Thursday, November 26, 2015

ভিক্ষা দাও – কাজী নজরুল ইসলাম

ভিক্ষা দাও। ওগো পুরবাসী ভিক্ষা দাও। তোমাদের একটি সোনার ছেলে ভিক্ষা দাও।
আমাদের এমন একটি ছেলে দাও, যে বলবে আমি ঘরের নই, আমি পরের। আমি আমার নই, আমি দেশের।
ওগো তোমরা চেয়ে দেখ সর্বনাশা আমাদের বুকের উপর চেপে বসে আছে। কোটি কোটি লোক দু মুঠো ভাতের জন্য হা হা করে ছুটেছে। ওগো ঐ দেখ কোটি কোটি ভাই আধপেটা খেয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। তোমাদের বুকে হাত দিয়ে দেখ সেখানে আর প্রাণ নাই, তোমাদের হৃদয়ে অনুভব করে দেখ সেখানে আর বল নাই। ওগো বলি চাই। বলি চাই। তোমাদের একটি ছেলে বলি চাই।
ওগো সংসারী। কোথা যাও। তুমি কি সুখ পেয়েছো? পদে পদে অভাব আর অধীনতায় আহত হয়ে তুমি এক মুহুর্তের জন্যও শান্তি পেয়েছো? ওগো! তুমি ত শান্তি পাবে না। তুমি তো যুদ্ধে তোমার ছেলে দাও নাই। ওগো, ভিক্ষা দাও, একটি সোনার ছেলে ভিক্ষা দাও। ওগো পূজারী, কোথায় অর্ঘ্য দিতে চলেছ? বুকে বুকে দেবতার তপ্ত শ্বাস হু হু করে বয়ে যায়-তুমি কার ডালি নিয়ে যাও। ও কী নিয়ে যাচ্ছ তুমি! ফুল আর পাতায় তোমার দেবতা কি তুষ্ট হবেন? বুকে তার তীব্র জালা, চোখে তার হিংস্র বহ্নি। ওগো সে তো ফুল পাতা চায় না, সে চায় কাঁচা তাজা প্রাণ। ওগো বলি দাও-বলি দাও।
ওরে তরুণের দল! একবার ফিরে দাঁড়াও।
কোথা যাও তোমরা অন্ধের মত, কোথায় চলেছ তোমরা? ঐ যেন চাষীর শত শত রক্ত প্রাণহীণ দেহ পড়ে আছে তাদের দলিত করে কোন উন্নতির দিকে ছুটে চলেছ? তোমার বুকের ভিতর যে দেবতা গুমরে গুমরে কেঁদে উঠেছে তার কন্ঠরোধ করে কোন মায়াবীপুুরের দিকে চলেছ? কান পেতে শোন কাদের কান্নার ধ্বনি আকাশে পাতালে ধ্বনিত হচ্ছে। তোমরা কি তোমাদের অলস বাঁশী দূর করে দেবে না? চোখ মেলে দেখ, সব গেল। সব গেল। তিল তিল করে সব যে শেষ হয়ে গেল। ওগো তরুণের দল, তোমাদের ভিতর কি এমন লক্ষীছাড়া কেউ নেই-যে বলে, আমি তিল তিল করে মরি বাঁচব না। আমি ঘরের মায়ায় ভুলব না, ঘর আমার স্থান নয়, ঐ কাঁটাবন আমার ঘর, দুঃখ দারিদ্র্য আমার সম্পত্তি, মৃত্যু আমার পুরস্কার। তোমাদের মধ্যে কি এমন কেউ নাই-যে এই ভীষণ আঁধারে নিজের বুকের আগুন জেলে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়? তোমাদের মধ্যে কি এমন কেউ নেই-যে বলতে পারে আমি আছি, সব মরে গেলেও আমি বেঁচে আছি; যতক্ষণ আমার প্রাণে ক্ষীণ রক্তধারা বয়ে যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তা দেশের জন্য পাত করব। ওগো তরুণ ভিক্ষা দাও, তোমার কাঁচা প্রাণ ভিক্ষা দাও।
ওরে তরুণের দল! একবার বুকে হাত দিয়ে বল দেখি একবারও কি এ নাগপাশ ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হয় নি? একবারও কি এই জগদ্দল পাথর ঠেলে ফেলতে ইচ্ছে হয় নি? ওরে ওঠ, ওরে তোরা ওঠ, দূর করে দে জড়তা, ছিঁড়ে ফেলে দে বন্ধন। হৃদয় থেকে কোমলতা দূর করে দে। শয়তানের হিংসা নিয়ে শত্র“র পানে একবার ছুটে চল। বিশ্বের গরল এনে প্রাণ ঢেলে দে। তোরা বিশ্বময় বিষ ছড়িয়ে দে, সুখের সংসার পুড়ে ছাই হয়ে যাক। অত্যাচার! অত্যাচার! ঐ দেখ অত্যাচার তার ভীষণ মূর্তি ধরে বসেছে। ধনী তার ধন নিয়ে, বলবান তার লাঠি নিয়ে, কাজী আর পণ্ডিত তার শাস্ত্র দিয়ে মানুষকে হত্যা করবার কি ভীষণ চেষ্টা করছে। ঐ শোন তাদের তাণ্ডব চীৎকার। ঐ দেখ কি বিকট মূর্তি।
কে আছ বীর, তার টুঁটি ধরে মারতে পারো। কে আছ দুঃসাহসী, তার সহস্র ফণা দিয়ে খেলতে পারো। কে আছ নাস্তিক, কে আছ হিংসুক, কে আছ বিদ্রোহী, এসো! কে আছ তরুণ, কে আছ পাগল ভিক্ষা দাও, তোমার মাতাল প্রাণটি ভিক্ষা দাও।

No comments:

Post a Comment