প্রকৃত ইসলামে নারীর ক্ষমতায়ন
রাকীব আল হাসান
আজকের পৃথিবীতে বিভিন্নভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়, খুটিয়ে খুটিয়ে ইসলামের ত্র“টি বের কোরে এর বদনাম করা হয়। কিন্তু আজকে যে ইসলামটা দুনিয়াময় চালু আছে, এটা আল্লাহ ও রসুলের (দ:) প্রকৃত ইসলাম নয়। বিগত ১৩০০ বছরের কাল পরিক্রমায় বিকৃত হতে হতে ইসলাম আজ চূড়ান্তভাবে বিকৃত। আর এই চূড়ান্ত বিকৃতির সূত্রপাত ঘটায় ব্রিটিশ খ্রিস্টানরা ঔপনিবেশিক আমলে। তারা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা কোরে খ্রিস্টান প্রিন্সিপালদের তত্ত্বাবধানে তাদের নিজেদের তৈরি করা একটা বিকৃত ইসলাম শিক্ষা দেয় এবং জাতির মধ্যে একটি ধর্মব্যবসায়ী আলেম-মোল্লা শ্রেণির উদ্ভব ঘটায়। এই ধর্মব্যবসায়ী মোল্লা শ্রেণিটি সেই বিকৃত ইসলামটাই মাদ্রাসা থেকে শিখে এসে মসজিদে, মাদ্রাসায়, খানকায়, ওয়াজ নসীহতে সাধারণ মানুষকে শিক্ষা দেয়। এভাবে গত কয়েক শতাব্দী ধরে ব্রিটিশদের তৈরি করা বিকৃত ইসলামটিই এই জাতির মধ্যে চর্চিত হচ্ছে। আজকে যে বিভিন্ন মহল থেকে ইসলামের বদনাম করা হচ্ছে, ইসলামকে পশ্চাদপদ, বর্বর ধর্ম বলে গালি দেওয়া হচ্ছে সেটা এই বিকৃত ইসলামের রূপটিকে দেখেই করা হচ্ছে। যারা গালি দিচ্ছেন তারা প্রকৃত ইসলাম দেখেন নি, তারা তাদের সামনে ইসলাম হিসাবে যেটাকে দেখছেন সেটাকেই গালাগালি করছেন।
সত্যিকার অর্থেই বিকৃত ইসলামের এই ধারক বাহক তথা আলেম মোল্লা শ্রেণির মনোভাব সাংঘাতিক পশ্চাদপদ, বিকৃত। নারীদের ব্যাপারে তাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি আমরা দেখতে পাই তা ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি নয়, এটা তাদের নিজস্ব বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি। এই বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গিকে ইসলাম হিসাবে চালিয়ে দেওয়ার কারণে পশ্চিমা প্রভাবাধীন গণমাধ্যমগুলি বিকৃত ইসলামের কূপমণ্ডূকতার দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে যে ইসলাম নারীদের অবরুদ্ধ কোরে রাখে, মানুষের বাক-স্বাধীনতায়, চিন্তার স্বাধীনতায়, চলাফেরার স্বাধীনতায় বিঘœ ঘটায়, তাই যে কোনভাবেই হোক ইসলামের উত্থানকে রোধ করতে হবে।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ, শাশ্বত ও প্রাকৃতিক দীন। সুতরাং ইসলামের প্রতিটি বিধি-বিধান প্রাকৃতিক, যৌক্তিক ও চিরন্তন। কিন্তু প্রকৃত ইসলামের সাথে বর্তমানের কূপমণ্ডূক ধর্মব্যবসায়ীদের কাছে কুক্ষীগত বিকৃত ও বিপরীতমুখী ইসলামের তুলনা করা নিতান্তই বোকামী হবে। ১৩০০বছর আগে হারিয়ে যাওয়া আল্লাহ রসুলের সেই প্রকৃত ইসলামে নারীদের ক্ষমতায়ন ও বর্তমানে বিকৃত ইসলামের ধ্বজাধারীরা নারীদেরকে কিভাবে গৃহবন্দী কোরে রেখেছে তা তুলে ধরাই আমার আজকের আলোচ্য বিষয়।
বিকৃত ইসলামে নারীদের গৃহবন্দী অবস্থা:
আজকের বিকৃত ইসলামের কূপমণ্ডূক ধর্মজীবী আলেম-মোল্লারা নারীদের ব্যাপারে ইসলামের যে ধারণা প্রচার কোরে থাকে তা প্রকৃত ইসলামের একেবারে বিপরীত। তারা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের অধীন কোরে রাখার পক্ষে ফতোয়া দিয়ে থাকেন। তারা এটা বুঝতে সক্ষম নয় যে, যার নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা বেশি সে পুরুষই হোক আর নারীই হোক, তাকেই নেতা মনোনীত করা যাবে। অযোগ্য পুরুষকে নারীর কর্তা করতে হবে এমন সিদ্ধান্ত ইসলাম সমর্থন করে না। যেমন একটি প্রতিষ্ঠানে এক হাজার জন কর্মকর্তা, কর্মচারী আছে। সেখানে যদি জ্ঞান, যোগ্যতা, দক্ষতায় কোন নারী অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকে সেখানে সেই নারীকে প্রধান অর্থাৎ নেতৃত্বদানকারী হিসাবে মেনে নিতে বাধা কোথায়? সেই হিসাবে একজন নারী কোন এলাকার রাজনৈতিক প্রশাসকও (এড়াবৎহড়ৎ) হতে পারেন। আজকের বিকৃত ইসলামের ধ্বজাধারীরা ইসলামে পুরুষ ও নারীর অবস্থানকে এমনভাবে ভারসাম্যহীন কোরে ফেলেছে যে তারা নতমস্তক নারীদের গায়ে বোরকা চাপিয়ে দিয়েছে, তাদের গৃহবন্দী করেছে, অপরদিকে পুরুষকে দিয়েছে স্বৈরশাসকের অধিকার। তারা একবারও ভাবে না যে উম্মতে মোহাম্মদীর নারীরা রসুলের পাশাপাশি থেকে যুদ্ধ করলেন, এই রকম তাবুসদৃশ বোরখা গায়ে চাপিয়ে কি যুদ্ধ করা যায়, ঘোড়ায় চড়া যায়? বর্তমানে নারীর দিকে দৃষ্টিপাত করাকেও মারাত্মক গোনাহের কাজ বলে প্রচার করা হয়। এই সব মনগড়া, বুদ্ধিহীন, জাতিধ্বংসকারী ধারণাকে তারা ইসলামের উপরে চাপিয়ে দিয়েছে এবং এগুলির অনুকূলে হাজার হাজার বই লিখেছে, হাজার হাজার ফতোয়া ও মাসলা মাসায়েল বের করেছে। এই অন্ধত্ব আজ সমগ্র জাতির উপর জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসেছে। তথাকথিত প্রগতিশীলরাও মোল্লা শ্রেণির এইসব মুর্খতাকে অসার প্রমাণ করতে গিয়ে আল্লাহ-রসুলকেই দোষারোপ করছেন। প্রচলিত ইসলামের বোরখা পরিহিতা কিম্ভূতকিমাকার নারীমূর্তি দেখেই তারা ধরে নিয়েছেন যে ইসলাম নারীকে বুঝি এভাবেই অথর্ব, জড়বুদ্ধি, অচল, বিড়ম্বিত করেই রাখতে চায়। তারা নিজেরাও পাশ্চাত্য জড়বাদী ‘সভ্যতা’র প্রভাবে অন্ধ হয়ে আছেন। তাই ইসলামের বিরোধিতা করা তাদের মজ্জাগত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করার জ্ঞান তাদের লুপ্ত হয়ে গেছে। নইলে তারা বুঝতে পারতেন যে – এই ধর্মজীবী, ফতোয়াবাজ মাদ্রাসা শিক্ষিত আলেম মোল্লাদের সঙ্গে আল্লাহ রসুলের ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই, কেবল সম্পর্ক নেই নয়, এই মোল্লারাই ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্র“। তারা যে ইসলামটি বিক্রি কোরে খাচ্ছেন তার প্রতিটি দিক আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলামের বিপরীত দিকে ধাবিত হচ্ছে। সত্য ইসলামের নারী কেমন ছিল সেটা তাদের ধারণারও বাইরে।
আজ ইহুদি খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’র গলায় সুর মিলিয়ে নারীবাদীরা হিংস্র মুখভঙ্গি প্রদর্শন কোরে বলেন, নারীকে সর্বক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার দিতে হবে। তারা জানেন না যে প্রকৃতপক্ষে ইসলাম নারীর অধিকার তো দিয়েছেই, তাদেরকে এমন সম্মানিত করেছে যে কোন জীবনব্যবস্থাতে এর ভগ্নাংশও দেওয়া হয় নি, অপরদিকে পশ্চিমা সভ্যতা বিজ্ঞাপনী প্রচারণা ও অশ্লীল সংস্কৃতির দ্বারা নারীদেহকে কর্পোরেট পণ্যে পরিণত করেছে।
প্রকৃত ইসলামে নারীর ক্ষমতায়ন:
যেহেতু উপার্জন করা পুরুষের কাজ, তাই বলা যায় জীবিকার যুদ্ধক্ষেত্রে মেয়েরা দ্বিতীয় সারির সৈনিক। কখনও কখনও যদি অবস্থার প্রয়োজনে নারীকে প্রথম সারিতে গিয়ে জীবিকার লড়াইতে অবতীর্ণ হতে হয় সেটার সুযোগ আল্লাহ রেখেছেন। রসুলাল্লাহর অনেক নারী আসহাব পরিবারে পুরুষ সদস্য না থাকায় বা পুরুষ সদস্যরা জিহাদে অধিক ব্যস্ত থাকায় নিজেরাই কৃষিকাজ কোরে, কুটির শিল্পের মাধ্যমে উপার্জন করতেন, অনেকে ব্যবসাও করতেন।
এবার আসা যাক সত্যিকার যুদ্ধ-ক্ষেত্রে। রসুলাল্লাহর সময় নারীরা প্রায় সকল যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেছেন। তারা আহতদের চিকিৎসা দিয়েছেন, নিহতদের দাফনে সহায়তা করেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈন্যদেরকে পানি পান করিয়েছেন। আনাস (রা:) ওহুদ যুদ্ধের স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “সেদিন আমি আয়েশা বিনতে আবু বকর (রা:) এবং উম্মে সুলাইমকে (রা:) দেখেছি, তাঁরা উভয়েই পায়ের কাপড় গুটিয়ে নিয়েছিলেন। আমি তাদের পায়ের গোছা দেখতে পেয়েছি। তারা মশক ভরে পিঠে বহন করে পানি আনতেন এবং (আহত) লোকদের মুখে ঢেলে দিতেন। আবার চলে যেতেন এবং মশক ভরে পানি এনে লোকদের মুখে ঢেলে দিতেন (বোখারী শরীফ, হাদিস নং ৩৭৬৭)। এখানে কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের সবচাইতে বিপদসঙ্কুল পরিবেশের কথা বলা হয়েছে, বাড়িঘরের স্বাভাবিক পরিস্থিতির কথা বলা হয় নি। তাছাড়া মসজিদে নববীর এক পাশে যুদ্ধাহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যার প্রধান ছিলেন একজন নারী রুফায়দাহ (রা:)। কোন যোদ্ধাকে যদি রসদ ও এই সেবাগুলি দিয়ে সাহায্য না করা হয় তবে সে কখনও প্রথম লাইনে থেকে যুদ্ধ করতে পারবে না। যে কোন সামরিক বাহিনীর কাছে জিজ্ঞাস করে দেখতে পারেন এই কাজের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
শুধু এটুকুই না, যুদ্ধে এমন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যখন মেয়েদেরকেও অস্ত্র হাতে নিতে হয়, সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতে হয় [সংসার সমরাঙ্গণেও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে নারীকেও প্রথম সারিতে অর্থাৎ উপার্জন ও পরিবার ভরণপোষণের কাজে নামতে হবে]। যুদ্ধক্ষেত্রের এই বিশেষ পরিস্থিতিতে যেন মেয়েরা এগিয়ে আসতে পারে এবং পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে সমানভাবে যুদ্ধ কোরে যেতে পারে সে সুযোগ আল্লাহ রেখেছেন। তার প্রমাণ ইতিহাস। ওহুদের যুদ্ধে যখন মুসলিম বাহিনী বিরাট বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, বহু সাহাবী শহীদ হয়ে যান, স্বয়ং রসুলাল্লাহ মারাত্মকভাবে আহত হন, কাফেররা প্রচার কোরে দেয় যে, রসুলাল্লাহও শহীদ হয়ে গেছেন এমনই বিপজ্জনক মুহূর্তে মেয়েরা আর দ্বিতীয় সারিতে থাকলেন না, তারা অস্ত্র হাতে নিয়ে রসুলাল্লাহকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য কাফের সৈন্যদের বিরুদ্ধে বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ওহুদ যুদ্ধে নারী সাহাবী উম্মে আম্মারার (রা:) ভূমিকা ছিল প্রায় অবিশ্বাস্য। এ সম্পর্কে রসুলাল্লাহর (সাঃ) উক্তিই যথেষ্ট। তিনি বলেছিলেন, ‘ওহুদের দিন ডানে-বামে যেদিকেই নজর দিয়েছি, উম্মে আম্মারাহকেই লড়াই করতে দেখেছি।’ তিনি যেভাবে যুদ্ধ করেছিলেন তা নজিরবিহীন। এক শত্র“ সৈন্যের তরবারির কোপ পড়ল তার মাথায়। তিনি ঢাল দিয়ে তা প্রতিহত করলেন। তিনি আঘাত করলেন তার ঘোড়ার পায়ের উপর। অশ্ব ও অশ্বারোহী দুজনেই পড়ে গেল মাটিতে। মহানবী এই দৃশ্য দেখে তার পুত্র আব্দুল্লাহকে (রাঃ) সাহায্যের নির্দেশ দিলেন। তিনি পতিত সৈন্যকে শেষ করলেন। এলো অন্য এক শত্র“। সে আঘাত হানলো আব্দুল্লাহর (রাঃ) বাম বাহুতে। মা পুত্রের ক্ষতস্থান বেঁধে দিলেন। আর ছেলেকে আমৃত্যু লড়াই করার জন্য উদ্দীপ্ত করলেন। এই অপূর্ব দৃশ্য দেখে রসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘হে উম্মে আম্মারাহ! তোমার মধ্যে যে শক্তি আছে, তা আর কার মধ্যে থাকবে?’
নবী করিম (সা:) নিজ হাতে সেদিন এই বীরাঙ্গণার ক্ষতস্থানে পট্টি বেঁধে দিয়েছিলেন। তাঁর কাঁধ থেকে গল গল করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। বেশ কয়েকজন বীর সৈনিকের নাম উল্লেখ করে তিনি মন্তব্য করলেন, ‘আল্লাহর কসম! আজ তাদের সবার চেয়ে উম্মে আম্মারাহ বেশি বীরত্ব দেখিয়েছেন। এর অনেক পরে ইয়ারমুকের যুদ্ধে খালিদ বিন ওয়ালীদের অন্যতম এক বাহু দেরার বিন আজওয়ার যখন শত্র“র হাতে আটকা পড়েন তখন তারই আপন ভগ্নী খাওলা ঘোড়ায় চড়ে এমন লড়াই শুরু করেন যে স্বয়ং সেনাপ্রধান খালিদ (রাঃ) বার বার জিজ্ঞেস করেন, “কে এই বীর?” খাওলা শত্র“ শিবিরে আক্রমণ চালিয়ে শেষ পর্যন্ত তার ভাইকে উদ্ধার করেই ছাড়েন। পাঠক, এমন অসংখ্য উদাহরণের মধ্য থেকে কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করলাম, আশা করি সত্যপ্রিয় পাঠকের বোঝার জন্য এ ক’টিই যথেষ্ট হবে যে, রসুলাল্লাহর সময়ে নারীরা প্রথম সারির ভূমিকাও কিভাবে পালন করেছেন। মাসলা মাসায়েলের জটিল জাল বিস্তার কোরে কোনকাজেই তাদের অংশগ্রহণের বাধা সৃষ্টি করা হয় নি।
একটি জাতির প্রায় অর্ধাংশই নারী। জাতির অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে অচল কোরে রাখা আর এক পায়ে হাঁটার চেষ্টা করা একই কথা। সেই জাতির কোনদিনই উন্নতির কোন সম্ভাবনা নেই। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলাম নারী ও পুরুষের অংশগ্রহণের একটি সুন্দর সমন্বয় সাধন করেছে। নারীর নেতৃত্ব প্রদানের যোগ্যতাকে ইসলাম মোটেও অস্বীকার করে না। যদি অবস্থার প্রেক্ষাপটে কোন নারীকে দ্বিতীয় সারি থেকে প্রথম সারিতে আসতে হয় এবং সেখানে তিনি যদি তার জ্ঞান, প্রতিভা, যোগ্যতা, দক্ষতা, সামর্থ্যবলে নেতৃত্বদানের উপযুক্ত বলে সাব্যস্ত হন, সেক্ষেত্রে অবশ্যই তিনি বহু পুরুষের উপরও নেত্রী হিসাবে নিয়োজিত হতে পারবেন। প্রকৃত ইসলামের দৃষ্টিতে নারী হওয়া নেতৃত্বলাভের ক্ষেত্রে কোন অযোগ্যতা নয়। ইসলামের ইতিহাসের একটি দুঃখজনক অধ্যায় উটের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা:)। বহু সাহাবী তাঁর অধীনে থেকে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধটির বিভিন্ন দিক নিয়ে ঐতিহাসিকরা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন, কিন্তু “ইসলামে নারী নেতৃত্ব হারাম” বলে তখন তাঁর পক্ষে বিপক্ষে যুদ্ধরত কোন সাহাবী ফতোয়া দিয়েছেন বলে ইতিহাসে পাওয়া যায় না। এই কথাটি আবিষ্কার করেছেন বিকৃত আকিদার মোল্লারা যারা উম্মাহর মূল কাজ, তাকে সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অন্ধ।
মূল কথা হচ্ছে, যেখানে যুদ্ধক্ষেত্রের মতো বিপদসঙ্কুল এবং সবচাইতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পুরুষ সাহাবীদের পাশাপাশি নারী সাহাবীরা অংশ নিয়েছেন, সেখানে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং অন্যান্য কাজে যে নারীদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা কখনই পুরুষদের চেয়ে কোন অংশে পিছিয়ে ছিলেন না। তারা পূর্ণ সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে জাতীয় ও সামাজিক প্রয়োজনে নিশ্চিন্তে, নির্বিঘেœ যে কোন ভূমিকা রাখতে পারতেন। কেবল একটি মাত্র পদ নারীকে দেওয়া বৈধ নয়, সেটি হলো- উম্মতে মোহাম্মদী নামের যে মহাজাতিটি সৃষ্টি হবে সেই জাতির এমামের পদ। আল্লাহ নারী ও পুরুষের দেহ ও আত্মার স্রষ্টা, সচেতন মন ও অবচেতন মনের স্রষ্টা। এদের উভয়ের দুর্বলতা সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানেন মহান আল্লাহ। তিনি জানেন যে নারীর শারীরিক গঠন যেমন পুরুষের তুলনায় কোমল, তার হৃদয়ও পুরুষের তুলনায় কোমল, আবেগপ্রবণ ও সংবেদনশীল। সহজেই তার চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে, তার স্থৈর্য, দূরদর্শীতা পুরুষের চেয়ে কম, তাকে প্রভাবিত করা সহজতর। ইবলিস নারীকেই প্রথম আল্লাহর হুকুম থেকে বিচলিত করেছিল। এ কারণেই আল্লাহর অগণ্য নবী-রসুলের মধ্যে একজনও নারী নেই। সুতরাং পৃথিবীময় উম্মতে মোহাম্মদী নামক যে মহাজাতি হবে সেই মহাজাতির এমাম কেবল নারী হতে পারবেন না, স্বীয় যোগ্যতাবলে অন্যান্য যে কোন পর্যায়ের আমীর বা নেতা সে হতে পারবে। শুধু নারী হওয়ার কারণে কেউ নেতৃত্ব দিতে পারবে না এটা ইসলামের দৃষ্টিতে যোগ্যতা অযোগ্যতার মাপকাঠি নয়।
[পাঠক মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ: ০১৯৩৩৭৬৭৭২৫]
Tuesday, June 30, 2015
প্রকৃত এসলামের বিয়ে এবং বর্তমানের বিকৃতিসমূহ
প্রকৃত এসলামের বিয়ে এবং বর্তমানের বিকৃতিসমূহ
আফরোজা শবনম:
এসলামে নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বিয়ে হোচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা। বিয়ে পুরুষ ও নারীর মাঝে সামাজিক পরিবেশে ও সমর্থনে শরীয়ত মোতাবেক অনুষ্ঠিত এমন এক সম্পর্ক, যার ফলে দু’জনে একত্রে বসবাস ও পরস্পরে দাম্পত্য সম্পর্ক ও সন্তান উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে বৈধ হয়ে যায় এবং পরস্পরের উপর অধিকার ও দায়িত্ব কর্তব্য অবশ্য পালনীয় হয়ে দাঁড়ায়।
রাসুলাল্লাহ বলেন আল্লাহ “দাম্পত্য সম্পর্ককে নৈকট্য ও আত্মীয়তার মাধ্যম হিসেবে নির্ধারণ কোরেছেন এবং এটাকে অবশ্যকীয় বিষয় কোরেছেন যার কারণে আত্মীয়তার বন্ধন মজবুত হয়। সমগ্র মানব মানবীর মধ্যে এই বিষয়ে আকর্ষণ ও অনুরাগকে সহজাত কোরেছেন এবং বংশের দ্বারা সম্মানিত কোরেছেন”। এ প্রসঙ্গে সুমহান আল্লাহ বলেন: “তিনি সেই সত্তা যিনি অপবিত্র পানি হতে মানুষ সৃষ্টি কোরেছেন এবং বৈবাহিক সম্পর্ককে বংশও আত্মীয়তার অন্যতম মানদণ্ড নির্ধারণ কোরেছেন। আর আপনার প্রতিপালক প্রবল পরাক্রমশালী (সুরা ফোরকান ৫৪)।
এসলামে বিয়ের শর্ত মূলত তিনটি। প্রথমতঃ ছেলে এবং মেয়ে দু’জন দু’জনকে অবশ্যই পছন্দ হতে হবে। সাক্ষী থাকবে দু’জন এবং মেয়েকে দেনমোহর দিতে হবে। ছেলের সামর্থ অনুযায়ী যে দেনমোহর দিতে সক্ষম তা মেয়ে যদি মেনে নেয় তাহোলেই হবে এসলামের বিয়ে। কিন্তু আমরা যদি সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখি তাহলে দেখতে পাই যে, এসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত। আমাদের সমাজে একজন পাত্রের অবিভাবক কোরবানির হাটের গরুর মত পাত্রের দাম হাকেন। যে যত দাম বেশি দিবে বিয়েটা শেষ পর্যন্ত সেখানেই হয়। এখানে অবিভাবকরা পাত্র পাত্রীর পছন্দ অপছন্দের মূল্যায়ন করে না। আর মেয়ের অভিভাবকরা একটা মেয়েকে পার করার জন্য পাত্র পক্ষের চাহিদা পূরণ করার জন্য সাধ্যের বাইরে চেষ্টা করেন, অনেক সময় দেখা যায় পাত্র পক্ষের এই চাহিদা পূরণ করার জন্য জায়গা-জমি, সহায়-সম্পত্তিও বিক্রি কোরতে হয়। তারপরও যদি শ্বশুর বাড়ির নির্যাতন থেকে নিস্তার পাওয়া যেত! নববধূর হাতের মেহেদীর রং মুছতে না মুছতেই শুরু হয় নতুন উৎপীড়ন। প্রতিদিন যৌতুকের বলী হোচ্ছেন হাজার হাজার নারী, কাউকে আত্মহত্যা কোরতে বাধ্য করা হোচ্ছে। কতগুলো ঘটনা আমরা জানি আর কতগুলো ঘটনা আমাদের অজানাই থেকে যায়।
আমরা যদি মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর দিকে তাকাই তাহোলে আমাদের উপমহাদেশের বিপরীত চিত্র দেখতে পাবো। সেখানে পাত্রীর অভিভাবকরা মোটা অংকের দেনমোহর হাঁকেন, যা একজন পাত্রের সাধ্যের বাইরে। তাই সেখানে একজন ছেলে বিয়ে করার আগেই প্রৌঢ়ত্বে পদার্পণ করেন, অনেকে বিবাহে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, অনেকে তাদের চাহিদা পূরণ কোরতে হয় আরব উপমহদেশের বাইরে গিয়ে অবৈধ উপায়ে।
পাশ্চাত্য সমাজের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, সেখানে নারী পুরুষরা বিয়েকে একটা বোঝা হিসাবে মনে করে। ওদের দর্শন হল, অর্থ উপার্জন করো এবং যত পারো ভোগ করো। যতদিন যৌবন থাকে এই দর্শনে তারা বিশ্বাসী থাকে, পরে যখন জীবন বার্দ্ধক্যের দিকে ঝুঁকতে থাকে এই দর্শনের প্রতি আস্থাও কমতে থাকে, লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ পড়ে অনিশ্চয়তায়। কোন পরিবার নেই, মনের ভাব আদান-প্রদান করার কেউ নেই। প্রচণ্ড হতাশায় দিন কাটাতে হয়। এই হতাশা কাটাতে নির্ভর কোরতে হয় মাদকের উপরে, জীবনের উপার্জিত সম্পদ ব্যয় হতে থাকে মাদক আর বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। একসময় অনেকগুলি জারজ সন্তান দুনিয়াতে রেখে হাসপাতালে বা বৃদ্ধাশ্রমে প্রাণত্যাগ করে। ইদানিং তো এই বিয়ে ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেওয়ার ভয়াবহ পরিণতি অন্যদিকে গড়িয়েছে। সেটা হোচ্ছে সমকামীতা যা কিনা পশুও পশুর সঙ্গে করে না। কী জঘন্য, কী ভয়াবহ, কী নিকৃষ্ট! অথচ এই সমকামীতা অনেকগুলি উন্নত (!) দেশে আইনসিদ্ধ।
হিন্দু শাস্ত্রে বিয়েটা এমনই জটিল যে আধুনিক ভারতীয় হিন্দুরাও পুরাতন ধ্যান ধারণা ছুঁড়ে ফেলে পাশ্চাত্যের ‘অবাধ বা ফ্রি-সেক্স’ জীবনদর্শনে প্রভাবিত হয়ে পড়ছে এবং বিয়েকে ‘তথাকথিত’ ‘প্রথাগত’ ইত্যাদি বিশেষণে আখ্যায়িত কোরছে।
পুরুষের বহু বিবাহের প্রয়োজনীয়তা
আধুনিক নারীরা পুরুষের বহু বিবাহের ব্যাপারটি মানতে রাজি না, তারা মনে করে এসলাম এই অপমানজনক পুরুষতান্ত্রিক প্রথাটিকে নারীর উপরে চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর জনসংখ্যা জরিপে দেখা যায় যে পুরুষের চেয়ে নারীদের সংখ্যা অনেক দেশেই বেশি। এখন একজন পুরুষ যদি একটি বিয়েই করে তাহোলে বাদবাকী নারীদের কি হবে? হয় তাদের বিয়ে ছাড়া জীবন কাটিয়ে দিতে হবে, না হয় অবৈধ পথ বেছে নিতে হবে। অন্যভাবে বলা যায়, সংসারের আশ্রয় না পাওয়ায় সমাজই তাকে বাধ্য করবে ‘অসতী’ হতে। তার চেয়ে কি ভাল নয় যৌথ পরিবারে ঐক্যবদ্ধভাবে অন্য নারীর সঙ্গে স্ত্রীর অধিকার ও সম্মান নিয়ে সহমর্মী হয়ে বসবাস করা? এতে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেলো, একাকীত্ব দূর হোল, জীবনের অবলম্বনও হোল, অবিচার অনাচারের পথও রুদ্ধ হোল।
তাছাড়া একজন পুরুষের স্ত্রী যদি সন্তান ধারণে অক্ষম হয়, তখনও তার স্বামী কি আরেকজন স্ত্রী গ্রহণ কোরতে পারবে না? অথবা প্রথমা স্ত্রী অসুস্থ হোলে তখন সেই পুরুষ কি দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করে পরিবারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারবে না? মহান আল্লাহর দেওয়া কোন বিধানই একপেশে বা অন্যায় হতে পারে না, আল্লাহর সকল বিধান হোচ্ছে চূড়ান্ত ন্যায় ও ভারসাম্যে পূর্ণ এবং প্রাকৃতিক। অনেকেই আমরা মনে করি, পুরুষের বহু বিবাহ কেবলমাত্র পুরুষেরই প্রয়োজনে, কিন্তু আসলেই কি তাই? একাধিক নারী একটি সংসারে যদি সহোদরার ন্যায় অবস্থান কোরতে পারেন, সন্তানদেরকে মানুষ করার ক্ষেত্রে, পারস্পরিক সেবাযতেœ এবং সংসারকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করার ক্ষেত্রে তারা কেমন অবদান রাখতে পারেন, তা কি ভেবে দেখেছেন?
