Saturday, October 24, 2015

ঐক্যের গুরুত্ব এবং অনৈক্যের পরিণাম

ঐক্যের গুরুত্ব এবং অনৈক্যের পরিণাম

 0

মো: হাসানুজ্জামান:
মানবজাতির পার্থিব ও পারলৌকিক অর্থাৎ যাবতীয় কল্যাণের উদ্দেশ্যে যুগে যুগে স্রষ্টার পক্ষ থেকে তাঁর বার্তাবাহকগণ সত্যধর্ম নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। সকল ধর্মই সত্য, ন্যায়, কল্যাণ এবং মানবজাতির শান্তির পক্ষে কথা বলে। কারণ স্রষ্টা হলেন যাবতীয় সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের আধার। স্রষ্টা প্রেরিত সর্বশেষ দীন হলো দীনুল ইসলাম। পৃথিবী থেকে সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার, অত্যাচার, যুদ্ধ-রক্তপাত এক কথায় অশান্তিকে নির্মূল করে, মানবজাতিকে এক জাতিতে পরিণত করার উদ্দেশ্যেই শেষ নবীর আগমন। এ জন্য মানবজাতির মধ্যে ঐক্য অপরিহার্য। এ কারণে ইসলাম ঐক্যকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। অন্যদিকে অনৈক্য এই মহাপরিকল্পনার পথে প্রধান অন্তরায়। তাই এই দীনের বিধানগুলোও অনৈক্যের বিরুদ্ধে অতিশয় কঠিন।
সারা দুনিয়ার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, জাত-পাত, হিংসা-বিদ্বেষ লুপ্ত করে তাদেরকে এক কাতারে নিয়ে আসার মতো অসাধ্য সাধন করা যার উদ্দেশ্য, সেই মহামানব সর্বপ্রথম যে কাজটিতে মনোনিবেশ করেছিলেন তাহলো সীসা ঢালা প্রাচীরের ন্যায় একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করা। ইতিহাসে পাই- তদানীন্তন আরবের ৫ লাখের একটি জাতিকে তিনি (সা.) তাঁর জীবদ্দশাতেই ঐক্যবদ্ধ করে গিয়েছিলেন। এর কারণও অতি সোজা। তিনি এটা ভালোভাবেই জানতেন যে- তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব এক জীবনে পূর্ণ করে যাওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়।
তাই তিনি তাঁর যাবতীয় কর্মকাণ্ড, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই জাতিটিকে হাতে কলমে এমন শিক্ষা দিয়ে গেলেন যাতে এই ঐক্যবদ্ধ জাতিটি তাঁর চলে যাওয়ার পরেও আপ্রাণ সংগ্রাম করে সমস্ত পৃথিবীকে ঐ শিক্ষা পৌঁছে দিয়ে মানবজাতিকে এক জাতিতে পরিণত করতে পারে। তিনি জানতেন এই কাজ এই জাতি ততক্ষণ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারবে যতক্ষণ তাদের মধ্যে ঐক্য বজায় থাকবে। ঐক্যের হানি ঘটলেই জাতি তার চলার গতি হারিয়ে ফেলবে এবং এক সময় স্থবির হয়ে পড়বে- উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। এটা পৃথিবীর এক অমোঘ নিয়ম যে- একটি জাতি কিংবা একটি সংগঠন যত শক্তিশালীই হোক, ধনে-বলে যতই উন্নত হোক, যদি তাদের মধ্যে ঐক্য না থাকে তবে তারা কখনোই জয়ী হতে পারবে না। অতি দুর্বল শত্রুর কাছেও পরাজিত হবে। তাই আল্লাহ বহুবার কোর’আনে এই ঐক্য অটুট রাখার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। এই ঐক্য যাতে না ভাঙ্গে সে জন্য তাঁর রসুল (সা.) সদা শংকিত ও জাগ্রত থেকেছেন। ঐক্য নষ্ট হবার সম্ভাবনা আছে এমন কোন কথা বা কাজ যখনই কাউকে করতে দেখেছেন তখনই তিনি ভীষণ রেগে গেছেন।
রসুলাল্লাহর জীবনী যারা ভাসা ভাসাভাবেও পড়েছেন তারাও এটা অস্বীকার করতে পারবেন না যে- তাঁর নবী জীবনের ২৩ বছরে তিনি কত অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মক্কা ও তায়েফের মাটিতে তাঁকে মুশরিকদের ক্রীড়া-কৌতুকের পাত্র হতে হয়েছে, প্রস্তরাঘাতে পবিত্র দেহ থেকে রক্ত ঝরাতে হয়েছে। যুদ্ধের ময়দানে শত্র“র অস্ত্রের আঘাতে জর্জরিত হয়েছেন। কিন্তু তিনি ঐ মুশরিকদের উপর রেগে গিয়েছেন বা তাদের অভিসম্পাত করেছেন এমন কোন নজীর কেউ দেখাতে পারবে না। বরং তিনি তাদের জন্য আল্লাহর কাছে মাগফেরাত কামনা করেছেন। কিন্তু সর্বরিপুজয়ী ঐ একই ব্যক্তির রাগও আমরা দেখতে পাই তাঁর পবিত্র জীবনীতে। না, সেটা মুশরিকদের জর্জরিত করা আঘাতের কারণে নয়, তাঁরই প্রাণপ্রিয় আসহাবদের মধ্যে কেউ যখন কোর’আনের কোন আয়াত নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতে দেখেছেন তখন তিনি রেগে লাল হয়ে গেছেন। তাঁর আসহাব এবং ঐতিহাসিকদের বর্ণনা মোতাবেক রসুলকে আমরা সর্বদাই একজন সদা হাস্যময় এবং শান্ত-সৌম্য মানুষ হিসেবে দেখতে পাই। অপরাধীকে ক্ষমা করে দেওয়া তাঁর চরিত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সেই মানুষটিও রেগে অগ্নিশর্মা হয়েছেন। কখন হয়েছেন? যখন তিনি কাউকে এমন কোন কাজ করতে দেখেছেন যার ফলে তিলে তিলে গড়ে তোলা তাঁর আজীবনের সাধনা, অর্থাৎ মহান আল্লাহ তাঁকে যে কাজের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন তার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, অর্থাৎ যে কাজের ফলে তাঁর সারা জীবনের সংগ্রাম ব্যর্থ হয়ে যাবে।
তাঁর পবিত্র জীবনীতে আমরা পাই, একদিন দুপুরে আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা.) রসুলাল্লাহর গৃহে গিয়ে দেখেন তাঁর মুখ মোবারক ক্রোধে লাল হয়ে আছে। কারণ তিনি দু’জন আসহাবকে কোর’আনের একটি আয়াত নিয়ে মতবিরোধ করতে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি (সা.) বললেন- কোর’আনের আয়াতের অর্থ নিয়ে যে কোনরকম মতভেদ কুফর। নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহ (উম্মাহ) তাদের (উপর অবতীর্ণ) কিতাবগুলোর (আয়াতের) অর্থ নিয়ে মতবিরোধের জন্য ধ্বংস হয়ে গেছে। তারপর তিনি আরও বললেন (কোর’আনের) যে অংশ (পরিষ্কার) বোঝা যায় এবং ঐক্যমত আছে তা বল, যেগুলো বোঝা মুশকিল সেগুলোর অর্থ আল্লাহর কাছে ছেড়ে দাও (মতবিরোধ করো না) [হাদিস-আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে- মুসলিম, মেশকাত]।
এটা একটা প্রাকৃতিক নিয়ম যে মতভেদ থেকেই অনৈক্যের সূত্রপাত। আর অনৈক্য মানেই ব্যর্থতা, দুর্বল শত্রুর কাছেও পরাজয়। সুতরাং সামান্য বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও মতভেদের মাধ্যমে তাঁর পবিত্র জীবনের সব সংগ্রাম, ত্যাগ যদি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় তবে তা কি করে তিনি মেনে নিতে পারেন? এ কারণেই আমরা সর্বরিপুজয়ী এই জিতেন্দ্রীয় মহামানবকেও রেগে লাল হতে দেখেছি।
তাই মুসলিম জাতির ঐক্যের গুরুত্ব কতখানি তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ইসলামের বিরুদ্ধে, রসুলাল্লাহর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধের চেয়েও বড় অপরাধ হলো মুসলিম জাতির মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি করা। কারণ জাতির মধ্যে যে কোন রকমের মতভেদের সূত্রপাতই অনৈক্য সৃষ্টি এবং পরিণামে জাতি ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। এ কারণে রসুলাল্লাহ ঐক্য নষ্ট হয় এমন কোন কথা, কাজ বা ইশারা-ইঙ্গিতকেও কুফর বলে আখ্যায়িত করেছেন।
কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় এই যে জাতির অখণ্ডতা ও অবিভাজ্যতা সম্পর্কে আল্লাহ ও রসুলের এমন স্পষ্ট আদেশ-নিষেধ সত্ত্বেও মুসলিম জাতি আজ শরিয়াহগতভাবে শিয়া-সুন্নি, হানাফি, মালেকি, শাফেয়ী, হাম্বলী, আহলে হাদিস; আধ্যাত্মিকভাবে- কাদেরিয়া, নক্শবন্দিয়া, মোজাদ্দেদিয়া, আহলে বাইত, ভৌগোলিকভাবে ৫৫ টিরও বেশি রাষ্ট্রে এবং ইহুদি খ্রিস্টানদের নকল করে রাজনীতিকভাবে কেউ গণতন্ত্রী, কেউ সমাজতন্ত্রী, কেউ সাম্যবাদী, কেউ রাজতন্ত্রী, কেউ পুঁজিবাদী ইত্যাদি হাজার হাজার ভাগে বিভক্ত।
কোর’আনে আল্লাহ বলেছেন- ‘সকল মুমিন ভাই ভাই।’ হাদিসে রসুলাল্লাহ বলেছেন- ‘উম্মতে মোহাম্মদী জাতি যেন একটি শরীর, তার একটি অঙ্গে ব্যথা পেলে সারা শরীরেই ব্যথা অনুভূত হয়।’ অথচ আজ আর তারা এক জাতি, ভাই-ভাই তো নয়-ই উপরন্তু নিজেরা নিজেরা মারামারি-হানাহানি, রক্তপাত, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বোমাবাজি করে চূড়ান্ত ঐক্যহীন ও শতধা বিচ্ছিন্ন একটি জাতিতে পরিণত হয়েছে। আর তাই রসুলাল্লাহ তাদেরকে যে মহান উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন সেই উদ্দেশ্য অর্জন করাও তাদের দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না।
শুধু শেষ রসুলের উম্মাহ হিসেবেই নয়, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও যদি আমরা মানব জাতির কল্যাণ ও উন্নতি কামনা করি তাহলে মানুষকে সমস্ত প্রকার বিভক্তি- ব্যবধান ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মানুষ একই দম্পতি- বাবা আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.) থেকে আগত, সুতরাং মানুষকে সেই আদি পরিচয়ে ফিরে যেতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এর কোন বিকল্প পথ খোলা নেই।

