Monday, November 30, 2015

আধুনিক প্রগতিবাদী ও মুক্তমনাদের প্রতি

আধুনিক প্রগতিবাদী ও মুক্তমনাদের প্রতি


মোহাম্মদ আসাদ আলী  :
সম্প্রতি বাংলাদেশে ‘ব্লগার-প্রকাশক হত্যাকাণ্ড’ ও ‘বিদেশি হত্যাকাণ্ড’ সংঘটিত হবার পেছনে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠার পর দেশের প্রখ্যাত গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, সুশীল শ্রেণি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তারা কেউ এ ধরনের ঘটনাকে নেয়ায়েত বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়েই দিচ্ছেন। কেউ ‘জঙ্গি আছে জঙ্গি নেই’ এই বিতর্কের পালে হাওয়া দিচ্ছেন। আবার একটি বিশাল শ্রেণী এই ইস্যুতে এতটাই ভীত-সন্ত্রস্ত ও আশাহত হয়ে পড়েছেন যে, তারা পারেন তো আজই দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান। তারা কথায় কথায় ‘এই দেশ আমার দেশ না’ টাইপের বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে কার্যত জাতির এই দুর্যোগকালীন মুহূর্তে নিজেদের দায়বদ্ধতাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছেন। যেন এই অবস্থা সৃষ্টির পেছনে তাদের কোনো দায় নেই, এখান থেকে জাতির মুক্তি নিশ্চিত করার চেষ্টা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তাদের মধ্যে কেউ সম্পূর্ণ দোষ চাপাচ্ছে সরকারের উপর, কেউ জঙ্গিদের উপর, কেউবা খোদ ধর্মের উপরেই। অতঃপর এমন একটা ভাবাবেগ সৃষ্টি করছেন যে, বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে তারা বড্ড ভুল করে ফেলেছেন, এখানকার নাগরিকত্ব বড়ই লজ্জার। এই দেশ তাদের দেশ নয়। এখানে ফ্রি-থিংকিং বাধাগ্রস্ত। বিজ্ঞানবাদিতা বাধাগ্রস্ত। গোঁয়ার বাঙালি জাতি পশ্চিমা ধর্মহীনতা ও বিজ্ঞানবাদিতার মাহাত্ম বুঝল না। তাই তারা আশাহত। জাতির চিন্তা ছেড়ে তারা এখন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়েই চিন্তিত, শঙ্কিত।
যারা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন বলে হীনম্মন্যতায় ভুগছেন, এই দেশের আচার-প্রথা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ধ্যান-ধারণা ও ধর্মবিশ্বাস যাদের মনপুত নয়, তাদের আরও আগেই এ দেশ ছাড়ার কথা ছিল। তারা কোন স্বার্থে এতদিন এখানে পড়ে ছিলেন সেটাই চিন্তার বিষয়। একবার ভাবুন তো, আপনার পিতা-মাতা যতই ভয়ংকর রোগাক্রান্ত হোক, আপনি কখনই বলতে পারবেন কি যে, এই পিতা-মাতা আমার পিতা-মাতা নয়? প্রিয় মাতৃভূমি আজ ভয়ানক রোগাক্রান্ত। উপসর্গ দেখেই বোঝা যায় রোগের ভয়াবহতা কেমন হতে পারে। এ সময় আমাদের আরও বেশি সচেতনতা প্রয়োজন। মনে সাহস যোগানো প্রয়োজন। যে কেনো বিপর্যয় থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য আÍত্যাগ করা প্রয়োজন। বড় ধরনের কোরবানি করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ‘এই দেশ আমার দেশ না’- এই টাইপের বক্তব্যের মধ্যে তার চিহ্নমাত্রও নেই। আছে হতাশা-ভীরুতা, আছে আত্মসমর্পণের অলিখিত আবেদন। এ ধরনের বক্তব্য জাতিকে বিন্দুমাত্র লাভবান করবে না, বরং যে অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ হয়তো জাতির কল্যাণে এগিয়ে আসতো তারাও সাহস হারিয়ে ফেলবেন।
এই দেশ কি একদিনে এমন হয়েছে? কখনই না, একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এগোতে এগোতে আজ এই বিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে। আপনারাই দেশকে এখানে নিয়ে এসেছেন। বরাবরই জাতির প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করতে ভুল করেছেন। প্যারাসিটামল সেবন করে রোগের কিছু উপসর্গের চিকিৎসা করা সম্ভব, রোগ নির্মূল সম্ভব নয়। তার জন্য রোগকে সনাক্ত করতে হয়, রোগের মূল জায়গায় আঘাত করতে হয়। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-কালচার ও বিশ্বাসকে মূল্য না দিয়ে পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতিকে আমদানি করার নির্লজ্জ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন আপনারাই। একটি বারও ভেবে দেখেন নি যে, এটা পশ্চিম নয়, এখানকার মানুষ পশ্চিমা জীবনাচারের জন্য উপযুক্ত নয়। পশ্চিমারা আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তা রাতারাতি ঘটে নি, সেটা একটি দীর্ঘ সংগ্রাম, সংঘর্ষ ও রক্তপাতের ফল। তাও যদি সেই ফলাফল শান্তিদায়ক হতো তাহলে কথা ছিল না। অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নতিই মানবজীবনের সার্বিক উন্নতি নয়। মানুষের আত্মা আছে। মানবিক সত্ত্বাকে বিসর্জন দিয়ে পশ্চিমারা আজ যেভাবে দৈহিক ভোগ-বিলাসিতা ও শরীরিনির্ভর জীবনাচারে মত্ত হয়েছে তা দেখে শুনেও তাদেরকে অনুসরণ করার কোনো অর্থ থাকতে পারে না। কিন্তু আপনারা সেটা বোঝেন নি। আপনারা এই জাতিকে গণতন্ত্র গিলিয়েছেন, ধর্মনিরপেক্ষতা গিলিয়েছেন, কিন্তু এ দেশের মানুষ সেগুলো আদৌ হজম করতে পারল কি পারল না তার খোঁজ রাখেন নি। আজ আবার চেষ্টা করছেন বদহজমের শিকার এই জাতির পেটে বিজ্ঞানবাদিতার নামে নাস্তিকতা, সমকামিতা ও লিভ টুগেদারের মতো ভয়ংকর বিষ ঢুকিয়ে দিতে। কীভাবে ভাবলেন যে, এত কিছুর পরও কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে না? সেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখে ‘এই দেশ আমার না’ বলেন কোন যুক্তিতে?
আমাদের দেশের বিজ্ঞানবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতার কর্ণধার বলে যারা সদা পরিচিত, সেই ব্লগারদের মধ্যে অনেকেই ইউরোপের ভিসা পেয়ে দেশ ছেড়েছেন। শোনা গেছে এতে তাদের কোনো দুঃখ নেই, বরং এক প্রকার উচ্ছ্বাস আছে। তারা নাকি নিরাপদ জীবন ও সভ্যতার সংস্পর্ষ পেয়েছেন। দেশে থাকতে তাদের কপালে যে চিন্তার ভাজ পড়েছিল তা এখন নেই। কেন থাকবে? তাদের চিন্তা তো দেশকে নিয়ে ছিল না, ছিল নিজেকে নিয়ে। এই দেশ কি তাদের দেশ?
যতদূর জানা যায় অন্যরাও দেশ ছাড়ার অপেক্ষায় আছে। জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের কারণেই হোক বা অবদমিত কোনো লালসা চরিতার্থ করতেই হোক তারাও কথিত অসভ্য-বর্বরদের এই দেশ ছেড়ে সভ্য দেশে যেতে চায়। তাই এখন প্রশ্ন উঠছে, ইউরোপের অ্যাসাইলাম পাওয়াই তাদের লেখালেখির মূল উদ্দেশ্য ছিল কিনা? তাদের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলে এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে তবে আপাতত সে প্রশ্ন আমি করছি না। ধরে নিলাম তারা মানুষের কল্যাণে, এই জাতির কল্যাণে, এই পশ্চাদপদ দেশকে ধর্মীয় অন্ধত্ব ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে প্রগতিশীল ও উন্নত দেশ গঠনের লক্ষ্যেই আদর্শিক আন্দোলন করছিলেন, লেখালেখি করছিলেন, মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব কাঁধে তুলেছিলেন। তাদের সেই আদর্শ কতটুকু নির্ভূল ছিল সে প্রশ্নও এখন থাক, মূল কথা- একটা প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসের বিপক্ষে সম্পূর্ণ বিপরীত আরেকটি আদর্শ নিয়ে তারা দাঁড়িয়েছিলেন।
প্রশ্ন হলো তারা কি এ পথকে পুষ্পসজ্জিত জ্ঞান করেছিলেন? এই দেশের মানুষের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা, আবেগ-অনুভূতি তাদের জানা ছিল না? তারা জানতেন না যে, একদিন না একদিন এই সংঘর্ষ বাঁধবেই? তারা দাঁড়িয়েছেন ধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মহীনতা নিয়ে, বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদ বা বিজ্ঞানবাদ নিয়ে, আধ্যাত্মিকতার বিরুদ্ধে বস্তুবাদ নিয়ে, ঐতিহ্য-পরম্পরার বিরুদ্ধে প্রথাবিরোধিতা নিয়ে, এক কথায় মৌমাছির মৌচাকে ঢিল ছোঁড়ার মতো সমাজের মূল মূল উপাদানে তারা আঘাত করেছেন, অথচ ভেবেই নিয়েছেন যে, তার প্রতিঘাত তাদের সহ্য করতে হবে না। তারা কি এতটাই অর্বাচীন যে, বিজ্ঞানের উপর দু-একটা বই লিখে কিংবা ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মীয় মাহামানবদের গালাগালি করে কয়েকটা ব্লগপোস্ট করেই ধরে নিলেন সমাজে বিপ্লব হয়ে যাবে? এই নবীন ‘কিবোর্ড বিপ্লবী’রা না হয় ইউটোপিয়ায় বিচরণ করছিলেন বলে পরিণতি টের পান নি, কিন্তু যে প্রবীণরা তাদেরকে পৃষ্ঠাপোষকতা দান করলেন তারা কী ভক্ষণ করে ছিলেন?