বর্তমানে আমাদের সমাজে একটা বিয়ে মানেই পাত্র এবং পাত্রী উভয় পক্ষের অর্থের অপচয়। অথচ রসুলাল্লাহর আদরের মেয়ে জান্নাতের রানী ফাতেমাকে (রা:) বিয়ে দিলেন তাঁর চাচাতো ভাই আলীর (রা:) সঙ্গে। বিয়ে ঠিক হবার পর রসুলাল্লাহ আলীকে (রা:) জিজ্ঞাস করলেন তার কাছে কি আছে? আলী (রা:) জবাব দিলেন টাকা পয়সা কিছুই নেই। থাকার মধ্যে আছে একটি ঘোড়া, একটি তলোয়ার আর একটি লোহার বর্ম। মহানবী তাকে বোললেন, ‘আর যখন কিছুই নেই তখন বর্মটি বন্ধক দিয়ে টাকা নিয়ে এসো।’ তাই করা হোল এবং ঐ টাকা দিয়ে বিয়ের খরচ চালানো হোল। এবং দেনমোহর হোল চারশত মিসকাল রূপা। আরেকটি উদাহরণ দিই। একজন সাহাবীর বিয়ের প্রশ্ন উঠলে রসুলাল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস কোরলেন, ‘দেন মোহর দেওয়ার মত তোমার কি আছে?’ সাহাবী বোললেন, ‘আমার কোন কিছুই তো নেই।’ রসুলাল্লাহ জিজ্ঞেস কোরলেন, ‘তুমি কি কোর’আনের কোন আয়াত জানো?’ সাহাবী বোললেন, ‘হ্যাঁ। আমি কোর’আনের এতগুলি আয়াত জানি।’ রসুলাল্লাহ বোললেন, ‘তোমার দেনমোহর হচ্ছে তুমি এই আয়াতগুলি তোমার স্ত্রীকে শিক্ষা দিবে।’ তখন এভাবেই বিয়ে হোল।
পাঠকগণ একটু চিন্তা করে দেখুন এসলামের বিয়ে কত সাধারণ ও সহজ! আল্লাহর রসুল কি পারতেন না তাঁর আদরের কন্যার বিয়ে অতি জাঁকজমকপূর্ণভাবে দিতে। কিন্তু প্রকৃত এসলাম বর্তমান সমাজের এই অপচয় মোটেও সমর্থন করে না। আরেকটি প্রতারণামূলক ও দুঃখজনক ব্যাপার হোচ্ছে আমাদের সমাজে মোটা অংকের টাকা দেনমোহর হিসাবে ধার্য করা হয় কিন্তু সেই দেনমোহরের টাকা স্ত্রীকে জীবনেও আর পরিশোধ করে না অথচ দেনমোহরের টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত— স্ত্রী কোন পুরুষের জন্য বৈধ হয় না। তাই আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে বোলেছেন “স্ত্রীদের মোহর স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও সন্তুষ্টচিত্তে প্রদান কর। অবশ্য তারা নিজেরা যদি খুশিমনে মোহরের কিছু অংশ মাফ করে দেয়, তবে তা তোমরা সানন্দে গ্রহণ কোরতে পার (সুরা নিসা-৪)। পাঠকগণ, আয়াতটি লক্ষ্য করুন। মোহরানার টাকা অবশ্যই আদায় কোরতে হবে। তারপর স্ত্রী যদি সন্তুষ্টচিত্তে কিছু অংশ ক্ষমা করে দেয় তাহলে গ্রহণ কোরতে পারবে। অথচ আমাদের পুরুষ সমাজ বিশাল অংকের টাকা মোহরানা প্রদানের শর্তে বিয়ে করে কিন্তু পরিশোধ করেন না, বিবাহিত জীবনের শুরুতেই “মোহরানার টাকা মাফ করে দাও” বলে আজীবন স্ত্রীর কাছে ছোট হয়ে থাকে। কারণ যদি কোন কারণে বিয়ে ভেঙ্গে যায় ঐ মোহরানার টাকা তাকে তখন বাধ্য হয়ে পরিশোধ কোরতে হবে, যার সামর্থ্য অনেক সময়ই স্বামীর থাকে না।
বর্তমানে সারা পৃথিবীতেই রেওয়াজ প্রচলিত আছে যে, পাত্রীকে অবশ্যই পাত্রের চেয়ে বয়সে ছোট হতে হবে। এই ধারণা এসলাম সমর্থন করে না। রসুলাল্লাহর প্রথমা স্ত্রী আম্মা খাদিজা রসুলাল্লাহর চেয়ে বয়সে ১৫ বছরের বড় ছিলেন। আমাদের সমাজে কোন ছেলে যদি বয়সে বড় কাউকে বিয়ে করে তাকে কেউ সহজে মেনে নিতে পারে না। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ বোলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ‘আইয়্যিম’ তাদেরকে বিয়ে দিয়ে দাও (সুরা নূর ৩২)।’ আইয়্যিম বোলতে যে প্রাপ্তবয়ষ্কা নারীর স্বামী নেই বা যে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের স্ত্রী নেই, সে কুমারী, অবিবাহিত, তালাকপ্রাপ্ত, বিধবা বা বিপতœীক যাই হোক না কেন। এখানে আল্লাহ কোন বয়সের সীমারেখা দেন নি।
আমাদের সমাজে বিধবা অথবা তালাক প্রাপ্ত মহিলাকেও কেউ বিয়ে কোরতে চায় না, এবং বিধবা তালাকপ্রাপ্ত মহিলা আজীবন কষ্টে দিন পার করেন কিন্তু বিয়ে করেন না, কিন্তু এসলামে এই ধারণা সমর্থন করে না। আমাদের সমাজে কোন বিধবা তালাকপ্রাপ্ত মহিলাকে কেউ বিয়ে কোরলে তার পরিবারের সদস্যরা কিছুতেই মেনে নেয় না। অথচ এসলামে বিধবাদেরকে বিবাহ করার ক্ষেত্রে উৎসাহ দেওয়া হোয়েছে, বিয়ের জন্য অনেক সময় আপন সন্তানদের মাধ্যমেও প্রস্তাব পাঠানো হোয়েছে। এসলাম কোন পুরুষ বা নারীর নিঃসঙ্গ থাকা সমর্থন করে না। কারণ প্রাপ্তবয়স্ক নারী বা পুরুষ অবিবাহিতভাবে থাকলে সমাজে অপরাধ বিস্তারের সম্ভাবনা বেড়ে যায়, পাশাপাশি তারা সমাজের একটি বোঝাতেও পরিণত হয়। বর্তমান সমাজেই এর ভুরি ভুরি প্রমাণ পাওয়া যায়। এখন সময় এসেছে আমাদের সমাজের প্রচলিত এই ভুল ধারণাগুলো থেকে বেরিয়ে আসার।
আল্লাহর দেওয়া ন্যায়-নীতিতে পূর্ণ, ভারসাম্যপূর্ণ, শান্তিময় জীবনবব্যস্থাকে নির্বাসন দিয়ে দাজ্জাল আজ এমন এক সভ্যতা কায়েম কোরেছে যা পুরো মানবজাতিকেই ভারসাম্যহীন করে ফেলেছে। মানুষ শুধুমাত্র জাতীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবেই চরম অশান্তিতে নেই বরং ব্যক্তি-জীবনেও ভয়াবহ দুর্বিসহ জীবন অতিবাহিত কোরছে।
আল্লাহর দেওয়া বিয়ের ব্যবস্থা ও পারিবারিক জীবনযাপন পদ্ধতি পরিহার করে কোথাও যৌতুকের বিয়ে, কোথাও Live together, কোথাও সমকামীতা, কোথাও বহুবিবাহের নামে যথেচ্ছাচার করা হোচ্ছে। পরিণতিতে সারা দুনিয়াতেই মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন সাংঘাতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হোয়েছে। কিছুদিন আগেও দাদা-দাদী, নানা-নানীরা বার্ধ্যক্যে এসে নাতি, পুতি, সন্তান, প্রতিবেশীদের মধ্যে আনন্দে, গল্পে জীবন অতিবাহিত কোরত, বয়স্ক হিসাবে সকলে তাদের শ্রদ্ধা কোরত, যে কোন খানাপিনা, পোশাক আশাক আগে বয়স্কদের দেওয়া হোত, যে কোন কাজ শুরুর আগে তাদের থেকে দোয়া আশীর্বাদ নেওয়া হোত, ফলে ঐ তারা নিজেদেরকে সম্মানিত বোধ কোরতেন। তারা মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে কান্নার রোল উঠতো, শোকের পরিবেশ বিরাজিত থাকতো অনেকদিন। তার আত্মার মাগফেরাতের জন্য মিলাদ, দরিদ্র মানুষকে আহার করানো ইত্যাদি অনুষ্ঠান হোত।
কিন্তু আজ সর্বত্র বিপরীত চিত্র। সন্তানরা অল্প বয়স থেকে বাবা-মাকে উপেক্ষা কোরতে আরম্ভ করে। পাঠবইয়ের সিলেবাসে কোথাও আদব কায়দা না শেখানোয় নতুন প্রজন্ম হয়ে উঠছে বে-পরোয়া। বৃদ্ধরা এ সমাজে Old fool. যারা আরও আধুনিক তারা বাবা-মাকে নির্বাসন দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম নামের কারাগারে। বৃদ্ধাশ্রম তো পরিবার নয়, সেখানকার কর্মচারীদের পেশাদারিত্ব থাকতে পারে ভালোবাসা নেই। সরকার এই বৃদ্ধদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে বার্দ্ধক্য ভাতা হিসাবে ২০০/৩০০ টাকা কখনও সখনও দিতে পারে, কিন্তু সেই টাকায় কোন মমতা বা শ্রদ্ধার স্পর্শ থাকে না, তাকে শুধুই অবহেলা।
দরিদ্র বাবা-মাকে ফেলে বহু শিক্ষিত, উপার্যনক্ষম সন্তান যার যার পথ বেছে নিচ্ছে। এমন দৃশ্য আমরা প্রায়ই দেখি যে গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে ঘর্মাক্তে কলেবরে রিক্সা চালাচ্ছেন একজন সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ আর তার রিক্সায় বসে শীস দিয়ে গান গাইছে নতুন প্রজন্মের ‘শিক্ষিত’ যুবক। জিজ্ঞেস কোরলে জানতে পারবেন ঐ বৃদ্ধেরও আছে জোয়ান ছেলে মেয়ে। এই বৃদ্ধ একদিন সেই ছেলেমেয়েদের অজ্ঞাতেই হয়তো দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবেন। তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বোলবে, বুড়ো মরে বাঁচলো।
আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা প্রত্যাখ্যানের জন্য কী কঠিন মূল্যই না দিয়ে যাচ্ছে মানবজাতি, কিন্তু বুঝতে পারছে না কোথায় তাদের গলদ। এখন সেই গলদ শোধরানোর একটি সুযোগ এসেছে। যামানার এমাম, হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীকে আল্লাহ দয়া করে সেই হারিয়ে যাওয়া এসলামের আকিদা বুঝিয়ে দিয়েছেন এবং আল্লাহ মো’জেজা ঘটিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন যে অচিরেই সেই তওহীদ ভিত্তিক সত্যদীন প্রতষ্ঠিত হোয়ে দুনিয়াকে একটি জান্নাতের বাগানে পরিণত কোরবে।
এসলামে বিয়ের শর্ত মূলত তিনটি। প্রথমতঃ ছেলে এবং মেয়ে দু’জন দু’জনকে অবশ্যই পছন্দ হতে হবে। সাক্ষী থাকবে দু’জন এবং মেয়েকে দেনমোহর দিতে হবে। ছেলের সামর্থ অনুযায়ী যে দেনমোহর দিতে সক্ষম তা মেয়ে যদি মেনে নেয় তাহোলেই হবে এসলামের বিয়ে। কিন্তু আমরা যদি সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখি তাহলে দেখতে পাই যে, এসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত। আমাদের সমাজে একজন পাত্রের অবিভাবক কোরবানির হাটের গরুর মত পাত্রের দাম হাকেন। যে যত দাম বেশি দিবে বিয়েটা শেষ পর্যন্ত সেখানেই হয়। এখানে অবিভাবকরা পাত্র পাত্রীর পছন্দ অপছন্দের মূল্যায়ন করে না। আর মেয়ের অভিভাবকরা একটা মেয়েকে পার করার জন্য পাত্র পক্ষের চাহিদা পূরণ করার জন্য সাধ্যের বাইরে চেষ্টা করেন, অনেক সময় দেখা যায় পাত্র পক্ষের এই চাহিদা পূরণ করার জন্য জায়গা-জমি, সহায়-সম্পত্তিও বিক্রি কোরতে হয়। তারপরও যদি শ্বশুর বাড়ির নির্যাতন থেকে নিস্তার পাওয়া যেত! নববধূর হাতের মেহেদীর রং মুছতে না মুছতেই শুরু হয় নতুন উৎপীড়ন। প্রতিদিন যৌতুকের বলী হোচ্ছেন হাজার হাজার নারী, কাউকে আত্মহত্যা কোরতে বাধ্য করা হোচ্ছে। কতগুলো ঘটনা আমরা জানি আর কতগুলো ঘটনা আমাদের অজানাই থেকে যায়।
আমরা যদি মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর দিকে তাকাই তাহোলে আমাদের উপমহাদেশের বিপরীত চিত্র দেখতে পাবো। সেখানে পাত্রীর অভিভাবকরা মোটা অংকের দেনমোহর হাঁকেন, যা একজন পাত্রের সাধ্যের বাইরে। তাই সেখানে একজন ছেলে বিয়ে করার আগেই প্রৌঢ়ত্বে পদার্পণ করেন, অনেকে বিবাহে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, অনেকে তাদের চাহিদা পূরণ কোরতে হয় আরব উপমহদেশের বাইরে গিয়ে অবৈধ উপায়ে।
পাশ্চাত্য সমাজের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, সেখানে নারী পুরুষরা বিয়েকে একটা বোঝা হিসাবে মনে করে। ওদের দর্শন হল, অর্থ উপার্জন করো এবং যত পারো ভোগ করো। যতদিন যৌবন থাকে এই দর্শনে তারা বিশ্বাসী থাকে, পরে যখন জীবন বার্দ্ধক্যের দিকে ঝুঁকতে থাকে এই দর্শনের প্রতি আস্থাও কমতে থাকে, লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ পড়ে অনিশ্চয়তায়। কোন পরিবার নেই, মনের ভাব আদান-প্রদান করার কেউ নেই। প্রচণ্ড হতাশায় দিন কাটাতে হয়। এই হতাশা কাটাতে নির্ভর কোরতে হয় মাদকের উপরে, জীবনের উপার্জিত সম্পদ ব্যয় হতে থাকে মাদক আর বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। একসময় অনেকগুলি জারজ সন্তান দুনিয়াতে রেখে হাসপাতালে বা বৃদ্ধাশ্রমে প্রাণত্যাগ করে। ইদানিং তো এই বিয়ে ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেওয়ার ভয়াবহ পরিণতি অন্যদিকে গড়িয়েছে। সেটা হোচ্ছে সমকামীতা যা কিনা পশুও পশুর সঙ্গে করে না। কী জঘন্য, কী ভয়াবহ, কী নিকৃষ্ট! অথচ এই সমকামীতা অনেকগুলি উন্নত (!) দেশে আইনসিদ্ধ।
হিন্দু শাস্ত্রে বিয়েটা এমনই জটিল যে আধুনিক ভারতীয় হিন্দুরাও পুরাতন ধ্যান ধারণা ছুঁড়ে ফেলে পাশ্চাত্যের ‘অবাধ বা ফ্রি-সেক্স’ জীবনদর্শনে প্রভাবিত হয়ে পড়ছে এবং বিয়েকে ‘তথাকথিত’ ‘প্রথাগত’ ইত্যাদি বিশেষণে আখ্যায়িত কোরছে।
পুরুষের বহু বিবাহের প্রয়োজনীয়তা
আধুনিক নারীরা পুরুষের বহু বিবাহের ব্যাপারটি মানতে রাজি না, তারা মনে করে এসলাম এই অপমানজনক পুরুষতান্ত্রিক প্রথাটিকে নারীর উপরে চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর জনসংখ্যা জরিপে দেখা যায় যে পুরুষের চেয়ে নারীদের সংখ্যা অনেক দেশেই বেশি। এখন একজন পুরুষ যদি একটি বিয়েই করে তাহোলে বাদবাকী নারীদের কি হবে? হয় তাদের বিয়ে ছাড়া জীবন কাটিয়ে দিতে হবে, না হয় অবৈধ পথ বেছে নিতে হবে। অন্যভাবে বলা যায়, সংসারের আশ্রয় না পাওয়ায় সমাজই তাকে বাধ্য করবে ‘অসতী’ হতে। তার চেয়ে কি ভাল নয় যৌথ পরিবারে ঐক্যবদ্ধভাবে অন্য নারীর সঙ্গে স্ত্রীর অধিকার ও সম্মান নিয়ে সহমর্মী হয়ে বসবাস করা? এতে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেলো, একাকীত্ব দূর হোল, জীবনের অবলম্বনও হোল, অবিচার অনাচারের পথও রুদ্ধ হোল।
তাছাড়া একজন পুরুষের স্ত্রী যদি সন্তান ধারণে অক্ষম হয়, তখনও তার স্বামী কি আরেকজন স্ত্রী গ্রহণ কোরতে পারবে না? অথবা প্রথমা স্ত্রী অসুস্থ হোলে তখন সেই পুরুষ কি দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করে পরিবারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারবে না? মহান আল্লাহর দেওয়া কোন বিধানই একপেশে বা অন্যায় হতে পারে না, আল্লাহর সকল বিধান হোচ্ছে চূড়ান্ত ন্যায় ও ভারসাম্যে পূর্ণ এবং প্রাকৃতিক। অনেকেই আমরা মনে করি, পুরুষের বহু বিবাহ কেবলমাত্র পুরুষেরই প্রয়োজনে, কিন্তু আসলেই কি তাই? একাধিক নারী একটি সংসারে যদি সহোদরার ন্যায় অবস্থান কোরতে পারেন, সন্তানদেরকে মানুষ করার ক্ষেত্রে, পারস্পরিক সেবাযতেœ এবং সংসারকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করার ক্ষেত্রে তারা কেমন অবদান রাখতে পারেন, তা কি ভেবে দেখেছেন?
বর্তমানে আমাদের সমাজে একটা বিয়ে মানেই পাত্র এবং পাত্রী উভয় পক্ষের অর্থের অপচয়। অথচ রসুলাল্লাহর আদরের মেয়ে জান্নাতের রানী ফাতেমাকে (রা:) বিয়ে দিলেন তাঁর চাচাতো ভাই আলীর (রা:) সঙ্গে। বিয়ে ঠিক হবার পর রসুলাল্লাহ আলীকে (রা:) জিজ্ঞাস করলেন তার কাছে কি আছে? আলী (রা:) জবাব দিলেন টাকা পয়সা কিছুই নেই। থাকার মধ্যে আছে একটি ঘোড়া, একটি তলোয়ার আর একটি লোহার বর্ম। মহানবী তাকে বোললেন, ‘আর যখন কিছুই নেই তখন বর্মটি বন্ধক দিয়ে টাকা নিয়ে এসো।’ তাই করা হোল এবং ঐ টাকা দিয়ে বিয়ের খরচ চালানো হোল। এবং দেনমোহর হোল চারশত মিসকাল রূপা। আরেকটি উদাহরণ দিই। একজন সাহাবীর বিয়ের প্রশ্ন উঠলে রসুলাল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস কোরলেন, ‘দেন মোহর দেওয়ার মত তোমার কি আছে?’ সাহাবী বোললেন, ‘আমার কোন কিছুই তো নেই।’ রসুলাল্লাহ জিজ্ঞেস কোরলেন, ‘তুমি কি কোর’আনের কোন আয়াত জানো?’ সাহাবী বোললেন, ‘হ্যাঁ। আমি কোর’আনের এতগুলি আয়াত জানি।’ রসুলাল্লাহ বোললেন, ‘তোমার দেনমোহর হচ্ছে তুমি এই আয়াতগুলি তোমার স্ত্রীকে শিক্ষা দিবে।’ তখন এভাবেই বিয়ে হোল।
পাঠকগণ একটু চিন্তা করে দেখুন এসলামের বিয়ে কত সাধারণ ও সহজ! আল্লাহর রসুল কি পারতেন না তাঁর আদরের কন্যার বিয়ে অতি জাঁকজমকপূর্ণভাবে দিতে। কিন্তু প্রকৃত এসলাম বর্তমান সমাজের এই অপচয় মোটেও সমর্থন করে না। আরেকটি প্রতারণামূলক ও দুঃখজনক ব্যাপার হোচ্ছে আমাদের সমাজে মোটা অংকের টাকা দেনমোহর হিসাবে ধার্য করা হয় কিন্তু সেই দেনমোহরের টাকা স্ত্রীকে জীবনেও আর পরিশোধ করে না অথচ দেনমোহরের টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত— স্ত্রী কোন পুরুষের জন্য বৈধ হয় না। তাই আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে বোলেছেন “স্ত্রীদের মোহর স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও সন্তুষ্টচিত্তে প্রদান কর। অবশ্য তারা নিজেরা যদি খুশিমনে মোহরের কিছু অংশ মাফ করে দেয়, তবে তা তোমরা সানন্দে গ্রহণ কোরতে পার (সুরা নিসা-৪)। পাঠকগণ, আয়াতটি লক্ষ্য করুন। মোহরানার টাকা অবশ্যই আদায় কোরতে হবে। তারপর স্ত্রী যদি সন্তুষ্টচিত্তে কিছু অংশ ক্ষমা করে দেয় তাহলে গ্রহণ কোরতে পারবে। অথচ আমাদের পুরুষ সমাজ বিশাল অংকের টাকা মোহরানা প্রদানের শর্তে বিয়ে করে কিন্তু পরিশোধ করেন না, বিবাহিত জীবনের শুরুতেই “মোহরানার টাকা মাফ করে দাও” বলে আজীবন স্ত্রীর কাছে ছোট হয়ে থাকে। কারণ যদি কোন কারণে বিয়ে ভেঙ্গে যায় ঐ মোহরানার টাকা তাকে তখন বাধ্য হয়ে পরিশোধ কোরতে হবে, যার সামর্থ্য অনেক সময়ই স্বামীর থাকে না।
বর্তমানে সারা পৃথিবীতেই রেওয়াজ প্রচলিত আছে যে, পাত্রীকে অবশ্যই পাত্রের চেয়ে বয়সে ছোট হতে হবে। এই ধারণা এসলাম সমর্থন করে না। রসুলাল্লাহর প্রথমা স্ত্রী আম্মা খাদিজা রসুলাল্লাহর চেয়ে বয়সে ১৫ বছরের বড় ছিলেন। আমাদের সমাজে কোন ছেলে যদি বয়সে বড় কাউকে বিয়ে করে তাকে কেউ সহজে মেনে নিতে পারে না। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ বোলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ‘আইয়্যিম’ তাদেরকে বিয়ে দিয়ে দাও (সুরা নূর ৩২)।’ আইয়্যিম বোলতে যে প্রাপ্তবয়ষ্কা নারীর স্বামী নেই বা যে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের স্ত্রী নেই, সে কুমারী, অবিবাহিত, তালাকপ্রাপ্ত, বিধবা বা বিপতœীক যাই হোক না কেন। এখানে আল্লাহ কোন বয়সের সীমারেখা দেন নি।
আমাদের সমাজে বিধবা অথবা তালাক প্রাপ্ত মহিলাকেও কেউ বিয়ে কোরতে চায় না, এবং বিধবা তালাকপ্রাপ্ত মহিলা আজীবন কষ্টে দিন পার করেন কিন্তু বিয়ে করেন না, কিন্তু এসলামে এই ধারণা সমর্থন করে না। আমাদের সমাজে কোন বিধবা তালাকপ্রাপ্ত মহিলাকে কেউ বিয়ে কোরলে তার পরিবারের সদস্যরা কিছুতেই মেনে নেয় না। অথচ এসলামে বিধবাদেরকে বিবাহ করার ক্ষেত্রে উৎসাহ দেওয়া হোয়েছে, বিয়ের জন্য অনেক সময় আপন সন্তানদের মাধ্যমেও প্রস্তাব পাঠানো হোয়েছে। এসলাম কোন পুরুষ বা নারীর নিঃসঙ্গ থাকা সমর্থন করে না। কারণ প্রাপ্তবয়স্ক নারী বা পুরুষ অবিবাহিতভাবে থাকলে সমাজে অপরাধ বিস্তারের সম্ভাবনা বেড়ে যায়, পাশাপাশি তারা সমাজের একটি বোঝাতেও পরিণত হয়। বর্তমান সমাজেই এর ভুরি ভুরি প্রমাণ পাওয়া যায়। এখন সময় এসেছে আমাদের সমাজের প্রচলিত এই ভুল ধারণাগুলো থেকে বেরিয়ে আসার।
আল্লাহর দেওয়া ন্যায়-নীতিতে পূর্ণ, ভারসাম্যপূর্ণ, শান্তিময় জীবনবব্যস্থাকে নির্বাসন দিয়ে দাজ্জাল আজ এমন এক সভ্যতা কায়েম কোরেছে যা পুরো মানবজাতিকেই ভারসাম্যহীন করে ফেলেছে। মানুষ শুধুমাত্র জাতীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবেই চরম অশান্তিতে নেই বরং ব্যক্তি-জীবনেও ভয়াবহ দুর্বিসহ জীবন অতিবাহিত কোরছে।
আল্লাহর দেওয়া বিয়ের ব্যবস্থা ও পারিবারিক জীবনযাপন পদ্ধতি পরিহার করে কোথাও যৌতুকের বিয়ে, কোথাও Live together, কোথাও সমকামীতা, কোথাও বহুবিবাহের নামে যথেচ্ছাচার করা হোচ্ছে। পরিণতিতে সারা দুনিয়াতেই মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন সাংঘাতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হোয়েছে। কিছুদিন আগেও দাদা-দাদী, নানা-নানীরা বার্ধ্যক্যে এসে নাতি, পুতি, সন্তান, প্রতিবেশীদের মধ্যে আনন্দে, গল্পে জীবন অতিবাহিত কোরত, বয়স্ক হিসাবে সকলে তাদের শ্রদ্ধা কোরত, যে কোন খানাপিনা, পোশাক আশাক আগে বয়স্কদের দেওয়া হোত, যে কোন কাজ শুরুর আগে তাদের থেকে দোয়া আশীর্বাদ নেওয়া হোত, ফলে ঐ তারা নিজেদেরকে সম্মানিত বোধ কোরতেন। তারা মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে কান্নার রোল উঠতো, শোকের পরিবেশ বিরাজিত থাকতো অনেকদিন। তার আত্মার মাগফেরাতের জন্য মিলাদ, দরিদ্র মানুষকে আহার করানো ইত্যাদি অনুষ্ঠান হোত।
কিন্তু আজ সর্বত্র বিপরীত চিত্র। সন্তানরা অল্প বয়স থেকে বাবা-মাকে উপেক্ষা কোরতে আরম্ভ করে। পাঠবইয়ের সিলেবাসে কোথাও আদব কায়দা না শেখানোয় নতুন প্রজন্ম হয়ে উঠছে বে-পরোয়া। বৃদ্ধরা এ সমাজে Old fool. যারা আরও আধুনিক তারা বাবা-মাকে নির্বাসন দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম নামের কারাগারে। বৃদ্ধাশ্রম তো পরিবার নয়, সেখানকার কর্মচারীদের পেশাদারিত্ব থাকতে পারে ভালোবাসা নেই। সরকার এই বৃদ্ধদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে বার্দ্ধক্য ভাতা হিসাবে ২০০/৩০০ টাকা কখনও সখনও দিতে পারে, কিন্তু সেই টাকায় কোন মমতা বা শ্রদ্ধার স্পর্শ থাকে না, তাকে শুধুই অবহেলা।
দরিদ্র বাবা-মাকে ফেলে বহু শিক্ষিত, উপার্যনক্ষম সন্তান যার যার পথ বেছে নিচ্ছে। এমন দৃশ্য আমরা প্রায়ই দেখি যে গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে ঘর্মাক্তে কলেবরে রিক্সা চালাচ্ছেন একজন সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ আর তার রিক্সায় বসে শীস দিয়ে গান গাইছে নতুন প্রজন্মের ‘শিক্ষিত’ যুবক। জিজ্ঞেস কোরলে জানতে পারবেন ঐ বৃদ্ধেরও আছে জোয়ান ছেলে মেয়ে। এই বৃদ্ধ একদিন সেই ছেলেমেয়েদের অজ্ঞাতেই হয়তো দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবেন। তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বোলবে, বুড়ো মরে বাঁচলো।
আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা প্রত্যাখ্যানের জন্য কী কঠিন মূল্যই না দিয়ে যাচ্ছে মানবজাতি, কিন্তু বুঝতে পারছে না কোথায় তাদের গলদ। এখন সেই গলদ শোধরানোর একটি সুযোগ এসেছে। যামানার এমাম, হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীকে আল্লাহ দয়া করে সেই হারিয়ে যাওয়া এসলামের আকিদা বুঝিয়ে দিয়েছেন এবং আল্লাহ মো’জেজা ঘটিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন যে অচিরেই সেই তওহীদ ভিত্তিক সত্যদীন প্রতষ্ঠিত হোয়ে দুনিয়াকে একটি জান্নাতের বাগানে পরিণত কোরবে।
অস্তিত্বহীন মাদ্রাসা-এতিমখানার নামে প্রতারণা!
অস্তিত্বহীন মাদ্রাসা-এতিমখানার নামে প্রতারণা!
ফার্মগেট সিগনালে থেমেছে বাস। পাঞ্জাবি-টুপি পরা এক ব্যক্তি উঠেই দান-খয়রাতের মাহাত্ম্য বয়ান শুরু করলেন। পরে আহ্বান জানালেন মোহাম্মদপুরের একটি এতিমখানা-মাদ্রাসায় দান করার। সরলমনা অনেকেই হাত ঢোকালো পকেটে। এক ফাঁকে কথা হয় ওই ব্যক্তির সঙ্গে। নাম হাফেজ রকিকুদ্দিন। জানালেন, মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের দারুল আহসানুল উলুম হেফজখানার শিক্ষক তিনি। মাদ্রাসার আরও কয়েকজন শিক্ষক তার মতো এতিম ছাত্রদের জন্য টাকা তোলেন। তবে তারা শুধু রমজান মাসেই টাকা তোলেন মাদ্রাসার জন্য। তার তথ্য অনুযায়ী মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া যায়নি দারুল আহসানুল উলুম নামের কোনও হেফজখানা।
রমজানকে কেন্দ্র করে মসজিদ-মাদ্রাসার জন্য অনুদান সংগ্রহের নামে নিজেদের পকেট ভরতে মাঠে নেমেছে প্রতারক চক্র। অবশ্য সারা বছরই এরা ধর্মানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে মসজিদ-মাদ্রাসার জন্য অনুদানের নামে টাকা হাতিয়ে নেয়। তবে রমজানকে কেন্দ্র করে তাদের ব্যস্ততা বরাবরই বেশি।
জনবহুল রাস্তার পাশে, বাস, ট্রেন, লঞ্চে এ তৎপরতা দেখা যায় বেশি। কেউ কেউ বাসা-বাড়ি ও দোকানেও মসজিদ-মাদ্রাসার নামে টাকা তোলে। রমজানে দান করলে বেশি সওয়াব- এমনটা বলেই টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। কেউ আবার নিজেদের প্রতারণাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে অনুদান আদায়ের রশিদও ধরিয়ে দিচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মসজিদ বা মাদ্রাসার নামে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আদায়ের ভিন্ন ভিন্ন কৌশল রয়েছে। সাধারণত দু-চারজনের একটি দল ব্যস্ত সড়কের পাশে টেবিল চেয়ার বসিয়ে মাইকে মসজিদে দান করার কথা বলেন। পাশাপাশি চলে ধর্মীয় বয়ান। রমজানের সময় ফেতরার টাকা দানের জন্য উৎসাহ দেওয়া হয় বেশি বেশি।
রাজধানীর বনানী, মিরপুর, আজীমপুর, যাত্রাবাড়ী, হাতিরঝিল, মগবাজার এলাকায় দেখা গেছে এমন অনেক অনুদান সংগ্রহকারী। এরা দলবদ্ধ হয় কম। আলাদাভাবে কাজ করে। সিগনালে থেমে থাকা বাস, ট্রেন-লঞ্চ, দোকানে গিয়ে টাকা তোলে।
আজীমপুরে ফুটপাতের একটি দোকানে মসজিদের জন্য টাকা চাইছেন আহমদ আলী নামের এক ব্যক্তি। তার হাতেও যথারীতি রশিদ। মসজিদ কমিটির সভাপতির নাম্বার চাইলেই কেটে পড়তে চান তিনি। পরে আহমদ আলী জানান, তিনি দীর্ঘদিন জুরাইনের একটি মসজিদের খাদেম ছিলেন। সেখানেও অনুদান সংগ্রহ করতেন। এখন বেকার থাকায় মসজিদের নামে টাকা তুলছেন। দিনে কমপক্ষে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা আয় তার।
প্রতারণা হোক বা না হোক, এভাবে মসজিদ-মাদ্রাসার নামে অনুদান সংগ্রহ অনুচিত বলে মনে করেন শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের খতিব মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মসজিদ-মাদ্রাসা মানুষের দান-খয়রাতে চলে। তাই বলে এভাবে রাস্তাঘাটে টাকা তোলা ঠিক নয়। মসজিদ-মাদ্রাসা সাধারণত এলাকাভিত্তিক অনুদানে চলে। তাই সন্দেহ হয় এরা আসলে কারা। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে এমনভাবে প্রতারণা গর্হিত কাজ। এ বিষয়ে সরকারের খোঁজ খবর রাখা উচিত।’
ধর্মব্যবসা চলছে কোরান বেচা চলছে হরদম।
ধর্মব্যবসা চলছে কোরান বেচা চলছে হরদম।
ধর্মব্যবসা চলছে কোরান বেচা চলছে হরদম।
যেন প্রতিবাদের কোন লোক নেই।যেন কিছুই হয়নি। যারা ভাল মানুষ আল্লাহর গযব আসলে তারাও অই গযবে পতিত হবেন।আর গযবও বতমানে পুরাদুমে চলছে কেন ঢের পান না?
চালান ছাড়া ব্যবসার মৌসুম হলো রোযার মাস।
আলেম-মোল্লা রা বরকতের কথা বলে টাহা হাতিয়ে নিচ্ছে আবার ইতিমধ্যে ফতোয়া বের করে ফেলেছে যে হাদিয়া চলে আল্লাহ কি আয়াত নাযেল করে ভুল করে ফেলেছেন বর্তমানে এরা ফতোয়া বের করে ঠিক করেছে। গযব আসিতেছে ------------- অতি শিঘ্রই --
চালান ছাড়া ব্যবসার মৌসুম হলো রোযার মাস।
আলেম-মোল্লা রা বরকতের কথা বলে টাহা হাতিয়ে নিচ্ছে আবার ইতিমধ্যে ফতোয়া বের করে ফেলেছে যে হাদিয়া চলে আল্লাহ কি আয়াত নাযেল করে ভুল করে ফেলেছেন বর্তমানে এরা ফতোয়া বের করে ঠিক করেছে। গযব আসিতেছে ------------- অতি শিঘ্রই --
( কোর-আন এর আয়াত বিক্রি করে কারা খায়?
এটা শুধু মোল্লাদের না, ,, চুলচেরা বিশ্লেষণকারী যত গুলা আছেন সবই এক নায়ের মাঝি। যাহোক যারা কোর-আন জানে তারাই তো বেচতে পারে?না যারা কোর-আন সম্বন্ধে কিছুই জানেনা তারা বেচে? ,,, এরা নামায পড়ায় মাগনা? তারাবীহ পড়ায় মাগনা? এরা ওয়াজ মাহফিল করায় মাগনা?এরা বায়না কইরা তারপর যায়। ওখানে যেয়ে কি,,,,আলু পটল, মলম বিক্রি করে ? না আল্লাহ রাসুল এর কথা, ,,কোর-আন এরকথা বলে? ,তাইলে কি বেচলো? কেরা বেচলো? আজকের এই তথাকথিত আলেম মোল্লারা সরাসরি আল্লাহর হুকুম পত্যাখানকরে নিজেরা মনগড়া ফতওয়া দিয়া জনগণ সহ, ,,বোকা বানাইয়া জাহান্নামের আগুনের দিকে যাচ্ছে সাথে অসহায় মুর্খ মোসলেম জাতিকেও নিয়া যাচ্ছে,এরা বুঝতেও পারতেছেনা এইজন্য যে, এরা খাটি গোমরাহীর মধ্যে পরে আকিদা ভুলে কাফের, মোশরেক এ পরিনত হয়ে গেছে। পড়ুন - মায়েদা ৪৪;৪৫;৪৭)...আর আলেম - মোল্লা চিনার জন্য-
এটা শুধু মোল্লাদের না, ,, চুলচেরা বিশ্লেষণকারী যত গুলা আছেন সবই এক নায়ের মাঝি। যাহোক যারা কোর-আন জানে তারাই তো বেচতে পারে?না যারা কোর-আন সম্বন্ধে কিছুই জানেনা তারা বেচে? ,,, এরা নামায পড়ায় মাগনা? তারাবীহ পড়ায় মাগনা? এরা ওয়াজ মাহফিল করায় মাগনা?এরা বায়না কইরা তারপর যায়। ওখানে যেয়ে কি,,,,আলু পটল, মলম বিক্রি করে ? না আল্লাহ রাসুল এর কথা, ,,কোর-আন এরকথা বলে? ,তাইলে কি বেচলো? কেরা বেচলো? আজকের এই তথাকথিত আলেম মোল্লারা সরাসরি আল্লাহর হুকুম পত্যাখানকরে নিজেরা মনগড়া ফতওয়া দিয়া জনগণ সহ, ,,বোকা বানাইয়া জাহান্নামের আগুনের দিকে যাচ্ছে সাথে অসহায় মুর্খ মোসলেম জাতিকেও নিয়া যাচ্ছে,এরা বুঝতেও পারতেছেনা এইজন্য যে, এরা খাটি গোমরাহীর মধ্যে পরে আকিদা ভুলে কাফের, মোশরেক এ পরিনত হয়ে গেছে। পড়ুন - মায়েদা ৪৪;৪৫;৪৭)...আর আলেম - মোল্লা চিনার জন্য-
"আল্লাহ কেতাবে যাহা নাযেল করেছেন তাহা যারা গোপন করে এবং উহার বিনিময়ে তুচ্ছ মুল্য (সামান্য হাদিয়া,টাকা, যেকোন কিছু দীনের ব্যাপারে) গ্রহন করে তারা তাদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছুই ঠুকায় না। আল্লাহ তাদের সাথে (কেয়ামতে) কথা বলবেন না, না তাদের পবিত্র করা হবে। বস্তুত তাদের জন্য রয়েছে বেদানাদায়ক আযাব। -(সুরা বাকারা 174)
এর চেয়ে আর পরিষ্কার কি হতে পারে?
এর চেয়ে আর পরিষ্কার কি হতে পারে?
বর্তমান পন্ডিত আহবার ও রোহবানগণ,রাব্বানীগণ কি সঠীক
পথে আছে ??
