Wednesday, May 27, 2015

জঙ্গিবাদ: স্রষ্টা পশ্চিমা বিশ্ব, শিকার মুসলিম বিশ্ব

জঙ্গিবাদ: স্রষ্টা পশ্চিমা বিশ্ব, শিকার মুসলিম বিশ্ব

রিয়াদুল হাসান:
আদর্শিক লড়াই কেন ও কীভাবে?
মাননীয় এমামুয্‌যামান এ প্রস্তাবনা পেশ করেছিলেন ২০০৯ সনে। তারপরে আরো বহু রণাঙ্গন তৈরি করা হয়েছে যেগুলোতে লক্ষ লক্ষ মুসলিম দাবিদারের রক্তধারা প্রবাহিত হয়েছে। যাদের অস্ত্র বিক্রি করা দরকার তারা অস্ত্র বিক্রি করছে। কিন্তু এটা এখন প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, সর্বোচ্চ বল প্রয়োগে বা সীমাহীন অর্থব্যয় করেও যে জঙ্গিবাদ দমন সম্ভব নয়। মাননীয় এমামুয্‌যামান তাঁর চিঠিতে প্রমাণ করেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত জঙ্গিবাদবিরোধী যুদ্ধ ফলপ্রসূ হয় নি, বরং বিশ্বে গত এক দশকে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে, অর্থাৎ যুদ্ধের ফলে জঙ্গিবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৮-নভেম্বর ২০১৪ তারিখে বিবিসিতে প্রকাশিত ‘বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ সূচক-২০১৪’ রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ২০১২ এবং ২০১৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতের হার শতকরা ৬১ ভাগ বেড়ে গেছে, যা শক্তিপ্রয়োগে জঙ্গিবাদ দমনের ব্যর্থতার প্রমাণ বহন করে। রিপোর্টে বলা হয় গত বছর বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সবমিলিয়ে ১০ হাজারের মতো সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে যাতে প্রাণ হারায় ১৮ হাজার মানুষ। এ সংখ্যা ২০১২ সালের চেয়ে ৪৪ ভাগ বেশি। জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট, আল কায়দা, বোকো হারাম এবং তালেবানরাই অধিকাংশ সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। সন্ত্রাসবাদ সূচকের শীর্ষে রয়েছে ইরাক, অথচ ১০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে ইরাক জয়ের ঘোষণাও দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ‘ইন্সটিটিউট ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড পিস’ (আইপি) কর্তৃক প্রকাশিত ওই রিপোর্টে এ কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে, ‘বিশ্বে কেবল সন্ত্রাসের তীব্রতাই বাড়ে নি এর প্রসারও বৃদ্ধি পেয়েছে।’ ২০১৩ সালে যে পাঁচটি দেশে সর্বাধিক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছিল সেগুলো হচ্ছে- ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া এবং সিরিয়া। শতকরা ৮০ ভাগ হামলার ঘটনাই ঘটেছে এ ক’টি দেশে। এটা প্রমাণ করে যে, যেখানে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বেশি শক্তিপ্রয়োগ করা হয়েছে সেখানে সন্ত্রাসী হামলার পরিমাণ তত বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থা প্রমাণ করে যে, জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে আগে আদর্শিক লড়াইয়ের দ্বারা জঙ্গিবাদকে ভুল প্রমাণ করতে হবে। এতে জঙ্গিরা যুদ্ধের প্রেরণা হারিয়ে ফেলবে এবং তাদের রিক্রুটমেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে। তারা বৃহত্তর জনগোষ্ঠী দ্বারা ধিকৃত ও প্রত্যাখ্যাত হবে, তারা গণপ্রতিরোধের সম্মুখীন হবে। আর এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে মতবাদভিত্তিক সন্ত্রাসবাদের মোকাবেলার জন্য গণপ্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই।
