়ার কথা ছিল। তারা কোন স্বার্থে এতদিন এখানে পড়ে ছিলেন সেটাই চিন্তার বিষয়। একবার ভাবুন তো, আপনার পিতা-মাতা যতই ভয়ংকর রোগাক্রান্ত হোক, আপনি কখনই বলতে পারবেন কি যে, এই পিতা-মাতা আমার পিতা-মাতা নয়? প্রিয় মাতৃভূমি আজ ভয়ানক রোগাক্রান্ত। উপসর্গ দেখেই বোঝা যায় রোগের ভয়াবহতা কেমন হতে পারে। এ সময় আমাদের আরও বেশি সচেতনতা প্রয়োজন। মনে সাহস যোগানো প্রয়োজন। যে কেনো বিপর্যয় থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য আÍত্যাগ করা প্রয়োজন। বড় ধরনের কোরবানি করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ‘এই দেশ আমার দেশ না’- এই টাইপের বক্তব্যের মধ্যে তার চিহ্নমাত্রও নেই। আছে হতাশা-ভীরুতা, আছে আত্মসমর্পণের অলিখিত আবেদন। এ ধরনের বক্তব্য জাতিকে বিন্দুমাত্র লাভবান করবে না, বরং যে অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ হয়তো জাতির কল্যাণে এগিয়ে আসতো তারাও সাহস হারিয়ে ফেলবেন।
এই দেশ কি একদিনে এমন হয়েছে? কখনই না, একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এগোতে এগোতে আজ এই বিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে। আপনারাই দেশকে এখানে নিয়ে এসেছেন। বরাবরই জাতির প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করতে ভুল করেছেন। প্যারাসিটামল সেবন করে রোগের কিছু উপসর্গের চিকিৎসা করা সম্ভব, রোগ নির্মূল সম্ভব নয়। তার জন্য রোগকে সনাক্ত করতে হয়, রোগের মূল জায়গায় আঘাত করতে হয়। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-কালচার ও বিশ্বাসকে মূল্য না দিয়ে পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতিকে আমদানি করার নির্লজ্জ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন আপনারাই। একটি বারও ভেবে দেখেন নি যে, এটা পশ্চিম নয়, এখানকার মানুষ পশ্চিমা জীবনাচারের জন্য উপযুক্ত নয়। পশ্চিমারা আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তা রাতারাতি ঘটে নি, সেটা একটি দীর্ঘ সংগ্রাম, সংঘর্ষ ও রক্তপাতের ফল। তাও যদি সেই ফলাফল শান্তিদায়ক হতো তাহলে কথা ছিল না। অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নতিই মানবজীবনের সার্বিক উন্নতি নয়। মানুষের আত্মা আছে। মানবিক সত্ত্বাকে বিসর্জন দিয়ে পশ্চিমারা আজ যেভাবে দৈহিক ভোগ-বিলাসিতা ও শরীরিনির্ভর জীবনাচারে মত্ত হয়েছে তা দেখে শুনেও তাদেরকে অনুসরণ করার কোনো অর্থ থাকতে পারে না। কিন্তু আপনারা সেটা বোঝেন নি। আপনারা এই জাতিকে গণতন্ত্র গিলিয়েছেন, ধর্মনিরপেক্ষতা গিলিয়েছেন, কিন্তু এ দেশের মানুষ সেগুলো আদৌ হজম করতে পারল কি পারল না তার খোঁজ রাখেন নি। আজ আবার চেষ্টা করছেন বদহজমের শিকার এই জাতির পেটে বিজ্ঞানবাদিতার নামে নাস্তিকতা, সমকামিতা ও লিভ টুগেদারের মতো ভয়ংকর বিষ ঢুকিয়ে দিতে। কীভাবে ভাবলেন যে, এত কিছুর পরও কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে না? সেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখে ‘এই দেশ আমার না’ বলেন কোন যুক্তিতে?
আমাদের দেশের বিজ্ঞানবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতার কর্ণধার বলে যারা সদা পরিচিত, সেই ব্লগারদের মধ্যে অনেকেই ইউরোপের ভিসা পেয়ে দেশ ছেড়েছেন। শোনা গেছে এতে তাদের কোনো দুঃখ নেই, বরং এক প্রকার উচ্ছ্বাস আছে। তারা নাকি নিরাপদ জীবন ও সভ্যতার সংস্পর্ষ পেয়েছেন। দেশে থাকতে তাদের কপালে যে চিন্তার ভাজ পড়েছিল তা এখন নেই। কেন থাকবে? তাদের চিন্তা তো দেশকে নিয়ে ছিল না, ছিল নিজেকে নিয়ে। এই দেশ কি তাদের দেশ?
