Friday, October 16, 2015

ধর্ম নিয়ে এত আলোচনা কেন???

ধর্ম নিয়ে এত আলোচনা কেন?
(দৈনিক বজ্রশক্তি, ১৬-১০-১৫)
.
ফেসবুকে-ব্লগে ধর্ম ছাড়া অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলা যায় না? মানুষ এত ধর্ম ধর্ম করে কেন? এর বাইরেও তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করতে সমস্যা কোথায়?
অনলাইনে ব্যক্তিগতভাবে আমি অনেকবার এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি। প্রশ্নটি এক দিক দিয়ে অবান্তর নয়, আবার অবান্তরও। ইদানীং ফেসবুক, ব্লগসহ অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে আলোচনার অন্যতম বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্ম। ধর্মের আলোচনায় মনোযোগ দিয়েছেন ধর্মবিশ্বাসী, ধর্মভীরু, ধর্মান্ধ থেকে শুরু করে ধর্মে অবিশ্বাসী বা নাস্তিক ট্যাগধারী মানুষরাও। ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে বাস্তবে ধর্মীয় রীতিনীতি বা আনুষ্ঠানিকতায় সচরাচর যাদের দেখা যায় না, তারাও অতি উৎসাহের সাথে এ আলোচনায় সম্পৃক্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে যারা ধর্মে অবিশ্বাসী, স্বাভাবিক বিবেচনায় যাদের ধর্ম নিয়ে মাথাব্যথা থাকার কোনো কারণ নেই, ধর্মের সমালোচনায় তাদেরও সক্রিয়তা রয়েছে চোখে পড়ার মতো। নাস্তিকতা ও ধর্মবিদ্বেষ কিছু ক্ষেত্রে কার্যত সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাই হোক, বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে সংক্ষেপে বলতে গেলে- অনলাইন জগৎ এখন মূলত ধর্ম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাতেই মুখরিত হয়ে আছে। কাজেই ধর্ম সম্পর্কে যাদের আগ্রহ সীমিত এবং সাম্প্রতিক ধর্মীয় আলাপচারিতায় যারা প্রায় বিরক্ত, তাদের পক্ষ থেকে এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। এ প্রশ্নের জবাবে আমি সচরাচর যে উত্তরটি প্রদান করি তা পাঠকদের উপযোগী করে এখানে উপস্থাপন করেছি। আশা করি পাঠকরা এখান থেকে ভাবনার খোরাক পাবেন।
.
আমি মনে করি, ফেসবুক-ব্লগে অর্থাৎ অনলাইনে ধর্মই এখন প্রধান আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত। শুধু অনলাইনে কেন, রাস্তাঘাটে, অফিস-আদালতে, বাসে-ট্রেনে, দোকানপাটে, সচিবালয়ে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, ক্লাবে, পার্কে, আড্ডায়, উৎসবে, অনুষ্ঠানে, আলোচনায়, সেমিনারে, জনসভায়, সংস্কৃতি চর্চায়, টকশোতে, পত্রিকার কলামে সর্বত্র এখন যে ইস্যু নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত, তা ধর্ম। হয়তো আপনার পছন্দ নয়, ধর্মের প্রতি আপনি আগ্রহী নন, কিংবা ধর্ম নিয়ে কোনো বিতর্ক হোক, তা আপনি চান না। কিন্তু এমন অনেক বিষয়ই তো আছে, যেমন হরতাল-অবরোধ, রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, যুদ্ধ-সংঘাতের মতো অনেক অপ্রত্যাশিত ও অপছন্দনীয় বিষয়, যা আপনি শত প্রচেষ্টা করেও আলোচনার বাইরে রাখতে সক্ষম হন না। সক্ষম হন না কারণ আপনার অপছন্দনীয় হলেও এগুলো আপনার জীবনেরই অংশে পরিণত হয়েছে। এগুলোকে এড়িয়ে চলা আপনার পক্ষে সম্ভব হয় না। বর্তমান পরিস্থিতিতে ধর্মও তেমন বিষয়ে পরিণত হয়েছে যাকে কেবল ব্যক্তিগত ইচ্ছে না থাকার কারণে আলোচনার বাইরে রাখা সম্ভব নয়।
আজ ধর্ম নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন উত্তপ্ত। এই ইস্যুটিকে কেন্দ্র করে এবার তৃতীয় বারের মতো সমস্ত পৃথবী দুইভাগে বিভক্ত হয়ে একে অপরের দিকে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার কথিত ধর্মনিরপেক্ষতা যতই বিস্তার লাভ করুক, তা যে মানবজাতির মধ্য থেকে ধর্মের আবেদন এতটুকু কমাতে পারে নি বাস্তবতাই তার প্রমাণ। ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীরাই এখন ধর্মকে কেন্দ্র করে একে অপরের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। গত কয়েক দশকের ইতিহাস পর্যালোচনা করুন; অধিকাংশ যুদ্ধ, সংঘাত, রক্তপাত ও মৃত্যুর পেছনে ধর্মকে ইস্যু হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছে। সুতরাং ধর্ম নামক ইস্যুকে সহজ করে ভাবার উপায় নেই।
.
