Monday, November 30, 2015

আক্রান্ত মুসলিম বিশ্ব, ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

আক্রান্ত মুসলিম বিশ্ব, ঝুঁকিতে বাংলাদেশ






মোহাম্মদ আসাদ আলী:  ঠিক যে মুহূর্তে আমাদের দেশে ‘ঈদুল আযহা’ উপলক্ষে আনন্দ-উল্লাসের জোয়ার বইছে, সেই মুহূর্তেই আন্তর্জাতিক গতিপ্রকৃতি ঘোষণা করছে এমন এক করুণ বাস্তবতা, যা সমস্ত পৃথিবীর মুসলিম নামধারী জাতিটির ভবিষ্যৎকে ভয়াবহ অন্ধকারে নিপতিত করেছে। মহামারীর মতো একের পর এক মুসলিম দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে জঙ্গিবাদ, যার পেছনে পেছনে রক্তলোলুপ সাম্রাজ্যবাদ তার ডালপালা বিস্তৃত করে রেখেছে। এই অশুভ শক্তির অপঘাতে আজ ক্ষত-বিক্ষত ইরাক, মিশর, উত্তর আফ্রিকা, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া ও তুরস্কের মতো মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রগুলো। জঙ্গিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের শিকার হয়ে এসব দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে ঈদের আনন্দ। যেখানে জীবন বাঁচানোই দুরূহ, চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় লাশের স্তুপ, আকাশ থেকে পড়ে বোমাবৃষ্টি, প্রতিটি মুহূর্ত যেখানে এক একটি আতঙ্কের নাম, সেখানে ঈদ কোনো আনন্দের বার্তা বয়ে আনবে না, বরং যে কোনো প্রকারের আনন্দ-উচ্ছ্বাসই সেখানে বিলাসিতা হিসেবে পরিগণিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। ইরাক-সিরিয়ার মাটি থেকে উদ্বাস্তু হওয়া লক্ষ লক্ষ মুসলমানের ঈদ কাটছে শরণার্থী শিবিরের নোংরা পরিবেশে, উত্তাল সমুদ্রের বুকে, অথবা খুব ভালো হলে ইউরোপের ফুটপাত-রাস্তাঘাটে। মুসলিম দুনিয়ায় এতবড় মানবিক বিপর্যয় ইতিহাসে দেখা যায় নি।
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম মুসলিম প্রধান দেশ। এখানেও জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি রয়েছে। এ আশঙ্কা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ব্যক্ত করেছেন। এসএসএফ- এর ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন যে, ‘বিশ্বে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কৌশল পরিবর্তন হচ্ছে দিন দিন। নানা ধরনের সংঘাত বাড়ছে। বাংলাদেশকে আমরা এই সংঘাত থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছি। বিষয়টি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।’ গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও বলছেন, গত দুই বছরে ইরাক, সিরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জঙ্গি তৎপরতার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনদের নানা কার্যক্রমে এ দেশেও জঙ্গি তৎপরতায় অনেকে উৎসাহিত হচ্ছে। (প্রথম আলো অনলাইন, ২৮.০৭.২০১৫)। চলতি মাসের ১৬ তারিখে বিবিসি সংবাদে প্রকাশ, ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এদেশে জঙ্গিবাদ দমনে ব্রিটিশ সরকারকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
আক্রান্ত মুসলিম বিশ্ব, ভয়াবহ ভবিষ্যতের হাতছানি:
কেউ স্বীকার করুক আর না করুক, এটা প্রমাণিত সত্য যে, বর্তমান পৃথিবীতে এক নম্বর ইস্যু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে জঙ্গিবাদ। কিছুদিন পূর্বেও পৃথিবীব্যাপী মিডিয়াগুলোর আলোচ্য বিষয় ছিল তালেবান ও আল কায়েদা, সে স্থান এখন পুরোপুরি ‘আইএস’ এর দখলে। আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাসের নিয়ন্ত্রণ, জমজমাট অস্ত্রব্যবসা এবং ক্ষমতা প্রদর্শনের সাম্রাজ্যবাদী পটভূমিতে হঠাৎ প্রবেশ করে রাতারাতি সারা পৃথিবীর আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে সংগঠনটি। অবশ্য বর্তমানে অনেকেই তাদেরকে সংগঠন বলতে রাজি নয়। কারণ এখন তাদের ভূখণ্ড আছে, অস্ত্র আছে, অর্থ আছে, এমনকি অল্প দিনেই তারা একটি রাষ্ট্রকাঠামোও গড়ে তুলেছে। এই ‘আইএস’ই এখন মুসলিম বিশ্বের ভয়ানক চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকলেই বুঝতে সক্ষম হচ্ছেন। ওদিকে