Saturday, June 25, 2016

তওহীদ জান্নাতের চাবি

তওহীদ জান্নাতের চাবি
মাহবুব আলী

মহানবী (সা.) বলেছেন- “জান্নাতের চাবি হচ্ছে- আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা (ইলাহ) নেই” (মুয়াজ বিন জাবাল থেকে আহমদ, মেশকাত)। অপর হাদিসে এসেছে- যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে “আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা (ইলাহ) নেই এবং মোহাম্মদ (সা.) তাঁর প্রেরিত” তার জন্য জাহান্নাম হারাম হয়ে যাবে। (ওবাদাহ বিন সামিত থেকে মুসলিম, মেশকাত)। এছাড়াও অনেক হাদীস থেকে দেখানো যাবে যে, তওহীদই জান্নাতের চাবি। কালিমা তথা তওহীদের স্বীকৃতি না দিলে যেমন মুমিন মুসলিম থাকা যায় না ঠিক তেমনই স্বীকৃতি দানের পর আবার তওহীদের ওপর থেকে সরে গেলেও আর মুমিন মুসলিম থাকা যায় না, আর এটা সবাই জানে যে, মুমিন মুসলিম না থাকলে সে জান্নাতে যেতে পারবে না, সে যতই ইবাদত করুক। দীনুল হকের ভিত্তি হচ্ছে তওহীদ অর্থাৎ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এই কালিমাটি, এ নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। তওহীদ ব্যতীত কোনো ইসলামই হতে পারে না, তওহীদই ইসলামের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, মুসলিম বলে পরিচিত এই জনসংখ্যাটি তওহীদ সম্পর্কে যে ধারণা (আকিদা) পোষণ করে তা ভুল। তাদের কাছে তওহীদ মানে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করা এবং তাঁর ইবাদত বা উপাসনা করা। ‘তওহীদ’ এবং ‘ওয়াহদানিয়াহ্’ এই আরবি শব্দ দু’টি একই মূল থেকে উৎপন্ন হলেও এদের অর্থ এক নয়। ‘ওয়াহদানিয়াহ্’ বলতে বোঝায় মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ যে একজন তা বিশ্বাস করা (একত্ববাদ-Monotheism), পক্ষান্তরে ‘তওহীদ’ মানে ঐ এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়া, তাঁর ও কেবলমাত্র তাঁরই নিঃশর্ত আনুগত্য করা। আরবের যে মুশরিকদের মধ্যে আল্লাহর শেষ রসুল এসেছিলেন, সেই মুশরিকরাও আল্লাহর একত্বে, ওয়াহদানিয়াতে বিশ্বাস করত, কিন্তু তারা আল্লাহর হুকুম, বিধান মানত না অর্থাৎ তারা আল্লাহর আনুগত্য করত না। তারা তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সামষ্টিক জীবন নিজেদের মনগড়া নিয়ম-কানুন দিয়ে পরিচালনা করত। এই আইনকানুন ও জীবন ব্যবস্থার উৎস ও অধিপতি হিসাবে ছিল বায়তুল্লাহ, কা’বার কুরায়িশ পুরোহিতগণ। মূর্তিপূজারী হওয়া সত্ত্বেও তাদের এই ঈমান ছিল যে, এ বিশ্বজগতের স্রষ্টা আল্লাহ একজনই এবং তাদের এই ঈমান বর্তমানে যারা নিজেদেরকে মুমিন মুসলিম বলে জানে এবং দাবি করে তাদের চেয়ে কোনো অংশে দুর্বল ছিল না (সুরা যুখরুফ ৯, আনকাবুত ৬১, লুকমান ২৫)। কিন্তু যেহেতু তারা আল্লাহর প্রদত্ত হুকুম মানত না, তাই তাদের ঐ ঈমান ছিল অর্থহীন, নিষ্ফল এবং স্বভাবতঃই আল্লাহর হুকুম না মানার পরিণতিতে