ধর্ম কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে তা জিজ্ঞাসা করুন আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, লেবানন, ইয়ামেন, ফিলিস্তিন ইত্যাদি দেশের মানুষকে। তারা জানে ধর্ম কেন আলোচনার প্রধান ক্ষেত্র হওয়া উচিত, কেন একটি জাতির ধর্মবিশ্বাস অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কেন জাতির প্রতিটি সদস্যের ধর্মবিশ্বাসকে সঠিক পথে প্রবাহিত করা সময়ের দাবি, ধর্মকে অবহেলা করে দূরে সরিয়ে রাখলে পরিণাম কোথায় গিয়ে দাড়াতে পারে, ধর্ম কীভাবে আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর স্বার্থের লড়াইয়ে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তারা এ প্রশ্নগুলোর উত্তর শিখেছে নিজেদের জীবন থেকে, অভিজ্ঞতা থেকে। আমাদেরকেও যদি তেমন অভিজ্ঞতা থেকেই সেই শিক্ষা পেতে হয় তাহলে আর সার্থকতা রইল কোথায়?
.
একবার বন্যা শুরু হয়ে গেলে আর বাঁধ নির্মাণ সম্ভব হয় না। একবার একটি দেশে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় চক্রান্তে ধর্ম নিয়ে নোংরা খেলা শুরু হয়ে গেলে তার সমাপ্তি টানা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই যা করার আগেই করতে হয়। আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক পরাশক্তির দৃষ্ট পড়ে গেছে। সর্বোপায়ে চেষ্টা করা হচ্ছে বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করতে। সফলও হচ্ছে। আবার এ দেশে জঙ্গি একেবারেই যে নেই তাও বলা যাচ্ছে না। ধর্ম নিয়ে রাজনীতিসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ইস্যুতে অতীতে বড় বড় দুর্ঘটনার জন্ম দিয়েছে আমাদের দেশ। এমতাবস্থায় যদি প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশের জন্য এখন সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ কী? উত্তর আসা উচিত- আমাদের ধর্মবিশ্বাসের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
.
একটি নিুমধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের দেশে সমস্যার অন্ত নেই। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, বিরোধী দল, নির্বাচন, গুম, খুন, ক্রসফায়ার, দুর্নীতি, ক্ষমতার লড়াই, রাজনৈতিক কোন্দল ইত্যাদি ইস্যু প্রায় লেগেই রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই এসব চলে আসছে। সরকার পরিবর্তন হয়েছে, ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে, বিরোধী দল ক্ষমতায় আরোহন করেছে কিন্তু সমস্যা থেকেছে সমস্যার জায়গাতেই। প্রচলিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি সিস্টেম যতদিন বহাল তবিয়তে আছে, ততদিন এ সমস্যা নির্মূল হবে বলে আশা করা যায় না। বড় কথা হলো এ ইস্যুগুলো বছরের পর বছর ধরে ক্রিয়াশীল থাকলেও তার ক্ষয়ক্ষতি এতদূর গড়াতে পারে নি যাতে জাতি শারীরিকভাবেই ধ্বংস হয়ে যায়। অন্যদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে এই চিরপরিচিত ইস্যুগুলোর চেয়ে বড় এবং ¯পর্শকাতর ইস্যু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে যে ধর্মীয় ইস্যু, তাতে জাতির সামান্য পরিমাণ উদাসীনতাও বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বাংলাদেশ পরিণত হতে পারে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক, লেবানন বা ইয়ামেনের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে। কাজেই অন্য যে কোনো ইস্যুর চেয়ে ‘ধর্ম’ এখন প্রধান আলোচ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। ধর্মের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য চলা উচিত নিরন্তর অনুসন্ধান।
.
বস্তুত ধর্মীয় ইস্যুটি যে খুব বড় একটি ব্যাপার এবং মানুষের ধর্মবিশ্বাসের অপপ্রয়োগ জাতিকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে সে চ্যালেঞ্জকে আগে উপলব্ধি করতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা, বিচার-বিশ্লেষণ। আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে জনগণের ধর্মবিশ্বাসকে সঠিক পথে প্রবাহিত করার উপায় অনুসন্ধান করতে হবে। ধর্ম নিয়ে আলোচনাকে আমি তাই কোনো ভাবেই অবান্তর জ্ঞান করি না, বরং এ জাতির সকলেই এ আলোচনায় গুরুত্বের সাথে অংশগ্রহণ করবে- এটাই আমার প্রত্যাশা।

No comments:

Post a Comment