যতদূর জানা যায় অন্যরাও দেশ ছাড়ার অপেক্ষায় আছে। জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের কারণেই হোক বা অবদমিত কোনো লালসা চরিতার্থ করতেই হোক তারাও কথিত অসভ্য-বর্বরদের এই দেশ ছেড়ে সভ্য দেশে যেতে চায়। তাই এখন প্রশ্ন উঠছে, ইউরোপের অ্যাসাইলাম পাওয়াই তাদের লেখালেখির মূল উদ্দেশ্য ছিল কিনা? তাদের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলে এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে তবে আপাতত সে প্রশ্ন আমি করছি না। ধরে নিলাম তারা মানুষের কল্যাণে, এই জাতির কল্যাণে, এই পশ্চাদপদ দেশকে ধর্মীয় অন্ধত্ব ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে প্রগতিশীল ও উন্নত দেশ গঠনের লক্ষ্যেই আদর্শিক আন্দোলন করছিলেন, লেখালেখি করছিলেন, মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব কাঁধে তুলেছিলেন। তাদের সেই আদর্শ কতটুকু নির্ভূল ছিল সে প্রশ্নও এখন থাক, মূল কথা- একটা প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসের বিপক্ষে সম্পূর্ণ বিপরীত আরেকটি আদর্শ নিয়ে তারা দাঁড়িয়েছিলেন।
প্রশ্ন হলো তারা কি এ পথকে পুষ্পসজ্জিত জ্ঞান করেছিলেন? এই দেশের মানুষের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা, আবেগ-অনুভূতি তাদের জানা ছিল না? তারা জানতেন না যে, একদিন না একদিন এই সংঘর্ষ বাঁধবেই? তারা দাঁড়িয়েছেন ধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মহীনতা নিয়ে, বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদ বা বিজ্ঞানবাদ নিয়ে, আধ্যাত্মিকতার বিরুদ্ধে বস্তুবাদ নিয়ে, ঐতিহ্য-পরম্পরার বিরুদ্ধে প্রথাবিরোধিতা নিয়ে, এক কথায় মৌমাছির মৌচাকে ঢিল ছোঁড়ার মতো সমাজের মূল মূল উপাদানে তারা আঘাত করেছেন, অথচ ভেবেই নিয়েছেন যে, তার প্রতিঘাত তাদের সহ্য করতে হবে না। তারা কি এতটাই অর্বাচীন যে, বিজ্ঞানের উপর দু-একটা বই লিখে কিংবা ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মীয় মাহামানবদের গালাগালি করে কয়েকটা ব্লগপোস্ট করেই ধরে নিলেন সমাজে বিপ্লব হয়ে যাবে? এই নবীন ‘কিবোর্ড বিপ্লবী’রা না হয় ইউটোপিয়ায় বিচরণ করছিলেন বলে পরিণতি টের পান নি, কিন্তু যে প্রবীণরা তাদেরকে পৃষ্ঠাপোষকতা দান করলেন তারা কী ভক্ষণ করে ছিলেন?
ব্যক্তিগতভাবে আপনি নাস্তিক হতেই পারেন, কিন্তু আপনার অবিশ্বাসকে সমগ্র সমাজের উপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। ওই প্রচেষ্টা কম হয় নি, কিন্তু শেষাবধি ফলাফল কী হয়েছে? জঙ্গিবাদের উত্থান হলো, ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে মানুষের ধর্মবিশ্বাসের অপব্যবহার করার ‘হাতিয়ার’ এলো, সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি হলো। নিরাপত্তার অভাবে উল্টো এখন আপনারাই দেশ ছাড়ছেন। অর্থাৎ যা হলো তাকে ‘হিতে বিপরীত’ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। আপনাদের মেধা আছে, মননশীলতা আছে, আমরা মনে করি জাতির কল্যাণে আত্মত্যাগ করার সদিচ্ছাও আপনাদের আছে, কিন্তু সেই সদিচ্ছার অপব্যবহার হচ্ছে বলে তা জাতির কোনো কল্যাণ বয়ে আনছে না।
যারা প্রকৃতপক্ষেই মুক্তমনা ও বিজ্ঞানমনস্ক তাদেরকে বুঝতে হবে যে, ধর্ম বা ধর্মবিশ্বাস তাদের প্রতিদ্বন্দ্বি নয়। যুগে যুগে ধর্ম কীভাবে বড় বড় সভ্যতার জন্ম দিয়েছে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের সাধনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প সাধনায় বাধা এসেছে মূলত ধর্মান্ধ ও ধর্মব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে। জ্ঞান-বিজ্ঞান মানুষের অন্তর্দৃষ্টি খুলে দেয়, সমাজকে আলোকিত করে, অন্যদিকে ধর্মব্যবসায়ীরা সমাজকে অন্ধকারে রেখে নিজেদের আখের গোছাতে চায়। এখানেই ধর্মান্ধতা ও ধর্মব্যবসার সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞানের লাগালাগি। এই লাগালাগি অতীতেও ছিল আজও আছে। আমাদেরকে লড়াই করতে হবে তাই ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে। মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে সঠিক পথে প্রবাহিত করে তাদেরকে ধর্মব্যবসায়ীদের পেছন থেকে সরাতে পারলেই বিজ্ঞানের জয় হবে, সমাজ আলোকিত হবে।