আসমানী কিতাব প্রচার/প্রতিষ্ঠা/বাস্তবায়ণের পথে নবী ও রসুল
মুহাম্মদ (স:)-এর পূর্বে অনেক নবী-রসুল প্রেরিত হয়েছে তাদের
মধ্যে অনেকের কথা কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে অনেকের কথা উল্লেখ
করা হয়নি দেখুন সূরা – ০২:৮৭>০৪:১৬৩-১৬৫>৪০:৭৮।
আল্লাহ্ প্রেরিত নবী-রসুলদেরকে অনেক মানুষ নবী-রসুল
হিসাবে অস্বীকার করেছে।প্রস্তর আঘাতে মারতে চেয়েছে,দেশ
থেকে বিতাড়িত করেছে,অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করেছে,শুলে বিদ্ধ
করে মারতে চেয়েছে,কত নবী-রসুলদেরকে হত্যা করেছে।তারা নবী-
রসুলদেরকে ঠাট্রা বিদ্রুপ করেছে,মিথ্যাবাদী,গণক,যাদুকর,পা
গল,দাম্ভিক,মিথ্যা উদ্ভাবনকারী বলে গালি দিয়েছে দেখুন সূরা –
০২:৬১>০৩:২১,১১২,১৮১-১৮৪>৮৭:৯১>০৬:১০>১৩:৩২>১৪:১৩>১৫:৬,১১>২১:৬
৮-৭০,৯১-৯৫>২৩:২৫-২৭,৩৮-৪৮,৭০>২৫:৪১>২৬:১১৬,১৫৩,১৬৭,১৮৫,১৮৬>২৯
:২৪>৫১:৫২>৫৪:২৫।
ইহুদি ও খ্রীষ্টান পন্ডিত আহবার ও রোহবানগণ,রাব্বানীগণ
আসমানী কিতাব বিকৃত করেছে,গোপন করেছে,আয়াতের বিনিময়ে তুচ্ছ
মূল্য (টাকা) গ্রহণ করেছে,আয়াত পরিবর্তন ও বিকৃত করেছে বলে আল-
কুরআনে উল্লেখ রয়েছে।দেখুন সূরা – ০২:৪১,৭৯,১৪০,১৫৯>০৩:৭৫-৭৭,১৮৭,
০৪:৪৬>০৫:১৩-১৫,৪৪>০৬:৯১>০৯:০৯>০৭:৬২,১৬৯।
মুসলমানদের ধর্ম প্রচারক কি ইহুদি-খ্রীষ্টানদের মত ব্যাবসিক নয় ?
পথে আছে ??
আসমানী কিতাব প্রচার/প্রতিষ্ঠা/বাস্তবায়ণের পথে নবী ও রসুল
মুহাম্মদ (স:)-এর পূর্বে অনেক নবী-রসুল প্রেরিত হয়েছে তাদের
মধ্যে অনেকের কথা কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে অনেকের কথা উল্লেখ
করা হয়নি দেখুন সূরা – ০২:৮৭>০৪:১৬৩-১৬৫>৪০:৭৮।
আল্লাহ্ প্রেরিত নবী-রসুলদেরকে অনেক মানুষ নবী-রসুল
হিসাবে অস্বীকার করেছে।প্রস্তর আঘাতে মারতে চেয়েছে,দেশ
থেকে বিতাড়িত করেছে,অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করেছে,শুলে বিদ্ধ
করে মারতে চেয়েছে,কত নবী-রসুলদেরকে হত্যা করেছে।তারা নবী-
রসুলদেরকে ঠাট্রা বিদ্রুপ করেছে,মিথ্যাবাদী,গণক,যাদুকর,পা
গল,দাম্ভিক,মিথ্যা উদ্ভাবনকারী বলে গালি দিয়েছে দেখুন সূরা –
০২:৬১>০৩:২১,১১২,১৮১-১৮৪>৮৭:৯১>০৬:১০>১৩:৩২>১৪:১৩>১৫:৬,১১>২১:৬
৮-৭০,৯১-৯৫>২৩:২৫-২৭,৩৮-৪৮,৭০>২৫:৪১>২৬:১১৬,১৫৩,১৬৭,১৮৫,১৮৬>২৯
:২৪>৫১:৫২>৫৪:২৫।
ইহুদি ও খ্রীষ্টান পন্ডিত আহবার ও রোহবানগণ,রাব্বানীগণ
আসমানী কিতাব বিকৃত করেছে,গোপন করেছে,আয়াতের বিনিময়ে তুচ্ছ
মূল্য (টাকা) গ্রহণ করেছে,আয়াত পরিবর্তন ও বিকৃত করেছে বলে আল-
কুরআনে উল্লেখ রয়েছে।দেখুন সূরা – ০২:৪১,৭৯,১৪০,১৫৯>০৩:৭৫-৭৭,১৮৭,
০৪:৪৬>০৫:১৩-১৫,৪৪>০৬:৯১>০৯:০৯>০৭:৬২,১৬৯।
মুসলমানদের ধর্ম প্রচারক কি ইহুদি-খ্রীষ্টানদের মত ব্যাবসিক নয় ?
একটিমাত্র ফেরকা বাদে সমস্ত ফেরকা, মাযহাব আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে”
একটিমাত্র ফেরকা বাদে সমস্ত ফেরকা, মাযহাব আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে”
একটিমাত্র ফেরকা বাদে সমস্ত ফেরকা, মাযহাব আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে”
শুক্রবার, জানুয়ারী 17, 2014, 18:25বিশেষ নিবন্ধমন্তব্য যোগ করুন (দেশেরপত্র)
আল্লাহর রসুল (দ:) একদিন মরুভূমির বুকে একটি সরল-সোজা লাইন থেকে ডান দিকে কতকগুলি এবং বাম দিকে কতকগুলি লাইন টানলেন এবং বোললেন-শয়তান এই রাস্তাগুলিতে ডাকতে থাকবে। এই বোলে তিনি কোর’আন থেকে এই আয়াত পড়লেন- নিশ্চয়ই এই হোচ্ছে আমার (আল্লাহর) সহজ-সরল পথ সেরাতুল মোস্তাকীম। সুতরাং এই পথেই চলো, অন্য পথে চলো না, (অন্যপথে) চোললে তা তোমাদের তার (আল্লাহর) পথ থেকে (চতুর্দিকে) বিচ্ছিন্ন কোরে দেবে। এইভাবে তিনি (আল্লাহ) নির্দেশ দিচ্ছেন যেন তোমরা সাবধানে পথ চোলতে পার (কোর’আন- সুরা আল-আনাম ১৫৪ এবং হাদিস- আব্দাল্লাহ বিন মাসউদ (রা:) থেকে- আহমদ, নিসায়ী, মেশকাত)। আল্লাহ ও তার রসুলের (দ:) সরাসরি আদেশকে অমান্য কোরে সেরাতুল মোস্তাকীমকে ত্যাগ কোরে এই জাতি আজ অতি মুসলিম হোয়ে শতধা বিচ্ছিন্ন হোয়ে গেছে। আজ দুনিয়াময় মোসলেম বোলে যে জাতিটি পরিচিত সেটা বহু ভাগে বিভক্ত। এর প্রত্যেক ভাগ অর্থাৎ ফেরকা, মাযহাব, বিশ্বাস করে যে সেই ভাগটাই শুধু প্রকৃত এসলামে আছে, বাকি সব মাযহাব, ফেরকা পথভ্রষ্ট, ঠিক যেমন অন্যান্য ধর্মের লোকেরা নিশ্চিত যে তাদের ধর্মই সঠিক, অন্য সব ধর্মের মানুষ নরকে যাবে। কিন্তু আসলে অন্যান্য সব ধর্ম যেমন তাদের নবীদের (দ:) দেখানো পথ থেকে বিচ্যুত হোয়ে পথভ্রষ্ট হোয়ে গেছে, মুসলিম নামধারী এই জাতিও তার নবীর (দ:) প্রতিষ্ঠিত পথ থেকে তেমনি ভ্রষ্ট হোয়ে গেছে যতখানি পথভ্রষ্টতা, বিকৃতি আসলে, পূর্বে আল্লাহ নতুন নবী পাঠিয়েছেন, এই জাতিতে ততখানি বিকৃতি বহু পূর্বেই এসে গেছে। নতুন নবী আসেন নি, কারণ, নবুয়্যত শেষ হোয়ে গেছে এবং শেষ রসুলের (দ:) প্রতিষ্ঠিত পথে, প্রকৃত এসলামে আবার ফিরে যাওয়ার জন্য অবিকৃত কোর’আন ও রসুলের হাদিস আছে যা অন্যান্য ধর্মে নেই।
শেষ এসলামের বিভক্তিগুলির মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাগ হোচ্ছে শিয়া মাযহাব। এই মাযহাবের পণ্ডিতরাও কোর’আন-হাদিসের চুলচেরা বিশ্লেষণে সুন্নী পণ্ডিতদের চেয়ে পেছনে পড়ে নেই এবং তাদের পাণ্ডিত্যের ফলে শিয়া মাযহাবও অগণিত ফেরকায় বিভক্ত হোয়ে গেছে সুন্নীদের মত। ফলে প্রকৃত এসলামের উদ্দেশ্য থেকে শিয়া-সুন্নী উভয় মাযহাবই বহু দূরে। কে বেশি দূরে কে কম দূরে এ পরিমাপ করা আমাদের উদ্দেশ্যও নয়, আমাদের সাধ্যও নয়, আমরা শুধু এইটুকুই জানি যে মহানবীর (দ:) কথিত একটিমাত্র ফেরকা বাদে শিয়া-সুন্নীসহ আর সমস্ত ফেরকা, মাযহাব আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে, অর্থাৎ মহানবীর (দ:) এসলামে নেই। সেই একমাত্র ফেরকা কোন্ ফেরকা তা পেছনে দেখিয়ে এসেছি। সুন্নীরা যেমন বিশ্বনবীর (দ:) প্রকৃত সুন্নাত ত্যাগ কোরে আল্লাহ-রসুলের নিষিদ্ধ ‘চুলচেরা বিশ্লেষণ’ কোরে উম্মাহটাকে টুকরো টুকরো কোরে ভেঙ্গে দিলেন এবং হাত থেকে তলোয়ার ফেলে দিয়ে তসবিহ নিয়ে খানকায়, হুজরায় ঢুকে উম্মাহর বর্হিমুখী (ঊীঃৎড়াবৎঃ) গতিকে অন্তর্মুখী কোরে একে স্থবির কোরে দিলেন (ওহঃৎড়াবৎঃ), তেমনি শিয়ারাও তাদের মাযহাবকে চুলচেরা বিশ্লেষণ কোরে বহু ভাগে ভাগ কোরে দিলেন এবং নবীর (দ:) প্রকৃত সুন্নাহ অর্থাৎ দীনকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বাদ দিয়ে বহু পূর্বের এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাকে নিয়ে মাতম করাটাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম-কর্ম হিসাবে গ্রহণ কোরলেন। মাতম করা কোন জীবন্ত জাতির মুখ্য কাজ হোতে পারে না, মৃত জাতির হোতে পারে।
প্রচলিত ইসলাম ইসলাম নয় কেন
প্রচলিত ইসলাম ইসলাম নয় কেন
আদম (আ.) থেকে মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত প্রত্যেক নবীর সময় এই দীনের মূলমন্ত্র রাখা হয়েছে-একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ)- এবং পরে যোগ হয়েছে তদানীন্তন নবীর নাম। এই কলেমার মূলমন্ত্রে কখনো এই ইলাহ শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ স্রষ্টা ব্যবহার করেন নি। এটা এই জন্য যে তিনি ‘একমাত্র’ হুকুমদাতা, একমাত্র সার্বভৌমত্বের মালিক যার আদেশ-নিষেধ ছাড়া আর কারো আদেশ নিষেধ গ্রাহ্য নয়, যার বিধান এবং নির্দেশ জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে, প্রতি ব্যাপারে অলংঘনীয়। কলেমার এই ঘোষণামতে কেউ যদি তাঁর কতগুলি আদেশ-নির্দেশ মেনে নিলো কিন্তু অন্য কতকগুলি অস্বীকার করল, তবে তিনি আর তার ‘একমাত্র’ ইলাহ রইলেন না। সংক্ষেপে এই দীনের ভিত্তি তওহীদের মর্মার্থ হচ্ছে আমি জীবনের প্রতিটি বিষয়ে যেখানেই আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কোনো বক্তব্য আছে সেটা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি যে বিভাগেই হোক না কেন, সেই ব্যাপারে আমি আর কারও কোনো বক্তব্য, নির্দেশ মানি না। যে বিষয়ে আল্লাহ অথবা তাঁর রসুলের কোনো বক্তব্য নেই সে বিষয়ে আমরা স্বাধীনভাবে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি। এর ঠিক বিপরীত হচ্ছে শেরক। সেটা হচ্ছে, জীবনের যেখানে, যে বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কোনো বক্তব্য বা বিধান আছে, সেখানে তাদের সেই বিধানকে অমান্য করে অন্য কারও তৈরি বিধান মানা। আজ এই শেরক-এ পুরো মানবজাতি আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে আছে। অথচ যে বা যারা আল্লাহর তওহীদে থাকবে না, যারা তাদের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত জীবনের যে কোনো একটি ভাগে, অঙ্গনে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বা নিজেদের তৈরি আইন-কানুন, রীতি-নীতি গ্রহণ বা প্রয়োগ করবে তাকে বা তাদের আল্লাহ মাফ না করার অঙ্গীকার করেছেন (সুরা নেসা ৪৮)। তাদের কোনো আমলই আল্লাহ গ্রহণ করবেন না।
আল্লাহর এই সুস্পষ্ট ঘোষণা সত্ত্বেও অনেকে বলতে পারেন আমরা কিভাবে কাফের মোশরেক হোলাম, আমরা তো নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, হজ্ব করি। তাদের এই মনোভাবের জবাবে বলতে চাই মক্কার কাফের মোশরেকরা রসুল (সা.) কে এই কথাই বলতো। রসুলাল্লাহর সমসাময়িক সময়ের যাদেরকে আমরা কাফের মোশরেক বলে জানি, অর্থাৎ আবু জেহেল, আবু লাহাব, ওতবা, শায়েবা, তাদের ধর্মীয় অবস্থা বর্তমান মুসলিম দাবিদারদের থেকে মোটেই আলাদা নয়। আমাদের মাঝে একটা ভুল ধারণা আছে যে তারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখত না, আল্লাহকে আল্লাহ বলে মানতো না ইত্যাদি ইত্যাদি। আল্লাহর কোর’আন এবং ইতিহাস কিন্তু বলছে অন্য কথা। ঐ আরবরা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা বলে, পালনকারী বলে বিশ্বাস করত, নামাজ পড়তো, কাবা শরীফকে আল্লাহর ঘর বলে বিশ্বাস করত, ঐ কাবাকে কেন্দ্র করে বাৎসরিক হজ্ব করত, কোরবানি করত, রোজা রাখত, আল্লাহর নামে কসম করত, আমাদের মতই এব্রাহীমকে (আ.)-তারা জাতির পিতা বলে বিশ্বাস করত, এব্রাহীম (আ.)-কে তাদের নবী হিসাবে মানতো। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনীয় দলিল, বিয়ে-শাদির কাবিন ইত্যাদি সমস্ত কিছু লেখার আগে আল্লাহর নাম লিখতো। তারা লিখতো- বেস্মেকা আল্লাহুম্মা, অর্থাৎ তোমার নাম নিয়ে (আরম্ভ করছি) হে আল্লাহ, অর্থাৎ আমাদের মতোই। আরবের মোশরেকরা আল্লাহয় বিশ্বাসী ছিল এ কথায় সাক্ষী স্বয়ং আল্লাহ। কোর’আনে তিনি তাঁর রসুলকে বলছেন- তুমি যদি তাদের (আরবের মোশরেক, কাফের অধিবাসীদের) জিজ্ঞাসা করো, আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি করেছেন? তবে তারা অবশ্যই জবাব দেবে- সেই সর্বশক্তিমান, মহাজ্ঞানী (আল্লাহ) (কোর’আন- সুরা যুখরুফ- ৯)। এমন আয়াত আরও আছে। ইতিহাস ও আল্লাহর সাক্ষ্য, দু’টো থেকেই দেখা যায় যে, যে মোশরেকদের মধ্যে আল্লাহর রসুল প্রেরিত হলেন তারা আল্লাহকে গভীরভাবে বিশ্বাস করত। তারা হাবল লা’ত, মানাতের পূজা করত ঠিকই কিন্তু ওগুলোকে তারা আল্লাহ বলে বিশ্বাস করত না, ওগুলোকে স্রষ্টা বলেও মানতো না। তারা বিশ্বাস করত যে হাবল, লা’ত, মানাত, ওজ্জা এরা দেব-দেবী, যারা ওগুলোকে মানবে, পূজা করবে তাদের জন্য ঐ দেব-দেবীরা সেই আল্লাহর কাছেই সুপারিশ করবে (কোর’আন- সুরা ইউনুস- ১৮, সুরা যুমার ৩)। ঠিক যেমন আজকে পীরদের ব্যাপারে মানুষ ধারণা করে থাকে।
আজকে মুসলিম নামক এই জাতি যে অবস্থায় আছে তাদের চাইতে কোন অংশে কম নয়। এরাও আল্লাহ বিশ্বাস করে, নিজেদেরকে মোহাম্মদ (সা.) এর উম্মাহ বলে বিশ্বাস করে, হজ্ব করে, কোরবানি করে, খাতনা করে। মক্কার ঐ লোকগুলো ব্যক্তি জীবনে এত কিছু করার পরও তাদেরকে আল্লাহ কাফের মোশরেক বললেন কেন? কারণ তারা আল্লাহর তওহীদ মানতো না, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মানতো না, তাদের জাতীয়, সমষ্টিগত জীবন পরিচালিত করত নিজেদের সমাজপতিদের তৈরি করা আইন-বিধান দ্বারা। এজন্য আল্লাহর রসুল এসে প্রথমেই তাদেরকে অন্য কোন কিছু না বলে কেবলমাত্র তওহীদ মেনে নেওয়ার আহ্বান জানালেন এবং প্রচণ্ড বাধা ও বিরোধিতা সত্ত্বেও নিরবচ্ছিন্নভাবে কালেমার বালাগ চালিয়ে গেলেন। নবুয়তের প্রথম ১৩ বছর তিনি অন্য কোন কিছুর দিকে আহ্বান করেন নি। তিনি বলেন নি যে, তোমাদের হজ্ব হয় না, হজ্ব ঠিক করে নাও, নামাজ হয় না নামাজ ঠিক করে নাও, কোরবানি হয় না ইত্যাদি ঠিক করে নাও। এমন কি সমাজে তাঁর চোখের সামনে যে অবিচার হোত তিনি সেগুলোরও কোন প্রতিবাদ করেন নি। শুধু মাত্র নিরবচ্ছিন্নœভাবে তওহীদের ডাক দিয়ে গেছেন, কারণ তিনি জানতেন তওহীদ অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা হলে সমাজ থেকে সর্বরকম অন্যায়, অবিচার অর্থাৎ অশান্তি দূর হয়ে যাবে।
বর্তমান দুনিয়াতে যে ইসলামটি চালু আছে তাতে এই তওহীদ নেই, সর্বত্র আল্লাহকে কেবল উপাস্য বা মা’বুদ হিসাবে মানা হচ্ছে, কিন্তু ইলাহ বা সার্বভৌমত্বের আসনে আল্লাহ নেই। তওহীদহীন ইসলাম মানেই প্রাণহীন, আত্মাহীন জড়বস্তু। মানুষ নিজেই এখন নিজের জীবনব্যবস্থা তৈরি করে সেই মোতাবেক জীবন চালাচ্ছে, মানুষ নিজেই ইলাহ অর্থাৎ বিধাতার আসনে আসীন। মানুষের তৈরি জীবন-ব্যবস্থাগুলিকেই (দীন) মানবজীবনের সকল সমস্যার যুগোপযোগী সমাধান হিসাবে মনে করা হচ্ছে যদিও সেগুলির সবই মানুষকে শান্তি দিতে চরমভাবে ব্যর্থ। মানুষের ইলাহর আসন থেকে আল্লাহকে সরিয়ে (Dethroning) দিয়ে সেখানে পাশ্চাত্য ‘সভ্যতা- কে অর্থাৎ মানুষকে বসিয়ে (Replacement) যে ধর্ম পালন করা হচ্ছে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা আমাদের বৃহত্তর ও সমষ্টিগত জীবনে গায়রুল্লাহর সার্বভৌমত্বকে স্বীকার ও গ্রহণ করে নিয়ে শুধুমাত্র ব্যক্তিজীবনের সার্বভৌমত্বটুকু আমরা আল্লাহর জন্য রেখেছি। সেই জাল্লে-জালাল, আযিজুল জব্বার, স্রষ্টা ভিক্ষুক নন যে তিনি এই ক্ষুদ্র তওহীদ গ্রহণ করবেন। তাছাড়া ওটা তওহীদই নয়, ওটা শেরক ও কুফর।
আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে বাদ দিয়ে অন্য যে কোনোটি স্বীকার, গ্রহণ করে নিলে সে আর মুসলিম বা মো’মেন থাকতে পারে না। কোনো লোক যদি ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী এবং জাতীয় জীবনের আল্লাহ ছাড়া অন্য যে কারও যেমন- সংখ্যাগরিষ্ঠ জনংখ্যার, সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণির, রাজা-বাদশাহর বা একনায়কের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী হয় তবে সে মোশরেক। আর উভয় জীবনেই কোন লোক যদি আল্লাহ ছাড়া ঐগুলির যে কোনটায় বিশ্বাস করে তবে সে কাফের। তাই যেহেতু এই মুসলিম দাবিদার জনসংখ্যাটি তাদের জাতীয় জীবনে কেউ গণতন্ত্র, কেউ সমাজতন্ত্র, কেউ রাজতন্ত্র, কেউ একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি তন্ত্র-মন্ত্র, ism, cracy ইত্যাদি মেনে চলছে অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বাদ দিয়ে ঐ সমস্ত তন্ত্রমন্ত্রের সার্বভৌমত্ব মানছে, সেহেতু তারাও কার্যতঃ (Defacto) জাতিগত হিসাবে মোশরেক ও কাফেরে পরিণত হয়েছে।
আল্লাহর এই সুস্পষ্ট ঘোষণা সত্ত্বেও অনেকে বলতে পারেন আমরা কিভাবে কাফের মোশরেক হোলাম, আমরা তো নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, হজ্ব করি। তাদের এই মনোভাবের জবাবে বলতে চাই মক্কার কাফের মোশরেকরা রসুল (সা.) কে এই কথাই বলতো। রসুলাল্লাহর সমসাময়িক সময়ের যাদেরকে আমরা কাফের মোশরেক বলে জানি, অর্থাৎ আবু জেহেল, আবু লাহাব, ওতবা, শায়েবা, তাদের ধর্মীয় অবস্থা বর্তমান মুসলিম দাবিদারদের থেকে মোটেই আলাদা নয়। আমাদের মাঝে একটা ভুল ধারণা আছে যে তারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখত না, আল্লাহকে আল্লাহ বলে মানতো না ইত্যাদি ইত্যাদি। আল্লাহর কোর’আন এবং ইতিহাস কিন্তু বলছে অন্য কথা। ঐ আরবরা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা বলে, পালনকারী বলে বিশ্বাস করত, নামাজ পড়তো, কাবা শরীফকে আল্লাহর ঘর বলে বিশ্বাস করত, ঐ কাবাকে কেন্দ্র করে বাৎসরিক হজ্ব করত, কোরবানি করত, রোজা রাখত, আল্লাহর নামে কসম করত, আমাদের মতই এব্রাহীমকে (আ.)-তারা জাতির পিতা বলে বিশ্বাস করত, এব্রাহীম (আ.)-কে তাদের নবী হিসাবে মানতো। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনীয় দলিল, বিয়ে-শাদির কাবিন ইত্যাদি সমস্ত কিছু লেখার আগে আল্লাহর নাম লিখতো। তারা লিখতো- বেস্মেকা আল্লাহুম্মা, অর্থাৎ তোমার নাম নিয়ে (আরম্ভ করছি) হে আল্লাহ, অর্থাৎ আমাদের মতোই। আরবের মোশরেকরা আল্লাহয় বিশ্বাসী ছিল এ কথায় সাক্ষী স্বয়ং আল্লাহ। কোর’আনে তিনি তাঁর রসুলকে বলছেন- তুমি যদি তাদের (আরবের মোশরেক, কাফের অধিবাসীদের) জিজ্ঞাসা করো, আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি করেছেন? তবে তারা অবশ্যই জবাব দেবে- সেই সর্বশক্তিমান, মহাজ্ঞানী (আল্লাহ) (কোর’আন- সুরা যুখরুফ- ৯)। এমন আয়াত আরও আছে। ইতিহাস ও আল্লাহর সাক্ষ্য, দু’টো থেকেই দেখা যায় যে, যে মোশরেকদের মধ্যে আল্লাহর রসুল প্রেরিত হলেন তারা আল্লাহকে গভীরভাবে বিশ্বাস করত। তারা হাবল লা’ত, মানাতের পূজা করত ঠিকই কিন্তু ওগুলোকে তারা আল্লাহ বলে বিশ্বাস করত না, ওগুলোকে স্রষ্টা বলেও মানতো না। তারা বিশ্বাস করত যে হাবল, লা’ত, মানাত, ওজ্জা এরা দেব-দেবী, যারা ওগুলোকে মানবে, পূজা করবে তাদের জন্য ঐ দেব-দেবীরা সেই আল্লাহর কাছেই সুপারিশ করবে (কোর’আন- সুরা ইউনুস- ১৮, সুরা যুমার ৩)। ঠিক যেমন আজকে পীরদের ব্যাপারে মানুষ ধারণা করে থাকে।
আজকে মুসলিম নামক এই জাতি যে অবস্থায় আছে তাদের চাইতে কোন অংশে কম নয়। এরাও আল্লাহ বিশ্বাস করে, নিজেদেরকে মোহাম্মদ (সা.) এর উম্মাহ বলে বিশ্বাস করে, হজ্ব করে, কোরবানি করে, খাতনা করে। মক্কার ঐ লোকগুলো ব্যক্তি জীবনে এত কিছু করার পরও তাদেরকে আল্লাহ কাফের মোশরেক বললেন কেন? কারণ তারা আল্লাহর তওহীদ মানতো না, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মানতো না, তাদের জাতীয়, সমষ্টিগত জীবন পরিচালিত করত নিজেদের সমাজপতিদের তৈরি করা আইন-বিধান দ্বারা। এজন্য আল্লাহর রসুল এসে প্রথমেই তাদেরকে অন্য কোন কিছু না বলে কেবলমাত্র তওহীদ মেনে নেওয়ার আহ্বান জানালেন এবং প্রচণ্ড বাধা ও বিরোধিতা সত্ত্বেও নিরবচ্ছিন্নভাবে কালেমার বালাগ চালিয়ে গেলেন। নবুয়তের প্রথম ১৩ বছর তিনি অন্য কোন কিছুর দিকে আহ্বান করেন নি। তিনি বলেন নি যে, তোমাদের হজ্ব হয় না, হজ্ব ঠিক করে নাও, নামাজ হয় না নামাজ ঠিক করে নাও, কোরবানি হয় না ইত্যাদি ঠিক করে নাও। এমন কি সমাজে তাঁর চোখের সামনে যে অবিচার হোত তিনি সেগুলোরও কোন প্রতিবাদ করেন নি। শুধু মাত্র নিরবচ্ছিন্নœভাবে তওহীদের ডাক দিয়ে গেছেন, কারণ তিনি জানতেন তওহীদ অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা হলে সমাজ থেকে সর্বরকম অন্যায়, অবিচার অর্থাৎ অশান্তি দূর হয়ে যাবে।
বর্তমান দুনিয়াতে যে ইসলামটি চালু আছে তাতে এই তওহীদ নেই, সর্বত্র আল্লাহকে কেবল উপাস্য বা মা’বুদ হিসাবে মানা হচ্ছে, কিন্তু ইলাহ বা সার্বভৌমত্বের আসনে আল্লাহ নেই। তওহীদহীন ইসলাম মানেই প্রাণহীন, আত্মাহীন জড়বস্তু। মানুষ নিজেই এখন নিজের জীবনব্যবস্থা তৈরি করে সেই মোতাবেক জীবন চালাচ্ছে, মানুষ নিজেই ইলাহ অর্থাৎ বিধাতার আসনে আসীন। মানুষের তৈরি জীবন-ব্যবস্থাগুলিকেই (দীন) মানবজীবনের সকল সমস্যার যুগোপযোগী সমাধান হিসাবে মনে করা হচ্ছে যদিও সেগুলির সবই মানুষকে শান্তি দিতে চরমভাবে ব্যর্থ। মানুষের ইলাহর আসন থেকে আল্লাহকে সরিয়ে (Dethroning) দিয়ে সেখানে পাশ্চাত্য ‘সভ্যতা- কে অর্থাৎ মানুষকে বসিয়ে (Replacement) যে ধর্ম পালন করা হচ্ছে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা আমাদের বৃহত্তর ও সমষ্টিগত জীবনে গায়রুল্লাহর সার্বভৌমত্বকে স্বীকার ও গ্রহণ করে নিয়ে শুধুমাত্র ব্যক্তিজীবনের সার্বভৌমত্বটুকু আমরা আল্লাহর জন্য রেখেছি। সেই জাল্লে-জালাল, আযিজুল জব্বার, স্রষ্টা ভিক্ষুক নন যে তিনি এই ক্ষুদ্র তওহীদ গ্রহণ করবেন। তাছাড়া ওটা তওহীদই নয়, ওটা শেরক ও কুফর।
আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে বাদ দিয়ে অন্য যে কোনোটি স্বীকার, গ্রহণ করে নিলে সে আর মুসলিম বা মো’মেন থাকতে পারে না। কোনো লোক যদি ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী এবং জাতীয় জীবনের আল্লাহ ছাড়া অন্য যে কারও যেমন- সংখ্যাগরিষ্ঠ জনংখ্যার, সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণির, রাজা-বাদশাহর বা একনায়কের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী হয় তবে সে মোশরেক। আর উভয় জীবনেই কোন লোক যদি আল্লাহ ছাড়া ঐগুলির যে কোনটায় বিশ্বাস করে তবে সে কাফের। তাই যেহেতু এই মুসলিম দাবিদার জনসংখ্যাটি তাদের জাতীয় জীবনে কেউ গণতন্ত্র, কেউ সমাজতন্ত্র, কেউ রাজতন্ত্র, কেউ একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি তন্ত্র-মন্ত্র, ism, cracy ইত্যাদি মেনে চলছে অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বাদ দিয়ে ঐ সমস্ত তন্ত্রমন্ত্রের সার্বভৌমত্ব মানছে, সেহেতু তারাও কার্যতঃ (Defacto) জাতিগত হিসাবে মোশরেক ও কাফেরে পরিণত হয়েছে।
ইসলামে বর্তমানের ন্যায় সুফিবাদের স্থান কতটুকু?
ইসলামে বর্তমানের ন্যায় সুফিবাদের স্থান কতটুকু?
