Thursday, December 31, 2015

রসুলাল্লাহর আবির্ভাবের আগে ও পরে

রসুলাল্লাহর আবির্ভাবের আগে ও পরে


রসুলাল্লাহর আগমনের পটভূমি:
রসুলাল্লাহর আবির্ভাবকালীন বিশ্বে পারস্য, রোম, চীন ও ভারতীয় সভ্যতা ছিল উল্লেখযোগ্য। তন্মধ্যে পারস্য ও রোম সভ্যতা ছিল সর্বাপেক্ষা বিস্তৃত এবং পরাক্রমশালী (সুপার পাওয়ার)। সে সময়ের প্রতিটি সভ্যতার অধীনেই সীমাহীন অন্যায়, অশান্তি, রক্তপাত বিস্তার লাভ করেছিল। যেমন: ধর্মীয়ভাবে পারস্যের অধিবাসীরা ছিল অগ্নি উপাসক। কিন্তু সে ধর্ম সমাজে কোন সুফল বয়ে আনতে পারেনি। ফলে পারাস্য সমাজে অনাচার, অবিচার, যুদ্ধ, বিগ্রহ লেগেই ছিল। নৈতিক অবক্ষয় তাদের মধ্যে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, পিতা কন্যাকে, ভাই বোনকে পর্যন্ত বিয়ে করত। আর রোমানদের অবস্থাও পারস্যের চেয়ে খুব একটা ভাল ছিল না, খ্রিষ্টান ধর্মালম্বী হলেও তাদের মধ্যে ধর্ম সংক্রান্ত মতানৈক্য, দলাদলির দাবানল চরম আকার ধারণ করেছিল। রসুলাল্লাহর জন্মের মাত্র ছাপ্পান্ন বছর আগে ৫১৪ খ্রিষ্টাব্দে একত্ববাদ থেকে ত্রিত্ববাদের সূচনাকে কেন্দ্র করে রোমীয় খ্রিষ্টানদের মধ্যে এক মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং এ যুদ্ধের ফলে প্রায় পঁয়ষট্টি হাজার খ্রিষ্টান রোম ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এদিকে ভারত উপমহাদেশ সনাতন বা হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নানা রকম কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল। বর্ণবাদের বৈষম্যের বেড়াজালে আটকে পুরো জাতি বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। বর্ণবাদের নিষ্পেষণে ভারত উপমহাদেশ চরমভাবে সামাজিক অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছিল। অপর দিকে চীনের অধিবাসীরা ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম তখনো চীনকে শান্তি দিতে পারেনি বরং সামাজিক অবক্ষয়ে জাতিটা থিতিয়ে পড়েছিল। তৎকালীন বিশ্বের বড় বড় সভ্যতার যখন এই দূরাবস্থা তখন ছোট ছোট জাতিগুলির অবস্থা কি হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
এমন একটি ছোট্ট জাতি ছিল আরব জাতি। সে সময় আরবের সামাজিক অবস্থা ছিল ভয়াবহ রকমের নৈরাজ্যকর। ব্যক্তিগতভাবে হিংসা-বিদ্বেষ; দলগতভাবে হানাহানি, যুদ্ধ; সামাজিকভাবে হত্যা, লুণ্ঠন, জুয়া, মদ ও ব্যভিচার সমগ্র আরবকে যেন গ্রাস করে ফেলেছিল। তারা আল্লাহকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে বিশ্বাস করলেও মানাত, লাত, ওযযা, হাবলসহ শতশত দেবতার উপাসনায় ছিল নিমগ্ন। কাঠ-পাথরের বিভিন্ন মূর্তি দিয়ে তারা কাবাকে কলঙ্কিত করেছিল। শুধু তাই নয়, হজ্ব উপলক্ষ্যে তারা কাবাকে বাণিজ্যিক কেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছিল। সে সময় সবচেয়ে বর্বর, অসভ্য, হতদরিদ্র জাতি হিসাবে আরবরা সর্বত্র পরিচিত ছিল।
এক কথায় বলা যায় রসুলাল্লাহর আবির্ভাবের সময় সমস্ত বিশ্বে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজাধিরাজ পর্যন্ত সকলেই আকণ্ঠ ডুবে ছিল অন্ধকারের সাগরে।
পৃথিবীর এমন ক্রান্তিকালে মহান আল্লাহ সমস্ত মানব জাতির উপর সদয় হলেন। নৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় সকল বিষয়ে অধঃপতিত আরব জাতির মধ্যে তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহামনব, নবীকূলশিরমনি মোহাম্মদ (সা.) এর আবির্ভাব ঘটালেন।
আইয়্যামে জাহেলিয়াতের সাথে বর্তমানের মিল:
বর্তমানে সমস্ত পৃথিবীর একক কর্তৃত্বকারী ‘সভ্যতা’ হলো ইহুদি খ্রিষ্টান বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’ যার প্রভাবাধীন সমস্ত পৃথিবী আজ চরম অন্যায়, অবিচার, শোষণ, বঞ্চনায় পরিপূর্ণ। প্রতিদিনের সংবাদপত্র খুললেই দেখা যায় হত্যা, রাহাজানি, ধর্ষণ, ছিনতাই, যুদ্ধ, আত্মঘাতী বোমাহামলা ইত্যাদি নানা জঘন্য ঘটনায় পরিপূর্ণ আমাদের এই পৃথিবী। আজও পত্রিকার পাতায় তৎকালীন আরব সমাজের মতো দেখতে পাই “বাবার কাছে যৌন নিপীড়নের শিকার হলো নিজ কণ্যা”, “ভারতে বাবা ও ভাইয়ের পৈশাচিক যৌন নিপীড়নের শিকার হতভাগ্য এক নারী” ইত্যাদি আরও জঘন্য সব লোমহর্ষক সংবাদ। পাশ্চাত্য সমাজের নৈতিক অবক্ষয় এমন পর্যায়ে গেছে যে, পৃথিবীর ইতিহাসের সমস্ত রকম যৌনতার রেকর্ড ভেঙ্গে সমলিঙ্গে যৌনতা আইনসিদ্ধ করে নিচ্ছে, ইতর প্রাণীর সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করছে এবং বিকৃত যৌনাচারের ভিডিওচিত্র ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে সমগ্র পৃথিবীতে। আর আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের হতদরিদ্র জাতিগুলি তাদের পদে পদে অনুসরণ করছে। অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নির্যাতন, যুদ্ধ-বিগ্রহ, সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিক স্খলনসহ সকল ক্ষেত্রে বর্তমান সমাজ তৎকালীন আরবসমাজের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলেছে।
নবুয়্যত পূর্ববর্তী জীবন:
অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীকে আলোকিত করতে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে ১২ই রবিউল আউয়াল অর্থাৎ আজকের এই দিনে আরব মরুর বুকে ঝর্ণাধারার মত আবির্ভূত হলেন মানবতার মুক্তির দূত, মানবজাতির আদর্শ মোহাম্মদুর রসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম। রসুলাল্লাহ এই অন্ধকার যুগে জন্মগ্রহণ করলেও আল্লাহ তাঁকে সবধরণের দোষত্রুটি, নোংরামী থেকে সম্পূর্ণরূপে নিষ্কলুষ রেখেছিলেন। ফলশ্রুতিতে যৌবনে তিনি হলেন আরবের সবচেয়ে উত্তম চরিত্রের অধিকারী, সবচেয়ে সত্যবাদী, সর্বাধিক বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি। সকল গুণের সমাহারে মহান আল্লাহ তাঁকে এমন সুমহান চরিত্রের অধিকারী করলেন যে আরবদের কাছে তিনি ‘আল আমিন’ বলে পরিচিত হয়ে গেলেন।
মানুষের বিপদাপদ, সামাজিক সংস্কার নবুয়ত প্রাপ্তির আগেও রসুলাল্লাহর স্বাভাবজাত ছিল। ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি সমাজ কল্যাণে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রত হয়েছিলেন। যদিও হেদায়াহ্হীন ‘হিলফুল ফুজুল’ এর কার্যক্রম বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আর স্থায়ী হলেও রসুল্লাহর জন্য এর কোন প্রয়োজন ছিল না। কারণ আল্লাহ তাকে সমাজ সংস্কারের মত ছোখাট কোন দায়িত্ব দিয়ে পাঠাননি। তাঁকে আল্লাহ দায়িত্ব দিলেন সব রকমের কুসংস্কার, অতীতের বিকৃত ধর্ম ও মানুষের মনগড়া বিধান সম্বলিত জীবনব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে আল্লাহ প্রদত্ত ‘সত্যদীন’ প্রতিষ্ঠার কাজ।
নবুয়্যতের দায়িত্ব পালন:
রসুলাল্লাহ তৎকালীন সমাজের অন্যায়, অবিচার, জুলুম, যুদ্ধ-বিগ্রহ দেখে সর্বদা চিন্তা করতেন কিভাবে এই অশান্তি থেকে মানবজাতিকে মুক্ত করে শান্তি ফিরিয়ে আনা যায়। চল্লিশ বছর বয়সের মোহাম্মদ (সা.) এই চিন্তাগুলি নিয়ে যখন হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন তখন পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক আল্লাহপাক তাঁকে বিশাল এক দায়িত্ব দিয়ে মনোনীত করলেন শেষ নবী ও রসুল হিসেবে। রসুলাল্লাহকে আল্লাহ বুঝিয়ে দিলেন কেন আজ সমাজ এত অশান্তিতে পূর্ণ এবং কিভাবে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। রসুলাল্লাহ বুঝলেন সমাজে সমস্তরকম অশান্তির মূল কারণ আল্লাহকে হুকুমদাতা হিসাবে না মানা। লাত, মানাত, ওয্যা, হাবল ইত্যাদি দেবদেবীর নামে নিজেদের মস্তিষ্কপ্রসূত আইন-কানুন দিয়ে সমাজ পরিচালনার জন্যই সমাজে চরম অশান্তি বিরাজ করছিল যেমন বর্তমান সমাজেও আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে মানবরচিত আইন-বিধান দিয়ে সমাজ পরিচালিত হয় বলে সমাজে এত অশান্তি বিরাজ করছে। তাই রসুলাল্লাহ প্রথমেই আরবজাতিকে বোললেন, “তোমরা বল, আল্লাহ ছাড়া কোন হুকুমদাতা নাই, তাহোলে আল্লাহ তোমাদের জান্নাতে দাখিল করবেন।” তিনি দীর্ঘ ১৩বছর অর্থাৎ মক্কার জীবনের সম্পূর্ণ সময় শুধু এই কলেমার দাওয়াত বা আল্লাহর তওহীদের দাওয়াত দিয়ে গেলেন। এই সময়ে তিনি নানা রকম নির্যাতনের মধ্যে নিপতিত হয়েছেন কিন্তু দৃঢ় প্রত্যয়ে সবর করেছেন এবং তওহীদের বালাগ চালিয়ে গেছেন, একটি বারের জন্যও নির্যাতন কারীদের বিরুদ্ধে বদদোয়া করেন নি। মক্কার জীবনে তিনি কোন কেতাল অর্থাৎ সশস্ত্র সংগ্রাম করেন নি।
রসুলাল্লাহর দায়িত্বকে পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ স্পষ্ট করে দিয়েছেন এই বলে হেদায়াহ (সঠিক দিক নির্দেশনা) ও সত্যদিনসহ আপন রসুলকে প্রেরণ করেছি এজন্য যে তিনি যেন অন্য সমস্ত দিনের ওপর একে বিজয়ী করেন। (আল কোর’আন- সুরা ফাতাহ-২৮, তওবা-৩৩, সফ-৯)। রসুলাল্লাহ তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব এবং এর ফলাফল সম্পর্কে ছিলেন সম্পূর্ণ সচেতন। মক্কায় যখন রসুলাল্লাহ ও তাঁর সাহাবীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চলছিল, সে সময় একদিন তিনি কাবার দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। হঠাৎ কাফেরদের নিষ্ঠুরতম নির্যাতনের শিকার খাব্বাব (রা.) এসে বোললেন, ‘হে আল্লাহর রসুল! এই অত্যাচার নিপীড়ন আর সহ্য হচ্ছে না। আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করুন আমাদের বিরোধীরা সব যেন ধ্বংস হয়ে যায়।’ তিনি সোজা হয়ে বসলেন এবং খাব্বাব (রা.)-কে বোললেন, ‘তুমি কী বোললে? সাহাবা তার কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। শুনে আল্লাহর রসুল তাকে বোললেন, ‘শোন, শীঘ্রই সময় আসছে যখন কোন যুবতী মেয়ে গায়ে গহনা পরে একা সা’না থেকে হাদরামাউদ যাবে। তার মনে এক আল্লাহ এবং বন্য জন্তু ছাড়া আর কোন ভয় থাকবে না।’ না এটা খাব্বাব (রা.) কে দেয়া রসুলের কোন অভয় ছিল না, বরং তিনি সম্পূর্ণ সচেতনভাবেই কথাটি বোলেছেন।
মক্কাবাসীর সকল বিরোধিতা উপেক্ষা করে রসুল তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। তিনি বোলতে থাকলেন ‘লা এলাহ এল্লাল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন হুকুমদাতা-বিধানদাতা নাই। কালেমার এই বাক্য অর্থাৎ জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের হুকুমের স্থলে অন্য কারো হুকুম মানব না। মাত্র কয়েকশজন ব্যতীত সমস্ত মক্কাবাসী রসুলকে প্রত্যাখান কোরল একই সাথে দমন, নিপীড়ন চালাতে আরম্ভ কোরল। তাদের অত্যচার চরম সীমায় পৌঁছুলে রসুলাল্লাহ তাঁর আসহাবদের সঙ্গে নিয়ে মদীনায় হেজরত করলেন।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, মক্কার তের বছর অবস্থান করলেও রসুলাল্লাহ সে সমাজের কোন অন্যায়কে সংস্কার করতে এগিয়ে জাননি, কারণ বিষবৃক্ষের ফল একটি একটি করে না ছিঁড়ে তিনি বিষবৃক্ষটি সমূলে উপড়ে ফেলার কাজে হাত দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন আল্লাহর দেয়া সত্যদীনের বিধান প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সমাজকে পুরাতন বিল্ডিংএর মত পরতে পরতে সংস্কার করার প্রয়োজন থাকবে না।
যা হোক, আল্লাহ তাঁর অসীম রহমতে মদিনাকে রসুলাল্লাহর হাতে তুলে দিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই দীনুল হকের সত্যের আলোকচ্ছটা মদিনাকে আলোকিত করে ফেলল। যে সমাজে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, হত্যা, লুন্ঠন, জুয়া, জেনা, সুদ ইত্যাদি ছিল নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়, যেখানে মেয়েদের কোন নিরাপত্তা ছিল না, দীনুল হক প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে যেন ঠিক তার বিপরীত হয়ে গেল, নতুন এক সমাজ প্রতিষ্ঠা হলো। সে সমাজের পুরাতন কোন সমস্যা আলাদাভাবে রসুলকে সংস্কার করতে হলো না। কিন্তু শুধুমাত্র মদীনায় দীনুল হক প্রতিষ্ঠা রসুলের দায়িত্ব ছিল না ছিল দুনিয়াব্যাপী। তথাপি চতুর্থ হেজরী পর্যন্ত বদর, ওহদ, খন্দক যুদ্ধ এবং ইহুদিদের সন্ধি ভঙ্গের দরুন তাদের দমনে রসুলাল্লাহর সময় ব্যয় হয়ে গেল। পঞ্চম হেজরীতে হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে মদীনায় স্থিরতা আসলে রসুল মোটেই কালক্ষেপণ করলেন না। তিনি ঝড়ের বেগে সাহাবীদের নিয়ে বহির্গত হলেন। আল্লাহর সাহায্যে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে আরব উপদ্বীপেবর বাকি সবটুকু দীনুল হকের ছায়াতলে চলে এলো। আরববাসী এবার প্রত্যক্ষ করল দীনুল হকের নির্যাস ‘এসলাম’ শান্তি। মক্কায় অবস্থানকালে খাব্বাব (রা.) কে বলা সে কথা বাস্তবে পরিণত হলো। রসুল এমন এক শান্তির সমাজ গড়লেন যে সত্যই একজন যুবতী স্বর্ণ অলঙ্কার পরে নির্ভয়ে দু-তিনশত মাইল এককি পথ চলল। কেউ ভুল করে চুরি করে ফেললে, বা রিপুর তাড়নায় ব্যভিচার করে ফেললে সে এসে বলল আমি ব্যভিচার করেছি, আমাকে শাস্তি দিন। এমনকি সমাজে সকলে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করত কিন্তু পাহারা দেওয়ার জন্য কোন পুলিস রাখা হলোনা এবং সমাজে কোন অন্যায়ও সংঘটিত হলো না। এমনও হলো যে, আদালতে বিচারক বসে অপেক্ষা করতেন কিন্তু তার কাছে কোন অপরাধ সংক্রান্ত মামলা আসতো না। এর চেয়ে শান্তি, আর কি হতে পারে?
শুধু আরব উপদ্বীপে দীনুল হক প্রতিষ্ঠার পর রসুলাল্লাহ প্রত্যক্ষ দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। বিদায়ের আগে তিনি বাকি দুনিয়ায় আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করার জন্য দায়িত্ব দিয়ে গেলেন নিজ হাতে গড়া জাতিটির উপর, যার নাম উম্মতে মোহাম্মদী।
আসহাবদের দায়িত্ব পালন এবং পরবর্তীদের উদাসীনতা:
রসুলের এন্তেকালের পর এ জাতিটি মোটেই কালক্ষেপণ কোরল না, তাঁরা খরোস্রোতা নদীর মত প্রচণ্ড গতিতে দুনিয়ার বুকে ছড়িয়ে পড়লো। ফলশ্র“ততি মাত্র ষাট সত্তর বছরের মধ্যে তৎকালীন পরাশক্তি রোম ও পারস্য সাম্রাজ্য সে খরস্রোতে বিলীন হয়ে গেল। অর্ধেকেরও বেশি দুনিয়ায় এসলাম প্রতিষ্ঠা হলো। তারপর হঠাৎ এ খরোস্রোতা নদীর স্রোত গতিহীন হতে থাকলো। এ জাতি ভুলে যেতে থাকলো যে কেন তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তারা বাকি দুনিয়াতে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ত্যাগ কোরল। শুরু কোরল বাদশাহী, ভোগ বিলাস আর দীন নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ও মাসলা ফতোয়া নিয়ে গবেষণা। তখন থেকে বর্তমানের ইতিহাস সবারই জানা।

