Tuesday, June 16, 2015

গণতন্ত্রের এই ‘গলিত শব’ আর কতকাল বয়ে বেড়াব?

গণতন্ত্রের এই ‘গলিত শব’ আর কতকাল বয়ে বেড়াব?

Untitled-52-300x234
মসীহ উর রহমান:
আমীর, হেযবুত তওহীদ।
গণতান্ত্রিক সিস্টেমে রাষ্ট্রপরিচালনায় বিরোধী দলের অস্তিত্বকে অত্যাবশ্যক বলে থাকেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও গবেষকগণ। বলা হয়ে থাকে, “গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সরকার ও বিরোধী দল দুটি স্বতন্ত্র উপাদান। একটি অপরটির পরিপূরক। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে দল নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তারা সরকার গঠন করে। যারা কম আসন পায়, তারা থাকে বিরোধী দলে। এই দুয়ের স্বতন্ত্র ভূমিকা শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য রক্ষা করে। এ কারণে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার স্বেচ্ছাচারী হতে পারে না। বিরোধী দল এতে বাধা দেয়। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তির অন্যতম হচ্ছে এই বিধান (বিরোধীদলের উপস্থিতি)।” এই বিধানমতে ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতার জোরে স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নেয় কি না এ ব্যাপারে সজাগ থাকে বিরোধী দল। যে কোনো আইন পাশ, বৈদেশিক চুক্তি, দুর্নীতি ইত্যাদিতে তারা সরকার পক্ষকে চাপের মুখে রাখে। বিরোধী দল ব্যর্থ হলে বা দুর্বল হলে ক্ষমতাসীন দল স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ পায়, দুর্নীতি, ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার ও রাষ্ট্রের প্রভূত ক্ষতি সাধন করে। এই যুক্তিটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিরোধী দল ছাড়া রাষ্ট্র হবে অন্যায়ের আখড়া। কিন্তু আসলেই কি তাই?
বিরোধী দলগুলির প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা:
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান কার্যালয় হচ্ছে সংসদ। সংসদে বসেই নতুন নতুন আইন পাশ, বাজেট প্রণয়ন থেকে শুরু করে সমস্ত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা, অনুমোদন দেওয়া হয়। অর্থাৎ সংসদই হচ্ছে সরকারি দল ও বিরোধী দলের প্রধান কার্যালয়। এখান থেকেই সাংসদগণ আলাপ-আলোচনা, যুক্তিতর্ক ইত্যাদির মাধ্যমে কোনো একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হন। একটি দেশের সংসদ যত প্রাণবন্ত সে দেশের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড ততটাই স্বচ্ছ এবং সচল। কিন্তু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, যখন যে দলই বিরোধী দলে গিয়ে থাকুক না কেন, তারা লাগাতার সংসদ বর্জন করার মাধ্যমে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। দেশের সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিটি সংসদেই নানা অজুহাতে বিরোধীদলের সংসদ বর্জন এক প্রকার প্রথায় পরিণত করা হয়েছে।
প পঞ্চম সংসদে (১৯৯১-১৯৯৫) প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ৪০০ কার্যদিবসের মধ্যে সংসদের বাইরে ছিল ২৬৫ কার্যদিবস।
প সপ্তম সংসদে (১৯৯৬-২০০১) প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ৩৮২ কার্যদিবসের মধ্যে সংসদের বাইরে ছিল ২১৯ কার্যদিবস।
প আর অষ্টম সংসদে (২০০১-২০০৬) কার্যদিবস ছিল ৩৭৩ দিন। এই সংসদে ৩৭৩ কার্যদিবসের মধ্যে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সংসদের বাইরে ছিল ২২৩ দিন।
প ৯ম সংসদে বিভিন্ন অজুহাতে পাঁচ বছরের অধিকাংশ দিনই সংসদে অনুপস্থিত ছিল বিরোধী দল বিএনপি। ৪১৮ কার্যদিবসের মধ্যে বিরোধী দল ৩৪২ দিনই সংসদের বাইরে ছিল।
প ৯ম সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া সংসদে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ১০ কার্যদিবস। দেশের ইতিহাসে এ সংসদেই সবচেয়ে বেশি কার্যদিবস ও সবচেয়ে বেশি ২৭১টি বিল পাস হয়েছে। সুতরাং বলা চলে এ বিলগুলি সরকারের একক সিদ্ধান্তেই পাস হয়েছে।