সমগ্র মানবজাতি এক পিতা-মাতা থেকে আগত

সমগ্র মানবজাতি এক পিতা-মাতা থেকে আগত

 0

মিজানুর রহমান:
আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে মানুষ জ্ঞান-বুদ্ধি-যোগাযোগ-বিবেক-কৃষ্টি ইত্যাদি এক কথায় বিবর্তনের এমন একটা বিন্দুতে পৌঁছুল যে, তখন সমগ্র মানব জাতির জন্য একটি মাত্র জীবন-বিধান গ্রহণ করা সম্ভব অর্থাৎ সকলেই একই দীনের আওতায় আসা সম্ভব। এটা মহান স্রষ্টার মহা পরিকল্পনারই একটি অংশ, যে পরিকল্পনা তিনি তার প্রতিনিধি মানুষ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়ই করেছিলেন। মানুষ বিবর্তনের এই বিন্দুতে পৌঁছামাত্র আল্লাহ পাঠালেন মোহাম্মদ বিন আব্দাল্লাহকে (সা.)। পূর্ববর্তী প্রেরিতদের মতো তাঁর মাধ্যমেও আল্লাহ পাঠালেন সেই দীনুল কাইয়্যেমা-সিরাতুল মুস্তাকীম অর্থাৎ আল্লাহকেই একমাত্র বিধাতা, সার্বভৌম হুকুমদাতা হিসাবে স্বীকার করে নেওয়া। ঐ সিরাতুল মুস্তাকীমকে ভিত্তি করে যে সংবিধান এল সেটা এবার এল সমস্ত মানব জাতির জন্য (কোর’আন- সূরা আত-তাকভীর ২৭)। আগের মতো নির্দিষ্ট কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর জন্য নয়। এর পরিষ্কার অর্থ হলো এই যে আল্লাহ চান যে বিভক্ত বিচ্ছিন্ন মানব জাতি নিজেদের ভেদাভেদ ভুলে আবার একটি মাত্র জাতিতে পরিণত হোক। কারণ, তারা আসলে গোড়ায় একই বাবা-মা, আদম-হাওয়ার (Adam-Eve) সন্তান অর্থাৎ একই জাতি। ভৌগোলিক পরিবেশ, বিপর্যয়, কালের বিবর্তন ইত্যাদি কারণে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল কিন্তু এখন আবার সময় এসেছে এক হয়ে শান্তিতে বসবাস করার অর্থাৎ আল্লাহ চান তাঁর এই প্রিয় সৃষ্টি বনি আদম আবার সকল বর্ণ, সকল ভেদাভেদ ভুলে একটি জাতিতে পরিণত হোক। একটি জাতিতে পরিণত করার জন্য তিনি এমন একটি জীবন-ব্যবস্থা দিলেন, যেটা সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতি নির্ভর অর্থাৎ দীনুল ফেতরাহ। প্রাকৃতিক উপাদান বায়ু থেকে অক্সিজেন, সূর্য থেকে উত্তাপ গ্রহণের ক্ষেত্রে যেমন পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি-বর্ণের মধ্যে কোনো বৈষম্য নেই, তেমনিভাবে এই দীনটিও সকল এলাকার সকল মানুষ সমানভাবে গ্রহণ করতে পারবে। এই জীবনব্যবস্থা সমানভাবে সকল এলাকার মানুষের প্রয়োজন পূরণ করতে পারবে। নতুন সংবিধানে তিনি বললেন, “হে মানব জাতি! আমি তোমাদের একটি মাত্র পুরুষ ও একটি মাত্র স্ত্রী থেকে সৃষ্টি করেছি। জাতি গোষ্ঠীতে তোমাদের পরিণত করেছি যাতে তোমরা নিজেদের চিনতে পার। তোমাদের মধ্যে যে যত বেশি ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে সতর্ক, অর্থাৎ মুত্তাকী আল্লাহর চোখে সে তত বেশি সম্মানিত। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছুই জানেন। সব কিছুরই খবর রাখেন (কোর’আন- সূরা আল-হুজরাত ১৩)। এখানে আল্লাহ তিনটি কথা মানুষকে বলেছেন।
ক) মানুষকে তিনি এক-দম্পতি থেকে সৃষ্টি করেছেন অর্থাৎ সমস্ত মানব জাতি একই বংশের একই রক্তের; সুতরাং একই জাতি।
খ) দেহের গঠনে, চামড়ার রংয়ে, ভাষায় ইত্যাদিতে যে বিভক্তি এ শুধু পরিচয়ের জন্য, তার বেশি কিছুই নয়।
এই কথাটা একটু পরিষ্কার করা দরকার। একটি লোকের কয়েকটি সন্তান আছে। সন্তানরা কেউ কালো, কেউ ফর্সা, কেই বাদামী, কেউ লম্বা, কেউ খাটো, কেউ মোটা, কেউ পাতলা। এদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নাম রাখা হয়। কেন? নিশ্চয়ই পরিচিতির জন্য। আল্লাহ বলছেন ‘মানব জাতিকে শুধু ঐ পরিচিতির জন্যই বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীতে, গায়ের রংয়ে, ভাষায় ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তাছাড়া এটা আল্লাহর সৃষ্টি কৌশলতার এক অনন্য সৌন্দর্য। যদি সকল মানুষ সাদা হতো অথবা সকল মানুষ একই উচ্চতার হতো তাহলে সৌন্দর্যের কোনো মানদণ্ড থাকত না, যেমন হাতের ৫টি আঙ্গুল একেকটি একেক আকৃতির এবং প্রত্যেকটিরই আলাদা-আলাদা সৌন্দর্য এবং কার্যকারিতা রয়েছে। এর মানে এই নয় যে খাট আঙ্গুলটি শ্রীহীন ও কম গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে বিভিন্ন বর্ণের হলেও ঐ লোকটির সন্তানদের মতই পুরো মানবজাতি ভাই-বোন, একই জাতি। অর্থাৎ আল্লাহ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ-বৈষম্য মিটিয়ে দিচ্ছেন।
গ) মানুষে মানুষে তফাতের একটি মাত্র সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিলেন, সেটি হলো ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ দেখে যে যত সতর্কভাবে চলবে, কাজ করবে- অর্থাৎ যে যত বেশি উন্নত চরিত্রের- সে তত বেশি আল্লাহর কাছে সম্মানিত। এক কথায় আল্লাহ বলছেন মানুষ এক জাতি, কেউ কারো চেয়ে বড় নয়, ছোট নয়, সব সমান। ছোট-বড়র একটি মাত্র মাপকাঠি, সেটি হলো ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠি। সেখানে চামড়ার রংয়ের, ভাষার, কোন্ দেশে কার জন্ম বা বাস এসবের কোনো স্থান নেই। এবং ঐ ন্যায়-অন্যায়ের সংজ্ঞা হচ্ছে সেটা, যেটা আল্লাহ তার সংবিধান কোর’আনে দিয়ে দিয়েছেন। এই আয়াতটি ছাড়াও আল্লাহ কোর’আনের বিভিন্ন স্থানে বলেছেন একই আদম-হাওয়া থেকে সৃষ্ট বলে সমস্ত মানব জাতি একজাতি। সুতরাং এ কথা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, ভৌগোলিক বা গায়ের রং, ভাষা ইত্যাদি ভিত্তিক জাতি আল্লাহর দেয়া জীবন-ব্যবস্থার সরাসরি পরিপন্থী, উল্টো।
আজ সারা পৃথিবী জুড়ে চামড়ার রং, ভাষা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করা জাতিগুলি প্রত্যেকটি নিজেদের ছাড়া বাকি মানব গোষ্ঠী থেকে আলাদা, স্বতন্ত্রভাবে দেখে; শুধু স্বতন্ত্রভাবেই দেখে না বর্তমানে এক দেশ আর এক দেশের সঙ্গে শত্র“ভাবাপন্নে পরিণত হয়েছে। এর কারণ ঐ সব জাতিগুলির প্রত্যেকটির জাতীয় স্বার্থ বিভিন্ন অর্থাৎ একেক জাতির একেক স্বার্থ। তাদের প্রত্যেকেরই মনোভাব হচ্ছে যে কোনো উপায়েই হোক নিজের স্বার্থ রক্ষা করতেই হবে, এতে পাশ্ববর্তী দেশের কত মানুষ হত্যা করতে হবে, কত বাড়ী-ঘর, জনপথ ধ্বংস করা হবে তার কোনো হিসাব করার প্রয়োজন নাই, কোনো ন্যায়-নীতি, মানবতার বালাই নেই। নিজ দেশের সীমান্তে নদীর গতিপথে বাঁধ দিয়ে অন্যদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করে দেওয়া ন্যায়সঙ্গত করে নিয়েছে। মানুষ জীবিকা ও অন্য কোনো প্রয়োজনে এই সীমানা অতিক্রমের চেষ্টা করলে সীমান্তরক্ষীদের গুলি তাদেরকে ঝাঁঝরা করে দেয়। অথচ পৃথিবীর এই মাটি থেকে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই মাটিতেই আবার সকল আদম সন্তানকে ফেরত যেতে হবে সুতরাং সৃষ্টিগতভাবেই এই মাটির উপর, এই পৃথিবীর উপর মানুষের পূর্ণ অধিকার, হক রয়েছে। মানুষ ইচ্ছা করলে এই পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে যেতে পারে, যে কোনো জায়গায় বসবাস করতে পারে। এই পৃথিবী আল্লাহ মানুষের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেছেন মানুষ হচ্ছে পৃথিবীর বুকে তাঁর প্রতিনিধি, খলিফা। এখানে তিনি পৃথিবীর বুকে কোনো বিভক্তিরেখা আরোপ করেন নি। সুতরাং এই সম্পূর্ণ পৃথিবীর উপর প্রতিটি মানুষের সৃষ্টিগত অধিকার। সেই অধিকারবলে এই মাটির সর্বত্র সে যেতে পারে- এই পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় ন্যায়সঙ্গতভাবে ফসল ফলাতে পারে। এই পৃথিবীর বুকে আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা থেকে যার যা খেতে ইচ্ছা করবে তা খেতে পারে, কেউ বাধা দিতে পারে না। অন্যের কোনো ক্ষতি না করে, অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না হয় এমন সব কাজ সে করতে পারে। মানুষের স্রষ্টা, প্রভু, রব, মালিক আল্লাহ মানুষকে এই অধিকার দিয়ে রেখেছেন, পাশ্চাত্য সভ্যতা এসে মানুষের যাবতীয় অধিকার হরণ করেছে বিভিন্ন সীমারেখা, বিধি-নিষেধ আরোপ করে। ফলে মানুষের মধ্যে স্থায়ী সংঘাত, সংঘর্ষের রূপ নিয়েছে, এই সংঘর্ষের প্রবণতা সব চেয়ে বেশি প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে, একথা যে কোনো সময়ে পৃথিবীর রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইতিহাস লক্ষ্য করলেই পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। কারণ ঐ একই। ‘মানুষ এক জাতি’ আল্লাহর এই কথা অস্বীকার করে পৃথিবীর বুকের উপর খেয়াল খুশি মতো দাগ দিয়ে, লাইন টেনে, চামড়ার রংয়ের উপর ভাষার উপর ভিত্তি করে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে চিরস্থায়ী সংঘাত-সংঘর্ষ-রক্তপাত ও যুদ্ধের ব্যবস্থা করা। যতদিন মানুষের তৈরি এই জীবনব্যবস্থা পৃথিবীতে চালু থাকবে, ততদিন মানুষে-মানুষে, জাতিতে-জাতিতে অশান্তি, যুদ্ধ রক্তপাত কেউ বন্ধ করতে পারবেন না। শত লীগ অব নেশনসও (League of Nations) নয়, শত জাতিসংঘ ও (United Nations) নয়। মালায়েকরা মানুষ তৈরির বিরুদ্ধে যে যুক্তি দিয়েছিলেন; ইবলিস মানুষকে দিয়ে যা করাবে বলে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে- অর্থাৎ সেই ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা- অশান্তি, অন্যায়, রক্তপাত ও যুদ্ধ যাতে চলতে থাকে সেজন্য শয়তানের হাতে যত অস্ত্র আছে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান অস্ত্র হচ্ছে এই ভূগোল, চামড়ার রং, ভাষা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে মানব জাতিকে বিভক্ত করা। এবং এই জন্যই এই ব্যবস্থা শেষ ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এই ব্যবস্থা মানুষ জাতির কত অশান্তি, অন্যায়, অবিচার, রক্তপাত, যুদ্ধ, অশ্র“ ও ভগ্ন হৃদয়ের কারণ হয়েছে- হচ্ছে, তা সমুদ্রের মতো সীমাহীন।

উপায় এখন একটাই

উপায় এখন একটাই

 0

DSC04812মানুষ শুধু দেহসর্বস্ব প্রাণী নয়, তার একটি আত্মাও আছে। সেই আত্মা হলো আল্লাহর রূহ। অর্থাৎ মানুষ দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে ভারসাম্যপূর্ণ সামাজিক জীব। মানুষ নামক এই জীবের জীবনকে সুখকর, শান্তিময় ও শৃঙ্খলাপূর্ণ করার জন্য এমন একটি জীবনব্যবস্থা দরকার, যে জীবনব্যবস্থাটাও শরীয়াহ ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়ে ভারসাম্যপূর্ণ হবে। যেখানে শরীয়াহগতভাবে অন্যায়ের শাস্তি যেমন থাকবে তেমনি অন্যায় না করার জন্য আত্মিক প্রশিক্ষণ তথা ন্যায়নীতিবোধ, পারলৌকিক মুক্তির চিন্তা, স্রষ্টার প্রতি পূর্ণ আনুগত্যবোধ ইত্যাদি সৃষ্টির প্রক্রিয়াও থাকতে হবে। সমগ্র মানবজাতিকে একটি জাতিতে পরিণত করার জন্য, সমস্ত পৃথিবীকে ন্যায়, সুবিচার ও শান্তিতে পরিপূর্ণ করার জন্য যে দীনটি আল্লাহ পাঠিয়েছেন, সেই দীনটি প্রাকৃতিক নিয়মের উপরে, আমাদের দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে ভারসাম্যপূর্ণ একটি ব্যবস্থা। স্রষ্টার দেওয়া ব্যবস্থাতে উপরোক্ত দু’টি দিকই আছে, ভারসাম্যপূর্ণভাবে। ১৪০০ বছর আগে যেটা অর্ধ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবার ফলে মানুষ দেখেছিল শান্তি ও পূর্ণ নিরাপত্তার দৃষ্টান্ত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে যখন এই জাতির একটি বিশেষ শ্রেণি তাদের নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এর ভারসাম্য বিনষ্ট কোরল এবং ক্রমে ক্রমে এটি প্রত্যাখ্যান কোরল তখন থেকে সমাজে সৃষ্টি হলো অন্যায়, অবিচার, শোষণ, বঞ্চনা এক কথায় চরম অশান্তি। এক পর্যায়ে মানুষ নিজেই তার জীবনব্যবস্থা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিলো, জন্ম হলো দাজ্জালের। দাজ্জাল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদির নামে এমন ভারসাম্যহীন জীবনব্যবস্থা কায়েম কোরল যেখানে মানুষের আত্মিক ভাগটা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। অপরাধ দমনের জন্য শাস্তির বিধান থাকলেও অপরাধ না করার জন্য যে আত্মিক প্রশিক্ষণ দরকার অর্থাৎ স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা, আনুগত্যবোধ, ভীতি কিছুই সেখানে রোইল না; এই ব্যবস্থাটি হলো সম্পূর্ণ স্রষ্টাহীন, আত্মাহীন, জড়বাদী, ভোগবিলাসী এক সভ্যতা যার মূলনীতিই হলো খাও-দাও ফূর্তি করো। মানুষ ধীরে ধীরে আত্মাহীন হয়ে পোড়ল। আত্মাই যখন অনুপস্থিত সুতরাং মানুষের ভেতরে আত্মা থেকে সৃষ্ট- দয়া-মায়া, সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা, সহমর্মিতা, পারস্পরিক সহযোগিতা, ন্যায়নীতিবোধ, সততা, সত্যবাদিতা, বিবেক, ঐক্য, শৃঙ্খলাবোধ ইত্যাদি সৎগুণাবলীও অনুপস্থিত হতে লাগলো। ফলে সমাজে সৃষ্টি হলো চরম অরাজকতা, অন্যায়, অশান্তি। তারা সম্মিলিতভাবে স্রষ্টার এই দুনিয়াটাকে সাক্ষাৎ এক নরকপূরীতে পরিণত করেছে। এখন শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ করে, শাস্তির বিধান তৈরি করে আর সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। আগুনের মধ্যে লাফ দিলে আগুন আপনাকে দগ্ধ করবেই, বাঁচতে হলে আগে আগুন থেকে বের হতে হবে, আগুনের মধ্যে থেকে বাঁচার উপায় খোঁজা নিতান্তই বোকামী। তাই এখন বাঁচতে হলে স্রষ্টা আল্লাহর দেওয়া সেই নিঁখুত জীবনব্যবস্থা (দীন) গ্রহণ করা ছাড়া পথ নেই। সেই নিঁখুত ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা কোথায় পাওয়া যাবে। হেযবুত তওহীদ আল্লাহর রহমে মানবজাতির সামনে এটা উপস্থাপন করছে।
হেযবুত তওহীদ

তাদের নিশানা ইসলামের দিকে!

তাদের নিশানা ইসলামের দিকে!

