Monday, February 29, 2016

রাজধানীর আদাবর এলাকায় হেযবুত তওহীদের জনসভা

রাজধানীর আদাবর এলাকায় হেযবুত তওহীদের জনসভা


জঙ্গিবাদকে না বলুন, ধর্মব্যবসাকে না বলুন, সাম্প্রদায়িকতাকে না বলুন। যারা মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে হাইজ্যাক করে ধর্মবিশ্বাসী মানুষকে অমানবিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত করায় তাদেরকে বয়কট করুন।
.
পৃথিবীতে যা কিছু কল্যাণকর তাই ধর্ম, যা অকল্যাণকর তা অধর্ম। আসুন- নিজেদের ইহকালকে সাফল্যমণ্ডিত করতে ও পরকালকে সাফল্যমণ্ডিত করতে নিজেকে মানবতার কল্যাণে সমর্পণ করি।
.
পৃথিবী যখন অশান্তির আগুনে পুড়ছে, তখন কারও কোনো ব্যক্তিগত আমল-এবাদত-পূজা-প্রার্থনা কবুল হবে না। আগে মানুষের মুক্তি, আগে সমাজের শান্তি, তারপর আমল।
.
এই মুহূর্তে মানুষের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হলো ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করে পৃথিবী থেকে মিথ্যা ও অন্যায়ের রাজত্বকে সমূলে উৎপাটন করা। মানবজীবনে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।
.
যে জীবন মানবকল্যাণে কাজে লাগল না, যে জীবন সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে লাগল না, সে জীবন বৃথা গেল। যে ব্যক্তি সমাজ নিয়ে ভাবল না, দেশ নিয়ে ভাবল না, বিশ্ব নিয়ে ভাবল না, অতঃপর মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে নিজেকে বিসর্জন করল না সে তো মানুষই নয়, পশুর সাথে স্বার্থপর-আত্মকেন্দ্রিক ওই ব্যক্তির কোনোই পার্থক্য নেই।
.
যে ব্যক্তি নিজের জন্য বাচে সে ধার্মিক নয়, ধার্মিক সেই জন যার প্রতিটি নিঃশ্বাস থেকে এই জগৎ সংসার উপকৃত হয়।
.
সুতরাং যারা ধর্মকে বিশ্বাস করেন, ধর্মকে ধারণ করতে চান তারা আসুন- নিজেদের আত্মার বলে বলীয়ান হয়ে যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, অপরাজনীতি, ধর্মব্যবসা, জঙ্গিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হই।
.
আর যারা ধর্মই বিশ্বাস করেন না তারাও আসুন, সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা ভেবে হলেও। এই সমাজে আপনি জন্ম নিয়েছেন, এই সমাজে লালিত-পালিত হয়েছেন, এই সমাজে বেচে আছেন, সুতরাং এই সমাজের প্রতি আপনি ঋণী। এই ঋণের বোঝা হালকা করার সময় এসেছে। সমাজের দুর্দশাকে অনুধাবন করুন। সমাজ নামক দেহটির প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আজ ভয়ানক ব্যাধিতে আক্রান্ত, তাকে বাচান। তার চিকিৎসা করুন। ওষুধ আছে আমাদের কাছে। আমরা সে ওষুধ নিয়ে আপনাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি, আসুন, বসুন, শুনুন আমাদের কথা। উপলব্ধি করুন। সমাজ বেচে যাবে, আপনিও বাচবেন।
.
হেযবুত তওহীদের সংগ্রাম চলছে। চলবে। সত্য প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রামে সবাইকে আমন্ত্রণ।

অধ্যক্ষের বক্তব্য: আলীয়া মাদ্রাসা ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রের ফসল

অধ্যক্ষের বক্তব্য: আলীয়া মাদ্রাসা ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রের ফসল



রাকীব আল হাসান
আবদুস সাত্তার রচিত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত ‘আলীয়া মাদ্রাসার ইতিহাস’ নামক বিরল তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ জনাব মোহাম্মদ ইয়াকুব শরীফ (তাং- শবে বরাত ১৪০০ হিজরী)। আমরা তার সেই মহামূল্যবান লেখা থেকে কিছু অংশ পাঠক-পাঠিকার জন্য তুলে ধরছি।
“এটি কোনো একটি প্রতিষ্ঠান বিশেষের ইতিহাস নয়, এটা মূলত তদানীন্তন সুবায়ে বাংলার আরবী শিক্ষা তথা গোটা মুসলমান জাতির শিক্ষা, মর্যাদা এবং আপন বৈশিষ্ট্য রক্ষার সংগ্রাম বিধৃত একটি করুণ আলেখ্য।
আজ এই লেখাটি লিখতে স্বভাবতই মন কতগুলো বিশেষ কারণে আবেগ-আপ্লুত হয়ে ওঠে। আর তা হলো অতীতে প্রতিটি ক্ষেত্রে মুসলমানদের অনৈক্য। মুসলমানরা ছিল বীরের জাতি, ইংরেজ বেনিয়ারা ছলে-বলে-কৌশলে তাদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তাদের প্রচলিত ধর্ম, শিক্ষা, ও মর্যাদা হরণ করার জন্য পদে পদে যেসব ষড়যন্ত্র আরোপ করেছিল, আলিয়া মাদ্রাসা তারই একটি ফসল। বাহ্যত এই প্রতিষ্ঠানের পত্তন করা হয়েছিল আলাদা জাতি হিসাবে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের নিমিত্ত, যাতে মুসলমানদের ধর্ম, কৃষ্টি ও আদর্শ রক্ষা পায়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মুসলমানদের ধোঁকা দেওয়াই ছিল তাদের আসল উদ্দেশ্য।
ইংরেজরা যুদ্ধ করে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করতে সক্ষম হয় নি। হয়তো সে সময় তাদের পক্ষে তা করা সম্ভবও ছিল না। মুসলিমদের মধ্যে পরস্পরলোভী নেতৃত্বের জন্যই এটা সম্ভব হয়েছিল। সুবায়ে বাংলার শাসনভার ইংরেজদের হাতে হস্তান্তরিত হওয়ার পর থেকে আরম্ভ হয় মুসলমানদের তাহজীব-তমদ্দুন ও শিক্ষা-সংস্কৃতির উপর কূটনৈতিক আক্রমণ। এই শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন ব্যতীত এটা সম্ভব নয়, তাই ইংরেজরা সন্তর্পণে শিক্ষা পরিবর্তনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
দিওয়ানী বিভাগে স্বয়ং ইংরেজরা এবং তাদের পদলেহনকারী হিন্দুরা নিয়োজিত ছিল। এদিকে মুসলমানদের কীভাবে উৎখাত করা যায় প্রশাসন বিভাগে সেই ষড়যন্ত্র চলল। কারণ তখনও রাষ্ট্র ভাষা ফারসি পরিবর্তন করা সম্ভব হয় নি। রাষ্ট্রভাষা ফারসিকে পরিবর্তন করে সে স্থলে ইংরেজি প্রতিষ্ঠা করাও সহজসাধ্য ছিল না। এবং সেকালে ফারসি জানা হিন্দু-মুসলমানদের সংখ্যাও কম ছিল না। ১৭৮০ সালে কলিকাতাতে আলিয়া মাদ্রাসার বুনিয়াদ রাখা হয়। নানা পরিবর্তনের মাধ্যমে অবশেষে ওয়েলেসলী স্কোয়ারে মাদ্রাসার ইমারত প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এখানকার উলামারা ভারত বর্ষকে দারুল হরব বলে বিশ্বাসী ছিলেন। সুতরাং ছাত্রগণও ঐভাবে শিক্ষিত হতে থাকে।
অতঃপর মুসলিম জাতির হাত থেকে প্রশাসন বিভাগ হস্তান্তরিত করবার পালা আসে। পূর্বে মাদ্রাসার শিক্ষিত ছাত্ররাই কাজী, এসেসর ও জজ ইত্যাদি পদে নিযুক্ত হতো। পরে তাও না হওয়ার ব্যবস্থা গৃহীত হয়। ধীরে ধীরে মুসলমানদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে দুর্বল করার ব্যাপারে সকল প্রচেষ্টা চালানো হয়। জীবিকার ক্ষেত্রে মাদ্রাসার ছাত্ররা যাতে একটা পথ খুঁজে পেতে পারে এজন্য আলিয়া মাদ্রাসাতে ইলমে ত্বিব (হেকিমি চিকিৎসাবিদ্যা) সিলেবাসভুক্ত করারও প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু ইংরেজ সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেন। শেষাবধি শুধু ধর্ম শিক্ষার জন্যই এই মাদ্রাসা কোনো রকমে টিকে থাকে। প্রকৃতপক্ষে আলিয়া মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাই ছিল মুসলমানদের আসল শিক্ষার মাধ্যম। কিন্তু কালক্রমে ইংরেজরা এর পাশাপাশি একটি বিকল্প শিক্ষা হিসেবে ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ গড়ে তোলে।
মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার এক শতাব্দী পর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এবং সামগ্রিকভাবে ইংরেজি এই দেশের রাষ্ট্রভাতা রূপে গৃহীত হয়। এভাবে মুসলমানরা ধীরে ধীরে রাজ্যহারা, ধনহারা, মান-সম্মানহারা হয়ে এমন দরিদ্র জাতিতে পরিণত হয়, যা কোনোদিন তারা কল্পনা করতে পারে নি।
এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভাষা হিসাবে ফারসি, আরবি ইত্যাদি ছিল এবং ভালোভাবে এর শিক্ষাসূচিতে নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থাও ছিল। মূলত তা ছিল ধর্মভিত্তিক, এমনকি হিন্দুদের শিক্ষাব্যবস্থাও ছিল ধর্মভিত্তিক। তাই বিদেশি ভাষার মাধ্যমে নৈতিকতাহীন শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণে মুসলমান কিছুতেই রাজী হয় নি। কিন্তু তরপরও কিছু কিছু মুসলমান ইংরেজি পড়তে বাধ্য হয়েছে এবং ইংরেজি শিখে তাদের গোলাম হয়েছে। এ ব্যাপারে আকবর ইলাহাবাদী তাঁর ভাষায় বলেন-
আহবাব কেয়া নুমাযা কর গ্যায়ে
বি.এ. কিয়া, নওকর হুয়ে, পেনশন মিলি আরও মর গ্যায়ে।
অর্থাৎ, বন্ধুগণ কী কীর্তিই না করলেন। বি.এ. পাস করার পর ইংরেজের চাকর হলেন, চাকরির অবসানে পেনশন পেয়ে মৃত্যুবরণ করলেন।
মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন-বর্জিত এই শিক্ষাব্যবস্থার পরিণতি এ ছাড়া আর কী হতে পারে? এই ধর্মহীন, নৈতিকতাহীন ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে চরিত্রহীনতা ও ধ্বংস এদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করল। এ সত্যের নতুন ব্যাখ্যার প্রয়োজন মোটেই নেই। যে জাতি ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হয়, তাকে কে রক্ষা করতে পারে? একটা জাতির মধ্যে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ বিদ্যমান এবং রাষ্ট্রও এগুলোকে নিয়ে গঠিত। একটি জাতির উত্থান প্রকৃতপক্ষে তার ত্যাগ ও কুরবানির ভিত্তিতে সম্ভব হয়। লোভ-লালসা, ইন্দ্রীয়পরায়ণতা, ঈর্ষা-হিংসার ফলে জাতি পরাধীন ও দাসত্বে পদানত হয়ে থাকে। স্বাধীনতা লাভের পরও এই দেশে শিক্ষাব্যবস্থা নৈতিকতাভিত্তিক সুগঠিত ও সুবিন্যস্ত হতে পারে নি। পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের ফলে জাতির মাঝে নৈতিক দিক শূন্য থেকে শূন্যতর হয়ে আসছে। এই মানসিকতা জাতির সম্মান, স্বাধীনতা ও অস্তিত্বের প্রতি দৈনন্দিন এক হুমকিসরূপ বিরাজ করছে।
আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস জাতির পতনের ইতিহাস। অনুভূতিহীন জাতির সম্মুখে এ আলোচনা কি ভালো বোধ হবে? তবে নিরাশ হওয়া চলবে না। মানুষ যেখানে পতিত হয় সেখান থেকে উত্থানের পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। অনুভূতি জাগ্রত হলে উন্নতির পথ সুপ্রশস্ত হয়।

তাহলে ধর্মজীবী মোল্লারা খাবেন কী করে?

তাহলে ধর্মজীবী মোল্লারা খাবেন কী করে?


আরিফ মোহাম্মদ আলী আহসান
আমরা যখন প্রকৃত ইসলাম কী এবং কিভাবে প্রকৃত ইসলাম মানবজীবনে প্রতিষ্ঠা করতে হবে এই বিষয়গুলো মানুষের সামনে তুলি ধরি, তখন সঙ্গতভাবেই ধর্মব্যবসায়ী আলেমদের প্রসঙ্গ এসে যায়। কারণ তারাই প্রচলিত ইসলামের অভিভাবক ও ধ্বজাধারী সেজে আছে। অথচ প্রকৃত ইসলামে ধর্মব্যবসার কোন সুযোগ নেই, রসুলাল্লাহর সময় এই ধর্মজীবিদের কোন অস্তিত্বও ছিল না। দীনের বিকৃতি ঘটায় ও খ্রিস্টানদের ঔপনিবেশিক শাসনামলে চক্রান্তের ফাঁদে পড়ে এই পুরোহিত শ্রেণি একেবারে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। এ কারণে প্রকৃত ইসলামের কথা বললে ধর্মজীবীদের অবৈধ বাণিজ্যের বিষয়টি এড়ানোর কোন সুযোগ থাকে না। তাই আমাদেরকে অনেকে প্রশ্ন করেন- তাহলে তারা কী করে খাবেন? তারা কী করে খাবেন তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এখন তারা কী খাচ্ছেন? আল্লাহ বলছেন, আল্লাহ যা নাজেল করেছেন যারা তা গোপন করে এবং এর বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে তারা তাদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছু প্রবেশ করায় না। (সুরা বাকারা ১৭৪)। সুতরাং ধর্মজীবী আলেমরা জাহান্নামের আগুন দিয়ে উদর পূর্তি করছেন। প্রশ্ন হলো, জাহান্নামের আগুন না খেলে তারা খাবেন কী? এর জবাব হলো:
১। ধর্মব্যবসা আমারা নিষেধ করি নি, স্বয়ং আল্লাহ নিষেধ করছেন। শুধু নিষেধই করেন নি, ধর্মের কথা বলে বিনিময় নিলে তাকে তিনি জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। ক্ষুধার তাড়নায়, কোন উপায় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত পশু, শুকরের গোশত খেলেও আল্লাহ ক্ষমা করবেন কিন্তু কোন অবস্থাতেই দীনের কাজের বিনিময় নেয়া যাবে না একথা আল্লাহ কঠোরভাবে নিষেধ করে দিয়েছেন (সুরা বাকারা ১৭৩-১৭৫)। সুতরাং প্রশ্নটি আমাদের করে কী লাভ? বরং আল্লাহকেই প্রশ্নটি করা দরকার যেহেতু নিষেধটি স্বয়ং আল্লাহই করেছেন।
২। নামাজ পড়ানোর জন্য তারা যে সময় ব্যয় করেন- মুসুল্লীও সেই একই সময় ব্যয় করেন, ওয়াজ করে তিনি যে সময় ব্যয় করেন- যে ওয়াজ শোনেন সেও একই সময় ব্যয় করেন। মুসল্লীগণ ও ওয়াজ শুনতে আসা লোকজন কী করে জীবন ধারণ করেন? নিশ্চয় তারা সামাজে অন্য সকলের মতো ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প কারখানা, ক্ষেতখামার বা চাকুরী-বাকুরী করে জীবিকা নির্বাহ করেন? তাহলে ধর্ম নিয়ে কেন ব্যবসা করতে হবে? সকলের মতো তাদের জন্যও জীবিকা আহরণের পথ খোলা রয়েছে।
৩। সুরা জুম’আতে আল্লাহ বলেছেন নামাজ শেষে তোমরা কর্মে বেরিয়ে পড়? সুতরাং সকলের জন্যই জীবিকার নির্বাহ আবশ্যকীয়, অলসতার কোন সুযোগ নেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় রসুলাল্লাহও জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে একজন ইহুদির কূপ থেকে পানি তুলে দিতেন। প্রকৃত ইসলামের খলিফাগণও কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেছেন; বৃদ্ধ আবু বকর (র:) কাপড়ের গাট্টি মাথায় করে বাজারের দিকে ছুটেছেন, আলী (রা:) যবের আটা পিষে বিক্রি করেছেন এবং কুলির কাজ করেছেন। কিন্তু তাঁরা চাইলে খুব সহজেই ধর্মের বিনিময় নিতে পারতেন। খানকা, হুজরা, মসজিদ, মাদ্রাসা তৈরি করে সেখানে বসে এখনকার মোল্লাদের চেয়ে বেশি আয়-রোজগার করতে পারতেন, ওয়াজ করে কাড়ি কাড়ি টাকা কামাতে পারতেন (নাউযুবিল্লাহ)। কিন্তু তাঁরা তা করেন নি, বরং কঠোরভাবে আল্লাহর হুকুম মান্য করেছেন। তাহলে ধর্মজীবীদের অন্য সকলের মতো কাজ করে উপার্জনে বাধা কোথায়?
রসুলাল্লাহ বলেন হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি, জীবিকা নির্বাহের জন্য সম্ভাব্য সকল উপায়ে চেষ্টা করো এবং তোমাদের প্রচেষ্টার পরিপূর্ণতার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করো। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, কোন মুমিনের সত্তাকে দুনিয়ায় বেকার এবং অনর্থক সৃষ্টি করা হয় নি। বরং তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কর্ম ও কর্তব্যের সঙ্গে সংযুক্ত। কর্ম ও প্রচেষ্টার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অল্পে সন্তুষ্টি এবং আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার অর্থ এ নয় যে, হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা এবং নিজের বোঝা অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া। নিশ্চয়ই আল্লাহর উপর ভরসা করা আমাদের প্রধান কর্তব্য। কিন্তু রেযেক হাসিল করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা নিতান্তই জরুরী বিষয় (মহানবীর স. ভাষণ-ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)।
নায়েবে রসুলের দাবীদার ধর্মব্যবসায়ীরা ছাড়া রসুলের এ কথার বাইরে তো কাউকে দেখা যায় না। আল্লাহ ও তাঁর রসুলের নিষেধ অমান্য করে যারা ধর্মব্যবসা করছেন সেই সকল ধর্ম ব্যবসায়ীরা কী করে খাবেন এ প্রশ্ন করা শুধু অনুচিত নয় আল্লাহ ও তাঁর রসুলের বিরুদ্ধাচারণও বটে। তবে এ কথাও ঠিক যে, তাদেরকে প্রচলিত সিস্টেমের মাধ্যমেই হারাম উপার্জনের দিকে এক প্রকার ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা যখন পরিকল্পিতভাবে তাদের উপনিবেশগুলিতে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে সেখানে তারা কেবল ধর্মীয় বিকৃত জ্ঞানই শিক্ষা দেয়। তাদের সিলেবাসে অংক, ভূগোল, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার কোন কিছুই রাখা হয় না। ফলে মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে এই সমস্ত আলেমরা রুজি-রোজগার করে বেঁচে থাকার জন্য ধর্ম বিক্রী করে রোজগার করা ছাড়া আর কোন পথ থাকে না। তাই বাধ্য হয়ে তারা দীন বিক্রি করে উপার্জন করে এবং ওয়াজ নসিহতের মাধ্যমে ঐ বিকৃত ইসলামটা এই জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা দেয়। এ উপমহাদেশসহ খ্রিস্টানরা তাদের অধিকৃত সমস্ত মুসলিম দেশগুলিতে এই একই নীতি কার্যকরি করেছে এবং সর্বত্র তারা একশ’ ভাগ সফল হয়েছে। এই নিশ্চিত এবং সহজ জীবিকা, দাওয়াত, খানা-পিনা ও মান-ইজ্জত হারানোর ভয়ে এখন আলেম সাহেবরা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ধর্মব্যবসাকে জায়েজ করার জন্য বহু ফতোয়া আবিষ্কার করেছেন। এজন্যই আল্লাহ তাদের বিষয়ে বলেছেন, “আগুন সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্য্যশীল (সুরা বাকারা ১৭৪)।”
মনে রাখতে হবে, অন্যের করুণার দানের উপর যারা নির্ভর করে তাদের নৈতিক বল থাকে না। যারা তাকে ভিক্ষা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে তারা কোন অন্যায় করলে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে না। এজন্যই কোন ধর্মব্যবসায়ী সমাজের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেন না। অথচ উম্মতে মোহাম্মদীর দায়িত্ব হচ্ছে মানুষকে সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে বাধা প্রদান করা, এজন্য সবার আগে দরকার নৈতিক বল। তাই আলেম দাবি করেও যারা এখনও ধর্মব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছেন তাদের উচিৎ এই হারাম উপার্জন বন্ধ করা, যেহেতু তারাই সব সময় ওয়াজ করেন যে কোন ইবাদত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে হালাল রুজি আর যে শরীর পুষ্ট হয় হারাম উপার্জনের দ্বারা সে শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না।