যে কারণেই হোক, যার কৃতকর্মের পরিণতিতেই হোক, আজ আমাদের দেশ এক ভয়াবহ মৃত্যুখাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন দেশে যা চলছে তা কারও ব্যক্তিগত বা দলীয় সঙ্কট নয়। জাতীয় সঙ্কট। এই জাতীয় সঙ্কট নিরসনে সমগ্র জাতিকেই ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা হেযবুত তওহীদ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। সকল প্রকার ধর্মব্যবসা, অপরাজনীতি ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যের আহ্বান এ দেশের মানুষের মধ্যে প্রভূত সাড়া ফেলেছে। সকল ধর্ম-বর্ণ-দল-মতের মানুষ আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। আমরা আশা করব যারা প্রকৃতপক্ষেই বিজ্ঞান ও প্রগতিকে উদ্ভাসিত করার লক্ষ্যে কাজ করছেন, যারা প্রকৃতপক্ষেই বিজ্ঞানমনস্ক মুক্তমনা আসন্ন সঙ্কট মোকাবেলায় তারাও আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবেন। ধর্মভীরু মানুষকে ধর্মান্ধতার ঘোর কাটিয়ে প্রকৃত ধার্মিক হতে হবে, ধর্মব্যবসার উৎখাত করতে হবে। ইনশা’আল্লাহ ধর্মব্যবসা, অপরাজনীতি, জঙ্গিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের পরাজয় হবে, জাতি সত্যিকার অর্থেই উন্নতি ও প্রগতির মার্গ লাভ করবে। ধর্ম, মানবতা, বিজ্ঞান ও প্রগতির সম্মিলিত শক্তি দিয়ে নির্মিত হবে ঐক্যবদ্ধ সোনার বাংলাদেশ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।

ফোনে টিপস্ শুনে বোনের ডেলিভারি করাল কিশোরী

ফোনে টিপস্ শুনে বোনের ডেলিভারি করাল কিশোরী





ইনস্ট্রাকশন আসছিল টেলিফোনে। তাই শুনেই ঠাণ্ডা মাথায় নিজে হাতে নিজের ছোট্ট বোনের ডেলিভারি করাল ১১ বছরের মেয়েটি। সযত্নে সদ্যোজাতের নাড়ি কেটে তুলে দিল মায়ের কোলে। জীবনে এমন একটা অভিজ্ঞতা কিশোরীটিকে এমনই অনুপ্রাণিত করেছে যে, বড় হয়ে সে ধাই মা হতে চায়। রোজকার মতো স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল ব্রিটেনের ডর্ডনের বাসিন্দা ১১ বছরের কেটলিন ব্রুক। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে বড়। অন্তঃসত্ত্বা মায়ের একেবারে অ্যাডভান্সড স্টেজ। বাবা ড্যানিয়েল ভোর পাঁচটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দশ মিনিটের মধ্যে হঠাত্‍‌ই লেবার পেন শুরু হয় কেটলিনের মা তারা নাইটেলের। তাঁর পরামর্শে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে পাঠায় কেটলিন। কিন্তু, জল ভাঙতে শুরু করেছে দেখে, পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে তারা বুঝতে পারে, এতটা সময় পাওয়া যাবে না।
কেটলিনকে সেটা বুঝিয়ে বলার পর এতটুকু বিচলিত হয়নি ছোট্ট কিশোরী। সে অ্যাম্বুলেন্স কর্মীকে ফোন করে জানায়, যা করার এখনই করতে হবে। ডেলিভারি করার পদ্ধতি পরপর জানাতে বলে কেটলিন। ফোনের ইনস্ট্রাকশন অনুযায়ী সে ঠাণ্ডা মাথায় পুরো দস্তুর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ডাক্তার বা ধাই মায়েদের মতো প্রসব করানোর কাজ চালিয়ে যায়। কেটলিনের হাত ধরে জন্ম নেয় তার ছোট্ট বোন এলসা। নিখুঁতভাবে তার নাড়ি কেটে বোনকে মায়ের কোলে তুলে দেয় কেটলিন। রোমহর্ষক সেই মুহূর্তটা যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না তারা। চোখের জলে তিনি জড়িয়ে ধরেন দুই কন্যাকে। গোটা কর্মকাণ্ডের পর মা ও বোন নিরাপদ আছে দেখে, স্কুলে চলে যায় উচ্ছ্বসিত কেটলিন। সে যে কতবড় একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে, তা বুঝতেই পারছিল না ছোট্ট মেয়েটি।
