Saturday, June 25, 2016

মানুষ এনেছে গ্রন্থ, -গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো

মানুষ এনেছে গ্রন্থ, -গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো

আতাহার হোসাইন


কমনসেন্স বা সাধারণ জ্ঞান এমন একটি বিষয় যা কারো ভিতরে না থাকলে অন্য কেউ তা ঢুকিয়ে দিতে পারে না। ধর্মের ব্যাপারে যখন সেই কমনসেন্স হারিয়ে যায় তখন গোটা ধর্মই তার মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে। তখন ধর্মের শরীয়াহ, বিধিবিধান কার্যকর থাকলেও সেসব অর্থহীন হয়ে যায়। পাশাপাশি সেই ধর্ম মানুষকে শান্তি না দিয়ে বরং অশান্তিই উপহার দেয়, এমতাবস্থায় ধর্মের আনুষ্ঠানিকতাই মুখ্য হয়ে উঠে। কথায় আছে ধর্ম মানুষের জন্য কিন্তু ধর্মের জন্য মানুষ নয়। ধর্মের ব্যাপারে এই কমনসেন্স হারিয়ে গেলে তখন মানুষের জন্য ধর্ম নয়, বরং ধর্মের জন্যই মানুষ-এটা প্রকট হয়ে উঠে। তখন ধার্মিকরা মানুষ মেরে ধর্মপালন করতেও দ্বিধাবোধ করে না।
বিষয়টি আরো একটু পরিষ্কার করতে স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী থেকে একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। একবার একদল তরুণ স্বামী বিবেকানন্দের আশ্রমে গিয়ে বলল, ‘স্বামীজি, বিহারে ভয়ানক মরণঘাতী গো-মড়ক দেখা দিয়েছে। আমরা এই কটি তরুণপ্রাণ গো-মড়ক রোধ করার জন্য প্রাণপাত করব বলে আপনার আশীর্বাদ ভিক্ষা করতে এসেছি।’ স্বামী বিবেকানন্দ তরুণদের আকুতি শুনে বললেন, ‘তোমরা দেশের গো-সম্পদ রক্ষার জন্য উদ্যোগী হয়েছ দেখে আমি যারপরনাই আনন্দিত হলাম। তবে, তোমরা জান না, পূর্ববাংলার অনেক এলাকায় মরণঘাতী কলেরা দেখা দিয়েছে। সেখানে প্রতিদিন বহু মানুষ মারা যাচ্ছে। আমি বলি কি, তোমরা মানুষের প্রাণ রক্ষার জন্য আগে পূর্ববাংলায় ছুটে যাও। কলেরা আক্রান্ত অসহায় মানুষের সেবায় আমার তরফ থেকে যা কিছু সাহায্যের প্রয়োজন তার সবই তোমরা পাবে।’ স্বামী বিবেকানন্দের কথা শুনে স্বেচ্ছাসেবী দলের নেতা গোছের এক তরুণ হায় হায় রব ছেড়ে বলল, ‘স্বামীজি, এ আপনি কি বলছেন। বিহারে গো-মড়কে গো-মাতা মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রোগাক্রান্ত গো-মাতার সেবা ফেলে আপনি আমাদের মানুষের সেবায় পূর্ববাংলায় যেতে বলছেন? সব শুনে স্বামীজি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘তা ঠিক। গো-মাতা বিনে এমন নির্বোধ সন্তান জগতে কে আর প্রসব করবে?’
অনুরূপভাবে আমরা বলতে চেয়েছি যে এই মুহূর্তে মুসলিম বিশ্ব যখন চরম দুরাবস্থায় পতিত, মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে যখন চরম ঐক্যহীন অবস্থার কারণে নিজেরা নিজেরা মারামারি, গৃহযুদ্ধ কিংবা ভীন জাতির আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে, যখন মাথার উপর প্রতিনিয়ত বোমারু বিমান চক্কর দিচ্ছে, বোমার আঘাতে দেহ খ–বিখ- হয়ে যাচ্ছে, যখন প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে মুসলমানরা নিজের দেশ থেকে পালিয়ে ছোট ছোট নৌ-যানে করে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে মরছে, ইউরোপের রাস্তায় রাস্তায় আশ্রয়ের খোঁজে দিন কাটাচ্ছে, ঠিক এই সময়ে এই জাতিরই অন্য সদস্য অর্থাৎ অন্য মুসলমানরা কিভাবে ঈদের আনন্দ উৎসব করে তা আমাদের মাথায় আসে না। মাথায় আসেনা লাখ লাখ টাকা খরচ করে কিভাবে তারা হজ্জ করতে যায়! এই দুর্ভোগে পতিত মানুষের জন্য তাদের কি কোন ভূমিকাই নেই?
আমাদের এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে অনেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে অনেকে আমাদেরকে ইসলামের প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রচার চালান। তারা আরো বলেন যে, হজ্জ কিংবা কোরবানী আল্লাহর হুকুম, ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। সুতরাং এসব করতেই হবে। এইসব প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকারীদের উদ্দেশ্যে আমাদের বক্তব্য হচ্ছেঃ হজ্জ কিংবা কোরবানী যে আল্লাহর হুকুম, ইসলাামের অন্যতম স্তম্ভ তা আমাদের অবশ্যই জানা আছে। কিন্তু আমারই স্বজাতি ভাইয়েরা যখন না খেয়ে মরছে, উদ্বাস্তু শিবিরে মানবেতর জীবন-যাপন করছে, সাগরে ডুবে মরছে, আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, তখন আমি কি করে আনন্দ-উৎসব করি? কিভাবে আমার মুখে অন্ন উঠে? কিভাবে আমার মুখে হাসি আসে? কিভাবে আমি বত্রিশ পাটি দন্ত বিকশিত করে গরুর সাথে ফেসবুকে ‘কাউফি’ আপলোড করি?