 0

আলী হোসেন:
আজকে আমাদের দেশের প্রত্যেকটা নাগরিককে দেশ ও সমাজকে নিয়ে ভাবতে হবে। আমাদেরকে আর ক্ষুদ্রস্বার্থে, ব্যক্তিচিন্তায় বুঁদ হয়ে থাকলে চলবে না। এক শ্রেণির মিডিয়ার প্রচারণা, বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও পশ্চিমা সংস্কৃতি, রোজগারমুখী শিক্ষাব্যবস্থা, আমাদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংকীর্ণ ধর্ম, ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা ধর্মের নামে অধর্ম ইত্যাদি বিভিন্ন নিয়ামক আমাদের দৃষ্টিকে এতটাই নিুমুখী, ক্ষুদ্র ও হীন করে রেখেছে যে, আমরা কিছুতেই ব্যক্তির গণ্ডির বাইরে চিন্তাও করতে পারছি না। আমরা চোখ তুলে তাকাই না বিশ্বে কী হচ্ছে, বিশ্বে কী তুমুল কাণ্ড ঘটে চলেছে, কী ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেখানে। সেই পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আছে কিনা, এ পরিস্থিতি দ্বারা আমরা আক্রান্ত হতে পারি কিনা, তা আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে কিনা, যদি সৃষ্টি হয় তখন আমাদের কী করণীয়, আমাদের পূর্ব প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে কিনা, কোন কোন ক্ষেত্রে তা প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আমাদের কৃষক নেতৃবৃন্দ, শ্রমিকশ্রেণী থেকে শুরু করে প্রত্যেকের ভাবার আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা তা নিয়ে ভাবি না। সেটা যে আমার ভাবনার বিষয়বস্তু হতে পারে সেটাও আমাদের জ্ঞানে আসে না। অচৈতন্যকে, অসচেতনতাকে আমরা আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য বানিয়ে নিয়েছি। আমরা ভাবি ওসব ভাবার জন্য সরকার আছে, বড় বড় মাথাওয়ালা বুদ্ধিজীবী আছে, এরা আছে, তারা আছে। আমি একজন ভুক্তভোগী হয়েও নিষ্পৃহ নির্বিকার দর্শকমাত্র। নির্বিকার থাকাই আমাদের শেখানো হয়েছে ঠিক যেমন চিড়িয়াখানার বাঘটি দীর্ঘ বন্দীদশায় একসময় নির্বিকার হয়ে যায়। আমাদেরকে মিডিয়াগুলো একটা সামান্য পৌরসভার মেয়র নির্বাচন নিয়ে এমনভাবে প্রচার-প্রচারণা চালায় তাতে মানুষও এটা নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়। আমাদের সকল জাতীয় চেতনার সমাধি ঘটানো হয় অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন ঘটনাবলীর চোরাবালিতে। এই যে অসার বিষয় নিয়ে মগ্ন করে রাখার প্রয়াস, এটা একটি বিরাট আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, তা হচ্ছে আমাদেরকে জাতীয়ভাবে কূপমণ্ডূকতা, কুয়োর ব্যাঙ করে রাখা। এ ষড়যন্ত্র চলছে সেই ঔপনিবেশিক যুগ থেকে দু’টি সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থার নামে।
১৫ কোটি মুসলমান এই দেশে বাস করে। এই বিরাট জনগোষ্ঠীর কত ভাগ মানুষ এটা অনুধাবন করতে পারছি যে, ইসলাম তথা মুসলমানদের দিকেই বন্দুক তাক করা হয়েছে, লাইন অব ফায়ারে বাংলাদেশও আছে। রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতনের পর পশ্চিমা বিশ্ব তাদের আধিপত্যকে নিরঙ্কুশ করার জন্য প্রতিপক্ষ হিসাবে গ্রহণ করেছে ইসলামকে। এই লক্ষ্যেই তালেবান, আল কায়েদা,আই.এস, বোকো হারাম ইত্যাদি দলের উদ্ভব ঘটিয়ে, রাজনীতিক দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিয়ে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সন্ত্রাস দমন, মানবাধিকার ইত্যাদি অজুহাত ধরে একের পর এক ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়ামেন ইত্যাদি দেশকে ধ্বংস¯তূপে পরিণত করা হলো। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে সৃষ্টি করা হলো আরব বসন্ত, যার আদলে যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও ধর্ম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে আমাদের দেশেও সৃষ্টি করা হয়েছে যথাক্রমে শাহবাগ ও শাপলা চত্বরের আন্দোলন। এগুলোর ধারাবাহিকতায় ও রাজনীতিক দ্বন্দ্বের পরিণামে আমাদের দেশে বার বার গৃহযুদ্ধের আবহ সৃষ্টি হয়েছে যা কোনোরকমে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। সারা দুনিয়ায় শতমুখী প্রোপাগান্ডা চালিয়ে ইসলামকে সন্ত্রাসের ধর্ম, আল্লাহর রসুলকে সন্ত্রাসী নবী (নাউযুবিল্লাহ) বলে প্রতিষ্ঠা করে ফেলা হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে আবার চলে প্রতিশোধপরায়ণদের জঙ্গি তৎপরতা। বিশ্বময় যতগুলো মুসলিমপ্রধান দেশ আছে প্রায় প্রতিটি দেশেই জঙ্গি কর্মকাণ্ড ঘটছে। তাদেরকে দমন করতে জোরদার করা হচ্ছে আইন, কেনা হচ্ছে নতুন নতুন অস্ত্র, তৈরি করা হচ্ছে নতুন নতুন নামের বাহিনী। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীরা জঙ্গি দমনের অজুহাতে যে কোনো দেশে যে কোনো সময় প্রবেশ করতে পারে, হামলা চালাতে পারে। ঐ দেশের সরকারের অনুমতি বা প্রটোকল রক্ষার প্রয়োজনীয়তাও বোধ করে না, যে কোনো ছুতানাতা পেলে একটি দেশের উপর অবরোধ আরোপ করতে পারে, নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে, সর্ববিধ উপায়ে মারার ব্যবস্থা করতে পারে। আমাদের ভাগ্যে এ জাতীয় কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না তা সেটা আমাদেরকে ভেবে দেখা উচিত। এটা ১৬ কোটি মানুষের জীবনের ও তাদের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত বিষয়। কেননা একটি দেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তার চিকিৎসার জন্য পশ্চিমারা ডাক্তার সেজে ওষুধ নিয়ে উড়ে আসেন সেই পরিস্থিতি যেন না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে এই ১৬ কোটি মানুষকেই। কেবল একটা নির্দিষ্ট সরকারের পক্ষে সেটা সম্ভব হবে না। যে দেশে জনগণের মধ্যে ঐক্য নেই, পারস্পরিক হানাহানি, বিদ্বেষ লেগেই থাকে সেখানে কোনো সরকারই তা করতে পারবে না। তার প্রতিটি সৎ উদ্যোগ পদে পদে বিঘ্নিত হবে।
আমাদের দেশের ৯০% মুসলমান, এর মধ্যে মাদ্রাসার লক্ষ লক্ষ ছাত্র আছে, এখানে প্রভাবশালী ইসলামী দল আছে যারা ক্ষমতার অংশীদার হয়েছেন, লক্ষ লক্ষ তরুণ সমাজ আছে যারা ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত, তারা এতটাই উজ্জীবিত যে তাদের চেতনাকে ভুল পথে চালিতে করে বার বার দেশের অর্থনীতির চরম ক্ষতি করেছে, শত শত মানুষ হত্যা করা হয়েছে, অর্থাৎ ধর্ম চেতনা এখানে প্রবল। এখানে নাস্তিকতাবাদের ইস্যু নিয়ে বার বার রাজপথ প্রকম্পিত করে লক্ষ লক্ষ লোক বের হয়ে এসে বিক্ষোভ করেছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিক দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে নাস্তিকতার অভিযোগ আরোপ করে, কুফর শক্তির উৎখাতের নামে জনরোষ ও জনবিক্ষোভ সৃষ্টির প্রচেষ্টা করে থাকে। একেও জঙ্গিবাদ আখ্যা দিয়ে আমাদের দেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্র বলে চিহ্নিত করে থাকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন। এই অসন্তোষকে প্রতিহত করার জন্য বিদেশিদের পাঁয়তারার কোনো কমতি নেই। কিছুদিন আগে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সন্ত্রাস দমনে দৃঢ়তার জন্য সাধুবাদ জানিয়ে গেছেন যার মাধ্যমে তিনি এটাও প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন যে এদেশে সন্ত্রাসবাদের অস্তিত্ব ব্যাপক হারে আছে। সুতরাং যে কোনো সময়ে এখানে একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কি করণীয় এ বিষয়টা নিয়ে আমাদের খুব ভাবতে হবে। এ পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হতে পারে সেজন্য ষোল কোটি মানুষকে প্রণোদিত (Motivate) করতে হবে। আমাদেরকে বুঝতে হবে, একদল মাদক ব্যবসায়ীর যেমন মানুষের ক্ষতি বা উপকার নিয়ে চিন্তা থাকে না, তারা কেবল মাদকদ্রব্য বিক্রি করতেই সচেষ্ট থাকে তেমনি আন্তর্জাতিক অস্ত্রব্যবসাকে যারা নিজেদের অর্থনীতির ভিত্তি বানিয়ে নিয়েছে তারা কেবল অস্ত্রই বিক্রি করতে সচেষ্ট আছে। অস্ত্রের প্রয়োগ হয় রণাঙ্গনে, তাই তারা সারা বিশ্বেই রণাঙ্গন সৃষ্টি করতে চায়। তাদের শান্তির প্রয়োজন নেই, শান্তি তাদের দু চোখের বিষ। তারা চায় যুদ্ধ, দাঙ্গা, গোলোযোগ কারণ আমাদের যেমন কৃষি অর্থনীতি, তেমনিভাবে তাদের হলো যুদ্ধ অর্থনীতি (War economy)। কাজেই মানুষ বাঁচল কি মরল তা নিয়ে তাদের চিন্তা নেই, পৃথিবীতে এমনিই জনসংখ্যা সমস্যা বিকট দানবের আকৃতি নিয়ে মানবজাতিকে ভয়াবহ সংকটে নিক্ষেপ করেছে। যুদ্ধ সৃষ্টি করে যদি এই জনসংখ্যা থেকে একশ ষাট কোটি মানুষও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তাতে তেমন ইতরবিশেষ তারতম্য হবে না, বরং এতে তাদের লাভই হবে। তাদের একাধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হবে, তাদের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে, আরো বেশি ভোগবিলাসে জীবনযাপন করবে। কাজেই আমাদের ভাবনা এখন আমাদেরকেই ভাবতে হবে। জনগণকে এই ভাবনা কেউ ভাবায় না, না রাজনীতিকগণ, না মিডিয়া। এমতাবস্থায় জাতির জন্য একটু ভাবার জন্য হেযবুত তওহীদ কড়া নাড়ছে প্রত্যেকের মনের দরজায়, ঘরের দরজায়। আমরা জনগণের কাছে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই, “আমাদের দেশে দেশপ্রেমিক দাবিদার অসংখ্য। কিন্তু এমন কোনো দেশপ্রেমিক কি আপনারা দেখেছেন যারা সত্যিই জনগণের কল্যাণ অকল্যাণ নিয়ে চিন্তা করেন? নাকি তারা স্বার্থচিন্তায় মগ্ন?” এর উত্তর কী হবে তা সহজেই অনুমেয়। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, দেশপ্রেম ও ধর্মের নামে স্বার্থহাসিল সবচেয়ে বড় অধর্ম। এটা সাধারণ জ্ঞান যে, রাজার অধর্ম আর প্রজার অধর্ম সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়। সিরিয়াতে বাশার আল আসাদ তার ক্ষমতার মোহে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে দেশের এই পরিণতি তিনি কস্মিনকালেও ভাবতে পারেন নি। তিনি বিরুদ্ধপক্ষের বিরুদ্ধে দমন পীড়ন চালিয়েছেন। জনগণও দর্শকের ভূমিকায় বসে নাটক দেখেছে। তারা সচেতন হয় নি। আজ সেই হাজার হাজার বছরের সিরিয়া যাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল বহু সভ্যতা ও ইতিহাস, সেই সিরিয়া মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। সেই জনগণের থেকেই আড়াই লক্ষ মানুষ মাটির সাথে মিশে গেছে। আর বাকি ৪০ লক্ষ নিজেদের আরবীয় কায়দার ভোগবিলাসপূর্ণ জীবন ফেলে মরুভূমির উত্তপ্ত বালুর মধ্যে শরণার্থী শিবিরে থেকে পার্শ্ববর্তী দেশের করুণা ভিক্ষা করছেন (সূত্র: বিবিসি রিপোর্ট)। তাদের বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য, মসজিদ, মাজার, মাদ্রাসা, শহর সব বিরান হয়ে গেছে। ঠিকানা পর্যন্ত মুছে ফেলা হয়েছে। ইরাকে নিহত হয়েছে ১০ লক্ষাধিক মানুষ। আজ সময় এসেছে আমাদের নিজেদেরকে নিয়ে চিন্তা করার, নিজের সমাজ নিয়ে, মাটি নিয়ে চিন্তা করার।
আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর প্রতিনিধি (Representative) হিসাবে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ যেমন সমগ্র সৃষ্টি জগৎকে প্রতিপালন করেন, আমাদের দায়িত্ব এই মানবজাতির শান্তিরক্ষা ও প্রতিপালন। পৃথিবীর দূরতম প্রান্তেও কোনো মানুষ যদি কষ্ট পায় সেটা নিয়ে আমাকে ভাবতে হবে। তার কষ্ট আমাদের হৃদয়েও দোলা দেবে। এই অনুভূতি যার নেই সে আকৃতিতে মানুষ হলেও মানুষের ধর্ম থেকে সে বিচ্যুত, সে ধর্মহীন, কাফের। যারা ব্যক্তিগত ধর্মপালনের মাধ্যমে কোনো রকমে দুনিয়া থেকে পালিয়ে জান্নাতে চলে যেতে চান, তাদের জন্য বলছি। জান্নাতে যেতে হলে ধর্মকর্ম করার আগে মোমেন হতে হবে। যে সমাজে মানুষ অন্যায় অশান্তির মধ্যে বাস করে সেখানে কারো কোনো ধর্মকর্ম কবুল হয় না। সেখানে আসল ধর্ম হচ্ছে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এর চেয়ে বড় দেশপ্রেম নেই, এর চেয়ে বড় ধর্মও নেই।
আমাদের রাজনীতিক নেত-নেত্রীদের মধ্যে একটি বড় অংশ আছেন যারা দেশে কোনো চূড়ান্ত দুর্যোগ হানা দিলে তারা আগে থেকেই পাসপোর্ট, ভিসা তৈরি করে রেখেছেন চম্পট দেওয়ার জন্য। কিন্তু পালিয়ে গিয়েও শান্তি পাবেন না, কারণ ইউরোপের বিভিন্ন দেশও এখন মন্দাক্রান্ত্র, বিপর্যস্ত, অধঃপতিত। কাজেই এখন একটিই উপায়, ১৯৭১ সনে লক্ষ লক্ষ প্রাণের চরম ত্যাগ ও কোরবানির বিনিময়ে যে ভূখণ্ডটি মহান আল্লাহ আমাদেরকে দান করেছেন, নিজের মাতৃভূমি সেই মাতৃভূমিকে আগে টেকসই শান্তিপূর্ণ ও বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। নিজেদের মধ্যেকার সব কোন্দল, রেষারেষি মিটিয়ে ষোল কোটি মানুষের সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে, যেন কেউ এ জাতির গায়ে দাঁত বসাতে না পারে।
লেখক: আমীর, হেযবুত তওহীদ, ঢাকা মহানগরী।

Friday, October 23, 2015

মানুষের প্রকৃত ধর্ম কী?

মানুষের প্রকৃত ধর্ম কী?

