Thursday, March 24, 2016

ইলাহ অর্থ: যাঁর হুকুম মানতে হবে

ইলাহ অর্থ: যাঁর হুকুম মানতে হবে


এমামুয্যামানের লেখা থেকে সম্পাদিত


‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এই বাক্যটি হচ্ছে দীনুল হকের ভিত্তি। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, মুসলিম বলে পরিচিত এই জনসংখ্যাটি তওহীদ সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে (অর্থাৎ আকীদা) তা ভুল। তাদের কাছে তওহীদ মানে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করা এবং তাঁর ইবাদত বা উপাসনা করা। ‘তওহীদ’ এবং ‘ওয়াহদানিয়াহ্’ এই আরবি শব্দ দু’টি একই মূল থেকে উৎপন্ন হলেও এদের অর্থ এক নয়। ‘ওয়াহদানিয়াহ্’ বলতে বোঝায় মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ যে একজন তা বিশ্বাস করা (একত্ববাদ- Monotheism, পক্ষান্তরে ‘তওহীদ’ মানে ঐ এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়া, তাঁর ও কেবলমাত্র তাঁরই নিঃশর্ত আনুগত্য করা। এই আনুগত্য কেবল ধর্মীয় কাজে নয়, মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারাবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, আইন-কানুন, দ-বিধি, প্রশাসনিক অর্থাৎ যে কোনো অঙ্গনেই হোক, আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কোনো হুকুম বা অভিমত থাকলে সে বিষয়ে আর কারও কোনো কথা মানি না, এটাই হচ্ছে তওহীদের মর্মবাণী আরবের যে মুশরিকদের মধ্যে আল্লাহর শেষ রসুল এসেছিলেন, সেই মুশরিকরাও আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করত, কিন্তু তারা আল্লাহর হুকুম, বিধান মানতো না অর্থাৎ তারা আল্লাহর আনুগত্য করত না। তারা তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সামষ্টিক জীবন নিজেদের মনগড়া নিয়ম-কানুন দিয়ে পরিচালনা করত। এই আইনকানুন ও জীবন ব্যবস্থার উৎস ও অধিপতি হিসাবে ছিল বায়তুল্লাহ, কা’বার কোরায়েশ পুরোহিতগণ। মূর্তিপূজারী হওয়া সত্ত্বেও তাদের এই ঈমান ছিল যে, এ বিশ্বজগতের স্রষ্টা আল্লাহ একজনই এবং তাদের এই ঈমান বর্তমানে যারা নিজেদেরকে মুমিন মুসলিম বলে জানে এবং দাবি করে তাদের চেয়ে কোনো অংশে দুর্বল ছিল না (সুরা যুখরুফ ৯, আনকাবুত ৬১, লোকমান ২৫)। কিন্তু যেহেতু তারা আল্লাহর প্রদত্ত হুকুম মানতো না, তাই তাদের ঐ ঈমান ছিল অর্থহীন, নিষ্ফল এবং স্বভাবতঃই আল্লাহর হুকুম না মানার পরিণতিতে তাদের সমাজ অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, নিরাপত্তাহীনতা, সংঘর্ষ ও রক্তপাতে পরিপূর্ণ ছিল। তাদের আল্লাহর হুকুমের প্রতি ফিরিয়ে আনার জন্যই তাদের মধ্যে রসুল প্রেরিত হয়েছিলেন। রসুলও সে কাজটিই করেছিলেন, ফলশ্রুতিতে অন্যায় অশান্তিতে নিমজ্জিত সেই সমাজটি নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার, সুখ-সমৃদ্ধিতে পূর্ণ শান্তিময় একটি সমাজে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং আল্লাহর আনুগত্য না করাই ছিল তাদের কাফের মুশরিক হওয়ার প্রকৃত কারণ। বর্তমানের মুসলিমরা উপলব্ধি করতে পারছে না যে প্রাক-ইসলামিক যুগের আরবের কাঠ পাথরের মূর্তিগুলিই এখন গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদির রূপ ধরে আবির্ভূত হয়েছে এবং মুসলিম জনসংখ্যাটি আল্লাহর পরিবর্তে এদের তথা এদের প্রবর্তক ও পুরোধা ‘পুরোহিতদের’ আনুগত্য করে যাচ্ছে এবং তারাও সেই পৌত্তলিক আরবদের মতোই মুশরিক ও কাফেরে পরিণত হয়েছে।