ঈসা (আ.) কেন সেদিন প্রচলিত শরিয়ত ‘লংঘন’ করলেন? -রাকীব আল

ঈসা (আ.) কেন সেদিন প্রচলিত শরিয়ত ‘লংঘন’ করলেন? -রাকীব আল হাসান



পৃথিবীতে প্রায় দু’শ কোটির অধিক খ্রিস্টধর্মের অনুসারী রয়েছেন। তারা যদি সত্যিকার অর্থেই যিশু খ্রিস্টের প্রদত্ত শিক্ষাকে অনুধাবন করে কার্যক্ষেত্রে তার প্রতিফলন ঘটাতে পারতেন তাহলে পৃথিবীর অশান্তি অনেকাংশেই কমে যেত।
একদিন পথ দিয়ে যাবার সময় ঈসা (আ.) একজন অন্ধ লোককে দেখতে পেলেন। অন্ধ ব্যক্তিটি জন্ম থেকেই অন্ধ ছিলেন। তাকে দেখে ঈসা (আ.) মাটিতে থুথু ফেলে কাদা করলেন। তারপর সেই কাদা তিনি অন্ধ লোকটির চোখে লাগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যাও শীলোহের পুকুরে গিয়ে ধুয়ে ফেল।’
অন্ধ লোকটি তখন পুকুরে গিয়ে চোখ ধুয়ে ফেলল। সে অভিভূত হয়ে গেল কারণ, সে চোখে দেখতে পাচ্ছিল। তার দৃষ্টিশক্তি তৈরি হওয়ায় সাধারণ মানুষ অবাক হয়ে গেল। কেউ কেউ বলল, এ কি সেই লোক, যে কিছুক্ষণ পূর্বে ভিক্ষা করছিল? দৃষ্টি ফিরে পাওয়া ব্যক্তিটি বললেন, হ্যাঁ, আমি সেই লোক ঈসা (আ.) যার দৃষ্টিশক্তি দান করেছেন।
কথা হচ্ছে এখানে উম্মতের জন্য কী শিক্ষা? উম্মত তো আর মো’জেজা দেখিয়ে অন্ধের দৃষ্টি ফেরত দিতে পারবে না। হ্যাঁ, উম্মতের জন্য বড় শিক্ষা আছে। বস্তুত দিনটি ছিল ইহুদিদের বিশ্রামবার বা স্যাবাথ। ইহুদি ধর্মের অন্যতম প্রধান বিধান হলো সপ্তাহে একদিন, শনিবার, জাগতিক কোনো কাজকর্ম না করে শুধু ধর্ম-কর্ম করা এবং সিনাগগে যেয়ে উপাসনা করা। ঈসা (আ.) দৃষ্টিহীনকে দৃষ্টিশক্তি দান করে সেই স্যাবাথের নিয়ম ভঙ্গ করেছিলেন। এতে ইহুদি ধর্মীয় নেতারা প্রচণ্ড রেগে যায় এবং দৃষ্টি ফিরে পাওয়া ব্যক্তিকে সমাজ থেকে বের করে দেয়।
ঐ জন্মান্ধটি তো সারা বছরই ঐ সিনাগগের সামনে বসে ভিক্ষা করত। জন্মান্ধকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়াই বা অলৌকিক শক্তি (মো’জেজা) দেখানোই যদি নবীর একমাত্র উদ্দেশ্য হতো তবে তিনি শনিবার ছাড়া অন্য যে কোনোদিন কি তা করতে পারতেন না? পারতেন, কিন্তু তিনি বেছে বেছে ঐ স্যাবাথের দিনটাতেই ঐ কাজ করলেন।
ঈসা (আ.) কর্তৃক সেদিনের বিধান ভঙ্গের কারণ ছিল এটা বোঝানো যে, ‘মানবিক কাজ বা মানবতার কল্যাণ সাধিত হয় এমন কাজ ঐ স্যাবাথের অর্থাৎ আইনের দোহাই দিয়ে বাদ দেয়ার অর্থ হলো ধর্মের আÍাকেই বিসর্জন দেওয়া। বস্তুত মানবতার জন্যই ধর্ম, কাজেই ধর্মের আইন-অনুশাসন কোনোভাবেই মানবতার কল্যাণের পথে বাধা হতে পারে না। যে ধর্ম মানবতার বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সেটা ধর্ম নয়, অধর্ম। সেটা পালন করে স্বর্গে আরোহণ করা যায় না।

কাল থেকেই হতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ!

কাল থেকেই হতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ!






 বিজ্ঞানী আইনস্টাইন-কে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলো, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেমন হতে পারে। তিনি বলেছিলেন, তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ কেমন হবে টা বলতে পারি না, তবে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ লাঠি দিয়ে হবে!
আইনস্টাইন-এর কথা থেকে এটা স্পষ্ট যে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা এতটাই হবে যে প্রায় ধ্বংসই হয়ে যাবে মানব সভ্যতা। সেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বোধহয় আর বেশি দূরে নেই। খুব শীঘ্রই এমনকি আজ বা কাল যে কোনো সময়েই লেগে যেতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আর একবিংশ শতাব্দীর এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক জোট ন্যাটোর প্রতিপক্ষ হতে পারে চীন ও রাশিয়া।
গত দুই দশক ধরে লন্ডন ও ওয়াশিংটনের যুদ্ধের ক্ষেত্রে সিয়েরা লিওন, বসনিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান আর বর্তমানে সিরিয়া। তবে আবার বিশ্ব পটভূমিতে ফিরে এসেছে শক্তি প্রদর্শনের রাজনীতি।
যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর যুদ্ধে জড়ানোর আশঙ্কা বেড়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের পর চীন ও রাশিয়ার যুদ্ধের শঙ্কা অনেকটাই শেষ হয়ে গিয়েছিল। তবে আবার ফিরে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র জোট ও এই রাষ্ট্রগুলোর বিরোধ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ছোট একটি বিরোধ বা মতপার্থক্য থেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা রয়েছে।
পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সবশেষ বিরোধ দেখা দিয়েছে রাশিয়ার বোমা হামলাকে কেন্দ্র করে। সিরিয়ায় হামলা চালাতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক জোট ন্যাটোভুক্ত কয়েকটি দেশের ওপর দিয়ে উড়েছে রাশিয়ার যুদ্ধবিমান। এমন ঘটনার কারণে যে কোনো সময় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিমানযুদ্ধের শঙ্কা আছে। সিরিয়ার আকাশসীমা বিভিন্ন দেশের যুদ্ধবিমান, বোমারু বিমানে ভরে গেছে। বোমা ফেলতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানের খুব কাছ দিয়ে উড়ছে।
আবার মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে থাকা সাগরেও ন্যাটো ও রাশিয়া নৌসেনা মোতায়েন করেছে। যে কোনো সময় অতিসাধারণ কারণ নিয়েও এদের মধ্যে সংঘাত শুরু হতে পারে।
আবার কোনো সামরিক কারণ ছাড়াই বিশ্বকে নতুন রূপ দিতে যুদ্ধ হতে পারে। এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তি চীন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের নেতৃত্বদানকারীর অবস্থান থেকে সরাতে চায়। চীনের অর্থনীতিও দেশটির এমন স্বপ্নকে সমর্থন দেওয়ার মতো অবস্থানে আছে।

ব্যক্তির চেয়ে সিস্টেমের পরিবর্তনই এখন জরুরি

ব্যক্তির চেয়ে সিস্টেমের পরিবর্তনই এখন জরুরি

মোফাজ্জল হোসেন সর্দার
প্রকৃত শান্তিময় সমাজ পেতে হলে ব্যক্তি পরিবর্তন না করে সিস্টেম পরিবর্তন করা জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন হেযবুত তওহীদের সিলেট বিভাগের আমীর মোফাজ্জল হোসেন সর্দার। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি আফ্রিকা থেকে শুরু করে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত মুসলিম নামক এই জাতিতে এক অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন, আন্দোলন, ভাংচুর, হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও, সন্ত্রাস, সহিংসতা, জঙ্গিবাদ, গৃহযুদ্ধ, যুদ্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি যা কিছু হচ্ছে – তা এ জাতিরই হচ্ছে। আমাদের দেশও এর বাইরে নয়। স্বাধীনতার পর বিগত ৪৪ বছর যাবত আমরা দেখে আসছি ক্ষমতাসীন কোন একটা সরকারকে প্রবল আন্দোলনে জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে টেনে হিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামানো হয়। আবার আরেক দলকে ক্ষমতায় বসানো হয়। তারা এসে আবার পূর্ববর্তী সরকারের মতই দুর্নীতি, লুটপাট, স্বজনপ্রীতি, অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচার ইত্যাদির মাধ্যমে জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে ফেলে। শুরু হয় আবার তাদের নামানোর প্রক্রিয়া। কিন্তু তারাও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে চলে কঠিন হাতে দমনাভিযান। অন্তরালে চলে বৈদেশিক প্রভুদের সাথে হাত মেলানো। এই প্রভুদের কে কতটা খুশি করতে পারে শুরু হয় তার প্রতিযোগিতা। এটাই এই জাতিগুলির চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি। দীর্ঘদিন যাবত এভাবেই চলে আসছে।
তিনি বলেন, রাজনীতির উপর ত্যাক্ত-বিরক্ত মানুষ রাজনীতিকদের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়, বার বার ভোটের মাধ্যমে শাসন ক্ষমতায় দল বদল করে। কিন্তু সিস্টেমের আবর্তে ঘুরে ফিরে আবার আসে সেই পুরনো দৃশ্যপট। ঘুরে ফিরে সেই দলগুলোই ক্ষমতার পালা বদল করে। কারো প্রতিই আজ সাধারণ মানুষের আস্থা নেই, কিন্তু আস্থা না থাকলেও কিছু করার নেই। জনপ্রিয়তা হারানো ক্ষমতাসীন দলকে নামিয়ে যাদেরকে আবার ক্ষমতায় আনার প্রক্রিয়া চলে তারাও একই অভিযোগে অভিযুক্ত। জাতি একবার চুলা থেকে কড়াইতে লাফ দিয়ে ওঠে, আরেকবার কড়াই থেকে চুলোয় লাফ দিয়ে নামে। যন্ত্রণা দিন দিন বাড়ে।
ইসলামের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা জানি নবী করিম (সাঃ) এর সমকালীন সময়ে অর্থাৎ যাকে আমরা আইয়ামে জাহেলিয়াত বলি, সেই অন্ধকার সময়ে আরব জাতির অবস্থা একই রকম ছিল। তাদের অবস্থা আর আমাদের অবস্থা হুবহু মিলে যাচ্ছে। তারাও পরস্পর নানা গোত্রে বিভক্ত হোয়ে দাঙ্গা হাঙ্গামা, সামান্য তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে পুরুষাণুক্রমে শত্র“তা, যুদ্ধ, প্রতিশোধ ইত্যাদিতে লিপ্ত ছিল। অভাব ও দারিদ্রে গোটা জাতি ছিল জর্জরিত। তাদের এই দুরবস্থার কারণে বিশ্বের বুকে তাদের কোন সম্মান ছিল না। মানুষ তাদের প্রতি ঘৃণা ও অবজ্ঞার চোখে তাকাত। এই অবস্থায় আরবে আবির্ভাব ঘটে শেষ রসুলের। তিনি জাতিকে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থার (সিস্টেম) দিকে আহ্বান করলেন। যখনই আরবরা আল্লাহর দেওয়া সিস্টেমকে গ্রহণ করে নিল তখন তারা অল্প দিনের মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে দুনিয়ার বুকে সর্বদিকে সম্মানিত ও শ্রেষ্ঠ জাতিতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। রসুলের আনীত সিস্টেম পরস্পর শত্র“ভাবাপন্ন মানুষগুলোকে ভাই বানিয়ে ফেললো। মিটে গেল সমস্ত অনৈক্য, প্রতিশোধ নেওয়ার স্পৃহা। বরং রূহামা ও ভ্রাতৃত্বের বেলায় তারা অন্যকে নিজের চাইতে প্রিয় জ্ঞান করতে শিখল। সেই সাথে আধ্যাত্মিক উন্নতির ফলে প্রতিটি মানুষ একেক জন সোনার মানুষে রূপান্তরিত হোয়ে গেলেন। চুরি, ডাকাতি বন্ধ হোয়ে গেল। অভাব, অনটন, দারিদ্র্য দূর হোয়ে সমাজে সমৃদ্ধি আসলো। আজ আমরা যাদেরকে আদর্শ মানুষ হিসেবে জানি, জীবন চলার পথে যাদেরকে অনুসরণ করি- তাঁদের অধিকাংশই বর্তমানে আমরা তাঁদেরকে যেমন জানি তেমন ছিলেন না। আজ দীর্ঘ চৌদ্দশত বছর পরেও আমরা তাদের নাম মুখে উচ্চারণ কোরলে বলি ‘রাদি আল্লাহু আনহুম’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ তাঁর প্রতি খুশি এবং তিনিও আল্লাহর উপর খুশি’।
কিসে তাঁদের এই পরিবর্তন এনেছিল? রসুলাল্লাহর (দ:) আনীত আল্লাহর দেওয়া সিস্টেম, জীবন ব্যবস্থা।
তিনি আরও বলেন, সাধারণ মানুষসহ সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি আমাদের আহ্বান- আপনারা বার বার বীতশ্রদ্ধ হয়ে একজনের পর আরেকজনকে শাসন ক্ষমতায় বসাচ্ছেন, আন্দোলন করছেন, সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন, সরকারী সম্পত্তির ক্ষয়-ক্ষতি করছেন, এতে কিন্তু সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। বরং দিন দিন সমস্যা বেড়েই চলছে। একের প্রতি অন্যের ক্রোধ, হিংসা-প্রতিহিংসা চূড়ান্ত অবস্থায় উপনীত হয়েছে। তারাও সমান প্রতিশোধ নিতে অপেক্ষা করছে। প্রতিশোধ-পাল্টা প্রতিশোধ কোন সমাধান নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দাজ্জালের বস্তুবাদী, স্রষ্টাহীন এই জীবনব্যবস্থা অর্থাৎ সিস্টেমটাই মানুষগুলিকে এমন করে দিয়েছে। আসুন সিস্টেমটাই পাল্টাই। নতুবা সামনে জনগণের দুর্ভোগ আরো বাড়বে বৈ কমবে না। এই সিস্টেমে একের পর এক ঘুরে ফিরে যারা আসছে তাদের চরিত্রও একই রকম। খুব তাড়াতাড়ি অতীত ভুলে যাওয়ার খারাপ একটি রোগ আমাদের আছে। এটা উচিত নয়। আসুন আমরা বার বার মানুষের পরিবর্তন না করে এমন একটি সিস্টেম গ্রহণ করি যে সিস্টেম সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার ও পাপাচারের ছিদ্র বন্ধ করে দেয়। সেই সিস্টেমের দিকেই মানব জাতির প্রতি হেযবুত তওহীদের আহ্বান। এই সিস্টেম বাস্তবায়নের ফলে আজকের এই ঘুঁণে ধরা সমাজের অসৎ মানুষগুলিই একেকজন সোনার মানুষে পরিণত হবে ইনশা’আল্লাহ।

