Saturday, November 28, 2015

জঙ্গিবাদ ষড়যন্ত্রে আটকে যাচ্ছে বাংলাদেশ

জঙ্গিবাদ ষড়যন্ত্রে আটকে যাচ্ছে বাংলাদেশ



আতাহার হোসাইন:
——————
একের পর এক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটছে বাংলাদেশে। সরকারের তরফ থেকে সেগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে আখ্যায়িত করা হলেও এসব ঘটনার পেছনে ধর্মীয় উগ্রতার একটা যোগসূত্র পাওয়া যাচ্ছে। প্রথমত নাস্তিক ব্লগার হত্যা দিয়ে শুরু। তালিকা প্রকাশ করে কিছুদিন পর পর নৃশংসভাবে চাপাতি দিয়ে এলোপাতারিভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাদের অনেককে। অন্যদিকে হত্যার তালিকায় নাম যুক্ত হয়ে আছে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের। বাদ যায়নি প্রকাশকরাও। এর আগে একই দিনে ঢাকার দুটো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়। প্রথম হামলায় আক্রান্তরা বেঁচে গেলেও দ্বিতীয় হামলায় জাগৃতি প্রকাশনের প্রকাশককে বাঁচানো যায়নি। শুধু ব্লগার বা প্রকাশকই নন, হামলার শিকার হয়ে প্রাণ দিয়েছেন খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। ঢাকা ও রংপুরে দুজন বিদেশি নাগরিক খুনের সাথেও জঙ্গিবাদীদের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলেও আলোচনায় এসেছে। উগ্রবাদীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে ধর্মীয় ভিন্নমতাবলম্বী শিয়া সম্প্রদায়ও। আশুরার আগের দিন মধ্যরাতে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় প্রায় হাজার দুয়েক মানুষের উপস্থিতিতে চালানো হয় বোমা হামলা। এতে অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয় ও দু’জন মারা যায়। এর পর রংপুরে এক মুয়াজ্জিনকে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বগুড়ায় শিয়া মসজিদে নামাজ পড়া অবস্থায় মসজিদে ঢুকে মুসুল্লীদের উপর গুলি বর্ষণ করা হয়েছে। এতে মোয়াজ্জেম নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন এবং আরো তিনজন আহত হয়েছেন। এছাড়া ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপর হামলা ও চিঠি দিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
বলা বাহুল্য এসব হত্যাকাণ্ডের পরপরই দায় স্বীকার করে আসছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএস। সরকার তাদের দায় স্বীকারকে অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশে আইএস নেই এবং এগুলো স্থানীয় সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম বলে দাবি করে আসলেও খোদ আইএসের প্রকাশনা ‘দাবিক’ এর মাধ্যমে সেগুলোকে তাদের নিজেদের কাজ বলে সত্যায়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম বিস্তারে প্রকাশ করা হয়েছে পরিকল্পনার কথাও। সরকারের দাবি মোতাবেক দাবিকের এই দাবি মিথ্যা হয়ে থাকলেও এটা প্রমাণিত সত্য যে বাংলাদেশ নিয়ে আইএসের নজর রয়েছে। উপর্যুপরী সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলে নিষিদ্ধ ঘোষিত এদেশীয় জঙ্গিরা আইএসের কার্যক্রমের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে তাদেরকে এদেশে ডেকে আনার বন্দোবস্ত করছে। অন্যদিকে এমনও হতে পারে যে স্বার্থান্বেষী কিছু গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র প্রমাণ করতে। সবকিছু মিলিয়ে একথা পরিষ্কার যে বাংলাদেশকে জঙ্গিরাষ্ট্র বানাতে বিরাট এক ষড়যন্ত্র চলছে।
এই ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় সরকার যে ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে তা মোটেই যথোপযুক্ত নয়। ঘটনা ঘটার পর পরিস্থিতি মোকাবেলা কিংবা পরিকল্পনা নস্যাৎ করতেই ব্যস্ত থাকছে প্রশাসন। কিন্তু কেন এই জঙ্গিবাদের উত্থান, কারা তাদেরকে রিক্রুট করে, কিভাবে তাদেরকে মোকাবেলা করা যায় সে ব্যাপারে উপযুক্ত পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। জঙ্গিবাদ বর্তমানে পুরো বিশ্বজুড়েই এক ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এই আদর্শে যারা উদ্বুদ্ধ হচ্ছে তারা ক্ষয়-ক্ষতি কিংবা প্রাণের মায়া করে না। কত মানুষ নিহত হবে তাও তারা চিন্তা করে না। তাদেরকে ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা দ্বারা জান-প্রাণ উৎসর্গ করার জন্য উপযোগী করে তোলা হয়েছে। তাদেরকে মৃত্যুর পর সুনিশ্চিত জান্নাতের