চলমান সংসদে কার্যত কোনো বিরোধী দল না থাকায় তার পরিসংখ্যান দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি না। তাই এ পরিসংখ্যান উল্লেখ না করেই পরবর্তী আলোচনায় যাচ্ছি।
বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে বিরোধী দল সংসদে অনুপস্থিত থেকে প্রতিনিয়ত জনগণের অর্পিত দায়িত্ব পালন না করার মাধ্যমে তাদের ওয়াদা খেলাফ করে চলেছে, পক্ষান্তরে তারা সাংসদ হিসেবে বেতন ভাতাসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা গ্রহণে মোটেও অরুচি দেখান নি। অনেক সময় তারা সংসদে হাজির হয়েছে কেবল সদস্যপদ টিকিয়ে রাখার জন্য। বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা হচ্ছে, শুধুমাত্র বিরোধিতা করার খাতিরেই বিরোধী দল পাঁচ বছর যাবত সরকারের ভালো-মন্দ সকল কর্মকাণ্ডের একচেটিয়া বিরোধিতা করে যায়। এমনও দেখা যায় বাজেট ঘোষণার আগেই বিরোধীদল বাজেটের বিরুদ্ধে কর্মসূচি গ্রহণ করে ফেলে এমন কি বিকল্প বাজেটও তৈরি করে। বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপরিচালনা মোটেও থেমে থাকে না। তাই প্রশ্ন ওঠে, একটি কল্যাণরাষ্ট্রে বিরোধী দল কি সত্যিই অপরিহার্য?
বিরোধী দল ছাড়া সরকারের জবাবদিহিতা কীভাবে সম্ভব:
আল্লাহ মানবজাতির জীবন পরিচালনার জন্য যে জীবনব্যবস্থা দান করেছেন তাতে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রটি প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনেক ঊর্ধে। ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিরোধী দলের কোনো দরকার হয় না, এবং ইসলাম কোনো বিরোধীদলকে বৈধতা দেয় না। বিরোধী মানেই বিদ্রোহী। যারাই রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তারা আল্লাহর বিধান মোতাবেকই তা করেন। তাই এর বিরোধিতার সুযোগ নেই। বিরোধী দল না থাকা সত্ত্বেও শাসকরা কোনো অন্যায় করেন না বা করতে পারেন না। কারণ তারা হন সত্যের ধারক। ন্যায়, ওয়াদা, আমানতদারী ইত্যাদির মূল্য তাদের কাছে জীবনের চেয়েও বেশি। তারা বিশ্বাস করেন যে আল্লাহ তাঁদের প্রত্যেকটি কাজ দেখছেন, তিনি তাদের আত্মারও পরিজ্ঞাতা। পাশাপাশি তারা জনগণের কাছেও জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন। গণতন্ত্রের শাসকদের মতো ইসলামের শাসকরা জনবিচ্ছিন্ন হতে পারেন না। সাধারণ জনতার সঙ্গে তাদের মসজিদে দেখা হবেই। এছাড়াও তাদেরকে প্রতিনিয়ত জনগণের মধ্যে বসবাস করতে হয়। জনগণের প্রতিটি অভাব-অভিযোগ তাদের সামনে সুস্পষ্ট থাকে। ইসলাম জনগণকে এমন অধিকার দিয়েছে যে তারা রাষ্ট্রনেতাদের যে কোনো কাজের জন্য সরাসরি জবাব চাইতে পারেন। অর্ধ-পৃথিবীর খলিফা ওমর (রা.) এর মসজিদে খোতবা দানকালে তাঁর সকল নাগরিক থেকে অতিরিক্ত কাপড় পরিধানের জবাব চাওয়ার ঘটনাটি এখানে স্মরণ করা যায়। অন্যদিকে ভোগবাদী গণতান্ত্রিক শাসকরা অন্যায় করতে আল্লাহ বা মানুষ কারও ব্যাপারে ভয়, পরোয়া বা সঙ্কোচ করেন না। তারা জনগণকে ফাঁকি দেন, তাদের কোনো কুকর্ম প্রকাশ হয়ে গেলেও লজ্জিত হন না। বিরোধী দল এ নিয়ে কোনো আন্দোলন করতে চাইলে সরকারি নেতারা পরিসংখ্যান দেখিয়ে দেন যে, বিরোধী দল ক্ষমতায় থাকাকালে এর চেয়েও বেশি অপকর্ম করেছে। এসব কারণে গণতান্ত্রিকগণ ক্ষমতায় আরোহণ করতে পারলে হয়ে উঠেন অপ্রতিরোধ্য। রাষ্ট্রীয় অন্যায় রোধ করার কোনো পথই খোলা থাকে না বিরোধী দল যত শক্তিশালীই হোক না কেন। সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিরোধী দলের প্রয়োজন, এই যুক্তিতে বিরোধী দলের সৃষ্টি হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ভাল-মন্দ বিচার না করে অযৌক্তিকভাবে সকল কাজেরই বিরোধিতা করতে করতে জনগণের কল্যাণের পরিবর্তে সরকারি ও বিরোধী দল পরস্পর শত্রুতে পরিণত হয়। শুরু হয় দোষাদুষী, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, শেষে সংঘাত, সংঘর্ষ; অবর্ণনীয় দুর্দশার শিকার হয় সাধারণ মানুষ। অথচ সরকার যদি মনে করে তাদের প্রতিটি কাজের জন্য স্রষ্টার কাছে জবাবদিহি করতে হবে, তারা রাষ্ট্রীয় সম্পদের রক্ষকমাত্র, মালিক নয়, তাহলে তারা এতটা বেপরোয়া হতে পারত না। স্রষ্টার ভয় যার