Sunday, March 13, 2016

কারা আমাদের বংশরক্ষা করবে???

কারা আমাদের বংশরক্ষা করবে???


আতাহার হোসাইন

মানুষ পৃথিবীতে আসে আবার নির্ধারিত কাল অতিক্রম করে চলে যায়। কিন্তু সে সব সময়ই আশা করে তার উত্তরসুরীর মাধ্যমে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে। উত্তরসূরী রেখে যাওয়ার মাধ্যমেই মানুষ তার আদি পিতা আদমের অমরত্বের আকাক্সক্ষাকে পূর্ণতা দেয়। যে মানুষ তার উত্তরসূরী রেখে যেতে পারে না সে তার জীবনকে বৃথা বলে মনে করে। আমরাও এর ব্যতিক্রম নই। কিন্তু আমাদেরকে অবশ্যই দেখতে হবে পৃথিবীতে আমাদের কেমন উত্তরসূরী রেখে যাচ্ছি। আমরা কি তাদেরকে মানুষ বানাতে পারছি, নাকি রেখে যাচ্ছি মানুষ নামের দু’পেয়ে কিছু প্রাণী?
এই লেখাটার পেছনে যিনি আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছিলেন তিনি অতিশয় দুঃখ নিয়ে আমাকে একটি ঘটনা শুনিয়েছিলেন। কোনো এক কোরবানির ঈদের দিন ঢাকা মহানগরীর একটি গলিতে বাড়ির কর্তা গরু কোরবানি দেবেন। গরুতো আর একা জবাই করা সম্ভব নয়, তাই তিনি কসাইসহ আরো দু-একজনের সহযোগিতা নিলেন এবং তার পরিবারের (উত্তর প্রজন্ম) তরুণটিকেও ডাকলেন গরুটিকে শোয়ানোর কাজে সহযোগিতা করার জন্য। তরুণটি আসলো বটে, কিন্তু সে গরুটিকে বিব্রত ভাব নিয়ে এমনভাবে ধরলো যাকে ‘ধরলো’ না বলে ‘ছুয়েছে’ বলাটাই শ্রেয় হবে। তার চালচলনে ভীষণ আনাড়ি ভাব। কিন্তু গরুকে শুধু ছুয়ে রাখলে তো আর জবাই করা সম্ভব নয়। কর্তা তরুণটির এই অবস্থা দেখে রেগে মেগে দিলেন এক ধমক, ‘যা এখান থেকে!’ ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে বিড়বিড় করতে করতে পিছু হটে গেল, যেন এটাই সে চাইছিল। আর কর্তা তখন রাগে গজ-গজ করতে করতে আরো দু’একজন প্রৌঢ়-বৃদ্ধের সহযোগিতায় সর্বশক্তি প্রয়োগ করে গরুটিকে জবাই করলেন। তরুণটি তখন কী করছিল? সে পাঞ্জাবির পকেট থেকে স্মার্ট ফোনটি বের করে টেপাটিপি করছিল আর গরু জবাইয়ের ছবি তুলছিল।
হ্যাঁ, এই হচ্ছে আমাদের উত্তর প্রজন্ম। এরা হাতে ছুঁয়ে দিয়ে গরু জবাই করতে চায়, পারে তো ভার্চুয়ালী গরু কোরবানি করে ফেলে আর কী! এরা বড় হয়ে উঠছে টিভি স্ক্রিনে ফুটবল, ক্রিকেট, রেসলিং দেখে, নিজেরাও খেলছে বহুকিছু তবে ঐ কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে। ধূলি-বালি-কাদা-ঘাম এদেরকে স্পর্শ করতে পারে না। অল্প বয়সেই এদের অনেকের চোখে ভারি চশমা। এরা অদ্ভুত বাংরেজি ভাষায় কথা বলে, বিচিত্র তার শব্দভা-ার (যেমন: জোস, শিরাম, আজীব, মাম্মা, আম্রে মাইরালা ইত্যাদি)। মাথার চুল থেকে পায়ের জুতা পর্যন্ত পশ্চিমা রকস্টারদের নকল করে এরা হয়েছে ‘ইয়ো ইয়ো’ জেনারেশন। পরনে খাটো টি-শার্ট, থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট অথবা নিচু করে পরা ফেঁসে যাওয়া জিন্স, প্রকাশিত আন্ডার অয়্যার আধুনিকতার জানান দেয়। গলায়, কানে, কবজিতে এমন কি ভ্রুতে বিভিন্ন গহনা, মোটা বকলেসের ঘড়ি। হাতে এনার্জি ড্রিংকস। কৈশোরেই ধূমপানে অভ্যস্ত। মাদকাসক্তও কম নয়। বেলা একটার পরে এদের সকাল হয়। এক মাইল পথ হাঁটার সামর্থ এদের নেই, ইচ্ছাও নেই। এদের কেউ ডাব কেটে পানি বের করে খেতে পারে না। এরা গাড়ি, রিক্সা, মোটর বাইক ছাড়া চলে না, প্রিয় খাদ্য ফাস্টফুড। এদের মধ্যে একটি বিরাট অংশের শরীর স্বাস্থ্য ব্রয়লার মুরগির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এদের হাতে থাকে বড় বড় স্ক্রিনের স্মার্ট ফোন, ট্যাব, কানে হেডফোন-ব্লুটুথ। দিনমান ব্যস্ত ফেসবুক, স্কাইপে, ভিডিও চ্যাট, হিন্দি