Sunday, February 28, 2016

হেদায়াতের সঠিক অর্থ

হেদায়াতের সঠিক অর্থ


মোহাম্মদ আক্কাস আলী
হেদায়াহ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা হলো, কোনো দুষ্ট প্রকৃতির গোনাহগার লোককে যদি উপদেশ দিয়ে মদ খাওয়া ছাড়ানো যায়, চুরি-ডাকাতি ছাড়ানো যায়, তাকে নামাজী বানানো যায়, রোজা রাখানো যায় তবে আমরা বলি- লোকটা হেদায়াত হয়েছে। এই ধারণা ভুল, কারণ মানুষ নামাজ পড়তেই মসজিদে যায় অথচ রসুলাল্লাহ বলেছেন, “এমন সময় আসবে যখন মসজিদসমূহ জাঁকজমকপূর্ণ ও লোকে লোকারণ্য হবে কিন্তু সেখানে হেদায়াহ থাকবে না।” তাহলে রসুলাল্লাহর কথা মোতাবেকই বোঝা গেল হেদায়াহ একেবারেই অন্য জিনিস। কারণ বর্তমানে যে কাজগুলিকে ইবাদত মনে করা হয় যেমন নামাজ, রোজা ইত্যাদি, সেগুলি করলেই হেদায়াতে থাকা হলো এ ধারণা ভুল। হেদায়াহ অর্থ হচ্ছে সঠিক দিক নির্দেশনা (Right direction, guidance, orientation) অর্থাৎ আল্লাহ রসুল মানবজাতিকে যে পথ প্রদর্শন করেছেন, যে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন, সেই পথে, সেই দিকে চলাই হচ্ছে হেদায়াহ। আল্লাহ যে পথে চলতে আদেশ দিচ্ছেন সেটা হলো সেরাতুল মোস্তাকীম- সহজ, সরল পথ, জীবনের সর্বস্তরে, সর্ব অঙ্গনে, সর্ব বিভাগে এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো আইন-কানুন, নীতি নির্দেশ অস্বীকার করা এবং তাঁকে ছাড়া আর কারো খেলাফত না করা এক কথায় তওহীদ; এই সহজ সোজা কথা। আর আজ সারা দুনিয়ার কোথাও আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ, হুকুমদাতা, সার্বভৌমত্বের মালিক হিসাবে মানা হচ্ছে না, এমন কি ঐ জাঁকজমকপূর্ণ সোনার গম্বুজওয়ালা মসজিদগুলিতেও এই হেদায়াহ নেই, সেখানেও চলছে তাগুতের গোলামী।
অথচ আল্লাহর রসুল এবং প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী খেজুর পাতার ছাউনি দেওয়া মাটির মসজিদ থেকে অর্ধ পৃথিবী শাসন করেছেন, তাঁদের মসজিদসমূহ কোনোই জাঁকজমকপূর্ণ ছিল না। তবু যে ভূখণ্ডে এই জাতি শাসন করেছেন সেখান থেকে সমস্ত অন্যায় অবিচার, যুদ্ধ রক্তপাত, ক্ষুধা দারিদ্র্য, শোষণ এক কথায় সর্ব প্রকার অন্যায় অশান্তি লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। অর্ধেক পৃথিবীর কোথাও শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো বাহিনী না থাকা সত্ত্বেও সমাজে বলতে গেলে কোনো অপরাধই ছিল না। সুন্দরী যুবতী নারী অলঙ্কার পরিহিত অবস্থায় শত শত মাইল পথ একা পাড়ি দিত, তার মনে কোনো প্রকার ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কাও জাগ্রত হতো না। মানুষ রাতে ঘুমানোর সময় ঘরের দরজা বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করত না, রাস্তায় ধন-স¤পদ ফেলে রাখলেও তা খোঁজ করে যথাস্থানে পাওয়া যেত, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, রাহাজানি প্রায় নির্মূল হয়ে গিয়েছিল, আদালতে বছরের পর বছর কোনো অপরাধ সংক্রান্ত মামলা আসতো না। আর অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রতিটি মানুষ স্বচ্ছল হয়ে গিয়েছিল। এই স্বচ্ছলতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, মানুষ যাকাত ও সদকা দেওয়ার জন্য টাকা পয়সা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত, কিন্তু সেই টাকা গ্রহণ করার মতো লোক পাওয়া যেত না। এই পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, কারণ ঐ জাতি হেদায়াতে ছিল, তওহীদে ছিল। তাদের ইলাহ, বিধাতা, হুকুমদাতা ছিলেন আল্লাহ।
আর আজ যারা সোনার গম্বুজওয়ালা মসজিদে নামাজ পড়তে যাচ্ছেন তাদের কারও ইলাহ গণতন্ত্র, কারও রাজতন্ত্র, কারও সমাজতন্ত্র, কেউ সরকারি দলের, কেউ বিরোধীদলের অনুসারী, অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব কোথাও নেই। সবাই ইহুদি খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’র সার্বভৌমত্ব মাথায় নিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে দৌঁড়ে পাক্কা মুসল্লী হচ্ছে। এ জন্যই আল্লাহর রসুল বলেছেন, মসজিদ সমূহ ভর্তি হবে কিন্তু সেখানে হেদায়াহ থাকবে না। পাঠক, ভেবে দেখেছেন কি, মুসলিম জাতি যদি হেদায়াতেই না থাকে তবে কোথায় রয়েছে? নিশ্চয়ই হেদায়াতের বিপরীত অর্থাৎ পথভ্রষ্টতায়, যদি সেরাতুল মোস্তাকীমেই না থাকে তবে নিশ্চয়ই রয়েছে ইবলিসের বক্রপথে। এই পথ তাদেরকে কোন গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছে- জান্নাতে, না জাহান্নামে?

নারী

নারী


রুম্মানা খানম কণিকা:
সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবদানকে উল্লেখ না করে কোনো উপায় নেই। অধিকাংশ মহৎ কাজের স্বীকৃতি ও পুরস্কার পুরুষ সগৌরবে গ্রহণ করলেও তার সাফল্যের জন্য পর্দার অন্তরালে থেকে নীরবে কাজ করে গেছে কোনো না কোনো নারী, অন্ধ সমাজের দৃষ্টি খুব কমই সেই নারীর দিকে আকৃষ্ট হয়। নজরুল লিখেছেন:
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি, কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোনো কালে একা হয়নি কো জয়ী পুরুষের তরবারী,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়লক্ষ্মী নারী।
কোনো স্বীকৃতি তো নেইই- উল্টো আজকের এই সভ্যতার মুখোস পরা সমাজে নারীরা পদে পদে হচ্ছেন নির্যাতিত, নিষ্পেষিত। আজকের সমাজ যেন ১৪০০ বছর আগের আরবের সেই আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও হার মানিয়েছে। সে সময় অনেকে সদ্যজাত কন্যা শিশুকে মাটিচাপা দিয়ে দিত। পিতা-মাতার সম্পত্তিতে তাদের কোন অধিকার স্বীকৃত ছিল না। নারীর চরম অবমাননার এই যুগে ইসলাম এসেছিল নারীর মুক্তির বার্তা নিয়ে। পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রের সর্বত্র নারীর অবাধ বিচরণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে ইসলাম যা আজ থেকে এক শতাব্দী আগে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতেও ছিল অচিন্ত্যনীয়। আল্লাহ তাঁর কাছে যে জীবনব্যবস্থা পাঠিয়েছিলেন সেটা বাস্তবায়নের ফলেই অর্ধ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চূড়ান্ত ন্যায়, সুবিচার, নিরাপত্তা ও অনাবিল শান্তি। তবে সেই ইসলাম আর আজকের ইসলাম এক নয়। এ কারণে তার ফলও সম্পূর্ণ বিপরীত, চরম অশান্তি।
নারী সৃষ্টিগতভাবে শান্তির আধার:
নারী ও পুরুষ উভয়কেই আল্লাহ তাঁর প্রতিনিধি বা খলিফা হিসাবে সৃষ্টি করলেও তাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য পৃথক। আল্লাহ আদমকে সৃষ্টির পর জান্নাতের অঢেল সুখ ও শান্তিময় পরিবেশে বসবাস করতে দিলেন। সেখানে তাঁর ছিল যেখানে খুশি যাওয়ার, যা খুশি খাওয়ার, যা খুশি করার নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা। কিন্তু জান্নাতের এত সুখ-সম্ভোগ ও রঙ-রূপ-রসও তাঁকে আনন্দ দিতে পারছিল না, সব কিছু অর্থহীন, বিবর্ণ, নিরস মনে হচ্ছিল। তখন আল্লাহ তাঁরই পাঁজড়ের হাড় থেকে সৃষ্টি করলেন তাঁর সঙ্গিনী এবং সাহায্যকারী হাওয়াকে (বাইবেল- জেনেসিস ২:২২)। মা হাওয়াকে পেয়ে শান্তির সুধারসে আদমের হৃদয় পূর্ণ হয়ে গেল। এরপর আল্লাহর একটি হুকুম অমান্য করায় আল্লাহ তাঁদের উভয়কে শাস্তি-স্বরূপ পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন। শাস্তি হলো, পুরুষ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করে পরিবারের ভরণপোষণ করবে আর নারী গর্ভযাতনা সহ্য করবে, সন্তান লালন পালন করবে (বাইবেল- জেনেসিস ৩:১৬-১৭)। আর আল্লাহর খেলাফতের দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সঙ্গী হিসাবে তার পাশে থাকবে। অর্থাৎ আল্লাহ নারীকে সৃষ্টিই করেছেন রহমত, বরকত ও নেয়ামত হিসাবে। তিনি বলেছেন, “আল্লাহর নিদর্শনাবলীর মধ্যে একটি এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের নিজেদের মধ্যে থেকে সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি লাভ কর এবং সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া।” (আর-রূম ৩০:২১) আর আল্লাহর রসুল বলেছেন, সমগ্র পৃথিবী আল্লাহর নেয়ামত আর সম্পদরাশিতে পূর্ণ এবং সেই সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে মঙ্গলময় সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ ও নেয়ামত হচ্ছে সেই স্ত্রী যে আল্লাহর আদেশ ও নিষেধের প্রতি সদা সতর্ক (সহীহ মুসলিম, ২য় খণ্ড ৩৪৫৬)। সুতরাং যে কর্মকাণ্ডে নারী নেই সেটা প্রাণহীন। তাদের আগমনেই মানবজীবনের প্রতিটি অঙ্গন শান্তিময় হয়ে উঠবে।
আদমের (আ.) পর থেকে পৃথিবীতে যখন মানুষের বিস্তার হলো আল্লাহ তাদের শান্তিতে জীবনযাপনের জন্য নবী রসুলদের মাধ্যমে তাঁর বিধান পাঠাতে থাকলেন। সেই বিধানগুলি মানুষ যখন মেনে চোলত তাদের সমাজে অনাবিল শান্তি বিরাজ করত। কিন্তু নবীদের প্রস্থানের পর একটি শ্রেণির জন্ম হয়েছে প্রতিটি জাতির মধ্যে যারা ঐ বিধানের অর্থাৎ ধর্মের ধারক বাহক সেজে বসেছে। তারা নিজেদের পার্থিব স্বার্থে আল্লাহর বিধানকে বিকৃত করে ভারসাম্যহীন করে ফেলেছে। ফলে ধর্মই হয়ে দাঁড়িয়েছে নিষ্ঠুর নির্যাতনের কল। সেই বিকৃত বিধানের ফলে সমাজের শান্তিময় পরিবেশ বিনষ্ট হয়েছে। কোমলমতি নারীরা স্বভাবতই সামাজিক নিষ্ঠুরতার প্রথম শিকারে পরিণত হয়েছে।
দাজ্জাল অর্থাৎ ইহুদি খ্রিষ্টান ‘সভ্যতা’র বস্তুবাদী জীবনের আকর্ষণ, সম-অধিকার, স্বাধীনতা জাতীয় প্রহেলিকামূলক মতবাদ, আর্থিক উৎকর্ষের পেছনে ছুটে ছুটে আমাদের নারী সমাজের বড় একটি অংশও তাদের সৃষ্টিগত আত্মিক ও বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য হারিয়েছেন, তাদের সৌন্দর্য, করুণা, দয়া-মায়া, শিষ্টাচার, নম্রতা, লাজ-লজ্জা সবই প্রায় খুইয়েছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ স্নেহবঞ্চিত নিরাশ্রয় নারীকে রুজি রোজগারের জন্য কঠোর পরিশ্রমের কাজের দিকে, প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলার দিকে ঠেলে দেয়। আমাদের গ্রাম বাংলার অনেক নারী কৃষিক্ষেত্রে দিনমজুরী করছেন। একজন পুরুষ দিনমজুর সারাদিন রৌদ্রে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে যে পরিশ্রমের কাজগুলি করেন একজন নারী দিনমজুরও সমান পরিশ্রমের কাজ করেন। তারা স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং নারী হিসাবে তাদের যে জীবন প্রাপ্য ছিল তা থেকেও বঞ্চিত। পাশাপাশি পুরুষালি কাজগুলি করে তারা তাদের নারীসুলভ চারিত্রিক ও শারীরিক বৈশিষ্ট্যও হারাচ্ছেন।