 0

রাকীব আল হাসান
—————–
ধর্ম ও ধারণ একই শব্দ থেকে এসেছে। যে গুণ বা বৈশিষ্ট ধারণ করে কোনো বস্তু তার স্বকীয়তা, নিজস্বতা পায় তাকেই ঐ বস্তুর ধর্ম বলে। যেমন একটি লৌহদণ্ড আকর্ষণ করার গুণ ধারণ করে চুম্বকে পরিণত হয়। এই আকর্ষণ করার গুণটিই হলো ঐ চুম্বকের ধর্ম। যদি কোনো কারণে চুম্বক তার ধর্ম তথা আকর্ষণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তবে সেটি পুনরায় লৌহে পরিণত হয়, সেটি আর চুম্বক থাকে না। একটি লৌহকে চুম্বকে পরিণত করতে হলে নিরন্তর তাকে চুম্বক দিয়ে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় ঘর্ষণ করতে হয়, এটি চুম্বকের ধর্ম প্রাপ্ত করার প্রক্রিয়া। আবার পরিপূর্ণ চুম্বকও যদি আগুনে পোড়ানো যায় তবে সে তার ধর্ম হারিয়ে সাধারণ পদার্থে পরিণত হয়।
পানির ধর্ম হলো সে নিজে পবিত্র এবং সমস্ত কিছুকে ধৌত করে পবিত্র করে দেয়, তৃষ্ণার্তের তৃষ্ণা দূর করে নতুন জীবন দান করে। কিন্তু পানি যদি অপবিত্র, বিষাক্ত হয়ে যায় তবে সে অন্যকে না পবিত্র করতে পারে, না কারো তৃষ্ণা দূর করতে পারে। পানিকে পবিত্র করার জন্য, বিষমুক্ত করার জন্য আগুনে ফুটাতে হয়। এটিই পানির প্রকৃত ধর্ম প্রাপ্ত করার প্রক্রিয়া। ধর্মহীন তথা বিষাক্ত, অপবিত্র পানি মানুষের জীবনের কারণ না হয়ে মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
মানুষও একটি সাধারণ প্রাণী হিসাবে জন্মগ্রহণ করে আস্তে আস্তে মনুষ্য ধর্ম প্রাপ্ত হয়ে মানুষের স্তরে ওঠে। এই মনুষ্য ধর্ম হলো মানবতা। এক পিতার মধ্যে সন্তানের প্রতি যে ভালোবাসা থাকে তা পিতৃধর্ম, ছেলে-মেয়ের প্রতি মায়ের মমতা হলো মাতৃধর্ম, ভায়ের প্রতি ভায়ের যে প্রেম তা ভ্রাতৃধর্ম। আর মানুষের প্রতি মানুষের যে প্রেম, ভালোবাসা, মায়া, মমতা সেটি হলো মনুষ্যধর্ম। যার মধ্যে অন্য মানুষের প্রতি যত বেশি ভালোবাসা সে তত বড় ধার্মিক। সন্তান কষ্টে থাকলে মা-বাবার মনেও সুখ থাকে না, সন্তানের কষ্ট দূর করার জন্য সে আপ্রাণ চেষ্টা করে। বাবা-মা হিসাবে এটা তাদের কর্তব্য। মানুষ কষ্টে থাকলে অপর মানুষও কষ্টে থাকবে, অপরের কষ্ট দূর করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে- এটা মানুষ হিসাবে তার কর্তব্য, এটাই তার এবাদত। এই এবাদতের জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষের প্রতি ভালোবাসাই স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা। সন্তানকে কষ্ট দিয়ে কি কখনো তার বাবা-মায়ের ভালোবাসা পাওয়া যায়? ঠিক একইভাবে আল্লাহর প্রিয় সৃষ্টি মানুষকে কষ্টে রেখে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া সম্ভব নয়।
এখন প্রশ্ন হলো- নামাজ, রোজা, পূজা, প্রার্থনা ইত্যাদি যে ধর্মীয় উপাসনাগুলি ধর্ম মনে করে, এবাদত মনে করে করা হয় সেগুলির উদ্দেশ্য কী? একটি লৌহকে যেমন চুম্বকের ধর্ম প্রাপ্ত করার জন্য নিরন্তর চুম্বক দিয়ে ঘর্ষণ করতে হয়, পানিকে যেমন বিশুদ্ধ করার জন্য ফুটাতে হয় ঠিক তেমনই মানুষের আত্মায় সর্বদা মনুষ্য ধর্ম তথা অন্য মানুষের প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত রাখার জন্য নানা উপাসনা করতে হয়। মানুষের সৃষ্টিগত বৈশিষ্টই এমন যে, সে অসচেতনভাবেই নিজ স্বার্থচিন্তায় মগ্ন হয়ে অপরের কল্যাণের চিন্তা ভুলেই যায়। নামাজ, রোজা, পূজা, প্রার্থনার মাধ্যমে সে স্রষ্টার কাছে জবাবদিহি করবে, স্রষ্টাকে স্মরণ করবে, তার কর্তব্য তথা এবাদতের কথা স্মরণ করবে, সে নিজ স্বার্থ ভুলে জগৎসংসারের কল্যাণ চিন্তা করবে। অর্থাৎ উপাসনাগুলি হলো ধর্ম প্রাপ্ত করার প্রক্রিয়া। যতবেশি উপাসনা করবে তত বেশি ধর্ম প্রাপ্ত হবে। এই উপাসনাগুলি সকল খারাপ কাজ থেকে, অকল্যাণকর কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখবে। এজন্যই আল্লাহ বলেছেন, “নিশ্চয় নামাজ সকল প্রকার ফাহেশা তথা অকল্যাণকর কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখে।” (সুরা আনকাবুত- ৪৫)। দিনরাত উপাসনায় মগ্ন থেকেও যদি কারো মধ্যে মনুষ্য ধর্ম জাগ্রহ না হয়, অকল্যাণকর কাজ থেকে সে বিরত না হয়, মানুষের কষ্ট দূর করার জন্য নিজের জীবন-সম্পদ ব্যয় করার মনোবৃত্তি সৃষ্টি না হয় তবে সকল উপসনালয় ব্যর্থ।

Tuesday, October 20, 2015

সামাজিক অপরাধ দূরীকরণে প্রয়োজন ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা

সামাজিক অপরাধ দূরীকরণে প্রয়োজন ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা

 0
রাকীব আল হাসান:
সামাজিক অপরাধ, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, ধর্মব্যবসা ও অপরাজনীতির হীনচর্চা আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে। পরিসংখ্যান বলছে, কেবল আমাদের দেশেই নয় সমগ্র বিশ্বেই সামাজিক অপরাধ, অন্যায়, অশান্তি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা খুললে যে নৃশংস হৃদয়বিদারী চিত্র চোখে ভেসে আসে, তা কোনো মানবসমাজের প্রতিনিধিত্ব করে না। মানুষের মধ্যে পারষ্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, অবিশ্বাস, কূটিলতা, স্বার্থপরায়ণতা ইত্যাদি যখন বৃদ্ধি পায়, এক কথায় মানুষের নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন ঘটে তখন সে মনুষ্যত্ব হারায়। সমাজে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। মানুষের চারিত্রিক অবনতি ও অবক্ষয় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পুলিশ পাহারা দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হচ্ছে না, উপরন্তু যদি শান্তিরক্ষাকারীদের মধ্যেই দুর্নীতি প্রবিষ্ট হয় তখন শান্তি আসার শেষ পথটিও বন্ধ হয়ে যায়। তথাপি মানুষের শান্তির লক্ষ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে, তাদেরকে আধুনিক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে আইন কঠোর থেকে কঠোরতর করা হচ্ছে। যে অপরাধের সাজা ছিল ১০ বছর, তা বাড়িয়ে করা হচ্ছে যাবজ্জীবন, যে অপরাধের সাজা ছিল যাবজ্জীবন তা এখন মৃত্যুদণ্ড করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো দিনকে দিন মানুষের অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেই অপরাধ সংঘটন করছে। পুলিশ প্রহরায় রাস্তাঘাটে হয়তো অপরাধ সংঘটন কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিন্তু বাড়ির মধ্যে স্বামী স্ত্রীকে হত্যা করছে, মেয়ে বাবা-মাকে হত্যা করছে, ভাই ভাইকে হত্যা করছে, পিতা-মাতা সন্তানকে হত্যা করছে, এই ভয়াবহ অবস্থায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দোষারোপ করার কোনো যুক্তি নেই। সমস্ত পরিসংখ্যান বলছে, দিন দিন অপরাধ বাড়ছে, উদ্ভাবিত হচ্ছে অপরাধের নিত্য-নতুন কলাকৌশল। এ থেকে বাঁচতে হলে আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, শুধু শক্তি প্রয়োগ করে, দণ্ডবিধি দেখিয়ে মানুষকে অপরাধ থেকে ফিরিয়ে রাখা সম্ভব নয়। মানুষ শুধু দেহসর্বস্ব প্রাণী নয়, তার একটা আত্মাও আছে। এই আত্মাই তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই মানুষকে যদি আত্মিক শিক্ষা দেবার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করা হয়, তাদেরকে যদি নৈতিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তবে সে নিজেই আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে অপরাধ সংঘটন থেকে নিবৃত থাকবে। অপরাধ প্রবণতা থেকে মানুষেকে বিরত রাখার জন্য এটাই সর্বোত্তম পন্থা, পাশাপাশি অপরাধের জন্য কঠোর দণ্ডবিধিও থাকতে হবে।
আমাদের সমাজে যে ধর্ম প্রচলিত আছে তা একান্তই উপাসনাকেন্দ্রিক- সমাজকেন্দ্রিক নয়। এর নৈতিক শিক্ষাগুলি বহুবিধ কারণে মানুষকে অপরাধ থেকে দূরে রাখতে পারছে না। তাদের জন্য প্রয়োজন ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা। মানুষকে শিক্ষা দিতে হবে প্রকৃত ধর্ম কী, প্রকৃত ইবাদত কী, মানুষের কাছে স্রষ্টার চাওয়া কী, কাজ ও কাজের পরিণতি (হাশর) কী, মানবজন্মের সার্থকতা কীসে, জান্নাতে বা স্বর্গে যাবে কারা ইত্যাদি। অতি সংক্ষেপে মূল কথাগুলো বলার চেষ্টা করছি:-
(১) ধর্ম কী? প্রকৃতপক্ষে ধর্ম হলো কোনো পদার্থ বা প্রাণীর প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। যেমন আগুনের ধর্ম পোড়ানো, পানির ধর্ম ভেজানো। ঠিক একইভাবে মানুষের ধর্ম হলো মানুষের অভ্যন্তরস্থ মানবীয় গুণাবলী। সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতি, দয়া, মায়া, ভালোবাসা, মনুষ্যত্ব, মানবতা, সৌহার্দ্য, বিবেক, সহমর্মিতা, শৃঙ্খলা ইত্যাদি মানবীয় গুণাবলীই হলো মানুষের ধর্ম। যতক্ষণ একজন মানুষ অন্যের ব্যথায় ব্যথিত হয়, অন্যের দুঃখে দুঃখী হয়, অন্যের আনন্দে আনন্দিত হয়, অপরকে সহযোগিতা করে, আর্তপীড়িতের পাশে দাঁড়ায় ততক্ষণ সে ব্যক্তি ধার্মিক হিসেবে পরিগণিত হবার যোগ্য, কেননা তার ভিতরে মনুষ্যত্বের বৈশিষ্ট্যগুলি আছে। পক্ষান্তরে কেউ যদি নামায, রোযা, হজ, পূজা, অর্চনা, উপাসনা ইত্যাদি নিয়ে দিনরাত ব্যাপৃত থাকে কিন্তু তার ভিতরে মানবতার গুণাবলী না থাকে সে প্রকৃত ধার্মিক নয়, আল্লাহর প্রকৃত উপাসক নয়।
(২) প্রকৃত ইবাদত ও মানবজীবনের সার্থকতা: মানবজাতির শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য কাজ করাই মানুষের প্রকৃত ইবাদত। যখন কারো বাড়িতে আগুন লাগে তখন যারা সেই আগুন নেভাতে না গিয়ে মসজিদে নামাজ পড়ে তারা আসলে আল্লাহর ইবাদত করছে না। আমাদের এ কথা থেকে কেউ যেন মনে না করেন যে, আমরা নামাজ পড়াকে ছোট করে দেখছি। হ্যাঁ, মানুষ অবশ্যই নামাজ পড়বে, কারণ নামাজ তাকে মানবতার কল্যাণে আত্মনিয়োগ ও সংগ্রাম করার যে চরিত্র দরকার তা সৃষ্টি করবে। মানুষের জীবনের উদ্দেশ্যে কেবল উদরপূর্তি, সংসারবৃদ্ধি ও দেহত্যাগ করা নয়, ওটা পশুর জীবন। মানুষ আল্লাহর রূহ ধারণকারী, আল্লাহর নিজ হাতে সৃষ্ট আশরাফুল মাখলুকাত। আল্লাহ তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য স্থির করে দিয়েছেন যে, মানুষ যদি তার সমগ্র জীবনকালে স্বার্থকে কোরবানি দিয়ে মানবতার কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে তবেই তার মানবজনম সার্থক হবে। মানুষ যদি এই প্রত্যয় করে যে, সে বাঁচবে মানবতার কল্যাণে, মরবে মানবতার কল্যাণে, জ্ঞান লাভ করবে মানুষকে দেওয়া জন্য, জগতের উন্নতির জন্য, দুটো পয়সা রোজগারের জন্য নয় তবেই এই পৃথিবীতে তার আসার উদ্দেশ্য সার্থক হল।
(৩) হাশর: মানুষের জীবন কর্মফলের চক্রে বাঁধা। মানুষ যে কাজই করে তার ফল অবশ্যই তাকে ভোগ করতে হবে। এখানে যদি সে খারাপ কাজ, মন্দ কাজ, মানুষের জন্য অকল্যাণকর কাজ করে তবে পৃথিবীতেই তাকে তার কুফল ভোগ করতে হবে, হাশরের দিনও তার কষ্টদায়ক ফল ভোগ করতেই হবে। মানুষের পরিণতি বা হাশরের উপমা আল্লাহ, ঈশ্বর প্রকৃতিতে ছড়িয়ে রেখেছেন যেমন- বীজ থেকে অঙ্কুরিত হয় গাছ এবং আর গাছ থেকে হয় ফল। ফলই হচ্ছে সেই বীজের হাশর। এখন সেই বীজ যত ছোটই হোক বা যত বড়ই হোক, তিল, সরিষা, গম, সিম, সুপারি বা নারকেল যা-ই হোক না কেন। মানুষের কর্মও এমন বীজের মতই- তার একটি ফল আছেই। এটাই তার হাশর।
মানুষের আত্মিক এবং মানসিক পরিশুদ্ধির এই প্রশিক্ষণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাগুলির মধ্যেও নেই, ধর্মগুলির মধ্যেও অনুপস্থিত, শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কৃতি সবই তো সম্পূর্ণ বস্তুবাদী ও ভোগবাদী। এ বিষয়গুলো যদি মানুষকে শিক্ষা দেয়া যায়, তাহলেই মানুষের মানসিক অবস্থার শুভ পরিবর্তন হবে এবং সামাজিক অপরাধ অনেকাংশেই বন্ধ হবে।