মানবসমাজ ও পশুর সমাজের মধ্যে পার্থক্য

মানবসমাজ ও পশুর সমাজের মধ্যে পার্থক্য


মোহাম্মদ আসাদ আলী
মানুষ পশু নয়, তাই মানব সমাজ আর পশুর সমাজও এক নয়। মানুষ হলো আশরাফুল মাখলুকাত, স্রষ্টা প্রদত্ত রূহের ধারক, স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন অসাধারণ এক সৃষ্টি। তার সম্মান, মর্যাদা অন্য যে কোনো সৃষ্টির চেয়ে বহুগুণ বেশি। একই কারণে মানবসমাজও সর্বশ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্বের পেছনে অসাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলো কেবল মানবসমাজেই দৃষ্টিগোচর হয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যে সমাজে অনুপস্থিত থাকে তাকে কখনও মানবসমাজ বলা যায় না।
মানবসমাজের প্রধানত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- ‘মানুষ তার স্বীয় ধর্মকে ধারণ করে সে সমাজ নির্মাণ করে। সমাজ পরিচালিত হয় ধর্মের ভিত্তিতে।’ মানুষের ধর্ম হলো মানবতা, মনুষ্যত্ব তথা মানবীয় গুণাবলী, যেমন অন্য মানুষের জন্য তার সহানুভূতি, ভ্রাতৃত্ব, দয়া, মায়া, সহমর্মিতা ইত্যাদি। ধার্মিক ব্যক্তি তার সত্ত্বাকে বিলিন করে দেয় অন্যের কল্যাণের উদ্দেশ্যে। অন্যের কষ্ট দেখলে, দুর্দশা দেখলে, বিপদ-আপদ দেখলে তার নিজের আত্মায় সে কষ্ট অনুভূত হয়। সমাজের সকল কিছুতেই সে কেবল নিজেকে দেখতে পায়। সমাজের কোনো মানুষ তো দূরের কথা কোনো জীবেরও এতটুকু দুঃখ তাকে পীড়া দেয়, আর সুখ তাকে আনন্দ ও সন্তুষ্টি প্রদান করে। ধার্মিক ব্যক্তি তার জীবন নির্বাহ করে শুধুই অপরের দুঃখ নিবারনের চেষ্টায়। কারণ সে জানে- অপরের কল্যাণে কাজ করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানবজনমের সার্থকতা। এটাই জেহাদ, এটাই ধর্মযুদ্ধ, এটাই ধর্মের সর্বোত্তম কাজ। এই যে মানসিকতা, সর্বভূতে হিত সাধনার্থে প্রয়াস, অপরের মাঝে নিজেকে দেখা- এটাই মানবসমাজের বৈশিষ্ট্য। এ সমাজে কোনো স্বার্থচিন্তার স্থান থাকে না, শুধু থাকে বিনিময়হীন সেবা। স্বার্থচিন্তা ব্যতিরেখে যে যত বেশি সেবা প্রদান করতে পারে সে তত বেশি মর্যাদার অধিকারী হয়, তত বেশি তার কীর্তি প্রাপ্ত হয়।
অন্যদিকে পশুর সমাজ হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে সমাজ পরিচালিত হয় স্বার্থচিন্তার ভিত্তিতে। সেখানে প্রত্যেকেই আত্মস্বার্থে কাজ করে। সবসময় নিজেকে নিয়েই সবাই ব্যস্ত থাকে। অন্যের প্রতি কোনো অনুভূতি থাকে না। এমন কি নিজের স্বার্থ হাসিলের পথে যত অন্যায়-অবিচার, যুলুম দরকার হোক তার কোনো বাছ-বিচার করা হয় না, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের পার্থক্য থাকে না। এ সমাজে শক্তিই পরিণত হয় ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ডে। প্রত্যেকের জীবনের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় যে করেই হোক নিজের সর্বোচ্চ স্বার্থ আদায় করে নেওয়া। এখানে আত্মার কোনো স্থান থাকে না, থাকে শুধু দেহ। তাই দেহের প্রয়োজন পূরণ করাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। পশু বেঁচে থাকে শুধু উদরপূর্তি করার জন্য। সে সারাদিন চিন্তা করে কোনো পশুকে আক্রমণ করবে, পরাভূত করবে, মাংস ভক্ষণ করবে। পাশাপাশি শঙ্কিতও থাকে এই বুঝি তার ওপর হামলা হলো, এই বুঝি তার থেকে শক্তিশালী কেউ তাকে ঠুকরে ঠুকরে খেল।
আপনি যদি পশুর সমাজে যান, অর্থাৎ কোনো ভয়ংকর বনে-জঙ্গলে প্রবেশ করেন তখন অবশ্যই আপনি খালি হাতে যাবেন না। কারণ সেখানে নিরাপত্তা নেই, যে কোনো সময় প্রাণ চলে যাবার সম্ভাবনা আছে। বন্য পশুর সামনে হাতজোড় করে দয়াভিক্ষা করলেও নিস্তার পাওয়া যায় না। এমন পরিস্থিতিতে দরকার পড়ে পাহারার। কিন্তু যে সমাজ, যে জগতে একজন আরেকজনের জন্য নিজের সত্ত্বাকে বিলিন করে দেয়, অপরের মাঝে নিজের অস্তিত্ব অনুভব করে, অপরের সুখে নিজের তৃপ্তি খুঁজে পায় এমন সমাজে কি পাহারার দরকার পড়ে? বস্তুত পাহারা দিতে হয় পশুর সমাজে, মানবসমাজে তো কেবল সৌহার্দ্র্য, ভ্রাতৃত্ব, দয়া-মায়া, ভালোবাসার সমাহার। সেখানে অনিরাপত্তার ছোঁয়াও লাগে না, তাই পাহারারও দরকার হয় না।
কিন্তু দুর্ভাগ্য আজকের মানবজাতির! দুর্ভাগ্য কথিত মানবসমাজের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এখানে কী না করতে হয়। এ সমাজে মানুষের নিরাপত্তার জন্য বাহিনী গঠন করতে হয়, চৌকি বসাতে হয়, দিবা-রাত্রি অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মানুষের জীবন-সম্পদ পাহারা দিতে হয়; বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির জন্য আবার প্রয়োজন পড়ে বিশাল নিরাপত্তা ব্যবস্থার, বডি গার্ডের বা পুলিশ ভর্তি গাড়ি বহরের। এর অর্থ কী দাঁড়ায়? এর অর্থ কি এটাই দাঁড়ায় না যে, আমরা যে সমাজে বসবাস করছি, যেখানে মানুষ মানুষের রক্তে হোলি খেলছে, উদায়াস্ত একজন মানুষ কেবল নিজের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে, ক্ষুধার্ত বাঘের মতো যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে দুর্বলকে আক্রমণ করছে, একজন আরেক জনকে জীবন্ত আগুনে দগ্ধ করছে, বাবা মেয়ের ইজ্জতের হানি ঘটাচ্ছে, মেয়ে তার জন্মদাতা পিতা-মাতার গলায় ছুরি চালাচ্ছে, চার বছরের শিশুও ধর্ষিত হচ্ছে সে সমাজ আর মানুষের সমাজ নয়? কথিত এই মানবসমাজ আর পশুর সমাজের মধ্যে কার্যত কোনো তফাৎ আছে কি?
সোজা কথা হলো মানবতা-মনুষ্যত্ব হারিয়ে আজকের মানবজাতি ধর্মহীন পশুতে পরিণত হয়েছে। তাদের সমাজ পরিণত হয়েছে পশুর সমাজে। কারণ পাহারা দেওয়ার দরকার হলেই সে সমাজ আর মানুষের সমাজ থাকে না। এ কারণেই যুগে যুগে যখন ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেখা গেছে তখন মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পাহারা বসানোর দরকার পড়ে নি, অস্ত্রের লাইসেন্স করার দরকার পড়ে নি, অস্ত্রব্যবসার জন্য রাষ্ট্রের অনুমোদনের দরকার পড়ে নি। অথচ সমাজে কোনো অন্যায়-অবিচার ছিল না, অনিরাপত্তা ছিল না। এমনটা সম্ভব হয়েছিল কারণ তখন প্রতিটি মানুষ ছিল মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত। আর আজ এমন আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে কারণ এখন প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলে নিয়োজিত।

সামাজিক অপরাধ দূরীকরণে প্রয়োজন ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা

সামাজিক অপরাধ দূরীকরণে প্রয়োজন ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা


রাকীব আল হাসান
সামাজিক অপরাধ, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, ধর্মব্যবসা ও ধর্ম নিয়ে অপরাজনীতির হীনচর্চা আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে। আমাদের সমাজজীবন নানাপ্রকার সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, কেবল আমাদের দেশেই নয় সমগ্র বিশ্বেই সামাজিক অপরাধ, অন্যায়, অশান্তি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা খুললে যে নৃশংস হৃদয়বিদারী চিত্র চোখে ভেসে আসে, তা কোনো মানবসমাজের প্রতিনিধিত্ব করে না। এ যেন নরকতুল্য একটি আবাসভূমি, যে ভূমিতে অনুষ্ঠিত প্রতিটি অমানবিক ঘটনা ধিক্কার জানাচ্ছে কথিত মানবসভ্যতাকে, মানুষের মিথ্যা অহংকারকে, তার অস্তিত্বকে। মানুষের বিবেকহীন নির্লজ্জ আসুরিক কর্মকাণ্ড আজ পশুকেও হার মানিয়েছে। মানুষ তার প্রধান ধর্ম মানবতা ও মনুষ্যত্বকে ত্যাগ করেছে সম্পূর্ণভাবে। মানুষের মধ্যে পারষ্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, অবিশ্বাস, কূটিলতা, স্বার্থপরায়ণতা ইত্যাদি যখন বৃদ্ধি পায়, এক কথায় মানুষের নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন ঘটে তখন সে মনুষ্যত্ব হারায়। সমাজে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। মানুষের চারিত্রিক অবনতি ও অবক্ষয় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পুলিশ পাহারা দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হচ্ছে না, তা ছাড়া উপরন্তু যদি শান্তিরক্ষাকারীদের মধ্যেই দুর্নীতি প্রবিষ্ট হয় তখন শান্তি আসার শেষ পথটিও বন্ধ হয়ে যায়। তথাপি মানুষের শান্তির লক্ষ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে, তাদেরকে আধুনিক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে আইন কঠোর থেকে কঠোরতর করা হচ্ছে। যে অপরাধের সাজা ছিল ১০ বছর, তা বাড়িয়ে করা হচ্ছে যাবজ্জীবন, যে অপরাধের সাজা ছিল যাবজ্জীবন তা এখন মৃত্যুদণ্ড করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো দিনকে দিন মানুষের অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেই অপরাধ সংঘটন করছে। পুলিশ প্রহরায় রাস্তাঘাটে হয়তো অপরাধ সংঘটন কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিন্তু বাড়ির মধ্যে স্বামী স্ত্রীকে হত্যা করছে, মেয়ে বাবা-মাকে হত্যা করছে, ভাই ভাইকে হত্যা করছে, পিতা-মাতা সন্তানকে হত্যা করছে, এই ভয়াবহ অবস্থায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দোষারোপ করার কোনো যুক্তি নেই। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে সারা দেশে ৩ হাজার ৬১টি খুনের ঘটনা ঘটে। এ সময়ে রাজধানীতে ১৭২ জন খুন হন। যার মধ্যে ১৬২টি খুনের কারণ সামাজিক ও পারিবারিক (বাংলাদেশ প্রতিদিন- ১২ অক্টোবর, ২০১৪)। স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের হাতে গত ৫ বছরে খুন হয়েছেন এক হাজার ১৭৫ জন নারী। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিস কেন্দ্র (আসক)-এর পরিসংখ্যান থেকে এটি জানা যায়। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, মূলত অর্থের প্রতি প্রবল মোহের অসম প্রতিযোগিতা, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক-রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক অস্থিরতা, অন্যদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা, দাম্পত্য কলহ ও স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসহীনতা, স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার আকাক্সক্ষা, সামাজিক উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ না থাকা, রাষ্ট্রের উদাসীনতা, বিষণ্ণতা ও মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন কারণে এ ধরনের খুনের ঘটনা ঘটছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, দেশে প্রতিদিন গড়ে খুন হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ জন। আর এর অধিকাংশই পারিবারিক ও সামাজিক কারণে হচ্ছে। সমস্ত পরিসংখ্যান বলছে, দিন দিন অপরাধ বাড়ছে, উদ্ভাবিত হচ্ছে অপরাধের নিত্য-নতুন কলাকৌশল। এ থেকে বাঁচতে হলে আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, শুধু শক্তি প্রয়োগ করে, দণ্ডবিধি দেখিয়ে মানুষকে অপরাধ থেকে ফিরিয়ে রাখা সম্ভব নয়। মানুষ শুধু দেহসর্বস্ব প্রাণী নয়, তার একটা আত্মাও আছে। এই আত্মাই তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই মানুষকে যদি আত্মিক শিক্ষা দেবার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করা হয়, তাদেরকে যদি নৈতিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তবে সে নিজেই আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে অপরাধ সংঘটন থেকে নিবৃত থাকবে। অপরাধ প্রবণতা থেকে মানুষেকে বিরত রাখার জন্য এটাই সর্বোত্তম পন্থা, পাশাপাশি অপরাধের জন্য কঠোর দণ্ডবিধিও থাকতে হবে।
পাশ্চাত্যের সঙ্গে প্রাচ্যের বড় পার্থক্য হলো এতদঞ্চলের সমাজ বস্তুবাদভিত্তিক নয়, বিশ্বাসভিত্তিক। এখানকার মানুষ হাজার হাজার বছর থেকে ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। কেউ ইসলাম ধর্ম, কেউ হিন্দু ধর্র্ম, কেউ বৌদ্ধ ধর্ম। অর্থাৎ এখানে ধর্মবিশ্বাসহীন লোক খুবই কম। ধর্ম তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে, তাই এখানে পাশ্চাত্যের সব দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতি খাপ খায় না। এখানে ধর্মের শিক্ষা দ্বারাই মানুষের আত্মিক শুভ পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ধর্মের শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মানুষ বিশ্বাস করে যে সে পৃথিবীর সবাইকে ফাঁকি দিতে পারলেও আল্লাহর চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। প্রতিটি কাজের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসাব তাকে একদিন দিতে হবে। পাশাপাশি আল্লাহ, রসুল, অবতারগণের উন্নত জীবনাদর্শ তার হৃদয়ে জাগরিত থাকে, সে লাগামহীন উচ্ছৃঙ্খলতার তুলনায় ন্যায়নিষ্ঠ, পরিশিলীত জীবনযাপনকে ভালোবাসতে থাকে। ধর্মের প্রভাবেই মানুষ একসময় ছিল সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ণ, আদর্শবান। অথচ আজ পশ্চিমা ধর্মহীন জীবনদর্শন ও অসভ্য সংস্কৃতির দাপটে জীবন থেকে ধর্মের মূল্যবোধ (Moral Values) প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রতিটি ধর্ম এখন ধর্মব্যবসায়ীদের স্বার্থসিদ্ধি ও অপরাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, ফলে জাতীয় ও সামাজিক জীবনে ধর্ম এখন কার্যকারিতাহীন নিছক পোশাকী একটি বিষয়। ধর্মব্যবসায়ীদের দুষ্কর্মের কারণে মানুষ দিনদিন ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছে। পৃথিবীর বর্তমানে ১২০ কোটি মানুষ নিজেদেরকে কোনো ধর্মেই বিশ্বাসী নয় বলে দাবি করে থাকেন। ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা হারিয়ে যাওয়ায় সমাজে যারা ধর্মের একেবারে ধ্বজাধারী হিসাবে পরিগণিত তারাও এমনসব কুকর্ম ও অপরাধে বিজড়িত হয়ে পড়েন যে, সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে তারাও শ্রদ্ধার পাত্র না হয়ে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হন। মোট কথা আমাদের সমাজে যে ধর্ম প্রচলিত আছে তা একান্তই উপাসনাকেন্দ্রিক- সমাজকেন্দ্রিক নয়। এর নৈতিক শিক্ষাগুলি বহুবিধ কারণে মানুষকে অপরাধ থেকে দূরে রাখতে পারছে না। তাদের জন্য প্রয়োজন ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা। মানুষকে শিক্ষা দিতে হবে ধর্ম কী? প্রকৃত ইবাদত কী? মানুষের কাছে স্রষ্টার চাওয়া কী? কাজ ও কাজের পরিণতি (হাশর) কী? মানবজন্মের সার্থকতা কীসে ইত্যাদি। অতি সংক্ষেপে মূল কথাগুলো বলার চেষ্টা করছি:-
(১) ধর্ম কি? প্রকৃতপক্ষে ধর্ম হলো কোনো পদার্থ বা প্রাণীর প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। যেমন আগুনের ধর্ম পোড়ানো, পানির ধর্ম ভেজানো। ঠিক একইভাবে মানুষের ধর্ম হলো মানুষের অভ্যন্তরস্থ মানবীয় গুণাবলী। সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতি, দয়া, মায়া, ভালোবাসা, মনুষ্যত্ব, মানবতা, সৌহার্দ্য, বিবেক, সহমর্মিতা, শৃঙ্খলা ইত্যাদি মানবীয় গুণাবলীই হলো মানুষের ধর্ম। যতক্ষণ একজন মানুষ অন্যের ব্যথায় ব্যথিত হয়, অন্যের দুঃখে দুঃখী হয়, অন্যের আনন্দে আনন্দিত হয়, অপরকে সহযোগিতা করে, আর্তপীড়িতের পাশে দাঁড়ায় ততক্ষণ সে ব্যক্তি ধার্মিক হিসেবে পরিগণিত হবার যোগ্য, কেননা তার ভিতরে মনুষ্যত্বের বৈশিষ্ট্যগুলি আছে। পক্ষান্তরে কেউ যদি নামায, রোযা, হজ, পূজা, অর্চনা, উপাসনা ইত্যাদি নিয়ে দিনরাত ব্যাপৃত থাকে কিন্তু তার ভিতরে মানবতার গুণাবলী সে প্রকৃত ধার্মিক নয়, আল্লাহর প্রকৃত উপাসক নয়।
(২) প্রকৃত ইবাদত ও মানবজীবনের সার্থকতা: মানবজাতির শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য কাজ করাই মানুষের প্রকৃত ইবাদত। যখন কারো বাড়িতে আগুন লাগে তখন যারা সেই আগুন নেভাতে না গিয়ে মসজিদে নামাজ পড়ে তারা আসলে আল্লাহর ইবাদত করছে না। মানুষের জীবনের উদ্দেশ্যে কেবল উদরপূর্তি, সংসারবৃদ্ধি ও দেহত্যাগ করা নয়, ওটা পশুর জীবন। মানুষ আল্লাহর রূহ ধারণকারী, আল্লাহর নিজ হাতে সৃষ্ট আশরাফুল মাখলুকাত। আল্লাহ তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য স্থির করে দিয়েছেন যে, মানুষ যদি তার সমগ্র জীবনকালে স্বার্থকে কোরবানি দিয়ে মানবতার কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে তবেই তার মানবজনম সার্থক হবে। মানুষ যদি এই প্রত্যয় করে যে, সে বাঁচবে মানবতার কল্যাণে, মরবে মানবতার কল্যাণে, জ্ঞান লাভ করবে মানুষকে দেওয়া জন্য, জগতের উন্নতির জন্য, দুটো পয়সা রোজগারের জন্য নয় তবেই এই পৃথিবীতে তার আসার উদ্দেশ্য সার্থক হল।
(৩) হাশর: মানুষের জীবন কর্মফলের চক্রে বাঁধা। মানুষ যে কাজই করে তার ফল অবশ্যই তাকে ভোগ করতে হবে। এখানে যদি সে খারাপ কাজ, মন্দ কাজ, মানুষের জন্য অকল্যাণকর কাজ করে তবে পৃথিবীতেই তাকে তার কুফল ভোগ করতে হবে, হাশরের দিনও তার কষ্টদায়ক ফল ভোগ করতেই হবে।
মানুষের আত্মিক এবং মানসিক পরিশুদ্ধির এই প্রশিক্ষণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাগুলির মধ্যেও নেই, ধর্মগুলির মধ্যেও অনুপস্থিত, শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কৃতি সবই তো সম্পূর্ণ বস্তুবাদী ও ভোগবাদী। এ বিষয়গুলো যদি মানুষকে শিক্ষা দেয়া যায়, তাহলেই মানুষের মানসিক অবস্থার শুভ পরিবর্তন হবে এবং সামাজিক অপরাধ অনেকাংশেই বন্ধ হবে।

শিক্ষক জাতির আজ কেন এই হীনম্মন্যতা???

শিক্ষক জাতির আজ কেন এই হীনম্মন্যতা???