যুলুম শব্দের সঠিক অর্থ

যুলুম শব্দের সঠিক অর্থ

মসীহ উর রহমান
পবিত্র কোরআনে ‘যুলুম’ শব্দটি আল্লাহ অনেকবার ব্যবহার করেছেন। এর প্রকৃত অর্থ হারিয়ে গেছে। বর্তমানে এর অর্থ করা হয় অত্যাচার, মারধর ইত্যাদি দ্বারা। কোরআনের সব ইংরেজি অনুবাদেও এই শব্দকে (Tyranny, Oppression) অনুবাদ করা হয়েছে। আসলে ‘যুলুম’ শব্দের অর্থ এর থেকে অনেক ব্যাপক। আল্লাহ যে অর্থে এই শব্দ ব্যবহার করেছেন তা সংক্ষেপে এই- যা হওয়া বা করা উচিৎ নয়, তা হওয়া বা করা এবং যা হওয়া বা করা উচিৎ তা না হওয়া বা না করা। এক কথায় অন্যায়। প্রশ্ন হতে পারে, ন্যায়- অন্যায়ের মাপকাঠি কী? উত্তর হচ্ছে স্রষ্টা যে মাপকাঠি ঠিক করে দিয়েছেন সেই মাপকাঠি মোতাবেক যেটা ন্যায় এবং যেটা অন্যায়। আল্লাহ যে জীবন-ব্যবস্থা, ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠি মানুষকে দিয়েছেন সেই মাপকাঠি দিয়ে না মেপে মানুষের কাজকে যদি মানুষের গড়া মাপকাঠি দিয়ে মাপা হয় তবে তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হবে অন্যায়-যুলুম। জীবনের যে অঙ্গনেই তা করা হবে সেই অঙ্গনেই অন্যায় হবে, যুলুম হবে। এজন্যই আল্লাহ বলেছেন- যা অবতীর্ণ করা হয়েছে (কোর’আন) সেই মোতাবেক যারা শাসন- বিচার করে না তারা যালেম (সুরা মায়েদা,আয়াত-৪৫)। অর্থাৎ বিচার ও শাসনে ন্যায়- অন্যায়ের মাপকাঠি হিসাবে আল্লাহর দেয়া মাপকাঠি কোর’আনকে যারা নেয় না, নিজেরা ইচ্ছামত মাপকাঠি তৈরি করে নেয় তারা যালেম অর্থাৎ অন্যায়কারী কারণ তাদের কাজের ফলে অন্যায় সংঘটিত হবে, অবিচার সংঘটিত হবে। উদাহরণ স্বরূপ ধরুন-দুটি দেশ; একটি দেশের শাসনকর্তা স্রষ্টার দেয়া ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠি দিয়ে বিচার করেন, স্রষ্টার দেয়া দণ্ডবিধি অনুসারে শাস্তি ও পুরস্কার দেন, শাস্তির ব্যাপারে কাউকে ক্ষমা করেন না, কঠিন শাস্তিকে লঘুও করেন না। আপাতঃদৃষ্টিতে তিনি নির্দয়, যালেম। অন্য দেশটির শাসক স্রষ্টার দেয়া ব্যবস্থাকে অতি কঠোর মনে করে নিজের তৈরি ব্যবস্থায় বিচার করেন, অপরাধীদের লঘুদণ্ড দেন বা মাফই করে দেন। আপাতঃদৃষ্টিতে তিনি একজন সহৃদয় শাসনকর্তা। কিন্তু কোরআনের সংজ্ঞা অনুযায়ী আল্লাহ্র দৃষ্টিতে প্রথম জন ন্যায়বান ও দ্বিতীয় জন যালেম। কারণ, প্রথম জনের দ্বারা স্রষ্টার নির্ধারিত বিচার ও শাাস্তি প্রয়োগের ফলে সমাজ থেকে অপরাধ প্রায় নির্মূল হয়ে যাবে, মানুষ নিরাপত্তা ও শান্তিতে বাস করতে পারবে। দ্বিতীয় জনের সহৃদয়তায়, লঘু শাস্তির ফলে অপরাধীরা উৎসাহিত হবে দেশে অপরাধ বাড়বে এবং বহু লোক অপরাধের শিকার বা মজলুম হবে; অর্থাৎ ঐ সহৃদয় শাসকের কাজের ফলে সমাজের উপর যুলুম, অন্যায় হবে। এজন্যই আল্লাহ বলেছেন, ‘যারা আমার নাজেলকৃত আয়াত দ্বারা বিচার করে না, তারা যালেম (সুরা মায়েদা ৪৫)।’
নিজ বাবা-মা ও আত্মীয়বর্গের প্রতি মানুষের কর্তব্য পালন করা অপরিহার্য্য এবং কর্তব্যে অবহেলা করা অনুচিত ও অমানবিক। যারা তা করে আমরা তাদেরকে যালেম বলে আখ্যায়িত করি। কিন্তু যখন দেখা যায় সেই ঘনিষ্ঠজনেরা আল্লাহ ও রসুলের বিরুদ্ধাচারী তখন তাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করাই ন্যায় এবং আন্তরিক সম্পর্ক রক্ষা করাই যুলুম। এ ব্যাপারে আল্লাহ্র ঘোষণা, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের পিতা ও ভ্রাতা যদি ঈমানের মোকাবেলায় কুফরিকে শ্রেয় জ্ঞান করে তবে উহাদেরকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করিও না। তোমাদের মধ্যে যাহারা উহাদেরকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করে, তাহারাই যালেম’ (কোর’আন, সুরা তওবা, আয়াত-২৩)। আজকে আল্লাহ্র দেয়া জীবনব্যবস্থা বাদ দিয়ে মানব জাতি এখন সেই ইহুদি-খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’র দেওয়া জীবনব্যবস্থা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি গ্রহণ করে নিয়েছে, এভাবে তারা নিজেরাও ঐ জাতিগুলির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। এর ফলে মানবজাতি যে অন্যায় বা যুলুমের শিকার হয়েছে তার কদর্য রূপ আমরা বর্তমান দুনিয়ার দিকে তাকালে দেখতে পাই। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচারে, দরিদ্রের উপর ধনীর বঞ্চনায়-শোষণে, শাসিতের উপর শাসকের অবিচারে, ন্যায়ের উপর অন্যায়ের বিজয়ে, সরলের উপর ধূর্তের বঞ্চনায় পৃথিবী আজ মানুষের বাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য।

Friday, February 26, 2016

তন্ত্র-মন্ত্রের পূজা ছেড়ে তওহীদে ফিরে আসার আহ্বান

তন্ত্র-মন্ত্রের পূজা ছেড়ে তওহীদে ফিরে আসার আহ্বান

মনিরুজ্জামান মনির
আল্লাহ আদম (আ.) থেকে শুরু করে শেষ নবী মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত যতো নবী ও রসুল পৃথিবীর বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরণ করেছেন তাদের প্রত্যেকের প্রতি একটি অভিন্ন দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, তা হলো বালাগ। নবী ও রসুলগণ প্রত্যেকে তাঁদের স্ব স্ব সম্প্রদায়কে বলেছেন, “আমাদের দায়িত্ব তো কেবলমাত্র সুস্পষ্টভাবে সংবাদ পৌঁছে দেয়া” (সুরা ইয়াসীন ১৭)। এখানে আল্লাহ শব্দ ব্যবহার করেছেন “বালাগুল মুবীন” যার অর্থ সুস্পষ্টভাবে পৌঁছানো। সুতরাং আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন কিছুর সংবাদ পরিষ্কারভাবে পৌঁছে দেওয়াই ছিল নবী-রসুলদের একমাত্র কাজ, কে সেটা গ্রহণ করবে আর কে প্রত্যাখ্যান করবে সেটা তাদের বিবেচ্য বিষয় নয়, সেটা আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত।
ইসলামের বালাগ কাদের প্রতি:
মক্কার ১৩ বছরের জীবনে রসুলাল্লাহ ও তাঁর সঙ্গীরা কাফের মোশরেকদেরকে সালাহ, সওম ইত্যাদি কোন আমলের দিকে আহ্বান করেন নি, তাঁরা আহ্বান করেছেন কেবলমাত্র কলেমার দিকে, তওহীদের দিকে। অনেকে মনে করেন মক্কার সেই কাফেরদের আল্লাহর প্রতি এবং আল্লাহর একত্বের প্রতি ঈমান ছিল না। এ ধারণাটি সঠিক নয়। সেই মোশরেকরাও আল্লাহর একত্বে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত, কিন্তু তারা আল্লাহর হুকুম, বিধান মানতো না অর্থাৎ তারা আল্লাহর আনুগত্য করত না। তখনকার আরবরা বিশ্বাস করত যে তারা আল্লাহর নবী ইবরাহীমের (আ.) উম্মাহ। তারা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা বলে, পালনকারী বলে বিশ্বাস করত, নামাজ পড়ত, কাবা শরীফকে আল্লাহর ঘর বলে বিশ্বাস করত, ঐ কাবাকে কেন্দ্র করে বাৎসরিক হজ্ব করত, কোরবানি করত, রোজা রাখত, আল্লাহর নামে কসম করত, এমনকি খাৎনাও করত। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনীয় দলিল, বিয়ে শাদীর কাবিন ইত্যাদি সমস্ত কিছু লেখার আগে আমরা যেমন ‘বিসমিল্লাহ’ লেখি তেমনি তারাও আল্লাহর নাম লিখত। আরবের মোশরেকরা যে আমাদের মতোই আল্লাহয় বিশ্বাসী ছিল এ কথার সাক্ষ্য দিচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ। কোর’আনে তিনি তাঁর রসুলকে বলছেন- তুমি যদি তাদের জিজ্ঞাসা করো, আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি করেছেন? তবে তারা অবশ্যই জবাব দেবে- সেই সর্বশক্তিমান, মহাজ্ঞানী (আল্লাহ) (সুরা যুখরুফ- ৯)। অন্যত্র বলেছেন- তুমি যদি তাদের প্রশ্ন করো আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি করেছেন এবং কে সূর্য ও চন্দ্রকে তাদের (কর্তব্য কাজে) নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণ করছেন, তবে তারা নিশ্চয়ই জবাব দেবে- আল্লাহ (সুরা আনকাবুত- ৬১)।
এমন আরও অনেকগুলি আয়াত এবং ইতিহাস থেকে দেখা যায় সেই মোশরেকদের আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্বের ওপর ঈমান ছিল। তারা মূর্তিপূজা করত ঠিকই কিন্তু ওগুলোকে তারা স্রষ্টা বলে মানতো না। তারা বিশ্বাস করত যে ঐ দেব-দেবীকে মানবে, ওগুলোর পূজা করবে তাদের জন্য ঐ দেব-দেবীরা আল্লাহর কাছেই সুপারিশ করবে (সুরা ইউনুস- ১৮, সুরা যুমার ৩)। এত ঈমান সত্ত্বেও তারা কাফের ছিল কারণ তারা তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সামষ্টিক জীবন নিজেদের মনগড়া নিয়ম-কানুন দিয়ে পরিচালনা করত। যেহেতু তারা আল্লাহর প্রদত্ত হুকুম মানতো না, তাই তাদের ঐ ঈমান ছিল অর্থহীন, নিষ্ফল এবং স্বভাবতই আল্লাহর হুকুম না মানার পরিণতিতে তাদের সমাজ অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, নিরাপত্তাহীনতা, সংঘর্ষ ও রক্তপাতে পরিপূর্ণ ছিল। ঠিক আজকেও আল্লাহর প্রতি আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস থাকলেও আল্লাহর হুকুম, আইন, বিধান অমান্য করার ফলে আমাদের সমসাময়িক পৃথিবীও চরম অন্যায় ও অশান্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে আছে।
একইভাবে বর্তমানে ‘মুসলিম’ বলে পরিচিত জনসংখ্যাটি তদানীন্তন আরবের মানুষের মতোই আল্লাহকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, তাকে স্রষ্টা বলে, জীবন-মরণের প্রভু বলে মানে, কিন্তু আরবের ঐ মোশরেকদের মতই তাঁর দেয়া দীন, জীবন-বিধান মোতাবেক সমষ্টিগত, জাতীয় জীবন পরিচালনা করে না। আরবের মোশরেকরা দেব-দেবীর পুরোহিতদের দেয়া বিধান অনুযায়ী তাদের জাতীয় জীবন পরিচালনা করত, বর্তমানের মুসলিম দুনিয়া নতুন দেব-দেবী গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম-নিরপেক্ষতা, রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্রের পুরোহিত ইহুদি-খ্রিস্টানদের তৈরি করা জীবন-বিধান অনুযায়ী তাদের জাতীয় জীবন পরিচালনা করছে। তফাৎ শুধু এইটুকু যে আরবদের হাবল, লা’ত, মানাতের মূর্তিগুলি ছিল কাঠ এবং পাথর দিয়ে তৈরি, বর্তমানের মূর্তিগুলি কাঠ পাথরের নয়, তন্ত্রের মূর্তি। বরং এই তন্ত্রের মূর্তিগুলোর পূজা ঐ কাঠ পাথরের মূর্তিপূজার চেয়েও বড় র্শেক ও কুফর। তাহলে বিশ্বনবী যাদের মধ্যে আবির্ভুত হয়েছিলেন আরবের সেই আল্লাহয় বিশ্বাসী অথচ মোশরেক কাফেরদের সঙ্গে বর্তমানের আল্লাহয় বিশ্বাসী কিন্তু কার্যতঃ মোশরেক ‘মুসলিম’ জনসংখ্যার তফাৎ কোথায়? এজন্যই আল্লাহর রসুল মক্কার ঐ আল্লাহ-বিশ্বাসী কাফের মোশরেকদেরকে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অর্থাৎ তওহীদের বালাগ দিয়েছিলেন, আর একই কারণে মাননীয় এমামুয্যামান মানবজাতিকে তওহীদ মেনে নেওয়ার আহ্বান করেছেন।

সত্যবাণী: ঐক্যই শক্তির আধার

সত্যবাণী: ঐক্যই শক্তির আধার


রাকীব আল হাসান
আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে শুধু মুসলিমই নয় বিরাট একটা জনসংখ্যা সনাতন ধর্মের অনুসারীও রয়েছেন। এছাড়াও রয়েছেন বৌদ্ধ ও খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারী। আমরা বিশ্বাস করি উল্লেখযোগ্য সকল ধর্মই একই স্রষ্টা মহান আল্লাহ পাকের নিকট থেকে আগত। প্রতিটি ধর্মই মানুষকে সত্যের দিকে আহ্বান করে, মানবতা ও শান্তির কথা বলে। কাজেই আমরা সকল ধর্মের অনুসারীদের উদ্দেশ্যেই তাদের ধর্মগ্রন্থ থেকে কিছু সত্যবাক্য তুলে ধরে আলোচনা করবার চেষ্টা করব এই কলামে। আজ বিভিন্ন ধর্মে ঐক্যের ব্যাপারে যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তা আলোচনা করব।
আল্লাহ যে সকল নিয়ম দিয়ে তাঁর সৃষ্টিজগৎ পরিচালনা করেন সেগুলো প্রাকৃতিক এবং চিরন্তন, শাশ্বত (Etarnal) নিয়ম। বাহ্যিক চোখে আমরা অনেকে বস্তুর পরিবর্তন হতে দেখলেও প্রকৃতপক্ষে ঐ নিয়মগুলোর কখনোই কোনো পরিবর্তন হয় না। যেমন আগুনের ধর্ম হচ্ছে সে সবকিছু পুড়িয়ে দেবে। এটা হাজার বছর আগে যেমন সত্য ছিল তেমনি হাজার বছর পরেও একইরকম থাকবে। আবার পানিকে মুক্ত করে দিলে সে নিু ভূমিতে ছড়িয়ে পড়বে- এটাও প্রাকৃতিক নিয়ম। আল্লাহ মানবজাতিকে শান্তি, সুখ ও সমৃদ্ধিতে বসবাস করার জন্য দয়াপরবশ হয়ে এমনই কতগুলো নিয়ামক দান করেছেন। এর মধ্যে মতভেদ ও বিভক্তি না করে ঐক্যবদ্ধ থাকার গুরুত্ব অপরিসীম। এ জন্য তিনি প্রত্যেক নবী-রসুলদের মাধ্যমে পাঠানো জীবনব্যবস্থায় মানুষকে ঐক্যবদ্ধ থাকার হুকুম দিয়েছেন। তিনি কোর’আনে বলেছেন, “আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন যারা সীসা ঢালা প্রাচীরের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করে (সুরা সওফ-৪), গলিত সীসার দেয়ালে একটি সূঁচ ঢোকার জায়গাও থাকে না। সুরা আল ইমরানের ১০৩নং আয়াতে বলেছেন- ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর রজ্জু (হেদায়াহ, দীন) ধরে রাখতে, বিচ্ছিন্ন না হতে। যাদের কাজে, কথায় ঐক্য নষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে আল্লাহ তাদের জন্য রেখেছেন কঠিন শাস্তি, আযাব। কোর’আনের বহু স্থানে তার উল্লেখ রয়েছে। যে সব কাজে ও কথায় উম্মাহর ঐক্য নষ্ট হবার সম্ভাবনা আছে সে সব কাজকে আল্লাহর রসুল সরাসরি কুফর বলে আখ্যায়িত করেছেন।
কেবল শেষ দীনেই নয়, ইতোপূর্বে আল্লাহ যত নবী রসুল পাঠিয়েছেন এবং তাদের প্রতি যত কিতাব নাজিল করেছেন সর্বত্র জাতির ঐক্যের বিষয়ে বিরাট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বাইবেলে যিশু (ঈসা আ.) বলেছেন, “যে রাজ্য আত্মকলহে নিজেদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়, সেই রাজ্য ধ্বংস হয়? আবার কোন পরিবার যদি নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে, তবে সেই পরিবারও ভেঙ্গে যায়” (বাইবেল- লূক ১১: ১৭)। এখানেও ঐক্যহীন হতে নিষেধ করা হয়েছে। ঐক্য ছাড়া কোনো অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না। প্রকৃতির দিকে তাকালেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঐক্যের নিদর্শন।
সনাতন ধর্মের গ্রন্থগুলিতেও ঐক্যের বিষয়ে বলা আছে। যেমন মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে মহাত্মা বিদুর বলেছিলেন, “দৃঢ়বদ্ধমূল অতিমহৎ একমাত্র মহীরুহ সমীরণভরে অনায়াসে মর্দিত ও পতিত হইয়া থাকে, কিন্তু বহু বৃক্ষ একত্র মিলিত ও বদ্ধমূল হইলে অক্লেশে প্রবল বায়ুবেগ সহ্য করিতে পারে; এইরূপ গুণসমন্বিত ব্যক্তিও একাকী হইলে শত্রুগণ তাঁহাকে পরাজয় করা অনায়াসসাধ্য মনে করিয়া থাকে।” সরল বাংলায় বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে যদি বিরাট কোনো বৃক্ষ একাকী দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে প্রবল ঝড়ে সেটা উপড়ে পড়ে যায়। পক্ষান্তরে বহুসংখ্যক বৃক্ষ একত্রিতভাবে থাকলে প্রবল ঝড়েও তাদের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। একইভাবে অতি বড় বীরও একা থাকলে শত্রুরা তাকে পরাজিত করাকে সহজ মনে করে। ঐক্যের শক্তি কত বিরাট তা এই প্রাকৃতিক ঘটনাটির মধ্যেই সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
আজ আমাদের দেশের এই ষোল কোটি মানুষ শত সহস্রভাবে বিভক্ত হয়ে আছে। তারা বিচ্ছিন্ন গাছের মতো একাকী ও শক্তিহীন। তাই যে কোনো হালকা ঝড়েও তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যায়।