অন্যায়রোধে উপদেশ যথেষ্ট নয়

অন্যায়রোধে উপদেশ যথেষ্ট নয়

 0

যামানার এমাম জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী’র লেখা থেকে
 হাজারে হাজারে প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলো নানাভাবে মানুষকে অন্যায় থেকে, পাপ থেকে বিরত রাখতে, পুণ্য কাজ বা সওয়াবের কাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ব্যস্ত আছে। এই রকমের প্রতিষ্ঠান ইসলাম, খ্রিষ্ট, হিন্দু, বৌদ্ধ ইত্যাদি পৃথিবীর সব ধর্মেরই আছে। এরা সাধ্যমতো চেষ্টাও করে চলেছে মানুষকে অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে ন্যায় ও পূণ্যে ফিরিয়ে আনতে। পারছে কি? না, দশ বিশ বছর আগের পৃথিবীর অন্যায় অপরাধের অবস্থার সঙ্গে একটা পরিসংখ্যান তুলনা করলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে যে ঐসব মহৎ প্রচেষ্টা মানব জাতিকে সমষ্টিগতভাবে উন্নত করতে পারে নি, তাদের অন্যায়, অপরাধের সংখ্যা কমাতে পারে নি বরং তা বহু বেড়ে গেছে। দশ বিশ বছর আগের তুলনায় শুধু যে পৃথিবীময় অন্যায়, অপরাধ (চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ধর্ষণ, ছিনতাই, খুন জখম ইত্যাদি) দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে তাই নয়, ঐসব মহতি প্রতিষ্ঠানগুলির অবিশ্রান্ত প্রচার সত্ত্বেও মানব জাতি আজ পারমাণবিক আত্মহত্যার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে, আর মাত্র একটি পদক্ষেপ বাকি। কেন ঐসব মহতি প্রতিষ্ঠানগুলির চেষ্টার কোনো ফল হচ্ছে না? যদিও ঐ কাজ করতে বহু কোটি টাকা প্রতি বছর খরচ হচ্ছে? তার কারণ শুধু শিক্ষা দিয়ে, উপদেশ দিয়ে মানুষকে শৃঙ্খলায় আনা যাবে না, যদি শিক্ষা উপদেশের পর তা ভঙ্গ করে অপরাধ করলে কঠিন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না থাকে বা না দেয়া যায়। বর্তমান মুসলিম দুনিয়াতেও অনেক প্রতিষ্ঠান, আনজুমান, জামাত ইত্যাদি আছে যেগুলো মুসলিমদের আরও ভালো ‘মুসলিম’ বানাবার জন্য প্রচার, সভা-সমিতি, এজতেমা, ওয়াজ-মাহফিল ইত্যাদি করে কোটি কোটি টাকা খরচ করেন, বহু পরিশ্রম করেন। এইসব প্রতিষ্ঠানগুলি বহু বছর থেকেই এই কাজ করছে, ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলির যে সংখ্যা ছিল এবং যতলোক এগুলোতে শামিল ছিল আজ তার চেয়ে অনেক বেশি আছে। কিন্তু একটি পরিসংখ্যান নিয়ে দেখুন ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে জনসংখ্যার অনুপাতে বিভিন্ন দেশে শতকরা যতভাগ চুরি, ডাকাতি, খুন, ব্যভিচার ইত্যাদি হতো আজ তার চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে। একটি বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠান আছে যেটার প্রচারিত উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও শিক্ষা দেয়া। বিভিন্ন দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ ঐ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থেকে ঐ কাজ করেন। এরা জোর দিয়ে প্রকাশ করেন যে তাদের প্রতিষ্ঠান নিছক ‘ধর্মীয়’ সুতরাং অরাজনৈতিক। একটি ‘মুসলিম’ প্রধান দেশে এরা বছরে একবার একত্রিত হন। বলা হয় এদের এই সমাবেশে হজ্বের চেয়েও বেশি লোক হয়। যেখানে ঐ বাৎসরিক সম্মেলন হয় ঐ দেশটাকেই ধরুন উদাহরণ স্বরূপ। ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে ঐ দেশটাতে জনসংখ্যার অনুপাতে যে অপরাধ হতো আজ তার চেয়ে বহুগুণ বেশি অপরাধ ঘটছে। শুধু তাই নয় তখন যত রকমের অপরাধ ঘটতো আজ তার চেয়ে অনেক বেশি নতুন নতুন ধরনের অপরাধ যোগ হয়েছে। তাহলে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে হজ্বের পর পৃথিবীর বৃহত্তম ‘মুসলিম’ সম্মেলন করে, এত পরিশ্রম করে লাভটা কী হলো? সত্যিকার ইসলামের কথা না হয় এখানে বাদই রাখলাম অন্যান্য ধর্মও যেটুকু করতে চেষ্টা করে, অর্থাৎ মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে অন্যায় অপরাধ থেকে বিরত রাখা, সেটুকুও তো তারা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। মসজিদ থেকে জুতা চুরিটুকুও তো তারা বন্ধ করতে পারেন নি, বরং জুতা চুরি চল্লিশ বছর আগের চেয়ে আজ অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, এখন মসজিদের দরজা ভেঙ্গে মাইক, ফ্যান, ঘড়িও চুরি হয়ে যায়।
কিছুই হবে না। এই জন্য হবে না যে, অপরাধ করলে তার শাস্তি দেবার শক্তি না থাকলে শুধু ওয়াজ-নসিহত করে মানুষকে অপরাধ থেকে ফেরানো যাবে না এবং ঐ শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রশক্তি ছাড়া সম্ভব নয়। কাজেই রাষ্ট্রীয় ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত না হলে সে ইসলাম পূর্ণ ইসলাম নয়, সেটা হবে আংশিক, কাজেই ব্যর্থ হবে এবং আংশিক ইসলাম আল্লাহ গ্রহণ করেন না, কারণ তা শেরক। সামাজিক জনকল্যাণকর প্রতিষ্ঠানগুলির ব্যাপারেও ইসলামের নীতি বর্তমানের ইসলামের নীতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেখানে শেষ নবী (সা.) প্রবর্তিত শেষ ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে সেখানে সামাজিক পর্যায়ে ইয়াতীমখানা, আনজুমানে মফিদুল ইসলাম, পঙ্গু-আবাস, প্রতিবন্ধী-আবাস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের কোনই প্রয়োজন হবে না, কারণ, এ সমস্ত দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাই মহানবী (সা.) ঐ ধরনের কোন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন নি। যে ইয়াতীমদের সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ কোর’আনে বহুবার উল্লেখ করেছেন; যে ইয়াতীমদের সম্বন্ধে বিশ্বনবী (সা.) এতবার বলেছেন; সেই ইয়াতীমদের জন্য একটি ইয়াতিমখানা তিনি প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন না? যে বিস্ময়কর মহাকর্মী পৃথিবীতে একটা মহাশক্তি সৃষ্টি করলেন তার সামান্য একটি নির্দেশেই তো শত শত ইয়াতীমখানা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেত। তিনি তা করেন নি, তা তার সুন্নাহ নয়, কারণ তিনি জানতেন যে, যে রাষ্ট্র তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেলেন, যে জীবন ব্যবস্থা তিনি চালু করে গেলেন তা যদি মানুষ তাদের জীবনে চালু রাখে, বিকৃত না করে তবে ঐ সব জনকল্যাণকর প্রতিষ্ঠানের কোনই প্রয়োজন হবে না, রাষ্ট্রই সে দায়িত্ব নেবে।
আজ ‘মুসলিমদের’ আকিদায় রাষ্ট্রের কোন স্থান নেই। ‘ধর্ম’ বলতে তাদের আকিদা ও খ্রিষ্টান, ইহুদি, বৌদ্ধ, জৈন, হিন্দু ইত্যাদির আকিদার সঙ্গে কোনো প্রভেদ নেই। তাদের মতোই এদের ‘ধর্ম’ ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ইসলাম, মহানবী (সা.) প্রবর্তিত ইসলাম নয়। তাঁর শেখানো ইসলাম প্রথমেই আরবের বুকে রাষ্ট্রীয় ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারপর তার চলে যাবার পর সে ইসলাম দুর্বার সংগ্রামের মাধ্যমে অর্দ্ধেক দুনিয়ার রাষ্ট্রশক্তি অধিকার করেছিল, এটা সর্বসম্মত ইতিহাস। ঐ সময়ে ঐ ইসলামে অন্য কোন মাযহাব ছিল না, কোন ফেরকা ছিল না, মসলা-মাসায়েল নিয়ে কোন মতভেদ ছিল না, কোন পীর মুরীদ ছিল না, খানকাহ, হুজরা, ছিল না, মসলা মাসায়েল বিশ্লেষণকারী পুরোহিত যাজকশ্রেণি ছিল না। ছিল শুধুমাত্র দীনুল কাইয়্যেমা, সনাতন ধর্ম সেরাতুল মোস্তাকীম। অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, সালাত ও যাকাত, এবং ঐ দীনুল কাইয়্যেমা, সেরাতুল মোস্তাকীমকে সমস্ত পৃথিবীতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করে মানব জাতির জীবনের প্রতি স্তরে শান্তি আনয়ন করার নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম, জেহাদ। আর আজ ঐ দীনুল কাইয়্যেমার, সেরাতুল মোস্তাকীমের, সংবিধানের চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করা আছে, বহু মাযহাব বহু ফেরকায় বিভক্তি আছে, মসলা-মাসায়েল নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি আছে, যাজক শ্রেণি আছে, বহু রকম তরিকা আছে, বহু রকম পীর-মুরীদ আছে, খানকাহ আছে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলাম নেই, ওখানে আল্লাহর ওয়াহদানীয়াত নেই এবং তা করার জেহাদও নেই। সুতরাং এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ঐ দুই ইসলাম একেবারে ভিন্ন জিনিস, একটা অপরটার বিপরীতমুখী। যেহেতু মহানবীর (সা.) প্রবর্তিত ইসলাম এবং বর্তমানের ইসলাম ভিন্ন, সুতরাং ঐ ভিন্ন ইসলামের উৎপাদিত জাতিগুলিও সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং বিপরীতমুখী। আল্লাহর রসুলের (সা.) ইসলাম সৃষ্টি করেছিল এক অজেয় দুর্ধর্ষ যোদ্ধা জাতি, আজকের ইসলাম সৃষ্টি করে কাপুরুষ-ভীতু, যারা যুদ্ধের-সংগ্রামের কাছ দিয়েও যায় না। মহানবীর (সা.) ইসলাম সৃষ্টি করেছিল এক সিংহের জাতি, দীনের সামান্যতম বিপদে হুংকার দিয়ে শত্র“র উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো, আজকের ইসলাম সৃষ্টি করে খরগোশ, বিপদের আভাস পাওয়া মাত্র যেগুলি পাগড়ীর লেজ হাওয়ায় উড়িয়ে তীব্রবেগে গর্তের ভেতর লুকায়। বিশ্বনবীর (সা.) ইসলাম যে মুসলিম সৃষ্টি করেছিল তা সুদূর সিন্ধু দেশে একটি মুসলিম মেয়ের অপমানিত হবার খবর পেয়ে সেখানে মুজাহীদ বাহিনী পাঠিয়ে দিয়েছিল, আজকের ইসলাম যে ‘মুসলিম’ সৃষ্টি করে তা কয়েক মাইল দূরে তাদের মতই ‘মুসলিম’দের হত্যা করা হচ্ছে খবর পেয়ে নির্বিকারভাবে ওযু করে টাখনুর উপর পাজামা পড়ে মাথায় টুপি দিয়ে হাতে তসবিহ নিয়ে মসজিদে যায়। আল্লাহর রসুল (সা.) তার নবীজীবনের সংগ্রামের অতি প্রাথমিক সময়ে বলেছিলেন “শীগগিরই সময় আসছে, যখন একা একটি মেয়ে মানুষ সানা থেকে হাদ্রামাউত পর্যন্ত (কয়েকশ’ মাইল) নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারবে ।” অর্থাৎ ঐ রকম নিরাপত্তা সৃষ্টি করা রাষ্ট্রশক্তি ছাড়া সম্ভব নয়। তাই ইতিহাস এই যে কিছুদিন পরই তার (সা.) প্রবর্তিত ইসলাম আরবের বুকে আল্লাহ’র তওহীদ ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে তার ভবিষ্যতবাণীর নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করেছিল যদিও তখন ঐ ইসলামের মুসলিম সংখ্যায় ছিল মাত্র দু’তিন লাখ। আর আজকের ইসলাম উৎপাদন করে যে ‘মুসলিম’ তারা বিশ-ত্রিশ লাখ একত্র হয়ে এজতেমা করে। তাদের চারিদিকে চলে হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ঘুষ, ছিনতাই। ত্রিশ-চল্লিশ লাখ একত্রিত হয়ে হজ্ব করে আর দুনিয়াময় তাদেরই উপর চলে নির্মম নির্যাতন, যুদ্ধ, রক্তপাত, দেশ থেকে উচ্ছেদ-করণ তবুও তারা টু শব্দটি করার সাহস পায় না। এই সব হাজীদের রাষ্ট্রগুলি শাসিত হয় সেই আইন-কানুন দিয়ে যেগুলো ধ্বংস করে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করতে বিশ্বনবী (সা.) প্রেরিত হয়েছিলেন। বিশ্বনবীর (সা.) প্রবর্তিত ইসলাম যে মুসলিম উৎপাদন করেছিল সে মুসলিমের আকিদা এই ছিল যে, তাদের নেতা আল্লাহর রসুলের (সা.) জীবনের উদ্দেশ্য ছিল সংগ্রামের মাধ্যমে সমস্ত পৃথিবীতে শেষ ইসলাম সমস্ত মানব জাতির উপর কায়েম করে পৃথিবীময় শান্তি প্রতিষ্ঠা, আর আজ যে ইসলাম প্রচলিত তা যে মুসলিম উৎপাদন করে তাদের আকিদা হলো এই যে আল্লাহ নবী রসুলদের নেতা, তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি যার কোনো তুলনা নেই, তাঁকে পাঠানো হয়েছিল মানুষকে টাখনুর উপর পাজামা পরা, মাথায় টুপি দেওয়া, দাঁত মাজা, কুলুখ নেয়া, ডান পাশে শোয়া ইত্যাদি তুচ্ছ ব্যাপার শেখাতে। মানুষের ইতিহাসে বোধহয় কোনো জাতি তার নেতার এমন অপমানকর অবমূল্যায়ন করে নি। কাহ্হার আল্লাহও তার শ্রেষ্ঠ ও প্রিয়তম রসুলের (সা.) এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে ছাড়েন নি। তিনি ইউরোপীয়ান খ্রিষ্টান জাতিগুলি দিয়ে এদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে মেশিনগান দিয়ে গুলি করিয়েছেন, বেয়নেট করে, জীবন্ত কবর দিয়ে, পুড়িয়ে, ট্যাংকের তলে পিষে মেরেছেন, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশুরাও বাদ যায় নি। এদের মেয়েদের ইউরোপের আফ্রিকার বেশ্যালয়ে বিক্রি করিয়েছেন এবং তারপর মাত্র চারটি ছোট দেশ বাদে মরক্কো, থেকে ফিলিপাইন পর্যন্ত এই বিশাল এলাকার সমস্তটুকুর রাষ্ট্রশক্তি এদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ইউরোপীয়ান খ্রিষ্টান জাতিগুলির হাতে দিয়ে দিয়েছেন এবং তারা এদের সর্বস্ব লুণ্ঠণ ও শোষণ করে দারিদ্র্যের চরম সীমায় নামিয়ে দিয়েছে, গৃহপালিত পশুর মতো এদের নিজেদের কাজে লাগিয়েছে, তাদের জুতা পরিষ্কার করিয়েছে।
পৃথিবীর রাজনৈতিক পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে কিছুদিন আগে এই তথাকথিত মুসলিম নামের এই জাতি ইউরোপের দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু মুক্তি তারা দিয়ে গেলেও এরা মুক্তি নেয় নি। এখনও স্বেচ্ছায় তাদের পূর্ব প্রভূদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা-সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও সভ্যতার দাসত্ব করছে। আর যারা মহা মুসলিম তারা সেই আগের মতোই ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী, যিনি মানব জাতির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন তাকে টুপি, পাগড়ী, আর দাড়ি-মোচের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে তার চরম অপমান করে চলেছেন। এরা যদি আজও সেই পৃথিবী কাঁপানো ব্যক্তিত্বকে তাদের নিজেদের মতো গর্তের ভেতরে লুকানো মেরুদণ্ডহীন খরগোশ মনে করে তাঁর অপমান করতে থাকে তবে এরপর আল্লাহর শাস্তি হবে আরো কঠিন, তার প্রতিশোধ হবে আরও ভয়াবহ।
কাজেই শুরুতেই যে কথা বলতে চেয়েছি তা হলো শুধু ওয়াজ নসিহত করে, উপদেশ বিতরণ করে, বাণী শুনিয়ে অন্যায়, অবিচার, অশান্তি দূর করা যাবে না। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব-ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করে সেই রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেই কেবল সকল অবিচার দূর করা সম্ভব। উপদেশবাণী, নীতিকথা শুনে ব্যক্তিগতভাবে কিছু ভালো মানুষ তৈরি হলেও সমষ্টির চাপে, বৃহত্তর শক্তির চাপে ব্যক্তিগতভাবে আর ভালো থাকা যায় না। কাজেই ইসলাম ব্যক্তিগত নয়, জাতীয় ও সমষ্টিক। শুধু আইন প্রয়োগ করে, শরিয়াহ্ প্রয়োগ করে যেমন শান্তি আনা যায় না ঠিক তেমনই শুধু আধ্যাত্মিক শিক্ষা, নসিহত করে, শান্তি আনা যায় না। দুটোই দরকার। এটাই ভারসাম্য, ওয়াসাতা; একদিক শরিয়াহ’র দণ্ডবিধি অন্যদিকে আল্লাহর ভয়ে অন্যায় না করার আত্মিক প্রশিক্ষণ।
[সমস্ত পৃথিবীতে ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৫ সনে এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী হেযবুত তওহীদ নামক আন্দোলনটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই নিবন্ধটি লেখকের বিভিন্ন লেখা ও বক্তব্য থেকে সম্পাদিত। ]

মানবসমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠাই ইসলামের উদ্দেশ্য


প্রকৃত ইসলাম ও বিকৃত ইসলাম; মানবসমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠাই ইসলামের উদ্দেশ্য

 0

 সাইফুল ইসলাম:
মোহাম্মদ (সা.) এর মাধ্যমে ইসলামের সর্বশেষ সংস্করণটি আল্লাহ মানবজাতিকে যে উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছেন সে উদ্দেশ্যই এখন বদলে গেছে। মানব সৃষ্টির প্রারম্ভের ঘটনাগুলোর মধ্যে ইসলামের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। মানুষ সৃষ্টির সময়কার ঘটনাপ্রবাহ যা আল্লাহ আল কোর’আনের মাধ্যমে আমাদের জানিয়েছেন তা মোটামুটি এই যে, ‘আল্লাহ যখন পৃথিবীতে তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসাবে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিবিশিষ্ট একটি নতুন সৃষ্টি (আদম) করতে চাইলেন, তখন সকল মালায়েক মানুষ সৃষ্টির বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপন করে বলেছিল যে, ‘তোমার প্রশংসা ও গুণকীর্তণ করার জন্য আমরাই কি যথেষ্ট নই? তোমার এই সৃষ্টি পৃথিবীতে গিয়ে ফাসাদ (অন্যায় অশান্তি) ও সাফাকুদ্দিমা (রক্তপাত, যুদ্ধ বিগ্রহ) করবে (সুরা বাকারা ৩০)। কিন্তু আল্লাহ তাদের এই মৃদু আপত্তি সত্ত্বেও আদম (আ.) কে সৃষ্টি করলেন। এরপর আল্লাহ তাঁর নিজের রূহ আদমের (আ.) ভিতরে ফুঁকে দিলেন এবং সকল মালায়েককে আদমের খেদমতে নিয়োজিত করলেন। তারা প্রত্যেকেই আদমকে (আ.) সেজদা করার মাধ্যমে আল্লাহর এই হুকুমের আনুগত্য করল এবং আদমের সেবায় নিয়োজিত হলো। কিন্তু ইবলিস আল্লাহর এই হুকুমকে অন্যায্য ঘোষণা করে আদমকে সেজদা করা থেকে বিরত রইল। ফলে আল্লাহ ইবলিসকে তার সম্মানজনক অবস্থান থেকে বিতাড়িত (রাজীম) করলেন এবং অভিশাপ দিলেন। ইবলিসও তখন আল্লাহর কাছে অবকাশ চেয়ে নিলো এবং আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ দিলো যে সে বিভিন্ন প্রকার প্ররোচনা দিয়ে অধিকাংশ মানুষকেই আল্লাহর হেদায়াত (দিক নির্দেশনা), সরল পথ থেকে বিচ্যুত করে ফেলবে এবং প্রমাণ করবে যে মানুষ তার চাইতে নিকৃষ্ট সৃষ্টি। আল্লাহ জানিয়ে দিলেন যে, তিনি প্রতি যুগে, প্রতি জনপদে তাঁর নবী-রসুল পাঠিয়ে হেদায়াহ ও দীন (জীবনব্যবস্থা) প্রেরণ করবেন। সেটাকে অনুসরণ করলেই তারা দুনিয়াতে একটি শান্তিময় ও প্রগতিশীল সমাজে বসবাস করতে পারবে। সেখানে থাকবে না কোন ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা অর্থাৎ অন্যায়, অশান্তি, যুলুম, রক্তপাত, যুদ্ধ, ক্রন্দন, হতাশা অর্থাৎ সৃষ্টির আদিতে মালায়েকরা মানবজাতিকে নিয়ে যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল সেগুলো থাকবে না। পাশাপাশি ইবলিসের সঙ্গে করা চ্যালেঞ্জে আল্লাহ বিজয়ী হবেন।’
এজন্যই ইসলাম শব্দের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে শান্তি, এই নামকরণ আল্লাহ করেছেন এই জন্য যে, এই দীন, জীবন যাপন পদ্ধতি পৃথিবীর যে অংশে প্রতিষ্ঠিত হবে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে, সেখানে অশান্তির লেশও থাকবে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে এই দীনের আকীদা বা উদ্দেশ্য হলো- সমস্ত জীবনব্যবস্থার উপর একে সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করে মানবজীবনের সর্ব অঙ্গন থেকে অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত অর্থাৎ ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এই কাজ করাই হচ্ছে আল্লাহর খেলাফত করা, আর খেলাফত করাই হলো প্রকৃত এবাদত। এখন মুসলিম দাবিদার জাতির সামনে থেকে দীনের এই উদ্দেশ্য হারিয়ে গেছে, তারা কেবল নামাজ, রোজা, হজ্ব করাকেই এবাদত হিসাবে ধরে নিয়ে ভালো মানুষ হওয়ার জন্য জোর প্রচেষ্টা করছে। পৃথিবীতে সেই এবাদত কোন শান্তি আনতে পারছে কি পারছে না, তা ভেবেও দেখছে না। যেন সমাজের শান্তি-অশান্তির সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই, এবাদতেরও কোন সম্পর্ক নেই। আজ দীনের উদ্দেশ্য করা হয়েছে আখেরাতের পুঁজি হিসাবে সওয়াব অর্জন করা যেন মিজানের পরিমাপে পুণ্যের পাল্লা ভারি হয় আর পদ্ধতি করা হয়েছে উপাসনা। এটা জানা কথা যে, উদ্দেশ্য ভুল হলে আর কোন কিছুরই কোন মানে থাকে না। অথচ আল্লাহর দেওয়া ইসলামের উদ্দেশ্য হচ্ছে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, এই দীন অনুসরণের অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে শান্তি এবং অনুসরণ না করার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে অশান্তি। তাই যেখানে শান্তি নেই, আমরা বলতে পারি সেখানে ইসলাম নেই।

সন্ত্রাসের কালো থাবায় বিপন্ন গ্রহ

সন্ত্রাসের কালো থাবায় বিপন্ন গ্রহ

 0
Untitled-18
রিয়াদুল হাসান :
সারা দুনিয়াময় যে জীবনব্যবস্থা বা সিস্টেম চলছে সেই সিস্টেমই হচ্ছে সকল অপরাধ, অন্যায়, অবিচার ও অশান্তির উৎস। এই সিস্টেমের কারণেই কলুষিত আমাদের অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষাব্যবস্থা সবকিছু।  দুনিয়াময় যে সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসবাদ করাল থাবা বিস্তার কোরে আছে, সেটাও এই সিস্টেমেরই সৃষ্টি।
আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হয় পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত জ্বালামুখে, তারপর সেই গলিত লাভার স্রোত উচ্চভূমি থেকে নিুগামী হয়ে পাদদেশের সমতলভূমিকে ভষ্মীভূত কোরে দেয়। ঠিক তেমনি সন্ত্রাসবাদের জন্ম হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্বের পরাশক্তিদের হাতে। সেখান থেকে বিস্তারলাভ করে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, তারপর তা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের রূপ নিয়ে প্রতিটি ভূখণ্ডে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে সামাজিক অঙ্গন, শিক্ষাঙ্গন পেরিয়ে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত খুনোখুনি, রক্তের স্রোত, নিরাপত্তাহীনতা, অন্যায় ও অশান্তির দাবানল জ্বালিয়ে দেয়। সন্ত্রাস মিশে যায় মানবসমুদ্রে। প্রতিদিন জন্মায় নতুন সন্ত্রাসী।
আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস:
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে চলছে রক্তারক্তি, হানাহানি। ইরাক, আফগানিস্তান, মিশর, সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, ইসরাইল, আমেরিকা, রাশিয়া প্রভৃতি দেশগুলোতে চলছে রাষ্ট্রের অনুমোদনে সন্ত্রাসবাদ।  কোন কোন রাষ্ট্র ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তারের যুদ্ধে, কখনও সন্ত্রাস দমনের নামে নিজেরাই পৃথিবীকে অগ্নিগোলকে পরিণত করে রেখেছে। এই শতাব্দীতে দুটি বিশ্বযুদ্ধে চৌদ্দ কোটি বনি আদম যে শুধু হতাহত হয়েছে তাই নয়, ঐ যুদ্ধের পর সংঘাত এড়াবার মানবিক প্রচেষ্টার ফল জাতিসংঘের জন্মের পরও শুধু ২০০০ সন পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে ৪০,৯৬৮,০০০ (চার কোটি নয় লক্ষ আটষট্টি হাজার) মানুষ শুধু নিহতই হয়েছে, আহতদের সংখ্যা স্বভাবতই এর দশ গুণের বেশি (Stockholm International Peace Research Institute)। আর এই নতুন শতাব্দীর একটি দিনও অতিবাহিত হয় নি, যেদিন পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও যুদ্ধ ও রক্তপাত হয় নি।  শুধুমাত্র ইরাকেই নিহত হয়েছে ১০ লক্ষ মানুষ, আফগানিস্তান, মায়ানমার, সিরিয়া, ফিলিস্তিন এসব দেশের কথা বাদই দিলাম। এই মৃত্যুর সঙ্গে যে দুঃখ, হাহাকার, দারিদ্র্য, ক্ষুধা, ধর্ষিতার ক্রন্দন, গৃহ হারানোর বেদনা আর অশ্র“ জড়িয়ে আছে তা কোন পরিসংখ্যানে নেই।
রাজনৈতিক সন্ত্রাস:
মানবজাতির মধ্যে বিরাট অনৈক্য আর বিভেদের প্রাচীর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে পাশ্চাত্যের সৃষ্ট রাজনৈতিক মতবাদগুলি। ৪/৫ বছর পর পর অকল্পনীয় অর্থ ব্যয় কোরে দাঙ্গা হাঙ্গামার মধ্য দিয়ে একটি দল ক্ষমতায় আরোহণ করে। পরদিন থেকেই শুরু হয় বিরোধীদলের তীব্র সরকার বিরোধিতা যা খুব শীঘ্রই আন্দোলনে রূপ নেয়। কোন সরকারই তার মেয়াদকালে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয় না, কারণ পেছনে লেগে থাকে বিরোধী দল নামক শত্র“সেনা।  আগে যুদ্ধ হতো রাজায় রাজায়, এখন যুদ্ধ হয় সরকার আর বিরোধী দলে। দু’দলই জনগণের কথা বেমালুম ভুলে যায়।  রাজনীতির মাঠে চলে ক্ষমতার লড়াই আর অস্ত্রের ঝনঝনানি। খেলার মাঠে ফুটবলের যে দশা, গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে জনগণের অবস্থাও তেমন। জনগণ ভালো করেই জানে যে, সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ, আদর্শবান মানুষ রাজনৈতিক অঙ্গনে অচল। বরং যে প্রচুর কালো টাকার মালিক, যার সন্ত্রাসী ক্যাডার বাহিনী আছে, যে বেশি সাজিয়ে মিথ্যা বলতে পারে সেই নির্বাচনে জয়ী হয়।  তারপর শুরু হয় দেশের সম্পদ লুণ্ঠন, দুর্নীতি, নামে বেনামে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তৈরি ইত্যাদি যেন পরবর্তীতে আর ক্ষমতায় না আসলেও টেনশন না করতে হয়।
সামাজিক সন্ত্রাস:
সমাজের বুকেও চলছে ভয়াবহ এই সন্ত্রাসবাদের আগ্রাসন, মহল্লায়-মহল্লায়, পাড়ায়-পাড়ায়, গ্রামে-গ্রামে, এমনকি পরিবারের সাথে পরিবারের অন্তর্দ্বন্দ্ব সমাজকে ঠেলে দিচ্ছে সন্ত্রাসবাদের দিকে।  আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি নিয়ে রেষারেষি, খুন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এমনকি গুমের মতো ঘটনা ইত্যাদিও অহরহ ঘটে চলেছে। রোজকার পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় টুকরো টুকরো লাশ, পানির ট্যাংকে, ম্যানহলের মধ্যে গলিত লাশ উদ্ধারের খবর।
শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস:
অন্যান্য অঙ্গনের মতো শিক্ষাঙ্গনও আজ সন্ত্রাসবাদের কবলের বাইরে নয়। বরং সংঘঠিত ছাত্র সমাজকে সন্ত্রাসবাদের মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, আর শিক্ষাঙ্গনকে বানিয়ে রেখেছে সন্ত্রাসবাদের আখড়া।  প্রায়ই ছাত্রাবাস থেকে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, ধারাল অস্ত্রপাতি উদ্ধারের সংবাদ আমরা দেখি।  গ্রামের কোন দরিদ্র কৃষক হয়ত পরের জমিতে বর্গা চাষ করে উদয়াস্ত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে সন্তানের লেখাপড়ার খরচ যোগান।  সেই সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে হয়ে যায় সন্ত্রাসী।  অথবা বাড়ি ফেরে লাশ হয়ে।  বর্তমানে ছাত্র এবং শিক্ষক উভয়ই রাজনৈতিক দলগুলির লেজুড়বৃত্তিতে মগ্ন।  ছাত্রদেরকে কোন না কোন দলে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়, নয়তো হলে থাকতে দেওয়া হয় না।  এটাই হচ্ছে আমাদের শিক্ষাঙ্গনের চালচিত্র।
ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ:
যে ধর্ম এসেছে মানুষের কল্যাণের জন্য, সেই ধর্মই আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে আতঙ্কের অপর নাম। ধর্মের নামে পৃথিবী জুড়ে চলছে উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদ। ফিলিস্তিন, ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, থাইল্যান্ড, জিংজিয়াং, নাইজেরিয়া, মায়ানমার, বাংলাদেশ এভাবে পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রেই মহামারি আকার ধারণ করেছে এই ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ।  বলা চলে বর্তমান সময়ে বিশ্বের সকল সন্ত্রাসবাদের মূল কেন্দ্রবিন্দু এই ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসবাদ। একে দমন করার অজুহাতেই গত দুই যুগ ধরে বিশ্বব্যাপী চলছে যুদ্ধ আর রক্তক্ষরণ।  অন্যদিকে যে ধর্মব্যবসাকে আল্লাহ হারাম করেছেন, সেই ধর্মকে ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করেছে এক শ্রেণির ধর্মজীবী মোল্লা।  অন্যান্য ব্যবসায়ে যেমন সিন্ডিকেট কোরে মনোপলি করা হয়, ঠিক সেভাবে ধর্মকেও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মোল্লারা নিজেদের কুক্ষিগত কোরে রেখেছে।  সেখানে মাদ্রাসা শিক্ষিত ছাড়া যেন কারও প্রবেশাধিকার নেই।  সেই কূপমণ্ডূক ধর্মজীবী আলেম শ্রেণি প্রায়ই বিভিন্ন ইস্যুতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা ও উন্মত্ততা সৃষ্টি কোরে চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্নপ্রকার সন্ত্রাস, রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।
এভাবেই মানবজাতি পৌঁছে গেছে ধ্বংসের একেবারে দ্বারপ্রান্তে।  মানবিকতা, নীতি নৈতিকতার বোধ বহু আগেই বিদায় নিয়েছে মানবসমাজ থেকে।  এখন সময় এসেছে শারীরিক ধ্বংসের।  সারা দুনিয়ার প্রতিটি জনপদ, প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের আকুতি কিভাবে মুক্তি আসবে? কিভাবে, কোন পথে পৃথিবী শান্ত হবে।
অসহায় বিশ্বশক্তি:
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কোন কিছু করার উপায় নেই, সেখানে জড়িত আছে বিশ্বের মাথা রাষ্ট্রগুলি।  কিন্তু সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ দমনের জন্য কম চেষ্টা তদবির হচ্ছে না।  শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলমান এই সংকট নিরসনে একটার পর একটা জীবন ব্যবস্থা পরিবর্তন করা হয়েছে, বিভিন্ন সংস্থা সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান কোরে যাচ্ছে নিয়মিত সভা সেমিনার। বিভিন্ন সামরিক, আধা সামরিক, বেসামরিক বাহিনী তৈরি করে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করার জন্য।  তাদেরকে দেওয়া হচ্ছে উচ্চতর প্রশিক্ষণ।  কিন্তু সব ব্যর্থ। পৃথিবীর সর্ব ক্ষমতাবান ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টই স্বীকার করছেন তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ।  আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে ২৮ মার্চ, ০৯ তারিখে তিনি আফগানে তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান প্রসঙ্গে বলেন, A campaign against extremism will not succeed with bullets or bombs alone.অর্থাৎ চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে শুধু বুলেট ও বোমা দিয়ে সফল হওয়া যাবে না (বিবিসি, The STAR, 3 April, 2009) )। কিন্তু এর কোন বিকল্প তাদের সামনে না থাকায় এখনও তারা সামরিক শক্তি দিয়েই জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা কোরে যাচ্ছেন এবং স্বভাবতই সফল হচ্ছেন না।  তারা নিজেদের দেশে সামাজিক সন্ত্রাসও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন নি। তাই আজও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ অপরাধ সংঘটনের তালিকায় শীর্ষস্থানীয় একটি দেশ। সেখানে প্রতি ঘণ্টায় ৭৮ জন নারী ধর্ষিতা হয়। এটা মোট সংঘটিত ধর্ষণের মাত্র ১৬%। বাকিগুলো পুলিশের গোচরীভূত হয় না।  আর আমাদের উপমহাদেশের সুপার পাওয়ার ভারতে প্রতি ২২ মিনিটে ধর্ষিতা হন একজন নারী।  কানেকটিকাটের একটি স্কুলে একজন ছাত্রের গুলিতে ২৭টি শিশু নিহত হওয়ার ঘটনায় কথা বলতে গিয়ে বারাক হোসেন কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র এর শিশুদেরকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হলো।  পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রপ্রধান মি. ওবামা যদি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এভাবে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন তাহলে অন্যান্য দেশগুলির অবস্থা যে আরও ভয়াবহ তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।
তার এই কান্নাকে খাটো কোরে দেখার কোন অবকাশ নেই, কিন্তু সেই সঙ্গে একটি প্রশ্ন প্রাসঙ্গিকভাবে এসে যায়: বারাক হোসেনের যুদ্ধনীতি হচ্ছে ড্রোন হামলা। তিনি পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত ক্রমাগতভাবে যে ড্রোন হামলা চালিয়ে কতজন শিশু হত্যা করেছেন সে হিসাব কি তিনি রাখছেন?
যাই হোক। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ আশা করি অন্তত একটি বিষয়ে একমত যে তারা সকলেই চান শান্তি আসুক। কিন্তু তারা জানেন না যে কোন পথে সেই শান্তি আসতে পারে। একেক জন একেকভাবে চেষ্টা করছেন।  প্রার্থনাকারীরা তাদের উপাসনালয়ে নিয়মিত প্রার্থনা কোরে যাচ্ছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে তাদের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ। চারিদিকে কেবল হতাশা আর হতাশা।
অন্ধকারে আশার আলো:
হ্যাঁ, এই অশান্ত পৃথিবী এনশা’আল্লাহ অচীরেই শান্ত হবে, সকল সন্ত্রাসবাদ, অন্যায় অশান্তি দূর হবে। অবিচার বন্ধ হবে।  অশান্তির আগুনে দগ্ধ পৃথিবীর বুকে শান্তির সুবাতাস বইয়ে দিতে পারে একমাত্র সৃষ্টিকর্তার থেকে আগত সনাতন, শাশ্বত, সত্য জীবনব্যবস্থা।
তাই আহ্বান পুরো মানবজাতির প্রতি, আমরা যদি সত্যিই মানবজাতির মঙ্গল চাই, আমাদের নিজেদের মঙ্গল চাই, যদি বাঁচতে চাই, যদি সত্যিই আমরা আমাদের সন্তানদেরকে ভালোবাসি, আসুন আমরা আমাদের স্রষ্টার দেওয়া সত্য জীবনব্যবস্থাটি মেনে নেই, এমন একটি পৃথিবী গড়ি যেখানে আমরা এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিরাপদে জীবনযাপন করতে পারবে।  পাশাপাশি পরজীবনেও আমরা লাভ করব চিরস্থায়ী জান্নাত, স্বর্গ ও হ্যাভেন।