মোহাম্মদ আসাদ আলী
প্রকৃত ইসলাম পৃথিবীর কোথাও নেই। আল্লাহর রসুলের মাধ্যমে পৃথিবীতে আসা দীনুল হক, সত্য জীবনব্যবস্থা তার প্রকৃত আদর্শ, স্বকীয়তা এবং যথার্থতা হারিয়ে তথাকথিত একটি ধর্মবিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। শত মত-পথ-তরীকার আড়ালে সত্যদীন হারিয়ে গেছে। সেই সাথে হারিয়ে গেছে মহামূল্যবান আকীদা যে আকীদা ছাড়া ঈমানের কোনো দাম নেই। প্রকৃত ইসলামের জ্ঞান অর্জনের যে গুরুত্ব সেই সম্পর্কেও আকীদা বিকৃত হয়ে গেছে। গোঁড়ামীর কারণে জ্ঞানকে সীমিত রাখা হয়েছে আরবী ভাষা ও ব্যাকরণের ভেতরে। ধর্মের তথাকথিত আলেম মাওলানারা মাদ্রাসা-মক্তবে যে ফতোয়াবাজী শিক্ষা করে থাকেন তাই তারা প্রকৃত ও একমাত্র জ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করেন এবং সেটাকে বিক্রি করে নিজেদের পেট চালান। শুধু তাই নয়, তাদের একটি বিরাট অংশ রোয়েছেন যারা এই ফতোয়াবাজির বাইরে অন্য কোনো জ্ঞান যেমন- ভূগোল, গণিত, বিজ্ঞান, সাম্প্রতিক বিশ্ব ইত্যাদিকে শয়তানের জ্ঞান হিসেবে প্রচার করেন। তাদের সেই বিকৃত আকীদার কবলে পড়ে বর্তমান মোসলেম নামধারী জাতিটির একটি বিরাট অংশ আজ অজ্ঞতা, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, কুসংস্কার ইত্যাদিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে। পৃথিবী যেখানে নতুন নতুন আবিষ্কার, প্রযুক্তিতে একের পর এক ইতিহাস সৃষ্টি করে চোলেছে, মানুষ লক্ষ লক্ষ মাইল দূরের চাঁদের দেশ থেকে ঘুরে আসছে, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ছোটাছুটি কোরছে, নদীর স্রোতকে বেঁধে চাকরের মতো কাজ করাচ্ছে, সমুদ্রের তলদেশ থেকে খনিজ সম্পদ বের করে আনছে তখন মোসলেম নামধারী এই জাতিটি বদনা হাতে মাথায় টুপি, পরণে আরবীয় পোশাক আর হাতে তসবীহ নিয়ে মসজিদে, হুজরায়, খানকায়, মাদ্রাসার চার দেয়ালের অভ্যন্তরে বসে প্রশ্ন কোরছে টিভি দেখা, গান শোনা জায়েজ কি নাজায়েজ! এটাই কি প্রকৃত ইসলামের আকীদা? আল্লাহর রসুল মোহাম্মদ (দ:) কি ধর্মীয় জ্ঞান তালাশ করাকেই ফরদ বোলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তিনি কি তাঁর জাতিকে এরকম ধর্মান্ধ, গোঁড়া, অজ্ঞ, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন থাকার শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিলেন?
জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মোসলেমদের অবদান:
মুসলিম হিসেবে অবশ্যই হাদীস-কোরানের জ্ঞান থাকতে হবে, কিন্তু বাইরের জ্ঞানার্জনকে প্রত্যাখ্যান করে নয়। আমাদের আদর্শ হচ্ছেন রসুলাল্লাহ, আর আদর্শ জাতি হোল রসুলাল্লাহর হাতে গড়া জাতিটি যারা রসুলাল্লাহর সাথে থেকে প্রকৃত ইসলাম শিক্ষা করেছিলেন। রসুলাল্লাহর সাথে থেকে যারা ইসলাম শিখেছিলেন তাদের ইতিহাস তো অন্য রকম। আল্লাহর রসুলের ওফাতের পরপরই তাঁর অর্পিত দায়িত্ব যখন তাঁর হাতে গড়া জাতিটির কাঁধে এসে পড়লো তখন তারা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আরব থেকে দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাইরে বেরিয়ে পড়লেন এবং একের অসম সামরিক যুদ্ধে পর এক বিজয় অর্জন কোরতে লাগলেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তৎকালীন অর্ধপৃথিবীতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ভিত্তিক সত্যদীন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। উম্মতে মোহাম্মদী তখন সমস্ত পৃথিবীর মডেল। সত্যদীন তখন ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে দ্বিগি¦দিক আমোদিত করে তুলছে। শিক্ষা-দীক্ষা, চিকিৎসা, দর্শন, বিজ্ঞান সর্বদিক মুসলিমরা সমস্ত পৃথিবীর শিক্ষকের আসনে অধিষ্ঠিত হন। ক্রমেই নতুন নতুন আবিষ্কার, শিক্ষা-দীক্ষা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ইত্যাদিতে তারা অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ কোরতে থাকেন। তাদের তৈরি করা ভিত্তির উপর গড়ে ওঠা মুসলিম সভ্যতা বিশ্বের উন্নতির সর্ববিভাগে বহু আবিষ্কারের জনক হয়ে আছে।
বিজ্ঞান বিভাগে দৃষ্টি দিলেই দেখা যায়, রসায়ন বা কেমিষ্ট্রির জন্মদাতা মুসলিম। রসায়নের ইতিহাসে জাবিরের (৭২২-৮০৪) নাম সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। বীজগণিতের জন্মদাতা বলা হয় আল খোয়ারেজমীকে (৭৮০-৮৫০)। বন্দুক, বারুদ, কামান, প্রস্তর নিক্ষেপণ যন্ত্রের আবিষ্কারও মুসলিমদেরই অবদান। যুদ্ধের উন্নত কৌশল ও বারুদ বা আগ্নেয়াস্ত্র সম্বন্ধে বিখ্যাত আরবী গ্রন্থ তাঁরাই লিখেছেন বিশ্ববাসীর জন্য। সেটির নাম ‘আলফুরুসিয়া ওয়াল মানাসিব উল হারাবিয়া’। ভূগোলেও মুসলিমদের অবদান এত বেশী যা জানলে অবাক হতে হয়। ৬০ জন মুসলিম ভূগোলবিদ পৃথিবীর প্রথম যে মানচিত্র এঁকেছিলেন তা আজও বিশ্বের বিস্ময়। এর আরবী নাম হচ্ছে ‘সুরাতুল আরদ’ অর্থাৎ বিশ্বের আকৃতি। এবনে ইউনুসের অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমা মণ্ডল নিয়ে গবেষণার ফল ইউরোপ মাথা পেতে নিয়েছিল। ফরগানী, বাত্তানি (৮৫৮-৯২৯) ও আল খোয়ারেজমী প্রমুখের ভৌগোলিক অবদান স্বর্ণমণ্ডিত বলা যায়। কম্পাস যন্ত্রের আবিষ্কারকও মুসলিমরাই। তাঁর নাম এবনে আহমদ। জলের গভীরতা ও সমুদ্রের স্রোত-মাপক যন্ত্রের আবিষ্কারক এবনে আবদুল মাজিদ। বিজ্ঞানের উপর যে সব মূল্যবান প্রাচীন গ্রন্থ পাওয়া যায় আজও তা বিজ্ঞান জগতের পুঁজির মত ব্যবহৃত হচ্ছে। বিজ্ঞানের উপর গবেষণামূলক ২৭৫ টি পুস্তক যিনি একাই লিখেছেন তিনি হচ্ছেন আলকিন্দি (৮০১-৮৭৩)। প্রাচীন বিজ্ঞানী হাসান, আহমদ ও মুহম্মদ সম্মিলিতভাবে ৮৬০ সনে বিজ্ঞানের একশত রকমের যন্ত্র তৈরীর নিয়ম ও ব্যবহার প্রণালী এবং তাঁর প্রয়োজন নিয়ে গ্রন্থ রচনা করে গেছেন।
রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের এক হাজার বছর আগে মুসলিম কবি, জ্যোতির্বিদ, সঙ্গীত শিল্পী এবং প্রকৌশলী আব্বাস ইবনে ফারনাস নিজস্ব আবি®কৃত বিমানের সাহায্যে আকাশে ওড়ার চেষ্টা করেন। ৮৫২ সনে তিনি স্পেনের কর্ডোবা মসজিদের মিনারের উপর থেকে তার আবি®কৃত যন্ত্রসহ লাফিয়ে পড়েন। উড়তে না পারলেও ধীর গতিতে মাটিতে অবতরণ করেন। তার এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্যারাস্যুট আবিষ্কৃত হয়। ৮৭৫ সনে ৭০ বছর বয়সে তিনি আরেকবার লাফিয়ে পড়েন পাহাড়ের চূড়া থেকে এবং বেশ খানিকটা দূরত্ব উড়তে সক্ষম হন। তিনি ১০ মিনিট আকাশে ভেসে থাকেন। ইবনে ফারনাসের নামে বাগদাদের আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর এবং চন্দ্রপৃষ্ঠের একটি অগ্নিগিরির জ্বালামুখের নাম করা হয়েছে।
চার্লস ডারউইন পশু-পাখি, লতা-পাতা নিয়ে গবেষণা করে পৃথিবীতে প্রচার করেছেন ‘বিবর্তনবাদ’। কিন্তু তারও পূর্বে যিনি এ কাজ করার রাস্তা করে গেলেন এবং ইতিহাসে সাক্ষ্য রেখে গেলেন, তিনি হচ্ছেন আল আসমাঈ। তাঁর বইগুলো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। মুসলিমরাই প্রথম চিনি তৈরী করেন। তাছাড়া তুলা থেকে তুলট কাগজ প্রথম সৃষ্টি করেছেন ইউসুফ এবনে উমর। তার দু’বছর পর বাগদাদে কাগজের কারখানা তৈরী হয়।
জাবীর ইবনে হাইয়ান একাই ইস্পাত তৈরি, ধাতুর শোধন, তরল বাষ্পীকরণ, কাপড় ও চামড়া রং করা, ওয়াটার প্র“ফ আরস্তরণ তৈরি করা, লোহার বার্নিশ, চুলের কলপ ও লেখার পাকা অমোচনীয় কালী আবিষ্কার করে অমর হয়ে রোয়েছেন। ম্যাঙ্গানিজ ডাই অক্সাইড থেকে কাচ তৈরির প্রথম ধারণা দেন মুসলিম বিজ্ঞানী ‘আল রাজী’ (৮৬৫-৯২৫)। ইংরেজদের ইতিহাস গ্রন্থে তাঁর নাম লেখা হয় জধুবং. একদিকে দীনের জ্ঞানে তিনি ছিলেন বিরাট আলেম অপরদিকে ছিলেন গণিতজ্ঞ ও চিকিৎসা বিশারদ। সোহাগা, লবণ, পারদ, গন্ধক, আর্সেনিক ও সালমিয়াক নিয়ে তাঁর লেখা ও গবেষণা উল্লেখযোগ্য। আরও মজার কথা, পৃথিবীতে প্রথম পানি জমিয়ে বরফ তৈরি করাও তাঁর অক্ষয় কীর্তি। ইউরোপ পরে নিজের দেশে বরফ প্রস্তুত কারখানা চালু করে।
পৃথিবী বিখ্যাত গণিত বিশারদের ভিতর ওমর খৈয়ামের (১০৪৮-১১৩১) স্থান উজ্জ্বল রত্নের মত। ঠিক তেমনি নারিরুদ্দিন তুসী এবং আবু সিনার নামও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আকাশ জগত পর্যবেক্ষণ করার জন্য বর্তমান বিশ্বেরর মানমন্দির আছে ব্রিটেনে এবং আমেরিকায় কিন্তু কে বা কারা এগুলোর প্রথম আবিষ্কারক প্রশ্ন উঠলে উত্তর আসবে হাজ্জাজ ইবনে মাসার এবং হুনাইন ইবনে এসহাক। এঁরাই পৃথিবীর প্রথম মানমন্দির আবিষ্কারক। সেটা ছিল ৭২৮ খ্রিস্টাব্দ। ৮৩০ খ্রিস্টাব্দে জন্দেশপুরে দ্বিতীয় মানমন্দির তৈরি হয়। বাগদাদে হয় তৃতীয় মানমন্দির। দামেস্ক শহরে চতুর্থ মানমন্দির তৈরি করেন আল-মামুন।
আর ইতিহাসের ঐতিহাসিকদের কথা বোলতে গেলে মুসলিম অবদান বাদ দিয়ে তা কল্পনা করাই মুশকিল। এমনকি, মুসলিম ঐতিহাসিকরা কলম না ধোরলে ভারতের ইতিহাস হয়তো নিখোঁজ হয়ে যেত। অবশ্য ইংরেজ ঐতিহাসিকদের সংখ্যাও কম নয়। তবে একান্তভাবে মনে রাখা দরকার: ইতিহাসের স্রষ্টা বিশেষতঃ মুসলিমরা। তার অনুবাদক দল ইংরেজ ঐতিহাসিকরা। মুসলিম ঐতিহাসিকদের মধ্যে আল বিরুনি, ইবনে বতুতা, আলী বিন হামিদ, বায়হাকীম, উতবি, কাজী মিনহাজ উদ্দিন সিরাজ, মহিউদ্দিন, মোহাম্মদ ঘুরী, জিয়াউদ্দিন বারনী আমীর খসরু, শামসী সিরাজ, বাবর, ইয়াহিয়া-বিন-আহমদ, জওহর, আব্বাস শেরওয়ানী, আবুল ফজল, বাদাউনি, ফিরিস্তা, কাফি খাঁ, মীর গোলাম হোসাইন, হুসাইল সালেমী, সাঈদ আলী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এঁদের লিখিত মূল ইতিহাস গ্রন্থগুলির নামের তালিকা এত দীর্ঘ যে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতির আশঙ্কায় উল্লেখ কোরলাম না।
জ্ঞানসাধনায় মুসলিম নারীদের অবস্থান:
রসুলাল্লাহর সময়ের নারীরা যে কবিতা, কাব্য সাহিত্য এবং কোরান-হাদীসের যে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন সেকথা অনেকেরই জানা আছে। যেমন রসুলাল্লাহর স্ত্রী আয়েশা (রা:) ছিলেন একজন উচ্চস্তরের হাদীসবিদ ও বিদূষী। স্পেন দেশে ইসলামী সভ্যতা যখন পৌঁছালো তখন শুধু পুরুষরাই জ্ঞানচর্চায় এগিয়ে ছিলেন তাই নয় বরং মেয়েরাও অনগ্রসর ছিলেন না। যেমন বিখ্যাত মহিলা লাবানা, ফাতেমা, রাজেয়া, আয়েশা, খাদেজা প্রভৃতি। কেউ যেন মনে না করেন যে তাঁরা রসুলাল্লাহর স্ত্রী-কন্যা। তাঁরা ছিলেন তাঁর সত্যনিষ্ঠ অনুসারী, মোসলেম। রসুলাল্লাহর ভক্ত হিসেবেই তাঁদের পিতা-মাতারা তাদের ঐ নামগুলো রেখেছিলেন। অর্থাৎ তাঁরা তাদের নেতার আদেশকে বাস্তবায়নের জন্যই জ্ঞানচর্চা কোরতেন। এমনিভাবে রাদেয়া নামের এক সুপণ্ডিত মহিলা ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। যেহেতু তখনও বই ছাপার প্রেস আবিষ্কৃত হয়নি তাই হাতে লেখার উপরই নির্ভর কোরতে হোত জ্ঞান অনুসন্ধানকারীদের। জ্ঞানী পুরুষদের বাড়ির মেয়েরা সে কাজে সহযোগিতা কোরতেন। এতে করে পুরুষদের চেয়েও মেয়েদের লেখার দক্ষতা তৈরী হোত অনেক বেশী। তাছাড়া একই জিনিস বারবার লেখার কারণে তা খুব ভালোভাবে স্মরণে থাকতো যা তারা পরবর্তীতে কাজে লাগাতেন। সে যুগে মেয়েরা বিদ্যালয়ে গিয়ে লেখাপড়া কোরত যার প্রমাণও ইতিহাসে রোয়েছে। এখানে মনে রাখতে হবে তখন বর্তমানের মতো বিদ্যালয় ছিল না। পুরো জনপদ মিলে হয়তবা একটিমাত্র বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা ছিল আর সেখানেই ছেলে-মেয়ে সকলেই লেখাপড়া কোরত। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীশিক্ষার ভিত্তি রচনা হয় সেই যুগের মোসলেমদের হাত ধোরেই। পুরাতন আরবী সাহিত্য ও পুঁথিতে তার প্রমাণ আছে। যেমন- সালমা নামে এক বালিকার বিদ্যালয়ে যাওয়া এবং দোয়াতে কলম ডুবিয়ে কালি নিয়ে খেলার উল্লেখ আছে। সুতরাং বোঝা যায় বিদ্যালয়ে, কলম ও দোয়াতের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। (ডক্টর হামিদুল্লাহর লেখা ‘আহদে নববী কা নেযামে তালিম’ পৃষ্ঠা ৯)
এই ইতিহাস আর বর্তমানে সঠিক জায়গায় নেই। কুচক্রীদের চক্রান্তের শিকারে এবং মোসলেমদের হীনমন্যতার সুযোগে এই ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। মোসলেমরা তার স্বর্ণযুগে যে জ্ঞানবিজ্ঞানের ভিত্তি নির্মাণ করে গেছেন তার উপরেই যে আজকের পশ্চিমা সভ্যতার যান্ত্রিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে আছে তা আজকের মোসলেম নামধারী জাতির ক’জনই বা বিশ্বাস কোরবে। খ্রিস্টানদের তৈরি শিক্ষাব্যবস্থায় পড়াশুনা করে তাদের ভিতরে সৃষ্টি হয়ে স্বীয় জাতির প্রতি নিদারুণ হীনমন্যতা আর পাশ্চাত্য প্রভুদের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা। তারা জানেন, মোসলেম জাতির ইতিহাস বর্বরতার ইতিহাস, পাশবিক ভোগবিলাস আর শিয়াল কুকুরের মত রাজ্য নিয়ে কামড়া-কামড়ির ইতিহাস। পশ্চিমারা তাদেরকে এর বেশী কিছু জানতে দেয় নি। তবে যারা সত্যানুসন্ধী নিয়ে বিজ্ঞানের ইতিহাস পড়বেন তারা আজও জ্ঞানের প্রতিটি অঙ্গনে মোসলেম শিক্ষকদের পদচিহ্ন খুঁজে পাবেন। এ জাতিকে মাথা এখন উঁচু করে দাঁড়াতে হলে নিজেদের প্রকৃত অতীত জানা অত্যন্ত জরুরি।
[তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট এবং আল্লামা গোলাম আহমাদ মোর্তজার ‘চেপে রাখা ইতিহাস’]