তওহীদ সম্পর্কে সঠিক ধারণা

তওহীদ সম্পর্কে সঠিক ধারণা


মাহবুব আলী
মহানবী (সা.) বলেছেন- “জান্নাতের চাবি হচ্ছে- আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা (ইলাহ) নেই” (মুয়াজ বিন জাবাল থেকে আহমদ, মেশকাত)। অপর হাদিসে এসেছে- যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে “আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা (ইলাহ) নেই এবং মোহাম্মদ (সা.) তাঁর প্রেরিত” তার জন্য জাহান্নাম হারাম হয়ে যাবে। (ওবাদাহ বিন সামিত থেকে মুসলিম, মেশকাত)। এছাড়াও অনেক হাদীস থেকে দেখানো যাবে যে, তওহীদই জান্নাতের চাবি। কালিমা তথা তওহীদের স্বীকৃতি না দিলে যেমন মুমিন মুসলিম থাকা যায় না ঠিক তেমনই স্বীকৃতি দানের পর আবার তওহীদের ওপর থেকে সরে গেলেও আর মুমিন মুসলিম থাকা যায় না, আর এটা সবাই জানে যে, মুমিন মুসলিম না থাকলে সে জান্নাতে যেতে পারবে না, সে যতই ইবাদত করুক। দীনুল হকের ভিত্তি হচ্ছে তওহীদ অর্থাৎ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এই কালিমাটি, এ নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। তওহীদ ব্যতীত কোনো ইসলামই হতে পারে না, তওহীদই ইসলামের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, মুসলিম বলে পরিচিত এই জনসংখ্যাটি তওহীদ সম্পর্কে যে ধারণা করে (আকিদা) তা ভুল। তাদের কাছে তওহীদ মানে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করা এবং তাঁর ইবাদত বা উপাসনা করা। ‘তওহীদ’ এবং ‘ওয়াহদানিয়াহ্’ এই আরবি শব্দ দু’টি একই মূল থেকে উৎপন্ন হলেও এদের অর্থ এক নয়। ‘ওয়াহদানিয়াহ্’ বলতে বোঝায় মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ যে একজন তা বিশ্বাস করা (একত্ববাদ-Monotheism), পক্ষান্তরে ‘তওহীদ’ মানে ঐ এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়া, তাঁর ও কেবলমাত্র তাঁরই নিঃশর্ত আনুগত্য করা। আরবের যে মুশরিকদের মধ্যে আল্লাহর শেষ রসুল এসেছিলেন, সেই মুশরিকরাও আল্লাহর একত্বে, ওয়াহদানিয়াতে বিশ্বাস করত, কিন্তু তারা আল্লাহর হুকুম, বিধান মানত না অর্থাৎ তারা আল্লাহর আনুগত্য করত না। তারা তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সামষ্টিক জীবন নিজেদের মনগড়া নিয়ম-কানুন দিয়ে পরিচালনা করত। এই আইনকানুন ও জীবন ব্যবস্থার উৎস ও অধিপতি হিসাবে ছিল বায়তুল্লাহ, কা’বার কুরায়িশ পুরোহিতগণ। মূর্তিপূজারী হওয়া সত্ত্বেও তাদের এই ঈমান ছিল যে, এ বিশ্বজগতের স্রষ্টা আল্লাহ একজনই এবং তাদের এই ঈমান বর্তমানে যারা নিজেদেরকে মুমিন মুসলিম বলে জানে এবং দাবি করে তাদের চেয়ে কোনো অংশে দুর্বল ছিল না (সুরা যুখরুফ ৯, আনকাবুত ৬১, লুকমান ২৫)। কিন্তু যেহেতু তারা আল্লাহর প্রদত্ত হুকুম মানত না, তাই তাদের ঐ ঈমান ছিল অর্থহীন, নিষ্ফল এবং স্বভাবতঃই আল্লাহর হুকুম না মানার পরিণতিতে তাদের সমাজ অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, নিরাপত্তাহীনতা, সংঘর্ষ ও রক্তপাতে পরিপূর্ণ ছিল, এ জন্য আরবের ঐ সময়টাকে আইয়্যামে জাহেলিয়াত বলা হয়। আল্লাহর হুকুমের প্রতি ফিরিয়ে আনার জন্যই তাদের মধ্যে রসুল প্রেরিত হয়েছিলেন। রসুলও সে কাজটিই করেছিলেন, ফলশ্র“তিতে অন্যায় অশান্তিতে নিমজ্জিত সেই সমাজটি নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার, সুখ-সমৃদ্ধিতে পূর্ণ শান্তিময় (ইসলাম অর্থই শান্তি) একটি সমাজে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং আল্লাহর আনুগত্য না করাই ছিল তাদের কাফের মুশরিক হওয়ার প্রকৃত কারণ। বর্তমানের মুসলিমরা উপলব্ধি করতে পারছে না যে প্রাক-ইসলামিক যুগের আরবের কাঠ পাথরের মূর্তিগুলিই এখন গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদির রূপ ধরে আবির্ভূত হয়েছে এবং মুসলিম জনসংখ্যাটি আল্লাহর পরিবর্তে এদের তথা এদের প্রবর্তক ও পুরোধা ‘পুরোহিতদের’ আনুগত্য করে যাচ্ছে। এই প্রতিটি তন্ত্র আলাদা আলাদা একেকটি দীন (জীবনব্যবস্থা), ঠিক যেমন দীনুল হক ‘ইসলাম’ও একটি জীবনব্যবস্থা। পার্থক্য হলো, এই মানবরচিত দীনগুলি মানবজীবনের বিশেষ কিছু অঙ্গনের, বিশেষ কিছু বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে, কিন্তু সঠিক সমাধান দিতে পারে না আর ইসলাম মানবজীবনের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় থেকে শুরু করে সামষ্টিক অঙ্গনের সকল বিষয়ে সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা দিয়ে থাকে। বর্তমানের মুসলিম নামক জনসংখ্যাটি এই সকল মানবরচিত তন্ত্রের প্রতিমার আনুগত্য করে সেই পৌত্তলিক আরবদের মতই মুশরিক ও কাফেরে পরিণত হয়েছে। আল্লাহর রসুল এসে মুশরিক আরবদেরকে আল্লাহর তওহীদের ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি সেখানে আল্লাহর একত্ববাদ (ওয়াহদানিয়াত) প্রতিষ্ঠা করেন নি, কারণ আল্লাহর একত্ববাদের বিষয়ে সেই মুশরিকদের আগে থেকেই সুদৃঢ় ঈমান ছিল (সুরা ইউসুফ- ১০৬)। তারা তাদের দেবদেবীর কোনোটিকেই আল্লাহ মনে করত না, স্রষ্টা বা প্রভুও ভাবত না, তারা সেগুলির পূজা করত এই বিশ্বাসে যে সেগুলি তাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সাহায্য করবে এবং তাদের হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে (সুরা ইউনুস- ১৮, সুরা যুমার- ৩)। সুতরাং মূর্তি পূজার নেপথ্যে তাদের প্রকৃত উপাস্য আল্লাহই ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে যে মতবাদগুলির আনুগত্য করা হচ্ছে এর মধ্যে কোথাও আল্লাহর স্থান নেই, এগুলি আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কেই সম্পূর্ণ নির্বিকার। ফলে বর্তমানের মুমিন মুসলিম হবার দাবিদারগণ যে শেরক ও কুফরে লিপ্ত তা নিঃসন্দেহে ১৪০০ বছর আগের আরবদের শেরক ও কুফরের চেয়েও নিকৃষ্টতর।
‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ যে ‘আনুগত্য করা’, উপাসনা করা নয় তা কোর’আনের বহু আয়াত থেকে বোঝা যায়। সুরা ফাতাহ’র ১৭নং আয়াতে আল্লাহ বলছেন, ‘যে আল্লাহ এবং তাঁর রসুলের আনুগত্য করে আল্লাহ তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ এখানে জান্নাতে যাওয়ার পূর্বশর্ত আল্লাহ দিলেন, যে আনুগত্য করে, বললেন না যে, ‘ইবাদত, উপাসনা করে।’ এখানে তিনি অন্য কোনো আমলের কথাও বললেন না, না সালাহ কায়েম, না যাকাত প্রদান, না হজ্ব, না সওম, অন্যান্য ছোটখাটো আমলের তো কথাই নেই। তিনি জান্নাত প্রদানের ওয়াদা করলেন শুধুই তাঁর এবং তাঁর রসুলের আনুগত্যের বিনিময়ে। সুরা নেসার ৬৯নং আয়াতটি দেখুন, আল্লাহ বলছেন, ‘যে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের হুকুম মান্য করবে সে নবী, শহীদ, সিদ্দিক ও সালেহীনদের সঙ্গে (অর্থাৎ জান্নাতে) থাকবে।’ এখানেও ‘আনুগত্য করা’ ছাড়া আর কোনো শর্ত আল্লাহ দেন নি। সুতরাং কালিমায় ব্যবহৃত ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ ‘উপাস্য’ হওয়া সম্ভব নয়, এর অর্থ অবশ্যই ‘যার আনুগত্য করা হয়, হুকুম পালন করা হয়’। আল্লাহর দাবি হচ্ছে, প্রথমে মানুষকে এই অঙ্গীকারে আবদ্ধ হতে হবে যে আল্লাহ যা হুকুম করবেন তাই সে মেনে নিবে এবং তাঁর আনুগত্য করবে। তারপর এই চুক্তি বাস্তবায়নকল্পেই সে আল্লাহর ইবাদত করতে বাধ্য, কারণ আল্লাহর হুকুম হচ্ছে একমাত্র তাঁরই ইবাদত করা। তাহলে বোঝা গেল, প্রথম কাজ আল্লাহর আনুগত্য মেনে নেওয়া, তারপরে তাঁর ইবাদত করা। সুরা আম্বিয়ার ২৫ নং আয়াতটি দেখুন, আল্লাহ বলছেন, “আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই, সুতরাং তাঁর ইবাদত করো।” যদি ইবাদত করাই প্রথম ও প্রধান কাজ হোত তাহলে আয়াতটি হোত এমন যে, “আল্লাহ ছাড়া মা’বুদ (ইবাদত, বন্দনা পাওয়ার অধিকারী) কেউ নয়, সুতরাং তাঁরই আনুগত্য করো”, আরবিতে লা মা’বুদ ইল্লাল্লাহ, ফা আত্তাবিয়্যুহু। কিন্তু কোর’আনে এমনটা একবারও বলা হয় নি। সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ ‘ইলাহ’ এবং ‘মা’বুদ’ শব্দ দু’টি ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন কারণ এদের অর্থও সম্পূর্ণ আলাদা।
মোটকথা, এই ১৫০ কোটির জনসংখ্যাটি, যারা নিজেদেরকে কেবল মুসলিমই নয়, একেবারে মুমিন ও উম্মতে মোহাম্মদী বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, তারা এগুলির কোনোটিই নয়, তারা কার্যত মুশরিক এবং কাফের। আল্লাহ বলছেন, ‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা হুকুম (বিচার ফায়সালা) করে না তারা কাফের, জালেম, ফাসেক (সুরা মায়েদা ৪৪, ৪৫, ৪৭)। এই আয়াতগুলিতে ‘হুকুম’ শব্দটি দিয়ে কেবল আদালতের বিচারকার্যই বোঝায় না, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক অর্থাৎ সামগ্রিক জীবন তাঁর নাযিল করা বিধান অর্থাৎ কোর’আন (এবং সুন্নাহ) মোতাবেক পরিচালনা করাকেও বোঝায়। মুমিন মুসলিম হবার দাবিদারগণ এখন আর একটি সু-সংহত উম্মাহরূপে নেই, তারা ভৌগোলিকভাবে পঞ্চাশটিরও বেশী জাতিরাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে ইউরোপীয় খ্রিষ্টান, ইহুদি ও পৌত্তলিকদের দাসে পরিণত হয়েছে, তাই তারা তাদের সামষ্টিক কার্যাবলী আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে ফায়সালা করে না। ফলশ্র“তিতে তারা ফাসেক (অবাধ্য), জালেম (অন্যায়কারী) এবং কাফেরে (প্রত্যাখ্যানকারী) পরিণত হয়েছে। আল্লাহ প্রদত্ত বিধানগুলিকে অপাংক্তেয় করে রেখে তারা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের আইন, কানুনগুলি নিজেদের দেশে প্রবর্তন করে তা দিয়ে সামষ্টিক কার্যাবলী পরিচালনা করছে।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই আমরা পরিস্কারভাবে বুঝতে পেরেছি যে তওহীদ ও দীন যে দুটি ভিন্ন বিষয় এবং এ দুটির তফাৎ কী। তওহীদ হচ্ছে ভিত্তি এবং দীন হচ্ছে এই ভিত্তির উপর নির্মিত অবকাঠামো, দালান। তওহীদ হচ্ছে, “একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য সকল সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করা এবং প্রতিটি বিষয়ে তাঁর হুকুমের আনুগত্য করা। সংক্ষেপে জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁর ও তাঁর রসুলের (স:) হুকুম মানা, প্রতিটি বিষয়ে যেখানেই তাঁর কোনো বক্তব্য আছে তা বিনা প্রশ্নে, বিনা দ্বিধায় মেনে নেওয়া। যে বিষয়ে তাঁর অথবা তাঁর রসুলের কোনো বক্তব্য নেই সে বিষয়ে, তা ব্যক্তিগত হোক বা সমষ্টিগত, আমরা স্বাধীনভাবে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি।”
এখন আমরা যদি মুক্তি পেতে চাই, জান্নাতে যেতে চাই, মুমিন-মুসলিম হতে চাই তবে আমাদের আগে কালিমাতে ফিরে আসতে হবে, আমাদেরকে আগে স্বীকৃতি দিতে হবে, “যেখানেই আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কোনো হুকুম, নির্দেশনা আছে সেখানে আর কারো হুকুম মানি না।” আর এই কালিমার ভিত্তির উপর আমাদের একতাবদ্ধ হতে হবে।

মানবতার কল্যাণই প্রকৃত এবাদত

মানবতার কল্যাণই প্রকৃত এবাদত




মহান সৃষ্টিকর্তা উদ্দেশ্যহীনভাবে কিছুই সৃষ্টি করেননি। যাকে যে উদ্দেশ্যে বা যে কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন সেই কাজ করাই তার এবাদত। সূর্যকে সৃষ্টি করা হয়েছে আলো ও তাপ দেবার জন্য, এ কাজ করাই সূর্যের এবাদত। তেমনি ঘড়ির এবাদত সময় দেখানো, গাড়ির এবাদত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেয়া। তাহলে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ সৃষ্টির পেছনেও স্রষ্টার কোনো মহান উদ্দেশ্য রয়েছে। মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁর সমস্ত সৃষ্টিজগত যেভাবে সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে পরিচালনা করেন; ঠিক তেমনি পৃথিবীতে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং মানবতার কল্যাণ করার জন্য মানুষ সৃষ্টি করেছেন। এটাই তার প্রকৃত এবাদত। অথচ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষকে সৃষ্টি করা হলো সে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ বাদ দিয়ে, পৃথিবীকে অন্যায় অশান্তি ও রক্তারক্তির অন্ধকার কুয়ায় নিক্ষেপ করে মানুষ যার যার উপাসনালয়ে বসে স্রষ্টার গুণগানকে প্রধান এবাদত মনে করে খুব সাবধানতার সাথে পালন করে যাচ্ছে। মানবজাতি যে অন্যায় অশন্তির উত্তপ্ত সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে তাতে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। কারণ মানুষ জানেইনা কেন তাকে সৃষ্টি করা হলো? তাই বলে উপাসনা করা নিষেধ নয়। মানবতার কল্যাণে অবদান রাখার মতো মনোবল ও আত্মিক শক্তি অর্জনের জন্য উপাসনা প্রয়োজন।
আজ পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ এই চিন্তা নিয়ে ঘুম থেকে উঠে যে, পরের পকেটের টাকা কিভাবে নিজের পকেটে ঢুকাবে। এর জন্য তারা কোনো অন্যায় করতেও পিছপা হয় না। মানবতার কল্যাণ তো অনেক দূরের কথা। একটু কল্পনা করি তো এই ৭০০ কোটি মানুষ যদি এই চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুম থেকে উঠে যে, কিভাবে আমি মানুষের কল্যাণ করব, অন্যের দুঃখ-কষ্ট দূর করব, যে উদ্দেশ্যে স্রষ্টা আমাকে সৃষ্টি করলেন সেই কাজ করে স্রষ্টার এবাদত করব তাহলে এই অন্যায়-অশান্তি, ক্ষুধা-দারিদ্র এসব থাকবে? নিমিষেই সমাধান হবে এত বড় সমস্যা। কি আশ্চর্যের বিষয়, কত সহজ সমাধান! অথচ আমরা কখনও চিন্তাও করিনি। বর্তমানে শান্তির আশায় কত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, কত সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, লক্ষ লক্ষ কর্মীর শ্রম, কোটি কোটি ডলার ব্যায় করা হচ্ছে। কিন্তু শান্তি কি এসেছে? আসেনি, আসবেও না। কারণ প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, মানবতার কল্যাণের জন্য কেউই কাজ করছে না। সবাই মানবতার কল্যাণের ওসিলায় নিজের কল্যাণে ব্যস্ত। অন্যের সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে নিজে সুখে থাকার চেষ্টায় রত। আলিশান উপাসনালয়ে বসে উপাসনা করলে স্রষ্টা খুশী হবেন না, মানবজাতিও শান্তিতে থাকবে না। স্রষ্টা শুধু মসজিদ, মন্দির, উপাসনালয়ে থাকেন না। স্রষ্টা থাকেন ভগ্নপ্রাণ মানুষের কাছে, বিপদগ্রস্তদের কাছে। তাই মসজিদ মন্দিরে স্রষ্টাকে না খুঁজে, ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করা উচিত, গৃহহীনকে গৃহ নির্মান করে দেয়া উচিত। আর্ত পীড়িতের পাশে দাঁড়ানো উচিত। মানবতার কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করাই প্রকৃত ধর্ম, প্রকৃত এবাদত। এতে স্রষ্টা সবচেয়ে বেশী খুশি হবেন, মানবজাতি শান্তিতে ও নিরাপত্তায় থাকবে। আর আমাদেরও মানবজনম সার্থক হবে।