হেযবুত তওহীদের গান

হেযবুত তওহীদের গান 

শিল্পি ও সুরকার: নাজমুল আলম শান্তু তেজগাঁও কলেজের অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় তিনি এ গানটি পরিবেশন করেন। শোনো শোনো শোনো রব উঠেছে, আকাশ পাতাল ছেয়ে, আসছে বিজয় আসছে সুদিন প্রহরের খেয়া বেয়ে। জাগো জাগো জাগো আর কতকাল থাকবে ঘুমিয়ে। অন্ধ কারার বন্দীরা চলো মুক্তির পথে ধেয়ে। কৃষকের নোনা ঘামের মূল্যে যে ফসল ওঠে ঘরে, শ্রমিকের হাড় ভাঙা খাটুনিতে শিল্পের চাকা ঘোরে, বকেয়া মজুরি শোধ হবে সব এই প্রত্যয় নিয়ে, এলো সোনা ঝরা নতুন প্রভাত অবাক সূর্যোদয়ে। কেটে যাবে এই কালোরাত্রি জয়ের পরশ পেয়ে। শিশুটির চোখে কষ্ট ভীষণ ক্ষুধার আগুন পেটে, ধনীর দুয়ারে অনাহারী মা অসহায় দিন কাটে। হারিয়ে গিয়েছে শান্তির চাবি বিবর্ণ হতাশায়, সে চাবির খোঁজ মিলেছে আবার গান গেয়ে বলে যাই। অনাহারী আর থাকবে না কেউ শহরে কিংবা গাঁয়ে। জ্ঞানের নেশায় মাতোয়ারা ছিল কই সে ছাত্রদল, তাদের হাতে রক্তের রং কারা এঁকে দিল বল্? চোখে মুখে কারা একে দিল এত সহিংসতার ছাপ, ছাত্রজীবন মৃত্যুর ফাঁদ রাজনীতির অভিশাপ। কেটে যাবে এই কালোরাত্রি জয়ের পরশ পেয়ে। (কথা: রিয়াদুল হাসান)

Monday, October 19, 2015

ইসলামসম্পর্কিত কিছু বিষয়

আমরা যখন ইসলামসম্পর্কিত কিছু বিষয় সঠিকভাবে তুলে ধরছি তখন কিছু কিছু আপত্তি আসছে। ঠিক আপত্তি নয়, তবে এক ধরনের অনুযোগ যে, আপনারা ঠিক লিখেছেন কিন্তু কথাটা ওভাবে না বলে আরো সুন্দর করে, নরমভাবে বলতে পারতেন। এমনও অভিযোগ এসেছে যে আপনাদের লেখা ঠিক আছে, কিন্তু যেভাবে 'ইসলামের সমালোচনা' করছেন তাতে ইসলামবিদ্বেষীরা ইসলামকে হেয় করার সুযোগ পেয়ে যাবে। তাছাড়া অনেকে আপনাদেরকে ইসলামের বিপরীতে লিখেছেন এমনটাও মনে করতে পারে। কারণ, কেউ কেউ পোস্টের কয়েক লাইন পড়েই একটা ধারণা করে নিয়ে নেয়। আপনাদের লেখা পুরোটা না পড়লে বিভ্রান্তির যথেষ্ট সুযোগ আছে।
এ ব্যাপারে আমাদের আত্মপক্ষ সমর্থন হচ্ছে: বর্তমানে প্রায় ১৮০ কোটি মুসলিম জনসংখ্যার হাতে পঞ্চান্নটির মত রাষ্ট্রের মালিকানা থাকা সত্ত্বেও, তেল-গ্যাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদের এক বিরাট অংশের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তারা যে গভীর সংকটকাল অতিক্রম করছে এর পেছনে প্রধান দায় মূলত তাদের নিজেদেরই। এই দায়ের মধ্যে আছে ধর্ম সম্বন্ধে ভুল ও বিকৃত ধারণা, অজ্ঞতাসহ ধর্মের অপব্যবহার ইত্যাদি। ইসলামকে যারা পূর্বের ন্যায় নব যৌবনরূপে দেখতে চান তারা সেসবের সাথে আপোস করে মিনমিনিয়ে কথা বললে হবে না। আপনি সেসব অন্ধত্ব দূরও করতে চান আবার যারা সেই অন্ধত্ব টিকিয়ে রেখেছে তাদেরকে রাগাতে চান না- এই দুটো একসাথে কোনদিনও সম্ভব নয়। যেমন করে সম্ভব নয় দেহের কোন অংশে ফোঁড়া হলে তাকে আলতো করে হাত বুলিয়ে সারিয়ে ফেলা।
স্বাভাবিক নিয়মই এই যে, যখন কায়েমী স্বার্থবাদীরা নিজেদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ বা বক্তব্য দেখতে পাবে তখনই তারা তাতে সর্বাত্মক বাধা দেবে। তারা আপনাকে বাধ্য করতে চেষ্টা করবে সেই সত্যের সাথে মিথ্যার আপস ঘটাতে। তাদের স্বার্থ রক্ষা করে সত্যকে মিনমিনিয়ে উপস্থাপন করানোরও চেষ্টা করবে। এখন তাদের মুখের দিকে চেয়ে যদি আপনি সত্যকে সঠিকরূপে উপস্থাপন না করেন তবে আপনি কোনোদিনও সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না।
আমাদের কথা হচ্ছে, যে জাতি নিজেদের ব্যর্থতাকে উপেক্ষা করে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, নিজেদের বিরুদ্ধে যাওয়া সত্যকে গোপন করে, আত্মসমালোচনা করতে ভয় পায়, জবাবদিহিতাকে ভয় পায় সেই জাতি কোনোদিনই জাগতে পারবে না, শ্রেষ্ঠও হতে পারবে না। যারা বলেন কারো কথায় ইসলামবিদ্বেষীরা আমাদের দুর্বলতা সম্বন্ধে জেনে যাবে তাদেরকে বলবো যে, দুর্গন্ধ ছাড়ানোর ভয়ে কি আপনি নোংরা জিনিস আপনার চাদরের তলায় রেখে দেবেন? এটাই কি উচিত নয় যে সেই নোংরা বস্তুটাকে আপনি ঢিল মেরে দূরে ছুঁড়ে মারবেন?
যারা বলছেন যে আমরা ইসলামের সমালোচনা করছি তারা ভুল বুঝতেছেন। মিথ্যার সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। যা ইসলামের নয় সেটাকে ইসলামের সাথে জড়িয়ে মেকি যে একটা ইসলাম দাঁড় করা হয়েছে আমাদের কথা সেটার বিরুদ্ধে। কখনোই সেটা ইসলামের বিরুদ্ধে নয়। তারপরও যদি আপনি অর্ধেক স্ট্যাটাস পড়ে আমাদেরকে ইসলামবিরোধী বলে ধরে নেন তবে আপনার জন্য করুণা করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করণীয় নেই। আপনার মত লাখে লাখে ভেড়ার পাল থাকলেও একই কথা। ভেড়ার পাল দিয়ে ইসলামের উপকার কোনো কালে হয়নি আর হবেও না।

ধর্মগ্রন্থ ও শাস্ত্রের বিধানই মানুষকে শধর্মগ্রন্থ ও শাস্ত্রের বিধানই মারিয়াদুল হাসান:


ধর্মগ্রন্থ ও শাস্ত্রের বিধানই মানুষকে শান্তি দিয়েছে


বর্তমানে ইসলাম সম্বন্ধে দু’টি ভুল ধারণা প্রচলিত। একটি হলো মুসলিম বলে পরিচিত জাতিটি যে ধর্মে বিশ্বাস করে এটিকে বলা হয় ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্মকে অন্য বিভিন্ন নাম দেয়া হয়েছে। কিন্তু আসলে আল্লাহ আদম (আ.) থেকে শুরু করে শেষ নবী (সা.) পর্যন্ত যতবার যতভাবে জীবন-বিধান পাঠিয়েছেন সবগুলোরই ঐ একই নাম ইসলাম, শান্তি অর্থাৎ যে জীবন-বিধান অনুসরণ করে চললে মানুষ শান্তিতে সুখে বাস করতে পারবে আর অস্বীকার করলে তার অবধারিত পরিণতি অশান্তি, রক্তারক্তি, অবিচার। রাজনৈতিক আর্থ-সামাজিক অবিচার- যা মালায়েকরা বলেছিলেন।
দ্বিতীয়টি হলো এই ধারণা (আকিদা) যে, আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণের নাম ইসলাম।  এটাও ভুল।  কারণ আল্লাহ ইচ্ছা করলে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করবে।  কোন অবিশ্বাসী, কোন সন্দেহকারী, কোন মুশরিক বা মোনাফেক থাকবে না (সুরা আল আনা’ম ৩৫, সুরা ইউনুস ১০০)।  কাজেই তা নয়।  আল্লাহ মানুষের মধ্যে তার নিজের আত্মা ফুঁকে দিয়েছেন অর্থাৎ মানুষের মধ্যে যুক্তির শক্তি, বুদ্ধি, জ্ঞান ও সর্বোপরি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন, নবী পাঠিয়ে তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন, যে পথে চললে সে নিজেদের মধ্যে মারামারি, রক্তারক্তি না করে শান্তিতে থাকে। এরপর তিনি দেখবেন কে বা কারা তাঁর দেখানো পথে চলবে আর কে বা কারা তা চলবে না।
কাজেই আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণের নাম ইসলাম নয়।  তাঁর দেয়া জীবন-ব্যবস্থাকে গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠা করার ফল হিসাবে যে শান্তি সেই শান্তির নাম ইসলাম। মানুষ যদি যেসব নিয়ম, আইনের মধ্যে এই জগৎ সৃষ্টি করা হয়েছে ও চলছে তা সব জানতো তবে হয়তো মানুষই নিজেদের জন্য এমন জীবন-ব্যবস্থা, ধর্ম তৈরি করে নিতে পারত যা মেনে চললেও ঐ শান্তি ইসলাম আসতে পারতো।  কিন্তু মানুষ তা জানে না- তাকে আল্লাহ অতখানি জ্ঞান দেন নি। তাই স্রষ্টা তাকে বলে দিয়েছেন কোন পথে চললে, কেমন জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করলে ঐ অভীষ্ট শান্তি, ইসলাম আসবে। বলে দিয়েছেন তাঁর নবীদের মাধ্যমে। মনু (আ.), কৃষ্ণ (আ.), যুধিষ্ঠির (আ.), ইব্রাহীম (আ.), মুসা (আ.), ঈসা (আ.) এবং আরও অনেক অনেক নবী-রসুলদের মাধ্যমে এবং সর্বশেষে মোহাম্মদের (সা.) মাধ্যমে। [মনু (নুহ্ আঃ) কৃষ্ণ (আ.), যুধিষ্ঠির (ইদরীস আঃ) এরা যে নবী ছিলেন তা আমার গবেষণার ফল, ব্যক্তিগত অভিমত।  এ অভিমত আমি অন্য কাউকে গ্রহণ করতে জোর করছি না]।  কোন প্রাণী হত্যা করবো না, কেউ আমার কোট চুরি করলে তাকে জোব্বাটাও দিয়ে দিবো, এ অর্থে এ ইসলাম নয়।  যে ধর্ম ঐ শিক্ষা প্রচার করে তারা সংখ্যায় পৃথিবীতে অন্য সব ধর্মের চেয়ে বেশি কিন্তু সমস্ত পৃথিবী আজ ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি অশান্তি আর রক্তারক্তিতে লিপ্ত।  শুধু তাই নয় ঐ মতে বিশ্বাসীরা এই শতাব্দীতেই দু’বার নিজেদের মধ্যে মহাযুদ্ধ বাঁধিয়ে প্রায় পনের কোটি মানুষ হত্যা করেছে, হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর দু’টি কয়েক লক্ষ মানুষসহ ধ্বংস করেছে এবং আজ পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে সম্পূর্ণ মানব জাতিটাকেই ধ্বংস করার মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে।
মানুষকে নিজেদের মধ্যে অশান্তি, অবিচার, মারামারি না করে শান্তিতে, ইসলামে থাকার জন্য জীবন বিধান দিয়ে আল্লাহ যুগে যুগে পৃথিবীর প্রতি স্থানে, প্রতি জনপদে, প্রতি জাতিতে তার প্রেরিতদের, নবীদের পাঠিয়েছেন (সুরা আন নহল ৩৬)।  মানুষ জাতির কিছু অংশ তা গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠা করেছে, কিছু অংশ করে নি।  যারা গ্রহণ করেছে তাদের সমাজের রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি জীবনের সমস্ত কিছুই ঐ ব্যবস্থার নির্দেশে পরিচালিত হয়েছে।  তাদের সমাজের আইনের উৎস শুধু ঐ জীবন-বিধান বা ধর্মই ছিল না ঐ বিধানই আইন ছিল, ওর বাহিরের কোন আইন সমাজ গ্রহণ করত না।  অনেক কারণে আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধান বদলিয়ে ফেলে বা ইচ্ছামতো তার ভুল ব্যাখ্যা করে তা চালানো হয়েছে। কিন্তু ঐ ভুল ও অন্যায় আইনকেও সেই ধর্ম বা দীনের আইন বলেই চালানো হয়েছে। তার বাহিরের, মানুষের তৈরি বলে চালানো যায় নি।  পৃথিবীর ইতিহাসকে না তলিয়ে, শুধু এক নজরে যারা পড়েছেন তারাও এ কথা অস্বীকার করতে পারবেন না যে মানব সমাজ চিরদিন শাসিত হয়ে এসেছে ধর্মের আইন দিয়ে। যখন যেখানে যে নবী ধর্ম বা জীবন-বিধান প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেখানে রাজা বা শাসনকর্তা শাসন করেছেন সেই আইন দিয়ে- অন্য কোন কিছু দিয়ে নয়।  আইনের নির্দেশ, উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন সমাজের বিজ্ঞেরা, পুরোহিতরা, আর তাকে প্রয়োগ করেছেন রাজারা, শাসকরা।  ওর বাইরের কোন আইন, আদেশ চালাবার চেষ্টা করলে সমাজ তা গ্রহণ করত না, প্রয়োজনে বিদ্রোহ করত। উদাহরণ হিসাবে পশ্চিম এশিয়া নিন।  ইহুদিদের আগে ওখানে আমন বা রা দেবতা থেকে শুরু করে অনেক রকম দেব-দেবীর ধর্মের আইন চলত।  ওগুলোও পূর্বতন কোন নবীর আনা দীনের বিকৃতির ফল ছিল।  ইব্রাহীম (আ.) আবার আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, তওহীদ প্রতিষ্ঠা করার পর ইহুদিরা যতদিন মধ্য এশিয়ায় ছিল ততদিন ঐ আল্লাহ প্রেরিত দীনই ছিল তাদের জাতির আইন। ভারতের কথা ধরুন। রামায়ন, মহাভারতসহ ইতিহাস পড়ুন।  দেখবেন রাজারা শাসন করেছেন শাস্ত্রানুযায়ী- অর্থাৎ ওটাই ছিল শাসনতন্ত্র (Constitution)। ঐশ্বরিক বইয়ের (Scripture) উপর ভিত্তি করে শাস্ত্র, সেই শাস্ত্রের বিধান দিতেন ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা এবং বিধান বা আইন জনগণের উপর প্রয়োগ ও তার রক্ষার দায়িত্ব ছিল ক্ষত্রিয় রাজাদের উপর। এই শাস্ত্রীয় বিধানের বিরুদ্ধে কোন আদেশ, নির্দেশ দেয়া রাজা বা শাসকের সাধ্য ছিল না।  ইউরোপের অবস্থাও তাই ছিল। পোপের নির্দেশে রাজ্য শাসন করতেন রাজারা। কোন রাজা পোপের নির্দেশ অমান্য করতে পারতেন না- করলে তার দুরবস্থার সীমা থাকত না।  মোট কথা পৃথিবীর কোথাও আইনের উৎস ধর্ম ছাড়া আর কোন কিছুকে গ্রহণ করা হয় নি।
এ পর্যন্ত যা বলে এলাম, তা সমস্তটা একত্র করলে আমরা একটা পরিষ্কার ছবি পাই।  সেটা হলো- গোটা পৃথিবীটাকে পটভূমি হিসাবে নিয়ে মানুষ সৃষ্টির সময় থেকে যদি আরম্ভ করি তবে দেখতে পাই যে প্রথম মানব আদম (আ.) আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধান, দীন ইসলাম অনুযায়ী চলতে লাগলেন তার সন্তান-সন্তুতি নিয়ে এবং ফলে শান্তিতে বাস করতে থাকলেন। ইবলিস তার প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী চেষ্টা চালাতে লাগলো সেই জীবন ব্যবস্থা থেকে মানুষকে বিচ্যুত করতে।  মানুষেরই ভেতরে বসে তাকে প্ররোচনা দিয়ে আইন ভঙ্গ করাতে। কাবলকে দিয়ে তার ভাই হাবলকে হত্যা করাল।  তারপর আরো আইন ভাঙ্গার ফলে যখন ওটা যথেষ্ট বিকৃত হয়ে গেলো তখন আল্লাহ পাঠালেন দ্বিতীয় রসুল।  তার ডাকে সাড়া দিয়ে অনেকে নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করলো অনেকে রয়ে গেলো সেই পুরোনো ব্যবস্থায়- যেটা ছিল আদমের (আ.) উপর দেয়া। সৃষ্টি হলো দু’টো দীন, দু’টো ধর্ম, দু’টো জীবনব্যবস্থা।  এদিকে মানুষের বংশ বৃদ্ধি চলছেই। আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়লো আদম সন্তানরা পৃথিবীর চারিদিকে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যেখানেই তারা বসতি স্থাপন করলো সেখানেই আসতে লাগলেন প্রেরিত নবীরা আল্লাহর দেয়া দীনুল কাইয়্যেমা, সনাতন ধর্ম নিয়ে।  উদ্দেশ্য সেই একই- মানুষ যেন নিজেদের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি না করে, রক্তপাত না করে শান্তি ও সুখে বাস করতে পারে। একই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নবী উপস্থিত ছিলেন। কেউ হয়তো চীনের এক প্রান্তে, কেউ দক্ষিণ আমেরিকায়, কেউ ইউরোপে, কেউ মধ্য এশিয়ায়, কেউ ভারতের কোন কোণে।  আল্লাহ তাঁর দায়িত্ব এক মুহূর্তের জন্য ভুলে যান নি। যুগ বয়ে চলেছে, নবীরা মানুষের জন্য জীবন-ধর্ম দিয়ে চলে যাচ্ছেন, শয়তান মানুষকে প্ররোচনা দিয়ে সেগুলো বিকৃত, অকেজো করে ফেলছে।  তারা আবার আসছেন আবার নতুন করে জীবন পথ দিচ্ছেন, নতুন ধর্ম সৃষ্টি হয়ে চলেছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই অতীতে হারিয়ে গেছেন। তারাও হারিয়ে গেছেন, তাদের মাধ্যমে প্রেরিত জীবনব্যবস্থা গুলিও হারিয়ে গেছে।  আমরা পেছন দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই তাদের আনা ইসলামকেও দেখতে পাই।  পাই, কিন্তু অত্যন্ত অস্পষ্টভাবে এবং মানুষের হস্তক্ষেপের ফলে বিকৃতভাবে।
এই হলো মানুষের প্রকৃত অতীত।  ইতিহাসকে বহুলোক বহুভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু সত্য গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যান, ন্যায় ও অন্যায়ের অবিরাম দ্বন্দ্ব, সমষ্টি ও ব্যক্তিগতভাবে মানুষের আত্মাকে একদিকে ইবলিস অন্যদিকে আল্লাহর আত্মা, রুহাল্লাহর টানাটানি- এই হলো আদম (আ.) থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত মানুষের সত্যিকার অতীত।  এবং এ শুধু অতীত নয় ভবিষ্যতও নিঃসন্দেহে এই-ই।  এর কোন বিরতি, কোন চ্যুতি হয় নি, হচ্ছে না, হবে না।

বানানরীতি কোনটা ঠিক- ইসলাম, না এসলাম???

বানানরীতি কোনটা ঠিক- ইসলাম, না এসলাম?


আসলে দুইটা বানানই অভিধানে আছে, বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত আরবি, ফারসি, তুির্ক, হিন্দি, ও উর্দু শব্দের বাংলা ভাষার অভিধানের ৪৬ পৃষ্ঠায় প্রচলিত বানান লেখা হয়েছে ‘ইসলাম’ এবং আভিধানিক বানান লেখা হয়েছে ‘এসলাম’। শব্দটা আমরা নতুন করে লিখছি না। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বিশিষ্ট এসলামী চিন্তাবিদ মওলানা আকরম খাঁ প্রমুখ লেখকগণও এসলাম, মোসলেম শব্দগুলি লিখেছেন। একটি স্থানের নাম এখনও লেখা হয় ‘এলাহাবাদ’। আরবি উচ্চারণের নিয়ম হচ্ছে- যের থাকলে
এ-কার এবং পেশ থাকলে ও-কারের উচ্চারণ করতে হয়, আর খাড়া যের বা যেরের পর ইয়া-সাকিন থাকলে ই-কারের উচ্চারণ করতে হয় এবং উল্টা পেশ বা পেশের পর ওয়া-সাকিন থাকলে উ-কারের উচ্চারণ করতে হয়। আর যবর থাকলে আ-কারের উচ্চারণ করতে হয়। অর্থাৎ অপরিহার্য পাঁচটি স্বরধ্বনির উচ্চারণ আরবি ভাষাতেও রয়েছে।
আলেম, হাফেজ, জামে মসজিদ, কাফের, জাহেল, ফাসেক, হেফাজত ইত্যাদি শব্দগুলি আমরা সকলেই বলে থাকি। নিশ্চয় হাফেজ সাহেবকে কেউ হাফিজ সাহেব কিংবা জামে মসজিদকে কেউ জামি মসজিদ বলেন না। অর্থাৎ আরবি শব্দে এ-কারের ()ে ব্যবহার সকলেই করে। একইভাবে মোবারক, মোসলেম উদ্দিন, মোশাররফ ইত্যাদি আরবি শব্দে ও-কারের (ে া) উচ্চারণও সকলেই করে। কাজেই যে কারণে হিফাজত না লিখে হেফাজত লেখা হয়, ইলহাম না লিখে এলহাম লেখা হয় সে কারণেই আমরা ইসলাম না লিখে এসলাম লিখছি। যা হোক, দু’টি শব্দই যেহেতু অভিধানে আছে সেহেতু এর যেকোনোটি ব্যবহারে বাধা আছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।
বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, ফারসি, চাইনিজসহ সকল সমৃদ্ধ ভাষাতেই এ-কার এবং ও-কারের উচ্চারণ রয়েছে। এটা অতি সাধারণ জ্ঞান যে সমৃদ্ধ ভাষাতে অন্তত পাঁচটি স্বরধ্বনির ব্যবহার থাকতেই হবে, যথা- আ-কার, ই-কার, উ-কার, এ-কার এবং ও-কার। কোনো ভাষা থেকে যদি এর একটি ধ্বনিও বাদ দেওয়া হয় তবে ভাষাটি অত্যন্ত দরিদ্র হয়ে পড়ে। যেমন বাংলা ভাষা থেকে যদি এ-কারের এবং ও-কারের উচ্চারণ বাদ দেওয়া হয় তবে “বাংলাদেশকে ভালোবাসি” কথাটির উচ্চারণ করবেন কিভাবে? একটি বাক্য বলতেই যেখানে কষ্ট হচ্ছে সেখানে ধ্বনি দুটি বাদ দিয়ে একটি ভাষাকে কল্পনা করা নিতান্ত বোকামী। কেউ মানুক আর না মানুক সেটা তার ব্যাপার। কিন্তু সাধারণ মানুষদেরকে এই অপপ্রচার চালিয়ে বিভ্রান্ত করার তো কোনো মানে নেই যে, হেযবুত তওহীদ এসলাম বিকৃত করে ফেলছে, তারা ইসলামকে এসলাম লিখছে ইত্যাদি। এতে আপনারাও যেমন প্রকৃত সত্য থেকে দূরে থাকছেন তেমনি সাধারণ মানুষগুলিও প্রকৃত সত্য জানতে পারছে না। সম্মানিত পাঠকদের উদ্দেশে আমাদের কথা হলো- আপনারা ইসলামও ব্যবহার করতে পারেন এসলামও ব্যবহার করতে পারেন। তবে অধিকতর যুক্তিসংগত হবে যদি এসলাম ব্যবহার করেন। আমরা আমাদের পত্রিকার লেখাগুলি আপাতত ইসলাম লিখছি, তবে এমামুয্যামানের মূল লেখার মধ্যে এসলাম লিখছি। যাতে কেউ বানান নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে না পারে। তবে এ ব্যাপারে জনজরিপ চলছে, মতামত গ্রহণ চলছে, গবেষকদের, চিন্তাশীলদের, ভাষা বিজ্ঞানীদেরও মতামত গ্রহণ চলছে। মতামতের ভিত্তিতেই আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছব। অচিরেই সত্য উদ্ভাসিত হবে সেদিন সবাই এসলামই লিখবেন এনশা’ল্লাহ, সেদিনের অপেক্ষায় আমরা থাকলাম। সেদিন এনশা’ল্লাহ স্বার্থান্বেষীরা অপপ্রচার করে আর সুবিধা করতে পারবে না। প্রকৃত শব্দটাই সেদিন সবাই লিখবে এনশাল্লাহ।