তাদের সমাজ অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, নিরাপত্তাহীনতা, সংঘর্ষ ও রক্তপাতে পরিপূর্ণ ছিল, এ জন্য আরবের ঐ সময়টাকে আইয়্যামে জাহেলিয়াত বলা হয়। আল্লাহর হুকুমের প্রতি ফিরিয়ে আনার জন্যই তাদের মধ্যে রসুল প্রেরিত হয়েছিলেন। রসুলও সে কাজটিই করেছিলেন, ফলশ্রুতিতে অন্যায় অশান্তিতে নিমজ্জিত সেই সমাজটি নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার, সুখ-সমৃদ্ধিতে পূর্ণ শান্তিময় (ইসলাম অর্থই শান্তি) একটি সমাজে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং আল্লাহর আনুগত্য না করাই ছিল তাদের কাফের মুশরিক হওয়ার প্রকৃত কারণ। বর্তমানের মুসলিমরা উপলব্ধি করতে পারছে না যে প্রাক-ইসলামিক যুগের আরবের কাঠ পাথরের মূর্তিগুলিই এখন গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদির রূপ ধরে আবির্ভূত হয়েছে এবং মুসলিম জনসংখ্যাটি আল্লাহর পরিবর্তে এদের তথা এদের প্রবর্তক ও পুরোধা ‘পুরোহিতদের’ আনুগত্য করে যাচ্ছে। এই প্রতিটি তন্ত্র আলাদা আলাদা একেকটি দীন (জীবনব্যবস্থা), ঠিক যেমন দীনুল হক ‘ইসলাম’ও একটি জীবনব্যবস্থা। পার্থক্য হলো, এই মানবরচিত দীনগুলি মানবজীবনের বিশেষ কিছু অঙ্গনের, বিশেষ কিছু বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে, কিন্তু সঠিক সমাধান দিতে পারে না আর ইসলাম মানবজীবনের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় থেকে শুরু করে সামষ্টিক অঙ্গনের সকল বিষয়ে সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা দিয়ে থাকে। বর্তমানের মুসলিম নামক জনসংখ্যাটি এই সকল মানবরচিত তন্ত্রের প্রতিমার আনুগত্য করে সেই পৌত্তলিক আরবদের মতই মুশরিক ও কাফেরে পরিণত হয়েছে। আল্লাহর রসুল এসে মুশরিক আরবদেরকে আল্লাহর তওহীদের ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি সেখানে আল্লাহর একত্ববাদ (ওয়াহদানিয়াত) প্রতিষ্ঠা করেন নি, কারণ আল্লাহর একত্ববাদের বিষয়ে সেই মুশরিকদের আগে থেকেই সুদৃঢ় ঈমান ছিল (সুরা ইউসুফ- ১০৬)। তারা তাদের দেবদেবীর কোনোটিকেই আল্লাহ মনে করত না, স্রষ্টা বা প্রভুও ভাবত না, তারা সেগুলির পূজা করত এই বিশ্বাসে যে সেগুলি তাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সাহায্য করবে এবং তাদের হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে (সুরা ইউনুস- ১৮, সুরা যুমার- ৩)। সুতরাং মূর্তি পূজার নেপথ্যে তাদের প্রকৃত উপাস্য আল্লাহই ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে যে মতবাদগুলির আনুগত্য করা হচ্ছে এর মধ্যে কোথাও আল্লাহর স্থান নেই, এগুলি আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কেই সম্পূর্ণ নির্বিকার। ফলে বর্তমানের মুমিন মুসলিম হবার দাবিদারগণ যে শেরক ও কুফরে লিপ্ত তা নিঃসন্দেহে ১৪০০ বছর আগের আরবদের শেরক ও কুফরের চেয়েও নিকৃষ্টতর।

‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ যে ‘আনুগত্য করা’, উপাসনা করা নয় তা কোর’আনের বহু আয়াত থেকে বোঝা যায়। সুরা ফাতাহ’র ১৭নং আয়াতে আল্লাহ বলছেন, ‘যে আল্লাহ এবং তাঁর রসুলের আনুগত্য করে আল্লাহ তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ এখানে জান্নাতে যাওয়ার পূর্বশর্ত আল্লাহ দিলেন, যে আনুগত্য করে, বললেন না যে, ‘ইবাদত, উপাসনা করে।’ এখানে তিনি অন্য কোনো আমলের কথাও বললেন না, না সালাহ কায়েম, না যাকাত প্রদান, না হজ্ব, না সওম, অন্যান্য ছোটখাটো আমলের তো কথাই নেই। তিনি জান্নাত প্রদানের ওয়াদা করলেন শুধুই তাঁর এবং তাঁর রসুলের আনুগত্যের বিনিময়ে। সুরা নেসার ৬৯নং আয়াতটি দেখুন, আল্লাহ বলছেন, ‘যে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের হুকুম মান্য করবে সে নবী, শহীদ, সিদ্দিক ও সালেহীনদের সঙ্গে (অর্থাৎ জান্নাতে) থাকবে।’ এখানেও ‘আনুগত্য করা’ ছাড়া আর কোনো শর্ত আল্লাহ দেন নি। সুতরাং কালিমায় ব্যবহৃত ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ ‘উপাস্য’ হওয়া সম্ভব নয়, এর অর্থ অবশ্যই ‘যার আনুগত্য করা হয়, হুকুম পালন করা হয়’। আল্লাহর দাবি হচ্ছে, প্রথমে মানুষকে এই অঙ্গীকারে আবদ্ধ হতে হবে যে আল্লাহ যা হুকুম করবেন তাই সে মেনে নিবে এবং তাঁর আনুগত্য করবে। তারপর এই চুক্তি বাস্তবায়নকল্পেই সে আল্লাহর ইবাদত করতে বাধ্য, কারণ আল্লাহর হুকুম হচ্ছে একমাত্র তাঁরই ইবাদত করা। তাহলে বোঝা গেল, প্রথম কাজ আল্লাহর আনুগত্য মেনে নেওয়া, তারপরে তাঁর ইবাদত করা। সুরা আম্বিয়ার ২৫ নং আয়াতটি দেখুন, আল্লাহ বলছেন, “আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই, সুতরাং তাঁর ইবাদত করো।” যদি ইবাদত করাই প্রথম ও প্রধান কাজ হোত তাহলে আয়াতটি হোত এমন যে, “আল্লাহ ছাড়া মা’বুদ (ইবাদত, বন্দনা পাওয়ার অধিকারী) কেউ নয়, সুতরাং তাঁরই আনুগত্য করো”, আরবিতে লা মা’বুদ ইল্লাল্লাহ, ফা আত্তাবিয়্যুহু। কিন্তু কোর’আনে এমনটা একবারও বলা হয় নি। সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ ‘ইলাহ’ এবং ‘মা’বুদ’ শব্দ দু’টি ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন কারণ এদের অর্থও সম্পূর্ণ আলাদা।
মোটকথা, এই ১৫০ কোটির জনসংখ্যাটি, যারা নিজেদেরকে কেবল মুসলিমই নয়, একেবারে মুমিন ও উম্মতে মোহাম্মদী বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, তারা এগুলির কোনোটিই নয়, তারা কার্যত মুশরিক এবং কাফের। আল্লাহ বলছেন, ‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা হুকুম (বিচার ফায়সালা) করে না তারা কাফের, জালেম, ফাসেক (সুরা মায়েদা ৪৪, ৪৫, ৪৭)। এই আয়াতগুলিতে ‘হুকুম’ শব্দটি দিয়ে কেবল আদালতের বিচারকার্যই বোঝায় না, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক অর্থাৎ সামগ্রিক জীবন তাঁর নাযিল করা বিধান অর্থাৎ কোর’আন (এবং সুন্নাহ) মোতাবেক পরিচালনা করাকেও বোঝায়। মুমিন মুসলিম হবার দাবিদারগণ এখন আর একটি সু-সংহত উম্মাহরূপে নেই, তারা ভৌগোলিকভাবে পঞ্চাশটিরও বেশী জাতিরাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে ইউরোপীয় খ্রিষ্টান, ইহুদি ও পৌত্তলিকদের দাসে পরিণত হয়েছে, তাই তারা তাদের সামষ্টিক কার্যাবলী আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে ফায়সালা করে না। ফলশ্রুতিতে তারা ফাসেক (অবাধ্য), জালেম (অন্যায়কারী) এবং কাফেরে (প্রত্যাখ্যানকারী) পরিণত হয়েছে। আল্লাহ প্রদত্ত বিধানগুলিকে অপাংক্তেয় করে রেখে তারা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের আইন, কানুনগুলি নিজেদের দেশে প্রবর্তন করে তা দিয়ে সামষ্টিক কার্যাবলী পরিচালনা করছে।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই আমরা পরিস্কারভাবে বুঝতে পেরেছি যে তওহীদ ও দীন যে দুটি ভিন্ন বিষয় এবং এ দুটির তফাৎ কী। তওহীদ হচ্ছে ভিত্তি এবং দীন হচ্ছে এই ভিত্তির উপর নির্মিত অবকাঠামো, দালান। তওহীদ হচ্ছে, “একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য সকল সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করা এবং প্রতিটি বিষয়ে তাঁর হুকুমের আনুগত্য করা। সংক্ষেপে জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁর ও তাঁর রসুলের (স:) হুকুম মানা, প্রতিটি বিষয়ে যেখানেই তাঁর কোনো বক্তব্য আছে তা বিনা প্রশ্নে, বিনা দ্বিধায় মেনে নেওয়া। যে বিষয়ে তাঁর অথবা তাঁর রসুলের কোনো বক্তব্য নেই সে বিষয়ে, তা ব্যক্তিগত হোক বা সমষ্টিগত, আমরা স্বাধীনভাবে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি।”
এখন আমরা যদি মুক্তি পেতে চাই, জান্নাতে যেতে চাই, মুমিন-মুসলিম হতে চাই তবে আমাদের আগে কালিমাতে ফিরে আসতে হবে, আমাদেরকে আগে স্বীকৃতি দিতে হবে, “যেখানেই আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কোনো হুকুম, নির্দেশনা আছে সেখানে আর কারো হুকুম মানি না।” আর এই কালিমার ভিত্তির উপর আমাদের একতাবদ্ধ হতে হবে।

No comments:

Post a Comment