সিনেমা, নাচ-গান, হোয়াটসএপ-ভাইবার প্রভৃতি নিয়ে। বাবা-মা এদের কাছে গুরুত্বহীন ওল্ড ফুল, খানা-খাদ্যের প্রয়োজন মেটাতে ফর্মালিটির সম্পর্ক, হৃদয়ের বন্ধন বহু আগেই ছিন্ন হয়ে গেছে। ডিজিটাল সন্তানের অ্যানালগ বাবা-মায়ের সঙ্গে জেনারেশন গ্যাপতো হবেই। ভদ্রতা, শিষ্টাচারেরও বিরাট অভাব তাদের চরিত্রে। বন্ধুরাই জীবন-মরণ। দিনরাত বন্ধুদের সাথে আড্ডা, ফুর্তি (ওদের ভাষায় মাস্তি), চ্যাটিং আর ফোনালাপ। এদের নাকি বন্ধু ছাড়া একটা দিনও ইমপসিবল! গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশেও তারা থাকে ফেসবুকে মগ্ন।
একবার ভেবে দেখুনতো আপনার ঘরে আপনার যে উত্তরসূরীটি এভাবে বড় হচ্ছে তাদের ভবিষ্যত কী? বাস্তবতা বিবর্জিত, জগতের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে অক্ষম, মানসিকভাবে অক্ষম ও ভারসাম্যহীন এই প্রজন্মই আপনার আকাক্সিক্ষত ছিল? এরা কি আমাদের অমরত্বের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে? এভাবে যদি চলতে থাকে তবে আর দু’এক প্রজন্ম পরে এরা বলবীর্য্যহীন নপুংসকে পরিণত হবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ব্রয়লার মুরগি দিয়ে বংশরক্ষা হয় না।
প্রশ্ন হচ্ছে এই অনাকাক্সিক্ষত পরিণতি কি আমাদের নিয়তি, নাকি আমরাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সেদিকে ঠেলে দিয়েছি? অতীতে আমাদের স্বকীয়তা, স্বাধীন চেতনা, ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য পরধনলোভী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোকে সামরিকভাবে আমাদের ভূ-খ- দখল করে, শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে তাদের মানসিক গোলামে পরিণত করতে হতো। সেসময় বন্দুকের জোরে লুটে-পুটে আমাদের সম্পদ জাহাজে করে তাদের দেশে নিয়ে যেত। এভাবে তারা আমাদেরকে ফতুর করে দিয়ে গেছে। কিন্তু আজ সেই ঔপনিবেশিক যুগ তার রূপ পরিবর্তন করেছে। আজ বন্দুকের স্থান নিয়েছে পুঁজিবাদ ও আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন। আজ আর তাদেরকে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে আমাদেরকে শারীরিকভাবে দখল করতে হয় না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি (যা তারা নিজেদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করে না) আমাদের দেশগুলোতে রপ্তানি করেই তারা তাদের কাক্সিক্ষত সাফল্য আদায় করে নিচ্ছে। আমরা গ্লোবালাইজেশনের নামে তাদের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছি। আমরা যতই তাদের মতো হতে চাচ্ছি, ততই আমাদের সামান্য যা সম্পদ তারও সিংহভাগ তাদের কর্পোরেশনগুলির অ্যাকাউন্টে পাচার হচ্ছে। যেখানে গোলামী যুগেও আমাদের বৈদেশীক কোন ঋণ ছিল না সেখানে আজ আমাদের মাথাপিছু ঋণের কথা মনে হলে ঘুম হারাম হয়ে যায়।
প্রযুক্তির কল্যাণকর দিক যেমন আছে অপব্যবহারের ফলে সৃষ্ট অকল্যাণের পরিমাণও কম নয়। একটি মোবাইল ফোনের উদ্দেশ্য দূরে থাকা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা এবং প্রয়োজনীয় কথা বার্তা বলা। কিন্তু সেই মৌলিক প্রয়োজনীয়তাকে ছাড়িয়ে আজ মোবাইল ফোন হয়ে উঠেছে যুবসমাজ ধ্বংসের হাতিয়ারে। আজকে আপনার উত্তর প্রজন্মকে প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলার স্বার্থে তার হাতে যে বড় স্ক্রীনের মোবাইল, ট্যাবলেট-ফ্যাবলেট ফোনটি তুলে দিয়েছেন তা দিয়ে সে কি করছে তার খবর রাখছেন কি? যোগাযোগের জন্য এত দামি ও উন্নত কনফিগারেশনের ফোন কি তার খুব জরুরি? না, মূলত সে এই প্রযুক্তির অপব্যবহার