তাহাজ্জুদ যখন ঘুম নষ্ট রোজা যখন উপবাস

তাহাজ্জুদ যখন ঘুম নষ্ট রোজা যখন উপবাস


মূল: এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী
ভবিষ্যতে মুসলিম নামধারী এই জাতিটির কতখানি আকীদা বিচ্যুতি ঘটবে এবং তার দরুন তারা যে ইসলামের গণ্ডি থেকেই বহিরাগত হয়ে যাবে তা বোঝাতে গিয়ে আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে রসুলাল্লাহ (সা.) বলেন- ‘এমন সময় আসবে যখন ইসলাম শুধু নাম থাকবে, কোর’আন শুধু অক্ষর থাকবে, মসজিদসমূহ লোকে লোকারণ্য হবে কিন্তু সেখানে হেদায়াহ থাকবে না, আমার উম্মাহর আলেমরা হবে আসমানের নিচে সর্বনিকৃষ্ট জীব, তাদের তৈরি ফেতনা তাদের উপরই পতিত হবে। (আলী (রা.) থেকে বায়হাকী, মেশকাত)। কোর’আন শুধু অক্ষর থাকবে- এই কথাটি কীভাবে অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত হয়েছে তা বর্তমানে এই জাতির দিকে লক্ষ করলেই পরিষ্কার। কোর’আনের হুকুম এবং শিক্ষা এই জাতি প্রত্যাখ্যান করে দাজ্জালের হুকুম, বিধান মেনে নিয়েছে। কাজেই বর্তমানে কোর’আন শুধুু অক্ষরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর কোনো কার্যকারিতা নেই। আবার একই বক্তব্যের সমর্থনে তিনি অপর একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, “এমন সময় আসবে যখন মানুষ রোজা থাকবে কিন্তু তা হবে না খেয়ে থাকা, রাত জেগে নামাজ পড়বে কিন্তু তা হবে কেবল ঘুম নষ্ট করা (অর্থাৎ তাহাজ্জুদ হবে না)। (ইবনে মাজাহ, আহমাদ, তাবারানী, দারিমি, মেশকাত)।” এই হাদিসগুলোতে মহানবী (সা.) কাদের বোঝাচ্ছেন? প্রথম হাদিসে বলা হয়েছে- ইসলাম শুধু নাম থাকবে। অর্থাৎ ইসলাম শুধুমাত্র নামের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কার্যত ইসলামের নামে যেটা চলবে সেটা প্রকৃত ইসলাম হবে না। আর যেটা প্রকৃত ইসলাম নয় তার অনুসারীরাও যে প্রকৃত মুসলিম নন- তা বোঝা যায় সাধারণ জ্ঞানেই। আবার একই হাদিসে তিনি বলেছেন- মসজিদসমূহ লোকে লোকারণ্য হবে, কিন্তু সেখানে হেদায়াহ থাকবে না। এখানেও একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি। অর্থাৎ মানুষ মসজিদে যাবে, সেখানে গিয়ে আল্লাহর এবাদত করবে, নামাজ পড়বে কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও তাদের মধ্যে হেদায়াত থাকবে না। আর হেদায়াত না থাকার মানেই হলো তারা হবে পথভ্রষ্ট।
আবার দ্বিতীয় হাদিসে তিনি মানুষ বলতে তাদেরই বোঝাচ্ছেন যারা নিজেদের মুসলিম বলে মনে করে। কারণ তিনি অন্য নবীদের উম্মত খ্রিষ্টান-ইহুদিদের সম্বন্ধে বলছেন না। দ্বিতীয় কথা হলো হাজারো রকমের এবাদতের মধ্য থেকে মাত্র দু’টি তিনি বেছে নিয়েছেন। একটি রোজা অন্যটি তাহাজ্জুদ। তৃতীয় হলো এর একটা ফরদ-বাধ্যতামূলক, অন্যটি নফল- নিজের ইচ্ছাধীন। বিশ্বনবী (সা.) পাঁচটি বাধ্যতামূলক ফরজ এবাদত থেকে একটি এবং শত শত নফল এবাদত থেকে একটি বেছে নেয়ার উদ্দেশ্য হলো এই মনস্তত্ত্বের দিক দিয়ে আল্লাহ রসুল ও দীনের উপর পরিপূর্ণ (মোকাম্মেল) ঈমান ছাড়া কারো পক্ষে এক মাস রোজা রাখা বা নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়া সম্ভব নয়। এমনকি মোকাম্মেল ঈমান আছে এমন লক্ষ লক্ষ মানুষ আছে যারা তাহাজ্জুদ পড়েন না। অর্থাৎ রসুলাল্লাহ বোঝাচ্ছেন তাদের যাদের পরিপূর্ণ দৃঢ় ঈমান আছে আল্লাহ-রসুল-কোর’আন ও ইসলামের উপর। এই হাদিসে তিনি মোনাফেক বা লোক দেখিয়ে করা যায় অর্থাৎ রিয়াকারীদের বোঝান নি। কারণ যে সব এবাদত লোক দেখিয়ে করা যায় অর্থাৎ মসজিদে যেয়ে নামাজ-হজ্ব-যাকাত ইত্যাদি একটিও উল্লেখ করেন নি। মোনাফেক রিয়াকারী বোঝালে তিনি অবশ্যই এগুলো উল্লেখ করতেন যেগুলো লোক দেখিয়ে করা যায়। তিনি ঠিক সেই দু’টি এবাদত উল্লেখ করলেন যে দুটি মোনাফেক ও রিয়াকারীর পক্ষে অসম্ভব, যে দু’টি লোকজন দেখিয়ে করাই যায় না, যে দুটি পরিপূর্ণ ঈমান নিয়েও সবাই করতে পারে না। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তিনি ভবিষ্যত বাণী করেছেন যে এমন সময় আসবে যখন আমার উম্মতের মানুষ পরিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী হয়ে নামাজ-রোজা-হজ্ব-যাকাত-তাহাজ্জুদ ইত্যাদি সর্ববিধ এবাদত করবে কিন্তু কোন কিছুই হবে না, কোন এবাদত গৃহীত-কবুল হবে না। যদি দীর্ঘ এক মাসের কঠিন রোজা এবং মাসের পর মাস বছরের পর বছর শীত-গ্রীষ্মের গভীর রাত্রে শয্যা ত্যাগ করা তাহাজ্জুদ নিষ্ফল হয়, তবে অন্যান্য সব এবাদত অবশ্যই বৃথা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যারা শুধু পরিপূর্ণ বিশ্বাসী অর্থাৎ মোকাম্মল ঈমানদারই নয়, রোজাদার ও তাহাজ্জুদীও, তাদের এবাদত নিষ্ফল কেন? তাছাড়া তাদের এবাদতই যদি বৃথা হয় তবে অন্যান্য সাধারণ মুসলিমদের এবাদতের কী দশা?
মহানবীর (সা.) ঐ ভবিষ্যদ্বাণীর একমাত্র সম্ভাব্য উত্তর হচ্ছে এই যে, তিনি যাদের কথা বলছেন তারা গত কয়েক শতাব্দী ও আজকের দুনিয়ার মুসলিম নামধারী জাতি। আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা.) এই জাতির সম্মুখে যে উদ্দেশ্য স্থাপন করে দিয়েছিলেন সটা হলো আল্লাহর দেওয়া সত্যদীন, দীনুল হক পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠা করে মানবজীবন থেকে যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, অশান্তি দূর করে ন্যায়, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। এই আকিদার বিকৃতিতে জাতি তা বদলিয়ে অন্য উদ্দেশ্য স্থাপন করে নিয়েছে। আল্লাহ রসুলের (সা.) স্থাপিত উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য যে ঐক্যবদ্ধ, সুশৃঙ্খল, আনুগত্যশীল, দুর্জেয় সংগ্রামী চরিত্রের প্রয়োজন, সেই চরিত্র তৈরির জন্য যে প্রশিক্ষণ- সেই প্রশিক্ষণ (অর্থাৎ সালাহ, সওম বা নামাজ, রোজা) এবং আরও অন্যান্য ব্যাপারকে ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া হয়েছে। উদ্দেশ্যই যেখানে নেই বা বিকৃত সেখানে প্রশিক্ষণের আর কোন দাম, অর্থ থাকতে পারে না। কাজেই ঐসব প্রশিক্ষণ অর্থাৎ নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি সর্ব প্রকার এবাদত আজ নিষ্ফল, অর্থহীন। এতে কোন সন্দেহ নেই যে আমার এই কথায় বর্তমানের এই জাতিটি- যেটা নিজেকে শুধু মুসলিম নয় একেবারে উম্মতে মোহাম্মদী বলে মনে করে- এই জাতি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠবে। বিশেষ করে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে এই জাতির সেই অংশ যেটা আল্লাহ রসুলের কঠোর সতর্ক বাণী ও নিষেধ অগ্রাহ্য করে, সেরাতুল মোস্তাকীম ও দীনুল কাইয়্যেমা (জীবনের সর্বক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহর দেয়া বিধান ছাড়া সমগ্র বিধান অস্বীকার, সালাহ ও যাকাত প্রতিষ্ঠা) ত্যাগ করে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ফতোয়াবাজী করে জাতিকে শত টুকরোয় ভেঙ্গে খান খান করে দিয়েছেন এবং ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে সেই অন্য অংশটি যেটা আত্মার উৎকর্ষ ও আল্লাহর সান্নিধ্যের নাম করে জাতির সম্মুখে আল্লাহ ও রসুলের (সা.) স্থাপিত উদ্দেশ্য (মানবতার কল্যাণ) বদলিয়ে অন্য উদ্দেশ্য স্থাপন করেছেন, যে জাতিকে বিশ্বনবী (সা.) মিথ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সে জাতিকে সংগ্রাম ভুলিয়ে হাতে তসবিহ ধরিয়ে দিয়ে টেনে খানকায় বসিয়ে দিয়েছেন, জাতির বর্হিমুখী দৃষ্টিভঙ্গীকে অন্তর্মুখী করে তাকে কাপুরুষে পরিণত করেছেন, সিংহকে ইদুরে পরিণত করেছেন।
অকপট সত্যান্বেষী মন নিয়ে চিন্তা করলে দেখতে পাবেন যে আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থাকে জাতীয় জীবনে অস্বীকার করে মানুষের তৈরি জীবন ব্যবস্থা গ্রহণ করে পরিণতিতে পৃথিবীতে যে অন্যায়-অবিচার শোষণ-রক্তপাত হচ্ছে সে সবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করে সে সব থেকে মুখ ফিরিয়ে যারা মহা এবাদতে মশগুল হয়ে আছেন যাবতীয় অন্যায়, অসত্যের বিরুদ্ধে যারা প্রচণ্ড বিরোধ গড়ে তুলছেন না, যারা নানাভাবে জাতির ঐক্য ধ্বংস করে যাচ্ছেন তারাই হচ্ছেন রসুলাল্লাহর (সা.) ঐ ভবিষ্যতবাণীর লক্ষ্য। আল্লাহ এই জাতিকে লক্ষ্য করে বলছেন, “তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি (উম্মাহ) কারণ মানবজাতির মধ্যে থেকে তোমাদিগকে উত্থিত করা হয়েছে এই জন্য যে (তোমরা মানুষকে) সৎ কার্য করার আদেশ দান এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত করবে, আল্লাহকে বিশ্বাস করবে (কোর’আন- সুরা আলে-ইমরান ১১০)।” অর্থাৎ এই উম্মাহকে মানব জাতির মধ্য থেকে সৃষ্টিই করা হয়েছে মানুষকে অসৎ কাজ (আল্লাহর বিধানের বিরোধী কাজ অর্থাৎ যে কাজে মানুষের অকল্যাণ হয় তাই হলো অসৎ কাজ) থেকে নিবৃত্ত করা ও সৎ কাজ (আল্লাহর বিধান অনুযায়ী কাজ অর্থাৎ যে কাজ করলে মানুষের কল্যাণ হয় তাই হচ্ছে সৎকাজ) করার আদেশ করার জন্য এবং এই কাজ করার জন্যই সে জাতি শ্রেষ্ঠ জাতি। যে বা যারা এবাদতের নাম করে আল্লাহর যিকরের নাম করে বা যে কোন ছুতোয় বিরোধিতার ভয়ে, পার্থিব ক্ষতির ভয়ে, যে জন্য তাদের মানব জাতির মধ্য থেকে উত্থিত করা সেই কাজ থেকে পালায় তবে সে বা তারা আর সেই শ্রেষ্ঠ জাতির মধ্যেই নেই সুতরাং তাদের সব রকম এবাদত অর্থহীন, নিষ্ফল। (যখন সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করার দায়িত্ব পালন ত্যাগ করা হয় তখন মানুষের কোন আমল আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। হাদিস তিরবানী।)
এইখানে আরও একটি কথা বুঝে নেয়া প্রয়োজন। কোর’আনের এই আয়াতে আল্লাহ সৎকাজের জন্য যে শব্দটি ব্যবহার করেছেন সেটা হলো আদেশ, আরবিতে ‘আমর’। আদেশ তখনই করা যায় যখন সে আদেশকে কাজে পরিণত করা যায়, অর্থাৎ কাজে পরিণত করার শক্তি থাকে, নইলে খুব জোর অনুরোধ করা যায়। অসৎ কাজ থেকে মানুষকে বিরত করার ব্যাপারেও তাই। মানুষকে অর্থাৎ সমাজকে সৎকাজ করার আদেশ এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখার শক্তি শুধু রাষ্ট্রের থাকে অন্য কারো নয়। অন্য যে কেউ করতে গেলে তাকে শুধু অনুরোধ বা কাকুতি-মিনতি করতে হবে। কিন্তু আল্লাহ অনুরোধ শব্দ ব্যবহার করেন নি, করেছেন ‘আমর’ আদেশ অর্থাৎ ঐ কাজ করতে হবে রাষ্ট্রশক্তিতে। উপদেশ ও অনুরোধে যে ও কাজ হবে না তার প্রমাণ বর্তমান মানব সমাজ। এই সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ, অন্যায় কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখা যে আল্লাহ উপদেশ, অনুরোধের মাধ্যমে করা বোঝান নি তা পরিষ্কার হয়ে যায় তার কোর’আনের আরেকটি আয়াতে। তিনি বলেছেন- এরা (মো’মেন) তারা, যাদের আমি তাদের পৃথিবীতে (বা পৃথিবীর যে কোন অংশে) ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করলে সালাত (নামাজ) কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং ন্যায়, সৎ কাজের আদেশ দেয়, এবং অন্যায়, অসৎ কাজ থেকে বিরত করে (কোর’আন- সুরা আল-হজ ৪১)। এখানে লক্ষ্য করুন-মানুষকে ন্যায় কাজের আদেশ এবং অন্যায় থেকে বিরত রাখার জন্য আল্লাহ কী পূর্বশর্ত দিচ্ছেন। তিনি বলছেন আমি তাদের পৃথিবীতে (বা পৃথিবীর যে কোন অংশে) ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করার পর, কারণ তিনি ভালো করেই জানেন যে, ন্যায় কাজের আদেশ ও মানুষকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখা এ দু’টোর কোনটাই সম্ভব নয় রাষ্ট্রশক্তি ছাড়া। সুতরাং যারা অনুরোধ, উপদেশ, কাকুতি-মিনতি করে ঐ কাজ করতে চেষ্টা করছেন তারা পণ্ডশ্রম করছেন। কাজেই রাষ্ট্রশক্তি যাদের নিয়ন্ত্রণে তাদের প্রথম এবং প্রধান কর্তব্যই হলো সৎ কাজের আদেশ দেওয়া এবং অসৎ ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত হওয়া এবং জাতিকে বিরত রাখা। এর জন্য যে সঠিক আদর্শ দরকার তাই আমরা তুলে ধরছি।
[মতামতের জন্য ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৯৩৩৭৬৭৭২৫, ০১৭৮২১৮৮২৩৭, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩]

Thursday, February 25, 2016

সনাতন জীবনব্যবস্থাই ইসলাম

সনাতন জীবনব্যবস্থাই ইসলাম


সনাতন শব্দের অর্থ- নিত্য, চিরস্থায়ী, চিরন্তন, শাশ্বত এবং দীনুল কাইয়্যেমা শব্দের অর্থ- যা চিরদিন প্রবহমান, চিরন্তন ও শাশ্বত। এই অর্থে সনাতন এবং কাইয়্যেমা একার্থবোধক। অর্থাৎ যে নিয়ম, নীতি, পদ্ধতি লক্ষ বছর পূর্বে ছিল, এখন আছে এবং লক্ষ বছর পরেও যা সত্য থাকবে। যেমন লক্ষ বছর আগেও আগুন উত্তাপ দিত, এখনও আগুন উত্তাপ দেয় এবং লক্ষ বছর পরেও আগুন উত্তাপ দেবে- এটিই হলো চিরন্তন, শাশ্বত, সনাতন নীতি, পদ্ধতি। এরকম সনাতন, শাশ্বত নিয়ম, নীতি, পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে যে জীবনব্যবস্থা তাই হলো সনাতন জীবনব্যবস্থা বা দীনুল কাইয়্যেমা। আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে ইসলামকে দীনুল কাইয়্যেমা বলেছেন (সুরা বাইয়েনাহ-৫, ইউসুফ-৪০)। অর্থাৎ সনাতন জীবনব্যবস্থাই ইসলাম।
আদম (আ.) থেকে শুরু করে শেষনবী (দ.) পর্যন্ত আল্লাহ যে জীবন বিধান মানুষের জন্য পাঠিয়েছেন, স্থান, কাল ভেদে সেগুলোর নিয়ম-কানুনের মধ্যে প্রভেদ থাকলেও সর্বক্ষণ ভিত্তি থেকেছে তওহীদ এবং মৌলিক বিষয়গুলিতেও কোনো পরিবর্তন আনা হয় নি। এই জীবনব্যবস্থার ভিত্তি এবং মৌলিক বিষয়গুলি সানাতন, শাশ্বত, কাইয়্যেমা, যা পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। যেমন ভিত্তি হচ্ছে তওহীদ, একমাত্র প্রভু, একমাত্র বিধাতা (বিধানদাতা) আল্লাহ। যার আদেশ নির্দেশ, আইন-কানুন ছাড়া অন্য কারো আদেশ, নির্দেশ, আইন-কানুন কিছুই না মানা। আল্লাহ মানুষের কাছে এইটুকুই মাত্র চান। কারণ তিনি জানেন যে, মানুষ যদি সমষ্টিগতভাবে তিনি ছাড়া অন্য কারো তৈরি আইন কানুন না মানে, শুধু তারই আইন-কানুন মানে তবে শয়তান তার ঘোষিত উদ্দেশ্য অর্থাৎ মানুষকে দিয়ে অশান্তি, অন্যায় আর রক্তপাত অর্জনে ব্যর্থ হবে এবং মানুষ সুবিচারে, শান্তিতে (ইসলামে) পৃথিবীতে বসবাস করতে পারবে- অর্থাৎ আল্লাহ যা চান। কত সহজ। আল্লাহ এই দীনুল কাইয়্যেমার কথা বলে বলছেন- এর বেশি তো আমি আদেশ করি নি (সুরা আল বাইয়েনাহ ৫)।
এই সনাতন জীবনব্যবস্থাই ইসলাম। যুগে যুগে এই জীবনব্যবস্থার মৌলিক রূপের কোনো পরিবর্তন হয় নি। হিন্দুরা যে ধর্মের অনুসারী সেটি যেমন সনাতন ধর্ম অর্থাৎ ইসলাম, খ্রিস্টানরাও মূলত ঐ একই ধর্মের অনুসারী। আবার বৌদ্ধ, ইহুদি ও মুসলিম সকলেই একই সনাতন বা ইসলাম ধর্মের অনুসারী কারণ আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রসুলদের কাছে যে দীন পাঠিয়েছেন তার নাম ইসলাম। কিন্তু প্রতিটা ধর্মই তার অনুসারীদের মধ্যে থেকে কিছু অতিভক্তিবাদী শয়তান প্রকৃতির স্বার্থান্বেষী মানুষের এবং ধর্মব্যবসায়ীদের হস্তক্ষেপে মূল সনাতন রূপ হারিয়ে গেছে। এর ফলেই আজ নানা ধর্মের সৃষ্টি কিন্তু আদিতে, গোড়ায় এক।

