Monday, May 25, 2015

জুম’আর সালাহ কি ও কেন?

জুম’আর সালাহ কি ও কেন?

014মাহবুব আলী:
আল্লাহ মো’মেনদেরকে উদ্দেশ্য কোরে বোলেছেন, “হে মোমেনগণ! জুম’আর দিনে যখন সালাতের জন্য আহবান করা হয় তখন ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ কোরে আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও”(সুরা জুম’আ ৯)।” জুম’আর সালাহ এসলামের একটি বিশেষ সালাহ, যা সপ্তাহে মাত্র একবার কায়েম কোরতে হয়। ব্যক্তিগতভাবে এই সালাহ কায়েম করা যায় না, সামষ্টিকভাবে জামায়াতে, জুম’আ মসজিদে গিয়ে কায়েম কোরতে হয়। প্রশ্ন হোল- অন্যান্য সালাতের সঙ্গে জুম’আর সালাতের এই পার্থক্য কেন, জুম’আর বিশেষত্ব কি?
আল্লাহর রসুল ১৪০০ বছর আগে এই জাতিটিকে যেভাবে রেখে গিয়েছিলেন সেটা এখন আর সেই অবস্থানে নেই। তিনি রেখে গিয়েছিলেন একটি ইস্পাতের মত কঠিন ঐক্যবদ্ধ, একজন নেতার (এমাম) অধীনে সুশৃঙ্খল ও আনুগত্যশীল একটি উম্মাহ, যে উম্মাহ ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ কোরে, মারামারি কোরে আজ হাজার হাজার ভাগে বিভক্ত। তিনি রেখে গিয়েছিলেন এমন একটি জাতি যার প্রতিটি সদস্য ছিল দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, আর আজকের এই জাতি যে এসলাম পালন কোরছে তা কেবল মৃত্যুভয়ে ভীত কাপুরুষ তৈরি করে। সেই প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদীও জুম’আ কায়েম কোরতেন, তাদের সমাজ আর আজকে আমাদের সমাজে আকাশ পাতাল ফারাক। সেই সমাজে সার্বভৌমত্ব ছিল আল্লাহর, আইন-কানুন, অর্থনীতি, দণ্ডবিধি সমস্তকিছু ছিল কোর’আন মোতাবেক আর আজকের আমাদের সমাজে সার্বভৌমত্ব মানুষের, দাজ্জালের। মানুষের তৈরি মতবাদ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত, দণ্ডবিধি মানুষের তৈরি, অর্থনীতি সূদভিত্তিক। এভাবে সমগ্র জীবনব্যবস্থাটাই মানবরচিত। যেহেতু জুম’আর সালাহ সামষ্টিক তাই এর সঙ্গে সামষ্টিক জীবনব্যবস্থাও ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। এই বিপরীত প্রেক্ষাপটে এসে ১৪০০ বছর আগের সেই জুম’আকে বুঝতে হোলে আমাদেরকে আনুষাঙ্গিক আরও কিছু বিষয়, কিছু ইতিহাস আলোচনা কোরতে হবে।
এ ইতিহাস সর্বজনবিদিত যে, যতদিন রসুলাল্লাহ মক্কায় ছিলেন অর্থাৎ তাঁর হাতে রাষ্ট্রশক্তি ছিল না, ততদিন তিনি জুম’আর সালাহ কায়েম করেন নি কারণ জুম’আ একটি জাতীয়-রাষ্ট্রীয় এবাদত। মক্কায় তিনি ছিলেন ক্ষমতাহীন, জুম’আর যা কাজ অর্থাৎ শাসন তা করার ক্ষমতা তখন তাঁর ছিল না। মদিনাতে আল্লাহর সার্বভৌত্বভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করার পরে তিনি আল্লাহর বিধান দিয়ে জাতিকে পরিচালনা করার অধিকার লাভ কোরলেন, তখনই তিনি জুম’আ কায়েম আরম্ভ কোরলেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় রসুলাল্লাহ মক্কা থেকে হেজরত কোরে মদিনায় আসার পথে কু’বা পল্লীতে অবস্থান কোরেছিলেন। ঐ সময় তিনি সর্বপ্রথম জুম’আর সালাহ কায়েম করেন। তবে রসুলাল্লাহ নিজে মদিনায় আসার আগেই পত্র লিখে মদিনায় অবস্থানরত মাস’আব ইবনে উমায়েরকে (রা:) জুম’আর দুই রাকাত সালাহ কায়েমের হুকুম দেন। (আদ দারুল মনসুর- ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ: ২১৮, জুম’আ অধ্যায়)। ইবনে ইসহাক বলেন, কা’ব ইবনে মালেক স্বীয় পুত্র আব্দুর রহমানকে বলেন, বৎস! আবু উমামা আস আদ ইবনে জুরারাই (রা:) প্রথম ব্যক্তি যিনি আমাদের নিয়ে মদিনায় জুম’আর সালাহ প্রতিষ্ঠা করেন (ইবনে হিশাম (২য় খণ্ড), ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃ: ১০৭)।
অর্থাৎ এটা সর্বজন স্বীকৃত যে রসুলাল্লাহ মক্কায় কোনদিন জুম’আ কায়েম করেন নি। এর কারণ মক্কায় রসুলাল্লাহর কোন কর্তৃত্ব ছিল না, সেখানে তাঁর পক্ষে আল্লাহর কোন আইন-কানুন ইত্যাদি বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল না। তিনি যখন মদিনায় হেজরত কোরে আসলেন, মদিনায় আল্লাহর সার্বভৌমত্ব (তওহীদ) প্রতিষ্ঠিত হোল, মদিনার আউস এবং খাজরাজ গোত্র রসুলাল্লাহকে শাসক হিসাবে মেনে নিলেন, তখন মসজিদে নববী কেন্দ্রিক জুম’আর সালাহর কার্যক্রম আরম্ভ হোল।
একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য সর্বপ্রথম যে জিনিসটি প্রয়োজন তা হোল জাতির একজন নেতা থাকতে হয় যিনি আল্লাহর প্রতিটি হুকুম বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, অনড়। সেই নেতার আদেশ জাতিকে বিনা প্রশ্নে, বিনা দ্বিধায় পালন কোরতে হয়। মোসলেম উম্মাহর রাষ্ট্রীয় কার্যালয় হোল মসজিদ। রসুলাল্লাহ ও প্রকৃত এসলাম যতদিন ছিল ততদিন মসজিদ থেকেই জাতির সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হোত। সালাহ কায়েম ছাড়াও মসজিদ থেকে প্রেরিত হোত সেনাবাহিনী, মসজিদেই খলিফার সাক্ষাৎ কোরতেন বিভিন্ন রাষ্ট্রের দূতগণ। মসজিদ ছিল প্রাণবন্ত, জীবন্ত। প্রতি ওয়াক্তে নারী ও পুরুষ প্রায় সকলেই সালাতে অংশ নিত। তাই মসজিদ ছিল সবচেয়ে ব্যস্ততম এবং জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মসজিদকে আল্লাহর ঘর বলার কারণও এটাই। এমাম কেন্দ্রিক তথা মসজিদ কেন্দ্রিক এই জাতির একজন পুরুষ বা নারীও এই নেতৃত্বের, শৃঙ্খলার বাইরে ছিল না। যে এই ব্যবস্থার বাইরে থাকবে সে এসলাম থেকেই বহির্গত হোয়ে যাবে, অর্থাৎ উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত থাকবে না [আল হারিস আল আশয়ারী (রা:) থেকে আহমদ, তিরমিযি, বাব উল এমারত, মেশকাত]। এইভাবে কেন্দ্রীভূত থাকার জন্য আল্লাহ দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাহর বন্দোবস্ত দিয়েছেন। এই সালাতের মাধ্যমে জাতির মধ্যে যে ঐক্য, শৃঙ্খলা ও আনুগত্য সৃষ্টি করা দরকার তার প্রশিক্ষণ হবে পাশাপাশি তারা তাদের নেতার সংস্পর্শে আসবে ও কোন দিক নির্দেশনা থাকলে তা জানবে। একইভাবে আল্লাহর রসুলের তৈরি জাতির সকল সদস্য ও সদস্যা সপ্তাহে একবার জুম’আ মসজিদে একত্রিত হোতেন। সেখানে রসুলাল্লাহ, পরবর্তীতে খলিফা বা খলিফার প্রতিনিধিগণ এক কথা জাতির এমাম তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতেন। এই ভাষণই হোচ্ছে খোতবা। এর মাধ্যমে তাঁরা জাতিকে দিক নির্দেশনা দিতেন, পরবর্তী কর্মসূচি, কাজের নীতিমালা ইত্যাদি ঘোষণা কোরতেন। জুম’আর সালাতের পরে আল্লাহর নাজেলকৃত বিধান মোতাবেক অপরাধীদের দণ্ড কার্যকর করা হোত এবং খেয়াল রাখা হোত যেন জুম’আর দিনেই ঐ সপ্তাহের যাবতীয় বিচারকার্য সমাপ্ত হোয়ে যায়, পরবর্তী সপ্তাহ পর্যন্ত যেন দীর্ঘায়িত না হয়। এসকল ব্যস্ততার কারণে আল্লাহ জুম’আর সালাহ মাত্র দুই রাকাত কোরে দিয়েছেন। জুম’আর দিনে এতসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা হোত বোলেই জুম’আর সালাতের এতই গুরুত্ব, এজন্যই আল্লাহ জুম’আয় যাওয়ার জন্য আলাদাভাবে হুকুম কোরেছেন (জুম’আ ৯), রসুলাল্লাহও জুম’আয় অনুপস্থিত থাকলে তার বিষয়ে কঠিন সতর্কবাণী উচ্চারণ কোরেছেন এবং খোতবা শোনাকে ওয়াজিব কোরেছেন। যতদিন এসলামের শাসন অর্ধ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত ছিল ততদিন প্রতিটি এলাকার প্রশাসকরা খলিফার নির্দেশ ও নীতিসমূহ খলিফার পক্ষ থেকে তাদের স্ব-স্ব মসজিদে জুমার খোতবার মাধ্যমে বোলে দিতেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি ছাড়া জুম’আর অস্তিত্ব কল্পনাও করা যেত না। খোতবার প্রধান দিক হোল জাতির উদ্দেশ্যে দিক নির্দেশনা। রাষ্ট্রের পক্ষে যিনি এই ভাষণ দিবেন তিনিই খতিব। বর্তমানে আটলান্টিকের তীর থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত অর্ধ পৃথিবী জুড়ে শত শত ভাগে খণ্ড-বিখণ্ড মোসলমান নামক এই যে বিশৃঙ্খল জনসংখ্যা পড়ে আছে তা যেন মরা প্রাণহীন। এজন্য এদের মসজিদগুলিও মরা, প্রাণহীন। এরা এখন দাজ্জালের পদানত ভৃত্ত। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী খলিফা তো নেই, অনেক এলাকায় তাই কাপড় সেলাইকারী দর্জিদেরকেই খলিফা বোলে ডাকা হয়। এসলামে কাজী বোলতে বোঝায় যিনি আল্লাহর আইন দিয়ে বিচারকার্য সম্পাদন করেন অর্থাৎ বিচারক। অথচ আজ কাজী বোলতে বোঝায় যে লোক সামান্য অর্থের বিনিময়ে বিয়ে পড়ান। একইভাবে খতিবও এখন আর জুম’আর দিনে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসাবে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণদানকারী নন, তিনি কেবল নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে জুম’আর নামাজ পড়ান। তার দ্বারা বিচার ফায়সালা তো দূরের তিনি মসজিদ কমিটির চোখ রাঙানীর ভয়ে থাকেন সদা-তটস্থ। কি করুণ পরিণতি!
বড় দুঃখের বিষয় হোলেও সত্য যে আজ এই জাতির জাতীয় ও সামষ্টিক কাজের সঙ্গেই মসজিদের কোন যোগসূত্র নেই, জুম’আরও কোন যোগসূত্র নেই। বর্তমান মসজিদগুলো নি®প্রাণ অধিকাংশ সময়েই গেটে তালা ঝুলানো থাকে। সেখানে নামাজ পড়া ছাড়া আর কোন কাজ করা নিষেধ, এমন কি অনেক মসজিদে লেখা থাকে মসজিদে দুনিয়াবি কথা বলা হারাম। রসুলাল্লাহর জারি কোরে যাওয়া জুম’আর মতই আজও মসজিদে শুক্রবারে খোতবা দেওয়া হয়, কিন্তু সেই খোতবা দেওয়া হয় বই দেখে। তবে যিনি খোতবা দেন তিনি খলিফার প্রতিনিধি নন, মসজিদ কমিটির নিয়োজিত বেতনভুক্ত কর্মচারী, যদিও অতীত সংস্কারবশ্যে এখনও তাকে ‘এমাম বা নেতা’ বোলেই সম্বোধন করা হয়, যিনি প্রতিনিয়ত চাকুরি হারানোর ভয়ে তটস্থ থাকেন। সেই খোতবাতে জাতির নেতার কোন বক্তব্য থাকে না কারণ জাতির তো কোন নেতাই নেই। জুম’আর প্রকৃত আকিদা, উদ্দেশ্য ভুলে যাওয়ার দরুণ আজকে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, জুম’আ মসজিদে চোরের বিচার হওয়া দূরে থাক চুরি যাওয়ার ভয়ে সাধারণত কেউ দামি জুতা পরে মসজিদে যান না। নিয়ে গেলেও তা সযতেœ সেজদার স্থানে বা জুতা রাখার বাক্সের মধ্যে রাখেন। সালাহ শেষে সেই জুতা খুঁজে পেলে খুশিমনে বাড়ি ফিরে আসেন।

No comments:

Post a Comment