এক চরম অনিশ্চয়তার দিকে বিশ্বপরিস্থিতি; করণীয় নির্ধারণ করতে হবে এখনই
বিশ্বপরিস্থিতি ক্রমেই অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বহু বছর পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে øায়ুযুদ্ধ বিরাজমান ছিল তা নতুনরূপে আবির্ভূত হয়েছে। রাশিয়ার ক্রিমিয়া অন্তর্ভুক্তি থেকে শুরু করে সিরিয়ায় রাশিয়ার আইএসবিরোধী বিমান অভিযান নিয়ে পারস্পরিক দোষারোপ ও সন্দেহে দুই পক্ষের উত্তেজনার পারদ ক্রমেই বেড়েছে। সেই উত্তেজনায় ঘি ঢেলে দিয়েছে সম্প্রতি ন্যাটোর অন্তর্ভূক্ত দেশ তুরস্কের গুলিতে রুশ যুদ্ধবিমান ভূপতিত হওয়ার ঘটনা।
ঘটনাটি এমন এক সময় ঘটলো যখন সিরিয়ায় রাশিয়া আইএসসহ আসাদবিরোধী সব পক্ষের উপর তুমুল বোমাবর্ষণ করে চলেছে এবং জঙ্গিদের দমনে পশ্চিমা দেশগুলোর আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। অবশ্য এই প্রশ্ন কেবল রাশিয়া একাই তুলেছে তা নয়। বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে যারা লক্ষ রাখেন, তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করেন তাদের অনেকেই আইএস দমনে পশ্চিমারা কতটা আন্তরিক এ ব্যাপারে সন্দিহান। তবে রাশিয়ার অবস্থানের ভিন্ন তাৎপর্য রয়েছে, কেননা তারা সেখানে উপস্থিত থেকে সামরিক ভূমিকা রাখছে। আর আইএসের বিরুদ্ধে রাশিয়ার হামলা যখন কার্যকারিতা পাচ্ছে, সিরিয়ার বাশার সরকার তো বটেই ইরানেরও সমর্থন তারা পাচ্ছে তা নিঃসন্দেহে রাশিয়াকে বিশ্বরাজনীতিতে তার হারিয়ে ফেলা অবস্থানের দিকে আরেকধাপ এগিয়ে নিয়েছে। ক্রিমিয়া অন্তর্ভুক্তির পর রাশিয়ার এই সাফল্য পশ্চিমাদের স্বাভাবিকভাবেই দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
সিরিয়ায় রুশ বিমান হামলার মূল টার্গেট আইএস নাকি আসাদবিরোধী বিদ্রোহীগোষ্ঠী, এই প্রশ্নে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা চলে আসছে শুরু থেকেই। পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে অবস্থানকে উপেক্ষা করে রাশিয়া এতদিন হামলা চালিয়ে গেছে। কিন্তু তুরস্কের গুলিতে রুশ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাটি তারা উপেক্ষা করে যেতে পারে না। দেশটির তীব্র প্রতিক্রিয়া সেই বার্তাই দেয়। তুরস্ক বলছে বিমানটি তাদের আকাশসীমায় প্রবেশ করেছিল এবং অন্তত ১০ বার এ ব্যাপারে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তাদের গুলিতে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে সিরিয়ার ভূ-খণ্ডে। অর্থাৎ বিমানটি যদি বাস্তবেই তাদের আকাশসীমায় ঢুকে থাকে তবে আর কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলেই তা সিরিয়ায় ফিরে যেত। কিন্তু তারা ততটুকু অপেক্ষা করেনি বা করতে চায়নি। অন্যদিকে রাশিয়ার কর্তৃপক্ষ শুরু থেকে আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ ও সতর্কবার্তার দাবি প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। অন্যদিকে স্বয়ং তুর্কি প্রেসিডেন্ট তাইয়েপ এরদোগান জানিয়েছেন, এই সামান্য আকাশসীমা লঙ্ঘন হামলা করার মতো কারণ নয়। তিনি বলেন, ‘সংক্ষিপ্ত পরিসরের সীমান্ত লঙ্ঘনের কারণে হামলা করা বাস্তবসম্মত নয়। তুর্কি-সিরিয়া সীমান্তে সামরিক মহড়াই উদ্বেগের কারণ।’
ঘটনাটি কেবল পরস্পর দোষারোপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। তা ইতোমধ্যে একটি যুদ্ধের রূপ পেতে চলেছে। রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভাদিমির পুতিন এ ঘটনাকে ‘পিঠে ছুরি মারা’ অভিহিত করে এর চরম পরিণতির হুমকি দিয়েছেন। ইতোমধ্যে তুরস্কের সঙ্গে সব ধরনের সামরিক সহযোগিতা স্থগিত করেছে রাশিয়া। দেশটিতে রুশ পর্যটকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এই ঘটনার পরপর সিরিয়ার উপকূলে একটি ক্ষেপণাস্ত্রবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে রাশিয়া। মস্কো পরিষ্কার ভাষায় হুশিয়ার করেছে, সম্ভাব্য হুমকি বলে যেসব লক্ষ্যবস্তুকে গণ্য করা হবে তা ধ্বংস করে দেওয়া হবে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিরিয়ার হেমিমিম বিমান ঘাটিতে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ মোতায়েন করার ঘোষণা দিয়েছেন যা দিয়ে ৪০০ কি.মি. দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার পাশাপাশি বিমান হামলা এবং ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে সক্ষম তারা। অন্যদিকে তুরস্কও বসে নেই। ঘটনার পরপরই দেশটি ন্যাটোর সদস্যদের জরুরি বৈঠকের অনুরোধ করে। সে অনুরোধ রেখে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো বৈঠকে মিলিতও হয়েছে এবং বৈঠকশেষে তারা যে কোনো পরিস্থিতিতে তুরস্কের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সামরিক উপস্থিতিকে নতুন করে বলার কোনো প্রয়োজনই নেই।
দুই দাঙ্গাবাজ পক্ষ মধ্যপ্রাচ্যে তাদের আধিপত্যকে কেন্দ্র করে স্পষ্টতই দ্রুত একটি বৃহৎ যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের সারথী হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের মধ্যে বিভেদে লিপ্ত মুসলিম দেশগুলো। আর এই যুদ্ধ যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের রূপ নেবে এটা হলফ করে বলে দেওয়া যায়। বিশ্বশক্তিগুলোর শক্তিপ্রদর্শনের মহড়া অনন্তকাল স্থায়ী হতে পারে না, তা একটি পরিণতি পাবেই। কেবল প্রশ্নটা হতে পারে, সেটা কবে? তুরস্কের গুলিতে রুশ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা কি এত বড় একটি যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট? এর জবাবে অনেকেই বলবেন, না এখনই এমন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে, তুরস্কের এই গুলি করার ঘটনা রাশিয়াকে বৃহৎ শক্তিগুলোর সাথে যুদ্ধে জড়ানোর একটি পরিকল্পিত উস্কানি অর্থাৎ টোপ। মুখে পশ্চিমারা যতই বলুক, তারা যুদ্ধের বিপক্ষে, তারা যুদ্ধ চায় না, পৃথিবীবাসী এটা ভাল করেই জানে তারা দাঙ্গাবাজ, যুদ্ধপ্রেমী একটি জাতি। তাদের অস্ত্রব্যবসাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য হোক আর পৃথিবীতে আধিপত্যকে কায়েম রাখার জন্য হোক, এখানে তারা যুদ্ধ লাগিয়েই রাখবে। সুতরাং আজ হোক কাল হোক কেউ না কেউ প্রতিপক্ষের এমন টোপ গিলতে বা উস্কানিতে পা দিতে বাধ্য হবেই। অনন্তকাল একপক্ষ আরেকপক্ষে বুকে বন্দুক নিশানা করে দাঁড়িয়ে থেকে খিস্তি-খেওর পেরে যাবে না। একদিন কেউ না কেউ ট্রিগারটা চাপবেই। আর পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে সেই সময়টা খুব বেশি দেরি নেই।
কথা হচ্ছে, যখন ট্রিগারে চাপ পড়বে তখন বিশ্বের পরিস্থিতি কি হবে? পৃথিবীর সাতশো কোটি মানুষের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক এখানেই। উভয়পক্ষের নিকটই পারমাণবিক বোমা রয়েছে যা দিয়ে কেবল একটি দেশ নয়, কয়েকটি সম্মিলিত আঘাতে পুরো পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেওয়া যায়। পরিস্থিতি যেভাবে ঘোলাটে হচ্ছে তাতে এটা যেমন স্পষ্ট যে বৃহৎ একটি যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে, তেমনিভাবে এটাও স্পষ্ট যে সেই যুদ্ধে কোনো পক্ষই সেই ভয়ানক বিধ্বংসী বোমার ব্যবহার এড়াতে পারবে না। পাশাপাশি রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্রের ব্যবহার পুরো মানবজাতিকে একটি ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। এটা কারো মনপ্রসূত বক্তব্য নয়। এমন পরিস্থিতি শীঘ্রই এগিয়ে আসছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে বহু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা অনেক লেখালেখি করছেন। তারা আশঙ্ক প্রকাশ করছেন, পৃথিবীর মানুষ, আকাশ, বায়ুমণ্ডল, মাটি, পানি, বন, পশুপাখি কেউ সেই ভয়াবহ যুদ্ধের বিভীষিকা এড়াতে পারবে না। মানবজাতিকে এক চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে নিচ্ছে দাঙ্গাবাজরা যা সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষদের আতঙ্কিত করে তুলেছে।
কথা হচ্ছে, এখন আমাদের কি করণীয়? প্রতিবেশির ঘরে যখন আগুন লাগে তা নিভাতে না গেলে সেই আগুন নিজের ঘরকেও ভস্ম করে দেয়। পৃথিবীর কোনো দেশই এখন দূরে নয়। প্রযুক্তির উন্নতি সবদেশকে একে অপরের প্রতিবেশি বানিয়ে দিয়েছে। সুতরাং বিনাশের আরম্ভ যখন হবে আমরাও তার পরিণতি এড়াতে পারবো না। বিশ্বপরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও আমাদের নেই। কেবল একটা পথ খোলা আছে নিজেদেরকে সেই বিনাশের বাইরে রাখার। তা হলো ঐক্য, পুরো জাতির ইস্পাতকঠিন ঐক্য। এই ঐক্যই কেবল পারে আমাদের তেমন বিপদ সংকুল পরিস্থিতিতে অস্তিত্বহীন হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে। রাজনৈতিক দলাদলি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, আদর্শিক মতভেদ, স্বার্থের টানাটানি ইত্যাদি ভুলে আমরা যদি একে অপরকে আলিঙ্গন করি, জড়িয়ে রাখি, নিশ্চয় তা আমাদের জন্য এক বিরাট শক্তি হবে। এই ঐক্যই পারে আমাদের মাথার উপর ছায়া হতে। কোনো অশুভ শক্তিই বাংলার আকাশে উঁকি দিতে পারবে না যদি আমরা তেমন ঐক্যবদ্ধ হই। কিন্তু আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব ধেয়ে আসা সংকটকে উপলব্ধি করতে পারছেন কিনা সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। তারা যদি বাস্তবতা উপলব্ধি করতে না পারেন, তবে তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক। আর যদি বাস্তবতা তারা উপলব্ধি করে থাকেন, তবে অবশ্যই নিজের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে হলেও জাতিকে রক্ষা করা চেষ্টা করবেন বলে আমরা আশা করি।
No comments:
Post a Comment