আল্লাহ বনী আদমকে যাবতীয় অন্যায়-অশ ান্তি-রক্তপাত থেকে পরিত্রাণের জন্য মোহাম্মদ (সা.) কে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন দুইটি জিনিস দিয়ে যথা- হেদায়াহ এবং হেদায়াহর উপর প্রতিষ্ঠিত দীনুল হক, সত্য জীবনব্যবস্থা। আল কোর’আনে পাই- তিনি বিশ্বনবীর জীবনের উদ্দেশ্য ঠিক করে দিলেন এই নির্দেশ দিয়ে যে, ‘আমি তাঁকে (রসুলকে) হেদায়াহ এবং সত্যদীন দিয়ে এই কারণে পৃথিবীতে পাঠিয়েছি যেন তিনি এটাকে অন্য সমস্ত দীনের উপর বিজয়ী করেন এবং সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট ( সুরা আল ফাতাহ ২৮, তওবা ৩৩, সফ ৯ )’। ইতিহাসে পাচ্ছি- রসুলাল্লাহ তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কাটিয়েছেন এই একটি মাত্র কাজেই আর তা হলো সমস্ত পৃথিবীতে এই দীনুল হককে প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক সংগ্রাম। যেহেতু একজীবনে এই কাজ সম্ভব নয় তাই তিনি এই বৃহৎ কাজের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে একটি জাতি সৃষ্টি করলেন। এই জাতির নামই হলো উম্মতে মোহাম্মদী, মোহাম্মদের জাতি। এই জাতির লক্ষ্য হিসেবে তিনি স্থির করে দিলেন সংগ্রাম এবং শুধুই সংগ্রাম। সমস্ত পৃথিবীতে সত্য, ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের এই সংগ্রামের কোনো বিরতি নেই, কোনো চ্যুতি নেই। এই কাজকেই তিনি উল্লেখ করলেন তাঁর সুন্নাহ হিসেবে এবং সেই সাথে তিনি ঘোষণা করলেন -‘আমার এই সুন্নাহ যে বা যারা ছেড়ে দিবে তারা আমার কেউ নয়, আমিও তাদের কেউ নই (হাদিস- বোখারী, মুসলিম, মেশকাত)’। অর্থাৎ যারা রসুলাল্লাহর দিক নির্দেশনা অনুযায়ী চলবে না তাদের সাথে তিনি সম্পর্ক ছিন্ন করছেন। তিনি উম্মতে মোহাম্মদীকে তাঁর জীবদ্দশাতেই একটু একটু করে শিক্ষা দিলেন কিভাবে ইস্পাতের মতো ঐক্যবদ্ধ হতে হয়, পিঁপড়ার মতো শৃঙ্খলিত হতে হয় এবং মালায়েকদের মতো আনুগত্য পালন করতে হয়। অতঃপর তাঁর ওফাতের সাথে সাথেই তাঁর হাতে গড়া সেই জাতিটি তাদের দায়িত্বকে কাঁধে তুলে নিয়ে সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। এটা ইতিহাস যে তাদের এই বিস্ফোরণকে আটকানোর মতো শক্তি পৃথিবীতে তখন একটাও ছিল না। মাত্র অল্প কিছুদিনের মধ্যে তারা তৎকালীন বিশ্বের দুইটি সুপার পাওয়ার রোম এবং পারস্যকে সামরিকভাবে পরাজিত করে অর্ধ পৃথিবীকে আল্লাহর দীনের অধীনে নিয়ে আসলেন যার ফলে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
এর পর জাতি দুর্ভাগ্যবশতঃ তাদের আকিদা হারিয়ে ফেলল। তারা তাদের নেতার উপর অর্পিত দায়িত্বকে ভুলে গিয়ে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে একটা শ্রেণি রাজা বাদশাহদের মতো রাজত্ব করতে শুরু করল, একটা শ্রেণি দীনের চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ করে নতুন নতুন ফতোয়া আবিষ্কার করতে শুরু করল আর একটা শ্রেণি হুজরায়-খানকায় বসে আত্মার ঘষামাজা শুরু করে দিল। কেউই আর শেষ ইসলামের সেই ওয়াসাতা বা ভারসাম্যের মধ্যে থাকলেন না। তাদের কারো কাছে দীন হয়ে গেল শুধু দুনিয়াদারী আর কারো কাছে দীন হয়ে গেল শুধুই পরকালের মুক্তির পথ। আমি এখানে আলোচনা করব সেই শ্রেণিটির সম্পর্কে যারা এই জাতির আকিদা বিকৃতির পর তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বকে ত্যাগ করে সংগ্রাম ছেড়ে তসবিহ আর বদনা নিয়ে হুজরায়-খানকায় ঢুকল। এরাই হলো সেই সুফি- সাধকের দল যাদের আকিদায় আল্লাহ ইসলাম পাঠিয়েছেন শুধুই তাদের আত্মা পরিষ্কার করানোর উদ্দেশ্যে। তারা তাদের বিকৃত আকিদায় একথা বুঝতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলেন যে, ইসলাম হলো একটা পূর্ণাঙ্গ এবং শাশ্বত জীবন- ব্যবস্থা যা মানবজীবনের জাতীয় এবং ব্যক্তিগত উভয় ভাগের জন্যই প্রযোজ্য। এটার ভারসাম্য নষ্ট করে ফেললে তা আর আল্লাহর রসুলের আনীত ইসলাম থাকবে না সেটা হয়ে যাবে অন্যান্য বিকৃত দীনের মতোই নতুন একটা দীন। শেষ ইসলামের ভারসাম্য নষ্ট করে এই সুফীর দল যাকে আদর্শ হিসাবে বেছে নিলেন তিনি বিশ্বনবী (সা.) নন, তিনি মহাসাধক ওয়ায়েস করনী (রা.), যিনি রসুলাল্লাহর (সা.) নুবয়ত পাওয়ার অনেক আগে থেকেই আত্মিক উন্নতি অর্থাৎ তাসাওয়াফের সাধনা করে অতি উচ্চ স্তরে (মাকামে) অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। শেষ প্রেরিতের নবুয়ত পাওয়ার আগে থেকেই যিনি সাধনা করছিলেন তিনি কী প্রক্রিয়ায় সাধনা করছিলেন? নিশ্চয়ই মহানবীর (সা.) শেখানো পদ্ধতিতে নয়, হয় খ্রিস্টান বা ইহুদি বা বৌদ্ধ বা হিন্দু বা অন্য যে কোনো পূর্ববর্তী ধর্মের পদ্ধতি হবে। তা সত্ত্বেও তার সাধনা যে সম্পূর্ণ সফল ছিল তার প্রমাণ তার জীবনী এবং বিশেষ করে এই যে, মহানবী (সা.) তাঁর পবিত্র জোব্বা (Robe) তাকে উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু ওয়ায়েস করনী (রা.) বিশ্বনবীর (সা.) জীবনের কর্ম প্রবাহে যোগ দেন নি, এমন কি তাঁর (সা.) সাথে তার দেখাই হয় নি। মহানবী (সা.) আল্লাহর কাছ থেকে যে মহাদায়িত্ব নিয়ে এসে এবং তা পালন করতে যে অবিশ্বাস্য দুঃখ, দুর্দশার সংগ্রামের জীবন অতিবাহিত করলেন, তাতে ওয়ায়েস করনী (রাঃ) অংশ নেন নি- মা কে ছেড়ে আসতে হয় বলে। আবু বকর (রা.) থেকে শুরু করে হাজার হাজার আসহাব তাদের শুধু মা কে ছেড়ে নয়, বাপ-মা, স্ত্রী-পুত্র, কন্যা, সম্পত্তি, বাড়ি-ঘর হেলায় ত্যাগ করে এসে মহানবীর (সা.) সঙ্গী হয়েছেন, তাঁর সঙ্গে সব রকম দুঃখ বরণ করেছেন, বছরের পর বছর ছায়াহীন উত্তপ্ত মরুভূমিতে কাটিয়েছেন, বিশ্বনবীর (সা.) দায়িত্ব পূরণের সশস্ত্র সংগ্রামে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। সুফীরা ওহোদের যুদ্ধে বিশ্বনবীর (সা.) পবিত্র দাঁত ভেঙ্গে যাওয়ার খবরে ওয়ায়েস করনীর (রা.) নিজের দাঁত ভেঙ্গে ফেলাকে ভালোবাসার চূড়ান্ত পরিচয় হিসাবে পেশ করেন। নিজের দাঁত ভেঙ্গে ফেলা বেশি ভালোবাসার পরিচয়, না প্রিয় নেতার জীবন রক্ষার জন্য তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে শত্রুর অজস্র তীর নিজেদের শরীর দিয়ে ঠেকিয়ে তীরে তীরে সজারুর মতো হয়ে যাওয়া বেশি ভালোবাসার পরিচয়? শত্রুর আক্রমণ থেকে বিশ্বনবীকে (সা.) রক্ষা করতে জীবন পণ করে যুদ্ধ করে মারাত্মক আহত হয়ে প্রাণের চেয়ে প্রিয় নেতার পবিত্র পায়ের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে মরে যাওয়া কতখানি ভালোবাসার প্রমাণ? ওহুদের যুদ্ধে রসুলাল্লাহর আনুগত্য লঙ্ঘন করার কারণে মুসলিম বাহিনীর উপর সাংঘাতিক বিপর্যয় নেমে আসে। একটি সময় মোশরেক বাহিনী রসুলাল্লাহকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেললে তিনি বললেন, “এমন কে আছ, যে আমাদের প্রতিরক্ষার জন্য জীবন কোরবানি করতে প্রস্তুত?” এ কথা শুনে পাঁচজন আনসার সাহাবী এগিয়ে এলেন এবং রসুলাল্লাহ হেফাজতের জন্য এক একজন করে লড়াই করে শহীদ হতে লাগলেন এবং রসুলাল্লাহর পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়তে লাগলেন। সর্বশেষ ব্যক্তি ছিলেন যিয়াদ বিন সাকানা (রা.)। তিনিও বীর বিক্রমে লড়াই করে গুরুতর আহত হলেন। ইতোমধ্যে আরও কয়েকজন মোজাহেদ সেখানে ফিরে এলেন এবং আহত সাহাবীর পক্ষে লড়াই করে শত্রুপক্ষকে পর্যুদস্ত করে হটিয়ে দিল। রসুলাল্লাহ আহত যিয়াদকে (রা.) দেখিয়ে বললেন, ‘ওকে আমার কাছে আনো।” তাকে আনা হলে রসুলাল্লাহ নিজ জানুর উপর তাকে মাথা রেখে শোয়ালেন। এ অবস্থাতেই উক্ত সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। আর যদি দাঁতের কথাই তুলেন তবে রসুলাল্লাহর (সা.) মাথায় ঢুকে যাওয়া শিরস্ত্রাণের পেরেক পাগলের মতো কামড়িয়ে টেনে তুলতে যেয়ে আবু ওবায়দার (রা.) কয়েকটা দাঁত ভেঙ্গে ফেলার কথা ভুলে যাচ্ছেন কেন? ঐ ওহোদের যুদ্ধেই।
লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে মাত্র যে দশজন লোককে আল্লাহর সম্পূর্ণ ক্ষমা ও জান্নাতের সুসংবাদ তাদের জীবিতকালেই দেয়া হলো আবু ওবায়দা (রা.) তাদের অন্যতম- ওয়ায়েস করনী (রা.) নন। রসুলাল্লাহর (সা.) নিজের ব্যবহৃত খেরকা (জড়নব) ওয়ায়েস করনীকে (রা.) উপহার দেওয়াও এদের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মানের চিহ্ন হিসাবে বিবেচিত। বহু বইয়ে পড়েছি, বহু ওয়াজে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শুনেছি। কিন্তু বিদায় হজ্ব্বে মাথার চুল কামিয়ে সমস্ত পবিত্র চুলটুকু যে মহানবী (সা.) আল্লাহর তলোয়ার খালেদ বিন ওয়ালিদ (রা.) কে উপহার দিয়েছিলেন এবং খালেদ (রা.) যে সেই মহাপবিত্র চুলগুচ্ছ তার টুপির মধ্যে সেলাই করে নিয়েছিলেন এবং প্রতিটি যুদ্ধে তিনি শিরস্ত্রাণের নিচে সেই টুপি পরতেন- কই, কোনো ওয়াজে, কোনো বক্তৃতায় তো তা শুনি না। কাপড়ের তৈরি খেরকা উপহার দেয়া বেশি মেহেরবাণীর চিহ্ন না নিজের দেহের অংশ, মাথার চুল উপহার দেয়া বেশি স্নেহের, বেশি প্রেমের চিহ্ন? ওয়ায়েজরা খালেদকে (রা.) রসুলাল্লাহর চুল উপহার দেবার কথা বলেন না- বলেন ওয়ায়েস করনী (রা.) কে খেরকা উপহার দেয়ার কথা কারণ খালেদ (রা.) তার সমস্ত কিছু নিজের প্রাণ আল্লাহ ও তাঁর রসুলের (সা.) জন্য উৎসর্গ করে অস্ত্র হাতে সংগ্রাম করে গেছেন সারা জীবন।
শেষ নিশ্বাস ত্যাগের কয়েকদিন পূর্বে জনৈক ঘনিষ্ঠ বন্ধু খালিদের সঙ্গে সাক্ষাত করতে আসে। তিনি ডান পায়ের কাপড় তুলে বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি আমার পায়ে এমন এক বিঘত জায়গাও দেখতে পাও যেখানে তরবারি তীর বা বর্শার আঘাত নেই?” বন্ধু খালিদের পা পরীক্ষা করে না সূচক উত্তর দেয়। তখন খালিদ (রা.) বাম পায়ের কাপড় তুলে একই প্রশ্ন করেন এবং আবারও একই উত্তর আসে। এরপর খালিদ (রা.) প্রথমে ডান হাত ও পরে বাম হাত তুলে বন্ধুর সামনে মেলে ধরেন। বন্ধু হাত দুটি পরীক্ষা করে এবং একই অবস্থা দেখতে পায়। এবারে খালিদ (রা.) তার বিশাল বক্ষদেশ উম্মোচিত করেন। যার শক্তিশালী পেশীগুলি অসুস্থতার কারণে শিথিল হয়ে গেছে। বন্ধুটি খালিদের ক্ষত- বিক্ষত বক্ষদেশের অবস্থা দেখে বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। একজন মানুষ বুকে এতটা আঘাত পেয়েও কিভাবে বেঁচে থাকতে পারে! এ ক্ষেত্রেও সে আঘাতহীন এক বিঘত জায়গাও খুঁজে পায় না। তখন খালেদ (রা.) কাতর কণ্ঠে বলেন, “শহীদ হওয়ার জন্য আমি এক রণাঙ্গণ থেকে আরেক রণাঙ্গণে ছুটে বেড়িয়েছি। যেখানেই দেখেছি কাফেরদের ব্যুহ সবচেয়ে শক্তিশালী ও সুগঠিত সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়েছি। তবু কেন আল্লাহ আমাকে শাহাদাত দিলেন না?” এই হলো প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদীর জীবন। এই খালেদ (রা.) যাকে রসুলাল্লাহ “আল্লাহর তলোয়ার” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন তার কথা ওয়ায়েজরা উচ্চারণ করেন না, কারণ তিনি রসুলাল্লাহর যে সুন্নাহ অনুসরণ করে ‘সাইফুল্লাহ’ হয়েছিলেন তা পালন করতে গেলে বড় কষ্ট, বড় কোরবানি, বড় জানের বিপদ। ওয়ায়েসের (রা.) কথা সর্বত্র বলেন কারণ হুজরায় বসে আধ্যাত্মিক সাধনায়, নফল নামাজ, রোজায়, তসবিহ টানতে বিপদের আশঙ্কা নেই।
সাবধান! আমি ওয়ায়েস করনীকে (রা.) ছোট করার জন্য এসব বোলছি বলে কেউ মনে করবেন না। যে ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে, যে আকিদা বিকৃত হয়ে যেয়ে আজ এই জীবনব্যবস্থা পৃথিবীতে অবহেলার জিনিস হয়ে গেছে, এই জাতি আল্লাহ রসুলের (সা.) চোখে কার্যতঃ মোশরেক, কাফের হয়ে গেছে- সেই ভারসাম্য, সেই আকিদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্যই আমি লিখছি। আমি ওয়ায়েস করনীকে (রা.) ছোট করার জন্য লিখতে পারি না। কারণ যাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব, আল্লাহর রসুল (সা.) তাঁর ব্যবহৃত কাপড় উপহার দিয়েছেন তাকে কোনো রকম ছোট করা কোনো মুসলিমের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া পরবর্তীকালে এই মহা সাধক প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী হবার অর্থ কি তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই নির্জনতা ত্যাগ করে উম্মাহর বহির্মুখী জীবন প্রবাহে যোগ দিয়েছিলেন এবং অস্ত্র হাতে জেহাদে নেমে শহীদ হয়েছিলেন। অর্থাৎ এই ভারসাম্যযুক্ত জীবন-ব্যবস্থার দুটো দিকেই তিনি কামেলিয়াত, সিদ্ধিলাভ করলেন। আমি যা বলতে চেষ্টা করেছি, ওয়ায়েস করনীর (রা.) জীবন তারই দৃষ্টান্ত। কাজেই তাঁকে কি করে ছোট করতে পারি? তাঁকে ছোট করছেন ভারসাম্যহীন সুফীরা। তারাই এই জাতির কাছে তাঁকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে তাদের স্বার্থ হাসিল করছে।
এর পর জাতি দুর্ভাগ্যবশতঃ তাদের আকিদা হারিয়ে ফেলল। তারা তাদের নেতার উপর অর্পিত দায়িত্বকে ভুলে গিয়ে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে একটা শ্রেণি রাজা বাদশাহদের মতো রাজত্ব করতে শুরু করল, একটা শ্রেণি দীনের চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ করে নতুন নতুন ফতোয়া আবিষ্কার করতে শুরু করল আর একটা শ্রেণি হুজরায়-খানকায় বসে আত্মার ঘষামাজা শুরু করে দিল। কেউই আর শেষ ইসলামের সেই ওয়াসাতা বা ভারসাম্যের মধ্যে থাকলেন না। তাদের কারো কাছে দীন হয়ে গেল শুধু দুনিয়াদারী আর কারো কাছে দীন হয়ে গেল শুধুই পরকালের মুক্তির পথ। আমি এখানে আলোচনা করব সেই শ্রেণিটির সম্পর্কে যারা এই জাতির আকিদা বিকৃতির পর তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বকে ত্যাগ করে সংগ্রাম ছেড়ে তসবিহ আর বদনা নিয়ে হুজরায়-খানকায় ঢুকল। এরাই হলো সেই সুফি- সাধকের দল যাদের আকিদায় আল্লাহ ইসলাম পাঠিয়েছেন শুধুই তাদের আত্মা পরিষ্কার করানোর উদ্দেশ্যে। তারা তাদের বিকৃত আকিদায় একথা বুঝতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলেন যে, ইসলাম হলো একটা পূর্ণাঙ্গ এবং শাশ্বত জীবন- ব্যবস্থা যা মানবজীবনের জাতীয় এবং ব্যক্তিগত উভয় ভাগের জন্যই প্রযোজ্য। এটার ভারসাম্য নষ্ট করে ফেললে তা আর আল্লাহর রসুলের আনীত ইসলাম থাকবে না সেটা হয়ে যাবে অন্যান্য বিকৃত দীনের মতোই নতুন একটা দীন। শেষ ইসলামের ভারসাম্য নষ্ট করে এই সুফীর দল যাকে আদর্শ হিসাবে বেছে নিলেন তিনি বিশ্বনবী (সা.) নন, তিনি মহাসাধক ওয়ায়েস করনী (রা.), যিনি রসুলাল্লাহর (সা.) নুবয়ত পাওয়ার অনেক আগে থেকেই আত্মিক উন্নতি অর্থাৎ তাসাওয়াফের সাধনা করে অতি উচ্চ স্তরে (মাকামে) অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। শেষ প্রেরিতের নবুয়ত পাওয়ার আগে থেকেই যিনি সাধনা করছিলেন তিনি কী প্রক্রিয়ায় সাধনা করছিলেন? নিশ্চয়ই মহানবীর (সা.) শেখানো পদ্ধতিতে নয়, হয় খ্রিস্টান বা ইহুদি বা বৌদ্ধ বা হিন্দু বা অন্য যে কোনো পূর্ববর্তী ধর্মের পদ্ধতি হবে। তা সত্ত্বেও তার সাধনা যে সম্পূর্ণ সফল ছিল তার প্রমাণ তার জীবনী এবং বিশেষ করে এই যে, মহানবী (সা.) তাঁর পবিত্র জোব্বা (Robe) তাকে উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু ওয়ায়েস করনী (রা.) বিশ্বনবীর (সা.) জীবনের কর্ম প্রবাহে যোগ দেন নি, এমন কি তাঁর (সা.) সাথে তার দেখাই হয় নি। মহানবী (সা.) আল্লাহর কাছ থেকে যে মহাদায়িত্ব নিয়ে এসে এবং তা পালন করতে যে অবিশ্বাস্য দুঃখ, দুর্দশার সংগ্রামের জীবন অতিবাহিত করলেন, তাতে ওয়ায়েস করনী (রাঃ) অংশ নেন নি- মা কে ছেড়ে আসতে হয় বলে। আবু বকর (রা.) থেকে শুরু করে হাজার হাজার আসহাব তাদের শুধু মা কে ছেড়ে নয়, বাপ-মা, স্ত্রী-পুত্র, কন্যা, সম্পত্তি, বাড়ি-ঘর হেলায় ত্যাগ করে এসে মহানবীর (সা.) সঙ্গী হয়েছেন, তাঁর সঙ্গে সব রকম দুঃখ বরণ করেছেন, বছরের পর বছর ছায়াহীন উত্তপ্ত মরুভূমিতে কাটিয়েছেন, বিশ্বনবীর (সা.) দায়িত্ব পূরণের সশস্ত্র সংগ্রামে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। সুফীরা ওহোদের যুদ্ধে বিশ্বনবীর (সা.) পবিত্র দাঁত ভেঙ্গে যাওয়ার খবরে ওয়ায়েস করনীর (রা.) নিজের দাঁত ভেঙ্গে ফেলাকে ভালোবাসার চূড়ান্ত পরিচয় হিসাবে পেশ করেন। নিজের দাঁত ভেঙ্গে ফেলা বেশি ভালোবাসার পরিচয়, না প্রিয় নেতার জীবন রক্ষার জন্য তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে শত্রুর অজস্র তীর নিজেদের শরীর দিয়ে ঠেকিয়ে তীরে তীরে সজারুর মতো হয়ে যাওয়া বেশি ভালোবাসার পরিচয়? শত্রুর আক্রমণ থেকে বিশ্বনবীকে (সা.) রক্ষা করতে জীবন পণ করে যুদ্ধ করে মারাত্মক আহত হয়ে প্রাণের চেয়ে প্রিয় নেতার পবিত্র পায়ের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে মরে যাওয়া কতখানি ভালোবাসার প্রমাণ? ওহুদের যুদ্ধে রসুলাল্লাহর আনুগত্য লঙ্ঘন করার কারণে মুসলিম বাহিনীর উপর সাংঘাতিক বিপর্যয় নেমে আসে। একটি সময় মোশরেক বাহিনী রসুলাল্লাহকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেললে তিনি বললেন, “এমন কে আছ, যে আমাদের প্রতিরক্ষার জন্য জীবন কোরবানি করতে প্রস্তুত?” এ কথা শুনে পাঁচজন আনসার সাহাবী এগিয়ে এলেন এবং রসুলাল্লাহ হেফাজতের জন্য এক একজন করে লড়াই করে শহীদ হতে লাগলেন এবং রসুলাল্লাহর পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়তে লাগলেন। সর্বশেষ ব্যক্তি ছিলেন যিয়াদ বিন সাকানা (রা.)। তিনিও বীর বিক্রমে লড়াই করে গুরুতর আহত হলেন। ইতোমধ্যে আরও কয়েকজন মোজাহেদ সেখানে ফিরে এলেন এবং আহত সাহাবীর পক্ষে লড়াই করে শত্রুপক্ষকে পর্যুদস্ত করে হটিয়ে দিল। রসুলাল্লাহ আহত যিয়াদকে (রা.) দেখিয়ে বললেন, ‘ওকে আমার কাছে আনো।” তাকে আনা হলে রসুলাল্লাহ নিজ জানুর উপর তাকে মাথা রেখে শোয়ালেন। এ অবস্থাতেই উক্ত সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। আর যদি দাঁতের কথাই তুলেন তবে রসুলাল্লাহর (সা.) মাথায় ঢুকে যাওয়া শিরস্ত্রাণের পেরেক পাগলের মতো কামড়িয়ে টেনে তুলতে যেয়ে আবু ওবায়দার (রা.) কয়েকটা দাঁত ভেঙ্গে ফেলার কথা ভুলে যাচ্ছেন কেন? ঐ ওহোদের যুদ্ধেই।
লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে মাত্র যে দশজন লোককে আল্লাহর সম্পূর্ণ ক্ষমা ও জান্নাতের সুসংবাদ তাদের জীবিতকালেই দেয়া হলো আবু ওবায়দা (রা.) তাদের অন্যতম- ওয়ায়েস করনী (রা.) নন। রসুলাল্লাহর (সা.) নিজের ব্যবহৃত খেরকা (জড়নব) ওয়ায়েস করনীকে (রা.) উপহার দেওয়াও এদের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মানের চিহ্ন হিসাবে বিবেচিত। বহু বইয়ে পড়েছি, বহু ওয়াজে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শুনেছি। কিন্তু বিদায় হজ্ব্বে মাথার চুল কামিয়ে সমস্ত পবিত্র চুলটুকু যে মহানবী (সা.) আল্লাহর তলোয়ার খালেদ বিন ওয়ালিদ (রা.) কে উপহার দিয়েছিলেন এবং খালেদ (রা.) যে সেই মহাপবিত্র চুলগুচ্ছ তার টুপির মধ্যে সেলাই করে নিয়েছিলেন এবং প্রতিটি যুদ্ধে তিনি শিরস্ত্রাণের নিচে সেই টুপি পরতেন- কই, কোনো ওয়াজে, কোনো বক্তৃতায় তো তা শুনি না। কাপড়ের তৈরি খেরকা উপহার দেয়া বেশি মেহেরবাণীর চিহ্ন না নিজের দেহের অংশ, মাথার চুল উপহার দেয়া বেশি স্নেহের, বেশি প্রেমের চিহ্ন? ওয়ায়েজরা খালেদকে (রা.) রসুলাল্লাহর চুল উপহার দেবার কথা বলেন না- বলেন ওয়ায়েস করনী (রা.) কে খেরকা উপহার দেয়ার কথা কারণ খালেদ (রা.) তার সমস্ত কিছু নিজের প্রাণ আল্লাহ ও তাঁর রসুলের (সা.) জন্য উৎসর্গ করে অস্ত্র হাতে সংগ্রাম করে গেছেন সারা জীবন।
শেষ নিশ্বাস ত্যাগের কয়েকদিন পূর্বে জনৈক ঘনিষ্ঠ বন্ধু খালিদের সঙ্গে সাক্ষাত করতে আসে। তিনি ডান পায়ের কাপড় তুলে বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি আমার পায়ে এমন এক বিঘত জায়গাও দেখতে পাও যেখানে তরবারি তীর বা বর্শার আঘাত নেই?” বন্ধু খালিদের পা পরীক্ষা করে না সূচক উত্তর দেয়। তখন খালিদ (রা.) বাম পায়ের কাপড় তুলে একই প্রশ্ন করেন এবং আবারও একই উত্তর আসে। এরপর খালিদ (রা.) প্রথমে ডান হাত ও পরে বাম হাত তুলে বন্ধুর সামনে মেলে ধরেন। বন্ধু হাত দুটি পরীক্ষা করে এবং একই অবস্থা দেখতে পায়। এবারে খালিদ (রা.) তার বিশাল বক্ষদেশ উম্মোচিত করেন। যার শক্তিশালী পেশীগুলি অসুস্থতার কারণে শিথিল হয়ে গেছে। বন্ধুটি খালিদের ক্ষত- বিক্ষত বক্ষদেশের অবস্থা দেখে বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। একজন মানুষ বুকে এতটা আঘাত পেয়েও কিভাবে বেঁচে থাকতে পারে! এ ক্ষেত্রেও সে আঘাতহীন এক বিঘত জায়গাও খুঁজে পায় না। তখন খালেদ (রা.) কাতর কণ্ঠে বলেন, “শহীদ হওয়ার জন্য আমি এক রণাঙ্গণ থেকে আরেক রণাঙ্গণে ছুটে বেড়িয়েছি। যেখানেই দেখেছি কাফেরদের ব্যুহ সবচেয়ে শক্তিশালী ও সুগঠিত সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়েছি। তবু কেন আল্লাহ আমাকে শাহাদাত দিলেন না?” এই হলো প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদীর জীবন। এই খালেদ (রা.) যাকে রসুলাল্লাহ “আল্লাহর তলোয়ার” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন তার কথা ওয়ায়েজরা উচ্চারণ করেন না, কারণ তিনি রসুলাল্লাহর যে সুন্নাহ অনুসরণ করে ‘সাইফুল্লাহ’ হয়েছিলেন তা পালন করতে গেলে বড় কষ্ট, বড় কোরবানি, বড় জানের বিপদ। ওয়ায়েসের (রা.) কথা সর্বত্র বলেন কারণ হুজরায় বসে আধ্যাত্মিক সাধনায়, নফল নামাজ, রোজায়, তসবিহ টানতে বিপদের আশঙ্কা নেই।
সাবধান! আমি ওয়ায়েস করনীকে (রা.) ছোট করার জন্য এসব বোলছি বলে কেউ মনে করবেন না। যে ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে, যে আকিদা বিকৃত হয়ে যেয়ে আজ এই জীবনব্যবস্থা পৃথিবীতে অবহেলার জিনিস হয়ে গেছে, এই জাতি আল্লাহ রসুলের (সা.) চোখে কার্যতঃ মোশরেক, কাফের হয়ে গেছে- সেই ভারসাম্য, সেই আকিদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্যই আমি লিখছি। আমি ওয়ায়েস করনীকে (রা.) ছোট করার জন্য লিখতে পারি না। কারণ যাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব, আল্লাহর রসুল (সা.) তাঁর ব্যবহৃত কাপড় উপহার দিয়েছেন তাকে কোনো রকম ছোট করা কোনো মুসলিমের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া পরবর্তীকালে এই মহা সাধক প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী হবার অর্থ কি তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই নির্জনতা ত্যাগ করে উম্মাহর বহির্মুখী জীবন প্রবাহে যোগ দিয়েছিলেন এবং অস্ত্র হাতে জেহাদে নেমে শহীদ হয়েছিলেন। অর্থাৎ এই ভারসাম্যযুক্ত জীবন-ব্যবস্থার দুটো দিকেই তিনি কামেলিয়াত, সিদ্ধিলাভ করলেন। আমি যা বলতে চেষ্টা করেছি, ওয়ায়েস করনীর (রা.) জীবন তারই দৃষ্টান্ত। কাজেই তাঁকে কি করে ছোট করতে পারি? তাঁকে ছোট করছেন ভারসাম্যহীন সুফীরা। তারাই এই জাতির কাছে তাঁকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে তাদের স্বার্থ হাসিল করছে।
খানকার চার দেয়ালের অভ্যন্তরে কামেলিয়াত নেই
খানকার চার দেয়ালের অভ্যন্তরে কামেলিয়াত নেই
মসীহ উর রহমান:
আদম (আ.) থেকে শেষ নবী (সা.) পর্যন্ত আল্লাহ যুগে যুগে তওহীদভিত্তিক দীনগুলো পাঠিয়েছেন একটা ভারসাম্য দিয়ে। প্রত্যেকটিতে একদিকে যেমন মানুষের জন্য রাজনীতিক ও আর্থ-সামাজিক বিধান রয়েছে-তেমনি তার আত্মার উন্নতির প্রক্রিয়াও রয়েছে। দু’দিকেই সমান এবং একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটা একেবারে অচল। মানুষ যেমন দুপায়ে চলে, এক পায়ে চলতে পারে না, দীনও একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটা একা চলতে পারে না। কাজেই ইসলামেও তাসাওয়াফের গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। কিন্তু সেই তাসাওয়াফ কোন তাসাওয়াফ? বর্তমানে তাসাওয়াফের যে রূপ আমরা দেখে থাকি সেটা ইসলামের তাসাওয়াফ নয়। আত্মার উন্নতির প্রক্রিয়া পূর্ববর্তী সমস্ত দীনেই ছিল, বিকৃত অবস্থায় আজও আছে এবং ঐ পূর্ববর্তী ধর্মগুলোর প্রক্রিয়ায় সাধনা করলে আজও ফল পাওয়া যায়। আজও অন্যান্য ধর্মে অতি শক্তিশালী মহা সাধকরা আছেন যাদের কেরামত অলৌকিক ক্ষমতা মুসলিম ওলী, আওলিয়াদের চেয়ে কম নয়। যে কেউ-ই নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় সাধনা করলে তার ফল পাবে, তার আত্মার শক্তি বৃদ্ধি পাবে, অদৃশ্যের, গায়েবের অনেক খবর তার কাছে আসবে, সাধারণ মানুষ যা পারে না তেমন কাজ করার ক্ষমতা জন্মাবে, এক কথায় তাসাওয়াফের বই-কেতাবে যে সব উন্নতির কথা লেখা আছে সবই হবে। কিন্তু এগুলি শেখাতে বিশ্বনবী (সা.) আসেন নি। এই উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুফী ও আলেম, হাকীম-আল-উম্মাহ আশরাফ আলী থানভী (র.) লিখেছেন- “মানব শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যেমন জাহিরী (প্রকাশ্য) শক্তি রহিয়াছে। সেইরূপে মানুষের রূহের (আত্মার) মধ্যে অনেক বাতেনী (গুপ্ত) শক্তি নিহিত আছে। শরীর চর্চার মাধ্যমে যেমন মানুষের অঙ্গ-প্রতঙ্গ শক্তিশালী হইয়া উঠে, তদ্রƒপ আধ্যাত্মিক সাধনার দ্বারা তাহাদের রূহানী শক্তি বৃদ্ধি পায় (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ- ইসলামিক ফাউণ্ডেশন-১ম খণ্ড ৭৬ পৃঃ)। আশরাফ আলী থানভী প্রকৃত সত্য কথা লিখেছেন এবং সে সাধনার কথা লিখেছেন যে সাধনার প্রক্রিয়া প্রতিটি ধর্মেই আছে। কিন্তু শুধু এই প্রক্রিয়া শেখাতে শেষনবী (সা.) আসেন নি। কাজেই ইসলামের প্রকৃত তাসাওয়াফ জানা আমাদের একান্ত প্রয়োজন। ইসলামে তাসাওয়াফ হচ্ছে যখনই কোনো কাজ করা হবে তখন মনে রাখতে হবে এই কাজটি আল্লাহর অনুমোদিত কিনা, যদি আল্লাহ ও রসুলের অনুমোদিত হয়ে থাকে তাহলে সেটা করা আর যদি আল্লাহ রসুলের নিষিদ্ধ হয়ে থাকে সেটা না করা। অর্থাৎ কাজটি করা অথবা না করা এবং সেটা হবে আল্লাহর আদেশ বা নিষেধ মোতাবেক। হুকুম দেয়ার একমাত্র অধিকারী আল্লাহ কারণ সার্বভৌমত্ব হলো আল্লাহর। রসুলের কথা বলার কারণ রসুল আল্লাহর হুকুমের বাহিরে হুকুম দিতে পারেন না (সুরা হাক্কা- ৪৬, সুরা নজম ৩-৪)। আল্লাহর হুকুমের কোনটার কি মানে সেটা হলো রসুলের জীবনীতে অর্থাৎ রসুলের কথায়। সুতরাং ইসলামের আধ্যাত্মিকতার শুরু হলো এখান থেকে। এটা করতে করতে কে কত উচ্চে উঠতে পারে, নিখুঁত হতে পারে সেটা যার যার আমল। এটাকেই আল্লাহ বলেছেন আমার যেকর, সকাল সন্ধ্যা তাঁর যেকর এ রত থাকা (সুরা আল আহযাব-৪১, ৪২)। অন্যভাবে বলা যায় তাকওয়া। জান্নাতে স্তর নির্ধারিত হবে এই তাকওয়া বা যেকরের উপর নির্ভর করে। বর্তমানে আধ্যাত্মিকতার নামে যে সূফিবাদ চালু আছে সেটা আল্লাহ ও রসুলের নয়। মুমিনদের মধ্যে যিনি আল্লাহর হুকুমের ব্যাপারে যত সচেতন, যত বেশি মোত্তাকী তিনি তত বড় আধ্যাত্মিক সাধক। গাছের নিচে, ঝোপ ঝাড়ে বসে, গুহায়, খানকায় বসে অধ্যাত্ম অর্জন শেষ ইসলামের অধ্যাত্ম নয়। আজকের আধ্যাত্মিক সাধকদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ষড় রিপুকে দমন করে আত্মার উন্নতি সাধন। এখানে ষড়রিপু সম্পর্কে দুইটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। প্রথম ধরুন ‘লোভ’। লোভ হলো মানুষের ষড়রিপুর একটি রিপু। লোভ মানুষকে হীন পশুতে পরিণত করে দিতে পারে। একজন সাধক চোখ বন্ধ করে, না খেয়ে, আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যেমন হয়তো সে ৫০ বছরে কেবল লোভ থেকে মুক্ত হলো (যদিও আদৌ ১০০% সম্ভব কিনা তা যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে)। অন্যদিকে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের ডাক যখন আসে একজন মুমিন মুজাহিদ সঙ্গে সঙ্গে তার বাড়ি, ঘর, সহায় সম্পত্তি, আত্মীয় পরিজন, বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তান সব কিছুর মায়া ত্যাগ করে জিহাদে অংশগ্রহণ করে, অতঃপর সেখানে অবশেষে নিজের জানটুকু পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় কোরবান করে শহীদ হয়ে যায়। তাহলে লোভ থেকে, মোহ থেকে, ক্রোধ থেকে, ভোগের বাসনা থেকে ১০০% মুক্ত হয়ে গেল, কামেলিয়াত অর্জন কোরল, নিশ্চয় ঐ মুজাহিদ। একজন মুজাহিদ জিহাদ করে প্রথমত মানবজাতির কল্যাণের জন্য, আল্লাহকে বিজয়ী করার জন্য, পক্ষান্তরে সাধু, ফকীর, দরবেশ জুহুদ বা আত্মিক সাধনা করে একান্তই নিজের জন্য, স্বীয় আত্মিক পরিতৃপ্তি ও পরিশুদ্ধির জন্য। প্রশ্ন হলো বছরের পর বছর ধরে যে সাধক জুহুদ করে অর্থাৎ সাধনা করে একটা একটা করে রিপু জয় করতে চেষ্টা করল কিন্তু কোনটা থেকেই হয়তো পুরোপুরি মুক্ত হতে পারলনা সেখানে একজন মুজাহিদ কিভাবে সমস্ত কিছু বিসর্জন দেওয়ার মাধ্যমে একসঙ্গে সকল ষড়রিপু থেকে পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে সর্বোচ্চ কামেলিয়াত হাসিল করল। এর সহজ উত্তর, এটা মহান আল্লাহ করে দিয়েছেন কারণ সে আল্লাহকে বিজয়ী করার জন্য আত্মনিয়োগ করেছে। এখানে একটা কথা প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, এই সুন্দর পৃথিবী আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন বনী আদমের জন্য, বনী আদম আল্লাহর খেলাফত করবে, এখানে তারা শান্তিতে থাকবে, দুনিয়ার আলো বাতাস, খাদ্য পানীয় ইত্যাদি ভোগ করবে, বংশ বৃদ্ধি করবে, দুনিয়া চাষাবাদ করবে এটাই হলো স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষ যদি কাম প্রবৃত্তি দমন করতে থাকে, পাহাড়ে জঙ্গলে বসে সংসার না করে জীবন অতিবাহিত করে তাহলে মানবজাতি একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আজকের তাসাওয়াফ চর্চাকারীদের প্রতি কয়েকটি প্রশ্ন এখানে প্রাসঙ্গিক: ক) যদি নারী পুরুষ বৈবাহিক জীবন যাপন না করে তাহলে আল্লাহ নারীদের সৃষ্টি করলেন কেন? খ) বনী আদমের বংশ বৃদ্ধি হবে কিভাবে, আল্লাহর খেলাফত কে করবে? গ) সমস্ত মানবজাতির পক্ষে কি এসব তরিকা অবলম্বন করা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয় তবে তা সার্বজনীন নয়। আর যা সার্বজনীন নয় তা ইসলাম হতে পারে না। ঘ) তাছাড়া আল্লাহর রসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের উপর তোমাদের নফ্সের হক রয়েছে। নফল সওম রাখো এবং তা থেকে বিরত থাকো। রাতের বেলা তাহাজ্জুদের সালাহ কায়েম করো এবং ঘুমাও। আমি তাহাজ্জুদের সালাহ কায়েম করি এবং ঘুমাইও। কোনো কোনো সময় সওম রাখি। আবার কোনো কোনো সময় সওম ত্যাগও করি। গোশত খাই, চর্বিও খেয়ে থাকি। স্ত্রীদের নিকটও যাই। যে আমার সুন্নাহ ত্যাগ করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ শরীরকে বঞ্চিত করাকে তিনি জুলুম বা অন্যায় বলে আখ্যায়িত করেছেন। সুতরাং এই কথা পরিষ্কার যে, ইসলামের অধ্যাত্মবাদ হলো প্রত্যেক কাজে আল্লাহর উপস্থিতি গণ্য করা অর্থাৎ এটা মনে করা যে আমার এই কাজ আল্লাহ দেখছেন এবং আল্লাহর আদেশ নিষেধ অনুযায়ী সেই কাজ করা বা না করা। যে এটা যত বেশি স্মরণে রেখে জীবন অতিবাহিত করল সে তত বড় কামেল, তত বড় মোত্তাকী। এই হলো প্রকৃত ইসলামের তাসাওয়াফের সাথে বর্তমানের বিকৃত এবং ইসলাম বিবর্জিত তাসাওয়াফের পার্থক্য।
Sunday, June 28, 2015
যে প্রশ্নের উত্তর জানতেই হবে
যে প্রশ্নের উত্তর জানতেই হবে
এই পৃথিবী অপরূপ সুন্দর। পৃথিবীর আকাশ, বাতাস, নদী, নালা, পাহাড় সমস্ত কিছুকে মহান আল্লাহ নিজ পরিকল্পনায় সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছেন মানুষের জন্য। জন্ম থেকে মানুষ তার চাহিদা অনুযায়ী এই পৃথিবীকে উপভোগ করতে থাকে এবং একপর্যায়ে তাদের ভাবে ভঙ্গিতে মনে হয় যেন এটাই তার জীবন, এটাই তার সবকিছু। কিন্তু তার এই চেতনাকে ভুল প্রমাণ করে একদিন তাকে চলে যেতে হয় এই পৃথিবী ছেড়ে। ‘প্রত্যেক আত্মাকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’- এটাই সৃষ্টির অমোঘ নিয়ম। আর মৃত্যুর পরেই কবর জগতে সকল মানুষকে মুখোমুখি হতে হয় তিনটি প্রশ্নের। একটি কথা এখানে প্রাসঙ্গিক, তা হলো- কবর জগত বলতে কেবল সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরটিকে বোঝানো হয় না। মৃত্যুর পর থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত মানুষের যে সময়টি অতিবাহিত হয়, এ সময়কে বলা হয় ‘আলমে বরযখ’, সাধারণভাবে বোঝানোর জন্য এ সময়টিকেই আমরা কবর জগত বলে থাকি কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা কবর ছাড়াও প্রশ্নোত্তর হতে পারে। যেমন সনাতন ধর্মের অনুসারীদের শরীর মৃত্যুর পর ভষ্মীভূত করে ফেলা হয়, তাদের কবর দেওয়া হয় না। তাহলে কি তারা এই প্রশ্নোত্তর থেকে রেহাই পাবেন? বিষয়টি আসলে তেমন নয়। এসলামের বিষয়ে যাদের ন্যূনতম জ্ঞান আছে তারাও জানেন যে, মৃত্যুর পর প্রতিটি ব্যক্তিকে তিনটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হবে। এ সম্পর্কিত হাদিসটি উল্লেখ করছি তাহলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে:
বারা বিন আযিব (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমরা রসুলের সাথে একটি জানাজায় অংশ গ্রহণ করেছি। সেখানে রসুলাল্লাহ বলেছিলেন : তার (কবরবাসীর) নিকট দু’জন মালায়েক আসবে, তারা তাকে বসিয়ে বলবে: তোমার রব কে? সে বলবে, ‘আমার রব, আল্লাহ’। তারা বলবে: তোমার দীন কী? সে বলবে: আমার দীন হচ্ছে, ‘এসলাম’। তারা বলবে: এই যে ইনি! তোমাদের নিকট পাঠানো হয়েছিল, তাঁর পরিচয় কী? সে বলবে: ইনি আল্লাহর রসুল (মুসনাদে আহমদ ও আবু দাউদ)। কোন কোন বর্ণনায় পাওয়া যায়, প্রশ্ন তিনটি হলো যথাক্রমে (১) মান রাব্বুকা (তোমার প্রতিপালক কে)? (২) ওয়া মান দীনুকা (তোমার জীবনব্যবস্থা কী ছিল)? (৩) ওয়া মান নাবীয়্যুকা (তোমার নবী কে)?
