Friday, October 9, 2015

আইএস থাকলে যা হবে, আইএস না থাকলে যা হবে

আইএস থাকলে যা হবে, আইএস না থাকলে যা হবে

লিখেছেনঃ মোহাম্মদ আসাদ আলী।
এ দেশে আইএস সত্যিই আছে কি নেই তা ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা ও গবেষণার বিষয়। এ প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন জনের উত্তর ভিন্ন ভিন্ন। আইএস থাকার স্বপক্ষে যেমন অনেক যুক্তি-প্রমাণ আছে, বিপক্ষের যুক্তিও কম নেই। অনেকে আবার বিতর্কে মাঝামাঝি অবস্থান নিয়ে বলছেন, বাংলাদেশে আইএস নেই তবে জঙ্গি আছে। যাই হোক, আমার আজকের লেখার বিষয়বস্তু আইএসের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি প্রমাণ করা নয়। এখানে আমরা অতীত অভিজ্ঞতা, বাস্তবতা ও কিছু সরল যুক্তিবোধের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে অনুমান করার চেষ্টা করব আইএস থাকা বা না থাকার সাপেক্ষে আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে, অর্থাৎ আইএস থাকলে কী হবে আর না থাকলে কী হবে?
আইএস থাকলে-
১. আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দাবি মোতাবেক যদি ধরে নিই আমাদের দেশে আইএস আছে, তাহলে এটাও ধরে নিতে হয় ‘বিদেশী হত্যাকাণ্ড’গুলো তারাই ঘটাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি বড় ব্যর্থতা হয়ে দাঁড়ায় আইএসের সক্রিয়তা সম্পর্কে কোনোরূপ পূর্বধারণা না থাকা। আবার আইএস থাকার পরও এখন পর্যন্ত সরকার যেহেতু আইএস এর অস্তিত্ব সহজ ভাষায় স্বীকার করছে না, কাজেই বিষয়টি ভবিষ্যতে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে আইএস এর উত্থান কীভাবে হয়েছিল তা বিবেচনার বিষয়। ইরাক ও সিরিয়ার ভূখণ্ড দখল করে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রকাঠামো বা খেলাফত প্রতিষ্ঠার পূর্বপরিকল্পনা তাদের অনেক আগে থেকেই ছিল বলে জানা গেছে কিন্তু তা প্রকাশ করা হয় নি। সংগঠনটি আগে প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চয় করে, তারপর হঠাৎ আত্মপ্রকাশ করে ঝড়ের বেগে মধ্যপ্রাচ্যের সমস্ত হিসাব-নিকাশকে এলোমেলো করে ফেলে। একটি বিরাট ভূখণ্ড অধিকারের আগ পর্যন্ত সংগঠনটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আনকোরা একটি বিচ্ছিন্ন সংগঠন হিসেবেই পরিচিত ছিল। অর্থাৎ সুঁচ হয়ে প্রবেশ করে কীভাবে ফাল হয়ে বেরোতে হয় সে অভিজ্ঞতা তাদের আছে। আইএস এর এসব অতীত ইতিহাস যদি বিশ্লেষণ করা হয় এবং বাংলাদেশেও সংগঠনটি শাখা বিস্তার করেছে এ খবর সত্য ধরা হয় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আকস্মিকভাবে বাংলাদেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়লে অবাক হওয়া চলবে না।
২. বাংলাদেশে আইএস আছে কি নেই তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা গেলেও, এ দেশে জঙ্গি আছে, নামে-বেনামে, ছদ্মনামে অনেক উগ্রপন্থী জঙ্গিবাদী সক্রিয় রয়েছে এ কথায় আশা করি কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতার কারণে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারলেও এই জঙ্গিবাদীরা একেবারে নির্মূল হয়ে যায় নি। তাদের অন্তরে লালিত জেহাদী চেতনা জেল-জরিমানার ভয়ে নিঃশেষিত হয়ে যায় নি, বরং সময়ের সাথে সাথে সেই চেতনা আরও শাণিত হয়েছে। সাম্প্রতিককালে আইএস এর উত্থান ও বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিতে এইসব জেহাদী গোষ্ঠীগুলো নতুনভাবে অনুপ্রাণিত (রহংঢ়রৎবফ) হচ্ছে। বস্তুত আইএস তাদের আদর্শিক ‘হিরো’য় পরিণত হয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশে আইএস তাদের শাখা স্থাপন করলে এটা খুব স্বাভাবিক যে, এ দেশের জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলোও একাট্টা হয়ে তার অধীনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবে। সকল জঙ্গি সংগঠন একত্রে মিলিত হবার মতো একটি প্লাটফর্ম পেয়ে যাবে, যাকে নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে মোটেও সহজ হবে না।
