Sunday, June 28, 2015

মুক্তমনা বিপ্লবীদের জন্য সমাজ পরিবর্তনের সঠিক পথ

মুক্তমনা বিপ্লবীদের জন্য সমাজ পরিবর্তনের সঠিক পথ

রিয়াদুল হাসান:
ইউরোপের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত ব্যক্তিমাত্রই জানেন যে, ঈসা (আ:) এর বিদায় গ্রহণের কিছুদিন পর জনগণের উপর দেশগুলির রাজন্যবর্গ জোরপূর্বক খ্রিস্টধর্ম চাপিয়ে দিয়েছিল এবং চেয়েছিল খ্রিস্টধর্ম দ্বারা তাদের জাতীয় জীবন পরিচালনা কোরতে। সুতরাং রোমান ক্যাথেলিক ধর্মযাজকদের হাতে অর্পিত হোয়েছিল মানুষের ইহজীবন ও পরজীবনের ফায়সালা, যদিও রাজ্যগুলির অধীশ্বর ছিলেন রাজাই। যেহেতু ঈসা (আ:) আনীত শিক্ষায় জাতীয় জীবন পরিচালনার মত অর্থনৈতিক, বিচারিক, প্রশাসনিক ব্যবস্থাগুলি ছিল না, তাই ‘ঐশ্বরিক ক্ষমতার উত্তরাধিকার’ ধর্মযাজকরা নিজেদের মনগড়া বিধানকেই ঈশ্বরের বাণী বোলে চালিয়ে দিত। অপরদিকে রাজারাও ছিলেন দুর্দান্ত অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী। এই উভয়প্রকার স্বৈরাচারী ব্যবস্থার নিষ্পেষণে সাধারণ মানুষের জীবন একেবারে ওষ্ঠাগত হোয়ে গিয়েছিল। চার্চ ও রাজারাও একে অপরের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হোয়েছিল। এই অবস্থার সমাধানকল্পে মাত্র দু’টি রাস্তাই সমাজচিন্তকদের দৃষ্টিগোচর হোয়েছিল। হয় ধর্মকে অস্বীকার কোরতে হবে, নয়তো তাকে জাতীয় জীবন থেকে আলাদা কোরে ব্যক্তিজীবনের ক্ষুদ্র পরিধিতে নির্বাসন দিতে হবে। যেহেতু ধর্মকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা তথা সম্পূর্ণ ইউরোপের জনগণকে নাস্তিক বানিয়ে দেওয়া তখনো সম্ভব ছিল না, তাই অষ্টম হেনরির সময়ে ১৫৩৭ সনে সিদ্ধান্ত গৃহিত হোল যে, মানুষের জাতীয় জীবনে ধর্মের কোনো জায়গা থাকবে না। চার্চ কেবলই মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের ভালোমন্দ, প্রার্থনা আর পরকাল নিয়ে কাজ কোরতে পারবে। স্রষ্টার বিধি-নিষেধকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় জীবন থেকে এই প্রথম বর্জন করা হোল। এ থেকেই ক্রমশ জন্ম নিলো এক চরম বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’ দাজ্জাল যা ধীরে ধীরে সমগ্র পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়তে শুরু কোর। সেই দাজ্জালেরই সৃষ্ট ব্যবস্থা হল পুঁজিবাদী গণতন্ত্র। দাজ্জালের জন্মের খুব অল্প দিনের ভেতরেই সামন্তবাদ ও রাজতন্ত্রের জায়গা দখল করে নিল পুঁজিবাদী গণতন্ত্র। এই পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের প্রভাবে সমাজ আরও ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ল। দেখা গেল সমাজের এক শ্রেণির লোক রাতারাতি অসম্ভব অকল্পনীয় সম্পদ-অর্থবিত্তের মালিক বনে যাচ্ছে, আর এক শ্রেণির লোক অর্ধাহারে, অনাহারে থেকে জীবনযাপন কোরতে বাধ্য হচ্ছে। ইউরোপের এই বৈষম্য এত প্রকট আকার ধারণ করলো যে, আজকালকার আধুনিক যুগে সেটা চিন্তারও বাইরে। এ পরিস্থিতি দেখে ইউরোপের অনেক জ্ঞানী-গুণী, পণ্ডিত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিদরা মানুষের মুক্তির পথ সন্ধান কোরতে লাগলেন। এদেরই অন্যতম হোলেন কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস, হেগেলস, লেনিন, লুক্সেমবার্গ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। তারা এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আবিষ্কার করলেন সমাজতন্ত্র। তাদের কিছু কিছু শ্লোগান ঔপনিবেশিক ও পুঁজিবাদী শাসনের বেড়িবদ্ধ শ্রমদাস শ্রেণিকে