বরং নিস্পাপ কেটলিন তখন বলছে, প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কারণ আমি জীবনে কখনও এরকম কিছু করিনি। কিন্তু, বোনটাকে যখন জন্মাতে দেখলাম তখন দারুণ লেগেছে। ও খুব সুন্দর। এই অভিজ্ঞতাটাও আমার কাছে দারুণ আনন্দের। আমি বড় হয়ে ধাই মা-ই হতে চাই। কেটলিনের জন্য গর্বিত তাঁর মা তারাও। তিনি বলেছেন, ‘আমি যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছিলাম, কেউ নেই দেখে ভয়ও পেয়ে গিয়েছিলাম। কেটলিন কিন্তু আগাগোড়া শান্ত ছিল। ওকে যা বলা হচ্ছিল, তাই ও করে যাচ্ছিল। যখন দেখলাম এলসার মাথাটা দেখা যাচ্ছে, তখন আর ভয় পাইনি। কারণ তখন আমার মনে হয়েছিল, আমাকে কেটলিন দেখছে। ভয় পেলে চলবে না। ও সত্যিই খুব সাহসী।

শীতের ব্যায়াম ও খাবার

শীতের ব্যায়াম ও খাবার






হালকা কুয়াশার সাথে ঠাণ্ডা হওয়া-শীত আসি আসি করছে। শীতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে আপনার শরীরে। শীত যত বাড়বে ততই আপনার মধ্যে গুটিয়ে যাওয়ার অনুভূতি কাজ করবে। ঘরের বাইরে বেরুনো ও কাজ করার প্রতি অনীহা সৃষ্টি হবে, তৈরি হবে অলসতা।
তাই শীতেও নিজেকে চাঙ্গা রাখতে প্রয়োজন ব্যায়াম। হালকা ব্যায়াম করতে চাইলে ঘরে কিংবা বাসার ছাদে দৌড়াদৌড়িসহ ব্যায়াম করতে পারেন। এ ছাড়া পার্কে, খেলার মাঠে কিংবা ব্যায়ামাগারেও ব্যায়াম করতে পারেন। ব্যায়ামের ধরন অনুযায়ী আপনার খাবার, পোশাক নির্ধারণ করতে হবে।
খাবার : শরীর চাঙ্গা রাখার পাশাপাশি ব্যায়ামের আরও দুটি দিক রয়েছে। কেউ কেউ শরীরের মেদ ঝরাতে ব্যায়াম করেন, কেউ আবার স্বাস্থ্য আরও সুঠাম করতে ব্যায়াম করেন। সে হিসেবে খাদ্যাভাসও ভিন্ন হবে, তবে কোনো অবস্থাতেই খালি পেটে ব্যায়াম করা যাবে না। আর শীতকালে প্রচুর সবজি পাওয়া যায়, আর এ সবজি ব্যায়ামের কারণে আপনার শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া ক্যালরি ফেরাবে। এ ছাড়া চিনির শরবত ও প্রচুর পানি পান করতে হবে।
যারা ব্যায়াম করে মেদ ঝরাতে চান তারা সকালে হালকা ফল ও শুকনো জাতীয় খাবার খেয়ে নিবেন। ব্যায়াম শেষেও একই ধরনের খাবার নিতে পারেন, সাথে লেবুর শরবত খেতে পারেন। আর রাত ও দুপুরে ভাতের পাশাপাশি মাছ ও সবজি জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে পারেন। তবে ভাতের তুলনায় রুটি বেশি খেলে উপকার পেতে পারেন।
তবে যারা স্বাস্থ্য আরও সুগঠিত করতে চান তাদের খাবারের প্রতি জোর দিতে হবে বেশি। সকালে ব্যায়াম করার আগে রুটি-কলা ও পরে ডিম, দুধ, মুরগির মাংস খেতে পারেন। দুপুরে ও রাতেও সবজি, মুরগি, ডিম, দুধ খাবারের তালিকায় রাখতে পারেন।
পোশাক : ব্যায়ামের সময় সুতি কাপড় গায়ে দেওয়াই আরামদায়ক। যেহেতু শীত তাই ফুলহাতা টি-শার্ট পরে নিবেন। আর ট্রাউজার,কেডস তো থাকবেই। এ ছাড়া অলিভ অয়েল মেখে নিবেন শরীরে। সাথে পানির বোতল, তোয়ালে রাখবেন। ব্যায়াম শেষে শরীরের ঘাম শুকিয়ে নিলে গোসল করে নিবেন।

জান্নাতি ফেরকা মৃত জাতির আশার আলো

জান্নাতি ফেরকা মৃত জাতির আশার আলো


মোহাম্মদ আসাদ আলী:
বর্তমানে মুসলিম নামক এই জনসংখ্যাটির ব্যক্তিগত জীবনের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার ইলাহ (হুকুমদাতা) হলেন আল্লাহ, আর জাতীয়, রাষ্ট্রীয় জীবনের ইলাহ হলো দাজ্জাল তথা ইহুদি খ্রিষ্টান ‘সভ্যতা’। সমস্ত পৃথিবীর অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির মতো এই মুসলিম নামধারী জাতিটিও আজ এই প্রতারক ‘সভ্যতা’র গোলামে পরিণত হয়েছে, অর্থাৎ দাজ্জালকে প্রভু (রব) বলে মেনে নিয়েছে। দাজ্জালের ধর্মনিরপেক্ষ নীতিকে গ্রহণ করে এই জাতি আজ জাতীয় জীবন থেকে ইসলামকে প্রত্যাখ্যান করে কার্যত কাফের মোশরেকে পরিণত হয়েছে। তাই সমস্ত জাতির উপর দিয়ে বয়ে চলেছে আল্লাহ এবং তাঁর মালায়েকের অভিশাপের ঝড়। এই জাতি পৃথিবীর যেখানেই আছে সেই দেশের মানুষ দিয়ে অত্যাচারিত হচ্ছে, অপমানিত হচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে।
তবে আশার কথা হলো এই কালো অধ্যায়ের পরিসমাপ্তিও সন্নিকটে। কারণ অধঃপতিত মুসলিম নামধারী এই জাতি অচিরেই জেগে উঠবে এনশা’আল্লাহ। তারা তাদের হারিয়ে যাওয়া আকিদা ফিরে পাবে। শত্রুর অন্তরে ত্রাস সৃষ্টিকারী এবং নিজেদের মধ্যে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ চরিত্র তারা আবারো ফিরে পাবে। এর কয়েকটি যৌক্তিক এবং অকাট্ট কারণ রয়েছে।