মধ্যে আছে তাকে পাহারা দেবার দরকার হয় না। যদি একটা নীতিতে সকলেই ঐক্যবদ্ধ হয় যে, যেটা ন্যায় সেটাকে ন্যায় বলেই মনে করা হবে, আর যেটা অন্যায় সেটাকে অন্যায় হিসাবেই সাব্যস্ত করা হবে, মাথা গুণে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ন্যায়কে অন্যায় আর অন্যায়কে ন্যায় বানানো হবে না, তাহলে বর্তমানের মতো অন্যায় হওয়া সম্ভব নয়। এখানে মিছিল, অনশন, ধর্মঘট, হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও কোনো কিছুরই প্রয়োজন পড়ে না। সরকার জনগণের কল্যাণ, শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য যা ন্যায়সংগত তা-ই করবে। প্রশ্ন আসতে পারে, সরকারের ভুল সংশোধনের উপায় কী হবে? সংশোধনের উপায় হলো- যার সমালোচনা করার দরকার, দৃঢ়চিত্তে তার সামনেই করতে হবে, কারও আড়ালে সমালোচনা (গীবত) করা যাবে না। কারণ আড়ালে সমালোচনা করলে সমাধান হয় না, সংশোধন হয় না, বরং তা জাতির মধ্যে ঐক্যহীনতা ও অসন্তোষ সৃষ্টি করে। জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা রাষ্ট্রদ্রোহের সামিল। সরকারের কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণের জন্য বিরোধীদল রেখে পৃথিবীর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণকারী দেশগুলিতে গত ১০০ বছরের ইতিহাসে কি দেশগুলির অন্যায়, অবিচার, অশান্তি বেড়েছে না কমেছে? মানুষ কি বিরোধীদলগুলির দ্বারা শান্তি পেয়েছে না যন্ত্রণায় পতিত হয়েছে?
প্রচারমাধ্যম, শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনীতিকদের বক্তৃতা ইত্যাদির দ্বারা গত কয়েকযুগ ধরে পৃথিবীর মানুষকে অবিশ্রান্তভাবে বোঝানো হয়েছে যে গণতন্ত্রই সুখ-শান্তির একমাত্র চাবিকাঠি। এই মিথ্যা কথাটি অজস্রবার শুনে শুনে অবস্থা দাঁড়িয়েছে এমন যে, অন্য কোনো পথেও যে শান্তি আসা সম্ভব সেটাও মানুষের চিন্তার বাইরে চলে গেছে। গণতন্ত্রের শুদ্ধতার ব্যাপারে কেউ আজ কোনো প্রশ্ন তোলে না, যেন গণতন্ত্র একটি ঐশী বিধান, বেদবাক্য। যদি কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রবল বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, সেখানের বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিকরা বলতে থাকেন যে, এখানে গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চা হচ্ছে না, এখনও গণতন্ত্র শিশু, এর বিকাশের জন্য আমাদের সবাইকে মিলে চেষ্টা করতে হবে, আরও বেশি গণতন্ত্রমনা হতে হবে। অর্থাৎ সকলের চিন্তা, ধ্যান ধারণা বৃত্তাবদ্ধ হয়ে গেছে। এটা এক প্রকার মানসিক বৈকল্য আর মুক্তবুদ্ধির বিপরীত। আমাদের এখন সময় এসেছে ভেবে দেখার। আমরা যে ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছি, এর ত্র“টি-বিচ্যুতি, সুফল-কুফল ইত্যাদি নিয়ে সরকার, জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলির এখন চিন্তা করার সময় এসেছে যে সত্যিই কি এই ব্যবস্থা মানুষের জন্য শান্তিদায়ক? যদি না হয়, তাহলে এই গলিত শব আর কতকাল আমরা বয়ে বেড়াব? বর্তমানে আমাদের দেশ একটি মহা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বিরোধীদলগুলির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমাদের যে তীক্ত অভিজ্ঞতা সে আলোকে বলা যায় দেশের এমন একটি বিপন্ন সময়ে আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক বিরোধীদলের চেয়ে বেশি প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। সাম্প্রতিক সহিংসতা মানুষের দেহে ও চিত্তে যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে কেবলমাত্র জাতীয় ঐক্যই তা নিবারণ করতে পারে। তাই আসুন, কে ক্ষমতায় আছে কে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে সে বিচারে না গিয়ে দেশকে সকল প্রকার অন্যায়, অশান্তি, সহিংসতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে তুলি। আমরা সকলেই ন্যায়, সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হই, তাহলে সরকার ও জনগণ সকলেই শান্তি পাবে।
লেখক: আমীর, হেযবুত তওহীদ।

No comments:

Post a Comment