প্রাচীন চীনা সমরবিদ ও সেনানায়ক সান যু (Sun Tzu) বলেছিলেন, “To fight and conquer in all your battles is not supreme excellence; supreme excellence consists in breaking the enemy’s resistance without fighting অর্থাৎ “যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয় লাভ করাই চূড়ান্ত শ্রেষ্ঠত্ব নয়, শত্রুর প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বিনা যুদ্ধে তছনছ করে দেওয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব। আদর্শিক লড়াই (The Battle of Ideas) হচ্ছে শত্রুর প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বিনা যুদ্ধে তছনছ করে দেওয়ার একটি কার্যকরী পদ্ধতি।
আমরা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে শুধু মানবতার কল্যাণে আমাদের দেশকে (এবং মানবজাতিকে) জঙ্গিবাদের হুমকি থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব গ্রহণ করতে চাই। আমরা দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে পারি, যে আদর্শে দীক্ষিত হয়ে মানুষ বুকে বোমা বেঁধে আত্মঘাতী হয় সেই পদ্ধতিকে ভুল প্রমাণ করতে যে শক্তিশালী যুক্তি (Anti-logic), তথ্য ও প্রমাণ প্রয়োজন তা আছে কেবল হেযবুত তওহীদের কাছে। তাই জঙ্গিবাদ দমন এবং একেবারে নির্মূল করা হেযবুত তওহীদ ছাড়া সম্ভব নয়।
জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আদর্শিক লড়াই চালাতে বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো নির্ভর করছে আলেম শ্রেণিটির উপর। আমাদের দেশের সরকার এ ব্যাপারে নির্ভর করছেন মাদ্রাসা শিক্ষিত মসজিদের এমাম আর বিভিন্ন সরকারি ধর্মীয় গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানের উপর।
কিন্তু জঙ্গিদেরকে আদর্শিক যুদ্ধে পরাজিত করার সামর্থ্য কি এই ধর্মজীবী আলেম শ্রেণির রয়েছে?
এক কথায় এ প্রশ্নের উত্তর হলো: নেই। বাংলাদেশে কেবল নয়, দেড় যুগ আগে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটার পর থেকেই আলেমদেরকে দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণা (Campaign) চালানো হয়েছে। তারা ইতোমধ্যেই অসংখ্য বই লিখেছেন, ওয়াজ করেছেন, টিভি চ্যানেলে সেগুলো বছরের পর বছর প্রচারিত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। এই বাস্তবতা এখন স্বীকার করে নেওয়ার সময় এসেছে যে, এই আলেমদের কাছে এমন কোনো যুক্তি-প্রমাণ নেই যা দিয়ে তারা জঙ্গিবাদকে ভ্রান্ত প্রমাণ করতে পারেন।
সত্যিকার যুক্তি প্রমাণ না থাকা ছাড়াও তাদের দ্বারা জঙ্গিদমনে কার্যকরী কোনো ভূমিকা রাখা সম্ভব নয় কারণ মাদ্রাসা শিক্ষিত এই আলেম নামধারী শ্রেণিটি ধর্মকে তাদের জীবিকার উপকরণ হিসাবে গ্রহণ করেছেন, ইসলামের কাজ করে পার্থিব সম্পদ ও সুখ-সুবিধা হাসিল করছেন যা আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে কঠোরভাবে হারাম করেছেন (সুরা বাকারা ১৭৪ সহ বহু আয়াত)। যে তাদেরকে টাকা দেয়, ভাড়াটে আলেমরা তার পক্ষেই কথা বলেন, সামান্য পার্থিব স্বার্থে তারা কোর’আন হাদিসের বিকৃত ব্যাখ্যা করে মিথ্যা ফতোয়া প্রদান করেন। তাদের এসব ব্যাখ্যায় সত্য-মিথ্যার কোনো ভেদাভেদ থাকে না। হারাম ভক্ষণকারীর কোনো চরিত্র থাকে না, নৈতিক মেরুদণ্ড ও সত্যের প্রতি অবিচলতা থাকে না, অর্থের লোভে তারা যে কোনো মিথ্যার সঙ্গে আপস করে। তাদের এই স্বভাবের কারণে আমাদের সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা একেবারেই কমে গেছে।
তাছাড়া যামানার এমাম প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, এই তথাকথিত আলেমরা প্রকৃত ইসলামের অনুসারী নন। তাদের কাছে যে ইসলামটি আছে সেটা একটি বিকৃত এবং বিপরীতমুখী ইসলাম। যে কোনো জিনিস বিকৃত হয়ে গেলে সেটা বিভিন্ন আকৃতি-প্রকৃতি (Form) ধারণ করে। এই আলেম-পুরোহিত শ্রেণি হচ্ছে বিকৃত ইসলামের একটি শাখা আর জঙ্গিবাদ হচ্ছে বিকৃত ইসলামের আরেকটি শাখা। এই ধর্মজীবী আলেমদের কাছে সঠিক ইসলাম থাকলে তারা নিজেরা যেমন ধর্মব্যবসা করতেন না, তেমনি এ সমাজে জঙ্গিবাদেরও জন্ম হতো না। জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটাচ্ছেন আরেক শ্রেণির আলেম। বিকৃত ইসলামের অনুসারী ধর্মজীবী আলেমরা অন্ধ ও পথভ্রষ্ট, অপরপক্ষে জঙ্গিরাও অন্ধ ও পথভ্রষ্ট, যদিও উভয়ের মধ্যে আদর্শের ফারাক রয়েছে। একজন পথভ্রষ্ট অন্ধ কি কখনও আরেক পথভ্রষ্ট অন্ধকে পথ দেখাতে পারে? পারে না। তাই ধর্মজীবী, প্রচলিত ইসলামের আলেমদেরকে দিয়ে জঙ্গিবাদের মোকাবেলা করার চেষ্টা কেবল পণ্ডশ্রম; এতে সময় ও সরকারি অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই হবে না।
তাছাড়া আমরা জানি যে, মাদ্রাসা-শিক্ষিত শ্রেণিটি সহজেই জঙ্গিবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং মাদ্রাসাশিক্ষিত অধিকাংশ ব্যক্তির মনেই ‘জেহাদি’দের প্রতি একটি কোমল অনুভূতি (Soft corner) ও শ্রদ্ধামিশ্রিত সমর্থন থাকার যৌক্তিক কারণ রয়েছে, কারণ শত হলেও জঙ্গিরা ইসলামের জন্য জীবন দিতে উদ্যত, তাদেরও অধিকাংশই মাদ্রাসাশিক্ষিত। তাই তথাকথিত আলেম বেশধারী ব্যক্তিদেরকে দিয়ে জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণা চালানোর কোনো মানেই হয় না। তবে মাদ্রাসা থেকেই শুধু জঙ্গি তৈরি হয় তা নয়। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকেও জেহাদের অপব্যাখ্যা দ্বারা ভুল পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষিত সন্তানদের জঙ্গিবাদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার এ প্রবণতা কেবল গ্রেফতার, রিমান্ড, কারাদণ্ড, ফাঁসি দিয়ে রোধ করা সম্ভব নয়।
এটা উপলব্ধি করেই মাননীয় এমামুয্‌যামান এগিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, যে আদর্শে দীক্ষিত হয়ে মানুষ নিজের জীবন-সম্পদ সব তুচ্ছ করে অনিশ্চিত জীবন বেছে নেয়, এমনকি বুকে বোমা বেঁধে আত্মঘাতী হয়, ইসলাম প্রতিষ্ঠার সেই পদ্ধতিকে ভুল প্রমাণ করতে যে শক্তিশালী যুক্তি, তথ্য ও প্রমাণ প্রয়োজন তা তাঁর কাছে আছে। তাঁকে যদি সুযোগ দেওয়া হয় তবে তিনি কোর’আন ও হাদিসভিত্তিক সেই যুক্তি ও প্রমাণগুলো তুলে ধরে জঙ্গিদেরকে, ইসলামের নামে সহিংসতা সৃষ্টিকারীদেরকে ভ্রান্তপথ থেকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন এনশা’আল্লাহ।
সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯ এ সন্ত্রাসবাদের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে সে অনুযায়ী শুধু ইসলামের নামে বোমাবাজিই কিন্তু জঙ্গিপনা, সন্ত্রাস বা Terrorism নয়, যে কোনো কারণেই হোক, যারা মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি বা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে অস্ত্র বা বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার করল তারা হচ্ছে সন্ত্রাসী। এই হিসাবে গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আদর্শের যে দলই হোক না কেন, কেউ যদি বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, মানুষ হত্যা করে সেটাও সন্ত্রাস। সর্বপ্রকার সন্ত্রাস থেকে আমরা মানবজাতিকে মুক্ত করতে চাই। আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি, যামানার এমামের শিক্ষায় যারা শিক্ষিত হবে তারা সর্বরকমের ধর্মব্যবসা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, অন্যায়-অপরাধ থেকে নিজেরা যেমন বিরত থাকবে, তেমনি মানবজাতিকেও মুক্তি দিতে পারবে এনশা’আল্লাহ। তার একটি প্রমাণ হেযবুত তওহীদের গত ১৯ বছরের রেকর্ড। এই দীর্ঘ সময়ে হেযবুত তওহীদ আন্দোলন এবং এর কোনো সদস্য একটিও আইনভঙ্গ করে নি, একটিও অপরাধ করে নি। এটা আমাদের দাবি নয়, এটা আদালতের রেকর্ড। এটা সম্ভব হয়েছে কেবল এই কারণে যে, হেযবুত তওহীদ আল্লাহর প্রকৃত ইসলামের অনুসরণ করছে।
আজ যখন রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল পদে আসীন ব্যক্তিগণ অনুভব করছেন যে তাদের আদর্শিক যুদ্ধে অন্যদেরও এগিয়ে আসা, অংশ নেওয়া প্রয়োজন তখন এমামুয্‌যামানের সেই প্রস্তাবনাটি বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পুনর্বিবেচনা করার জন্য প্রস্তাব করছি। আমরা আশা করব, সরকার যদি সত্যিই জঙ্গিবাদ সমস্যার সমাধান চান তবে আমাদের এই প্রস্তাবনাটি বিবেচনায় রাখবেন।
এখন করণীয়:-
এটা প্রমাণিত সত্য যে, জঙ্গিবাদের স্রষ্টা তারাই যারা আজকে ‘জঙ্গি জঙ্গি’ বলে হৈ চৈ করছে, অর্থাৎ পশ্চিমারা। আর যারা ধর্মকে নিজেদের জীবিকার মাধ্যমে পরিণত করেছে সেই ধর্মব্যবসায়ীরাও জঙ্গিবাদের উস্কানিদাতা। এ বিষয়ে যেটুকু তথ্য-প্রমাণ দিলাম তা সামান্য হলেও আশা করি তা যেকোনো সত্যসন্ধানী মানুষের উপলব্ধির জন্য যথেষ্ট। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই জঙ্গিবাদ নির্মূল করার ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কি? মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রনায়ক, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সুশীল সমাজ, জননেতা, বুদ্ধিজীবী সাধারণ জনতা সকলের প্রতি আমাদের কথা হলো, এই পরিস্থিতিতে অতি সাবধানে আমাদেরকে কর্তব্যকর্ম নির্ধারণ করতে হবে। যথা:
(১) রাজনীতিতে ধর্ম এখন প্রধান ইস্যু:
যারা জাতির কর্ণধার অর্থাৎ রাষ্ট্রপরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদেরকে বুঝতে হবে যে, আমাদের উপমহাদেশের রাজনীতিতে বর্তমান সময়ে ধর্ম সবচেয়ে বড় ইস্যু, তাই মানুষের ধর্মানুভূতিকে অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ নেই। ইউরোপে সেক্যুলারিজমের জয়জয়কার। তারা তাদের সেই ধ্যান-ধারণাকে সবার উপরে চাপিয়ে দিতে চায়। কিন্তু ভারত উপমহাদেশের সঙ্গে ইউরোপের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন, তাই এই দুই অঞ্চলের অধিবাসীদের মানসিক গঠনও সম্পূর্ণ ভিন্ন্‌। ইউরোপের মানুষের পক্ষে ধর্মহীন জীবনব্যবস্থা নতুন কিছু নয়। ঈসা (আ.) এর আবির্ভাবের বহু আগে থেকেই ইউরোপ ছিল ধর্মবঞ্চিত। জনগণের অধিকাংশই ছিল মূর্তিপূজক প্যাগান। বর্বর রাজতন্ত্রের যাঁতাকলে নিরুপায় প্রজার নিষ্পেষণই ছিল ইউরোপের জীবনব্যবস্থা। ঈসা (আ.) এর আনীত ধর্মের আংশিক পরিবর্তিত রূপটি যখন ইউরোপে প্রচারিত হলো, তখন জনগণ এটাকেই তাদের মুক্তির পথরূপে বরণ করে নিল। কিন্তু হায়! সেখানে তো সামষ্টিক জীবন পরিচালনার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাই জনগণের মুক্তি মিললো না। জন্ম নিল ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি, তারা নিজেদের মুখের কথাকেই ধর্ম বলে জনগণের উপর চাপিয়ে দিল। তারা সৃষ্টি করল মধ্যযুগীয় বর্বরতা (Medieval barbarism) নামক মানব ইতিহাসের কালো অধ্যায়। মানুষ ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। ইউরোপীয় চিন্তানায়কদের গবেষণার ফল হিসাবে দাঁড়িয়ে গেল নতুন বস্তুবাদী জীবনব্যবস্থা, যার দ্ব্যার্থাত্মক, বিভ্রান্তিকর ও চমকপ্রদ নাম ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism)। এই মতবাদের চর্চায় ধর্ম কার্যত ব্যক্তিগত বিশ্বাস আর আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে বন্দি হলো। এই ইউরোপীয় জাতিগুলো যখন দিগ্বিজয়ে বের হলো, তারা পৃথিবীর বহু সমৃদ্ধ ও অ-সমৃদ্ধ জাতিকে তাদের গোলামে পরিণত করে ফেলল। তদানীন্তন বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ জাতি মুসলিমদের জন্য এই গোলামিতে অভিষিক্ত হওয়া ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা শাস্তিবিশেষ। মুসলিম হিসাবে তাদের উপর আল্লাহ দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন যে তারা সারা পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করে মানুষকে শান্তিময় একটি জীবন উপহার দেবে। তাদের এই দায়িত্ব ত্যাগের পরিণাম কী ভয়াবহ সেটাও আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, ‘হে মো’মেনগণ! তোমরা যদি (সত্যদীন প্রতিষ্ঠার) অভিযানে বের না হও তবে আল্লাহ তোমাদেরকে কঠিন শাস্তি দিয়ে তোমাদের উপরে অন্য জাতি চাপিয়ে দেবেন (সুরা তওবা ৩৯)’। কিন্তু আল্লাহর রসুল বিদায় নেয়ার ৬০/৭০ বছর পরই তারা এ দায়িত্ব ত্যাগ করেছিল। যার পরিণামে আল্লাহর পক্ষ থেকে ভয়াবহ শাস্তি হিসাবে মুসলিমরা ইউরোপীয়দের গোলামে পরিণত হয়েছিল। এ সময়ে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ ভূখণ্ড ছিল মুসলিম দাবিদার মোঘল রাজতন্ত্রের দ্বারা শাসিত ভারত উপমহাদেশ। যদিও এখানকার জীবনব্যবস্থা প্রকৃত ইসলাম ছিল না, তবে ইসলামের বহু বিধান প্রতিষ্ঠিত ছিল। ধর্মই শান্তির একমাত্র উৎস এ কথাটি ভারতবর্ষের মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে জেনে এসেছে, দেখে এসেছে। অতি প্রাচীনকালে বৈদিক যুগে ভারতে সনাতন শাস্ত্রের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল যা মানুষকে পরম শান্তিতে জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা দান করেছিল। এভাবেই এতদঞ্চলের মানুষের চিন্তা-চেতনায়, সংস্কৃতিতে, তাদের রক্তের কণিকায় ধর্ম এতটাই প্রভাব বিস্তার করে আছে যে, তাদের প্রতিটি সিদ্ধান্তের সঙ্গে ধর্মীয় মূল্যবোধ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে; সুতরাং ইউরোপের ঐ ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত জীবনব্যবস্থা এখানে অচল। তবু যেহেতু ইংরেজরা তখন প্রভু, তারা চাইল প্রভুর ধর্মই হবে দাসের ধর্ম। এ লক্ষ্যে তারা আধুনিক শিক্ষার নামে এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা এখানে চালু করল যার মাধ্যমে তারা এ জাতির মধ্যেও ধর্মবিদ্বেষের প্রসার ঘটাতে চাইল। তারা তাদের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি দ্বারা এ জাতির মননে গেড়ে দিতে চাইল যে, ধর্ম হচ্ছে মিথ্যা, কূপমণ্ডূকতা, অন্ধকার, পশ্চাৎপদতা, বর্বরতা, সকল প্রকার উন্নতি-প্রগতির অন্তরায়, মুক্তচিন্তার প্রতিবন্ধক। স্বভাবতই তাদের এই ধ্যানধারণা ধীরে ধীরে মানুষের মনের উপর প্রভাব সৃষ্টি করল। তারা বুঝল সভ্য, আধুনিক, বিশ্বমানের মানুষ হতে হলে ধর্মকে বিসর্জন দিতে হবে, নিদেনপক্ষে খ্রিষ্টান হতে হবে। ঔপনিবেশিকদের এই শিক্ষাব্যবস্থার দ্বারা তারা এদেশে একটি ধর্মবিদ্বেষী বস্তুবাদী মানসিকতাসম্পন্ন শ্রেণি তৈরি করতে সক্ষম হল। ইউরোপীয় জাতিগুলো নিজেরা নিজেদের মধ্যে দু দুটি বিশ্বযুদ্ধ করে নিজেদের যথেষ্ট শক্তিক্ষয় করে ফেলল এবং বিপর্যস্ত হলো। ফলে নিজেদের পুনর্গঠন করে এই বিশাল বিশাল উপনিবেশগুলো আর ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। তাছাড়া উপনিবেশগুলোর ভেতর থেকেও স্বাধীনতার জন্য চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা এ উপনিবেশগুলো থেকে আর উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পদ আহরণ বাদ ছিল না। যেটুকু বাদ ছিল সেটুকুও পরবর্তীতে যেন শোষণ করা যায় সে পথ উন্মুক্ত রাখার জন্য তারা যখন নিজ নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করল তখন এই জাতির সরকার বানিয়ে দিয়ে গেল তাদের প্রদত্ত ‘আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ’ শিক্ষায় শিক্ষিত সেই দাস মনোবৃত্তির অথচ উন্নাসিক শ্রেণিটি থেকে বাছাইকৃত,পরীক্ষিত সবচেয়ে বংশবদ ব্যক্তিবর্গকে। আজ আমাদের বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, আমলাশ্রেণিসহ রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রকদের একটা বড় অংশই মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও আদতে ধর্মবিদ্বেষী। ধর্ম তাদের অধিকাংশের কাছেই অপ্রয়োজনীয় বিধায় পরিত্যাজ্য, কারো নিছক সামাজিকতার অবলম্বন, অনেকের কাছে ঘৃণ্য। কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও সেটা তাদের একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ।

No comments:

Post a Comment