মানবসমাজে ধর্ম-অধর্ম ও শান্তি-অশান্তির চিরন্তন দ্বন্দ্ব

মানবসমাজে ধর্ম-অধর্ম ও শান্তি-অশান্তির চিরন্তন দ্বন্দ্ব


মোহাম্মদ আসাদ আলী
দিন দিন মানুষ নামের প্রাণীটি যেন অন্য রূপ ধারণ করছে। অন্য রূপ মানে অন্য চরিত্র, অন্য স্বভাব, অন্য বৈশিষ্ট্য। মানুষ কাকে বলে, কী করলে মানুষ হওয়া যায়, শুধু মানুষের ঘরে জন্মগ্রহণ করলেই মানুষ হওয়া যায় কিনা- প্রশ্নগুলো এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। উত্তরও রয়েছে, তবে বিবিধ। মানুষ শব্দটি এসেছে মনুষ্য থেকে, ডিকশনারিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এমন- “যার মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে সে-ই মানুষ। মনুষ্যত্ব হলো মানুষের চিরাচরিত বা শাশ্বত স্বভাব বা গুণ।” যেমন দয়া-মায়া, ভালোবাসা, পরোপকারিতা, সহানুভূতি, সম্প্রীতি, ঐক্য ইত্যাদি। যুগে যুগে মানবজাতি তাদের বাস্তব জীবনে এই গুণগুলোর যথাসাধ্য প্রয়োগ ঘটিয়েছে। মানুষ হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে সবাই নয়। ভালো-মন্দ, কৃতজ্ঞ-কৃতঘ্ন, পরোপকারী-স্বার্থবাদী দুই ধরনের মানুষেরই পদচারণা ঘটেছে এই নিখিল বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে। তারা সকলেই মানবতা-মনুষ্যত্বকে প্রতিষ্ঠা করে নিজেদেরকে মানুষ প্রমাণ করতে সক্ষম হয় নি। যাদের কর্মকাণ্ডে মনুষ্যত্বের চিরন্তন-সনাতন প্রতিফলন ঘটে নি তারা মনুষ্যত্বহীন, তথা ধর্মহীন। আর ধর্মহীন মানবসন্তানকে কখনই মানুষ বলা যায় না, মানুষ নামের মর্যাদা তার শোভা পায় না। যারা কাজে-কর্মে মনুষ্যত্বের পরিচয় প্রদান করতে পারে কেবল তারাই মানুষ নামে পরিচিত হবার যোগ্য। তাদের সম্মান অতি উচ্চ। স্বয়ং স্রষ্টার গুণ প্রকাশিত হয় তাদের মধ্য দিয়ে। জগতে তারা নন্দিত হন ধার্মিক বা ধর্মপরায়ণ বলে। তাদের উপস্থিতি পৃথিবীকে আলোকোজ্জ্বল করে। ধর্মানুরাগীদের সঠিক মার্গ প্রদর্শন করে ও অধার্মিকদের দণ্ড প্রদান করে তারা পৃথিবীকে শান্ত রাখেন। অর্থাৎ মানুষ ও অমানুষ বলতে যথাক্রমে ধার্মিক ও অধার্মিককে বোঝায়। যে ব্যক্তি মনুষ্যত্ব বা মানবতাকে নিজের মধ্যে ধারণ করে সেই প্রকৃত ধার্মিক, অন্যদিকে যে ব্যক্তির মাঝে মানবতা নেই সে অধার্মিক। একইভাবে যে ব্যক্তি ধর্মের পথে চলে সে-ই মানুষ, আর যে অধর্মের পথে চলে সে অমানুষ।
এই ধর্ম ও অধর্মের দ্বন্দ্বই মানবজাতির প্রকৃত অতীত। বর্তমানও তাই। ভবিষ্যতেও এরই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এরই অংশ হিসেবে কালচক্রে এমন সময় এসেছে যখন সমাজ পুরোপুরিই ধর্মাবৃত হয়ে গেছে। অধর্ম পুরোপুরি নাশ হয়েছে। সমাজ শান্তি-সমৃদ্ধি-সৌহার্দ্য, মানবতায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। স্বর্গের মতো অবারিত সুখ-শান্তির দ্বার খুলে গেছে, যে ইতিহাসগুলো আজকাল রূপকথার মতো শোনায়। আবার এমনও হয়েছে যে, সমাজে অধর্মের মাত্রা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যার কারণে ধর্মকে থাকতে হয়েছে কোণঠাসা হয়ে।
এখানে একটি কথা বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। অধর্মের মাত্রা বৃদ্ধি পায় কীভাবে? সাধারণভাবে মনে হতে পারে- ধার্মিক লোক কমে যাওয়া, সকলে ধর্মকর্ম পরিত্যাগ করে অধর্মের পথে ধাবিত হওয়া। কিন্তু আসলে তা নয়। ইতিহাস এটাই বলছে যে, ধার্মিক সকল সমাজে, সকল জাতিতেই ছিল, কিন্তু তথাপি অন্যায়-অবিচার, অশান্তি, অধর্ম বেড়ে যাবার কারণ হলো ঐ ধার্মিকরা ধর্ম মনে করে যা করেছে তা আসলে প্রকৃত ধর্ম নয়। তারা প্রকৃত ধর্ম থেকে দূরে সরে গিয়ে বিকৃত ধর্ম পালনে নিয়োজিত হয়েছে। কিন্তু বিকৃত ধর্ম যখন শান্তি আনয়নে ব্যর্থ হয়েছে তখনই ঘটেছে যত অশুভ, অকল্যাণকর কর্মকাণ্ড, ভোগ করতে হয়েছে অনিবার্য পরিণতি।
ইহুদিদের নবী রাজা দাউদ বা কিং ডেভিড (আ:) এর সময় যে শান্তির রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল তা ছিল সত্যধর্মের অনুসরণের ফল। হিন্দুশাস্ত্রে রামরাজত্বের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাও ছিল ঐ সত্যধর্মের অনুসরণের ফল। আবার মুসলিমদের স্বর্ণযুগখ্যাত ইসলামের প্রাথমিক যুগে অর্ধপৃথিবীব্যাপী যে অকল্পনীয় শান্তি-সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাও ছিলো সত্যধর্মের বিধান অনুযায়ী চলার ফল, মনুষ্যত্বকে প্রতিষ্ঠা করার পুরস্কার। কিন্তু ইউরোপের মধ্যযুগের যে বর্বরতা মানবজাতির ইতিহাসে আজও কলংক হয়ে আছে সেটা ধর্মের ফল ছিল না, শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী মুসলিম সমাজে যে বিভেদ, হানাহানি, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, অন্ধত্ব, পশ্চাদপদতা ইত্যাদি গ্রাস করে আছে সেটাও ধর্মের ফল নয়। এগুলো বিকৃত ধর্মের পরিণতি। যখন ধার্মিকরা অধর্মকেই ধর্মকর্ম সাব্যস্ত করে ধর্মীয় মর্যাদায় সেগুলো পালন করে চলে তখনই জন্ম হয় এমন অশান্তির।
বস্তুত কোনো সমাজে ধর্ম আছে কিনা তা যাচাই করার প্রথম ও প্রধান উপায় হলো সে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত আছে কিনা তা দেখা। ধর্মের ফল শান্তি, অধর্মের ফল অশান্তি। এ কারণে শেষ নবীর আনীত সত্যদীনের নাম ‘ইসলাম’, যার শাব্দিক অর্থই হলো শান্তি। অর্থাৎ সেটাকে প্রতিষ্ঠা করলে তার অনিবার্য ফলাফল হবে অনাবিল শান্তি। যুগে যুগে যতো নবী-রসুল-অবতার এসেছেন, যত দীন, শাস্ত্র বা জীবনব্যবস্থা এসেছে তার সবগুলোই ছিল ইসলাম। কারণ- স্রষ্টা প্রদত্ত সকল জীবনব্যবস্থারই ফলাফল হচ্ছে শান্তি। তাই আল কোর’আনে আল্লাহ বলছেন- আমার কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) হলো ইসলাম (শান্তি)। (সুরা আল এমরান, ১৯) এর মর্মার্থ এই যে, তিনি যুগে যুগে যে দীনগুলো পাঠিয়েছেন এবং যেগুলো প্রতিষ্ঠিত হবার ফলে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছে- সেই জীবনব্যবস্থাগুলোই কেবল তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য। এর বাইরে যে জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে শান্তির পরিবর্তে মানবসমাজে কেবল অশান্তিই বৃদ্ধি পায় সেগুলো অগ্রহণযোগ্য, সেগুলো ইসলাম নয়।
আজ সমস্ত পৃথিব্যাপী অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। চারদিকে অন্যায়-অবিচার, যুদ্ধ-রক্তপাত, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি-মারামারি, শোষণ, বঞ্চনা আর সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য। নিপীড়িত, অত্যাচারিত, শোষিত আদম সন্তানের ক্রন্দন আর হাহাকারে পৃথিবী পরিণত হয়েছে এক অভিশপ্ত আতঙ্কের পুরীতে। কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা জাতি নয়, সকল ধর্মের অনুসারীই এই আতঙ্কপুরীতে মৃতপ্রায় হয়ে বেঁচে আছে। অর্থাৎ প্রচলিত কোনো ধর্মই মানুষকে শান্তি দিতে পারছে না। এর কারণ এই সব জাতিগুলোই তাদের নবী-রসুল-অবতারগণের আনীত সত্যধর্ম থেকে, প্রকৃত শিক্ষা থেকে বহু দূরে সরে গেছে। তারা কার্যত কেউই প্রকৃত ধর্মের অনুসারী নয়। তারা ধর্মের খোলসে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে অধর্মের বীজ বপন করে চলেছে। অর্থাৎ মানুষ অধর্মকেই ধর্ম মনে করে পালন করছে আর ভাবছে- ‘আমরা বুঝি খুব ধর্মকর্ম করছি, স্রষ্টা আমাদের প্রতি অতি প্রসন্ন রয়েছেন, স্বর্গ হতে দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণ করছে।’ কিন্তু বাস্তবে তারা অধর্মকে প্রশ্রয় দিয়ে স্রষ্টার ক্রোধের পাত্রে পরিণত হয়েছে।
এই পার্থিব নরক থেকে পরিত্রাণ পাবার উপায় একটিই- প্রকৃত ধর্মকে বরণ করে নেওয়া। ধর্মের নামে অধর্মের ডালপালা বিস্তার বন্ধ করা। মানবসমাজে একটি ধারণা ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে যে, ‘পৃথিবীতে এতগুলো ধর্মের মধ্যে মাত্র একটি ধর্ম সত্য হতে পারে (!) অন্য সকল ধর্ম মিথ্যা এবং ঐ সত্য ধর্মই কেবল মানুষকে মুক্তি দিতে সক্ষম।’ এ ধারণা প্রচলিত থাকায় সকল ধর্মের অনুসারীরাই দাবি করে যে, কেবল তাদের ধর্মই সত্যধর্ম। এটা ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম মেনে চলে স্বর্গে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো- স্রষ্টা প্রদত্ত সকল ধর্মই সত্যধর্ম। এগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এর যে কোনোটি মানুষ মেনে চলতে পারে। তবে মানতে হবে পূর্ণাঙ্গভাবে। জাতীয় ও ব্যক্তিগত উভয় জীবনে একমাত্র স্রষ্টাকেই সার্বভৌম বিধানদাতা হিসেবে মেনে নিয়ে তাঁর প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী জীবনযাপন করলে যে কোনো ধর্মের মানুষই শান্তি পাবে। সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার দূরিভূত হবে। কেবল তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে খ্রিস্টানদের কাক্সিক্ষত কিংডম অব হ্যাভেন, হিন্দুদের কাক্সিক্ষত রামরাজত্বের শান্তি তথা সত্যযুগের পুনরাবৃত্তি এবং মুসলিমদের কাক্সিক্ষত স্বর্ণযুগের শান্তি। শান্তি-অশান্তি, সত্য-মিথ্যা, ধর্ম-অধর্মের চিরন্তন দ্বন্দ্বে তখন জয় হবে সত্যের, জয় হবে ধর্মের, জয় হবে শান্তির।

ধর্মীয় সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসুন

ধর্মীয় সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসুন


রাকীব আল হাসান
অন্ধত্ব বা দৃষ্টিহীনতা (Blindness) কী? অন্ধত্ব হলো না দেখা, না বোঝা, নির্দিষ্ট একটা গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা, এর বাইরে চিন্তা না করা, গবেষণা না করা। পৃথিবীতে শুধু আমিই ঠিক। কাজেই এর বাইরে আর কোনো কিছুই দেখবো না, জানবো না, শুনবো না। পৃথিবীতে শুধু ধর্মের জ্ঞানই প্রয়োজনীয়, আর আমার সে ব্যাপারে যথেষ্ট পাণ্ডিত্য আছে, কাজেই এর বাইরে অন্য কোনো জ্ঞানের দরকার নেই। আমি যা জানি তাই সত্য, পৃথিবীতে আর কোনো সত্য নেই। স্বর্গে শুধুমাত্র আমিই যাব, আর কেউ যাবে না- এসবই হলো অন্ধত্ব। প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরাই মনে করেন যে তাদের ধর্মই সঠিক, একমাত্র তারাই সঠিক পথে আছে। স্বর্গে, জান্নাতে, হ্যাভেনে যাবার পথ শুধু তাদেরই জানা, কাজেই মুক্তির জন্য সকলকেই তাদের স্মরণাগত হতে হবে। বাকি সকল ধর্মই ভ্রান্ত, অসত্য। সুতরাং যে যত ধর্মই পালন করুক অন্য ধর্মের অনুসারী মাত্রই বিধর্মী অর্থাৎ জাহান্নামী। বিকৃত ইসলামের মুসলিমরা মনে করছে জান্নাতে যাবার অধিকার একমাত্র তাদের। জান্নাতে যাবার পূর্ব শর্তই হলো বর্তমানে ইসলাম নামে যে ধর্মটি চালু আছে তা গ্রহণ করা। অন্য যেকোনো ধর্ম যত যতœসহকারেই পালন করা হোক তাকে অনন্তকাল জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে। আবার হিন্দুরা ভাবছেন হিন্দুধর্মই স্বর্গলাভের একমাত্র পথ। হিন্দুরা ছাড়া কেউই স্বর্গে পৌঁছতে পারবে না। খ্রিস্টানরা ভাবছে স্বর্গের ‘ঊঃবৎহধষ ষরভব’ এ শুধুই তাদেরই একচেটিয়া অধিকার। এই মানসিকতাগুলি নিছক ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছাড়া কিছু নয়। প্রত্যেক ধর্মেই নিজেদের স্বার্থে ধর্মের ধারক বাহক সেজে একটি ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি তাদের এই সংকীর্ণ মানসিকতা দিয়ে সাধরণ মানুষকে প্রভাবিত করে অব্যাহতভাবে জগৎসংসারের অকল্যাণ করে চলেছে। এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে ধর্মীয় বিভেদ, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, অশ্রদ্ধা, দাঙ্গা, জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ। ধর্ম এসেছে মানবতার কল্যাণের জন্য, মুক্তির জন্য। কিন্তু ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাকে বিকৃত করে তারা ধর্মকে বানিয়ে নিয়েছে বাণিজ্যের মূলধন, স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার। তারা নানা ইস্যুতে অন্য ধর্মকে কটাক্ষ করে কথা বলে, অন্য ধর্মের নবী-রসুল, অবতার, মহামানবদের ব্যাপারে অশ্লীল বাক্য ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ায়। সাধারণ মানুষ ধর্ম সম্পর্কে জানার জন্য, ধর্মীয় নানা কার্য সম্পাদনের জন্য এই শ্রেণিটির স্মরণাপন্ন হয়। এরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে নিজেদের মনগড়া কথা ধর্মের নামে চালিয়ে দেয়। সাধারণ মানুষ তাদের কথায় প্রভাবিত হয়। বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর পেছনে এরাই মূলত রসদ যুগিয়েছে। এদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অন্য ধর্মকে ভ্রান্ত, ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক জ্ঞান করে মহামানবদের ব্যাপারে যখন অসত্য, মন্দ বাক্য বিনিময় করে তখনই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সূত্রপাত ঘটে। আল্লাহ বলেছেন- ‘যাহারা মনোযোগ সহকারে কথা শুনে এবং উহার মধ্যে যাহা উত্তম তাহা গ্রহণ করে। উহাদিগকে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেন এবং উহারাই বোধশক্তি সম্পন্ন।’ (সুরা জুমার-১৮)। আল্লাহ মনোযোগ সহকারে সব বিষয় শুনতে বলেছেন, যাচাই করতে বলেছেন, অতঃপর যেটা উত্তম সেটা গ্রহণ করতে বলেছেন। কিন্ত এই ধর্ম ব্যবসায়ীগুলো আল্লাহর এই কেতাবগুলোকে সংকীর্ণ, কূপমণ্ডুক দৃষ্টিহীন করে ফেলেছে। আল্লাহ সকলকে জ্ঞান দিয়েছেন, বুদ্ধি দিয়েছেন, বিবেক দিয়েছেন তাই প্রতিটা বিষয় আমাদের পড়ে দেখা উচিত, যদি বিষয়টি উত্তম এবং যৌক্তিক মনে হয় তাহলে সেটা গ্রহণ করাই জ্ঞানীর কাজ হবে। সাধারণ মানুষকে আজ ধর্ম ব্যবসায়ীরা অন্ধ করে রেখেছে। ধর্মব্যবসায়ীরা কোনো কথা বললে সেটা সত্য কি মিথ্যা সাধারণ জনগণ তা যাচাই করে না। কিন্তু বিবেকবান ও দৃষ্টিসম্পন্ন প্রতিটি মানুষের অবশ্যই সেটা যাচাই করা উচিত। কারণ এটা স্রষ্টার নির্দেশ।
একটা বিষয় সকলকে অনুধাবন করতে হবে- এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা নিশ্চয় সংকীর্ণ নন। যাঁর সৃষ্টি এত অসীম, তাঁর নিজের বিরাটত্ব কতটা অসীম এবং নিখুঁত! কাজেই তাঁর নিকট থেকে আগত ধর্মও বিশাল, উদার, ত্র“টিমুক্ত। সকল ধর্মই সেই মহান স্রষ্টার নিকট থেকে আগত। সকল ধর্মের মূল বাক্য একই, মৌলিক শিক্ষাগুলি অভিন্ন। আপনি কোন ধর্মের অনুসারী এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, আপনি আপনার ধর্মের মূল বাক্যে, মৌলিক শিক্ষার মধ্যে আছেন কি না সেটাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি পৃথিবীতে শান্তিতে বসবাস করতে চান, পৃথিবীকে স্বর্গরাজ্য তথা কিংডম অব হ্যাভেন বানাতে চান, সত্যযুগ ফিরিয়ে আনতে চান, পৃথিবীকে জান্নাতে পরিণত করতে চান মৃত্যুর পরও যদি জান্নাত, স্বর্গ তথা হ্যাভেনে যেতে চান তবে আপনাদেরকে নিজ নিজ ধর্মের মৌলিক শিক্ষার দিকে ফিরে যেতে হবে। আপনাকে জানতে হবে সেই মৌলিক শিক্ষাগুলি কী? মূল বাক্য কোনটি? এক কথায় স্বর্গে, জান্নাতে তথা হ্যাভেনে যাবার প্রকৃত উপায় কী?
সকল ধর্মের মূল বাক্য হলো জীবনের সর্বক্ষেত্রে স্রষ্টা ঈশ্বর তথা আল্লাহর হুকুমের যথাযথ বাস্তবায়ন। মানবরচিত ভোগবাদী, জড় ও বস্তুবাদী, স্রষ্টাহীন সকল তন্ত্র-মন্ত্র প্রত্যাখ্যান করে স্রষ্টার দেওয়া বিধান সার্বিক জীবনে প্রতিষ্ঠা করাই হলো মুক্তির একমাত্র পথ। এটাই সকল ধর্মের মূল বাক্য। অর্থাৎ জান্নাতে যাবার পূর্ব শর্তই হলো জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে স্রষ্টার হুকুমের যথাযথো বাস্তবায়নের মাধ্যমে পৃথিবী থেকে সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, যুলুম, যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানি, রক্তপাত, অশান্তি দূর করে অনাবিল শান্তি ও পূর্ণ নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা। স্বর্গে কারা যাবে এর এক কথায় উত্তর হোল, যারা একমাত্র স্রষ্টার ইবাদত করবে। আর স্রষ্টার ইবাদত হচ্ছে মানবজাতির শান্তির জন্য সকল প্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এই কাজ না করে যত উপাসনার আনুষ্ঠানিকতা, পূজা, অর্চনা, নামাজ রোযাই করা হোক না কেন সেগুলি কোনটাই ইবাদত হিসাবে কবুল হবে না, মানুষকে স্বর্গে নিতে পারবে না।
আর সকল ধর্মের মৌলিক শিক্ষা হলো মানুষের অভ্যন্তরস্থ মানবীয় গুণাবলীকে জাগ্রত করা। দয়া, মায়া, ভালোবাসা, মনুষ্যত্ব, মানবতা, সৌহার্দ্যতা, বিবেক, সহমর্মিতা, ঐক্য, শৃঙ্খলা, অপরকে সহযোগিতা করা ইত্যাদি হলো মানবীয় গুণাবলি, এই বৈশিষ্ট্যগুলো যখন হারিয়ে যায় তখন সে আর মানুষ থাকে না। তার কোনো ধর্ম থাকে না। সে তখন ধর্মহীন হয়ে যায়। সে তখন পশুতে পরিণত হয়। সে যে ধর্মের ধ্বজাধারীই হোক না কেন এই গুণাবলি যদি তার মধ্যে না থাকে তবে সে মনুষ্য রূপধারী পশু।