আমাদের সমাজের মোসলেম দাবিদারগণ জীবনের শেষ পর্যায়ে বৃদ্ধকালে এসে এই তিনটি প্রশ্ন উত্তরসহ প্রায়ই মুখস্ত করা ছাড়াও বার বার মুখে আবৃত্তি করেন যাতে কবরে সঠিক উত্তর দিয়ে পার পেতে পারেন। কিন্তু তারা এই সহজ সত্যটুকু বুঝতে পারেন না যে, দুনিয়াতে তার আমলগুলিই এ তিনটি প্রশ্নের উত্তর হিসাবে যথেষ্ট। অর্থাৎ দুনিয়ার জীবনে তারা যাকে প্রতিপালক হিসাবে গ্রহণ করেছে, যে যেই জীবনব্যবস্থার উপর দুনিয়ার জীবন পরিচালিত করছে এবং যে যার আদর্শ মোতাবেক নিজেকে সাজিয়েছে সেগুলিই সেখানে উত্তর হিসাবে সে উচ্চারণ করবে, দুনিয়ার মুখস্তবিদ্যা ওখানে কোন কাজে আসবে না।
এই প্রশ্ন এবং উত্তরগুলোর বিষয়েই সংক্ষিপ্ত আকারে কিছুটা পর্যালোচনা করব।
প্রথম প্রশ্নঃ তোমার রব কে? এখানে ‘রব’ বলতে শুধু প্রতিপালক বোঝায় না। কারণ, মক্কার মোশরেকরাও আল্লাহকে ‘রব’ হিসেবে মানতো। মক্কার মোশরেকদের যদি জিজ্ঞাসা করা হতো, বলতো, তোমাদের কে সৃষ্টি করেছেন, এই আকাশ-জমিন কে সৃষ্টি করেছেন, আশ্রয় দেয়ার মালিক কে, কার হাতে সকল কিছুর কর্তৃত্ব, এই প্রশ্নগুলোর জবাবে তারা বলতো, ‘আল্লাহ’। আল্লাহ বলেন: তাদেরকে প্রশ্ন করো, ‘কে সাত আসমানের রব এবং মহা আরশের রব’? তারা বলবে, ‘আল্লাহ।’ (সুরা মুমিনূনঃ ৮৪-৮৯)। সুতরাং আজ আমরা আল্লাহকে যেভাবে রব বলে ঈমান পোষণ করি সেটুকু ঈমান মক্কার মোশরেক-কাফেরদেরও ছিল। এই ঈমান আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য বা যথেষ্ট হলে আর নতুন করে নবী পাঠানোর কি প্রয়োজন ছিল? প্রকৃতপক্ষে ‘রব’ শব্দের অর্থ অনেক বিস্তৃত এবং এর প্রধান অর্থ হচ্ছে প্রভু। অর্থাৎ মানুষটি তার জীবনে কার হুকুমের দাসত্ব করেছে, কাকে নিজের সর্বময় কর্তৃত্বকারী সত্ত্বা বা প্রভু বলে মেনেছে সেটাই জানতে চাওয়া হচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আল্লাহর রসুল তাঁর দাজ্জাল সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণীগুলিতে মানবজাতির প্রতি দাজ্জালের একমাত্র দাবি কি হবে তা জানিয়ে দিয়েছেন, সেটা হলো দাজ্জাল নিজেকে মানবজাতির রব হিসাবে দাবি করবে, মা’বুদ বা স্রষ্টা হিসাবে নয়। বর্তমানে কথিত মোসলেম জনসংখ্যাটিসহ সমগ্র মানবজাতি দাজ্জাল অর্থাৎ ইহুদি খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’কে তাদের ‘রব’, প্রভু বলে মেনে নিয়ে জীবনের সর্বাঙ্গনে তার সাজদায় পড়ে আছে। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, তওহীদ অস্বীকার করে পাশ্চাত্য সভ্যতাকে সার্বভৌমের আসনে বসিয়ে রেখেছে। সুতরাং কবরে গিয়ে মালায়েকদের প্রশ্নের উত্তরে ইহুদি খ্রিস্টান সভ্যতাকে নিজেদের রব না বলে কোন উপায় থাকবে না। বর্তমানে মোসলেম দাবিদার জনসংখ্যাটিসহ সমগ্র মানবজাতিই দাজ্জালের অর্থাৎ ইহুদি খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’র অঙ্গুলিহেলনে পরিচালিত হচ্ছে। তারা পশ্চিমা প্রভু-জাতিগুলিকে নিজেদের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের সোপান ও নিয়ামক বলে বিশ্বাস করে থাকে। প্রভুদের কৃপা পেলে ধন্য হয়ে যায়, সর্বত্র সেই কৃপার দানকে গৌরবের সঙ্গে প্রচার করতে থাকে। এই ভিক্ষাবৃত্তি করেও তারা কোনরূপ লজ্জিত বোধ করে না। নিজেদের দেশের বাজেট করার আগে প্রভুদের দেশে গিয়ে করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অনুদান না পেলে অনাহারে, অশিক্ষায় ধুঁকে মরে। বিদেশীদের দান নিয়ে সরকারগুলি একে অপরের সঙ্গে বিদঘুটে লবিং প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। পৃথিবীর জীবনে ইহুদি খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’র এমন হীন গোলামিতে লিপ্ত থেকেও এ জাতি বিশ্বাস করে যে তারা আল্লাহকেই রব মেনে চলেছে।
দ্বিতীয় প্রশ্নঃ তারা বলবে: তোমার দীন কি? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ঐ সকল ব্যক্তিরা ব্যর্থ হয়ে যাবে যারা এসলামকে নিজের ‘দীন’ তথা ‘জীবনব্যবস্থা’ হিসেবে গ্রহণ করে নি। বর্তমানের এই তথাকথিত মোসলেম জনগোষ্ঠী ইহুদি খ্রিস্টানদের তৈরি বিভিন্ন মতবাদ ও তন্ত্রমন্ত্র যেমন গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ, সাম্যবাদ ইত্যাদি দিয়ে নিজেদের জীবন পরিচালনা করছে। মালায়েকদের প্রশ্নের জবাবে এরা যে যেই ব্যবস্থা মেনে নিয়ে জীবন পরিচালিত করেছেন, সেই অনুযায়ী উত্তর দিবেন। যেমন কেউ বলবেন, আমার দীন গণতন্ত্র, কেউ বলবেন সমাজতন্ত্র, কেউ বলবেন একনায়কতন্ত্র, কেউ বলবেন রাজতন্ত্র ইত্যাদি।
তৃতীয় প্রশ্নঃ তারা বলবে: এই যে ইনি! তোমাদের নিকট পাঠানো হয়েছিল, তাঁর পরিচয় কি? বা তোমার নবী কে? ‘তোমার নবী কে’ বলতে তোমরা তোমাদের জীবনে কার প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করেছ বা তার নেতা কে ছিল তা জানতে চাওয়া হচ্ছে। বাস্তব জীবনে মানুষ যে মতাদর্শে বিশ্বাসী, সেই মতবাদের প্রবক্তা ও নেতৃবৃন্দকে তার জীবনাদর্শ বলে মেনে চলেছে। রসুলাল্লাহ বলেছেন: “তোমাদের মাঝে কেউ ঐ পর্যন্ত মো’মেন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তার প্রবৃত্তি আমি যা নিয়ে এসেছি তার অনুসারী না হবে।” সুতরাং যারা তাদের জীবনে রসুলাল্লাহর কর্মপন্থা বা সুন্নাহ অনুসরণ করবে না তারা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হবে। তাই তারা যখন মৃত্যুর পর এই প্রশ্নের সম্মুখীন হবে তখন ঐ মতবাদগুলির প্রবক্তা ও নেতাদের নামই উল্লেখ করতে বাধ্য হবে। এ প্রশ্নের উত্তরে গণতন্ত্রীরা আব্রাহাম লিংকন বা গণতন্ত্রের অপর কোন পুরোধা ব্যক্তির নাম বলবেন।’ আর সমাজতন্ত্রীরা বলবেন, “আমার নবী কাল মার্কস অথবা ফ্রেডরিখ এ্যাঙ্গেলস’। যারা রাজতন্ত্রকে মেনে নিয়েছে তাদের উত্তর হবে ‘আমার নবী অমুক রাজা।’ যারা একনায়কতন্ত্রকে মেনে নিয়েছে তারা বলবে ‘আমার দীন একনায়কতন্ত্র এবং আমার নবী অমুক একনায়ক’ ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ দুনিয়াতে যে যাকে আদর্শ হিসাবে মেনে চলেছেন ওপারে তার নামই আপনাকে উচ্চারণ করতে হবে। আপনি তখন আল্লাহর রসুলকে দেখে চিনতে পারবেন না, কারণ আপনার জীবন তাঁর আদর্শে পরিচালিত হয় নি।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, মৃত্যুর পর মানুষ যে তিনটি প্রশ্নের সম্মুখীন হবে তার একটিরও সঠিক জবাব এই পথভ্রষ্ঠ মোসলেম জনসংখ্যার কাছে নেই। এমনকি যারা দীনুল হক কায়েম করার সংগ্রামে লিপ্ত, তারাও যদি দীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আল্লাহর রসুলের প্রদর্শিত পন্থা অনুসরণ না করে জনসভা, অনশন, ঘেরাও, মানববন্ধন, মিছিল, লংমার্চ জাতীয় তাগুত প্রদর্শিত পদ্ধতি অবলম্বন করেন তারাও রসুলের সুন্নাহ অনুসরণ করছেন না, করছেন তাগুতের সুন্নাহ বা পদ্ধতি। তাদের সকলকেই এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে হলে আল্লাহর নিজের রচিত, রসুলের রেখে যাওয়া পাঁচ দফার পবিত্র কর্মসূচিটি অনুসরণ করতে হবে অর্থাৎ যামানার এমামকে এমাম হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর নেতৃত্বে দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে হবে।
সুতরাং আজকে আমাদের উচিৎ এমন একটা জীবনব্যবস্থা বা সিস্টেমের উপর জীবন পরিচালিত করা যে সিস্টেমের রব ‘আল্লাহ’, যে সিস্টেমের জীবনব্যবস্থা ‘এসলাম’ এবং যে সিস্টেমের আদর্শ ‘মোহাম্মদ সঃ।’ তবেই আমরা কবরে সঠিক উত্তর দিতে পারবো। নতুবা দুনিয়াতে যেমন অন্যায়, অশান্তি, জুলুম নির্যাতন, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, হীনতা, গোলামি করে যাচ্ছি, কবরেও জুটবে কঠিন শাস্তি এবং পুনরুত্থানের পরে আবার স্থায়ী জাহান্নাম।
বারা বিন আযিব (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমরা রসুলের সাথে একটি জানাজায় অংশ গ্রহণ করেছি। সেখানে রসুলাল্লাহ বলেছিলেন : তার (কবরবাসীর) নিকট দু’জন মালায়েক আসবে, তারা তাকে বসিয়ে বলবে: তোমার রব কে? সে বলবে, ‘আমার রব, আল্লাহ’। তারা বলবে: তোমার দীন কী? সে বলবে: আমার দীন হচ্ছে, ‘এসলাম’। তারা বলবে: এই যে ইনি! তোমাদের নিকট পাঠানো হয়েছিল, তাঁর পরিচয় কী? সে বলবে: ইনি আল্লাহর রসুল (মুসনাদে আহমদ ও আবু দাউদ)। কোন কোন বর্ণনায় পাওয়া যায়, প্রশ্ন তিনটি হলো যথাক্রমে (১) মান রাব্বুকা (তোমার প্রতিপালক কে)? (২) ওয়া মান দীনুকা (তোমার জীবনব্যবস্থা কী ছিল)? (৩) ওয়া মান নাবীয়্যুকা (তোমার নবী কে)?
আমাদের সমাজের মোসলেম দাবিদারগণ জীবনের শেষ পর্যায়ে বৃদ্ধকালে এসে এই তিনটি প্রশ্ন উত্তরসহ প্রায়ই মুখস্ত করা ছাড়াও বার বার মুখে আবৃত্তি করেন যাতে কবরে সঠিক উত্তর দিয়ে পার পেতে পারেন। কিন্তু তারা এই সহজ সত্যটুকু বুঝতে পারেন না যে, দুনিয়াতে তার আমলগুলিই এ তিনটি প্রশ্নের উত্তর হিসাবে যথেষ্ট। অর্থাৎ দুনিয়ার জীবনে তারা যাকে প্রতিপালক হিসাবে গ্রহণ করেছে, যে যেই জীবনব্যবস্থার উপর দুনিয়ার জীবন পরিচালিত করছে এবং যে যার আদর্শ মোতাবেক নিজেকে সাজিয়েছে সেগুলিই সেখানে উত্তর হিসাবে সে উচ্চারণ করবে, দুনিয়ার মুখস্তবিদ্যা ওখানে কোন কাজে আসবে না।
এই প্রশ্ন এবং উত্তরগুলোর বিষয়েই সংক্ষিপ্ত আকারে কিছুটা পর্যালোচনা করব।
প্রথম প্রশ্নঃ তোমার রব কে? এখানে ‘রব’ বলতে শুধু প্রতিপালক বোঝায় না। কারণ, মক্কার মোশরেকরাও আল্লাহকে ‘রব’ হিসেবে মানতো। মক্কার মোশরেকদের যদি জিজ্ঞাসা করা হতো, বলতো, তোমাদের কে সৃষ্টি করেছেন, এই আকাশ-জমিন কে সৃষ্টি করেছেন, আশ্রয় দেয়ার মালিক কে, কার হাতে সকল কিছুর কর্তৃত্ব, এই প্রশ্নগুলোর জবাবে তারা বলতো, ‘আল্লাহ’। আল্লাহ বলেন: তাদেরকে প্রশ্ন করো, ‘কে সাত আসমানের রব এবং মহা আরশের রব’? তারা বলবে, ‘আল্লাহ।’ (সুরা মুমিনূনঃ ৮৪-৮৯)। সুতরাং আজ আমরা আল্লাহকে যেভাবে রব বলে ঈমান পোষণ করি সেটুকু ঈমান মক্কার মোশরেক-কাফেরদেরও ছিল। এই ঈমান আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য বা যথেষ্ট হলে আর নতুন করে নবী পাঠানোর কি প্রয়োজন ছিল? প্রকৃতপক্ষে ‘রব’ শব্দের অর্থ অনেক বিস্তৃত এবং এর প্রধান অর্থ হচ্ছে প্রভু। অর্থাৎ মানুষটি তার জীবনে কার হুকুমের দাসত্ব করেছে, কাকে নিজের সর্বময় কর্তৃত্বকারী সত্ত্বা বা প্রভু বলে মেনেছে সেটাই জানতে চাওয়া হচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আল্লাহর রসুল তাঁর দাজ্জাল সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণীগুলিতে মানবজাতির প্রতি দাজ্জালের একমাত্র দাবি কি হবে তা জানিয়ে দিয়েছেন, সেটা হলো দাজ্জাল নিজেকে মানবজাতির রব হিসাবে দাবি করবে, মা’বুদ বা স্রষ্টা হিসাবে নয়। বর্তমানে কথিত মোসলেম জনসংখ্যাটিসহ সমগ্র মানবজাতি দাজ্জাল অর্থাৎ ইহুদি খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’কে তাদের ‘রব’, প্রভু বলে মেনে নিয়ে জীবনের সর্বাঙ্গনে তার সাজদায় পড়ে আছে। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, তওহীদ অস্বীকার করে পাশ্চাত্য সভ্যতাকে সার্বভৌমের আসনে বসিয়ে রেখেছে। সুতরাং কবরে গিয়ে মালায়েকদের প্রশ্নের উত্তরে ইহুদি খ্রিস্টান সভ্যতাকে নিজেদের রব না বলে কোন উপায় থাকবে না। বর্তমানে মোসলেম দাবিদার জনসংখ্যাটিসহ সমগ্র মানবজাতিই দাজ্জালের অর্থাৎ ইহুদি খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’র অঙ্গুলিহেলনে পরিচালিত হচ্ছে। তারা পশ্চিমা প্রভু-জাতিগুলিকে নিজেদের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের সোপান ও নিয়ামক বলে বিশ্বাস করে থাকে। প্রভুদের কৃপা পেলে ধন্য হয়ে যায়, সর্বত্র সেই কৃপার দানকে গৌরবের সঙ্গে প্রচার করতে থাকে। এই ভিক্ষাবৃত্তি করেও তারা কোনরূপ লজ্জিত বোধ করে না। নিজেদের দেশের বাজেট করার আগে প্রভুদের দেশে গিয়ে করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অনুদান না পেলে অনাহারে, অশিক্ষায় ধুঁকে মরে। বিদেশীদের দান নিয়ে সরকারগুলি একে অপরের সঙ্গে বিদঘুটে লবিং প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। পৃথিবীর জীবনে ইহুদি খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’র এমন হীন গোলামিতে লিপ্ত থেকেও এ জাতি বিশ্বাস করে যে তারা আল্লাহকেই রব মেনে চলেছে।
দ্বিতীয় প্রশ্নঃ তারা বলবে: তোমার দীন কি? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ঐ সকল ব্যক্তিরা ব্যর্থ হয়ে যাবে যারা এসলামকে নিজের ‘দীন’ তথা ‘জীবনব্যবস্থা’ হিসেবে গ্রহণ করে নি। বর্তমানের এই তথাকথিত মোসলেম জনগোষ্ঠী ইহুদি খ্রিস্টানদের তৈরি বিভিন্ন মতবাদ ও তন্ত্রমন্ত্র যেমন গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ, সাম্যবাদ ইত্যাদি দিয়ে নিজেদের জীবন পরিচালনা করছে। মালায়েকদের প্রশ্নের জবাবে এরা যে যেই ব্যবস্থা মেনে নিয়ে জীবন পরিচালিত করেছেন, সেই অনুযায়ী উত্তর দিবেন। যেমন কেউ বলবেন, আমার দীন গণতন্ত্র, কেউ বলবেন সমাজতন্ত্র, কেউ বলবেন একনায়কতন্ত্র, কেউ বলবেন রাজতন্ত্র ইত্যাদি।
তৃতীয় প্রশ্নঃ তারা বলবে: এই যে ইনি! তোমাদের নিকট পাঠানো হয়েছিল, তাঁর পরিচয় কি? বা তোমার নবী কে? ‘তোমার নবী কে’ বলতে তোমরা তোমাদের জীবনে কার প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করেছ বা তার নেতা কে ছিল তা জানতে চাওয়া হচ্ছে। বাস্তব জীবনে মানুষ যে মতাদর্শে বিশ্বাসী, সেই মতবাদের প্রবক্তা ও নেতৃবৃন্দকে তার জীবনাদর্শ বলে মেনে চলেছে। রসুলাল্লাহ বলেছেন: “তোমাদের মাঝে কেউ ঐ পর্যন্ত মো’মেন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তার প্রবৃত্তি আমি যা নিয়ে এসেছি তার অনুসারী না হবে।” সুতরাং যারা তাদের জীবনে রসুলাল্লাহর কর্মপন্থা বা সুন্নাহ অনুসরণ করবে না তারা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হবে। তাই তারা যখন মৃত্যুর পর এই প্রশ্নের সম্মুখীন হবে তখন ঐ মতবাদগুলির প্রবক্তা ও নেতাদের নামই উল্লেখ করতে বাধ্য হবে। এ প্রশ্নের উত্তরে গণতন্ত্রীরা আব্রাহাম লিংকন বা গণতন্ত্রের অপর কোন পুরোধা ব্যক্তির নাম বলবেন।’ আর সমাজতন্ত্রীরা বলবেন, “আমার নবী কাল মার্কস অথবা ফ্রেডরিখ এ্যাঙ্গেলস’। যারা রাজতন্ত্রকে মেনে নিয়েছে তাদের উত্তর হবে ‘আমার নবী অমুক রাজা।’ যারা একনায়কতন্ত্রকে মেনে নিয়েছে তারা বলবে ‘আমার দীন একনায়কতন্ত্র এবং আমার নবী অমুক একনায়ক’ ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ দুনিয়াতে যে যাকে আদর্শ হিসাবে মেনে চলেছেন ওপারে তার নামই আপনাকে উচ্চারণ করতে হবে। আপনি তখন আল্লাহর রসুলকে দেখে চিনতে পারবেন না, কারণ আপনার জীবন তাঁর আদর্শে পরিচালিত হয় নি।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, মৃত্যুর পর মানুষ যে তিনটি প্রশ্নের সম্মুখীন হবে তার একটিরও সঠিক জবাব এই পথভ্রষ্ঠ মোসলেম জনসংখ্যার কাছে নেই। এমনকি যারা দীনুল হক কায়েম করার সংগ্রামে লিপ্ত, তারাও যদি দীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আল্লাহর রসুলের প্রদর্শিত পন্থা অনুসরণ না করে জনসভা, অনশন, ঘেরাও, মানববন্ধন, মিছিল, লংমার্চ জাতীয় তাগুত প্রদর্শিত পদ্ধতি অবলম্বন করেন তারাও রসুলের সুন্নাহ অনুসরণ করছেন না, করছেন তাগুতের সুন্নাহ বা পদ্ধতি। তাদের সকলকেই এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে হলে আল্লাহর নিজের রচিত, রসুলের রেখে যাওয়া পাঁচ দফার পবিত্র কর্মসূচিটি অনুসরণ করতে হবে অর্থাৎ যামানার এমামকে এমাম হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর নেতৃত্বে দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে হবে।
সুতরাং আজকে আমাদের উচিৎ এমন একটা জীবনব্যবস্থা বা সিস্টেমের উপর জীবন পরিচালিত করা যে সিস্টেমের রব ‘আল্লাহ’, যে সিস্টেমের জীবনব্যবস্থা ‘এসলাম’ এবং যে সিস্টেমের আদর্শ ‘মোহাম্মদ সঃ।’ তবেই আমরা কবরে সঠিক উত্তর দিতে পারবো। নতুবা দুনিয়াতে যেমন অন্যায়, অশান্তি, জুলুম নির্যাতন, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, হীনতা, গোলামি করে যাচ্ছি, কবরেও জুটবে কঠিন শাস্তি এবং পুনরুত্থানের পরে আবার স্থায়ী জাহান্নাম।
বিশ্বকবির ঐক্যভাবনা: “মূল ধর্ম এক বটে, বিভিন্ন আধার”
বিশ্বকবির ঐক্যভাবনা: “মূল ধর্ম এক বটে, বিভিন্ন আধার”
কবিগুরু তার প্রথম জীবনে দেশে ইংরেজরা যেধ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়েছিল, সেই পরিবেশ দ্বারা কিছুটা প্রভাবিত হয়েছিলেন। প্রতিটি মানুষই পরিবেশ দ্বারা কম-বেশি প্রভাবিত হয়, এটা সরল সত্য। কিন্তু যারা অসাধারণ তারা আত্মবলে বলীয়ান হয়ে একটা সময়ে পরিবেশকেও প্রভাবিত করতে সক্ষম হন। রবীন্দ্রনাথের বেলায় এই কথাটি প্রযোজ্য। তিনিও সত্ত্বর পরিবেশ থেকে পাওয়া সাম্প্রদায়িকতার কুপ্রভাব কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন এবং হিন্দু-মোসলেম নির্বিশেষে ভারতবাসীকে দাস বানিয়ে রাখার জন্য ইংরেজদের সাম্প্রদায়িকতা বিস্তারের ষড়যন্ত্রের রূপ উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। তিনি সকল ধর্মের মূল সত্যটি উপলব্ধি করে ঘোষণা করেন:
“স্থির হও ভাই। মূল ধর্ম এক বটে,
বিভিন্ন আধার। জল এক, ভিন্ন তটে
ভিন্ন জলাশয়।”(মালিনী)
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি উপমহাদেশের হিন্দু- মোসলেম সম্প্রীতি ধ্বংসের একটি বড় হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে এ কথা ঐতিহাসিক মাত্রই স্বীকার করবেন। আনন্দমঠে ব্যবহৃত ‘বন্দেমাতারম’ গানটির সুর করে দেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নিজে গেয়ে বঙ্কিমকে শোনান (রবীন্দ্র জীবনী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৩৬)। একসময় এই গানটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠলো যে গোঁড়া হিন্দুত্ববাদীরা একে ভারতের ‘জাতীয় সঙ্গীত’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মূলত অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। তিনি পরাধীন ভারতবর্ষের হিন্দু মোসলেমকে আলাদা করে না দেখে সবাইকে এক জাতিতে পরিণত করতে আগ্রহী ছিলেন। যে সময়ের কথা বলছি তখন ভারতবর্ষে ইংরেজদের আনুকূল্য পেয়ে হিন্দু ও ব্রাহ্ম সমাজ বেশ প্রভাবশালী অবস্থানে আছে আর মোসলেমদেরকে প্রতিটি ক্ষেত্রে দাবিয়ে রাখা হয়েছে। সমাজের মধ্যে এই অনৈক্যের বিষবাষ্প কোন মহৎ মানুষকেই ব্যথিত না করে পারে না। রবীন্দ্রনাথ বুঝলেন, বঙ্কিমের এই গান একটি সাম্প্রদায়িক সঙ্গীত, তাই এটিকে মিলিত হিন্দু-মোসলেম সকলে অন্তর থেকে মেনে নিতে পারে না, তখন কংগ্রেসের অধিবেশনে তিনি স্বয়ং আপত্তি করেছিলেন যাতে ওটা ‘জাতীয় সঙ্গীত’ না হয়। “……. সমগ্র ‘বন্দেমাতরম’ গানটি কংগ্রেসের ‘জাতীয়’ রূপে সর্বজাতির গ্রহণীয় নয় বলে মত প্রকাশ করে রবীন্দ্রনাথ উগ্রপন্থীদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। এবং তাঁর বিরোধিতা সত্ত্বেও ‘বন্দেমাতরম’ প্রথম স্তবক কংগ্রেসে জাতীয় সঙ্গীতরূপে গৃহীত হয়। (১৯৩৭)।” [অধ্যাপক (ঢাকা বিশ্ব:) ডক্টর মনিরুজ্জামান: আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু-মোসলেম সম্পর্ক, পৃষ্ঠা ২৬৯-প্রভাত মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্র জীবনকথা, পৃষ্ঠা ২৬০-৬১]
মোসলেমদেরকে হিন্দু সম্প্রদায় যেভাবে ঘৃণার চোখে দেখতো তা কবিকে খুব ব্যথিত করেছিল এবং এজন্য তিনি হিন্দু সম্প্রদায়কেই প্রধানত দায়ী করেন। তিনি নিজের কিশোর বয়সের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ‘হিন্দু মোসলেম’ প্রবন্ধে বলেন, ‘…আমি হিন্দুর তরফ থেকেই বলছি, মোসলেমের ত্র“টিবিচারটা থাক — আমরা মোসলেমকে কাছে টানতে যদি না পেরে থাকি তবে সেজন্যে যেন লজ্জা স্বীকার করি। অল্পবয়সে যখন প্রথম জমিদারি সেরেস্তা দেখতে গিয়েছিলুম তখন দেখলুম, আমাদের ব্রাহ্মণ ম্যানেজার যে-তক্তপোষের গদিতে বসে দরবার করেন সেখানে এক ধারে জাজিম তোলা, সেই জায়গাটা মোসলেম প্রজাদের বসবার জন্যে; আর জাজিমের উপর বসে হিন্দু প্রজারা। এইটে দেখে আমার ধিক্কার জন্মেছিল।’
তিনি মোসলেম জাতির বৈশিষ্ট্য ও ভারতবর্ষে তাদের অধিকার হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন এবং সে সঙ্গে ইংরেজের প্রকৃত চরিত্রও অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি লিখেছেন: “হিন্দু মোসলেমের সম্বন্ধ লইয়া আমাদের দেশে একটা পাপ আছে। এ পাপ অনেকদিন হইতে চলিয়া আসিতেছে। ইহার যা ফল তাহা না ভোগ করিয়া আমাদের কোন মতেই নিস্তার নাই।”
রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছেন: “তর্ক করিবার বেলায় বলিয়া থাকি কি করা যায়, শাস্ত্র তো মানিতে হইবে। অথচ শাস্ত্রে হিন্দু-মোসলেম সম্বন্ধে পরস্পরকে এমন করিয়া ঘৃণা করিবার তো কোন বিধান দেখি না। যদি বা শাস্ত্রের সেই বিধানই হয়, তবে সে শাস্ত্র লইয়া স্বদেশ-জাতি-স্বরাজ্যের প্রতিষ্ঠা কোনদিন হইবে না। মানুষকে ঘৃণা করা যে দেশে ধর্মের নিয়ম, প্রতিবেশীর হাতে পানি খাইলে যাহাদের পরকাল নষ্ট হয়, পরকে অপমান করিয়া যাহাদের জাতি রক্ষা করিতে হইবে, পরের হাতে চিরদিন অপমানিত না হইয়া তাহাদের গতি নাই, তাহারা যাহাদিগকে ¤ে¬চ্ছ বলিয়া অপমান করিতেছে সেই ¤ে¬চ্ছের অবজ্ঞা তাহাদিগকে সহ্য করিতে হইবে।’ (‘রবীন্দ্র রচনাবলী ১০ম খণ্ড, ৬২৮- ২৯ পৃষ্ঠায়)
রবীন্দ্রনাথ আরও বুঝতে পারলেন এবং স্বীকার করে তার নিজের ভাষায় বললেন-“যে একদেশে আমরা জন্মিয়াছি সেই দেশের ঐক্যকে খণ্ডিত করিতে থাকিলে ধর্মহানি হয়, এবং হইলে কখনই স্বার্থ রক্ষা হইতে পারে না তখনই আমরা উভয়ই ভ্রাতায় একই সমচেষ্টার মিলনক্ষেত্রে আসিয়া হাত ধরিয়া দাঁড়াইব।” (রবীন্দ্র রচনাবলী, ১০ম পৃষ্ঠা ৫০২)
১৯২০-২১ সালে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে মাওলানা মহম্মদ আলী ও গান্ধীজীর নেতৃত্বে হিন্দু-মোসলেমের পূনর্মিলনের প্রচেষ্টা দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন যে মিলন স্থায়ী হবে না। কারণ রাজনৈতিক ও সামাজিক ষড়যন্ত্রে মোসলেমদেরকে উন্নতির ধাপ হতে চরম অবনতিতে নামান হয়েছে। তাই কবি ‘সমস্যা’ নামে একটি ঐতিহাসিক প্রবন্ধ লিখলেন। তাতে তিনি জানালেন-হিন্দু-মোসলেমের ‘মিলন’ অপেক্ষা ‘সমকক্ষতা’ প্রয়োজন আগে (তথ্য: রবীন্দ্র রচনাবলী, ২৪শ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫৩-৫৮, ৩৬২)।
কবি মোসলেমদের শক্তি এবং আন্তর্জাতিক মর্যাদা অনুভব করে লিখেছেন: “বাংলাদেশের পূর্বভাগে মোসলেমের সংখ্যাই অধিক। ধর্মগত ও সমাজগত কারণে মোসলেমের মধ্যে হিন্দুর চেয়ে ঐক্য বেশি-সুতরাং শক্তির প্রধান উপকরণ তাহাদের মধ্যে নিহিত হইয়া আছে…”। (‘রবীন্দ্র রচনাবলী’র দশম খণ্ডের ৫২৩ পৃষ্ঠা)।
