Wednesday, January 27, 2016

এবাদত কী???

এবাদত কী???


কাজী মাহফুজ
আল্লাহর এবাদত করার জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে (সুরা যারিয়াত ৫৬)। এবাদত হচ্ছে যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে সেই কাজটি করা। গাড়ি তৈরি হয়েছে পরিবহনের কাজে ব্যবহারের জন্য, এটা করাই গাড়ির এবাদত। ঘড়ি তৈরি করা হয়েছে সময় দেখানোর জন্য সুতরাং সময় দেওয়াই ঘড়ির এবাদত। একইভাবে দূরবর্তী মানুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য মোবাইল তৈরি করা হয়েছে কাজেই যোগাযোগ রক্ষা করাই মোবাইলের মৌলিক কাজ বা এবাদত।
আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর প্রতিনিধি (Representative) হিসাবে (সুরা বাকারা-৩০)। অর্থাৎ সমগ্র সৃষ্টিকে আল্লাহ যেভাবে সুশৃঙ্খল, শান্তিপূর্ণ রেখেছেন ঠিক সেভাবে এ পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল রাখাই মানুষের এবাদত। মানুষের মধ্য থেকে সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, যুদ্ধ, রক্তপাত ইত্যাদি দূর করে শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের প্রচেষ্টাই হলো মানুষের এবাদত। মানুষের মধ্য থেকে সকল প্রকার অন্ধত্ব, গোঁড়ামী, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, অশ্লিলতা ইত্যাদি দূর করে স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা, প্রগতি, সুশাসন, সহযোগিতা, ভ্রতৃত্ব, প্রেম, সৌহার্দ্য ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবসমাজে শান্তি নিশ্চিত করাই মানুষের প্রধান কর্তব্য তথা এবাদত। ধরুন আপনি গভীর রাত্রে প্রার্থনায় মগ্ন। হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে ‘আগুন আগুন’ বলে আর্তচিৎকার ভেসে এল। আপনি কী করবেন? দৌড়ে যাবেন সাহায্য করতে নাকি চোখ-কান বন্ধ করে প্রার্থনা চালিয়ে যাবেন। যদি আগুন নেভাতে যান সেটাই হবে আপনার এবাদত। আর যদি ভাবেন- বিপন্ন ব্যক্তি অন্য ধর্মের লোক, তাহলে আপনার মধ্যে মানুষের ধর্ম নেই, আপনার নামায-রোযা, প্রার্থনা সবই পণ্ডশ্রম।
প্রকৃতপক্ষে এবাদত হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব। মুসার (আ.) দায়িত্ব অর্থাৎ এবাদত কী ছিল তা আল্লাহ তাঁকে জানিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ফেরাউনের নিকট যাও, সে দারুণ উদ্ধত হয়ে গেছে (সুরা ত্বা-হা: ২৪)। আল্লাহ তাঁকে ফেরাউনের কাছে পাঠালেন অত্যাচারিত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত ইহুদি জাতিকে দাসত্বের কবল থেকে মুক্ত করে তাদের মানবাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য, মানবতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
এবাদতের সঠিক অর্থ না বোঝার কারণে নির্যাতিতের হাহাকার, ক্ষুধার্তের ক্রন্দন মহা ধার্মিকদের কানে প্রবেশ করে না। এগুলোকে দুনিয়াবি কাজ বলে এড়িয়ে যাবার মতো পাশবিক মনোবৃত্তি তাদের তৈরি হয়েছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কি নামায, রোযা, হজ্ব করতে হবে না? হ্যাঁ, অবশ্যই করতে হবে, কিন্তু আকিদা বুঝে। মানুষের কল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার শারীরিক সক্ষমতা ও আত্মিক শক্তি ও প্রবণতা সবার থাকে না। এটা সৃষ্টির প্রশিক্ষণ (Training) হচ্ছে নামায, রোযা, হজ্ব ইত্যাদি। এগুলো উদ্দেশ্য অর্জনের প্রশিক্ষণ, উদ্দেশ্য হচ্ছে শান্তি। যে মানবতার কল্যাণে সংগ্রাম করবে না, অন্য মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ঘোঁচাতে সম্পদ ব্যয় করবে না, তার তাহাজ্জুদ হবে ঘুম নষ্ট করা, রোযা হবে না খেয়ে থাকা; অন্য আমলের কী দশা হবে ভেবে দেখুন। আল্লাহর রসুল ও তাঁর সাহাবীরা আজীবন মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে গেছেন, এটা করতে গিয়ে তাঁরা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। সকল ধর্মের অবতার ও মহামানবদের জীবনেও রয়েছে শান্তিময় সমাজ বিনির্মাণে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। অথচ আজকের সমাজে মানুষের ধর্মীয় জীবনের নেতৃত্ব দানকারী ধর্মব্যবসায়ী আলেম-পুরোহিতরা মানুষকে কেবল পরকালমুখী হতে শিক্ষা দেন। ফলে দেখা যায় যে যত বড় ধার্মিক সে তত বেশি নির্বিরোধী। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ইচ্ছা বা সাহস কোনোটাই তাদের থাকে না। কারণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোকে তারা এবাদত মনে করেন না, এবাদত বলতে কেবল নামায-রোযাই বোঝেন। এ জন্য উপাসনালয়ের চার দেওয়ালের অভ্যন্তরকেই তারা বেছে নিয়েছেন। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো লেবাস ধারণ করাই ইসলাম নয়, বরং শান্তিপূর্ণ সমাজই হচ্ছে ইসলাম।

No comments:

Post a Comment