পাথরের সামনে আগুন জ্বালালেই মিলবে ওয়াইফাই

পাথরের সামনে আগুন জ্বালালেই মিলবে ওয়াইফাই



 একে কলিযুগের ‘পরশ পাথর’ বললেও ভুল বলা হবে না। তবে এর ছোঁয়াতেই সব সোনা হয়ে যাবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু এই পাথরের অদ্ভুত কাজ মানুষকেও অবাক করে। জার্মানির এক মিউজিয়ামে রাখা অদ্ভুত এই পাথরের কাজ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে বেশ হইচই পড়ে গিয়েছে।
কী রয়েছে ওই পাথরে?
দেড় টন ওজনের ওই পাথরটি মিউজিয়ামের বাইরে রাখা রয়েছে। ওই পাথরের সামনে গিয়ে আগুন জ্বালালেই ওয়াইফাই সিগন্যাল চালু হয়ে যায়। শুনে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি।
মিউজিয়ামের বাইরে পড়ে থাকা ওই পাথরকে সাধারণ মানের বলেই ভ্রম হতে পারে। কিন্তু এর ক্ষমতা দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। তবে পাথরের ক্ষমতাকে কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা হয়েছে। আর এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে কেউ ধরতেই না পারেন পাথরের ভিতরে কিছু একটা রয়েছে।
এ বার আসল কথায় আসা যাক। যে পাথরকে নিয়ে এত হইচই আসলে সেটা একটা মামুলি পাথর। বিজ্ঞানীরা পাথরটিকে কেটে ওর ভিতরে একটি থার্মো ইলেক্ট্রিক জেনারেটর বসিয়ে দিয়েছেন। পাথরের গায়ের কাছে আগুন জ্বালালেই সেটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আর সেই তাপকে বিদ্যুতে পরিণত করে। আর এই বিদ্যুৎ মিলতেই মিউজিয়ামের ওয়াইফাই রাউটার চালু হয়ে যায়। সাধারণ পর্যটকেরা সেখানে গিয়ে আগুন জ্বালাচ্ছে আর ওয়াইফাই-এর মজা নিচ্ছেন।
কিন্তু এর আসল কারণ অনেকেরই অজানা। কী ভাবে চালু হচ্ছে ইন্টারনেট তা কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে পাথরটিকে। আর পাথরটির নাম দেওয়াও হয়েছে ‘কিপ এলাইভ’। আনন্দবাজার পত্রিকা।

মো’মেনের সংজ্ঞা কি???

মো’মেনের সংজ্ঞা কি???


মো’মেন শব্দটি এসেছে ঈমান অর্থাৎ বিশ্বাস থেকে। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ মো’মেনের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে,
“তারাই মো’মেন যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের উপর ঈমান আনে এবং আর কোন সন্দেহ পোষণ করে না এবং জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ। (সুরা হুজরাত ১৫)।
আল্লাহর দেয়া প্রকৃত মো’মেনের এই সংজ্ঞাটা ঠিক ভাবে বুঝতে গেলে আমাদের বুঝতে হবে “যারা আল্লাহর ওপর ঈমানে”র অর্থ শুধু আল্লাহর অস্তিত্বে ও একত্বের ওপর ঈমান নয়, তাঁর উলুহিয়াতের ওপর, সার্বভৌমত্বের ওপর (Sovereignty) ঈমান, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন আদেশদাতা, হুকুমদাতা নেই এই বিশ্বাস করা অর্থাৎ তওহীদ।
আল্লাহর দেয়া মো’মেনের এই সংজ্ঞার দ্বিতীয় ভাগ হলো প্রাণ ও সম্পদ দিয়ে জেহাদ করা। কি জন্য জেহাদ করা? আল্লাহর তওহীদের, সার্বভৌমত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত দীনটি যদি মানুষের জীবনে প্রতিষ্ঠা, কার্যকর না হয় তবে ওটা অর্থহীন। কাজেই আল্লাহর তওহীদ ভিত্তিক ঐ দীনুল হক, সত্য জীবন-ব্যবস্থাটা মানব জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, জেহাদ। এই দু’টি একত্রে প্রকৃত মো’মেনের সংজ্ঞা। এই দু’টি যার মধ্যে আছে, আল্লাহর দেয়া সংজ্ঞা মোতাবেক সে প্রকৃত মো’মেন। এই সংজ্ঞায় আল্লাহ বলেন নি, যে সালাহ পড়বে সে মো’মেন, বা যে রোযা রাখবে সে মো’মেন, বা যে হজ্ব করবে, বা অন্য যে কোন পূণ্য, সওয়াবের কাজ করবে সে মো’মেন।
এ সংজ্ঞায় শুধু আল্লাহ ছাড়া আর সমস্ত রকম প্রভূত্ব, সার্বভৌমত্ব অস্বীকার ও আল্লাহর পথে জেহাদ। এর ঠিক বিপরীতে তিনি এ সতর্কবাণীও বলেছেন যে এ তওহীদে যে বা যারা থাকবে না, যারা তাদের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত জীবনের যে কোন একটি ভাগে, অঙ্গনে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বা নিজেদের তৈরি আইন-কানুন, রীতি-নীতি গ্রহণ বা প্রয়োগ করবে, আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ইলাহ বা সার্বভৌম হুকুমদাতা হিসাবে মানবে তারা শেরক করবে। আর শেরক ক্ষমা না করার জন্য আল্লাহ অঙ্গীকারাবদ্ধ (কোর’আন- সুরা নেসা ৪৮)।
মহান আল্লাহ মো’মেনের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন আজ সারা পৃথিবীতে সেই সংজ্ঞা মোতাবেক মো’মেন আছে? নেই। আর মো’মেন নয় মানেই কাফের মোশরেক।

Wednesday, February 24, 2016

ধর্মহীন শিক্ষা-ব্যবস্থার উত্তরাধিকার

ধর্মহীন শিক্ষা-ব্যবস্থার উত্তরাধিকার




রিয়াদুল হাসান
মানবজাতির ইতিহাসে ধর্মের অধ্যায়টি বিরাট। এ বিরাট অধ্যায়ের দিকে তাকানোর জন্য আমাদের সামনে এখন দুটো চশমা রয়েছে। একটি ধর্মহীন চশমা, আরেকটি ধর্মের চশমা। এ দুটো চশমায় আমাদের অতীত দুটি ভিন্ন প্রকৃতি নিয়ে ধরা পড়ে।
ধর্মহীন চশমা বলছে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এমনিতেই সৃষ্টি হয়েছে, এর কোনো স্রষ্টা নেই। সকল জীব ও জড়ও এমনি এমনিই সৃষ্টি হয়েছে। প্রাণীকুলের মধ্যে কেউ উন্নত, কেউ অনুন্নত যা নির্ণিত হয়েছে তাদের অভিযোজনের ক্ষমতার তারতম্য দ্বারা। মানুষ (খুব সম্ভবত) একটি বানরজাতীয় বিবর্তিত প্রাণী, যার আদিপিতা-পিতৃব্যরা গাছে থাকত, তাদের লেজ ছিল। খুলির আকৃতির পার্থক্য অনুযায়ী তারা নিগ্রয়েড, ককেশয়েড, মঙ্গলয়েড, অস্ট্রালয়েড ইত্যাদি শ্রেণিবিন্যাসে বিভক্ত।
আর ধর্মের চশমা বলছে, এই বিশ্বজগৎ নিজে থেকে সৃষ্টি হয় নি, এর একজন স্রষ্টা আছেন, যিনি নিরন্তর এটি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিপালন করছেন। তিনি বিশ্বজগতে এমন কিছু প্রাকৃতিক নিয়ম, ব্যবস্থা বা চক্র আরোপ করেছেন যার দ্বারা সকল বস্তু ও প্রাণির সৃষ্টি, পালন, বাস্তুসংস্থান, ধ্বংস ইত্যাদি সাধিত হয়। মানুষ স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ ও ব্যতিক্রমী এক সৃষ্টি যার উদ্ভব জান্নাতে, যার আদিপিতা আদম (আ.), আদিমাতা হাওয়া (আ.)। তাদের থেকেই আজকের সকল হিন্দু, সকল বৌদ্ধ, সকল মুসলিম, সকল খ্রিষ্টান, আর সকলেই।
একটি চশমা দিয়ে তাকালে দেখি নূহ (আ.), ইব্রাহীম (আ.), মুসা (আ.), ঈসা (আ.) ইত্যাদি বহু উজ্জ্বল নাম। অন্য চশমায় তাদেরকে দেখা যায় না, সেখানে আছে বস্তুবাদী দার্শনিক আর বিভিন্ন রাজবংশের নাম। একটি চশমা বলছে, মানব ইতিহাস নবী-রসুলদের মাধ্যমে মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রামের ইতিহাস, ধর্মের দ্বারা মানবজাতির শান্তি পাওয়ার ইতিহাস। অন্য চশমাটি বলছে মানুষের অতীত অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল ধর্ম নামক কুসংস্কার ও বর্বরতা দ্বারা। বর্তমানে ধর্ম বিদায় নিয়েছে, মানুষ অন্ধত্ব থেকে মুক্তি পাচ্ছে।
বর্তমানে আমরা জাতি হিসাবে দ্বিধাগ্রস্ত, ধর্ম ও আধুনিকতা একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে দণ্ডায়মান, দু নৌকায় পা দিয়ে আছি আমরা। পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি উজ্জ্বল আকর্ষণ নিয়ে হাতছানি দিচ্ছে, ধর্ম ক্রমেই বিবর্ণ ও আকর্ষণহীন বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্তের কণিকায় মিশে আছে যা বাদ দেওয়া সহজ নয়। তবে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ধর্মের প্রতি সন্দেহ সৃষ্টির যে প্রচেষ্টা বিগত শতাব্দীগুলোতে চালানো হয়েছে তা খুবই সফল হয়েছে। উত্তর-ঔপনিবেশিক তথাকথিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় এই দ্বিধা ও সন্দেহ সৃষ্টির সচেতন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। উপরে যে দুটো চশমার কথা বললাম, বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যা, বিশেষ করে মুসলিম নামধারীরা এ দুটো চশমা দিয়েই নিজেদের ইতিহাসকে দেখতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। এর প্রভাব পড়ছে তাদের ব্যক্তি থেকে জাতীয় জীবনের সর্বত্র।
এ শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মকে রাখা হয়েছে নামে মাত্র। এস.এস.সি পর্যন্ত ধর্মের যেটুকু রাখা হয়েছে সেটুকুর উদ্দেশ্য নৈতিকতার শিক্ষা প্রদান। কারণ এটা অস্বীকার করার মত অবস্থা এখনও সৃষ্টি হয় নি যে, সকল ভদ্রতা, শিষ্টাচার, সত্যনিষ্ঠা ধর্মেরই অবদান। ধর্ম বইতে বলা হচ্ছে সমস্ত কিছুর মালিক স্রষ্টা, অথচ অন্য সকল বইয়ে ‘আল্লাহ’ শব্দটিও খুঁজে পাওয়া মুশকিল, এমনভাবে স্রষ্টার অস্তিত্বতে অস্বীকার করা হয়েছে। আর ধর্মকে সবচেয়ে গুরুত্বহীন বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে। যে ধর্ম সেখানে শেখানো হচ্ছে সেটাও মানুষের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েই আলোচনা করে, সামষ্টিক জীবন কীভাবে চলবে তা শেখানোর জন্য আছে অন্যান্য বিষয়সমূহ। এটা হচ্ছে মানবজাতিকে ধর্মবিমুখ করে তোলার একটি সুদূরপ্রসারী প্রক্রিয়া। কিন্তু পাশ্চাত্যে নানা কারণে এ প্রক্রিয়া কিছুটা সফল হলেও প্রাচ্যে এটি কয়েক শতাব্দী পরও খাপ খাচ্ছে না। বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে গেলে একটু গভীরে যেতে হবে।
‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ দর্শনটি উনিশ শতকে যুক্তরাজ্য থেকে প্রথমত উদ্ভূত হয়েছে। ১৮৪৬ সালে জর্জ জ্যাকব হোলিওক (George Jacob Holyoake) নামক এক ব্যক্তি সেকুলারিজম শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। Oxford Dictionary-তে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (Secularism)-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, Belief that religion should not be involved in the organization of society, education, etc. অর্থাৎ সমাজ কাঠামোতে ধর্মকে সম্পৃক্ত করা যাবে না এমন বিশ্বাস পোষণ করাই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। এ মতবাদের অনুসারী (Secular) স¤পর্কে বলা হয়েছে, Not connected with spiritual or religious matter যিনি আধ্যাত্মিক বিষয় বা ধর্মীয় বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত নন।
মূলত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে যুক্তি ও মুক্তবুদ্ধির চর্চার নামে Enlightenment Movement-এর ফসল হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ এর উদ্ভব হয়েছে। মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনের মাধ্যমে এর অনুসারীরা মহান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে মানবসভ্যতার ইতিহাসে স¤পূর্ণ নতুন দর্শন আমদানি করলেন যে, রাষ্ট্র ও সমাজের সাথে ধর্মের কোনো স¤পর্ক নেই; ধর্ম শুধু ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা অন্তরের ব্যাপার; অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও শিক্ষা প্রভৃতি থেকে ধর্মকে দূরে রাখতে হবে। তাদের মূল বক্তব্য ছিল, যুক্তি (logic)-ই জীবন পরিচালনার ভিত্তি হবে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহপ্রদত্ত নির্দেশনার (divine guidance) কোনো প্রয়োজন নেই। ইউরোপে এই আন্দোলনের সফলতার ফলে ধর্মহীন যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠল, তাতে মানুষ নিতান্তই স্বার্থপর হয়ে গেল, ভোগবাদী হয়ে পড়ল, পূর্বপুরুষ ও ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে গেল। সর্বোপরি নীতিবোধের লোপ ও নৈতিকতার অবক্ষয়ই এর চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে প্রকাশ পেল।
মূলত নৈতিক মূল্যবোধের জাগরণ ব্যতীত একটি কল্যাণকর মানবসমাজ কল্পনা করা যায় না। আর নৈতিক শিক্ষার মূল বিষয়টি ধর্মীয় শিক্ষা থেকে উৎসারিত। মানবসমাজে বিরাজিত সকল নৈতিকতার মূল ভিত্তি হলো, অতিপ্রাকৃতিক শক্তি তথা সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস। এ বিশ্বাসই ব্যক্তিমানুষকে তাঁর আদেশ ও নিয়ম অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত করে, পৃথিবীতে ও পরলোকে কু-কর্মের শাস্তি স¤পর্কে অবহিত করে এবং ভালো কাজের জন্য পুরস্কৃত হতে উৎসাহ দেয়। স্রষ্টায় বিশ্বাসের কারণেই ব্যক্তি সবচেয়ে গোপন ও নিরাপদ জায়গাতেও শত প্রলোভন সত্ত্বেও অনৈতিক কোনো কাজে জড়িত হতে পারে না। কিন্তু এ বিশ্বাসের বীজ যার হৃদয়ে বপিত হয় নি তার কাছে নৈতিকতা অর্থহীন মনে হয়। ধর্মীয় শিক্ষা ব্যতীত নৈতিক শিক্ষা ভঙ্গুর ও বিক্ষিপ্ত। এমন কি এগুলোর আদি উৎসও বিভিন্ন ধর্ম। ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে যে নৈতিক শিক্ষার কথা বলা হয় তাতে ব্যক্তি নিজের বিবেকের কাছে তার দায়বদ্ধতার কারণে নীতি মেনে চলে। ফলে ব্যক্তি যেকোনো দুর্বল মুহূর্তে প্রলোভনে পড়ে কিংবা মানবিক দুর্বলতার কারণে তার নৈতিক গণ্ডির বাইরে চলে যেতে পারে। সে তো পরকালীন শাস্তির ভয়ে নীতি মানছে না, তাই একবার ভাঙলে আবার তা গড়ে তোলার শক্তিশালী অনুপ্রেরণা পায় না। সে ভাবে যে, নশ্বর এই পৃথিবীতে ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশের মধ্য দিয়ে জীবন কেটে গেলেই হলো।
সুতরাং ধর্মকে কাজে লাগিয়েই সামষ্টিক মানুষের চারিত্রিক কাঠামোকে সুদৃঢ় করা সম্ভব, অন্যভাবে নয়। তাই শিশুকাল থেকেই এ চরিত্রগঠনের প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে। আমরা জানি যে, ব্যক্তির মানসিক গঠনের উপযুক্ত সময় তার শৈশব ও কৈশোর। এ সময় শিশুকে যেভাবে শিক্ষা দেয়া হবে তার গন্তব্যও সেদিকেই হবে। আমরা সবাই চাই, আমাদের শিশুরা জ্ঞানে-গুণে, যোগ্যতা-দক্ষতায় অনন্য হোক এবং তাদের সেই জ্ঞান ও দক্ষতা কল্যাণকর কাজে ব্যবহৃত হোক। অথচ তাদেরকে আমরা শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে সকল নৈতিকতার উৎস ধর্ম থেকে দূরে সরিয়ে রাখার শিক্ষাই দিয়ে থাকি। আমরা কি দেখছি না যে, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণেই আজ জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, চরিত্র বিকিয়ে টাকার মালিক হওয়ার প্রতিযোগিতা, মিথ্যা আর জালিয়াতির ছড়াছড়ি। সুতরাং বেঁচে থাকার জন্য যেমন মানুষের খাদ্যের প্রয়োজন, তেমনি সেই মানুষগুলোকে মনুষ্যত্বসম্পন্ন করে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন প্রকৃত ধর্মের শিক্ষা। বিকৃত ধর্ম সমাজকে আরো দূষিত করবে। প্রকৃত ধর্মের শিক্ষা যেমন পরিবার ও সমাজের পক্ষ থেকে দিতে হবে তেমনি দিতে হবে রাষ্ট্রের উদ্যোগের মাধ্যমে। রাষ্ট্রই শিক্ষাব্যবস্থার সিলেবাস ও কারিকুলাম প্রণয়ন করে। আর সকল পরিবারের পক্ষে সমভাবে জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি নির্দিষ্ট চারিত্রিক কাঠামোয় তৈরি করা সম্ভব নয়। পরিবারের অজ্ঞতা বা অসচেতনতার কারণে যেন শিশু সচ্চরিত্রের অধিকারী হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, সে জন্য সমগ্র জাতিকে এ ভার নিতে হবে। নীতিহীন, চরিত্রহীন মানুষ একটি দানব ছাড়া আর কিছু নয়, বিশেষ করে যখন সে কোনো ধ্বংসাত্মক শক্তির অধিকারী হয়ে যায়। এটা উপলব্ধি করে পারমাণবিক বোমা আবিষ্কারের পর The Philosophy of the Modern Education গ্রন্থে অধ্যাপক বার্বাস বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে বলেছেন, “বাধ্যতামূলকভাবে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অনুশীলন না করলে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। কারণ, মানুষ ধ্বংসের উপকরণ অনেক বেশি জোগাড় করে ফেলেছে।”