৩. বলা বাহুল্য, আইএসের কথিত খেলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বাহ্যত জেহাদী মনোভাব দেখে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেরও কিছু মানুষ ইতোমধ্যেই আইএসকে সমর্থন করা শুরু করেছে। যেহেতু বিষয়টা মানুষের ইমানের সাথে সম্পর্কিত, অর্থাৎ আল্লাহ-রসুল, কোর’আন-হাদীস তথা ইসলামের নাম ব্যবহার করে আইএস সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে, সুতরাং সাধারণ মানুষ তো বটেই, প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদস্থ ব্যক্তিও যদি ভেতরে ভেতরে আইএসবাদী হয়ে থাকেন তাহলে অবাক হবার কিছু নেই। সাধারণ মানুষের এই সরল বিশ্বাসকে মোকাবেলা করা পৃথিবীর পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর পক্ষেও প্রায় অসম্ভব। সম্প্রতি ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ পশ্চিমা দেশগুলো থেকে যে হারে সাধারণ মুসলিম পরিবারগুলো আইএসে যোগ দিচ্ছে তাতে এ আশঙ্কাই আরও পাকাপোক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশি বংশদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিকদেরও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবার ঘটনা অহরহ ঘটছে। আইএসে যোগ দেবার বাসনায় দেশ ছাড়তে গিয়ে বিমানবন্দরে পুলিশের হাতে বেশ কয়েকজন যুবক আটক হয়েছে আমাদের দেশেই- যা প্রায় সকল গণমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে। ইদানীং আইএসের পক্ষে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পোস্টার লাগানোর ঘটনাও ঘটছে। সুতরাং আইএস বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু করলে তাদেরকে সহযোগিতা ও সমর্থন প্রদানকারী সাধারণ মানুষের অভাব হবে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক ইসলাম (চড়ষরঃরপধষ ওংষধস) করতে গিয়ে নানাবিধ কারণে যারা বাধা-বিঘেœর শিকার হয়ে কার্যত নিশ্চিহ্ন হবার পথে, স্বভাবজাতভাবেই আইএস নামক ‘মওকা’ লুফে নিতে কসুর করবে না তারাও। কাজেই আইএসের উপস্থিতিকে কোনোভাবেই হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। একবার এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে কোনো প্রতিশেধকেই কাজ হবে না।
৪. জঙ্গিবাদের রোষানলে পড়ে পৃথিবীব্যাপী যে ভয়ানক বিপর্যয় চলছে, ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, আইএসসহ জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলো তার কেবল একটি দিক রচনা করে এসেছে, সেটা হলো বর্বরতা ও নৃশংসতার দিক, অন্য দিকটি অর্থাৎ ধ্বংসলীলা, শোষণ ও অস্ত্রবাণিজ্যের দিক বরাবরই রচিত হয়েছে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে। সাম্রাজ্যবাদের জঙ্গি জঙ্গি খেলা বর্তমানে অপ্রকাশ্য নয়। এ খেলায় বহু দেশ ধ্বংস হয়েছে, জনাকীর্ণ জনপদ বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছে, লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, উদ্বাস্তু হয়েছে। বাংলাদেশে যে কোনোভাবে আইএস সক্রিয় হলে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের লোলুপ দৃষ্টি পড়বে তখন আমাদের উপর। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সিরিয়া, ইরাকের মতো ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে বাংলাদেশকেও। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ আশঙ্কা অমূলক নয়।
আইএস না থাকলে-
১. অন্যদিকে বাস্তবতা যদি হয় এমন যে, সরকারের ভাষ্য মোতাবেক এ দেশে আইএসের কোনো অস্তিত্বই নেই, বিদেশী হত্যাকাণ্ডগুলো আইএস ঘটাচ্ছে না, বরং অন্য কোনো পক্ষ বহিঃর্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অভিসন্ধী নিয়ে এ অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে তাহলেও নিশ্চিন্ত হবার কারণ নেই। বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব নেই- এ কথা যদি সত্য হয় তাহলে এও সত্য যে, এ দেশে আইএসের মিথ্যা উপস্থিতি প্রমাণের পক্ষে একটি মহল অপতৎপরতা চালাচ্ছে এবং সফলও হচ্ছে। বাংলাদেশের সামনে হুমকি হিসেবে সেটাইবা কম কীসে?