আলোড়িত কোরেছিল যেমন: কেউ খাবে কেউ খাবে না, তা হবে না-তা হবে না, Workers of the world, unite! বিশ্বের লক্ষ-কোটি জনতা সমাজতন্ত্রকে আলিঙ্গন করে নিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কয়েকদিন পরেই সমাজতন্ত্রের অসারতাও প্রমাণিত হয়ে গেল। জেগে উঠলো নতুন শ্লোগান: Better dead than red অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের চেয়ে মৃত্যুও শ্রেয়। যারা এক সময় সাম্যবাদী আদর্শকে বুকে ধরে প্রবল প্ররাক্রমশালী শক্তির বিরুদ্ধে লড়েছেন, যারা শোষণমুক্ত সমাজের কল্পনা করতেন, যারা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জীবনকে শেষ করে দিয়ে গেছেন, মানুষের কল্যাণ সাধনকেই জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে জেনেছেন, যারা জীবনে ভালো খেতে-পরতে পারেন নি, সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারেন নি, এমনকী সমাজ পরিবর্তনের নেশায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন নি তারাই আজ পরাজিত শক্তি, তাদের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে। তাদের আদর্শের পতন তারা চেয়ে চেয়ে দেখেছেন এবং দেখছেন। এখন তাদের অনেকেই আন্দোলন সংগ্রামকে পরিত্যাগ কোরে গণতন্ত্র মেনে নিয়ে ঘোর পুঁজিবাদীতে পরিণত হোয়েছেন। বিশ্বে মাত্র চারটি দেশে যথা চীন, কিউবা, লাওস আর ভিয়েতনামে সমাজতন্ত্র টিকে আছে, তবে এটাকে টিকে থাকা বলে না। কেননা বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র চীন সবচেয়ে বড় পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সুতরাং মোড়ক পাল্টিয়ে আবার ফিরে এসেছে সেই পুঁজিবাদ যা মানবজাতিকে দিতে পারে এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা যা প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাল্প শ্রেণি কর্তৃক সংখ্যাগুরুদের দমনের একটা বিশেষ যন্ত্র। আর স্বভাবতই সংখ্যাল্প শোষক কর্তৃক সংখ্যাগুরু শোষিতদের নিয়মিত দমনের মতো একটি বিষম ব্যাপারে সফল হোতে হোলে দরকার দমনের চূড়ান্ত হিংস্রতা ও পাশবিকতা, দরকার রক্তের একটি সমুদ্র, মানবজাতিকে যেখানে খুঁড়িয়ে চলতে হয় সর্বপ্রকার দাসত্বে, মজুরি দাসত্বে। এটাই আমাদের বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার চিত্র।
যারা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের পথ দিয়ে মানুষের মুক্তি কামনা কোরে হতাশ হোয়েছেন, যারা সত্যিকার অর্থেই মানুষের কল্যাণ চান তাদের প্রতি আমাদের কথা হলো- ‘আপনারা এতদিন যে ধর্মকে দেখে এসেছেন, যে ধর্মকে আপনাদের গুরু কার্ল মার্কস আফিম বলেছেন সেটা প্রকৃতপক্ষে আফিমই ছিল, কারণ সে ধর্ম মানুষকে বুঁদ করে দেয়। কিন্তু যেটা প্রকৃত জীবনব্যবস্থা- এসলাম, সেটা মার্কস দেখেন নি। সেটা কেবল গতিশীলই নয়, সেটা ছিল এমন এক সাইক্লোনের মত যার সৃষ্ট প্লাবন অতি সামান্য সময়ে অর্ধ দুনিয়াকে প্লাবিত করেছিল এবং তা শাসক আর শাসিতকে এক কাতারে নিয়ে এসেছিল। কেবল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, মানবজীবনের প্রতিটি অঙ্গন থেকে সর্বপ্রকার অন্যায় অবিচার দূর কোরে চূড়ান্ত শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা কোরেছিল। সেই প্রকৃত এসলাম আবার এসে গেছে। সেই মহামূল্যবান সত্যের সন্ধান দেওয়ার লক্ষ্যেই এই সংকলনটি আমরা সাজিয়েছি। সত্যিকারের মুক্তমনা বিপ্লবীরা সমাজ পরিবর্তনের সঠিক পথ এতে খুঁজে পাবেন আশা করি।

No comments:

Post a Comment