প্রতিশ্র“তি দান করা হচ্ছে। মানুষ মেরে, সন্ত্রাস সৃষ্টি করে যে স্রষ্টার ভালোবাসা পাওয়া যায় না বরং মানুষের উন্নতি ও কল্যাণেই যে স্রষ্টার ভালোবাসা নিহিত তা তাদেরকে শেখানো হচ্ছে না। আর এসব শেখাবেই কারা? আমাদের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যখন দেশ প্রেম নয়- রোজগারের জন্য সরকারের চাকুরি করেন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা যখন পেশিশক্তি খাটিয়ে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন, প্রতিপক্ষকে নির্মূল করে নিজেরা বিজয়ী হন, আমলারা যখন ঘুষ ছাড়া কাজ করেন না, শিক্ষকরা যখন শিক্ষাবাণিজ্য করেন, বুদ্ধিজীবীরা যখন চাটুকারীতায় লিপ্ত হন, গণমাধ্যমকর্মীরা যখন মিথ্যার চর্চা করেন তখন বিক্ষুব্ধ মানুষতো মরিয়া পথ ধরতেই পারে।
সুতরাং আজকে যারা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের দিকে ঝুকে পড়ছে, ষড়যন্ত্রকারীদের শিকারে পরিণত হচ্ছে কিংবা মনে মনে সমর্থন করছে তাদেরকে এই পথ থেকে ফেরাতে হলে দরকার সুন্দর ও সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত আদর্শ। জঙ্গিবাদের এই বিকৃত আদর্শকে শুধু শক্তি প্রয়োগ করে নির্মূল করা যাবে না। সেটা যদি করা সম্ভব হত তবে মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রের সমান শক্তি নিশ্চয় পৃথিবীতে অন্য কোন দেশের নেই। খোদ তারাসহ তাদের মিত্র দেশগুলোর জোটই যেখানে জঙ্গিদের নির্মূল করতে হিমশিম খাচ্ছে, নিজেরা প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হচ্ছে, আক্রান্ত হচ্ছে সেখানে আমাদের মত ছোট ও তুলনামূলক কম শক্তির অধিকারী দেশ যে ব্যর্থ হবে সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়। তাই আমাদেরকে এর বিকল্প পথ ভাবতে হবে। আমাদেরকে জঙ্গি উত্থানের পথ রোধ করতে হবে। কোরআন-হাদিসের বিকৃত ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে প্রকৃত ব্যাখ্যা তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। কোরআন-হাদিস দিয়েই প্রমাণ করতে হবে যে জঙ্গিবাদকে কোন ধর্মই স্বীকৃতি দেয় না। যারা বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে মানবজাতিকে এই ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা তাদের ইহকালের পাশাপাশি পরকালকেও বিনষ্ট করছে। এই সত্যগুলো তুলে ধরার জন্য গণমাধ্যম ও দেশের প্রকৃত আলেমদেরকে কাজে লাগাতে হবে। ব্যাপক প্রচারণা বাড়িয়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময় বিশিষ্টজনের মত প্রকাশ করেছেন। চ্যানেল আই ‘তৃতীয় মাত্রায়’ গত ১৯ শে অক্টোবর সাবেক বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল (অবঃ) আ ল ম ফজলুর রহমান বলেছেন, ‘আমাদের জঙ্গিকে মোকাবেলা করতে হলে অনেক পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে। জঙ্গিদের মোকাবেলা কোরআন-হাদিস দিয়ে করতে হবে, সেকুলারিজম দিয়ে এটা কে মোকাবেলা সম্ভব নয়’। একই সাথে ধর্মকে উৎখাত করতে যে সব প্রচারণা চালানো হচ্ছে, আল্লাহ-রসুলদেরকে গালাগালি করা হচ্ছে তাও আমাদেরকে সমাধান দেবেনা। বরং এসব কার্যক্রম আমাদেরকে আরো খারাপ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে। একই সাথে জেহাদের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে যারা এ পথে মানুষদেরকে উদ্বুদ্ধ করছে তাদেরকেও রোধ করতে হবে। অনলাইন কার্যক্রম ও প্রচারণা বন্ধ করার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
শুধুমাত্র শক্তি দিয়ে জঙ্গিদেরকে স্তিমিত করে রাখা যাবে কিন্তু একেবারে নির্মূল করা যাবে না এ কথা নিরাপত্তা রক্ষকরাও স্বীকার করেছেন। কিন্তু দিন দিন পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটছে তাতে কিছুদিন পর গতিপ্রকৃতি কোন দিকে যায় তা পূর্বানুমান করা দুঃসাধ্য। কেননা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি দ্রুতই টালমাটাল পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর তার সাথে আমাদের দেশের পরিস্থিতিও যে নির্ভর করে তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। তাই জঙ্গিবাদের হুমকি ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় আমাদের যা করণীয় তা অতি দ্রুততার সাথে করতে হবে। নতুবা সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়ে পরিণত হতে পারে।

No comments:

Post a Comment