ধর্মীয় বিভেদ ও অন্তর্দ্বন্দ্ব, সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটিয়েছে কারা???

ধর্মীয় বিভেদ ও অন্তর্দ্বন্দ্ব, সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটিয়েছে কারা???


সোয়াইব আল বান্না
সমস্ত পৃথিবীর কোটি কোটি আদম সন্তানকে, ভৌগোলিক, অর্থনীতিক, জাতীয় ইত্যাদি শত-সহস্র ভাগে বিভক্ত করে রেখেছে পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতা। এসব বিভক্তির মধ্যে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক যে বিভক্তি করা হয়েছে তাহলো- ধর্মীয় বিভক্তি। এর পরিণাম হয়েছে সুদূরপ্রসারী, আজও তার ঘানি টেনে বেড়াচ্ছে মানবজাতি। অনেকে বলতে পারেন ধর্মীয় বিভক্তি তো আগে থেকেই ছিল। এটা সত্য যে এটা আগে থেকে ছিল, কিন্তু পশ্চিমা ‘সভ্যতা’ একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। মাত্র কিছুদিন আগে প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার সভাপতি ও সাবেক বিচারপতি মার্কেন্ডি কাতজু বলেছেন, ১৮৫৭ পর্যন্ত ভারতে সাম্প্রদায়িকতা বলতে গেলে ছিলই না। হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে পার্থক্য ছিল বটে, কিন্তু শত্র“তার সম্পর্ক ছিল না। সিপাহী বিদ্রোহের সময়ও হিন্দু ও মুসলিম একতাবদ্ধভাবে ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। বিদ্রোহ দমনের পরে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দেরকে উরারফব ধহফ জঁষব অর্থাৎ ঐক্যহীন করে শাসন করার নীতি গ্রহণ করেন।” ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যে ব্রিটিশদের সৃষ্টি তার ভুরি ভুরি প্রমাণ দেওয়া যাবে। ইতিহাসে ফকীর আন্দোলন ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বলে যে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের কথা জানা যায়, সেটা আসলে একই বিদ্রোহের দু’টি নাম। এতদঞ্চলের হিন্দু এবং মুসলিম শাসক ও জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় ও উভয় সম্প্রদায়ের প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ শাসকের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল, যে বিদ্রোহই পরবর্তীতে সিপাহী বিদ্রোহের রূপ পরিগ্রহ করে। এ সময়ের কথা পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে কাজী নজরুলের একটি লাইন উল্লেখ করছি।
হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারি বলো, ‘ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার’।
অর্থাৎ ভেদাভেদ তৈরির যে প্রচেষ্টা ব্রিটিশ সরকার নিয়েছিল তার বিরুদ্ধে এই কথাগুলি ছিল কবির সাহসী উচ্চারণ। তারা এই উপমহাদেশকে আপাতঃ স্বাধীন করে চলে গেলেও যাওয়ার আগে ধর্মের ভিত্তিতে পাক-ভারতকে ভেঙ্গে ভাগ ভাগ করে রেখে যায় যে ভাগগুলি বিগত বছরগুলিতে নিজেদের মধ্যে বহু যুদ্ধ করেছে এবং আজও একে অপরের বিরুদ্ধে শত্র“ভাবাপন্ন, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত। এমনকি নিজেদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার দাবিতেও সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে বহু মানুষ। এভাবে অশান্তি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে কত যে ভাগ আছে তা বলতে গেলে লেখা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। এক এলাকায় যে দেবতার পূজা করা হয়, অন্য এলাকায় সেই দেবতার নামও অজানা। হৃদয় বিদারক বর্ণভেদ প্রথা আজও হিন্দু সমাজকে কুরে কুরে খাচ্ছে। খ্রিস্টানরা তো শুরুতেই দু’টি প্রধান ভাগে ভাগ হয়ে গেল: ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট। মুসলমানরা বিভক্ত হলো শিয়া, সুন্নি, হানাফি, সালাফি, ওহাবী, মালেকী, শাফেয়ী, হাম্বলী ইত্যাদি শত শত সর্বনাশা ভাগে। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে পাশ্চাত্য সভ্যতা এগুলিকে জাতিগুলির আত্মায় একেবারে পাকাপোক্ত করে দিল। মাদ্রাসাগুলিতে এই শিয়া ও সুন্নী মতবাদ, বিভিন্ন ইমামের মতবাদগুলিকে আলাদাভাবে শেখানো হল, ফলে এই শিক্ষায় শিক্ষিতরা চিরকালের তরে একে অপরের শত্রু বনে গেল। একটি বিষয়ের নামই রাখা হল তর্কশাস্ত্র। অর্থাৎ যত পার মত তৈরি কর, যত পার পথ তৈরি কর। পথ-মত তৈরি করতে করতে এখন এক ইসলামেই হলো হাজার হাজার ভাগ, মত, ফেরকায় বিভক্ত। সারা বিশ্বে মারেফতি তরিকাগত বিভক্তি যে কত আছে তার হিসাব নেই, চিশতীয়া, কাদেরিয়া, মোজদ্দেদীয়া, নকশবন্দিয়া পীরের অনুসাসারীরা আরেক পীরের অনুসারীদের শুধু বিরোধিতা, বা ঘৃণাই করে না হামলা করে হতাহত পর্যন্ত করছে। ভৌগোলিক সীমা থেকে ধর্মীয় সীমারেখা আরো মারাত্মক। ভৌগোলিক সীমারেখা গুলি খেয়ে, ড্রামের ভিতরে ঢুকে, লাশের গাড়িতে করে হলেও পার হওয়া যায়, কিন্তু এই ধর্মীয় সীমানা কোনো অবস্থাতেই পার হওয়া যায় না। একজন খ্রিস্টানকে বৌদ্ধ বানানো বা হিন্দুকে মুসলমান বানানো যতটা না কঠিন, একজন শিয়াকে সুন্নী বানানো বা সুন্নীকে শিয়া বানানো তার চাইতে কঠিন। প্রতি বছর শুধুমাত্র শিয়া, সুন্নি সংঘর্ষে কত হাজার লোক যে নিহত হয় তার সঠিক হিসাব নেই। কি নিদারুন পরিহাস!

আল্লাহর পছন্দনীয় ধর্ম কোনটি?

আল্লাহর পছন্দনীয় ধর্ম কোনটি?