বিশ্বকবি তার প্রতিভায় ও গুণে ইংরেজকে নয় কেবল মানবজাতিকে মুগ্ধ করতে পেরেছিলেন তা প্রমাণিত হয়েছে। তবে তিনি এও উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, ইংরেজের বিচার মানে অবিচার; আর হিন্দুু-মোসলেমের মিলিত নেতৃত্ব ছাড়া সমস্যার সমাধান হবে না। মি: ডায়ারের নেতৃত্বে জালিয়ানওয়ালাবাগে ইংরেজদের গুলিতে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়েছিল তাতে কবি ব্যথিত হয়েছিলেন। আর তারই প্রমাণ দিতে ইংরেজ প্রদত্ত ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ই আগস্ট ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’ নামক নিজের লেখা যে প্রবন্ধটি কলকাতার টাউন হলে পড়েছিলেন তার একটু অংশ উদ্ধৃতি করলাম-“ দেশের কর্মশক্তিকে একটি বিশেষ কর্তৃসভার মধ্যে বদ্ধ করিতে হইবে। অন্তত একজন হিন্দু ও একজন মোসলেমকে আমরা এই সভায় অধিনায়ক করিব-তাঁদের নিকট নিজেকে সম্পূর্ণ অধীন, সম্পূর্ণ নত করিয়া রাখিব-তাঁহাদিগকে সম্মান করিয়া দেশকে সম্মানিত করিব।” (দ্রষ্টব্য রবীন্দ্র রচনাবলী, তৃতীয় খণ্ড, ১৩৭১, পৃষ্ঠা ৬১২)
ভারতে অনেক জাতি ও উপজাতি আছে। এখন যদি রবীন্দ্রনাথের সত্য-ভক্তদের প্রশ্ন করা যায়-বিশ্ববিখ্যাত রবিবাবু কি ভারতের নানাজাতি, নানামত, নানা পরিধানের কথা জানতেন না? তবুও কেন তিনি ‘হিন্দু-মোসলেম’ নিয়ে এত লেখালেখি করলেন? আর কোন জাতিকে কেন লিখলেন না? এ প্রশ্নের জবাবে বলতে হয় যে, তিনি অন্য সব জাতির কথাও লিখেছেন এবং তাদের প্রাপ্য গুরুত্ব তাদেরকে দিয়েছেন।
কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা
দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে সমুদ্রে হল হারা।
হেথায় আর্য, হেথা অনার্য হেথায় দ্রাবিড়, চীন–
শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।
সুতরাং তিনি সবার অংশগ্রহণে গঠিত যে মহান ‘সভ্যতা’র উল্লেখ করেছেন তার দেহ ও আত্মায় হিন্দু ও মোসলেম এই দু’টি জাতি সত্ত্বার গুরুত্ব ও ভূমিকাই মুখ্য। এজন্যই তিনি মোসলেম জাতির মর্যাদা, অধিকার ও প্রকৃত মূল্যায়নকে তাঁর লেখনী প্রতিভায় ফুটিয়ে তুলেছেন এবং এই দু’টি জাতিসত্ত্বার মিলনকে এত গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে জাতির অস্তিত্বের স্বার্থে হিন্দু সমাজকে তা বোঝাতে চেয়েছেন। এখানেও প্রমাণস্বরূপ তাঁর ভাষাতেই বলা যায়- “এ দিকে একটা প্রকাণ্ড বিচ্ছেদের খড়গ দেশের মাথার উপর ঝুলিতেছে। এই দুর্বলতার কারণ যতদিন আছে ততদিন আমাদের দেশের কোন মহৎ আশাকে সম্পূর্ণ সফল করা সম্ভব হইবে না … আমরা (হিন্দু) গোড়া হইতে ইংরেজদের স্কুলে বেশি মনোযোগের সাথে পড়া মুখস্থ করিয়াছি বলিয়া গভর্নমেন্টের চাকরি ও সম্মানের ভাগ মোসলেম ভ্রাতাদের চেয়ে আমাদের অংশে বেশি পড়িয়াছে সন্দেহ নেই। এইটুকু (পার্থক্য) কোন মতে না মিটিয়া গেলে আমাদের ঠিক মনের মিলন হইবে না। ”
রবীন্দ্রনাথ আরও জানালেন: “আমরা যে মোসলেমদের অথবা আমাদের দেশের জনসাধারণের যথার্থ হিতৈষী তাহার কোন প্রমাণ দিই নাই। অতএব তাহারা আমাদের হিতৈষিতায় সন্দেহ বোধ করিলে তাহাদিগকে দোষী করা যায় না। ….. আমরা যে দেশের সাধারণ লোকের ভাই তাহা দেশের সাধারণ লোক জানে না এবং আমাদের মনের মধ্যেও যে তাহাদের প্রতি ভ্রাতৃত্বভাব অত্যন্ত জাগরুক-আমাদের ব্যবহার এখনও তাহারে কোন প্রমাণ নাই।”
রবীন্দ্রনাথ মোসলেমদের গুরুত্ব এত বেশি অনুভব করেছিলেন যে তা তিনি তাঁর লেখায় সুস্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়: “স্বদেশীযুগে আমরা দেশের মোসলেমদের কিছু অস্বাভাবিক উচ্চস্বরেই আত্মীয় বলিয়া, ভাই বলিয়া ডাকাডাকি শুরু করিয়াছিলাম। সেই স্নেহের ডাকে যখন তাহার অশ্রু গদগদ কণ্ঠে সাড়া দিল না তখন আমরা তাহাদের উপর ভারী রাগ করিয়াছিলাম। ভাবিয়াছিলাম এটা নিতান্তই ওদের শয়তানি। একদিনের জন্যও ভাবি নাই, আমাদের ডাকের মধ্যে গরজ ছিল কিন্তু সত্য ছিল না…..। বাংলার মোসলেম যে এই বেদনায় আমাদের সাথে সাথে এক হয় নাই তাহার কারণ তাহাদের সাথে আমরা কোনদিন হৃদয়কে এক হইতে দিই নাই”।
ডা: কালিদাস নাগ বিলেত থেকে পত্র-মাধ্যমে জানতে চেয়েছিলেন-‘হিন্দু-মোসলেম সমস্যার সমাধান কী? সেটা ছিল ১৯২২ সাল। পত্রোত্তরে কবি লিখেছিলেন: “খিলাফত উপলক্ষ্যে মোসলেম নিজের মসজিদে এবং অন্যত্র হিন্দুকে যত কাছে টেনেছে, হিন্দু মোসলেমকে তত কাছে টানতে পারেনি। আচার হচ্ছে মানুষের সম্বন্ধের সেতু, সেখানেই পদে পদে হিন্দু নিজেদের বেড়া তুলে রেখেছে। ……অন্য আচার অবলম্বীদের অশুচি ব’লে গণ্য করার মতো মানুষের মিলনের এমন ভীষণ বাধা আর কিছুই নেই।” চিঠির শেষে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, “আমরাও মানসিক অবরোধ কেটে বেরিয়ে আসবো।”(শ্রী সত্যেন সেন: পনেরই আগস্ট, পৃষ্ঠা ১১০-১১৪)
উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জমিদারি দেখাশোনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে মোসলেম প্রজাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে হয়েছে। তিনি সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন হিন্দু মোসলেম প্রবন্ধে, ‘আমার অধিকাংশ প্রজাই মোসলেম। কোরবানি নিয়ে দেশে যখন একটা উত্তেজনা প্রবল তখন হিন্দু প্রজারা আমাদের এলাকায় সেটা স¤পূর্ণ রহিত করবার জন্য আমার কাছে নালিশ করেছিল। সে নালিশ আমি সংগত বলে মনে করি নি, কিন্তু মোসলেম প্রজাদের ডেকে যখন বলে দিলুম কাজটা যেন এমনভাবে সম্পন্ন করা হয় যাতে হিন্দুদের মনে অকারণে আঘাত না লাগে তারা তখনই তা মেনে নিল। আমাদের সেখানে এ-পর্যন্ত কোন উপদ্রব ঘটে নি। আমার বিশ্বাস তার প্রধান কারণ, আমার সঙ্গে আমার মোসলেম প্রজার সম্বন্ধ সহজ ও বাধাহীন। এ কথা আশা করাই চলে না যে, আমাদের দেশের ভিন্ন ভিন্ন সমাজের মধ্যে ধর্মকর্মের মতবিশ্বাসের ভেদ একেবারেই ঘুচতে পারে। তবুও মনুষ্যত্বের খাতিরে আশা করতেই হবে, আমাদের মধ্যে মিল হবে।’
আজকে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় যে সঙ্কট তা হচ্ছে মনুষ্যত্বের সঙ্কট। এই সঙ্কট থেকে মানবজাতিকে উদ্ধার পেতে হলে যে পদ্ধতি কবিগুরু বাতলে গেছেন তা হচ্ছে:
এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু মোসলেম।
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খ্রিস্টান।
এসো ব্রাহ্মণ শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার,
এসো হে পতিত করো অপনীত সব অপমানভার।
মা’র অভিষেকে এসো এসো ত্বরা,
মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা,
সবারে-পরশে-পবিত্র-করা তীর্থনীরে।
আজি ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।
“স্থির হও ভাই। মূল ধর্ম এক বটে,
বিভিন্ন আধার। জল এক, ভিন্ন তটে
ভিন্ন জলাশয়।”(মালিনী)
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি উপমহাদেশের হিন্দু- মোসলেম সম্প্রীতি ধ্বংসের একটি বড় হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে এ কথা ঐতিহাসিক মাত্রই স্বীকার করবেন। আনন্দমঠে ব্যবহৃত ‘বন্দেমাতারম’ গানটির সুর করে দেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নিজে গেয়ে বঙ্কিমকে শোনান (রবীন্দ্র জীবনী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৩৬)। একসময় এই গানটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠলো যে গোঁড়া হিন্দুত্ববাদীরা একে ভারতের ‘জাতীয় সঙ্গীত’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মূলত অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। তিনি পরাধীন ভারতবর্ষের হিন্দু মোসলেমকে আলাদা করে না দেখে সবাইকে এক জাতিতে পরিণত করতে আগ্রহী ছিলেন। যে সময়ের কথা বলছি তখন ভারতবর্ষে ইংরেজদের আনুকূল্য পেয়ে হিন্দু ও ব্রাহ্ম সমাজ বেশ প্রভাবশালী অবস্থানে আছে আর মোসলেমদেরকে প্রতিটি ক্ষেত্রে দাবিয়ে রাখা হয়েছে। সমাজের মধ্যে এই অনৈক্যের বিষবাষ্প কোন মহৎ মানুষকেই ব্যথিত না করে পারে না। রবীন্দ্রনাথ বুঝলেন, বঙ্কিমের এই গান একটি সাম্প্রদায়িক সঙ্গীত, তাই এটিকে মিলিত হিন্দু-মোসলেম সকলে অন্তর থেকে মেনে নিতে পারে না, তখন কংগ্রেসের অধিবেশনে তিনি স্বয়ং আপত্তি করেছিলেন যাতে ওটা ‘জাতীয় সঙ্গীত’ না হয়। “……. সমগ্র ‘বন্দেমাতরম’ গানটি কংগ্রেসের ‘জাতীয়’ রূপে সর্বজাতির গ্রহণীয় নয় বলে মত প্রকাশ করে রবীন্দ্রনাথ উগ্রপন্থীদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। এবং তাঁর বিরোধিতা সত্ত্বেও ‘বন্দেমাতরম’ প্রথম স্তবক কংগ্রেসে জাতীয় সঙ্গীতরূপে গৃহীত হয়। (১৯৩৭)।” [অধ্যাপক (ঢাকা বিশ্ব:) ডক্টর মনিরুজ্জামান: আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু-মোসলেম সম্পর্ক, পৃষ্ঠা ২৬৯-প্রভাত মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্র জীবনকথা, পৃষ্ঠা ২৬০-৬১]
মোসলেমদেরকে হিন্দু সম্প্রদায় যেভাবে ঘৃণার চোখে দেখতো তা কবিকে খুব ব্যথিত করেছিল এবং এজন্য তিনি হিন্দু সম্প্রদায়কেই প্রধানত দায়ী করেন। তিনি নিজের কিশোর বয়সের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ‘হিন্দু মোসলেম’ প্রবন্ধে বলেন, ‘…আমি হিন্দুর তরফ থেকেই বলছি, মোসলেমের ত্র“টিবিচারটা থাক — আমরা মোসলেমকে কাছে টানতে যদি না পেরে থাকি তবে সেজন্যে যেন লজ্জা স্বীকার করি। অল্পবয়সে যখন প্রথম জমিদারি সেরেস্তা দেখতে গিয়েছিলুম তখন দেখলুম, আমাদের ব্রাহ্মণ ম্যানেজার যে-তক্তপোষের গদিতে বসে দরবার করেন সেখানে এক ধারে জাজিম তোলা, সেই জায়গাটা মোসলেম প্রজাদের বসবার জন্যে; আর জাজিমের উপর বসে হিন্দু প্রজারা। এইটে দেখে আমার ধিক্কার জন্মেছিল।’
তিনি মোসলেম জাতির বৈশিষ্ট্য ও ভারতবর্ষে তাদের অধিকার হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন এবং সে সঙ্গে ইংরেজের প্রকৃত চরিত্রও অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি লিখেছেন: “হিন্দু মোসলেমের সম্বন্ধ লইয়া আমাদের দেশে একটা পাপ আছে। এ পাপ অনেকদিন হইতে চলিয়া আসিতেছে। ইহার যা ফল তাহা না ভোগ করিয়া আমাদের কোন মতেই নিস্তার নাই।”
রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছেন: “তর্ক করিবার বেলায় বলিয়া থাকি কি করা যায়, শাস্ত্র তো মানিতে হইবে। অথচ শাস্ত্রে হিন্দু-মোসলেম সম্বন্ধে পরস্পরকে এমন করিয়া ঘৃণা করিবার তো কোন বিধান দেখি না। যদি বা শাস্ত্রের সেই বিধানই হয়, তবে সে শাস্ত্র লইয়া স্বদেশ-জাতি-স্বরাজ্যের প্রতিষ্ঠা কোনদিন হইবে না। মানুষকে ঘৃণা করা যে দেশে ধর্মের নিয়ম, প্রতিবেশীর হাতে পানি খাইলে যাহাদের পরকাল নষ্ট হয়, পরকে অপমান করিয়া যাহাদের জাতি রক্ষা করিতে হইবে, পরের হাতে চিরদিন অপমানিত না হইয়া তাহাদের গতি নাই, তাহারা যাহাদিগকে ¤ে¬চ্ছ বলিয়া অপমান করিতেছে সেই ¤ে¬চ্ছের অবজ্ঞা তাহাদিগকে সহ্য করিতে হইবে।’ (‘রবীন্দ্র রচনাবলী ১০ম খণ্ড, ৬২৮- ২৯ পৃষ্ঠায়)
রবীন্দ্রনাথ আরও বুঝতে পারলেন এবং স্বীকার করে তার নিজের ভাষায় বললেন-“যে একদেশে আমরা জন্মিয়াছি সেই দেশের ঐক্যকে খণ্ডিত করিতে থাকিলে ধর্মহানি হয়, এবং হইলে কখনই স্বার্থ রক্ষা হইতে পারে না তখনই আমরা উভয়ই ভ্রাতায় একই সমচেষ্টার মিলনক্ষেত্রে আসিয়া হাত ধরিয়া দাঁড়াইব।” (রবীন্দ্র রচনাবলী, ১০ম পৃষ্ঠা ৫০২)
১৯২০-২১ সালে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে মাওলানা মহম্মদ আলী ও গান্ধীজীর নেতৃত্বে হিন্দু-মোসলেমের পূনর্মিলনের প্রচেষ্টা দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন যে মিলন স্থায়ী হবে না। কারণ রাজনৈতিক ও সামাজিক ষড়যন্ত্রে মোসলেমদেরকে উন্নতির ধাপ হতে চরম অবনতিতে নামান হয়েছে। তাই কবি ‘সমস্যা’ নামে একটি ঐতিহাসিক প্রবন্ধ লিখলেন। তাতে তিনি জানালেন-হিন্দু-মোসলেমের ‘মিলন’ অপেক্ষা ‘সমকক্ষতা’ প্রয়োজন আগে (তথ্য: রবীন্দ্র রচনাবলী, ২৪শ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫৩-৫৮, ৩৬২)।
কবি মোসলেমদের শক্তি এবং আন্তর্জাতিক মর্যাদা অনুভব করে লিখেছেন: “বাংলাদেশের পূর্বভাগে মোসলেমের সংখ্যাই অধিক। ধর্মগত ও সমাজগত কারণে মোসলেমের মধ্যে হিন্দুর চেয়ে ঐক্য বেশি-সুতরাং শক্তির প্রধান উপকরণ তাহাদের মধ্যে নিহিত হইয়া আছে…”। (‘রবীন্দ্র রচনাবলী’র দশম খণ্ডের ৫২৩ পৃষ্ঠা)।
বিশ্বকবি তার প্রতিভায় ও গুণে ইংরেজকে নয় কেবল মানবজাতিকে মুগ্ধ করতে পেরেছিলেন তা প্রমাণিত হয়েছে। তবে তিনি এও উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, ইংরেজের বিচার মানে অবিচার; আর হিন্দুু-মোসলেমের মিলিত নেতৃত্ব ছাড়া সমস্যার সমাধান হবে না। মি: ডায়ারের নেতৃত্বে জালিয়ানওয়ালাবাগে ইংরেজদের গুলিতে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়েছিল তাতে কবি ব্যথিত হয়েছিলেন। আর তারই প্রমাণ দিতে ইংরেজ প্রদত্ত ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ই আগস্ট ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’ নামক নিজের লেখা যে প্রবন্ধটি কলকাতার টাউন হলে পড়েছিলেন তার একটু অংশ উদ্ধৃতি করলাম-“ দেশের কর্মশক্তিকে একটি বিশেষ কর্তৃসভার মধ্যে বদ্ধ করিতে হইবে। অন্তত একজন হিন্দু ও একজন মোসলেমকে আমরা এই সভায় অধিনায়ক করিব-তাঁদের নিকট নিজেকে সম্পূর্ণ অধীন, সম্পূর্ণ নত করিয়া রাখিব-তাঁহাদিগকে সম্মান করিয়া দেশকে সম্মানিত করিব।” (দ্রষ্টব্য রবীন্দ্র রচনাবলী, তৃতীয় খণ্ড, ১৩৭১, পৃষ্ঠা ৬১২)
ভারতে অনেক জাতি ও উপজাতি আছে। এখন যদি রবীন্দ্রনাথের সত্য-ভক্তদের প্রশ্ন করা যায়-বিশ্ববিখ্যাত রবিবাবু কি ভারতের নানাজাতি, নানামত, নানা পরিধানের কথা জানতেন না? তবুও কেন তিনি ‘হিন্দু-মোসলেম’ নিয়ে এত লেখালেখি করলেন? আর কোন জাতিকে কেন লিখলেন না? এ প্রশ্নের জবাবে বলতে হয় যে, তিনি অন্য সব জাতির কথাও লিখেছেন এবং তাদের প্রাপ্য গুরুত্ব তাদেরকে দিয়েছেন।
কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা
দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে সমুদ্রে হল হারা।
হেথায় আর্য, হেথা অনার্য হেথায় দ্রাবিড়, চীন–
শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।
সুতরাং তিনি সবার অংশগ্রহণে গঠিত যে মহান ‘সভ্যতা’র উল্লেখ করেছেন তার দেহ ও আত্মায় হিন্দু ও মোসলেম এই দু’টি জাতি সত্ত্বার গুরুত্ব ও ভূমিকাই মুখ্য। এজন্যই তিনি মোসলেম জাতির মর্যাদা, অধিকার ও প্রকৃত মূল্যায়নকে তাঁর লেখনী প্রতিভায় ফুটিয়ে তুলেছেন এবং এই দু’টি জাতিসত্ত্বার মিলনকে এত গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে জাতির অস্তিত্বের স্বার্থে হিন্দু সমাজকে তা বোঝাতে চেয়েছেন। এখানেও প্রমাণস্বরূপ তাঁর ভাষাতেই বলা যায়- “এ দিকে একটা প্রকাণ্ড বিচ্ছেদের খড়গ দেশের মাথার উপর ঝুলিতেছে। এই দুর্বলতার কারণ যতদিন আছে ততদিন আমাদের দেশের কোন মহৎ আশাকে সম্পূর্ণ সফল করা সম্ভব হইবে না … আমরা (হিন্দু) গোড়া হইতে ইংরেজদের স্কুলে বেশি মনোযোগের সাথে পড়া মুখস্থ করিয়াছি বলিয়া গভর্নমেন্টের চাকরি ও সম্মানের ভাগ মোসলেম ভ্রাতাদের চেয়ে আমাদের অংশে বেশি পড়িয়াছে সন্দেহ নেই। এইটুকু (পার্থক্য) কোন মতে না মিটিয়া গেলে আমাদের ঠিক মনের মিলন হইবে না। ”
রবীন্দ্রনাথ আরও জানালেন: “আমরা যে মোসলেমদের অথবা আমাদের দেশের জনসাধারণের যথার্থ হিতৈষী তাহার কোন প্রমাণ দিই নাই। অতএব তাহারা আমাদের হিতৈষিতায় সন্দেহ বোধ করিলে তাহাদিগকে দোষী করা যায় না। ….. আমরা যে দেশের সাধারণ লোকের ভাই তাহা দেশের সাধারণ লোক জানে না এবং আমাদের মনের মধ্যেও যে তাহাদের প্রতি ভ্রাতৃত্বভাব অত্যন্ত জাগরুক-আমাদের ব্যবহার এখনও তাহারে কোন প্রমাণ নাই।”
রবীন্দ্রনাথ মোসলেমদের গুরুত্ব এত বেশি অনুভব করেছিলেন যে তা তিনি তাঁর লেখায় সুস্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়: “স্বদেশীযুগে আমরা দেশের মোসলেমদের কিছু অস্বাভাবিক উচ্চস্বরেই আত্মীয় বলিয়া, ভাই বলিয়া ডাকাডাকি শুরু করিয়াছিলাম। সেই স্নেহের ডাকে যখন তাহার অশ্রু গদগদ কণ্ঠে সাড়া দিল না তখন আমরা তাহাদের উপর ভারী রাগ করিয়াছিলাম। ভাবিয়াছিলাম এটা নিতান্তই ওদের শয়তানি। একদিনের জন্যও ভাবি নাই, আমাদের ডাকের মধ্যে গরজ ছিল কিন্তু সত্য ছিল না…..। বাংলার মোসলেম যে এই বেদনায় আমাদের সাথে সাথে এক হয় নাই তাহার কারণ তাহাদের সাথে আমরা কোনদিন হৃদয়কে এক হইতে দিই নাই”।
ডা: কালিদাস নাগ বিলেত থেকে পত্র-মাধ্যমে জানতে চেয়েছিলেন-‘হিন্দু-মোসলেম সমস্যার সমাধান কী? সেটা ছিল ১৯২২ সাল। পত্রোত্তরে কবি লিখেছিলেন: “খিলাফত উপলক্ষ্যে মোসলেম নিজের মসজিদে এবং অন্যত্র হিন্দুকে যত কাছে টেনেছে, হিন্দু মোসলেমকে তত কাছে টানতে পারেনি। আচার হচ্ছে মানুষের সম্বন্ধের সেতু, সেখানেই পদে পদে হিন্দু নিজেদের বেড়া তুলে রেখেছে। ……অন্য আচার অবলম্বীদের অশুচি ব’লে গণ্য করার মতো মানুষের মিলনের এমন ভীষণ বাধা আর কিছুই নেই।” চিঠির শেষে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, “আমরাও মানসিক অবরোধ কেটে বেরিয়ে আসবো।”(শ্রী সত্যেন সেন: পনেরই আগস্ট, পৃষ্ঠা ১১০-১১৪)
উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জমিদারি দেখাশোনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে মোসলেম প্রজাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে হয়েছে। তিনি সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন হিন্দু মোসলেম প্রবন্ধে, ‘আমার অধিকাংশ প্রজাই মোসলেম। কোরবানি নিয়ে দেশে যখন একটা উত্তেজনা প্রবল তখন হিন্দু প্রজারা আমাদের এলাকায় সেটা স¤পূর্ণ রহিত করবার জন্য আমার কাছে নালিশ করেছিল। সে নালিশ আমি সংগত বলে মনে করি নি, কিন্তু মোসলেম প্রজাদের ডেকে যখন বলে দিলুম কাজটা যেন এমনভাবে সম্পন্ন করা হয় যাতে হিন্দুদের মনে অকারণে আঘাত না লাগে তারা তখনই তা মেনে নিল। আমাদের সেখানে এ-পর্যন্ত কোন উপদ্রব ঘটে নি। আমার বিশ্বাস তার প্রধান কারণ, আমার সঙ্গে আমার মোসলেম প্রজার সম্বন্ধ সহজ ও বাধাহীন। এ কথা আশা করাই চলে না যে, আমাদের দেশের ভিন্ন ভিন্ন সমাজের মধ্যে ধর্মকর্মের মতবিশ্বাসের ভেদ একেবারেই ঘুচতে পারে। তবুও মনুষ্যত্বের খাতিরে আশা করতেই হবে, আমাদের মধ্যে মিল হবে।’
আজকে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় যে সঙ্কট তা হচ্ছে মনুষ্যত্বের সঙ্কট। এই সঙ্কট থেকে মানবজাতিকে উদ্ধার পেতে হলে যে পদ্ধতি কবিগুরু বাতলে গেছেন তা হচ্ছে:
এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু মোসলেম।
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খ্রিস্টান।
এসো ব্রাহ্মণ শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার,
এসো হে পতিত করো অপনীত সব অপমানভার।
মা’র অভিষেকে এসো এসো ত্বরা,
মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা,
সবারে-পরশে-পবিত্র-করা তীর্থনীরে।
আজি ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।
এসলাম শরীরে ধারণ করা যায় না সমষ্টিগত জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে হয়
এসলাম শরীরে ধারণ করা যায় না সমষ্টিগত জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে হয়
[মসীহ উর রহমান]
হেযবুত তওহীদের মতাদর্শ অর্থাৎ প্রকৃত এসলাম সম্পর্কে আমাদের লেখা পড়ে বা ডকুমেন্টারি দেখে অনেকে আমাদের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করেন, বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করেন। যেহেতু আমাদের বিষয়বস্তু এসলাম, তাই এই প্রশ্নকর্তাদের মধ্যে একটি বিরাট অংশ আছেন যারা মাদ্রাসা-শিক্ষিত। তাদের প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি অতি উচ্চারিত প্রশ্ন হল, ‘হেযবুত তওহীদের অনেককেই আমি চিনি, তাদের অনেকের মুখে দাড়ি নাই, মাথায় টুপি নাই, পাগড়ী নাই, গায়ে জুব্বা নাই ইত্যাদি। আগে তো নিজেদের শরীরে এসলাম কায়েম করতে হবে, তারপরে দুনিয়াতে কায়েম করার প্রশ্ন। আপনাদের সাড়ে তিন হাতে শরীরেই তো এসলাম নেই, সারা দুনিয়াতে কীভাবে এসলাম প্রতিষ্ঠা করবেন?’
এ প্রশ্নের জবাবে প্রথমেই আমি বলব, এসলাম আসলে কী এবং কেন, তা আগে আমাদের বুঝতে হবে। যদি এই প্রশ্ন দুটির উত্তর আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়, তাহলে আশা করি আমরা বুঝতে পারব আসলে দাড়ি, টুপি, পাগড়ীর সাথে এসলামের সম্পর্ক কতটুকু।
আল্লাহ যুগে যুগে তাঁর নবী-রসুলদের মাধ্যমে পৃথিবীতে দীনুল হক্ব বা সত্য জীবনব্যবস্থা পাঠিয়েছেন। এসলাম বা শান্তি হচ্ছে আল্লাহর দেওয়া এই জীবনব্যবস্থা প্রয়োগের ফল। অর্থাৎ দীনুল হক্ব কার্যকরী করা হলে মানবজীবন থেকে অন্যায় অবিচার বিলুপ্ত হয়ে যে নিরাপত্তা, সুবিচার, ন্যায় ইত্যাদি অর্থাৎ এক কথায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে- এই শান্তিটাই হচ্ছে এসলাম। ১৪০০ বছর আগে অর্ধেক পৃথিবীতে এই দীন প্রবর্তন করার ফলে ঐ সমস্ত এলাকায় মানবজীবনের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত, অর্র্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সকল প্রকার শোষণ, অবিচার, অন্যায়, নিরাপত্তাহীনতা দূরীভূত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চূড়ান্ত শান্তি, নিরাপত্তা ও সুবিচার, তথা এসলাম।
এই হলো এসলামের সঠিক আকিদা বা ধারণা। এই ধারণা মোতাবেক আসলে এসলামের সাথে দাড়ি, টুপি, পাগড়ী, জুব্বার সম্পর্ক কোথায়? এসলাম নির্ভর করে মানবজীবনের শান্তি-অশান্তির উপর। আল্লাহ প্রেরিত দীনুল হক্ব হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ। অর্থাৎ রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি সব কিছুই এই জীবন-ব্যবস্থার এক একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এসব কিছু মিলেই দীনুল হক্ব নামক বৃক্ষ পূর্ণতা পায়, আর এই পুর্ণাঙ্গ বৃক্ষের শান্তি নামক ফল হচ্ছে এসলাম। সুতরাং যারা আমাদের শরীরে এসলাম নাই এই প্রশ্ন করেন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন- শান্তি কি শরীরে ধারণ করা যায়, নাকি সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে হয়? একটি দেশের সব মানুষ যদি দাড়ি রাখে, টুপি পরে, জোব্বা গায়ে দেয় কিন্তু তাদের অর্থনীতি যদি সুদভিত্তিক হয়, বিচারব্যবস্থা দীনুল হক্বের না হয়ে মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত হয় তাহলে কি সেই দেশে শান্তি এসে যাবে? সাধারণ জ্ঞান কি বলে?