ব্যক্তিগতভাবে আপনি নাস্তিক হতেই পারেন, কিন্তু আপনার অবিশ্বাসকে সমগ্র সমাজের উপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। ওই প্রচেষ্টা কম হয় নি, কিন্তু শেষাবধি ফলাফল কী হয়েছে? জঙ্গিবাদের উত্থান হলো, ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে মানুষের ধর্মবিশ্বাসের অপব্যবহার করার ‘হাতিয়ার’ এলো, সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি হলো। নিরাপত্তার অভাবে উল্টো এখন আপনারাই দেশ ছাড়ছেন। অর্থাৎ যা হলো তাকে ‘হিতে বিপরীত’ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। আপনাদের মেধা আছে, মননশীলতা আছে, আমরা মনে করি জাতির কল্যাণে আত্মত্যাগ করার সদিচ্ছাও আপনাদের আছে, কিন্তু সেই সদিচ্ছার অপব্যবহার হচ্ছে বলে তা জাতির কোনো কল্যাণ বয়ে আনছে না।
যারা প্রকৃতপক্ষেই মুক্তমনা ও বিজ্ঞানমনস্ক তাদেরকে বুঝতে হবে যে, ধর্ম বা ধর্মবিশ্বাস তাদের প্রতিদ্বন্দ্বি নয়। যুগে যুগে ধর্ম কীভাবে বড় বড় সভ্যতার জন্ম দিয়েছে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের সাধনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প সাধনায় বাধা এসেছে মূলত ধর্মান্ধ ও ধর্মব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে। জ্ঞান-বিজ্ঞান মানুষের অন্তর্দৃষ্টি খুলে দেয়, সমাজকে আলোকিত করে, অন্যদিকে ধর্মব্যবসায়ীরা সমাজকে অন্ধকারে রেখে নিজেদের আখের গোছাতে চায়। এখানেই ধর্মান্ধতা ও ধর্মব্যবসার সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞানের লাগালাগি। এই লাগালাগি অতীতেও ছিল আজও আছে। আমাদেরকে লড়াই করতে হবে তাই ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে। মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে সঠিক পথে প্রবাহিত করে তাদেরকে ধর্মব্যবসায়ীদের পেছন থেকে সরাতে পারলেই বিজ্ঞানের জয় হবে, সমাজ আলোকিত হবে।
যে কারণেই হোক, যার কৃতকর্মের পরিণতিতেই হোক, আজ আমাদের দেশ এক ভয়াবহ মৃত্যুখাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন দেশে যা চলছে তা কারও ব্যক্তিগত বা দলীয় সঙ্কট নয়। জাতীয় সঙ্কট। এই জাতীয় সঙ্কট নিরসনে সমগ্র জাতিকেই ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা হেযবুত তওহীদ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। সকল প্রকার ধর্মব্যবসা, অপরাজনীতি ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যের আহ্বান এ দেশের মানুষের মধ্যে প্রভূত সাড়া ফেলেছে। সকল ধর্ম-বর্ণ-দল-মতের মানুষ আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। আমরা আশা করব যারা প্রকৃতপক্ষেই বিজ্ঞান ও প্রগতিকে উদ্ভাসিত করার লক্ষ্যে কাজ করছেন, যারা প্রকৃতপক্ষেই বিজ্ঞানমনস্ক মুক্তমনা আসন্ন সঙ্কট মোকাবেলায় তারাও আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবেন। ধর্মভীরু মানুষকে ধর্মান্ধতার ঘোর কাটিয়ে প্রকৃত ধার্মিক হতে হবে, ধর্মব্যবসার উৎখাত করতে হবে। ইনশা’আল্লাহ ধর্মব্যবসা, অপরাজনীতি, জঙ্গিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের পরাজয় হবে, জাতি সত্যিকার অর্থেই উন্নতি ও প্রগতির মার্গ লাভ করবে। ধর্ম, মানবতা, বিজ্ঞান ও প্রগতির সম্মিলিত শক্তি দিয়ে নির্মিত হবে ঐক্যবদ্ধ সোনার বাংলাদেশ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।

No comments:

Post a Comment