২. আইএস থাকুক আর না থাকুক, পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে যে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছিল তা যে অমূলক ছিল না তা তো প্রমাণ হয়ে গেছে। দুইজন বিদেশী নাগরিক খুন হয়েছেন। একই কায়দায়, মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে। দুইটি খুনেরই দায় স্বীকার করেছে আইএস, আর তা গণমাধ্যমে প্রচার করেছে যে ওয়েবসাইটটি তার পরিচালক একজন ‘ইজরাইলী গুপ্তচর’ বলে দাবী করছেন অনেকে। যদিও আইএসের নিজস্ব কোনো সূত্র থেকে দায় স্বীকার করা হয় নি, কাজেই হত্যাকাণ্ডের জন্য নিঃসন্দেহে আইএসকে দায়ী করার সুযোগ নেই, কিন্তু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এ ক্ষেত্রে যেভাবে ব্যাপক উৎসাহের সাথে বাংলাদেশে আইএসের উপস্থিতি প্রচারে আত্মনিয়োগ করেছে তাতে আইএস থাকা আর না থাকা এখন সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইএস থাকলে সরকারকে যতখানি চাপে পড়তে হতো, এখন মোটেও তার চেয়ে কম চাপ পোহাতে হচ্ছে না। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট টিমের পর এবার দক্ষিণ আফ্রিকার নারী ক্রিকেট দলও বাংলাদেশ সফর স্থগিত করেছে। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা দেশে আসতে ভয় পাচ্ছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো বারবার সরকারকে চাপ প্রয়োগ করছে, হত্যাকাণ্ডের কূল-কিনারা না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছে। কূটনীতিক মহলে শুরু হয়েছে ব্যাপক হুলস্থুল। গণমাধ্যমের প্রচারণা তো রয়েছেই। এক কথায় সারা বিশ্বে জঙ্গিবাদ প্রশ্নে বাংলাদেশের যে স্বচ্ছ একটি ইমেজ ছিল তা এখন অনেকাংশেই ম্লান। তবে বিশ্লেষকরা বর্তমানের চেয়ে ভবিষ্যৎ নিয়েই চিন্তিত বেশি।
এমতাবস্থায়, বাংলাদেশ সরকার যদি কোনোভাবে বিদেশী হত্যাকাণ্ডগুলোর প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে দিতে পারে যে, এর সাথে আইএসের কোনো যোগসূত্র নেই তবেই রক্ষা। তা করতে ব্যর্থ হলে এবং এভাবে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটতে থাকলে আইএসের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি সাপেক্ষে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আলাদা হবে না। উভয়ক্ষেত্রেই দেশটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের পরিণতি বরণ করতে বাধ্য হবে।
৩. তৃতীয়ত, সাম্রাজ্যবাদীদের বহুল ব্যবহৃত একটি সূত্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও কাজে লাগানো হচ্ছে কিনা তাও অনেকে ভেবে দেখছেন। প্রথমে একটি দেশে কৌশলে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটানো, এরপর আন্তর্জাতিকভাবে দেশটিকে জঙ্গিবাদে আক্রান্ত দেশ হিসেবে প্রচারণা চালানো এবং সবশেষে জঙ্গি দমনের নাম করে দেশটিকে ধ্বংস্তুপে পরিণত করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করার ইতিহাস পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বহুবার রচনা করেছে। সাম্রাজ্যবাদের এই পাতানো ফাঁদে পদার্পণ করার খেসারত আজও দিতে হচ্ছে পাকিস্তানকে। বাংলাদেশে হঠাৎ আইএসের উপস্থিতি নিয়ে প্রচার-প্রচারণা, দুই দুইটি পরিকল্পিত অথচ রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড, বিতর্কিত একটি ওয়েবসাইট থেকে আইএসের দায় স্বীকারের খবর প্রচার এবং আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ সরকারকে ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করা- সব মিলিয়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দিকেও যদি কেউ সন্দেহের তীর নিক্ষেপ করতে চায় তাহলে কি খুব অন্যায্য কাজ হবে?

No comments:

Post a Comment