এই জনসংখ্যাটি কিভাবে ইসলামের ভিত্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ থেকে সরে গেছে তা ব্যাখ্যা করছি। আদম (আ:) থেকে শুরু করে শেষ নবী মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত এ কলেমায় কখনোই “ইলাহ” শব্দটি ছাড়া অন্য কোনো শব্দ ব্যবহৃত হয় নি। নিসন্দেহে আল্লাহই আমাদের একমাত্র উপাস্য মা’বুদ, স্রষ্টা, পালনকর্তা, তবে এগুলি স্বীকার করে নেওয়া এই দীনের ভিত্তি নয়, কলেমা নয়। বরং কলেমা হচ্ছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। কলেমায় ব্যবহৃত ‘ইলাহ’ শব্দের প্রকৃত অর্থ, ‘যাঁর হুকুম মানতে হবে’ (He who is to be obeyed)। শতাব্দীর পর শতাব্দীর কাল পরিক্রমায় যেভাবেই হোক এই শব্দটির অর্থ ‘হুকুম মানা বা আনুগত্য’ থেকে পরিবর্তিত হয়ে গেছে ‘উপাসনা, বন্দনা, ভক্তি বা পূজা করা (He who is to be obeyed) । বর্তমানে সারা দুনিয়ায় খ্রিষ্টানদের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলিতে কলেমার অর্থই শেখানো হয় – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মানে আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। কোর’আনের ইংরেজী অনুবাদগুলিতেও কলেমার এই অর্থই করা হয় (There is none to be worshiped other than Allah)। অসঙ্গতিটি দিবালোকের মতো পরিষ্কার। ‘উপাস্য’ কথাটির আরবি হচ্ছে ‘মা’বুদ’, তাই “আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই” এই বাক্যটিকে আরবি করলে দাঁড়ায় “লা মা’বুদ ইল্লাল্লাহ’, যা ইসলামের কলেমা নয়। কোনো অমুসলিম এই সাক্ষ্য দিয়ে মুসলিম হতে পারবে না। কলেমার ‘ইলাহ’ শব্দটির অর্থ ভুল বোঝার ভয়াবহ পরিণতি এই হয়েছে যে সম্পূর্ণ মুসলিম জনসংখ্যাটি এই দীনের ভিত্তি থেকেই বিচ্যুত হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ পাল্টে যাওয়ায় এই মুসলিম জনসংখ্যার কলেমা সংক্রান্ত ধারণাই পাল্টে গেছে। বর্তমানে এই জাতির আকিদায় আল্লাহর হুকুম মানার কোনো গুরুত্ব নেই, তাঁর উপাসনাকেই যথেষ্ট বলে মনে করা হচ্ছে। কলেমার অর্থ সম্পর্কে এই ভুল আকিদা এই জনসংখ্যার আত্মায় এবং অবচেতন মনে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে। ফলে সারা দুনিয়াতে এমন কোনো দল নেই, এমন কোনো রাষ্ট্র নেই যারা তাদের সামষ্টিক, জাতীয় জীবনে আল্লাহর হুকুম মেনে চলছে, যা কিনা ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর আদেশ নিষেধ মানার চেয়ে বহুগুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য। জাতীয় জীবনে আল্লাহকে অমান্য করে তার বদলে উপাসনা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি দিয়ে আসমান জমিন ভর্তি করে ফেলা হচ্ছে, কিন্তু সেই পর্বত সমান উপাসনাও বিশ্বময় তাদের করুণ দুর্দশার প্রতি দয়াময় আল্লাহর কৃপাদৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে, বিজাতির হাতে তাদের অবর্ণনীয় নিপীড়ন, লাঞ্ছনা, পরাজয়, অপমান, নিগ্রহ বন্ধ তো হচ্ছেই না, বরং দিন দিন আরো বেড়ে চলছে।
আল্লাহ বলছেন, ‘আল্লাহ যা নাযেল করেছেন সে অনুযায়ী যারা হুকুম (বিচার ফায়সালা) করে না তারা কাফের, জালেম, ফাসেক (সুরা মায়েদা ৪৪, ৪৫, ৪৭)। এই আয়াতগুলিতে ‘হুকুম’ শব্দটি দিয়ে কেবল আদালতের বিচারকার্যই বোঝায় না, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক অর্থাৎ সামগ্রিক জীবন তাঁর নাযেল করা বিধান অর্থাৎ কোর’আন (এবং সুন্নাহ) মোতাবেক পরিচালনা করাকেও বোঝায়। মুমিন মুসলিম হবার দাবিদারগণ এখন আর একটি জাতি হিসাবে নেই, তারা ভৌগোলিকভাবে পঞ্চাশটিরও বেশি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে ইউরোপীয় খ্রিষ্টান, ইহুদি ও পৌত্তলিকদের দাসে পরিণত হয়েছে, তাই তারা তাদের সামষ্টিক কার্যাবলী আল্লাহর নাযেলকৃত বিধান দিয়ে ফায়সালা করে না। আল্লাহ প্রদত্ত বিধানগুলিকে অকার্যকর রেখে তারা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের আইন, কানুনগুলি নিজেদের দেশে প্রবর্তন করে তা দিয়ে সামষ্টিক কার্যাবলী পরিচালনা করছে।

No comments:

Post a Comment