রিয়াদুল হাসান
পবিত্র কোর’আনে মহান আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে একমাত্র পছন্দনীয় জীবনব্যবস্থা হচ্ছে ইসলাম’। তিনি ইসলামকে তোমাদের দীন হিসাবে মনোনীত করেছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর নেয়ামতকে পূর্ণ করেছেন। ইসলাম ছাড়া আর কোনো দীন গ্রহণ করা হবে না। এই আয়াতগুলির উপর ভিত্তি করে ইসলাম ধর্মের অনেক আলেম ওলামা অন্য ধর্মের অনুসারী মানুষের স্বর্গে যাবার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেন এবং একমাত্র মুসলমানেরাই জান্নাতে যাওয়ার হকদার বলে প্রচার করেন। কিন্তু বাস্তবে এই আয়াতগুলির মর্মার্থ কী তা এখানে আলোচ্য বিষয়।
প্রথমেই আসি দীন এবং ইসলাম এই শব্দ দু’টির অর্থ প্রসঙ্গে। দীন শব্দের অর্থ হচ্ছে জীবনব্যবস্থা অর্থাৎ মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে গেলে তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য যে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনীতিক, রাজনীতিক, বিচারিক বিধি-বিধান প্রয়োজন পড়ে সেগুলি হচ্ছে দীন। দীন হতে পারে মাত্র দুই প্রকার: আল্লাহর দেওয়া অথবা মানুষের তৈরি। আল্লাহ যুগে যুগে তাঁর নবী-রসুল-অবতারদের মাধ্যমে যে দীনগুলি পাঠিয়েছেন সেগুলির নাম তিনি দিয়েছেন ‘ইসলাম’। ‘ইসলাম’ শব্দের অর্থ শান্তি। এর তাৎপর্য হচ্ছে- এটি এমন এক জীবনব্যবস্থা যার পরিণামে মানবসমাজে নেমে আসবে অনাবিল শান্তি। তাই শান্তিই হচ্ছে সকল দীনের উদ্দেশ্য এবং উপরোক্ত আয়াত যেখানে আল্লাহ বলছেন যে, ‘ইসলাম’ ব্যতীত আর কোনো দীনকে কবুল করা হবে না, সেখানে তিনি এই শাশ্বত চিরন্তন জীবনবিধানকেই বুঝিয়েছেন যা তিনি তাঁর প্রত্যেক নবী-রসুলকে দিয়ে পাঠিয়েছেন। নবী-রসুল-অবতারদের শিক্ষাকে প্রত্যাখ্যান করে মানুষের মনগড়া অন্যান্য যে জীবনবিধানগুলি যুগে যুগে সৃষ্টি করা হয়েছে সেগুলিকেই মহান আল্লাহ গ্রহণ করবেন না। একজন নবীর আনীত শিক্ষা যখন কালক্রমে বিকৃত করে ফেলা হয় তখন আরেকজন নবী আসেন এবং সেই পূর্বতন নবীর প্রকৃত শিক্ষাকেই সত্যায়ন ও নবায়ন করেন। তাঁরা কেউই পূর্বতন নবীর মূল শিক্ষায় কোনো পরিবর্তন করেন না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, মুসার (আ:) শিক্ষাকে সত্যায়ন করার জন্যই ঈসার (আ:) আবির্ভাব। ঈসা (আ:) নতুন কোনো বিধান নিয়ে আসেন নি, তাঁর প্রচারিত শিক্ষার (ইঞ্জিল) মধ্যে মানুষের জাতীয়-রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনার মতো কোনো আইন-কানুন, অর্থনীতিক ব্যবস্থা বা দণ্ডবিধি পাওয়া যায় না। ধর্মের আত্মা হচ্ছে মানবতা, কিন্তু তওরাতের ধারক-বাহকদের কাছে মানবতার চেয়ে ধর্মের বিধিনিষেধ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যার ফলে ধর্ম হয়ে পড়েছিল ভারসাম্যহীন। ঈসা (আ:) এসে আবার মানবতার পুনস্থাপনা করে ধর্মকে তাঁর যথাস্থানে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই প্রচেষ্টা ইহুদি ধর্মব্যবসায়ীদের ষড়যন্ত্রে সফল হতে পারে নি।
মহানবী মোহাম্মদ (দ:) যখন মদীনায় রাষ্ট্রগঠন করলেন তিনি ইহুদি বা খ্রিস্টানদের উপর কোর’আনের বিধি-বিধান চাপিয়ে দেন নি। এবং ইহুদিরাও আল্লাহর রসুলকে শাসক হিসাবে মেনে নিলেও বিচারক হিসাবে মেনে নিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। আল্লাহর রসুলও তাদেরকে তাদের অভিপ্রায় অনুযায়ী তওরাতের বিধান দিয়েই বিচার করেছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তওরাতে যে বিধান দিয়েছেন সেই বিধান যদি ইহুদিরা মান্য করে সেটাই যথেষ্ট। বরঞ্চ আল্লাহ সেদিকেই তাদেরকে আহ্বান করেছেন, কোর’আন মানতে হুকুম করেন নি। কারণ তওরাতও আল্লাহরই হুকুম। তিনি পবিত্র কোর’আনে প্রশ্ন রেখেছেন যে, “তারা আপনাকে কেমন করে বিচারক নিয়োগ করবে অথচ তাদের কাছে তওরাত রয়েছে। তাতে আল্লাহর নির্দেশ আছে। অতঃপর তারা পেছন দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তারা কখনোই বিশ্বাসী নয়। আমিই তওরাত অবতীর্ণ করেছি। এতে রয়েছে হেদায়াত ও আলো। আল্লাহর আজ্ঞাবহ নবী, দরবেশ ও আলেমরা এর মাধ্যমে ইহুদিদেরকে ফায়সালা দিতেন। কেননা তাদেরকে এই ঐশীগ্রন্থের তত্ত্বাবধান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং তারা এর রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ছিলেন। অতএব তোমরা মানুষকে ভয় কারো না, আমাকে ভয় করো এবং আমার আয়াতসমূহের বিনিময়ে স্বল্পমূল্য গ্রহণ করো না। যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী ফায়সালা (হুকুম) করে না, তারাই কাফের (সুরা মায়েদা ৪৩-৪৪)।
সুতরাং এটা সুস্পষ্ট হলো যে, কেবল কোর’আন দিয়েই যে ফায়সালা দিতে হবে তা আল্লাহ বলেন নি, তিনি বলেছেন ‘আনযালাল্লাহু’ অর্থাৎ আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান। বেদ, তওরাত, জিন্দাভেস্তা, ত্রিপিটক, যবুর, ইঞ্জিলও আল্লাহর অবতীর্ণ, সুতরাং সেগুলি দিয়ে ফায়সালা দিলেও সেটা ইসলামেরই ফায়সালা, সেটাই সমাজে শান্তি আনবে। আর কাফের তো তারাই যারা আল্লাহর কোনো বিধান দিয়েই ফায়সালা দিতে রাজি না, যারা নিজেদের মনগড়া বিধানের পক্ষপাতী। সেটা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ সেটা শান্তি আনবে না।
একইভাবে আল্লাহ ঈসা (আ:) এর উপর অবতীর্ণ ইঞ্জিলের অনুসারীদেরকে কোর’আনের বিধান মানতে জোর করেন নি। তিনি বলেছেন, ‘আমি মরিয়ম তনয় ঈসাকে ইঞ্জিল প্রদান করেছি। এতে হেদায়াত ও আলো রয়েছে। এটি পূর্ববর্তী গ্রন্থ তওরাতের সত্যায়ন করে পথপ্রদর্শন করে এবং এটি মুত্তাকীদের জন্য হেদায়াতসহ উপদেশবাণী। ইঞ্জিলের অধিকারীদের উচিত আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুযায়ী ফায়সালা করা। যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই ফাসেক (অবাধ্য) (সুরা মায়েদা ৪৬-৪৭)।
একইভাবে বৈদিক ধর্ম যখন আত্মাহীন হয়ে গিয়েছিল তখন সর্বজীবে করুণার বাণী নিয়ে এসেছিলেন গৌতম বুদ্ধ (আ:)। স্বামী বিবেকানন্দ গৌতম বুদ্ধকে নবী ঈসার (আ:) সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, “বুদ্ধদেব এর শিষ্যগণ তাঁহাকে ঠিক ঠিক বুঝিতে পারেন নাই। ইহুদিধর্মের সহিত খ্রিস্টানধর্মের যে সম্বন্ধ, হিন্দুধর্ম অর্থাৎ বেদবিহিত ধর্মের সহিত বর্তমানকালের বৌদ্ধধর্মের প্রায় সেইরূপ সম্বন্ধ। যীশুখ্রিস্ট ইহুদি ছিলেন ও শাক্যমুনি (বুদ্ধদেব) হিন্দু ছিলেন। শাক্যমুনি নতুন কিছু প্রচার করিতে আসেন নাই। যীশুর মতো তিনিও (পূর্ব ধর্মমতকে) ‘পূর্ণ করিতে আসিয়াছিলেন, ধ্বংস করিতে আসেন নাই।’” [বিশ্বধর্ম মহাসভায় প্রদত্ত বক্তৃতা]।
একটি বৃক্ষের মধ্যে বহু শাখা প্রশাখা ও অসংখ্য পত্র-পল্লব থাকে, কিন্তু সেগুলি সব একই বৃক্ষের পরিচয় বহন করে, তারা একই বৃক্ষের অংশ হিসাবে পরিচিত হয়। বৃক্ষে যে ফল ধরে তার নামে ঐ বৃক্ষের নামকরণ হয়। তেমনি আল্লাহ যে জীবনব্যবস্থা যুগে যুগে নাজেল করেছেন সবগুলি মূলত একই বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা এবং সেই বৃক্ষের ফল হচ্ছে শান্তি। ফলের নামে এই দীনরূপ বৃক্ষের নাম আল্লাহ রেখেছেন ইসলাম বা শান্তি। উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন, একমাত্র যে জীবনব্যবস্থায় শান্তি আসবে সেটাই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য জীবনব্যবস্থা। একই বৃক্ষের ভিন্ন শাখায় যেমন পৃথক ফল ধরে না, তেমনি কোনো ধর্মেই অশান্তি হয় না, সকল ধর্মই শান্তিময়। তাই আদম (আ:) থেকে শুরু করে শেষ নবী মোহাম্মদ (দ:) পর্যন্ত যে শাশ্বত জীবনব্যবস্থা আল্লাহ পাঠিয়েছেন সেগুলি আলাদা আলাদা দীন নয়, সেগুলি একই দীন। এজন্য এর আরেক নাম দীনুল কাইয়্যেমাহ বা সনাতন জীবনব্যবস্থা- যে জীবনব্যবস্থা আদি, নিত্য, চিরন্তন, যা ছিল-আছে-থাকবে। খানিক আগে যে কথাটি বলে আসলাম যে, প্রতিটি ধর্মের মূল শিক্ষায় এবং ভিত্তিতে কোনো পার্থক্য আসে নি। সেই মূল শিক্ষা হচ্ছে- স্রষ্টার শর্তহীন আনুগত্যই শান্তির মূল। তাদের উপাসনা পদ্ধতি যতই আলাদা হোক, উপাস্য তো আলাদা নয়। প্রতিটি ধর্মের মানুষ যদি সেই সৃষ্টিকর্তার বিধান মেনে চলতে সম্মত থাকে, সেই বিধান বেদেরই হোক, তওরাতেরই হোক, ইঞ্জিলেরই হোক, যবুরেরই হোক বা কোর’আনেরই হোক তারা অবশ্যই সামগ্রিক জীবনে শান্তির দিকে ধাবিত হবে।
প্রকৃত ইসলামের বৃক্ষের সন্নিকটেই দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি বৃক্ষ যার ফলগুলি বিষাক্ত। এটা হচ্ছে মানবরচিত জীবনব্যবস্থা যার চিরন্তন ফল অন্যায়, অশান্তি, রক্তপাত, ঘৃণা। এই বিষবৃক্ষকে আল্লাহ প্রত্যাখ্যান করবেন। এ কথাই তিনি বলেছেন যে, ইসলাম (শান্তি) ছাড়া আর কোনো দীন গ্রহণ করা হবে না।
মানবজাতির শান্তির জন্য যে বিধি বিধান প্রয়োজন তা আল্লাহ অগণিত প্রেরিতের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়েছেন। শেষ রসুল মোহাম্মদ (দ:) এর উপর অবতীর্ণ পবিত্র কোর’আনের মাধ্যমে ইসলাম নামক জীবনব্যবস্থার শেষ ইষ্টকখানা সংযুক্ত হয়েছে। আর নতুন কোনো বিধান আসবে না, বিধান আসার পর্ব শেষ। একেই আল্লাহ বলেছেন, তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামতকে পূর্ণ করলাম। শেষ নবীর উপর আল্লাহ যে দায়িত্ব দিয়েছেন সমগ্র পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। আল্লাহ বলেছেন, “তিনি তাঁর রসুল প্রেরণ করেছেন পথনির্দেশ ও সত্য জীবনব্যবস্থা সহকারে যেন রসুল একে অন্যান্য সকল জীবনব্যবস্থার উপরে বিজয়ী করে”। এখানেও আল্লাহ হিন্দু-বৌদ্ধ-ইহুদি-খ্রিস্টান ধর্মকে নির্মূল করতে বলেন নি, কেবল বলেছেন জাতীয় জীবনে যেন মানুষের মনগড়া বিধান না চালু থাকে, সেখানে যেন আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করা হয়। আর অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদেরকে যেন স্বাধীনভাবে ধর্মপালনের সুযোগ করে দেওয়া হয়। রসুলাল্লাহর হাতে গড়া জাতিটি যেখানেই সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করেছেন সেখানেই অন্য ধর্মের উপাস্য ও উপাসনালয়কে সুরক্ষা দিয়েছেন- এর বহু দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে অঙ্কিত আছে। তবে শেষ নবী এবং শেষ বিধান এসে গেলেও বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে থেকে ধর্ম-সংস্কারক, মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হতেই পারে, তবে তাঁদেরও কাজ হবে সেই অধর্মের বিনাশ ও সাধুদিগের পরিত্রাণ।
এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমরা যদি সত্যিই চাই পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক, তাহলে মানবজাতিকে যে ভাবেই হোক শান্তির পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। যারা নাস্তিক বা নিরিশ্বরবাদী তারাও শান্তি চান, যারা ধার্মিক তারাও শান্তি চান। তাই মানবতার পক্ষে, শান্তির পক্ষে আস্তিক-নাস্তিক, সংশয়বাদী সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে। শান্তি আসবে স্রষ্টার বিধানে এটা অব্যয়, অক্ষয় এবং ঐতিহাসিক সত্য। আল্লাহর বিধান মান্য করার অনিবার্য্য ফল শান্তি ও নিরাপত্তা। আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাসীরাও যদি তাদের জীবনে আল্লাহর বিধান মান্য করে অবশ্যই তাদের সমাজ থেকেও সকল অন্যায়, অবিচার লুপ্ত হয়ে শান্তি কায়েম হবে। তবে পৃথিবীতে শান্তিতে থাকা আর পরকালে জান্নাতে যাওয়া নিশ্চয়ই এক বিষয় নয়। পরকালের সঙ্গে বিশ্বাস জড়িত। স্বর্গে যাবার জন্য আল্লাহ যে বিষয়গুলি বিশ্বাস করতে বলেছেন সেগুলি বিশ্বাস করতে হবে। এখানেই প্রশ্ন, ইসলামের শেষ সংস্করণ এসে যাওয়ার পরও ইসলাম গ্রহণ না করে, পূর্ববর্তী ধর্মবিশ্বাসে স্থির থেকে কেউ কি স্বর্গে যেতে পারবেন?
এর জবাব হচ্ছে, হ্যাঁ, অবশ্যই তাদেরও জান্নাতে যাওয়ার পথ খোলা আছে। এক্ষেত্রে শর্ত হলো, তাদেরকে শেষ নবী ও শেষ গ্রন্থ কোর’আনকে সত্য বলে বিশ্বাস করতে হবে। এটি শাশ্বত সত্য যে, বিশ্বাসী হিসাবে পরিগণ্য হতে হলে ধর্মের কয়েকটি মূল বিষয়ের উপর বিশ্বাস থাকতেই হবে। সেগুলি হচ্ছে: আল্লাহর উপর, মালায়েকদের উপর, সকল ঐশীগ্রন্থের উপর, সকল নবী-রসুলগণের উপর, কেয়ামত দিবসের উপর, ভাগ্যের ভালো-মন্দের নিয়ন্ত্রক আল্লাহ এ কথার উপর এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের উপর। তাই শেষ নবী এবং শেষ কেতাবের উপর অবিশ্বাস রেখে জান্নাতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই তেমনিভাবে পূর্ববর্তী কোনো নবী-রসুল-অবতার এবং তাঁদের আনীত কেতাবের প্রতিও অবিশ্বাস রেখে জান্নাতে যাওয়ার আশা করে লাভ নেই। এটাই রসুলাল্লাহ সুস্পষ্টভাষায় বলে দিয়েছেন, ‘আমার আহ্বান যার কানে পৌঁছালো সে যদি আমার উপর ঈমান না এনে মৃত্যুবরণ করে তবে সে অবশ্যই জাহান্নামী।’-হাদিস
প্রমাণ হিসাবে আমরা আবিসিনিয়ার খ্রিস্টান বাদশাহ নাজ্জাশিকে গ্রহণ করতে পারি। তিনি রসুলাল্লাহকে সত্য নবী এবং কোর’আনকে আল্লাহর বাণী বলে স্বীকার করে নিলেও কার্যত ইসলাম কবুল করেন নি, তবে সত্য প্রচারে অনেক সহযোগিতা করেছিলেন। নাজ্জাশী ইন্তেকাল করেছিলেন তাবুক যুদ্ধের পর নবম হিজরীতে। আল্লাহর রসুল নাজ্জাশীর এন্তেকালের সঙ্গে সঙ্গেই সাহাবাদেরকে বলেন- ‘তোমরা তে ামাদের ভাইয়ের জানাযা পড় যিনি তোমাদের দেশ ব্যতীত অন্য দেশে মৃত্যুবরণ করেছেন।’ রসুলাল্লাহ যখন জানাযায় দাঁড়ালেন তখন কয়েকজন মুনাফেক মন্তব্য করে যে, রসুলাল্লাহ একজন কাফেরের জানাযা পড়াচ্ছেন। এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ সুরা আল ইমরানের ১৯৯ নং আয়াত নাজেল করলেন, যেখানে বলা হয়েছে- ‘গ্রন্থধারীদের কেউ কেউ এমনও রয়েছে, যারা আল্লাহর উপর ঈমান আনে এবং যা কিছু তোমার উপর অবতীর্ণ হয় আর যা কিছু তাদের উপর অবতীর্ণ হয়েছে সেগুলোর উপর, আল্লাহর সামনে বিনয়াবনত থাকে এবং আল্লাহর আয়াতসমুহকে স্বল্পমূল্যের বিনিময়ে সওদা করে না, তারাই হলো সে লোক যাদের জন্য পারিশ্রমিক রয়েছে তাদের পালনকর্তার নিকট। নিশ্চয়ই আল্লাহ যথাশীঘ্র হিসাব চুকিয়ে দেন।’ সুতরাং নাজ্জাশী মুসলমান না হয়েও শেষ নবীকে আত্মা থেকে বিশ্বাস করে তাঁকে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সাহায্য করার জন্য জান্নাতবাসী হয়েছেন। সুতরাং একই কথা হিন্দু-বৌদ্ধ-ইহুদিসহ সকল ধর্ম-সম্প্রদায়ের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য।

Thursday, December 24, 2015

ঐক্যই শক্তির আধার

ঐক্যই শক্তির আধার


আল্লাহ যে সকল নিয়ম দিয়ে তাঁর সৃষ্টিজগৎ পরিচালনা করেন সেগুলো প্রাকৃতিক এবং চিরন্তন, শাশ্বত (Etarnal) নিয়ম। বাহ্যিক চোখে আমরা অনেকে বস্তুর পরিবর্তন হতে দেখলেও প্রকৃতপক্ষে ঐ নিয়মগুলোর কখনোই কোনো পরিবর্তন হয় না। যেমন আগুনের ধর্ম হচ্ছে সে সব কিছুকে পুড়িয়ে দেবে। এটা হাজার বছর আগে যেমন সত্য ছিল তেমনি হাজার বছর পরেও একইরকম থাকবে। আবার পানিকে মুক্ত করে দিলে সে নিু ভূমিতে ছড়িয়ে পড়বে- এটাও প্রাকৃতিক নিয়ম। আল্লাহ মানবজাতিকে শান্তি, সুখ ও সমৃদ্ধিতে বসবাস করার জন্য দয়াপরবশ হয়ে এমনি কতগুলো নিয়ামক দান করেছেন। এর মধ্যে মতভেদ ও বিভক্তি না করে ঐক্যবদ্ধ থাকার গুরুত্ব অপরিসীম। এ জন্য তিনি প্রত্যেক নবী-রসুলদের মাধ্যমে পাঠানো জীবনব্যবস্থায় মানুষকে ঐক্যবদ্ধ থাকার হুকুম দিয়েছেন। তিনি কোর’আনে বলেছেন, “আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন যারা সীসা ঢালা প্রাচীরের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করে (সুরা সওফ-৪), গলিত সীসার দেয়ালে একটি সূঁচ ঢোকার জায়গাও থাকে না। সুরা আল ইমরানের ১০৩ নং আয়াতে বলেছেন- ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর রজ্জু (হেদায়াহ, দীন) ধরে রাখতে, বিচ্ছিন্ন না হতে। যাদের কাজে, কথায় ঐক্য নষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে তাদের জন্য রেখেছেন কঠিন শাস্তি, আযাব কোর’আনের বহু স্থানে। যে সব কাজে ও কথায় উম্মাহর ঐক্য নষ্ট হবার সম্ভাবনা আছে সে সব কাজকে আল্লাহর রসুল সরাসরি কুফর বলে আখ্যায়িত করেছেন।
কেবল শেষ দীনেই নয়, ইতঃপূর্বে আল্লাহ যত নবী রসুল পাঠিয়েছেন এবং তাদের প্রতি যত কিতাব নাজিল করেছেন সর্বত্র জাতির ঐক্যের বিষয়ে বিরাট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বাইবেলে যিশু (ঈসা আ.) বলেছেন, “যে রাজ্য আত্মকলহে নিজেদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়, সেই রাজ্য ধ্বংস হয়? আবার কোন পরিবার যদি নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে, তবে সেই পরিবারও ভেঙ্গে যায়” (বাইবেল- লূক ১১: ১৭)। এখানেও ঐক্যহীন হতে নিষেধ করা হয়েছে। ঐক্য ছাড়া কোনো অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না। প্রকৃতির দিকে তাকালেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঐক্যের নিদর্শন।
সনাতন ধর্মের গ্রন্থগুলিতেও ঐক্যের বিষয়ে বলা আছে। যেমন মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে মহাত্মা বিদুর বলেছিলেন, “দৃঢ়বদ্ধমূল অতিমহৎ একমাত্র মহীরুহ সমীরণভরে অনায়াসে মর্দিত ও পতিত হইয়া থাকে, কিন্তু বহু বৃক্ষ একত্র মিলিত ও বদ্ধমূল হইলে অক্লেশে প্রবল বায়ুবেগ সহ্য করিতে পারে; এইরূপ গুণসমন্বিত ব্যক্তিও একাকী হইলে শত্র“গণ তাঁহাকে পরাজয় করা অনায়াসসাধ্য মনে করিয়া থাকে।” সরল বাংলায় বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে যদি বিরাট কোনো বৃক্ষ একাকী দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে প্রবল ঝড়ে সেটা উপড়ে পড়ে যায়। পক্ষান্তরে বহুসংখ্যক বৃক্ষ একত্রিতভাবে থাকলে প্রবল ঝড়েও তাদের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। একইভাবে অতি বড় বীরও একা থাকলে শত্র“রা তাকে পরাজিত করাকে সহজ মনে করে। ঐক্যের শক্তি কত বিরাট তা এই প্রাকৃতিক ঘটনাটির মধ্যেই সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
আজ আমাদের দেশের এই ষোল কোটি মানুষ শত সহস্রভাবে বিভক্ত হয়ে আছে। তারা বিচ্ছিন্ন গাছের মতো একাকী ও শক্তিহীন। তাই যে কোনো হালকা ঝড়েও তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যায়।