অনেকের ধারণা এই যে, দাড়ি ছাড়া এসলামই হয় না, সেই দাড়ি তো আল্লাহর রসুলের বিরোধিতাকারী, ঘৃণিত কাফের আবু জেহেল, আবু লাহাব, ওতবা, শায়েবার মুখেও ছিল। তারাও জুব্বা পরতো, রসুল (দ:) যে জুব্বা পরতেন ঠিক একই ধরনের জুব্বা। প্রকৃতপক্ষে দাড়ি, টুপি, পাগড়ি, জুব্বার সাথে এসলামের কোন সম্পর্ক নাই, প্রকৃতির আবহাওয়া, ভৌগোলিক অবস্থার সাথে এগুলোর সম্পর্ক রয়েছে। টুপি তো ইহুদিরা, শিখরা বা অন্যান্য ধর্মের ধর্মগুরুরাও পরেন, তাদেরও দাড়ি আছে, তারাও জুব্বা পরেন, তাদের অনেকেই পাগড়ী পরেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাড়ি, টুপি, জোব্বা সবই ছিল। শুধু ধর্মীয় সাধু সন্ন্যাসী নয়, আল্লাহর বিধানে সম্পূর্ণ অবিশ্বাসী হিসাবে পরিচিত অনেকেরই দাড়ি ছিল যেমন কার্ল মার্কস, চার্লস ডারউইন, আব্রাহাম লিঙ্কন প্রমুখ। দাড়ি-টুপিই যদি এসলামের পরিচায়ক হতো তাহলে এরাও তো এসলামেরই ধারক হবার যোগ্য! আসলে দাড়ি-টুপি-পাগড়ী-পাজামা-জোব্বার সাথে এসলামের সম্পর্ক নেই। এগুলো নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা নেহায়েত বোকামীর শামিল। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মতবিরোধে গিয়ে মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যাওয়া একপ্রকার মূর্খতা বলে আমরা মনে করি। গত কয়েক শতাব্দী ধরে এই জাতির দুর্ভাগ্যজনক পরাজয়ের কারণ এগুলিই। অথচ এটা ইতিহাস যে রসুলের একদল সর্বত্যাগী সাহাবী যাদেরকে আসহাবে সুফফা বলা হতো, তারা বাড়ী-ঘরে যেতেন না, মসজিদে নববীতে থাকতেন আর অপেক্ষা করতেন রসুল (দ:) কখন কি হুকুম দেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সে হুকুম বাস্তবায়ন করতেন, সেই সাহাবীদের অনেকেরই গায়ে জুব্বা তো দূরের কথা ঠিকমত লজ্জাস্থান ঢাকার মতো কাপড় সংস্থান করতেও কষ্ট হতো। আসুন সেই সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী মোজাহেদ সাহাবীদের জীবনীতে এসলাম তালাশ করি। লেবাসধারী ধর্মব্যবসায়ীদের নিকট এসলাম নেই।
এ প্রশ্নের জবাবে প্রথমেই আমি বলব, এসলাম আসলে কী এবং কেন, তা আগে আমাদের বুঝতে হবে। যদি এই প্রশ্ন দুটির উত্তর আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়, তাহলে আশা করি আমরা বুঝতে পারব আসলে দাড়ি, টুপি, পাগড়ীর সাথে এসলামের সম্পর্ক কতটুকু।
আল্লাহ যুগে যুগে তাঁর নবী-রসুলদের মাধ্যমে পৃথিবীতে দীনুল হক্ব বা সত্য জীবনব্যবস্থা পাঠিয়েছেন। এসলাম বা শান্তি হচ্ছে আল্লাহর দেওয়া এই জীবনব্যবস্থা প্রয়োগের ফল। অর্থাৎ দীনুল হক্ব কার্যকরী করা হলে মানবজীবন থেকে অন্যায় অবিচার বিলুপ্ত হয়ে যে নিরাপত্তা, সুবিচার, ন্যায় ইত্যাদি অর্থাৎ এক কথায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে- এই শান্তিটাই হচ্ছে এসলাম। ১৪০০ বছর আগে অর্ধেক পৃথিবীতে এই দীন প্রবর্তন করার ফলে ঐ সমস্ত এলাকায় মানবজীবনের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত, অর্র্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সকল প্রকার শোষণ, অবিচার, অন্যায়, নিরাপত্তাহীনতা দূরীভূত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চূড়ান্ত শান্তি, নিরাপত্তা ও সুবিচার, তথা এসলাম।
এই হলো এসলামের সঠিক আকিদা বা ধারণা। এই ধারণা মোতাবেক আসলে এসলামের সাথে দাড়ি, টুপি, পাগড়ী, জুব্বার সম্পর্ক কোথায়? এসলাম নির্ভর করে মানবজীবনের শান্তি-অশান্তির উপর। আল্লাহ প্রেরিত দীনুল হক্ব হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ। অর্থাৎ রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি সব কিছুই এই জীবন-ব্যবস্থার এক একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এসব কিছু মিলেই দীনুল হক্ব নামক বৃক্ষ পূর্ণতা পায়, আর এই পুর্ণাঙ্গ বৃক্ষের শান্তি নামক ফল হচ্ছে এসলাম। সুতরাং যারা আমাদের শরীরে এসলাম নাই এই প্রশ্ন করেন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন- শান্তি কি শরীরে ধারণ করা যায়, নাকি সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে হয়? একটি দেশের সব মানুষ যদি দাড়ি রাখে, টুপি পরে, জোব্বা গায়ে দেয় কিন্তু তাদের অর্থনীতি যদি সুদভিত্তিক হয়, বিচারব্যবস্থা দীনুল হক্বের না হয়ে মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত হয় তাহলে কি সেই দেশে শান্তি এসে যাবে? সাধারণ জ্ঞান কি বলে?
অনেকের ধারণা এই যে, দাড়ি ছাড়া এসলামই হয় না, সেই দাড়ি তো আল্লাহর রসুলের বিরোধিতাকারী, ঘৃণিত কাফের আবু জেহেল, আবু লাহাব, ওতবা, শায়েবার মুখেও ছিল। তারাও জুব্বা পরতো, রসুল (দ:) যে জুব্বা পরতেন ঠিক একই ধরনের জুব্বা। প্রকৃতপক্ষে দাড়ি, টুপি, পাগড়ি, জুব্বার সাথে এসলামের কোন সম্পর্ক নাই, প্রকৃতির আবহাওয়া, ভৌগোলিক অবস্থার সাথে এগুলোর সম্পর্ক রয়েছে। টুপি তো ইহুদিরা, শিখরা বা অন্যান্য ধর্মের ধর্মগুরুরাও পরেন, তাদেরও দাড়ি আছে, তারাও জুব্বা পরেন, তাদের অনেকেই পাগড়ী পরেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাড়ি, টুপি, জোব্বা সবই ছিল। শুধু ধর্মীয় সাধু সন্ন্যাসী নয়, আল্লাহর বিধানে সম্পূর্ণ অবিশ্বাসী হিসাবে পরিচিত অনেকেরই দাড়ি ছিল যেমন কার্ল মার্কস, চার্লস ডারউইন, আব্রাহাম লিঙ্কন প্রমুখ। দাড়ি-টুপিই যদি এসলামের পরিচায়ক হতো তাহলে এরাও তো এসলামেরই ধারক হবার যোগ্য! আসলে দাড়ি-টুপি-পাগড়ী-পাজামা-জোব্বার সাথে এসলামের সম্পর্ক নেই। এগুলো নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা নেহায়েত বোকামীর শামিল। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মতবিরোধে গিয়ে মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যাওয়া একপ্রকার মূর্খতা বলে আমরা মনে করি। গত কয়েক শতাব্দী ধরে এই জাতির দুর্ভাগ্যজনক পরাজয়ের কারণ এগুলিই। অথচ এটা ইতিহাস যে রসুলের একদল সর্বত্যাগী সাহাবী যাদেরকে আসহাবে সুফফা বলা হতো, তারা বাড়ী-ঘরে যেতেন না, মসজিদে নববীতে থাকতেন আর অপেক্ষা করতেন রসুল (দ:) কখন কি হুকুম দেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সে হুকুম বাস্তবায়ন করতেন, সেই সাহাবীদের অনেকেরই গায়ে জুব্বা তো দূরের কথা ঠিকমত লজ্জাস্থান ঢাকার মতো কাপড় সংস্থান করতেও কষ্ট হতো। আসুন সেই সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী মোজাহেদ সাহাবীদের জীবনীতে এসলাম তালাশ করি। লেবাসধারী ধর্মব্যবসায়ীদের নিকট এসলাম নেই।
চুক্তিতে ফিরে আসতে হবে
চুক্তিতে ফিরে আসতে হবে
[সাইদ হোসাইন]
আল্লাহর সাথে যে চুক্তি, শপথ বা অঙ্গীকার করে প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করার জন্য আমরা (মানবজাতি) পৃথিবীতে এসেছি, সেই চুক্তি পালন করছি কি-না। আমরা চুক্তি করেছি আল্লাহর পক্ষ হয়ে দুনিয়াতে আল্লাহর খেলাফত কায়েমের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করব। সেই শান্তি হবে সর্বব্যাপী শান্তি, দুনিয়াব্যাপী শান্তি। বর্তমানে দুনিয়ার কোথাও এক বিন্দু পরিমাণ শান্তি নাই। এতে এটাই বোঝা যায় যে, আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করি নি। চুক্তি মোতাবেক দায়িত্ব পালন করলে তো পৃথিবীতে শান্তিই থাকতো। অথচ সমস্ত দুনিয়া অন্যায় যুলুম যুদ্ধ রক্তপাতে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। এই অশান্তিপূর্ণ পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব যাদের উপর সবচেয়ে বেশি ছিল তারাই আজ সবচেয়ে বেশি অবহেলিত, লাঞ্ছিত এবং অন্য জাতির ঘৃণিত গোলাম হয়ে আছে। অবস্থা এই হয়েছে যে, যে সরিষা দিয়ে ভূত তাড়ানো হয় সেই সরিষাতেই যেন ভূত ভর করেছে। সরিষাতে ভূত থাকলে সরিষার বাইরেই শুধু ভূত তার অত্যাচার আর অশান্তি সীমিত রাখে না, স্বয়ং সরিষাকেও দলিত মথিত করে ছাড়ে। আমাদের অবস্থাও বর্তমান দুনিয়াতে ঠিক তাই। এটা আর কিছুই নয়, চুক্তি ভঙ্গের পরিণাম। সুতরাং কেউ স্বীকার করুক বা না করুক এটা দিবালোকের মত পরিষ্কার যে, আমরা চুক্তি ভঙ্গকারী, আমরা চুক্তিতে নাই।
বর্তমানে দুনিয়াতে মোসলেম নামের এই জাতির অবস্থা ফুটবলের মত। যে-ই পায় সেই লাথি মারে। লাথি আর লাথিই হচ্ছে এদের ভাগ্য। মোসলেম নাম শুনা মাত্রই অন্যজাতির থুথু পড়ে গায়ে। এই সংকটাপন্ন অবস্থা আল্লাহর প্রতিনিধির হতে পারে না এ অসম্ভব। সুতরাং আমরা মোসলেম নামের এই জাতি আজ চুক্তিহারা। তাই আমরা সর্বহারা, সৃষ্টির সর্বনিকৃষ্ট সৃষ্টিতে পরিণত হয়েছি কিন্তু পূর্ণ তাকওয়ার সাথে দৈনিক পাঁচবার মসজিদে দৌঁড়াচ্ছি, সওম হজ্জ যাকাত ইত্যাদি ইবাদত দিয়ে আসমান জমিন ভরে ফেলছি, লক্ষ লক্ষ লোকের এজতেমা করছি আর তাহাজ্জুদের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে নিষ্ফল মোনাজাত করে যাচ্ছি অর্থাৎ নূন্যতম বোধশক্তি হারিয়ে গেলে যা হয়। এই জাতি চুক্তিতে থাকলে আল্লাহর সাহায্য অবশ্যই এই জাতির সাথে থাকত। এখনও যদি আমরা সতর্ক না হই, আবার চুক্তিতে ফিরে না আসি, তাহলে দুনিয়াতে আমাদের উপরে লানত যা চলছে তাতেই বুঝা যায় আখেরাতে আমাদের অবস্থান কোথায় হবে। সেটা এক অবর্ণনীয় করুণ দুরবস্থা। কেননা যে জাতি দুনিয়াতে অন্য জাতির ঘৃণ্য গোলাম, সে জাতি আখেরাতে জান্নাতুল ফেরদাউসে স্থান পাবে এটা হতেই পারে না।
এখন আমাদের উচিত কোরআনের সেই আয়াতের দিকে যাওয়া, “আল্লাহর রহমত হতে তোমরা নিরাশ হয়ো না। কারণ কাফের সম্প্রদায় ব্যতীত আল্লাহর রহমত হতে কেউ নিরাশ হয় না। (সূরা ইউসুফ:৮৭) ” আল্লাহ আরও বলেন, হতাশ হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না, বিজয়ী তোমরা হবেই যদি তোমরা মুমিন হও। এইভাবে দয়ালু আল্লাহ অনেক অনেক আশ্বাস, অভয়বাণী, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে রেখেছেন তাদের জন্য যারা চুক্তিতে ঠিক থাকবে। এখন আমাদের একমাত্র কাজ আবার আল্লাহর সঙ্গে যে চুক্তি আমরা করে এসেছি সেই চুক্তিতে ফিরে আসা। শেষ নবী সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে একা দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ নামক চুক্তির। দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে ডাক দিয়ে বললেন, তোমরা শুধু এটুকু ঘোষণা দাও- হুকুমদাতা হিসাবে এক আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে মানি না। তাহলে তোমরা সফলকাম হয়ে যাবে এ জীবনে এবং পরজীবনে। এখন আমাদের একমাত্র কাজ মেরুদণ্ড সোজা করে, বুক টান করে, মাথা উচু করে আবার চুক্তিতে ফেরার ঘোষণা দেওয়া। কোন ভয়ভীতি, রক্তচক্ষু, শক্তি, হিংস্রতা, বর্বরতা কোন কিছুর পরোয়া না করে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য উঠে দাঁড়াতে হবে। তবেই আসবে আমাদের জন্য আল্লাহর সাহায্য, আসন্ন বিজয় এবং পরকালে মহাপুরস্কার জান্নাত।
বর্তমানে দুনিয়াতে মোসলেম নামের এই জাতির অবস্থা ফুটবলের মত। যে-ই পায় সেই লাথি মারে। লাথি আর লাথিই হচ্ছে এদের ভাগ্য। মোসলেম নাম শুনা মাত্রই অন্যজাতির থুথু পড়ে গায়ে। এই সংকটাপন্ন অবস্থা আল্লাহর প্রতিনিধির হতে পারে না এ অসম্ভব। সুতরাং আমরা মোসলেম নামের এই জাতি আজ চুক্তিহারা। তাই আমরা সর্বহারা, সৃষ্টির সর্বনিকৃষ্ট সৃষ্টিতে পরিণত হয়েছি কিন্তু পূর্ণ তাকওয়ার সাথে দৈনিক পাঁচবার মসজিদে দৌঁড়াচ্ছি, সওম হজ্জ যাকাত ইত্যাদি ইবাদত দিয়ে আসমান জমিন ভরে ফেলছি, লক্ষ লক্ষ লোকের এজতেমা করছি আর তাহাজ্জুদের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে নিষ্ফল মোনাজাত করে যাচ্ছি অর্থাৎ নূন্যতম বোধশক্তি হারিয়ে গেলে যা হয়। এই জাতি চুক্তিতে থাকলে আল্লাহর সাহায্য অবশ্যই এই জাতির সাথে থাকত। এখনও যদি আমরা সতর্ক না হই, আবার চুক্তিতে ফিরে না আসি, তাহলে দুনিয়াতে আমাদের উপরে লানত যা চলছে তাতেই বুঝা যায় আখেরাতে আমাদের অবস্থান কোথায় হবে। সেটা এক অবর্ণনীয় করুণ দুরবস্থা। কেননা যে জাতি দুনিয়াতে অন্য জাতির ঘৃণ্য গোলাম, সে জাতি আখেরাতে জান্নাতুল ফেরদাউসে স্থান পাবে এটা হতেই পারে না।
এখন আমাদের উচিত কোরআনের সেই আয়াতের দিকে যাওয়া, “আল্লাহর রহমত হতে তোমরা নিরাশ হয়ো না। কারণ কাফের সম্প্রদায় ব্যতীত আল্লাহর রহমত হতে কেউ নিরাশ হয় না। (সূরা ইউসুফ:৮৭) ” আল্লাহ আরও বলেন, হতাশ হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না, বিজয়ী তোমরা হবেই যদি তোমরা মুমিন হও। এইভাবে দয়ালু আল্লাহ অনেক অনেক আশ্বাস, অভয়বাণী, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে রেখেছেন তাদের জন্য যারা চুক্তিতে ঠিক থাকবে। এখন আমাদের একমাত্র কাজ আবার আল্লাহর সঙ্গে যে চুক্তি আমরা করে এসেছি সেই চুক্তিতে ফিরে আসা। শেষ নবী সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে একা দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ নামক চুক্তির। দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে ডাক দিয়ে বললেন, তোমরা শুধু এটুকু ঘোষণা দাও- হুকুমদাতা হিসাবে এক আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে মানি না। তাহলে তোমরা সফলকাম হয়ে যাবে এ জীবনে এবং পরজীবনে। এখন আমাদের একমাত্র কাজ মেরুদণ্ড সোজা করে, বুক টান করে, মাথা উচু করে আবার চুক্তিতে ফেরার ঘোষণা দেওয়া। কোন ভয়ভীতি, রক্তচক্ষু, শক্তি, হিংস্রতা, বর্বরতা কোন কিছুর পরোয়া না করে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য উঠে দাঁড়াতে হবে। তবেই আসবে আমাদের জন্য আল্লাহর সাহায্য, আসন্ন বিজয় এবং পরকালে মহাপুরস্কার জান্নাত।
আর কতদিন চলবে প্রভুদের গোলামী?
আর কতদিন চলবে প্রভুদের গোলামী?
[মাহবুব আলী]
ব্রিটিশ খ্রিস্টানরা পুরো ভারতবর্ষের উপরে নিরঙ্কুশ শাসনক্ষমতার অধিকারী হয়েছিল প্রায় দুইশত বছর। তখন তাদের নিজেদের দেশে ছিল রাজতন্ত্র আর আমরা, তাদের দখলকৃত এলাকার অধিবাসীরা ছিলাম তাদের পদানত দাস। একটি জাতি যখন দুইশত বছর অন্যের দাস থাকে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাদের চিন্তা চেতনায় এই দাসত্ব স্থায়ী আসন গেঁড়ে বসে। তারা স্বাধীন চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে ফেলে, প্রভুর হুকুমের জন্য সদা তটস্থ থাকে। এ জাতিটিরও সেটাই হয়েছে। তাদেরকে যখন সাম্রাজ্যবাদীরা ‘নামকাওয়াস্তে’ স্বাধীনতা ভিক্ষা দিয়ে গেল তখন তাদের মনে এ প্রশ্নও জাগলো না যে, প্রভুরা যে তাদেরকে গণতন্ত্র মেনে চলার জন্য উপায় বাতলে দিয়ে গেলো, তারা নিজেরা কি এতবছর এই গণতন্ত্র মেনে শাসন করেছিল? তারা কি এই দু’শ বছরে জনগণের একটি মতামতেরও পরোয়া করেছে? করে নি। তাদের কোন বড়লাট দূরের কথা, কোন এলাকার ক্ষুদ্র জমিদারও কি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন? যদি তারা কেউ জনগণের মতামতের জন্য নির্বাচন করতেন, পোস্টার ছাপাতেন, জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতারোহণ করার পদ্ধতি অবলম্বন করতেন তবে এক বছরের বেশি ব্রিটিশ শাসকেরা এদেশে থাকতে পারতো কি না সন্দেহ। অথচ তারা ভারতবর্ষ থেকে চলে যাওয়ার সময় গণতন্ত্র নামে একটি অসংলগ্ন, অসামঞ্জস্যপূর্ণ, উদ্ভট জীবন ব্যবস্থা যার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিক সম্পূর্ণ বিপরীত, তা এই জাতির উপরে চাপিয়ে দিয়ে গেছে। আমরা ভাবলাম, আমরা বুঝি তাদের ভারত থেকে তাড়িয়েছি। আসলে তখন তারা এটুকু নিশ্চিন্ত হয়েছে যে এখন আর তাদের এদেশে স্বশরীরে থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শাসন-প্রশাসন চালানোর প্রয়োজন নেই। তারা তখনই এদেশ থেকে গেছে যখন তারা পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হয়েছে যে, এদেশের শিক্ষিত মানুষগুলি যাদের হাতে তারা ক্ষমতার রশি ধোরিয়ে দিয়ে গেলো তারা এতটাই গোলাম যে তাদেরকে স্বাধীনতা দিয়ে গেলেও তারা সাদা চামড়ার প্রভুদের অবাধ্য হবে না, সাত সমুদ্দুরের পার থেকেও প্রভুর হুকুমে ওঠ্-বস করবে। বাস্তবেও তাই হলো। বিদেশিরা চলে যাওয়ার পর থেকে এ জাতির জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শুরু হলো ক্রমাবনতি। ব্রিটিশ আমলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যা ছিল এখন তার চেয়ে বহুগুণ খারাপ, তখন এ জাতি যতটা দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল এখন তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অসৎ। যে কোন পরিসংখ্যান দেখলেই আমার কথার সত্যতা মিলবে। প্রশ্ন হলো, আমাদের এই এলাকায় গণতন্ত্র এমন নিদারুণভাবে ব্যর্থ হলো কেন?
এর কারণ এই ব্যবস্থাটি এদেশের মানুষের চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস, সাংস্কৃতিক, সামাজিক কাঠামো ইত্যাদির সঙ্গে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়, শুধুমাত্র গায়ের জোরে গত ৭৩ বছর ধরে এটা এতদ অঞ্চলের মানুষকে গেলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এই চেষ্টা চালানো হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবাধীন মিডিয়া এবং তাদের তৈরি শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে। তারা সর্ব উপায়ে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে যে গণতন্ত্রই সেরা জীবনব্যবস্থা। প্রচারে প্রসার, তাই পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত গোলামি মানসিকতাবিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও সাধারণ মানুষ আজ প্রভুদের চাপিয়ে দেওয়া জীবনপদ্ধতি তাদেরকে শান্তি ও নিরাপত্তা দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হলেও এর বাইরে তাদের চিন্তা করার সামর্থ্য নেই। পশ্চিম থেকে শ্লোগান তোলা হয়, গণতন্ত্রেই মুক্তি আর তাদের এদেশীয় তল্পীবাহকের দল দিনরাত টক-শো, বিবৃতি, বক্তৃতায় সেই শ্লোগানে গলা মেলায়। তারা গোলামি করার ব্যাপারে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে, দেশের মানুষের ভালোমন্দ তাদের বিবেচ্য নয়, যেটুকু দেশপ্রেম তারা দেখায় সেটুকু শুধু ভোট পাওয়া জন্য।
আমাদের একটি নিজস্ব জীবনব্যবস্থা না থাকলে না হয় কথা ছিল যে, আমরা নিরুপায় হয়ে আইন-বিধানের জন্য অন্যের দ্বারস্থ হচ্ছি। কিন্তু তা তো নয়। মহান আল্লাহ আমাদেরকে অনুপম ভারসাম্যযুক্ত, একটি নিখুঁত পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা আখেরী নবী মোহাম্মদ (দ:) এর মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। আল্লাহর দেওয়া ঐ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে আজও পশ্চিমা প্রভুদের শেখানো, পড়ানো, দেখানো, গেলানো অকার্যকর জীবনব্যবস্থাটিকে বেদবাক্যের মত মেনে চলার চেষ্টা করছি। সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় একটি মহাজাতি হওয়ার জন্য একটি কর্মসূচিও আল্লাহ দিয়েছেন। গত ৭৩ বছরের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব থেকে মুক্তির পথ আমরা আল্লাহর রহমে পেয়েছি এবং সেটা আপনাদের সামনে তুলেও ধরছি। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা।
এর কারণ এই ব্যবস্থাটি এদেশের মানুষের চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস, সাংস্কৃতিক, সামাজিক কাঠামো ইত্যাদির সঙ্গে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়, শুধুমাত্র গায়ের জোরে গত ৭৩ বছর ধরে এটা এতদ অঞ্চলের মানুষকে গেলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এই চেষ্টা চালানো হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবাধীন মিডিয়া এবং তাদের তৈরি শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে। তারা সর্ব উপায়ে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে যে গণতন্ত্রই সেরা জীবনব্যবস্থা। প্রচারে প্রসার, তাই পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত গোলামি মানসিকতাবিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও সাধারণ মানুষ আজ প্রভুদের চাপিয়ে দেওয়া জীবনপদ্ধতি তাদেরকে শান্তি ও নিরাপত্তা দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হলেও এর বাইরে তাদের চিন্তা করার সামর্থ্য নেই। পশ্চিম থেকে শ্লোগান তোলা হয়, গণতন্ত্রেই মুক্তি আর তাদের এদেশীয় তল্পীবাহকের দল দিনরাত টক-শো, বিবৃতি, বক্তৃতায় সেই শ্লোগানে গলা মেলায়। তারা গোলামি করার ব্যাপারে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে, দেশের মানুষের ভালোমন্দ তাদের বিবেচ্য নয়, যেটুকু দেশপ্রেম তারা দেখায় সেটুকু শুধু ভোট পাওয়া জন্য।
আমাদের একটি নিজস্ব জীবনব্যবস্থা না থাকলে না হয় কথা ছিল যে, আমরা নিরুপায় হয়ে আইন-বিধানের জন্য অন্যের দ্বারস্থ হচ্ছি। কিন্তু তা তো নয়। মহান আল্লাহ আমাদেরকে অনুপম ভারসাম্যযুক্ত, একটি নিখুঁত পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা আখেরী নবী মোহাম্মদ (দ:) এর মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। আল্লাহর দেওয়া ঐ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে আজও পশ্চিমা প্রভুদের শেখানো, পড়ানো, দেখানো, গেলানো অকার্যকর জীবনব্যবস্থাটিকে বেদবাক্যের মত মেনে চলার চেষ্টা করছি। সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় একটি মহাজাতি হওয়ার জন্য একটি কর্মসূচিও আল্লাহ দিয়েছেন। গত ৭৩ বছরের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব থেকে মুক্তির পথ আমরা আল্লাহর রহমে পেয়েছি এবং সেটা আপনাদের সামনে তুলেও ধরছি। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা।
মোসলেম বিশ্বে প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা নতুন করে ভাবার সময় এসেছে
মোসলেম বিশ্বে প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা নতুন করে ভাবার সময় এসেছে
প্রাগৈতিহাসিক তথা প্রাচীনকাল থেকেই শিক্ষা মানব জীবনের বেঁচে থাকা, প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন- তথা মানব সম্পদ সৃষ্টির অন্যতম অনুষঙ্গ। শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ প্রকৃত আত্মপরিচয় লাভ করে, তার আশপাশের পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনা করে মানব উন্নয়নে যথার্থ অবদান রাখতে পারে। তাই মানবজাতির সামগ্রিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় শিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তবে সে শিক্ষাকে অবশ্যই সুশিক্ষা হতে হবে। যে শিক্ষা মানুষকে আলোর সন্ধান দেয় না, যে শিক্ষা মানব উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, মানুষকে পশ্চাদপদ করে রাখে, স্রষ্টার দানকৃত জ্ঞানের সঠিক মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়, সে শিক্ষা কখনোই সুশিক্ষা নয়। ঐ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত হয়ে মানুষ মানবতার কল্যাণ সাধন করতে সক্ষম হয় না, বরং তা অকল্যাণের আধারে পরিণত হয়। মোসলেম বিশ্বে প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার অবস্থা তেমনই। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ মাদ্রাসা চালু রয়েছে। প্রতিদিন কোটি কোটি মোসলেম পরিবারের ছেলে-মেয়ে সেখানে শিক্ষালাভ করছে। কিন্তু সেটা কোন শিক্ষা? তারা এমন শিক্ষা লাভ করছে যে শিক্ষা মানুষের উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, যে শিক্ষা একুশ শতকের মানবজাতির অন্যতম হাতিয়ার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অকল্পনীয় আবিষ্কার রেডিও-টেলিভিশনের জায়েজ-নাজায়েজ নিয়ে প্রশ্ন তোলে, যে শিক্ষা মানুষের হিতাহিত বোধ লুপ্ত করে দেয়, মানুষকে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রেখে অন্ধত্বকে প্রতিষ্ঠা করে, যে শিক্ষায় মানুষের মন-মগজকে আবদ্ধ রাখা হয় একটি নির্দিষ্ট সময় ও স্থানের ক্ষুদ্র পরিধির মধ্যে, আর তার বাইরের পৃথিবী থেকে যায় অজানা। এমন শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষুদ্র কুটিরে বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে আবদ্ধ করে রেখে বর্তমান মোসলেম জাতি কস্মিনকালেও কাক্সিক্ষত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারবে না। তার মানে এই নয় যে, মোসলেম জাতি শিক্ষার্জন বন্ধ করে অশিক্ষার তিমিরে প্রবেশ করবে। আমার কথা হলো তারা যে শিক্ষা অর্জন করবে তা যেন সুশিক্ষা হয়, অশিক্ষা না হয়। আর তার জন্যই সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় উপযুক্ত পরিবর্তন সাধন করে বিরাট আকারের এই মাদ্রাসা পড়–য়া শিক্ষার্থীর প্রকৃত শিক্ষা নিশ্চিত করা। কারণ, মোসলেম জাতিকে আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। শিক্ষা-দীক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, আবিষ্কার ও যথাযথ ব্যবহার তথা জাতীয় অগ্রগতির ক্ষেত্রে তারা আজ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। অথচ তাদেরই রচিত করা স্তম্ভের উপর আজকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইমারত দাঁড়িয়ে আছে। সেই স্বর্ণযুগকে আবারও ফিরিয়ে আনতে হবে। আমি আবারও বলছি- এই জাতিকে অশিক্ষা নয়, প্রকৃত শিক্ষার চর্চা করতে হবে। হয় প্রচলিত মাদ্রাসার চার দেয়ালের বন্ধন ছাড়তে হবে, নয় তো সে মাদ্রাসাকেই পরিণত করতে হবে আধুনিক শিক্ষার কেন্দ্রভূমিতে। আমি নিশ্চিত যে, আমার এই কথায় আপত্তির কোনো অন্ত থাকবে না। কারণ বর্তমান মোসলেম জাতির কাছে না যুক্তির মূল্য আছে, না জ্ঞানের। এই জাতির জ্ঞান, বিবেক-বুদ্ধি গচ্ছিত রাখা হয়েছে ধর্মব্যবসায়ীদের মস্তকে। আর ধর্মব্যবসায়ী মোল্লা-পুরুতরা জ্ঞানের অহংকারে এতটাই স্ফীত যে যুক্তের দাম তারা দিতে জানে না। আমার কথায় সবচেয়ে বেশি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠবে এই শ্রেণিটি। কিন্তু তারপূর্বে অন্তত একবার নিচে তুলে ধরা যুক্তিগুলো নিরপেক্ষ মনে বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করছি।
১। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা ও ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র:
ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীরা সামরিক শক্তিবলে মোসলেম নামধারী এই জাতিটির প্রায় সম্পূর্ণ ভৌগোলিক অংশ দখল করার পর সর্বপ্রথম যে বৃহৎ পদক্ষেপ নিল তাহলো শিক্ষাব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করা। উদ্দেশ্য- পদানত এই জাতিকে এমন একটা এসলাম শিক্ষা দেয়া যাতে তাদের চরিত্র প্রকৃতপক্ষেই একটা পরাধীন দাস জাতির চরিত্রে পরিণত হয়, তারা কোনদিন তাদের প্রভুদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার চিন্তাও না করে। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে তারা কী কী পদক্ষেপ নিয়েছিল এবং কীভাবে সফল হয়েছিল তা বোঝাতে আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশকেই আলোচনায় আনা যাক। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে দাস সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য নিয়ে এই উপমহাদেশে আগত খ্রিস্টান প্রাচ্যবিদরা সর্বপ্রথম বহু গবেষণা করে তাদের মনমত Syllabus I Curricullum তৈরি করে। এরপর এই উপমহাদেশের ভাইসরয় বড়লাট লর্ড ওয়ারেন হেসটিংকস ১৭৮০ সনে তদানীন্তন রাজধানী কোলকাতায় আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে ঐ সিলেবাস ও কারিকুলাম চালু করলো। এই শিক্ষাব্যবস্থায় এসলাম ও মোসলেম জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রসরূপ নিুলিখিত বিকৃতিগুলো চালু করা হলো-