মাননীয় এমামুযযামানের পারিবারিক ইতিহাস

মাননীয় এমামুযযামানের পারিবারিক ইতিহাস








রাকীব আল হাসান:
মাননীয় এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর পরিবারের ইতিহাস অতি প্রাচীন। রসুলাল্লাহর প্রিয় সাহাবী এবং জামাতা, ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী (রা.) এর বংশধারায় পন্নী বংশের উদ্ভব। তাঁর পূর্বপুরুষগণ সমগ্র পৃথিবীর বুকে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে উম্মতে মোহাম্মদীর সঙ্গে আরবভূমি থেকে বহির্গত হয়েছিলেন। ইতিহাস থেকে পাওয়া যায় ৬৫২ সনে রসুলাল্লাহর সাহাবি আহনাফ ইবনে কায়েস (রা.) এর নেতৃত্বে পরিচালিত খোরাসান অভিযানের সেনানী হিসাবে পন্নী বংশের পূর্বপুরুষগণ আফগানিস্তানের হিরাত অঞ্চলে আগমন করেন এবং এখানে বাস করতে থাকেন। পরবর্তীতে ইসলাম যখন ভারতবর্ষে প্রবেশ করে, এই বংশেরই এক ব্যক্তি দিল্লিতে আগমন করেন। ততদিনে আল্লাহর দেওয়া প্রকৃত ইসলাম বিকৃত হয়ে এর মধ্যে বিকৃত অধ্যাত্মবাদ বা সুফিবাদের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। এমামুযযামানের পূর্বপুরুষগণের মধ্যেও জন্ম নেন অনেক আধ্যাত্মিক সাধক, সুফি ও দরবেশ যার মধ্যে ভারতের বিখ্যাত সুফি সাধক সৈয়দ খাজা মোহাম্মদ হোসাইনী গেসুদারাজ বন্দে নেওয়াজ (র.) (১৩২১-১৪২২ খ্রি.) অন্যতম। তিনি ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে দীর্ঘদিন আফগানিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করেছিলেন। এ সময় তিনি কাররানী (মূল গোত্র কাকার) নামক পাঠান গোত্রে বিবাহ করেন। এই কারণে পরবর্তীতে তার বংশধরগণ তাদের নামের শেষে কাররানি ব্যবহার করতেন। কাররানী স্ত্রীর গর্ভে সৈয়দ খাজা মোহাম্মদ হোসাইনী (র.) এর একটি পুত্র জন্মগ্রহণ করে যার নাম পান্নী (উচ্চারণভেদে হান্নি)। তার বংশধরেরা নামের শেষে কাররানি বা পন্নী দুটোই ব্যবহার করতেন। এ বংশেই জন্ম নেন তাজ খান কররানি যিনি ষোড়শ শতাব্দীতে বঙ্গভূমিতে কাররানী রাজবংশের [Karrani dynasty (1564-1576)] পত্তন করেন। প্রবাদপ্রতিম বীর যোদ্ধা কালাপাহাড় ছিলেন তারই সেনাপতি। বাংলা, বিহার, গৌড়, উড়িষ্যা, ভারতের উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত রাজ্য বিস্তৃত করেন কররানি বংশীয় শাসকবর্গ। তারা নিজ নামে খোতবা প্রদান ও মুদ্রা প্রবর্তন করেন এবং পুরো ভারতবর্ষ মোগল সম্রাট আকবরের প্রভাবাধীন থাকা সত্ত্বেও দাউদ খান কররানি নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা দিয়ে দিল্লির সঙ্গে যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটান। ১৫৭২-১৫৭৬ পর্যন্ত বার বার মোগল বাহিনী বাংলা আক্রমণ করে কিন্তু একবারও নিরঙ্কুশ জয়লাভ করতে পারে নি, একবার আপাত জয়ী হলেও কিছুদিন বাদেই দাউদ খান কররানি তা পুনরুদ্ধার করেন। অতঃপর সাতমাসের রক্তক্ষয়ী রাজমহলের যুদ্ধে দাউদ খান কররানি দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জীবন দিয়ে বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান হিসাবে ইতিহাসের পাতায় আশ্রয় নেন। কররানি রাজবংশের অধীনে যে জমিদারগণ বাস করতেন তারা ইতিহাসে বারভূঁইয়া নামে খ্যাত। তাদের প্রতিরোধের কারণে মোগল সাম্রাজ্য এ অঞ্চলে পূর্ণাঙ্গরূপে শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন নি দীর্ঘ দিন যাবত। ১৭১৬ পর্যন্ত সাঁইত্রিশজন মোগল সুবাদার বাংলায় শাসন করেন, তারা কেউই শান্তিপূর্ণরূপে শাসন করতে সক্ষম হন নি।
তাজখান কররানির ভাই সুলায়মান খান কররানি তার শাসনামলে জনৈক সুফি সাধক আলী শাহান শাহ্ বাবা আদম কাশ্মিরী (র.)-কে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে টাঙ্গাইল জেলার জায়গিরদার নিয়োগ দান করলে তিনি এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন; এলাকাটি আতিয়া পরগনা বলে খ্যাত হয়, কারণ আতা শব্দের অর্থ দান। পরবর্তীতে বাবা আদম কাশ্মিরী সম্রাট জাহাঙ্গীরকে পরামর্শ দেন কররানি বংশীয় বায়াজীদ খান পন্নীর (সর্বশেষ স্বাধীন সুলতান দাউদ খান কাররানির বড় ভাই) সন্তান সাঈদ খান পন্নীকে আতিয়া পরগণার শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দান করার জন্য, সম্রাট জাহাঙ্গীরও সাঈদ খান পন্নীর গুণমুগ্ধ ছিলেন বলে সানন্দে তিনি এ প্রস্তাবে রাজি হন। এই সাঈদ খান পন্নীই করটিয়ার জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। ১৬০৯ সালে বাবা আদম কাশ্মিরীর কবরের সন্নিকটে আতিয়া মসজিদ নির্মাণ করেন যা বাংলাদেশের অন্যতম প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক মুদ্রিত ১০ (দশ) টাকা মূল্যমানের নোটের একপার্শ্বে আতিয়া মসজিদের ছবি রয়েছে। পরবর্তী সময়ে সমগ্র ভারতবর্ষই ব্রিটিশ শাসনের অধীন হয়। তখনও টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ-বগুড়া অঞ্চলে এ ক্ষয়িষ্ণু রাজপরিবারের জমিদারি বজায় থাকে। প্রজাহিতৈষীতা ও ধর্মপরায়ণতার জন্য তারা ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করতে তারা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। এক কথায় মাননীয় এমামুযযামানের পরিবারের সঙ্গে আবহমান বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি এক সূত্রে গাঁথা।
এই ঐতিহ্যবাহী পন্নী পরিবারেরই উত্তর পুরুষ মাননীয় এমামুযযামানেরও রয়েছে এক কর্মময় বর্ণাঢ্য জীবন-ইতিহাস। তিনি একাধারে ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম একজন বিপ্লবী, দক্ষ শিকারী, অলিম্পিকে চান্সপ্রাপ্ত রাইফেল শ্যুটার, প্রখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান আবু সাঈদ চৌধুরী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি তাঁর রোগীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ নজরুল একাডেমির একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি ভারতীয় ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন।
১৯৬৩ সনে এমামুযযামান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য অর্থাৎ এম.পি. নির্বাচিত হন। সমাজসেবায় তাঁর ছিল অনন্য অবদান। ১৯৬৩ সনে তিনি করটিয়ায় হায়দার আলী রেডক্রস ম্যাটার্নিটি এ্যান্ড চাইল্ড ওয়েলফেয়ার হসপিটাল প্রতিষ্ঠা করেন যার দ্বারা এখনও উক্ত এলাকার বহু মানুষ উপকৃত হচ্ছেন। পরবর্তীতে তিনি সা’দাত ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন নামে প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়নের জন্য একটি দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন সত্যের মূর্ত প্রতীক। তিনি তাঁর সমগ্র জীবন সত্য সন্ধান এবং সত্যের জন্য লড়াই করে গেছেন। তাঁর ৮৬ বছরের জীবনে একবারের জন্যও আইনভঙ্গের কোন রেকর্ড নেই, নৈতিক স্খলনের কোন নজির নেই। আধ্যাত্মিক ও মানবিক চরিত্রে বলীয়ান এ মহামানব সারাজীবনে একটিও মিথ্যা শব্দ উচ্চারণ করেন নাই।
তিনি ছোট বেলা থেকেই দেখেন আমরা মুসলিম জাতি হয়েও ব্রিটিশ খ্রিষ্টানদের দাসে পরিণত হয়ে আছি। যে জাতির হওয়ার কথা ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি সেই আজ সারা পৃথিবীতে নিকৃষ্ট গোলামের জাতিতে পরিণত হয়ে আছে। তিনি এটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন। পরিণত বয়সে এসে মহান আল্লাহ তাঁকে বোঝালেন যে মুসলিম দাবিদার এই জাতি তওহীদ (আল্লাহর সার্বভৌমত্ব) ও সত্যদীন ত্যাগ করে কার্যতঃ কাফের-মোশরেকে পরিণত হয়েছে। আল্লাহ মাননীয় এমামুযযামানকে সত্যের জ্ঞান দান করলেন, হেদায়াহ দান করলেন। তিনি সেই সত্য প্রচারের জন্য, সত্য প্রতিষ্ঠা করবার জন্য ১৯৯৫ সালে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংস্কারমূলক আন্দোলন হেযবুত তওহীদ প্রতিষ্ঠা করলেন। অকুতভয় একদল মোজাহেদ তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে হেযবুত তওহীদে নিজেদেরকে আত্মনিয়োগ করলেন এবং সত্য প্রচারে, মানবতার কল্যাণে নিজেদের জীবন-সম্পদ উৎসর্গ করে ২০ বৎসর যাবৎ কাজ করে যাচ্ছেন।

হেদায়াহ্হীন তাকওয়া অর্থহীন


মোফাজ্জল হোসাইন সর্দার
দীনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বুনিয়াদী বিষয় আকিদা ও ঈমানকে যেমন একই বিষয় করে ফেলা হয়েছে তেমনি হেদায়াহ ও তাকওয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে এ দু’টি বিষয়কেও এক করে ফেলা হয়েছে।
আমাদের বর্তমান বিকৃত আকিদায় আমরা ইসলামকে যে দৃষ্টিতে দেখি তাতে ‘ধর্মকর্ম’ করে না এমন একটি লোককে যদি উপদেশ দিয়ে নামাজ রোজা করানো যায়, যাকাত দেয়ানো যায়, মিথ্যা পরিহার করানো যায়, সত্য কথা বলানো যায়, এক কথায় সব রকম অন্যায়-মিথ্যাচার থেকে তাকে বাঁচিয়ে পবিত্র জীবন-যাপন করানো যায়, তবে বলা হয় লোকটি হেদায়েত হয়েছে। ভুল বলা হয়, সে হেদায়াত হয় নি, সে তাকওয়া অবলম্বন করেছে অর্থাৎ মুত্তাকী হয়েছে। হেদায়াত ও তাকওয়া দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। হেদায়াত অর্থ সঠিক পথে চলা। আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা.) যে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন, যে গন্তব্য স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন সেই পথে চলা। সেটা কোন্ পথ? সেটা হলো ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’’ সহজ-সরল পথ। ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ কী তা তাকওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পরিষ্কারভাবে জেনে নেওয়া দরকার।
ইবলিস আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করল যে মাটি দিয়ে তৈরি তোমার খলিফা আদমকে (মানবজাতিকে) তোমার দেখানো পথ থেকে বিচ্যুত করে তাকে তার নিজের তৈরি করা পথে নিয়ে যাবো যে পথে চলার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হবে মানুষের জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে অশান্তি, অবিচার এবং যুদ্ধ ও রক্তপাত (ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা)। আল্লাহ ইবলিসের ঐ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন এবং তাকে বললেন, আমি মানুষ জাতির মধ্যে আমার নবী-রসুল পাঠিয়ে এমন পথ দেখাব- যে পথে চললে তারা তোমার ঐ অশান্তি-অবিচার, অত্যাচার ও রক্তপাতের মধ্যে যেয়ে পড়বে না। আমার নবী-রসুলদের দেখানো পথে চললে তারা সুবিচার ও শান্তির মধ্যে বাস করবে। এই পথের নাম দিলেন তিনি সিরাতুল মুস্তাকীম; সহজ সরল পথ। এই সহজ সরল পথ কী? এটা হলো “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ, হুকুমদাতা, বিধানদাতা নেই; উপাস্য নেই, প্রভু নেই, কাজেই আর কারো আদেশ নিষেধ না মানা; জীবনের কোনো ক্ষেত্রে আর কারো আইন-কানুন না মানা অর্থাৎ প্রকৃত তওহীদ। আল্লাহ তার প্রদর্শিত পথ এত সহজ কেন করলেন? এই জন্য করলেন যে মানুষ যদি তার আইন, আদেশ নিষেধ ছাড়া অন্য কোনো আইন, জীবন-বিধান না মানে তবেই ইবলিস পরাজিত হবে। সে আর মানুষকে অন্য কোনো পথে পরিচালিত করতে পারবে না এবং মানুষও অশান্তি, অবিচার আর রক্তপাতের মধ্যে পতিত হবে না। কাজেই মানবজাতির মধ্যে যারা এই সিরাতুল মুস্তাকীমে চলবে তারা আল্লাহর দলে, আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য যে কোনো জীবন-বিধানকে স্বীকার করবে সেটা সম্পূর্ণই হোক বা আংশিকই হোক, তারা ইবলিসের দলে। বিকৃত আকিদায় তারা ব্যক্তি জীবনে সারারাত নামাজ পড়লেও সারা বছর রোজা থাকলেও সেই ইবলিসের দলে। এই সহজ সরলতাকে বোঝাবার জন্য রসুলাল্লাহ (সা.) বলেছেন- মানুষের সাথে আল্লাহর চুক্তি হচ্ছে এই যে, মানুষ আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ইলাহ বলে স্বীকার করবে না, আল্লাহর পক্ষ থেকে চুক্তি হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তাকে জান্নাত দেবেন। এখানে নামাজ, রোজা, হজ্ব ইত্যাদির কোনো শর্ত আল্লাহ রাখেন নি। এই হলো সহজ সরল পথ, সিরাতুল মুস্তাকীম। এই পথে চলা হলো হেদায়াতের পথে চলা, এই হলো আল্লাহর দেয়া দিক-নির্দেশনা।
এখন তাকওয়া অর্থ কী? তাকওয়ার অর্থ সাবধানে জীবনের পথ চলা। কোথায় পা ফেলছেন তা দেখে পথ চলা। অর্থাৎ জীবনের পথ চলায় ন্যায়-অন্যায়, ঠিক-অঠিক দেখে চলা, অসৎ কাজ পরিহার করে সৎ কাজ করে চলা। কোর’আনের অনুবাদগুলিতে তাকওয়া শব্দের অনুবাদ করা হয়েছে, ‘আল্লাহভীতি’ দিয়ে, ইংরেজিতে “Fear of God” দিয়ে। তাতে প্রকৃত অর্থ প্রকাশ পায় না। কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায় এর মাপকাঠি আসবে কোথা থেকে? এর মাপকাঠি অবশ্যই আল্লাহ ন্যায়-অন্যায়ের যে মাপকাঠি দিয়েছেন সেইটা, অন্য কোনো মাপকাঠি নয়। কাজেই সে হিসাবে আল্লাহভীতি এবং Fear of God শব্দগুলো চলে এবং সেই হিসাবেই তাকওয়া শব্দের অনুবাদে ওগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। ইংরেজি অনুবাদে আল্লামা ইউসুফ আলী অনুবাদ করেছেন Fear of God বলে এবং মোহাম্মদ মারমাডিউক পিকথল করেছেন Mindful of duty to Allah অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি কর্তব্য সম্বন্ধে চেতনা বলে। প্রকৃত পক্ষে তাকওয়া শব্দের মর্ম হলো আল্লাহ ন্যায়-অন্যায়ের যে মাপকাঠি নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, সেই মাপকাঠি মোতাবেক জীবনের পথে চলা। যারা অমন সাবধানতার সঙ্গে পথ চলেন তাদের বলা হয় মুত্তাকী। তাহলে দেখা যাচ্ছে তাকওয়া ও হেদায়াত দু’টো আলাদা বিষয়। তাকওয়া হচ্ছে সাবধানে পথ চলা আর হেদায়াত হচ্ছে সঠিক পথে চলা। আরও পরিষ্কার করার চেষ্টা করছি। আপনি আপনার গন্তব্য স্থানের দিকে দু’ভাবে যেতে পারেন। অতি সাবধানে পথের কাদা, নোংরা জিনিস এড়িয়ে, গর্ত থাকলে গর্তে পা না দিয়ে, কাঁটার উপর পা না ফেলে চলতে পারেন। ওভাবে চললে আপনার গায়ে ময়লা লাগবে না, আছড়ে পড়ে কাপড়ে কাদামাটি লাগবে না। আবার পথের ময়লা, গর্ত, কাঁটা ইত্যাদির কোনো পরওয়া না করে সোজা চলে যেতে পারেন। ওভাবে গেলে আপনি আছাড় খাবেন, গায়ে-কাপড়ে ময়লা কাদামাটি লাগবে। আর হেদায়াত হচ্ছে আপনি এ উভয়ভাবের যে কোনও ভাবে যে পথে চলছেন সে পথ সঠিক হওয়া, অর্থাৎ সে পথ আপনাকে আপনার প্রকৃত গন্তব্য স্থানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে কিনা। পথ যদি সঠিক না হয়ে থাকে অর্থাৎ হেদায়াত না থাকে তবে আপনার শত সাবধানে পথ চলা অর্থাৎ শত তাকওয়া সম্পূর্ণ বিফল, কারণ আপনি আপনার গন্তব্যস্থানে পৌঁছবেন না। আর যদি সঠিক পথে অর্থাৎ হেদায়াতে থাকেন ও চলেন তবে তাকওয়া না করেও গায়ের কাপড়ে কাঁদামাটি লাগিয়ে আপনি আপনার গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যাবেন আপনি সফলকাম হবেন। অর্থাৎ তাকওয়া এবং হেদায়াতের মধ্যে বুনিয়াদেই পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। সেই সাথে এটাও দেখা যাচ্ছে যে- হেদায়াহ না থাকলে তাকওয়া অর্থহীন এবং সেই হেদায়াত, সঠিক পথটি হলো সিরাতুল মুস্তাকীম, সহজ সরল পথ, জীবনের কোনো ক্ষেত্রে এক আল্লাহ ছাড়া কারো বিধান না মানা, তওহীদ।
[মতামতের জন্য: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৯৩৩৭৬৭৭২৫, ০১৭৮২১৮৮২৩৭, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩]