করে নিজেকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। অতীতের সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর প্রতিনিধি হয়ে আসা মোবাইল কোম্পানিগুলো বিভিন্ন প্রকার আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন, ভোগবাদী ও স্ফুর্তিবাজ লাইফস্টাইল তাকে নানাভাবে বাধ্য করছে তাদের নতুন নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করতে। এর মাধ্যমে তারা একদিকে যেমন দরিদ্র দেশগুলির অর্থ নিয়ে যাচ্ছে তেমনি ধ্বংস করে দিচ্ছে নতুন প্রজন্মটির নৈতিকতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা। তাদের ভার্চুয়াল দেশপ্রেমের সঙ্গে বায়ান্ন, একাত্তরের যোদ্ধাদের দেশপ্রেমের কতটুকু পার্থক্য সেটা আপনারাই বিবেচনা করুন। কেবল বন্ধুদের সঙ্গে অসার আড্ডাবাজি, চ্যাটিং, ফেসবুকিং করে তাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। বিনামূল্যে বা স্বল্পমূলে অনলাইন, ফেসবুক ব্যবহারের সুবিধা দিয়ে বেনিয়ারা এসবের নেশায় তরুণদেরকে আসক্ত করছে, ঠিক যেভাবে দু’শ’ বছর আগে ব্রিটিশরা এদেশের যুবক শ্রেণিকে বিনামূল্যে আফিম খাওয়াতো যেন এদের যুবসমাজ ধ্বংস হয়, এবং এদেশে আফিমের বাজার সৃষ্টি হয়। এজন্য তারা পাহাড়ি দেশগুলিতে আফিমের চাষও করত। তরুণ প্রজন্ম শুধু কি এসব যোগাযোগ সাইটই ব্যবহার করে? না, অনলাইন জগতে যতগুলো সাধারণ সাইট আছে তার চেয়েও বেশি সাইট রয়েছে পর্নোগ্রাফিক সাইট। সার্চ ইঞ্জিনগুলির হিসাবমতে সবচেয়ে বেশি সার্চ ও ভিজিট হয় পর্ন সাইটগুলিতে, আর এটা করে প্রধানত আপনার-আমার উত্তর প্রজন্মরাই। সুতরাং তাদের নৈতিক স্খলন রোধ করার কোনো উপায় থাকে না। বাস্তব জীবনে সেসবের প্রতিক্রিয়া হিসেবে তারা প্রেম-ডেটিং, ইভটিজিং, অনৈতিক শারীরিক সম্পর্ক, ধর্ষণ ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়ছে। প্রাচীন রীতি-চিঠির কথা মনে করে ধরে-টরে, বলে কয়ে বিয়ে থা দিলেন, ব্যাস- কিছুদিন পরেই সংসার শেষ। হাতের গ্লাস ভাঙতেও সময় লাগে কিন্তু এদের সংসার ভাঙতে সময় লাগে না।
অবশ্য ফেসবুক চালানোর সুবিধাও অস্বীকার করা যায় না। কারণ, পরীক্ষার আগেই সেখানকার পেজগুলো থেকে প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়। এর কল্যাণে শতকরা নব্বই শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী কৃতকার্য হয়ে যাচ্ছে। সকল খাতে যেখানে অবনতি, সেখানে শিক্ষাখাতে বসন্তের জোয়ার। কিন্তু ধরা খেতেও আমাদেরকে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয় না। গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া সেই ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় শতকরা নব্বই জন অকৃতকার্য হয়।
আধুনিক প্রজন্মের এই যে অধঃপতন, এর দায় কে নেবে? পুঁজিবাদী ও ভোগবাদী বিশ্বের মুখোমুখি করে দিয়ে আমরাই তাদেরকে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি করে দিয়েছি। যুগের চাহিদা মেটাতে, তাদের আব্দার মেটাতে আমরা তাদের হাতে প্রযুক্তি তুলে দিচ্ছি, কিন্তু সেসবের ক্ষতিকারক দিকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করি নি। ডিজিটাল জোয়ারে আমরা এতটাই টালমাটাল যে, অনেক সময় দেশের অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গকেও আমরা দেখি দায়িত্বে অবহেলা করে স্মার্ট ফোন টেপাটেপিতে মগ্ন। আমরাই নবপ্রজন্মকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছি। সুতরাং তাদেরকে এ থেকে উদ্ধার করার দায়িত্বও আমাদের।

No comments:

Post a Comment