প্রথম কারণ: রসুলাল্লাহর উপাধি ‘রহমাতাল্লিল আলামিন’
আল্লাহ তাঁর রসুলকে কোর’আনে রহমাতাল্লিল আলামিন বলেছেন। ‘রহমাতাল্লিল আলামিন’ শব্দের অর্থ হলো (পৃথিবীর) জাতি সমূহের উপর (আল্লাহর) রহমত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আজ পৃথিবীর দিকে চেয়ে দেখুন। কোথায় সে রহমত? পৃথিবীর সর্বত্র অশান্তি, হাহাকার, অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত, বুক ভাঙা দুঃখ। মানুষের ইতিহাসে বোধহয় একত্রে একই সঙ্গে দুনিয়ার এত অশ্রু, এত অশান্তি কখনো ঘটেনি। ইতিহাসে ত্রিশ বছরের মধ্যে দুইটি বিশ্বযুদ্ধ করে ষোল কোটি মানুষ এবং তারপর থেকে এখন পর্যন্ত পাঁচ কোটি মানুষ এত কম সময়ের মধ্যে কখনই হতাহত হয় নি। এত অন্যায়ও মানুষের ইতিহাসে আর কখনো হয়েছে কিনা সন্দেহ। তার চেয়েও বড় কথা, মানব জাতি আণবিক যুদ্ধ করে আজ ধ্বংসের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থা আজকের, বর্তমানের। রসুলাল্লাহর (সা.) পৃথিবীতে আসার চৌদ্দশ’ বছর পর। তাহলে তিনি কেমন করে পৃথিবীর মানুষের জন্য রহমত? এর জবাব হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তাকে (সা.) যে জীবনব্যবস্থা, দীন দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন সেই দীন মানব জাতির উপর সমষ্টিগতভাবে প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠা করলে যে শান্তি, সুবিচার, নিরাপত্তা মানুষের জীবনে নেমে আসবে সেটা হলো আল্লাহর রহমত, তার দয়া। কারণ তিনি ঐ জীবনব্যবস্থা না দিলে মানুষ কখনই তা নিজেরা তৈরি করে নিতে পারতো না, যদি করত তবে তা সীমাহীন অশান্তি আর রক্তপাত ডেকে আনতো, যেমন আজ করছে। সেই জীবনব্যবস্থা, দীন, সংবিধান তিনি যার মাধ্যমে মানুষকে দিলেন তাকে তিনি উপাধি দিলেন ‘রহমাতাল্লিল আলামিন’। কিন্তু যতদিন না সমগ্র মানব জাতি নিজেদের তৈরি জীবনব্যবস্থা সমূহ পরিত্যাগ করে মোহাম্মদের (সা.) মাধ্যমে প্রেরিত আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রয়োগ করবে ততদিন তারা সেই অশান্তি, অন্যায় (ফাসাদ) ও যুদ্ধ, রক্তপাতের (সাফাকুদ্দিমা) মধ্যে ডুবে থাকবে, আজকের মতো এবং ততদিন বিশ্বনবীর (সা.) ঐ উপাধি অর্থবহ হবে না, অর্থপূর্ণ হবে না এবং আজও হয় নি। তার উম্মাহ ব্যর্থ হয়েছে তার (সা.) উপাধিকে পরিপূর্ণ অর্থবহ করতে। তবে এনশা’আল্লাহ সেটা হবে, সময় সামনে। স্রষ্টার দেওয়া উপাধি ব্যর্থ হতে পারে না, অসম্ভব। সুতরাং আজ হোক আর কাল হোক সমস্ত মানবজাতি তাঁকে আল্লাহর রসুল হিসাবে মেনে নেবে। এবং তাঁর মাধ্যমে পাঠানো দীনুল হক কে তাদের সমষ্টিগত জীবনে কার্যকর করবে।
দ্বিতীয় কারণ: আসছে নবুয়্যতের আদলে খেলাফত
আল্লাহর রসুল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, “আল্লাহ যতদিন চান ততদিন তোমাদের মাঝে নবুয়্যত থাকবে (অর্থাৎ তিনি নিজেই), তারপর আল্লাহ তা উঠিয়ে নেবেন। তারপর আসবে নবুওয়াতের পদ্ধতিতে খেলাফত। যতদিন আল্লাহ চান ততদিন তা থাকবে তারপর আল্লাহ তা উঠিয়ে নেবেন। তারপর আসবে মুলকান (রাজতন্ত্র), যতদিন আল্লাহ চান ততদিন তা থাকবে অতঃপর আল্লাহ তা উঠিয়ে নেবেন। তারপর আসবে জাবারিয়াত (শক্তি প্রয়োগ, জোর-জবরদস্তিমূলক শাসন)। এরপর আবারো আসবে নবুয়াতের পদ্ধতিতে খেলাফত।” (দালায়েলুম নবুয়াত, বায়হাকী, মুসনাদ-আহমদ বিন হাম্বল, মেশকাত)
রসুলাল্লাহর এই ভবিষ্যদ্বাণীটি এখন অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রথম তিনটি ইতোমধ্যেই বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। বর্তমানে চলছে জাবারিয়াত অর্থাৎ দাজ্জালের জোর-জবরদস্তিমূলক শাসন (Might is right)। এর পরেই সামনে আসছে নবুয়াতের পদ্ধতিতে খেলাফত। আল্লাহর রসুলের এই কথা থেকেই বোঝা যায় যে, আখেরী যুগে, অর্থাৎ অদূর ভবিষ্যতে এই জাতি আবারো জাগবে। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন এসে যায় যে, কাদের দ্বারা জাগবে? কারা এই ঘুমন্ত জাতির কালঘুম ভাঙ্গাবে?