দান কেমন হওয়া উচিত

দান কেমন হওয়া উচিত


প্রতিটি কাজের মধ্যে দু’টি অংশ থাকে। একটি বাহ্যিক একটি আত্মিক। যেমন আপনি কাউকে খেতে দিলেন। এর মধ্যে আহার হচ্ছে বাহ্যিক আর আন্তরিকতা হচ্ছে আত্মিক। উভয়ের যে কোনো একটির অভাবে পুরো কাজটিই অর্থহীন হয়ে যাবে।
বৈষয়িক জীবন আর ধর্ম এভাবেই একে অপরকে অর্থপূর্ণ করে।
আমরা যাকাত দিতে দেখি, ত্রাণকার্য দেখি। আবার মানুষ মসজিদ-মন্দিরেও দান করে, ভিক্ষুককে দান করে। এগুলো সবই দান। যাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে বছর বছর কত মানুষকে পদপিষ্ঠ হয়ে মরতে দেখা যায়। দান বা ত্যাগ মানুষের আত্মাকে শুদ্ধ করার জন্য করা হয়। কিন্তু এই দানের মধ্যে কি আত্মার সংযোগ থাকে?
সনাতন ধর্মের গ্রন্থ তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে ‘শ্রিয়া দেয়ম্’। মানে বাংলায় অপভ্রংশে ছিরি অর্থাৎ দান করার মধ্যে যেন ছিরি-ছাঁদ থাকে। ফেলিয়ে-ছড়িয়ে, ছুঁড়ে ফেলে নয়। সেই দানের মধ্যে যেন সৌন্দর্য আর মর্যাদা ফুটে ওঠে।
আরো বলছে, ‘হ্রিয়া দেয়ম্’। হ্রী মানে লজ্জা। দানের মধ্যে যেন লজ্জা থাকে। অর্থাৎ দিচ্ছি বলে যেন কোনো ঔদ্ধত্য তৈরি না হয়। নিজের অহমিকা ও আত্মসচেতনতা নিজেই লাঘব করে দান করতে হবে।
তৃতীয় কথা- ‘শ্রদ্ধয়া দেয়ম্’- শ্রদ্ধার সঙ্গে দেবে। দান গ্রহণকারী ব্যক্তির প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা নিয়ে দিতে হবে। আর যদি অশ্রদ্ধা থাকে, তবে উপনিষদ পরিষ্কার নিষেধ করে দিয়েছে- ‘অশ্রদ্ধয়া অদেয়ম্’- অর্থাৎ শ্রদ্ধা না থাকলে দিও না, সেও অনেক ভালো। কিন্তু দিতে যদি হয়, তবে ঐ সৌন্দর্য, অহমিকাহীনতা এবং শ্রদ্ধা এই তিনটিই থাকা দরকার। আর এই সবগুলি মিলিয়েই হয় আন্তরিকতা যা দানের আত্মা।
দানকারীকে এটি মনে রাখতে হবে যে, তার দানকার্য থেকে সে নিজেই অধিক উপকৃত হচ্ছে, তার আত্মার পবিত্রতা ও সমৃদ্ধি অর্জিত হয়। যে দান গ্রহণ করছে সে কিছু অর্থ-সম্পদ লাভ করলেও তার আত্মিক হানি ঘটছে।
বর্তমানে ত্যাগ করা হয় ভোগের জন্য, খ্যাতির জন্য। প্রকৃত ত্যাগ তো সেটাই যাতে মানুষের আত্মায় ব্যাথা অনুভূত হবে। যেমন বৃদ্ধ বয়সের সন্তানকে জাতির পিতা ইব্রাহীম (আ.) কোরবানি দিতে আদিষ্ট হয়েছিলেন এবং তা পূর্ণ করেছিলেন। এর মানে তিনি তাঁর মিল্লাত বা জাতির সবাইকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করে গেছেন। কারণ মানুষের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন ও সম্পদ কোরবান করা অনিবার্য।
সবাই যদি ব্যক্তিজীবন যাপন করে তাহলে কখনোই মানবজাতির সামষ্টিক জীবনে শান্তি আসবে না। যুদ্ধ রক্তপাত বন্ধ হবে না, সমাজ থেকে অন্যায় অপরাধ হ্রাস পাবে না, কেউ নিরাপত্তায় থাকবে না। তাই মো’মেনদেরকে ব্যক্তিজীবনকে প্রাধান্য না দিয়ে সমাজের প্রতিটি দুঃখী, আর্ত, নিপীড়িত মানুষের দুঃখকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে এবং অন্যায়ে বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এই কাজে যদি তাকে জীবন দিতে হয় সেটাই হবে প্রকৃত কোরবানি।

আমি কারো সেবা নিতে আসিনি, এসেছি সেবা করার জন্য

আমি কারো সেবা নিতে আসিনি, এসেছি সেবা করার জন্য



আমি কারো সেবা নিতে আসিনি, এসেছি সেবা করার জন্য। (বার্নাবাসের বাইবেল- ৫০)। প্রতিটা ধর্মের মূল লক্ষ্যই হলো মানুষের কল্যাণ, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা। আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ যুগে যুগে মানবসমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই নবী-রসুল, অবতারগণকে প্রেরণ করেছেন। তাঁরা প্রত্যেকে ছিলেন আমাদের শিক্ষক। তাঁদের প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ অনুকরণীয়, অনুসরণীয়। ধর্ম পালন করা মানেই হলো তাদের পূর্ণ অনুসরণের চেষ্টা করা। যারা তাদের শিক্ষাকে নিজের জীবনে যত বেশি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে সে তত বড় ধার্মিক হবে, উভয় জীবনে সফল হবে। এখানে ঈসা (আ.) বলছেন তিনি সেবা নিতে আসেননি বরং সেবা করতে এসেছেন। তাহলে ধর্মের ধারক সেজে সেবা পাবার অধিকারী আর কে হতে পারে? কোনো ধর্মের অনুসরণই কাউকে সেবা পাবার অধিকারী করতে পারে না বরং অন্য মানুষের কল্যাণে, অন্যের সেবাই নিজেকে উৎসর্গ করতে শেখায়। সকল নবী-রসুল, অবতার, মহামানবগণই নিজেদের জীবন বিলিয়ে গেছেন মানুষের সেবায়। কিন্তু আজকের সমাজে দেখা যায় কিছু মানুষ ধর্মকে পুঁজি স্বার্থ হাসিল করে, ধর্মের ধারক-বাহক সেজে ব্যবসা করে, সেবাদানের পরিবর্তে সেবা গ্রহণের জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে। মনে রাখতে হবে, যারা প্রকৃত ধার্মিক তারা কখনো কারো জুতা মারার প্রচেষ্টা করবে না বরং তারা মানুষের জুতা পরিষ্কার করার জন্যই প্রচেষ্টা করবে। আর যারা ধর্মকে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থ হাসিল করতে চায়, মানুষের কষ্ট দিতে চায়, মানুষ হত্যা করতে চায় তারা আসলে ধর্মের অনুসারী নয়, তারা ভণ্ড, প্রতারক।
অন্য জায়গাতে এসেছে, “লক্ষ রেখ, যেন তোমাদের আসক্তি বা প্রেম দিয়ে ক্ষুদ্রতম কোনো ভাবনার কেনাবেচা না হয় যাতে তোমাদের লাভের অংকটি শূন্য। বরং তোমাদের ভাবনা, বাক্য ও কর্ম সবই যেন আল্লাহর উদ্দেশে নিবেদিত হয়, আর তাতেই সেই দিবসে (হাশরের দিন) নিরাপত্তা অর্জিত হবে। (বার্নাবাসের বাইবেল- ৬২)। অর্থাৎ ধর্মের কাজের কোনো বিনিময় চলে না, বিনিময় যদি এ পৃথিবীতেই নিয়ে নেওয়া হয় তবে তো হাশরের দিন বিনিময়ের পাল্লা শূন্য থেকে যাবে। ধর্মের কাজ, মানুষের সেবামূলক কাজ কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় করতে হবে তবেই তা আল্লার নিকট গ্রহণযোগ্য হবে। যদি পার্থিব স্বার্থে কোনো কাজ করা হয় তবে আর যাই হোক তা ধর্মের নামে চালানো যাবে না। ঐ কাজের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। আল্লাহর রাস্তায় কাজের বিনিময়ে একটি ইটের আশাও করা উচিত নয়, এটা আল্লাহর রাস্তায় নিবেদিতপ্রাণ মোজাহেদের সম্মানের সাথেও যায় না। হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা, মাননীয় এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী তাঁর কথা ও কাজ দ্বারা এ শিক্ষায় দিয়ে গেছেন। এজন্য হেযবুত তওহীদ সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিজেদের জীবন-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে যাচ্ছেন নিরন্তর কিন্তু এর ন্যূনতম বিনিময় তারা কারো কাছে চায় না।  তারা বিনিময় আশা করে কেবল মহান আল্লাহর নিকট থেকে। এ কাজে তাদের পার্থিব কোনো বিনিময় নেই, তারা কেবল এর বিনিময়ে জান্নাত চায়, জান্নাতের সুউচ্চ স্তরে যেতে চায়।  হেযবুত তওহীদ সকলকে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষার দিকে আহ্বান করে।

জান্নাতের পূর্বশর্ত তওহীদ, সালাহ নয়

জান্নাতের পূর্বশর্ত তওহীদ, সালাহ নয়


মোহাম্মদ জাকারিয়া হাবিব
সালাহ্ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মহান আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে ৮০ বারেরও বেশি সালাহ্’এর কথা উল্লেখ করেছেন। ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্পর্কে আকিদা অর্থাৎ ধারণা আজ বিকৃত হয়ে গেছে। কেউ একে মনে করছে ধ্যান, কেউ মনে করছে শারীরিক ব্যায়াম, কেউ মনে করছে আল্লাহর সামনে প্রণতি স্বীকারের পন্থাবিশেষ, কেউ কিছুই মনে করছে না, ভাবছেন আল্লাহ করতে বলেছেন তাই করতে হবে। অথচ একটি জিনিস সম্পর্কে যদি সঠিক ধারণাই না থাকে তাহলে সেটা থেকে কারও কোনো উপকার হাসিল করা সম্ভব নয়। যেমন আপনাকে একটি মোবাইল ফোন দেওয়া হলো যেটার মধ্যে আধুনিক সকল সুবিধা আছে কিন্তু সেগুলি কিভাবে ব্যবহার করতে হয় আপনি জানেন না, তাহলে কি সেই মোবাইলটি দিয়ে আপনি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন? তেমনি নামাজ সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় এ থেকে কেউ কোনো উপকার লাভ করছে না, তবু আল্লাহ বলেছেন বিধায় পড়েই যাচ্ছে, পড়েই যাচ্ছে। সঠিক ধারণা না থাকার কারণে অনেক মিথ্যা কথা নামাজের পক্ষে চালু হয়ে আছে যা কোর’আনেও নেই হাদিসেও নেই। যেমন- বিভিন্ন জায়গায় লেখা দেখা যায়- ‘নামাজ জান্নাতের চাবি।’ অথচ এই কথাটি সঠিক নয়, জান্নাতের চাবি হচ্ছে তওহীদ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া জীবনের কোনো অঙ্গনে আর কারও বিধান মানি না এই সাক্ষ্য দেওয়া।
আরেকটি কথা ছোট কাল থেকে শুনে আসছি, বিশেষতঃ সমাজে একটি দল আছে যারা মানুষকে নামাজের দাওয়াত দেয়, তারা বলে, “এক ওয়াক্ত ফরজ নামাজ বিনা কারণে কাযা করলে এক হোব্বা বা ২ কোটি ৮৮ লক্ষ বছর জাহান্নামের দাউ দাউ করা আগুনে জ্বলতে হবে”। এই কথাটিও না আছে কোর’আনে, না আছে হাদিসে। ফাজায়েলে নামাজ নামক একটি গ্রন্থে এই কথাটি উল্লেখ আছে, সেখানে লেখক বলেছেন, ‘হাদিসে আছে’। কিন্তু তিনি বলেন নি যে, কোন হাদিসে আছে। কোন এবারত, সনদ কিছু ছাড়াই একটি কথাকে হাদিস বলে চালিয়ে দেওয়া কতটুকু গ্রহণযোগ্য? প্রকৃতপক্ষে এটি কোনো হাদিস নয়, এটি তাদের মনগড়া কথা। এই মনগড়া কথাটি উপর্যুপরি প্রচারের ফলে মানুষের মনে গেঁথে গেছে যে, নামাজ পড়লেই জান্নাতে যাওয়া যাবে এবং না পড়লে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে। এই জন্য অনেকেই অন্য কিছুর চিন্তা না করে শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েই নিজেদেরকে পাক্কা মুমিন ও জান্নাতি মনে করেন।
সালাহ্ ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফরদ অর্থাৎ অবশ্যকরণীয়। কিন্তু সালাহ্, যাকাহ্, হজ্ব, সওম এমনকি জিহাদ পর্যন্ত ইসলামের সকল কাজের পূর্ব শর্ত হচ্ছে আল্লাহকে একমাত্র এলাহ্ (হুকুমদাতা) হিসাবে গ্রহণ করে নেওয়া। এই লা-এলাহা এল্লা আল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া হুকুমদাতা নাই অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বা তওহীদের ঘোষণা ছাড়া কেউ মুমিন হতে পারে না। তবে এখানে মনে রাখতে হবে যে, এই তওহীদ বর্তমানের ব্যক্তি জীবনের আংশিক তওহীদ নয়, এ তওহীদ সার্বিক জীবনের তওহীদ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, শিক্ষা ইত্যাদি মানব জীবনের সর্ব অঙ্গনের তওহীদ অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব। অর্থাৎ জীবনের সর্ব অঙ্গনে যেখানে আল্লাহ ও তার রসুলের কোনো বক্তব্য আছে সেখানে আর কারও কোনো হুকুম না মানা। যে বা যারা আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে নিয়ে নবী রসুলদের মাধ্যমে পাঠানো আইন-কানুন, আদেশ-নিষেধকে তাদের সমষ্টিগত জীবনে প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োগ করবে তাদের আমল তিনি গ্রহণ করবেন, ব্যক্তিগত সমস্ত অপরাধ, গোনাহ মাফ করে তাদের জান্নাতে স্থান দেবেন। এই প্রতিশ্রুতি সমগ্র কোর’আনে ও সহীহ হাদিসে ছড়িয়ে আছে। এটাকে আরও পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেবার জন্য আল্লাহর রসুল তাঁর বিশিষ্ট সাহাবা আবু যরকে (রা.) বললেন-যে লোক মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর তওহীদের ওপর অটল থাকবে সে ব্যভিচারী ও চোর হলেও জান্নাতে প্রবেশ করবে (হাদিস-আবু যর গিফারী (রা.) থেকে বোখারী ও মুসলিম)।
অতএব জান্নাত ও জাহান্নাম নির্ভর করছে তওহীদের উপরে; সালাহ্ করা আর না করার উপরে নয়। সালাহ্ কাদের জন্য তা আল্লাহ কোর’আনে ঘোষণা করেছেন, হে রসুল আমার বান্দাদের মধ্যে যারা মুমিন তাদেরকে তুমি বল সালাহ্ কায়েম করতে (সুরা-এব্রাহিম,আয়াত-৩১)। আর এই সালাহ্ হচ্ছে ঐ তওহীদ ভিত্তিক জীবন ব্যবস্থাটি সর্বাত্মক সংগ্রামের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্য যে চরিত্র দরকার সেই চরিত্র তৈরির প্রশিক্ষণ। এটা ইতিহাস যে, আল্লাহর রসুলের অনেক সাহাবী জীবনে এক ওয়াক্ত সালাহ্ কায়েম করার সুযোগ পাননি, রসুলের হাতে তওহীদের বায়াত গ্রহণ করেই জিহাদে, সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এবং শাহাদাত বরণ করে জান্নাতে চলে গেছেন। নামাজ বা সালাহ্ যদি জান্নাতের চাবি হতো তাহলে আল্লাহর রসুল নবুয়্যত পেয়েই মানুষকে বলতেন, ‘তোমরা নামাজ পড়’; তাহলেই তোমরা জান্নাতি হবে আর নামাজ যদি না পড় তাহলে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে।’ কিন্তু তিনি কি তাঁর জীবনে একবার ও এমন কথা বলেছেন? বলেন নি। এমন কি পবিত্র কোর’আনে এমন একটি আয়াত ও নেই যেখানে বলা হয়েছে, ‘সালাহ্ কায়েম করলে জান্নাতে যাওয়া যাবে, আর না করলে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে।’ বরং জান্নাত ও জাহান্নাম নির্ভর করে তওহীদের উপরে।
উম্মতে মোহাম্মদী সৃষ্টির আসল উদ্দেশ্য- জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় দীন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করা। রসুলাল্লাহর ৬০/৭০ বছর পরে যখন জাতি সেই সংগ্রাম ত্যাগ করল, তখন আত্মপক্ষ সমর্থনের উদ্দেশ্যে বহু জাল হাদিস উদ্ভাবন করা হয়। “নামাজ বেহেস্তের চাবি”, “এক ওয়াক্ত নামাজ কাযা করলে এক হোব্বা বা ২ কোটি ৮৮ লক্ষ বছর জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে”- তেমনই দুইটি বানোয়াট হাদিস। যে অসৎ উদ্দেশ্যে এই হাদিস উদ্ভাবন করা হয়েছে সেই উদ্দেশ্য শতভাগ সফল হয়েছে। যার প্রমাণ এই জনসংখ্যা এখন সম্পূর্ণ সংগ্রামবিমুখ এবং তাদের কাছে ইসলাম মানেই নামাজ। তাদের আকিদায় এখন জাতীয় জীবনে আল্লাহর হুকুমের কোনো অস্তিত্ব নেই, প্রয়োজনও নেই। আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করারও কোনো দরকার নেই। তাদের দরকার শুধু নামাজ আর নামাজ। কুফর ও শিরক’র সাগরে নিমজ্জিত থেকেও তারা মনে করে যে শুধু নামাজ পড়েই তারা জান্নাতে চলে যাবেন।
সাবধান আমার কথা থেকে কেউ যেন এটা মনে না করে যে, আমি সালাহ্কে খাটো করছি। পূর্বেই বলেছি যে, মহান আল্লাহ তাঁর কোর’আনে ৮০ বারের ও অধিক সালাহ্র কথা বলেছেন। যে সালাহ্ পবিত্র মেরাজে নিয়ে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীবকে শিক্ষা দিলেন, যে সালাহ্ দৈনিক ৫ বার ফরদ সে সালাহ্কে মুমিন খাটো করে দেখতে পারে না। আমি বলতে চেয়েছি, যেটা যে স্থানে থাকা দরকার সেটাকে সে স্থানে রাখাই ন্যায়সঙ্গত, অতিরঞ্জিত করা অন্যায়। তওহীদ ছাড়া সালাহ্র কোনো দামই নেই। নবী করিম (স:) মক্কার ১৩ বছর জীবনে শুধু তওহীদের বালাগ দিয়েছেন। নবুয়্যত প্রাপ্তির ১১ তম বৎসরে পবিত্র মেরাজে গিয়ে রসুল (দ:) সালাহ্ আনলেন, এর মধ্যে যারা শহীদ হয়েছিলেন অথবা মৃত্যু বরণ করেছিলেন তাঁরা তো শুধু তওহীদ নিয়েই জান্নাতে গেলেন। তাঁর নিকট প্রথমে কেউ আসলে তাকে শুধু তওহীদের দিকেই আহবান করতেন। যে তওহীদে আসবে তার জন্যেই সালাহ্। সালাহ্র কথা ৮০ বার কিন্তু তওহীদের কথা সহস্রবার বলা হয়েছে। পবিত্র কোর’আনে সবচাইতে আলোচিত বিষয় তওহীদ, সকল নবীর আনীত দীনের ভিত্তি এই তওহীদ। অথচ আজ সেই তওহীদ পৃথিবীর কোথাও নেই, মানবজাতি কার্যত কাফের ও মোশরেক হয়ে আছে, কিন্তু তা নিয়ে কারও কোনো চিন্তা নেই। তারা ভুলেই গেছে ইসলামের শুরু তওহীদ দিয়ে নামাজ দিয়ে নয়।