তাহাজ্জুদ যখন ঘুম নষ্ট রোজা যখন উপবাস

তাহাজ্জুদ যখন ঘুম নষ্ট রোজা যখন উপবাস

মূল: এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী
ভবিষ্যতে মুসলিম নামধারী এই জাতিটির কতখানি আকীদা বিচ্যুতি ঘটবে এবং তার দরুন তারা যে ইসলামের গণ্ডি থেকেই বহিরাগত হয়ে যাবে তা বোঝাতে গিয়ে আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে রসুলাল্লাহ (সা.) বলেন- ‘এমন সময় আসবে যখন ইসলাম শুধু নাম থাকবে, কোর’আন শুধু অক্ষর থাকবে, মসজিদসমূহ লোকে লোকারণ্য হবে কিন্তু সেখানে হেদায়াহ থাকবে না, আমার উম্মাহর আলেমরা হবে আসমানের নিচে সর্বনিকৃষ্ট জীব, তাদের তৈরি ফেতনা তাদের উপরই পতিত হবে। (আলী (রা.) থেকে বায়হাকী, মেশকাত)। কোর’আন শুধু অক্ষর থাকবে- এই কথাটি কীভাবে অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত হয়েছে তা বর্তমানে এই জাতির দিকে লক্ষ করলেই পরিষ্কার। কোর’আনের হুকুম এবং শিক্ষা এই জাতি প্রত্যাখ্যান করে দাজ্জালের হুকুম, বিধান মেনে নিয়েছে। কাজেই বর্তমানে কোর’আন শুধুু অক্ষরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর কোনো কার্যকারিতা নেই। আবার একই বক্তব্যের সমর্থনে তিনি অপর একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, “এমন সময় আসবে যখন মানুষ রোজা থাকবে কিন্তু তা হবে না খেয়ে থাকা, রাত জেগে নামাজ পড়বে কিন্তু তা হবে কেবল ঘুম নষ্ট করা (অর্থাৎ তাহাজ্জুদ হবে না)। (ইবনে মাজাহ, আহমাদ, তাবারানী, দারিমি, মেশকাত)।” এই হাদিসগুলোতে মহানবী (সা.) কাদের বোঝাচ্ছেন? প্রথম হাদিসে বলা হয়েছে- ইসলাম শুধু নাম থাকবে। অর্থাৎ ইসলাম শুধুমাত্র নামের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কার্যত ইসলামের নামে যেটা চলবে সেটা প্রকৃত ইসলাম হবে না। আর যেটা প্রকৃত ইসলাম নয় তার অনুসারীরাও যে প্রকৃত মুসলিম নন- তা বোঝা যায় সাধারণ জ্ঞানেই। আবার একই হাদিসে তিনি বলেছেন- মসজিদসমূহ লোকে লোকারণ্য হবে, কিন্তু সেখানে হেদায়াহ থাকবে না। এখানেও একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি। অর্থাৎ মানুষ মসজিদে যাবে, সেখানে গিয়ে আল্লাহর এবাদত করবে, নামাজ পড়বে কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও তাদের মধ্যে হেদায়াত থাকবে না। আর হেদায়াত না থাকার মানেই হলো তারা হবে পথভ্রষ্ট।
আবার দ্বিতীয় হাদিসে তিনি মানুষ বলতে তাদেরই বোঝাচ্ছেন যারা নিজেদের মুসলিম বলে মনে করে। কারণ তিনি অন্য নবীদের উম্মত খ্রিষ্টান-ইহুদিদের সম্বন্ধে বলছেন না। দ্বিতীয় কথা হলো হাজারো রকমের এবাদতের মধ্য থেকে মাত্র দু’টি তিনি বেছে নিয়েছেন। একটি রোজা অন্যটি তাহাজ্জুদ। তৃতীয় হলো এর একটা ফরদ-বাধ্যতামূলক, অন্যটি নফল- নিজের ইচ্ছাধীন। বিশ্বনবী (সা.) পাঁচটি বাধ্যতামূলক ফরজ এবাদত থেকে একটি এবং শত শত নফল এবাদত থেকে একটি বেছে নেয়ার উদ্দেশ্য হলো এই মনস্তত্ত্বের দিক দিয়ে আল্লাহ রসুল ও দীনের উপর পরিপূর্ণ (মোকাম্মেল) ঈমান ছাড়া কারো পক্ষে এক মাস রোজা রাখা বা নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়া সম্ভব নয়। এমনকি মোকাম্মেল ঈমান আছে এমন লক্ষ লক্ষ মানুষ আছে যারা তাহাজ্জুদ পড়েন না। অর্থাৎ রসুলাল্লাহ বোঝাচ্ছেন তাদের যাদের পরিপূর্ণ দৃঢ় ঈমান আছে আল্লাহ-রসুল-কোর’আন ও ইসলামের উপর। এই হাদিসে তিনি মোনাফেক বা লোক দেখিয়ে করা যায় অর্থাৎ রিয়াকারীদের বোঝান নি। কারণ যে সব এবাদত লোক দেখিয়ে করা যায় অর্থাৎ মসজিদে যেয়ে নামাজ-হজ্ব-যাকাত ইত্যাদি একটিও উল্লেখ করেন নি। মোনাফেক রিয়াকারী বোঝালে তিনি অবশ্যই এগুলো উল্লেখ করতেন যেগুলো লোক দেখিয়ে করা যায়। তিনি ঠিক সেই দু’টি এবাদত উল্লেখ করলেন যে দুটি মোনাফেক ও রিয়াকারীর পক্ষে অসম্ভব, যে দু’টি লোকজন দেখিয়ে করাই যায় না, যে দুটি পরিপূর্ণ ঈমান নিয়েও সবাই করতে পারে না। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তিনি ভবিষ্যত বাণী করেছেন যে এমন সময় আসবে যখন আমার উম্মতের মানুষ পরিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী হয়ে নামাজ-রোজা-হজ্ব-যাকাত-তাহাজ্জুদ ইত্যাদি সর্ববিধ এবাদত করবে কিন্তু কোন কিছুই হবে না, কোন এবাদত গৃহীত-কবুল হবে না। যদি দীর্ঘ এক মাসের কঠিন রোজা এবং মাসের পর মাস বছরের পর বছর শীত-গ্রীষ্মের গভীর রাত্রে শয্যা ত্যাগ করা তাহাজ্জুদ নিষ্ফল হয়, তবে অন্যান্য সব এবাদত অবশ্যই বৃথা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যারা শুধু পরিপূর্ণ বিশ্বাসী অর্থাৎ মোকাম্মল ঈমানদারই নয়, রোজাদার ও তাহাজ্জুদীও, তাদের এবাদত নিষ্ফল কেন? তাছাড়া তাদের এবাদতই যদি বৃথা হয় তবে অন্যান্য সাধারণ মুসলিমদের এবাদতের কী দশা?
মহানবীর (সা.) ঐ ভবিষ্যদ্বাণীর একমাত্র সম্ভাব্য উত্তর হচ্ছে এই যে, তিনি যাদের কথা বলছেন তারা গত কয়েক শতাব্দী ও আজকের দুনিয়ার মুসলিম নামধারী জাতি। আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা.) এই জাতির সম্মুখে যে উদ্দেশ্য স্থাপন করে দিয়েছিলেন সটা হলো আল্লাহর দেওয়া সত্যদীন, দীনুল হক পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠা করে মানবজীবন থেকে যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, অশান্তি দূর করে ন্যায়, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। এই আকিদার বিকৃতিতে জাতি তা বদলিয়ে অন্য উদ্দেশ্য স্থাপন করে নিয়েছে। আল্লাহ রসুলের (সা.) স্থাপিত উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য যে ঐক্যবদ্ধ, সুশৃঙ্খল, আনুগত্যশীল, দুর্জেয় সংগ্রামী চরিত্রের প্রয়োজন, সেই চরিত্র তৈরির জন্য যে প্রশিক্ষণ- সেই প্রশিক্ষণ (অর্থাৎ সালাহ, সওম বা নামাজ, রোজা) এবং আরও অন্যান্য ব্যাপারকে ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া হয়েছে। উদ্দেশ্যই যেখানে নেই বা বিকৃত সেখানে প্রশিক্ষণের আর কোন দাম, অর্থ থাকতে পারে না। কাজেই ঐসব প্রশিক্ষণ অর্থাৎ নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি সর্ব প্রকার এবাদত আজ নিষ্ফল, অর্থহীন। এতে কোন সন্দেহ নেই যে আমার এই কথায় বর্তমানের এই জাতিটি- যেটা নিজেকে শুধু মুসলিম নয় একেবারে উম্মতে মোহাম্মদী বলে মনে করে- এই জাতি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠবে। বিশেষ করে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে এই জাতির সেই অংশ যেটা আল্লাহ রসুলের কঠোর সতর্ক বাণী ও নিষেধ অগ্রাহ্য করে, সেরাতুল মোস্তাকীম ও দীনুল কাইয়্যেমা (জীবনের সর্বক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহর দেয়া বিধান ছাড়া সমগ্র বিধান অস্বীকার, সালাহ ও যাকাত প্রতিষ্ঠা) ত্যাগ করে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ফতোয়াবাজী করে জাতিকে শত টুকরোয় ভেঙ্গে খান খান করে দিয়েছেন এবং ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে সেই অন্য অংশটি যেটা আত্মার উৎকর্ষ ও আল্লাহর সান্নিধ্যের নাম করে জাতির সম্মুখে আল্লাহ ও রসুলের (সা.) স্থাপিত উদ্দেশ্য (মানবতার কল্যাণ) বদলিয়ে অন্য উদ্দেশ্য স্থাপন করেছেন, যে জাতিকে বিশ্বনবী (সা.) মিথ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সে জাতিকে সংগ্রাম ভুলিয়ে হাতে তসবিহ ধরিয়ে দিয়ে টেনে খানকায় বসিয়ে দিয়েছেন, জাতির বর্হিমুখী দৃষ্টিভঙ্গীকে অন্তর্মুখী করে তাকে কাপুরুষে পরিণত করেছেন, সিংহকে ইদুরে পরিণত করেছেন।
অকপট সত্যান্বেষী মন নিয়ে চিন্তা করলে দেখতে পাবেন যে আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থাকে জাতীয় জীবনে অস্বীকার করে মানুষের তৈরি জীবন ব্যবস্থা গ্রহণ করে পরিণতিতে পৃথিবীতে যে অন্যায়-অবিচার শোষণ-রক্তপাত হচ্ছে সে সবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করে সে সব থেকে মুখ ফিরিয়ে যারা মহা এবাদতে মশগুল হয়ে আছেন যাবতীয় অন্যায়, অসত্যের বিরুদ্ধে যারা প্রচণ্ড বিরোধ গড়ে তুলছেন না, যারা নানাভাবে জাতির ঐক্য ধ্বংস করে যাচ্ছেন তারাই হচ্ছেন রসুলাল্লাহর (সা.) ঐ ভবিষ্যতবাণীর লক্ষ্য। আল্লাহ এই জাতিকে লক্ষ্য করে বলছেন, “তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি (উম্মাহ) কারণ মানবজাতির মধ্যে থেকে তোমাদিগকে উত্থিত করা হয়েছে এই জন্য যে (তোমরা মানুষকে) সৎ কার্য করার আদেশ দান এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত করবে, আল্লাহকে বিশ্বাস করবে (কোর’আন- সুরা আলে-ইমরান ১১০)।” অর্থাৎ এই উম্মাহকে মানব জাতির মধ্য থেকে সৃষ্টিই করা হয়েছে মানুষকে অসৎ কাজ (আল্লাহর বিধানের বিরোধী কাজ অর্থাৎ যে কাজে মানুষের অকল্যাণ হয় তাই হলো অসৎ কাজ) থেকে নিবৃত্ত করা ও সৎ কাজ (আল্লাহর বিধান অনুযায়ী কাজ অর্থাৎ যে কাজ করলে মানুষের কল্যাণ হয় তাই হচ্ছে সৎকাজ) করার আদেশ করার জন্য এবং এই কাজ করার জন্যই সে জাতি শ্রেষ্ঠ জাতি। যে বা যারা এবাদতের নাম করে আল্লাহর যিকরের নাম করে বা যে কোন ছুতোয় বিরোধিতার ভয়ে, পার্থিব ক্ষতির ভয়ে, যে জন্য তাদের মানব জাতির মধ্য থেকে উত্থিত করা সেই কাজ থেকে পালায় তবে সে বা তারা আর সেই শ্রেষ্ঠ জাতির মধ্যেই নেই সুতরাং তাদের সব রকম এবাদত অর্থহীন, নিষ্ফল। (যখন সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করার দায়িত্ব পালন ত্যাগ করা হয় তখন মানুষের কোন আমল আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। হাদিস তিরবানী।)
এইখানে আরও একটি কথা বুঝে নেয়া প্রয়োজন। কোর’আনের এই আয়াতে আল্লাহ সৎকাজের জন্য যে শব্দটি ব্যবহার করেছেন সেটা হলো আদেশ, আরবিতে ‘আমর’। আদেশ তখনই করা যায় যখন সে আদেশকে কাজে পরিণত করা যায়, অর্থাৎ কাজে পরিণত করার শক্তি থাকে, নইলে খুব জোর অনুরোধ করা যায়। অসৎ কাজ থেকে মানুষকে বিরত করার ব্যাপারেও তাই। মানুষকে অর্থাৎ সমাজকে সৎকাজ করার আদেশ এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখার শক্তি শুধু রাষ্ট্রের থাকে অন্য কারো নয়। অন্য যে কেউ করতে গেলে তাকে শুধু অনুরোধ বা কাকুতি-মিনতি করতে হবে। কিন্তু আল্লাহ অনুরোধ শব্দ ব্যবহার করেন নি, করেছেন ‘আমর’ আদেশ অর্থাৎ ঐ কাজ করতে হবে রাষ্ট্রশক্তিতে। উপদেশ ও অনুরোধে যে ও কাজ হবে না তার প্রমাণ বর্তমান মানব সমাজ। এই সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ, অন্যায় কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখা যে আল্লাহ উপদেশ, অনুরোধের মাধ্যমে করা বোঝান নি তা পরিষ্কার হয়ে যায় তার কোর’আনের আরেকটি আয়াতে। তিনি বলেছেন- এরা (মো’মেন) তারা, যাদের আমি তাদের পৃথিবীতে (বা পৃথিবীর যে কোন অংশে) ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করলে সালাত (নামাজ) কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং ন্যায়, সৎ কাজের আদেশ দেয়, এবং অন্যায়, অসৎ কাজ থেকে বিরত করে (কোর’আন- সুরা আল-হজ ৪১)। এখানে লক্ষ্য করুন-মানুষকে ন্যায় কাজের আদেশ এবং অন্যায় থেকে বিরত রাখার জন্য আল্লাহ কী পূর্বশর্ত দিচ্ছেন। তিনি বলছেন আমি তাদের পৃথিবীতে (বা পৃথিবীর যে কোন অংশে) ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করার পর, কারণ তিনি ভালো করেই জানেন যে, ন্যায় কাজের আদেশ ও মানুষকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখা এ দু’টোর কোনটাই সম্ভব নয় রাষ্ট্রশক্তি ছাড়া। সুতরাং যারা অনুরোধ, উপদেশ, কাকুতি-মিনতি করে ঐ কাজ করতে চেষ্টা করছেন তারা পণ্ডশ্রম করছেন। কাজেই রাষ্ট্রশক্তি যাদের নিয়ন্ত্রণে তাদের প্রথম এবং প্রধান কর্তব্যই হলো সৎ কাজের আদেশ দেওয়া এবং অসৎ ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত হওয়া এবং জাতিকে বিরত রাখা। এর জন্য যে সঠিক আদর্শ দরকার তাই আমরা তুলে ধরছি।
[মতামতের জন্য ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৯৩৩৭৬৭৭২৫, ০১৭৮২১৮৮২৩৭, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩]