Thursday, November 26, 2015

সৃষ্টির কল্যাণই ধর্ম

সৃষ্টির কল্যাণই ধর্ম


রাকীব আল হাসান:
প্রাণীগণের অভ্যুদয়, ক্লেশনিবারণ ও পরিত্রাণের নিমিত্তই ধর্ম্মের সৃষ্টি হইয়াছে; অতএব যাহা দ্বারা প্রজাগণ অভ্যুদয়শালী, ক্লেশবিহীন ও পরিত্রাণ প্রাপ্ত হয়, তাহাই যথার্থ ধর্ম্ম। (কালি প্রসন্ন সিংহ অনুদিত মহাভারত ২য় খণ্ড: শান্তিপর্ব, নবাধিকশততম অধ্যায়- পৃষ্ঠা: ৬৪৪)।
মহাভারতের এই সত্যবাণী থেকে বোঝা যায় যে, ধর্মের মূল উদ্দেশ্যই হলো মানুষের কল্যাণ, সৃষ্টির কল্যাণ, জগতের কল্যাণ। যা দ্বারা মানুষের কল্যাণ হয়, সমাজের কল্যাণ হয়, সৃষ্টির কল্যাণ হয় তা-ই ধর্ম আর অকল্যাণকর সবই অধর্ম। সত্য প্রতিষ্ঠিত হলে শুধু মানুষ নয় প্রতিটি প্রাণী, প্রতিটি উদ্ভিদ নিরাপদ থাকবে। কারণ ছাড়া একটি গাছের পাতাও কেউ ছিড়বে না।
আরেকটু বিস্তারিতভাবে বললে ধর্ম ও ধারণ একই শব্দ থেকে এসেছে। যে গুণ বা বৈশিষ্ট ধারণ করে কোনো বস্তু তার স্বকীয়তা, নিজস্বতা পায় তাকেই ঐ বস্তুর ধর্ম বলে। যেমন একটি লৌহদণ্ড আকর্ষণ করার গুণ ধারণ করে চুম্বকে পরিণত হয়। এই আকর্ষণ করার গুণটিই হলো ঐ চুম্বকের ধর্ম। যদি কোনো কারণে চুম্বক তার ধর্ম তথা আকর্ষণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তবে সেটি পুনরায় লৌহে পরিণত হয়, সেটি আর চুম্বক থাকে না। একটি লৌহকে চুম্বকে পরিণত করতে হলে নিরন্তর তাকে চুম্বক দিয়ে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় ঘর্ষণ করতে হয়, এটি চুম্বকের ধর্ম প্রাপ্ত করার প্রক্রিয়া। আবার পরিপূর্ণ চুম্বকও যদি আগুনে পোড়ানো যায় তবে সে তার ধর্ম হারিয়ে সাধারণ পদার্থে পরিণত হয়।
পানির ধর্ম হলো সে নিজে পবিত্র এবং সমস্ত কিছুকে ধৌত করে পবিত্র করে দেয়, তৃষ্ণার্তের তৃষ্ণা দূর করে নতুন জীবন দান করে। কিন্তু পানি যদি অপবিত্র, বিষাক্ত হয়ে যায় তবে সে অন্যকে না পবিত্র করতে পারে, না কারো তৃষ্ণা দূর করতে পারে। পানিকে পবিত্র করার জন্য, বিষমুক্ত করার জন্য আগুনে ফুটাতে হয়। এটিই পানির প্রকৃত ধর্ম প্রাপ্ত করার প্রক্রিয়া। ধর্মহীন তথা বিষাক্ত, অপবিত্র পানি মানুষের জীবনের কারণ না হয়ে মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
মানুষও একটি সাধারণ প্রাণী হিসাবে জন্মগ্রহণ করে আস্তে আস্তে মনুষ্য ধর্ম প্রাপ্ত হয়ে মানুষের স্তরে ওঠে। এই মনুষ্য ধর্ম হলো মানবতা। এক পিতার মধ্যে সন্তানের প্রতি যে ভালোবাসা থাকে তা পিতৃধর্ম, ছেলে-মেয়ের প্রতি মায়ের মমতা হলো মাতৃধর্ম, ভায়ের প্রতি ভায়ের যে প্রেম তা ভ্রাতৃধর্ম। আর মানুষের প্রতি মানুষের যে প্রেম, ভালোবাসা, মায়া, মমতা সেটি হলো মনুষ্যধর্ম। যার মধ্যে অন্য মানুষের প্রতি যত বেশি ভালোবাসা সে তত বড় ধার্মিক। সন্তান কষ্টে থাকলে মা-বাবার মনেও সুখ থাকে না, সন্তানের কষ্ট দূর করার জন্য সে আপ্রাণ চেষ্টা করে। বাবা-মা হিসাবে এটা তাদের কর্তব্য। মানুষ কষ্টে থাকলে অপর মানুষও কষ্টে থাকবে, অপরের কষ্ট দূর করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে- এটা মানুষ হিসাবে তার কর্তব্য, এটাই তার এবাদত। এই এবাদতের জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষের প্রতি ভালোবাসাই স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা। সন্তানকে কষ্ট দিয়ে কি কখনো তার বাবা-মায়ের ভালোবাসা পাওয়া যায়? ঠিক একইভাবে স্রষ্টার প্রিয় সৃষ্টি মানুষকে কষ্টে রেখে স্রষ্টার সন্তুষ্টি পাওয়া সম্ভব নয়।
প্রতিটা মানুষের মধ্যে যদি ধর্মের এই বোধ জাগ্রত হয় তবে সমাজ এমনিতেই শান্তিময় হয়ে উঠবে। ধর্মবিশ্বাস একটা বিরাট শক্তি, এই শক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হলে মানুষের মধ্যে এই সত্য বোধগুলো জাগ্রহ করতে হবে, ধর্মকে শুধুমাত্র উপাসনা, আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বন্দী করা যাবে না। মূলত সকল উপাসনার উদ্দেশ্যও মানুষের মধ্যে মনুষ্যধর্মটাকে জাগিয়ে তোলা। কিন্তু আজ সবকিছুর উদ্দেশ্য পাল্টে গেছে। দিনরাত উপাসনায় মগ্ন থেকেও যদি কারো মধ্যে মনুষ্য ধর্ম জাগ্রহ না হয়, অকল্যাণকর কাজ থেকে সে বিরত না হয়, মানুষের কষ্ট দূর করার জন্য নিজের জীবন-সম্পদ ব্যয় করার মনোবৃত্তি সৃষ্টি না হয় তবে সকল উপসনাই ব্যর্থ। সব ধর্মই এখন মানবকল্যাণের পরিবর্তে কিছু ধর্মব্যবসায়ীর স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন ধর্মকে ঐ সকল ধর্মব্যবসায়ীদের হাত থেকে উদ্ধার করে সমাজের কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। তবে ধর্মের মাধ্যমে সমাজকে শান্তিময় করা সম্ভব হবে।

No comments:

Post a Comment