আল্লাহর রসুল বলেছেন, “আমার উম্মাহর মাঝে সকল সময়ই একদল লোক থাকবে যারা, সর্বাবস্থায় আল্লাহর আদেশ নিষেধ বলবৎ করবে।” এই ফেরকা সম্পর্কেই আল্লাহর রসুল বলেছেন তেহাত্তর ফেরকার মাঝে একমাত্র জান্নাতি ফেরকা। এই জান্নাতি ফেরকাকেই এখন মাঠে নামতে হবে। জাতির কালঘুম ভাঙ্গানোর জন্য তাদের চেতনায় যতবড় আঘাত করার দরকার তাই করতে হবে। এই জান্নাতি ফেরকার কোন মানুষকে যদি বাকি বাহাত্তর ফেরকার কেউ প্রশ্ন করে যে, আপনি শিয়া না সুন্নি, না আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত, না আহলে হাদিস, হানাফি না শাফেয়ী, মালেকী না হাম্বলী না অন্য কিছু? তবে তার জবাব হবে ভাই, আমি ওসবের কোনটাই নই। আমি তো শুধু প্রাণপণে চেষ্টা করছি মো’মেন ও উম্মতে মোহাম্মাদী হতে।
জান্নাতি ফেরকার অন্যতম কর্তব্য হবে মুসলিম নামধারী জাতিটিকে প্রশ্ন করা যে, সর্বদা আল্লাহর রসুলের সঙ্গে থেকে, তাঁর সাথে প্রতিটি সংগ্রামে সঙ্গী হয়ে সরাসরি তার কাছে থেকে যারা ইসলাম কি, তা শিখেছিলেন তারাই ঠিক ইসলাম শিখেছিলেন, নাকি আজকের মাওলানারা, মৌলবীরা, পীর মাশায়েখরা যে ইসলাম শেখাচ্ছেন সেটা ঠিক? রসুল (সা.) বর্ণিত জান্নাতি ফেরকার কর্তব্য হবে এই জাতিকে বুঝিয়ে দেওয়া যে, বাহ্যিক দৃষ্টিতে যা দেখা যায় তা আসলে যথেষ্ট নয়। আসল বিষয় হলো চরিত্র এবং আকিদা। একজন পবিত্র চরিত্রের উচ্চ স্তরের মানুষ আর একজন জঘন্য চরিত্রের খুনি অপরাধের মানুষের বাহ্যিক দৃশ্য, চেহারা প্রায় একই রকম হতে পারে। দুজনেরই হাত, পা, মাথা, মুখ সবই আছে। এমনকি ঐ দুশ্চরিত্র খুনীর বাহ্যিক চেহারা ঐ সচ্চরিত্র মানুষের চেহারার চেয়েও সুন্দর হতে পারে। শুধু ভেতরের চরিত্রের জন্যই একজন জান্নাতি আর একজন জাহান্নামী। এমনকি পৃথিবীর বিচারেও একজন সম্মানিত, অন্যজন জেল ফাঁসির উপযুক্ত। বর্তমানে আমরা ইসলাম মনে করে যে দীনটাকে আঁকড়ে আছি এটার বাইরের চেহারা মোটামুটি আল্লাহর রসুলের মাধ্যমে আসা দীনের মতই মনে হয়। বাইরে থেকে যেগুলো দেখা যায় যেমন যেকের, আসকার, নামাজ, রোজা, হজ্ব, দাড়ি, টুপি, কাপড়-চোপড় ইত্যাদি নানাবিধ কার্যকলাপ; কিন্তু ভেতরের চরিত্র নবীজীর ইসলামের একেবারে বিপরীত, সরাসরি বিপরীত। এছাড়াও জান্নাতি ফেরকার অন্যতম কাজ হবে এই জাতির ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন বাহাত্তর ফেরকাকে ডেকে বলা যে, আপনারা যত ফেরকা, মাজহাবে বিভক্ত হয়ে থাকুন আপনারা এক আল্লাহয়, এক নবীতে এবং এক কোর’আনে বিশ্বাসী তো? তাহলে জাতির এই দুঃসময়ে, যখন ঐক্য এতো প্রয়োজনীয়, এখন শুধু এর উপর সবাই একত্র হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। মাজহাবের ফেরকার যে অনৈক্য আছে তা যদি বিলুপ্ত করতে না পারেন, তবে ঐক্যের খাতিরে তা ব্যক্তিগত পর্যায়ে রেখে দিন। বাইরে আনবেন না। শিয়া শিয়াই থাকুন। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, এমনকি সামাজিক ক্ষেত্রে আপনারা আপনাদের মাজহাব মেনে চলুন, যত ইচ্ছা মাতম করুন, কিন্তু জাতীয় ক্ষেত্রে, জাতীয় ঐক্যের খাতিরে সুন্নিদের পাশে এসে দাঁড়ান। সুন্নি সুন্নিই থাকুন ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক ব্যাপারে, কিন্তু জাতীয়ভাবে শিয়ার পাশে এসে দাঁড়ান। এমনভাবে হানাফি, শাফেয়ী, হাম্বলী, মালেকী ইত্যাদি যত রকমের দুর্ভাগ্যজনক জাতি ধ্বংসকারী বিভক্তি আছে সব ব্যক্তিগত পর্যায়ে রেখে দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে এক আল্লাহর, এক নবীতে বিশ্বাসী হিসাবে, এক জাতি হিসাবে এক মঞ্চে এসে দাঁড়ান ও আল্লাহর রাস্তায় অর্থাৎ মানুষের কল্যাণে সংগ্রাম করুন। শিয়া-সুন্নী উভয়কে বলতে চাই, বর্তমানে আপনারা এই যে পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, বাহরাইন, ইয়েমেন, সৌদিআরবসহ প্রায় সমগ্র মুসলিম বিশ্ব জুড়ে দাঙ্গা চালাচ্ছেন, একে অপরকে গুলি করে হত্যা করছেন; আপনাদের মধ্যে কারা জান্নাতে যাবেন বলুন দেখি? আসলে মহানবীর ভাষ্যমতে কেউই জান্নাতি না। কাজেই আর না, এবার দয়া করে থামুন, যথেষ্ট হয়েছে। এক আল্লাহই, এক রসুলে এবং এক কোর’আনে বিশ্বাসী এই জাতি যদি জান্নাতি ফেরকার এই ডাকে সাড়া না দেয় তাহলে জান্নাতি ফেরকার কিছুই করার নেই। তারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কাছে সাফ থাকবেন। তবে ডাকের মতো ডাক দিতে হবে। যেমন করে নবী রসুলরা চিরকাল ডাক দিয়ে এসেছেন। তাঁদের প্রচণ্ড বিরোধিতা করা হয়েছে, অপমান করা হয়েছে, নিপীড়ন করা হয়েছে। কিন্তু তাদের ডাক বন্ধ করা যায় নি। শত অত্যাচার সহস্র বিরোধিতা তাদের নিবৃত্ত করতে পারে নি। এই ফেরকার নিরাশ হবার কোন কারণ নেই। এই ফেরকা জান্নাতি কেন? রসুলাল্লাহর প্রকৃত সুন্নাহ পালনকারী বলেই তো। তাহলে তিনি কত অত্যাচার, কত বিরোধিতা, কত অপমান ও নিগ্রহ সহ্য করেছেন সে সুন্নাহ তো, সে উদাহরণ তো, তাদের সামনেই আছে। তবে ভয় কিসের? জান্নাতি ফেরকা তো আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না।

মহাভারতের কথা: ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী???

মহাভারতের কথা: ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী???


রাকীব আল হাসান:
—————–
আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে শুধু মুসলিমই নয় বিরাট একটা জনসংখ্যা সনাতন ধর্মের অনুসারীও রয়েছেন। কাজেই এখানে তাদের উদ্দেশ্যে সনাতন ধর্মগ্রন্থ মহাভারত থেকে ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী, বলিদান বা কোরবানির মাহাত্ম কী, মানুষের প্রকৃত ধর্ম কী হওয়া উচিত ইত্যাদি প্রসঙ্গে অবতার শ্রীকৃষ্ণের (অনেকেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন) অমীয় বাণী থেকে কিছু কথা সহজবোধ্যভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরিণতি কী হবে সেটা জানতে চাইলে মহারানী দ্রৌপদীকে অবতার শ্রীকৃষ্ণ বলেন, যুদ্ধ তো সর্বদাই বিনাশ আনে, রণভূমিতে পীড়া আর দুঃখই জন্ম নেয়। তুমি কেমন করে ভেবে নিলে যে, তোমার জন্য সুখ থাকবে সেখানে? হ্যাঁ তোমার পঞ্চ স্বামী ব্যতীত মহারাজ শান্তনুর বংশের সমগ্র প্রদীপ নিভে যাবে, সমগ্র বংশের নাশ হয়ে যাবে এই যুদ্ধে। তখন মহারানী দ্রৌপদী জিজ্ঞাসা করেন, মহারাজ শান্তনুর সমগ্র বংশের নাশ হয়ে যাবে? আমাদের সন্তানেরা সংঘর্ষের সময় যাদের স্মরণ করে আমরা শক্তি পেয়েছি, যাদের জন্ম আমাদের নতুন রূপে জন্ম দিয়েছিল, তাদের মৃত্যু হয়ে যাবে? অর্থাৎ প্রতিদিন অদম্য উৎসাহে যে যুদ্ধের জন্য আমরা প্রস্তুত হচ্ছি, সেকি নিজেদের সন্তানের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছি? তখন তার উত্তরে অবতার শ্রীকৃষ্ণ বলেন, মানুষ জীবনের প্রত্যেক ক্ষণে মৃত্যুর দিকেই পা বাড়ায়। বাস্তবে সে যা করে তাকি মৃত্যুর জন্যই করে না? বসন্তে বিকশিত প্রত্যেক পত্র কি হেমন্তে ঝরে যাওয়ার জন্যই বিকশিত হয় না? তাহলে তার বিকাশ লাভ, সূর্যকিরণ পান করা আর বায়ুতে আন্দোলিত হয়ে মধুর ধ্বনি উৎপন্ন করা- সবই কি ব্যর্থ? ঘুর্ণিঝড় যখন বৃক্ষকে আন্দোলিত করে তখন সেই বৃক্ষের প্রত্যেক পাতা সমস্ত শক্তি লাগিয়ে সেই বৃক্ষের সাথে লেগে থাকার প্রয়াস করে। আর যখন পিত বর্ণ ধারণ করে তখন শুকিয়ে ঝরে যায়। সৃষ্টিও এক বিশাল বৃক্ষ, আর প্রত্যেক মানুষ, প্রত্যেক পশু-পক্ষী এই বৃক্ষের উদ্গোমিত ও মোচনপ্রাপ্ত পত্র স্বরূপ। পত্র মোচন অনিবার্য। কিন্তু যতক্ষণ সে বৃক্ষে লেগে থাকে ততক্ষণ সংঘর্ষ ও শান্তি দুইয়ের আনন্দ নেওয়া আবশ্যক। (মহারানী দ্রৌপদী- আমি কোনো আনন্দ দেখতে পাচ্ছি না গোবিন্দ) কারণ তুমি মোহজালে আবদ্ধ। (মহারানী দ্রৌপদী- হ্যাঁ, আমি মোহজালে আবদ্ধ। এই যুদ্ধে আমাদের যদি বিজয় প্রাপ্তিও হয় তবুও আমার তো কোনো সুখ প্রাপ্তি হবে না।) সুখের জন্য যুদ্ধ করার কথা কখন বলেছি আমি? সম্মান প্রাপ্তি, প্রতিশোধ এসবের জন্য যুদ্ধ করার পরামর্শ কবে দিয়েছি আমি? এ যুদ্ধ তো সমাজের সুখের জন্য করতে হবে। অধর্মের নাশ করার জন্য আর ধর্মের স্থাপনা করার জন্য আমাদের এ যুদ্ধ করতেই হবে। (মহারানী দ্রৌপদী- এত বড় বলিদান আমাকেই কেন দিতে হবে গবিন্দ।) শোন শখি, মনুষ্য সমাজ কর্তৃক প্রস্তুত নীতি, আদর্শ ও ধর্ম এ তিন সমুদ্র তটে নির্মিত বালুকণার ভবনের ন্যায়। সময়ের ঝাপটাই নিরন্তর ভাঙতে থাকে, এর নিরন্তর নির্মাণ করতে হয়, অন্যথা নীতি, আদর্শ ও ধর্ম এ সমস্তই নাশ হয়ে যায়। কিছু মানুষকে ঈশ্বর এই শক্তি দেন যে ধর্মের পুনস্থাপনা করতে পারে। আর যার কাছে সে শক্তি থাকে সে নিজের সমস্ত বলিদান দিয়েও ধর্মের