ভালো কথা যে- হজ্জ, কোরবানী ইত্যাদি আল্লাহর হুকুম। তা অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু ইসলাম কি এও বলেনি যে, প্রতিবেশীকে ক্ষুধার্ত রেখে যে উদরপূর্তি করে খায় তার নামাজ-রোজা করে সবই অর্থহীন হয়ে যায়? সুরা মাউন পড়ে দেখুন সেখানে আল্লাহ কি বলছেন।
আল্লাহ বলছেন: “আপনি কি দেখেছেন তাকে, যে বিচারদিবসকে মিথ্যা বলে?
সে সেই ব্যক্তি, যে এতীমকে গলা ধাক্কা দেয়
এবং মিসকীনকে অন্ন দিতে উৎসাহিত করে না।
অতএব দুর্ভোগ সেসব নামাযীর,
যারা তাদের নামায সম্বন্ধে বে-খবর;
যারা তা লোক-দেখানোর জন্য করে
এবং নিত্য ব্যবহার্য্য বস্তু অন্যকে দেয় না।”
অর্থাৎ যেসব মুসুল্লী এতীমকে গলা ধাক্কা দেয় এবং নিত্য ব্যবহার্য বস্তু অন্যকে দিয়ে সহযোগিতা করে না তারা প্রকৃতপক্ষে বিচার দিবসে অবিশ্বাসী। তাদেরকে আল্লাহ দুর্ভোগ আক্রান্ত হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন। আল্লাহ যাকে দুর্ভোগ আক্রান্ত বলেন তার অবস্থান কোথায়? সে কি আদৌ মো’মেন-মুসলিম থাকতে পারে? অপর দিকে রসুলাল্লাহ বলেছেন, মুসলিম জাতি একটি দেহের ন্যায়। দেহের কোন একটা অংশ ব্যথিত হলে যেমন সারা শরীর ব্যথা অনুভব করে তেমনি একজন মুসলিম আক্রান্ত হলেও সকল মুসলিম ব্যথিত হবে। আল্লাহ রসুলের বক্তব্য অনুযায়ীই সেই কাউফি আপলোডকারী, মহাসমারোহে একাধিক গরু কোরবানীকারীদের অবস্থান আজ কোথায়? লাখ লাখ টাকা খরচ করে হজ্জকারীর হজ্জই বা জাতির জন্য কী কল্যাণ বয়ে আনছে? তাদের নামাজ, তাদের কোরবানী, তাদের হজ্জ তাহলে তাদেরকে কী শিক্ষা দিল? তারা কি সত্যিকার অর্থে মানবিক হতে পেরেছে?
পাঠক খেয়াল করে দেখবেন ধর্মের আইন, হুকুম কোনটাই মানবিকতার উর্ধ্বে নয়। আপনি মসজিদের পানে নামাজের জন্য ছুটছেন। এমতাবস্থায় দুর্ঘটনা আক্রান্ত কোন মুমূর্ষু ব্যক্তি যদি কাতরাতে থাকে তাহলে আপনি কি আগে আল্লাহর হুকুম পালন করতে মসজিদে ছুটবেন নাকি তাকে বাঁচানোর জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাবেন? যদি আপনি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান সেটাই হবে উত্তম কাজ। ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন ঈসা (আ)। মুসার (আ) আনীত দীনের শরীয়া পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করলেও সে সময়ের ইহুদিরা ধর্মের প্রাণ অর্থাৎ মানবিকতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। শনিবারে দুনিয়াবী কোন কাজ করা যাবে না- এটা ছিল শরীয়াহর অংশ। কিন্তু এই দীনে অন্ধের চোখ ভালো করা কিংবা অন্যের উপকার করার মত মানবিক কাজগুলো সে শরীয়াহর অন্তরায় নয় তা বোঝাতে তিনি ঠিক সেই শনিবারেই এক জন্মান্ধের চোখে হাত বুলিয়ে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিলেন। আজকের কমনসেন্সবিহীন জাতির মত তখনকার ইহুদিরাও তাতে প্রচুর গোস্বা করে ঈসাকে (আ) ধর্মদ্রোহী হিসেবে আখ্যা দিয়ে তাঁর বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছিল। একইভাবে আমরা যখন বলার চেষ্টা করছি যে ধর্মের জন্য মানুষ নয় বরং মানুষের জন্য ধর্ম, আনুষ্ঠানিক এবাদতের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আর্ত-পীড়িতকে উদ্ধার করা তখন কমনসেন্স হারানো মানুষগুলো আমাদের সামনে আল্লাহর হুকুমের কথা তুলে ধরছেন, আমাদেরকে নাস্তিক, ইসলামবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। পরিশেষে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা মানুষ কবিতার দুটো লাইন তুলে ধরছি।
“মানুষেরে ঘৃণা করি
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি
ও মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে ।
পুজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল! মুর্খ্যরা সব শোনো
মানুষ এনেছে গ্রন্থ,-গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।”
এরপরেও যাদের হুঁশ ফিরবেনা স্বয়ং আল্লাহ ছাড়া আর কেউ তাদের হুঁশ ফিরাতে পারবে বলেও মনে হয় না।

No comments:

Post a Comment