(ক) প্রাচ্যবিদদের তৈরি করা সিলেবাস ও কারিকুলামে এসলামের আত্মা তওহীদের অর্থ বিকৃত করা হলো। লা এলাহা এল্লাল্লাহ-র অর্থ প্রকৃত ‘আল্লাহ ছাড়া হুকুমদাতা নেই’কে বদলিয়ে করা হলো- আল্লাহ ছাড়া উপাস্য নেই, যেটাকে আরবিতে ভাষান্তর করলে হয়- লা মা’বুদ এল্লাল্লাহ।
(খ) ব্রিটিশ শাসকরা এই মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে প্রধানতঃ বিতর্কিত বিষয়গুলির প্রাধান্য দিল, যেগুলো অতি আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল এমামদের এবং তাদের অনুসারীদের মধ্যে, কোর’আনের আয়াতের ব্যাখ্যা নিয়ে।
(গ) খ্রিস্টান প্রাচ্যবিদদের তৈরি ঐ এসলামে কোর’আনের গুরুত্ব একেবারে কমিয়ে দিয়ে সেখানে হাদিসের প্রবল প্রাধান্য দেয়া হলো। কারণ হাসিদের মাধ্যমে বেশি বিভ্রান্তি ছড়ানো যায়। কিন্তু কোর’আনে সেটার সুযোগ খুবই কম।
(ঘ) তারা তাদের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় তাদের তৈরি করা বিকৃত এসলামে যে শিক্ষা-ব্যবস্থা চালু কোরল তাতে অংক, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, ভূগোল, ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থ-বিজ্ঞান, জীব-বিদ্যা ইত্যাদির কোন কিছুই রাখা হলো না। খ্রিস্টানরা এটা এই উদ্দেশ্যে কোরল যে, তাদের মাদ্রাসায় শিক্ষিত এই মানুষগুলো যেন ওখান থেকে বেরিয়ে যেয়ে তাদের শেখানো বিকৃত এসলামটাকে বিক্রি করে পয়সা উপার্জন করা ছাড়া আর কোন পথে উপার্জন করতে না পারে।
এ শিক্ষাব্যবস্থায় অর্ধশতাব্দীর পর্যবেক্ষণের পর তারা যখন দেখলো যে- এ থেকে তাদের আশানুরূপ ফল আসছে না, তখন মোসলেম বলে পরিচিত এই জাতিটাকে নিজেদের তৈরি বিকৃত এসলামের মাধ্যমে চিরদিনের জন্য পঙ্গু, অথর্ব করে নিজেদের শাসন দীর্ঘদিনের জন্য পাকাপোখ্ত করার এই জঘন্য পরিকল্পনা যাতে বিঘিœত না হয় সেজন্য ১৮৫০ সালে ব্রিটিশ খ্রিস্টান শাসকরা তাদের প্রতিষ্ঠিত আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদটিও নিজেদের হাতে নিয়ে নিল। প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হলেন ডঃ ¯িপ্রংগার। তারপর একাধিক্রমে ২৬ জন খ্রিস্টান ৭৬ বৎসর (১৮৫০-১৯২৭) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদে আসীন থেকে এই মুসলিম জাতিকে এসলাম শিক্ষা দিলেন। দীর্ঘ ১৪৬ বছর এসলাম শিক্ষা দেবার পর ব্রিটিশরা যখন নিশ্চিত হলো যে, তাদের তৈরি করা বিকৃত এসলামটা তারা এ জাতির হাড়-মজ্জায় ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে এবং আর তারা কখনও এটা থেকে বের হতে পারবে না তখন তারা ১৯২৭ সনে তাদের আলীয়া মাদ্রাসা থেকেই শিক্ষিত মওলানা শামসুল ওলামা কামাল উদ্দিন আহমেদ (এম.এ.আই.আই.এস) এর কাছে অধ্যক্ষ পদটি ছেড়ে দিল। [দেখুন- আলীয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, মূল- আ: সাত্তার, অনুবাদ- মোস্তফা হারুণ, ইসলামী ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ এবং Reports on Islamic Education and Madrasah Education in Bengal by Dr. Sekander Ali Ibrahimy (Islami Foundation Bangladesh)। এটা শুধু আমাদের এই উপমহাদেশেই ঘটেছে তা নয়, একই পলিসি ইউরোপীয়ানরা তাদের অধিকৃত অন্যান্য অঞ্চলগুলোতেও কার্যকর করে। তাদের সেই ষড়যন্ত্রের ফসল আজকের মাদ্রাসাগুলো। আলীয়া মাদ্রাসার বাইরে কওমী ধাচের যে মাদ্রাসাগুলো আমাদের দেশে চলছে সেগুলোর অবস্থা আরও করুণ। এদের অন্ধত্ব ও পশ্চাদমুখীতা সর্বব্যাপী সমালোচিত। এদের জ্ঞান-বুদ্ধি, মস্তিষ্ক ও বিবেক সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে হাদিস-কোর’আনের পাতা, আরবি-ফারসি-উর্দু ভাষা ও দাড়ি-টুপি, পাঞ্জাবি, পাজামা, ঢিলা-কুলুখের ভেতরে। এর বাইরের পৃথিবী এদের অপরিচিত। এদের দ্বারা মানবজাতির অগ্রগতি, উন্নতি বা কল্যাণ সাধন অসম্ভব। কাজেই তাদের সম্পর্কে আলাদা করে কিছু বলার নেই।
২। শিক্ষার উদ্দেশ্যই যখন অনুপস্থিত: মানুষ শিক্ষা লাভ করে কেন? সে শিক্ষাকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে মানবজাতির উন্নয়ন সাধনের জন্য, তাই নয় কি? একজন মানুষ সর্বপ্রথম তার স্রষ্টা সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করবে। স্রষ্টার সাথে তার সম্পর্ক নির্ণয় করবে। মানুষ হিসেবে স্রষ্টা তাকে কী কাজ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তার ধারণা লাভ করবে। সে এই প্রশ্নের উত্তর বের করবে যে, ‘আমি কে? আমি কোথা থেকে আসলাম? আমাকে কে সৃষ্টি করেছেন? কেন সৃষ্টি করেছেন এবং এখন আমার কাজ কী?’ এ প্রশ্নগুলোর যথাযথ উত্তর লাভ করাই হলো একটি শিশুর প্রাথমিক জ্ঞান। এই জ্ঞানকে পুঁজি করে সে তার পরবর্তী জীবনের কর্মপদ্ধতি নির্দিষ্ট করবে। সে জানবে যে, “আমি মানুষ, আমাকে স্রষ্টা আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। আর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে। স্রষ্টার ন্যায়সঙ্গত বিধান দিয়ে এই পৃথিবীকে পরিচালনা করে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই হলো আমার লক্ষ্য। যতদিন পৃথিবীতে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গভিত্তিক মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকবে, পৃথিবীতে অন্যায়-অবিচার, নিপীড়ন অব্যাহত থাকবে ততদিন আমার জীবন অসম্পূর্ণ থাকবে। আমার লক্ষ্য অবাস্তবায়িত থাকবে।” এই শিক্ষা যখন একজন মানুষ তার শিক্ষাজীবনে লাভ করবে তখন তার দ্বারা কি কোনো অন্যায় কাজ করা সম্ভব? সে কি কখনো অন্ধত্বকে পুঁজি করে বিশ্ব অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে? সে কি কস্মিনকালেও ধর্মীয় উন্মাদনা বা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতে পারে? মানুষে মানুষে বিভেদের প্রাচীর খাড়া করতে পারে? পারে না। কিন্তু আজকের মাদ্রাসা শিক্ষিত শ্রেণিটির দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা কী দেখতে পাই? মানুষে মানুষে যত রকমের বিভেদের প্রাচীর দাঁড় করানো সম্ভব তার কোনোটাই এই ধর্মব্যবসায়ী মাদ্রাসা শিক্ষিত শ্রেণিটি বাদ রাখে নি। এমনকি তারা নিজেরা নিজেরাও একতাবদ্ধ নয়। হানাফি, হাম্বলি, মালেকি, শাফেয়ি, আহমদী, মোহাম্মদী, আহলে হাদিস, শিয়া, সুন্নি, কওমী ইত্যাদি শত শত ফেরকা-মজহাবের প্রাচীর দাঁড়িয়ে রয়েছে এদের নিজেদের মধ্যেই। এক ফেরকার সাথে আরেক ফেরকার দ্বন্দ্ব-বিবাদ, রক্তারক্তি চলছে প্রজন্মের পর প্রজন্মব্যাপী। আর এই বিভেদের মন্ত্র তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লাভ করছে বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মাদ্রাসার মাধ্যমে। পশ্চিমারা ঠিক এটাই চেয়েছিল।
৩। ধর্মব্যবসা নামক গুরুতর অন্যায়ের প্রশ্রয়: মাদ্রাসাগুলো থেকে শিক্ষালাভ করে যারা বের হন তারাই সমাজে পরিচিত হন মাওলানা, মোহাদ্দিস, মোফাসসির, আলেম-ওলামা, হাফেজ, কামেল, পীর, বুজুর্গ, মুফতি ইত্যাদি হিসেবে। সমাজে এদের ভূমিকা সম্পর্কে আমরা সকলেই জানি। ধর্মীয় ফতোয়া দেওয়া, কোর’আন পড়া, মৃতের জানাজা-দাফন-কাফন সম্পন্ন করা, মিলাদ পড়া, জিকির করা, চল্লিশার দাওয়াত খাওয়া, নামাজে ইমামতি করা, মাহফিলে ওয়াজ করা, দান সংগ্রহ করা ইত্যাদি কাজ মূলত করে এরাই। আর এভাবেই সংসার চলে অধিকাংশ মাওলানা-আলেম সাহেবদের। এ সকল ধর্মীয় কাজের মধ্যে ব্যাপৃত থাকায় তারা কোনো কায়িক শ্রম বা অন্য কোনোভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন না বা করেন না। সমাজের আর দশটা মানুষের মতো তারা স্বাবলম্বী নন। কার্যত তাদের জীবন-সংসার চলে পরজীবী বেশে। এদের মধ্যে এমনও ব্যক্তি আছেন যারা ওয়াজ-নসিহত করে রাতারাতি লাখপতিও বনে যান। মাদ্রাসা শিক্ষিত শ্রেণিটির এই পরজীবী চরিত্রের কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। এখন দেখা যাক, এদের এই কাজ এসলামের দৃষ্টিতে বৈধ কি না।
প্রকৃতপক্ষে ধর্ম কোনো পণ্য নয়, ধর্মীয় কাজ কোনো পেশা নয়। মানুষ ধর্মীয় কাজ করবে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার আশায়, এর বিনিময়ও গ্রহণ করবে কেবল আল্লাহর কাছ থেকে। আল্লাহর সকল নবী-রসুল এই কথা ঘোষণা দিয়েছেন যে, ‘আমি তোমাদের কাছে কোন বিনিময় চাই না, আমার বিনিময় আল্লাহর কাছে।’ (আল কোর’আন- হুদ: ২৯, হুদ: ৫১, শুয়ারা: ১৪৫, শুয়ারা: ১৮০, ইউসুফ: ১০৪) সুতরাং তাঁদের উম্মতের জন্যও একই বিধান। কিন্তু তা না করে যখন কেউ কিছু ধর্মীয় জ্ঞান আয়ত্ব করে সেটাকে পুঁজি করে অর্থ উপার্জন করে তখন আর সেটা ধর্মের কাজ হয় না, সেটা ব্যবসা হয়। পবিত্র কোর’আনে এবং হাদিসে ধর্মব্যবসার সবগুলি ধরণ সম্পর্কেই নিষেধাজ্ঞা ঘোষিত হয়েছে, ধর্মকে বিক্রি করে পার্থিব সুযোগ সুবিধা, সম্পদ হাসিলের কোন সুযোগ আল্লাহ রাখেন নি। তিনি একে কেবল হারামই করেন নি, তিনি বলেছেন, যারা এটা করে তারা পথভ্রষ্ট, তারা আগুন ছাড়া কিছুই খায় না। তিনি আখেরাতে তাদেরকে পবিত্র করবেন না, তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না এবং তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। (সুরা আল বাকারা ১৭৪)। এছাড়াও আল্লাহ সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, তোমরা তাদের অনুরসণ করো যারা বিনিময় গ্রহণ করে না এবং সঠিক পথে আছে (সুরা ইয়াসীন ২১)। সে হিসেবে মোসলেম বিশ্বে বিশাল-বিস্তৃত ডানা মেলে বসে থাকা মাদ্রাসাশিক্ষিত ধর্মজীবী পুরোহিত শ্রেণির অবস্থান কোথায় দাঁড়াল? বস্তুত এই ধর্মজীবীরা শুধু নিজেরাই জাহান্নামের দিকে যাচ্ছে না, সাথে আমাদেরকেও নিয়ে যাচ্ছে। আর সে পথ সুগম করছে মোসলেম বিশ্বে প্রচলিত লক্ষ লক্ষ মাদ্রাসায় প্রদত্ত বিকৃত শিক্ষা। একটি সহজ সরল শিশু পবিত্র হৃদয়ে মাদ্রাসায় প্রবেশ করছে। কিন্তু এরপর সেখান থেকে শিক্ষালাভ করে ধর্মব্যবসায়ী আগুনখোর, অপবিত্র ও পরজীবী হয়ে বের হয়ে আসছে। এমন শিক্ষাব্যবস্থা বজায় রাখার কোনো যৌক্তিকতা আছে কি? আমাদের বিবেক কী বলে?
৪। জঙ্গিবাদের প্রজননক্ষেত্র: এসলামের বিকৃত ব্যাখ্যা থেকেই জঙ্গিবাদের জন্ম। জঙ্গিদেরকে শেখানো হয় অমুক নাস্তিক, অমুক কাফের, অমুককে মারলে জান্নাত নিশ্চিত। এসব বলে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে সুবিধা আদায় করে ধর্মব্যবসায়ীরা। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, অধিকাংশ জঙ্গিবাদী গ্র“পের নেতারাই মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষালাভ করে জঙ্গি হয়েছে। মাদ্রাসাগুলো প্রথমে তাদেরকে ধর্মব্যবসায়ী বানিয়েছে, আর এ ধর্ম নিয়ে ব্যবসাই হচ্ছে ধর্মভিত্তিক অপ-রাজনীতি ও জঙ্গিবাদের সূতিকাগার। ধর্মব্যবসায়ীরা যেটাকে ইসলাম বলে পালন করছে, মসজিদে-খানকায়, ওয়াজ মাহফিলে প্রচার করছে, মাদ্রাসার মাধ্যমে ছেলে-মেয়েদেরকে শিক্ষা দিচ্ছে সেটা আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলাম নয়। প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা যারা লাভ করবে তারা কোনদিন জঙ্গি হবে না, তারা আইন অমান্যকারী হবে না, বিশৃঙ্খল হবে না, তারা হবে মানবতার কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ। কাজেই জঙ্গিবাদের বিলুপ্তি সাধনের পূর্বশর্ত হলো ধর্মব্যবসার বিলুপ্তি সাধন। আর ধর্মব্যবসার বিলুপ্তি সাধনের পূর্বশর্ত হলো প্রচলিত মাদ্রাসাব্যবস্থায় বিকৃত শিক্ষা প্রদান বন্ধ করে প্রকৃত এসলামের শিক্ষা প্রদান করা। পৃথিবীতে মোসলেমদের পরাজিত, নিপীড়িত, অত্যাচারিত যে অবয়ব সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে অন্যতম কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মোসলেমের অজ্ঞতা ও ধর্মীয় নেতাদের কথিত জ্ঞানের অহংকার। এ দুটোই সৃষ্টি হয়েছে এসলামের প্রকৃত শিক্ষার অভাবে। শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী এই জাতি মাদ্রাসায় শিক্ষালাভ করছে, লক্ষ লক্ষ আলেম তৈরি হচ্ছে, কোর’আনের হাফেজ তৈরি হচ্ছে, কিন্তু তারা কি জাতিকে অন্যায়-অবিচারের গ্লানি থেকে মুক্ত করতে পেরেছে? তারা কি অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাতির পরাজয় ঠেকাতে পেরেছে? পারে নি, কারণ মাদ্রাসা পড়ে বহু আলেম-বুজুর্গ, হাফেজ তৈরি হলেও উম্মতে মোহাম্মদী তৈরি হচ্ছে না, মো’মেন তৈরি হচ্ছে না। তাই জাতির বিজয়ও আসছে না। জাতি অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে টিকতে পারছে না। তাই আজ সময় এসেছে। মোসলেম জাতিকে পৃথিবীব্যাপী এসলাম শিক্ষার জন্য যে ব্যবস্থা আছে সেটার যথার্থতা নিয়ে ভাবতে হবে। আমি বলছি না, মাদ্রাসা বন্ধ করে দিতে হবে। মাদ্রাসা বন্ধ করলেই সমস্যার সমাধান হবে- এমন নিশ্চয়তা আমি দিতে পারবো না। কিন্তু পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের ফাঁদ থেকে তো আমরা বের হতেই পারি। সে চেষ্টাতেই এখন আমাদের মশগুল হওয়া উচিত।
১। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা ও ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র:
ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীরা সামরিক শক্তিবলে মোসলেম নামধারী এই জাতিটির প্রায় সম্পূর্ণ ভৌগোলিক অংশ দখল করার পর সর্বপ্রথম যে বৃহৎ পদক্ষেপ নিল তাহলো শিক্ষাব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করা। উদ্দেশ্য- পদানত এই জাতিকে এমন একটা এসলাম শিক্ষা দেয়া যাতে তাদের চরিত্র প্রকৃতপক্ষেই একটা পরাধীন দাস জাতির চরিত্রে পরিণত হয়, তারা কোনদিন তাদের প্রভুদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার চিন্তাও না করে। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে তারা কী কী পদক্ষেপ নিয়েছিল এবং কীভাবে সফল হয়েছিল তা বোঝাতে আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশকেই আলোচনায় আনা যাক। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে দাস সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য নিয়ে এই উপমহাদেশে আগত খ্রিস্টান প্রাচ্যবিদরা সর্বপ্রথম বহু গবেষণা করে তাদের মনমত Syllabus I Curricullum তৈরি করে। এরপর এই উপমহাদেশের ভাইসরয় বড়লাট লর্ড ওয়ারেন হেসটিংকস ১৭৮০ সনে তদানীন্তন রাজধানী কোলকাতায় আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে ঐ সিলেবাস ও কারিকুলাম চালু করলো। এই শিক্ষাব্যবস্থায় এসলাম ও মোসলেম জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রসরূপ নিুলিখিত বিকৃতিগুলো চালু করা হলো-
(ক) প্রাচ্যবিদদের তৈরি করা সিলেবাস ও কারিকুলামে এসলামের আত্মা তওহীদের অর্থ বিকৃত করা হলো। লা এলাহা এল্লাল্লাহ-র অর্থ প্রকৃত ‘আল্লাহ ছাড়া হুকুমদাতা নেই’কে বদলিয়ে করা হলো- আল্লাহ ছাড়া উপাস্য নেই, যেটাকে আরবিতে ভাষান্তর করলে হয়- লা মা’বুদ এল্লাল্লাহ।
(খ) ব্রিটিশ শাসকরা এই মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে প্রধানতঃ বিতর্কিত বিষয়গুলির প্রাধান্য দিল, যেগুলো অতি আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল এমামদের এবং তাদের অনুসারীদের মধ্যে, কোর’আনের আয়াতের ব্যাখ্যা নিয়ে।
(গ) খ্রিস্টান প্রাচ্যবিদদের তৈরি ঐ এসলামে কোর’আনের গুরুত্ব একেবারে কমিয়ে দিয়ে সেখানে হাদিসের প্রবল প্রাধান্য দেয়া হলো। কারণ হাসিদের মাধ্যমে বেশি বিভ্রান্তি ছড়ানো যায়। কিন্তু কোর’আনে সেটার সুযোগ খুবই কম।
(ঘ) তারা তাদের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় তাদের তৈরি করা বিকৃত এসলামে যে শিক্ষা-ব্যবস্থা চালু কোরল তাতে অংক, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, ভূগোল, ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থ-বিজ্ঞান, জীব-বিদ্যা ইত্যাদির কোন কিছুই রাখা হলো না। খ্রিস্টানরা এটা এই উদ্দেশ্যে কোরল যে, তাদের মাদ্রাসায় শিক্ষিত এই মানুষগুলো যেন ওখান থেকে বেরিয়ে যেয়ে তাদের শেখানো বিকৃত এসলামটাকে বিক্রি করে পয়সা উপার্জন করা ছাড়া আর কোন পথে উপার্জন করতে না পারে।
এ শিক্ষাব্যবস্থায় অর্ধশতাব্দীর পর্যবেক্ষণের পর তারা যখন দেখলো যে- এ থেকে তাদের আশানুরূপ ফল আসছে না, তখন মোসলেম বলে পরিচিত এই জাতিটাকে নিজেদের তৈরি বিকৃত এসলামের মাধ্যমে চিরদিনের জন্য পঙ্গু, অথর্ব করে নিজেদের শাসন দীর্ঘদিনের জন্য পাকাপোখ্ত করার এই জঘন্য পরিকল্পনা যাতে বিঘিœত না হয় সেজন্য ১৮৫০ সালে ব্রিটিশ খ্রিস্টান শাসকরা তাদের প্রতিষ্ঠিত আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদটিও নিজেদের হাতে নিয়ে নিল। প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হলেন ডঃ ¯িপ্রংগার। তারপর একাধিক্রমে ২৬ জন খ্রিস্টান ৭৬ বৎসর (১৮৫০-১৯২৭) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদে আসীন থেকে এই মুসলিম জাতিকে এসলাম শিক্ষা দিলেন। দীর্ঘ ১৪৬ বছর এসলাম শিক্ষা দেবার পর ব্রিটিশরা যখন নিশ্চিত হলো যে, তাদের তৈরি করা বিকৃত এসলামটা তারা এ জাতির হাড়-মজ্জায় ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে এবং আর তারা কখনও এটা থেকে বের হতে পারবে না তখন তারা ১৯২৭ সনে তাদের আলীয়া মাদ্রাসা থেকেই শিক্ষিত মওলানা শামসুল ওলামা কামাল উদ্দিন আহমেদ (এম.এ.আই.আই.এস) এর কাছে অধ্যক্ষ পদটি ছেড়ে দিল। [দেখুন- আলীয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, মূল- আ: সাত্তার, অনুবাদ- মোস্তফা হারুণ, ইসলামী ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ এবং Reports on Islamic Education and Madrasah Education in Bengal by Dr. Sekander Ali Ibrahimy (Islami Foundation Bangladesh)। এটা শুধু আমাদের এই উপমহাদেশেই ঘটেছে তা নয়, একই পলিসি ইউরোপীয়ানরা তাদের অধিকৃত অন্যান্য অঞ্চলগুলোতেও কার্যকর করে। তাদের সেই ষড়যন্ত্রের ফসল আজকের মাদ্রাসাগুলো। আলীয়া মাদ্রাসার বাইরে কওমী ধাচের যে মাদ্রাসাগুলো আমাদের দেশে চলছে সেগুলোর অবস্থা আরও করুণ। এদের অন্ধত্ব ও পশ্চাদমুখীতা সর্বব্যাপী সমালোচিত। এদের জ্ঞান-বুদ্ধি, মস্তিষ্ক ও বিবেক সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে হাদিস-কোর’আনের পাতা, আরবি-ফারসি-উর্দু ভাষা ও দাড়ি-টুপি, পাঞ্জাবি, পাজামা, ঢিলা-কুলুখের ভেতরে। এর বাইরের পৃথিবী এদের অপরিচিত। এদের দ্বারা মানবজাতির অগ্রগতি, উন্নতি বা কল্যাণ সাধন অসম্ভব। কাজেই তাদের সম্পর্কে আলাদা করে কিছু বলার নেই।
২। শিক্ষার উদ্দেশ্যই যখন অনুপস্থিত: মানুষ শিক্ষা লাভ করে কেন? সে শিক্ষাকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে মানবজাতির উন্নয়ন সাধনের জন্য, তাই নয় কি? একজন মানুষ সর্বপ্রথম তার স্রষ্টা সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করবে। স্রষ্টার সাথে তার সম্পর্ক নির্ণয় করবে। মানুষ হিসেবে স্রষ্টা তাকে কী কাজ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তার ধারণা লাভ করবে। সে এই প্রশ্নের উত্তর বের করবে যে, ‘আমি কে? আমি কোথা থেকে আসলাম? আমাকে কে সৃষ্টি করেছেন? কেন সৃষ্টি করেছেন এবং এখন আমার কাজ কী?’ এ প্রশ্নগুলোর যথাযথ উত্তর লাভ করাই হলো একটি শিশুর প্রাথমিক জ্ঞান। এই জ্ঞানকে পুঁজি করে সে তার পরবর্তী জীবনের কর্মপদ্ধতি নির্দিষ্ট করবে। সে জানবে যে, “আমি মানুষ, আমাকে স্রষ্টা আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। আর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে। স্রষ্টার ন্যায়সঙ্গত বিধান দিয়ে এই পৃথিবীকে পরিচালনা করে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই হলো আমার লক্ষ্য। যতদিন পৃথিবীতে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গভিত্তিক মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকবে, পৃথিবীতে অন্যায়-অবিচার, নিপীড়ন অব্যাহত থাকবে ততদিন আমার জীবন অসম্পূর্ণ থাকবে। আমার লক্ষ্য অবাস্তবায়িত থাকবে।” এই শিক্ষা যখন একজন মানুষ তার শিক্ষাজীবনে লাভ করবে তখন তার দ্বারা কি কোনো অন্যায় কাজ করা সম্ভব? সে কি কখনো অন্ধত্বকে পুঁজি করে বিশ্ব অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে? সে কি কস্মিনকালেও ধর্মীয় উন্মাদনা বা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতে পারে? মানুষে মানুষে বিভেদের প্রাচীর খাড়া করতে পারে? পারে না। কিন্তু আজকের মাদ্রাসা শিক্ষিত শ্রেণিটির দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা কী দেখতে পাই? মানুষে মানুষে যত রকমের বিভেদের প্রাচীর দাঁড় করানো সম্ভব তার কোনোটাই এই ধর্মব্যবসায়ী মাদ্রাসা শিক্ষিত শ্রেণিটি বাদ রাখে নি। এমনকি তারা নিজেরা নিজেরাও একতাবদ্ধ নয়। হানাফি, হাম্বলি, মালেকি, শাফেয়ি, আহমদী, মোহাম্মদী, আহলে হাদিস, শিয়া, সুন্নি, কওমী ইত্যাদি শত শত ফেরকা-মজহাবের প্রাচীর দাঁড়িয়ে রয়েছে এদের নিজেদের মধ্যেই। এক ফেরকার সাথে আরেক ফেরকার দ্বন্দ্ব-বিবাদ, রক্তারক্তি চলছে প্রজন্মের পর প্রজন্মব্যাপী। আর এই বিভেদের মন্ত্র তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লাভ করছে বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মাদ্রাসার মাধ্যমে। পশ্চিমারা ঠিক এটাই চেয়েছিল।
৩। ধর্মব্যবসা নামক গুরুতর অন্যায়ের প্রশ্রয়: মাদ্রাসাগুলো থেকে শিক্ষালাভ করে যারা বের হন তারাই সমাজে পরিচিত হন মাওলানা, মোহাদ্দিস, মোফাসসির, আলেম-ওলামা, হাফেজ, কামেল, পীর, বুজুর্গ, মুফতি ইত্যাদি হিসেবে। সমাজে এদের ভূমিকা সম্পর্কে আমরা সকলেই জানি। ধর্মীয় ফতোয়া দেওয়া, কোর’আন পড়া, মৃতের জানাজা-দাফন-কাফন সম্পন্ন করা, মিলাদ পড়া, জিকির করা, চল্লিশার দাওয়াত খাওয়া, নামাজে ইমামতি করা, মাহফিলে ওয়াজ করা, দান সংগ্রহ করা ইত্যাদি কাজ মূলত করে এরাই। আর এভাবেই সংসার চলে অধিকাংশ মাওলানা-আলেম সাহেবদের। এ সকল ধর্মীয় কাজের মধ্যে ব্যাপৃত থাকায় তারা কোনো কায়িক শ্রম বা অন্য কোনোভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন না বা করেন না। সমাজের আর দশটা মানুষের মতো তারা স্বাবলম্বী নন। কার্যত তাদের জীবন-সংসার চলে পরজীবী বেশে। এদের মধ্যে এমনও ব্যক্তি আছেন যারা ওয়াজ-নসিহত করে রাতারাতি লাখপতিও বনে যান। মাদ্রাসা শিক্ষিত শ্রেণিটির এই পরজীবী চরিত্রের কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। এখন দেখা যাক, এদের এই কাজ এসলামের দৃষ্টিতে বৈধ কি না।
প্রকৃতপক্ষে ধর্ম কোনো পণ্য নয়, ধর্মীয় কাজ কোনো পেশা নয়। মানুষ ধর্মীয় কাজ করবে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার আশায়, এর বিনিময়ও গ্রহণ করবে কেবল আল্লাহর কাছ থেকে। আল্লাহর সকল নবী-রসুল এই কথা ঘোষণা দিয়েছেন যে, ‘আমি তোমাদের কাছে কোন বিনিময় চাই না, আমার বিনিময় আল্লাহর কাছে।’ (আল কোর’আন- হুদ: ২৯, হুদ: ৫১, শুয়ারা: ১৪৫, শুয়ারা: ১৮০, ইউসুফ: ১০৪) সুতরাং তাঁদের উম্মতের জন্যও একই বিধান। কিন্তু তা না করে যখন কেউ কিছু ধর্মীয় জ্ঞান আয়ত্ব করে সেটাকে পুঁজি করে অর্থ উপার্জন করে তখন আর সেটা ধর্মের কাজ হয় না, সেটা ব্যবসা হয়। পবিত্র কোর’আনে এবং হাদিসে ধর্মব্যবসার সবগুলি ধরণ সম্পর্কেই নিষেধাজ্ঞা ঘোষিত হয়েছে, ধর্মকে বিক্রি করে পার্থিব সুযোগ সুবিধা, সম্পদ হাসিলের কোন সুযোগ আল্লাহ রাখেন নি। তিনি একে কেবল হারামই করেন নি, তিনি বলেছেন, যারা এটা করে তারা পথভ্রষ্ট, তারা আগুন ছাড়া কিছুই খায় না। তিনি আখেরাতে তাদেরকে পবিত্র করবেন না, তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না এবং তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। (সুরা আল বাকারা ১৭৪)। এছাড়াও আল্লাহ সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, তোমরা তাদের অনুরসণ করো যারা বিনিময় গ্রহণ করে না এবং সঠিক পথে আছে (সুরা ইয়াসীন ২১)। সে হিসেবে মোসলেম বিশ্বে বিশাল-বিস্তৃত ডানা মেলে বসে থাকা মাদ্রাসাশিক্ষিত ধর্মজীবী পুরোহিত শ্রেণির অবস্থান কোথায় দাঁড়াল? বস্তুত এই ধর্মজীবীরা শুধু নিজেরাই জাহান্নামের দিকে যাচ্ছে না, সাথে আমাদেরকেও নিয়ে যাচ্ছে। আর সে পথ সুগম করছে মোসলেম বিশ্বে প্রচলিত লক্ষ লক্ষ মাদ্রাসায় প্রদত্ত বিকৃত শিক্ষা। একটি সহজ সরল শিশু পবিত্র হৃদয়ে মাদ্রাসায় প্রবেশ করছে। কিন্তু এরপর সেখান থেকে শিক্ষালাভ করে ধর্মব্যবসায়ী আগুনখোর, অপবিত্র ও পরজীবী হয়ে বের হয়ে আসছে। এমন শিক্ষাব্যবস্থা বজায় রাখার কোনো যৌক্তিকতা আছে কি? আমাদের বিবেক কী বলে?
৪। জঙ্গিবাদের প্রজননক্ষেত্র: এসলামের বিকৃত ব্যাখ্যা থেকেই জঙ্গিবাদের জন্ম। জঙ্গিদেরকে শেখানো হয় অমুক নাস্তিক, অমুক কাফের, অমুককে মারলে জান্নাত নিশ্চিত। এসব বলে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে সুবিধা আদায় করে ধর্মব্যবসায়ীরা। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, অধিকাংশ জঙ্গিবাদী গ্র“পের নেতারাই মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষালাভ করে জঙ্গি হয়েছে। মাদ্রাসাগুলো প্রথমে তাদেরকে ধর্মব্যবসায়ী বানিয়েছে, আর এ ধর্ম নিয়ে ব্যবসাই হচ্ছে ধর্মভিত্তিক অপ-রাজনীতি ও জঙ্গিবাদের সূতিকাগার। ধর্মব্যবসায়ীরা যেটাকে ইসলাম বলে পালন করছে, মসজিদে-খানকায়, ওয়াজ মাহফিলে প্রচার করছে, মাদ্রাসার মাধ্যমে ছেলে-মেয়েদেরকে শিক্ষা দিচ্ছে সেটা আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলাম নয়। প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা যারা লাভ করবে তারা কোনদিন জঙ্গি হবে না, তারা আইন অমান্যকারী হবে না, বিশৃঙ্খল হবে না, তারা হবে মানবতার কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ। কাজেই জঙ্গিবাদের বিলুপ্তি সাধনের পূর্বশর্ত হলো ধর্মব্যবসার বিলুপ্তি সাধন। আর ধর্মব্যবসার বিলুপ্তি সাধনের পূর্বশর্ত হলো প্রচলিত মাদ্রাসাব্যবস্থায় বিকৃত শিক্ষা প্রদান বন্ধ করে প্রকৃত এসলামের শিক্ষা প্রদান করা। পৃথিবীতে মোসলেমদের পরাজিত, নিপীড়িত, অত্যাচারিত যে অবয়ব সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে অন্যতম কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মোসলেমের অজ্ঞতা ও ধর্মীয় নেতাদের কথিত জ্ঞানের অহংকার। এ দুটোই সৃষ্টি হয়েছে এসলামের প্রকৃত শিক্ষার অভাবে। শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী এই জাতি মাদ্রাসায় শিক্ষালাভ করছে, লক্ষ লক্ষ আলেম তৈরি হচ্ছে, কোর’আনের হাফেজ তৈরি হচ্ছে, কিন্তু তারা কি জাতিকে অন্যায়-অবিচারের গ্লানি থেকে মুক্ত করতে পেরেছে? তারা কি অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাতির পরাজয় ঠেকাতে পেরেছে? পারে নি, কারণ মাদ্রাসা পড়ে বহু আলেম-বুজুর্গ, হাফেজ তৈরি হলেও উম্মতে মোহাম্মদী তৈরি হচ্ছে না, মো’মেন তৈরি হচ্ছে না। তাই জাতির বিজয়ও আসছে না। জাতি অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে টিকতে পারছে না। তাই আজ সময় এসেছে। মোসলেম জাতিকে পৃথিবীব্যাপী এসলাম শিক্ষার জন্য যে ব্যবস্থা আছে সেটার যথার্থতা নিয়ে ভাবতে হবে। আমি বলছি না, মাদ্রাসা বন্ধ করে দিতে হবে। মাদ্রাসা বন্ধ করলেই সমস্যার সমাধান হবে- এমন নিশ্চয়তা আমি দিতে পারবো না। কিন্তু পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের ফাঁদ থেকে তো আমরা বের হতেই পারি। সে চেষ্টাতেই এখন আমাদের মশগুল হওয়া উচিত।
Subscribe to:
Posts (Atom)