জন্য সংঘর্ষ করতে থাকে। সে ভগবান রামচন্দ্রই হোন আর ভগবান পরশুরামই হোন অথবা বিষ্ণুর বামন অবতার- ধর্মের পুনঃস্থাপন করার জন্য সংঘর্ষকারীরই পূজা করে এই সংসার। একটা কথা জেনে রাখ শখি। ধর্মের জন্য সংঘর্ষ করা কারো কর্তব্য নয়, এ এক সিদ্ধান্ত, এক সংকল্প মাত্র। তোমার জন্যও যুদ্ধ কোনো কর্তব্য নয়। সমাজের কারণে কৃত এক সংকল্প মাত্র। তুমি যখন ইচ্ছে এ সংকল্প পরিত্যাগ করতে পার। কদাপি তুমি পতি, পুত্র, পৌত্র, আদির সুখ পেয়েই যাবে। কিন্তু কটি কটি মানুষের ন্যায় সময়ের প্রবাহে তলিয়ে যাবে, তোমার জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে। তোমার কারণে কারোর কোনো লাভ প্রাপ্তি হবে না। ঈশ্বর তোমাকে যে বিশেষ শক্তি দান করেছেন সেই ঈশ্বরের বিশ্বাস ভঙ্গ হবে। সিদ্ধান্ত তুমি নাও সখি।
সংসারে যখন দুঃখ বৃদ্ধি পায়, সংসারে স্বল্প মানুষ সুখ অনুভব করে আর অধিকতর মানুষ দুঃখ অনুভব করে তখন সংসার রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এরূপ সময় সেই রোগের নিরাময় করতেই হয়। নিজে নিজেকে বলিদান দিয়েও অধর্মের বিনাশ করা অনিবার্য হয়ে পড়ে। এরূপ সময় না সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ আর না প্রেম গুরুত্বপূর্ণ। না তো স্বার্থ দেখতে হয় আর না সুখের আশা করতে হয়। এইরূপই সময় এখন আপনাদের সবার সামনে। সিদ্ধান্ত আপনাদের সবার। ফলের স্বাদ বৃক্ষের প্রাপ্তি হয় না, কদাচিৎ সেইরূপে এই বলিদান থেকে আপনাদের লাভ নাও হতে পারে। নিজের হৃদয়ে উকি দাও, এতটা করুণা কি রয়েছে ওখানে, এতটাই কি ধর্ম রয়েছে আত্মায় যে, সমগ্র সমাজের জন্য নিজের বলিদান নিশ্চিত করতে পার। এই বিষয়ে আপনারা সবাই চিন্তা করুন।
দান তাকেই বলে যাতে দানী হারায় আর যাচক প্রাপ্তিলাভ করে কিন্তু বলিদান (এই অর্থে ইসলাম ধর্মে বলিদানকেই কোরবানি বলে) সেটাই হয় যা দানী দেয় আর সমগ্র জগৎ প্রাপ্ত করে।
পাপ ও পুণ্যের দুই রূপ, মালার ন্যায় থাকে। যে প্রকার একটি মুক্তা তার পরের মুক্তাকে আকর্ষণ করে ঠিক সেইরূপ এক পুণ্য অপর পুণ্যের সৃষ্টি করে আর এক পাপ অবশ্যই অপর পাপ করায়। পাপ মানুষের অহংকারকে সুখ প্রদান করে। মানুষকে স্বয়ং দ্বিতীয় পাপ করা থেকে তখনই রক্ষা করা যায় যখন ঐ পাপ ভয়াবহ ফল দেয়। কিন্তু অহংকারে অন্ধ মানুষ সেই ফল দেখতেই পায় না। অধর্ম ও অপরাধের পরম্পরা নির্মিত করতেই থাকে। সমাজ কত বঞ্চনা, কত ছল, কত অপরাধ সহ্য করতে পারে, কত অপরাধকে ক্ষমা প্রদান করতে পারে এর নির্ণয় সমাজই করে থাকে। আর সমাজে যার কাছে দণ্ড দেওয়ার শক্তি থাকে তাকে সেই নির্ণয় করতে হয়। (পঞ্চপাণ্ডবের এক পুত্র প্রতিবিন্দের এক প্রশ্নের জবাবে কৃষ্ণের বাবা-মা সম্পর্কে) প্রথম বালকের মৃত্যুর পর মাতা দেবকী ও পিতা বাসুদেবের মুখে কখনো হাসি আসে নি। বাস্তবে এই বালকদের বলি প্রদান করা হয় নি পুত্র, অধর্মের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে ওরা বীরগতি (ইসলাম ধর্মে- ধর্মের জন্য জীবন উৎসর্গকে শাহাদাত বলে) প্রাপ্ত হয়েছে। বলিদান তো আমার মাতা আর পিতার সুখের হয়েছিল। (কিন্তু এত বড় বলিদান কেন, সূতকর্মের এমন প্রশ্নের উত্তরে) পুত্র সূতকর্ম, ধর্মের স্থাপনা করার প্রয়াসকারীর মর্যাদা কিরূপ হয় জান তুমি? পাপীদের পাপের মর্যাদাই তাদের বলিদানের মর্যাদা। অর্থাৎ পাপী ও পাপ সম্পূর্ণ বিনষ্ট না হয় ততদিন ধর্মপ্রিয় মানুষদের বলিদান কী প্রকারে পূর্ণ হতে পারে?