নিউনেশিয়া, সোমালিয়া, নাইজেরিয়া, মরোক্ক, মিশর ইত্যাদি দেশগুলোতে কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম ও পশ্চিমাদের সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র ও শাষক শ্রেণির দমন-পীড়ন সব মিলিয়ে এক বিভিষীকাময় পরিস্থিতি চলছে। মধ্যপ্রাচ্যে যে অশান্তি ও রক্তপাত এখন অনেকাংশে সিরিয়া-ইরাকের ভূমিতেই সীমাবদ্ধ আছে, তা ছড়িয়ে পড়তে পারে সমগ্র মুসলিম দুনিয়ায়। যদি তা হয় তবে ইরাক-সিরিয়ার মতো ভাগ্য বরণ করতে হবে অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোকেও। এ আশঙ্কা এখন অনেক বিশ্লেষকই করছেন।
‘আইএস’ যে কারণে অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়তে পারে:
ক. ‘আইএস’ এর মূল শক্তি ইসলামের জেহাদী চেতনা। এই চেতনাকে কাজে লাগিয়ে তারা এতদূর এসেছে। ইসলামের নাম ব্যবহার করে সমগ্র বিশ্বের জেহাদী চেতনাধারী মানুষের কাছে আইএস ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করেছে। আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা সব জায়গা থেকে জেহাদীরা ইরাক-সিরিয়ার পানে ছুটছে। বর্তমানে ‘আইএস’ এর হয়ে লড়াই করছে প্রায় ৫০ হাজার যোদ্ধা, যাদের মধ্যে প্রায় ২৫ হাজারই বিদেশি। এই বিদেশি যোদ্ধার সংখ্যা দিন দিন হু হু করে বাড়ছে।
খ. মুসলিম দুনিয়ায় পবিত্র কোর’আনের পরেই যে গ্রন্থ অবশ্যই মান্য বলে বিবেচিত হয় তা হাদিস। সেই হাদিস দেখে দেখে, শেষ যামানা সম্পর্কে রসুলের ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে ‘আইএস’ যোদ্ধারা নিজেদের কর্মকাণ্ডকে এমনভাবে মিলিয়ে মিলিয়ে পদক্ষেপ ফেলছে যাতে মুসলিমমাত্রই বিভ্রান্ত হবে। তারা তাদের খলিফার নামটি পর্যন্ত মনোনীত করেছে হাদিস মিলিয়ে। ফল হয়েছে যে, সারা বিশ্বের ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ ‘আইএস’কেই প্রকৃত মুসলিম বলে মনে করছে এবং, পৃথিবীব্যাপী ইসলাম ও মুসলিমদের দুর্দিনে ‘আইএস’কে তাদের পরিত্রাণদাতা বলে জ্ঞান করছে। এ বিশ্বাস ধারণ করে অনেকেই জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে, যা সংগঠনটির ক্রমাগত শক্তিবৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
গ. পরিসংখ্যান বলছে- অতীতে কোনো জঙ্গি বা সন্ত্রাসীগোষ্ঠী এতটা অর্থের মালিক হতে পারে নি, যতটা অর্থ-সম্পদ এখন পর্যন্ত আইএস এর হাতে এসেছে। সংগঠনটির দুই বিলিয়ন ডলার অর্থসম্পদ আছে। ইরাক-সিরিয়ার বিশাল তেলসমৃদ্ধ অঞ্চল তাদের নিয়ন্ত্রণে। এত অর্থনৈতিক সাপোর্ট এর আগে কোনো জঙ্গি সংগঠন লাভ করে নি। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী, জেহাদী চেতনায় উজ্জীবিত, ইসলামের নামে পরিচালিত এমন একটি ভূখণ্ড সারা পৃথিবীর জেহাদী চেতনাধারী মুসলমানকে আকৃষ্ট করবে- এতে অবাক হবার কিছু নেই।
ঘ. আইএস যে কল্পিত নিয়ন্ত্রণরেখা প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, তাদের লক্ষ্য তারা নির্দিষ্ট করেছে মুসলিম দেশগুলোর দিকে। পাশ্চাত্য দেশগুলো সম্পর্কে আল কায়েদা বা তালেবানের মতো হিংসাত্মক বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে পশ্চিমাদের খেপিয়ে তোলার ইচ্ছা ‘আইএস’ এর এখনও নেই। সম্ভবত তারা অতীতের ইরাক-আফগান প্রেক্ষাপট থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেই এবারের কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে। আর এটাও ঠিক যে, ‘আইএস’ যে হারে শক্তি সঞ্চয় করছে, তা যদি আর কয়েক বছর অব্যাহত থাকে তবে তাদের উত্থান ঠেকানোর সক্ষমতা আরব-অনারব নির্বিশেষে কোনো মুসলিম দেশেরই থাকবে না। মুসলিম দেশগুলো যদি ‘আইএস’কে প্রতিরোধ করতে চায় তাহলে সামরিক শক্তির পাশাপাশি এসব দেশের সরকারের পক্ষে জনসমর্থনের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো- এসব মুসলিমপ্রধান অধিকাংশ দেশের সরকারেরই জনসমর্থন নেই, তারা কোনো রকমে অস্ত্রবলে, শক্তিবলে ক্ষমতা ধরে রেখেছে। অর্থাৎ যে কোনো বহিঃশত্র“র আক্রমণ প্রতিহত করতে চাইলে এই সরকারগুলোর পক্ষে জনগণের সহায়তা পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। এমতাবস্থায়, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার আগেই ‘আইএস’ এর মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিতে পারে একমাত্র পশ্চিমা শক্তিই। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে কতটা আগ্রহী তাতে সংশয়ের অবকাশ আছে। কারণ এখন পর্যন্ত যে চিত্র আমরা দেখে এসেছি তার উপর নির্ভর করে বলা যায়, আইএস থেকে পশ্চিমাদের কোনো ক্ষতি তো নেই-ই, বরং উপকার হয়েছে, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। আইএস যতই শক্তি-সামর্থ্য অর্জন করবে, নতুন নতুন ভূ-খণ্ড দখল করবে ততই যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর অস্ত্রব্যবসা জমজমাট হবে। ইতোমধ্যেই ‘আইএস’ এর ভয় দেখিয়ে আরব দেশগুলোতে অস্ত্রবিক্রির রমরমা ব্যবসা শুরু হয়েছে। সুতরাং ‘আইএস’ আমেরিকার শত্র“ বটে, তবে প্রয়োজনীয় শত্র“ (টংবভঁষ ঊহবসু)। আল কায়েদা বা তালেবান যতদিন সেই প্রয়োজনীয় শত্র“র ভূমিকা পালন করে এসেছে ততদিন ‘আইএস’ এর দরকার ছিল না, তাই আইএস সৃষ্টি হয় নি, এখন তালেবান-আল কায়েদা ছিবড়ে হয়ে গেছে, দরকার নতুন শত্র“, নতুন আতঙ্ক, তাই আইএস সৃষ্টি হলো। ‘আইএস’কে যারা নিজেরাই গর্ত থেকে টেনে বার করল, তারা শতভাগ সুবিধা আদায় না করেই কোন কারণে তাকে প্রতিরোধে নামবে?
সুতরাং পশ্চিমারা আইএস এর অগ্রযাত্রায় কার্যত কোনো বাধাই সৃষ্টি করবে না। অপরদিকে মুসলিম দেশগুলো আর কিছুদিন গেলে শত ইচ্ছা থাকলেও এই দৈত্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। অর্থাৎ পরিণতি অনুমানযোগ্য, অচীরেই হয়তো সাম্রাজ্যবাদ তথা স্বার্থবাদের লীলাভূমি সিরিয়া-ইরাকের রক্তরঞ্জিত মাটি থেকে উদ্গত এই বিষবৃক্ষের বিষফল ভোগ করতে হবে মুসলিমপ্রধান অন্যান্য দেশগুলোকে।
প্রেক্ষিত বাংলাদেশ:
আইএস যোদ্ধারা এখন কার্যত সারা বিশ্বের জঙ্গি ও জঙ্গিসমর্থকদের আদর্শিক ‘হিরো’তে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি ‘আইএস’ মহানবীর ভবিষ্যদ্বাণীকৃত হাদিস (যদিও অনেক হাদিসের বিশুদ্ধতা নিয়ে খোদ হাদিসবেত্তাদেরই প্রচুর মতভেদ রয়েছে, হাদীসের নামে বহু দয়ীফ, জাল বা ভুয়া হাদিস প্রচলিত আছে) মিলিয়ে মিলিয়ে ইসলামী খেলাফতের নামে এমন একটি কৃত্রিম কাঠামো দাঁড় করিয়ে ফেলছে যে, ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের মধ্যে একটি বড় অংশ মনে করছে ‘আইএস’ এর মাধ্যমেই বিশ্বে শান্তি আসবে, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে এবং পাশ্চাত্যের দুঃশাসন থেকে মানুষ চূড়ান্তভাবে মুক্তিলাভ করবে। ইতোমধ্যেই হাজার হাজার যুবক এই ধ্যানধারণা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে কথিত জেহাদ করছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষ ছুটছে ইরাক-সিরিয়ার পথে, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
১৫ কোটি মুসলমানের মাতৃভূমি হিসেবে বাংলাদেশও সমান ঝুঁকিতে রয়েছে, যা নির্মম সত্য। এ দেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। তারা আল্লাহ, আল্লাহর রসুল ও ইসলামকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। ‘জেহাদী তামান্না’ বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও আছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। অতীতে এ দেশে জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের নজিরও আছে। ব্যাপক প্রশাসনিক তৎপরতার মুখে জঙ্গিদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে বটে, তবে নির্মূল করা সম্ভব হয় নি এবং সম্ভব নয়ও যে কথা কিছুদিন পূর্বেই এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন। এখন আইএস এর এই উত্থানপর্ব থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এ দেশের জঙ্গিবাদীরাও যে নতুনভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে না তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না, বরং সে সম্ভাবনাই বেশি। এমনিতেই বিভিন্ন সময়ে উন্মাদনা সৃষ্টি করে কথিত জেহাদী তামান্না সৃষ্টি করা হয় বাংলাদেশে যা বার বার আমরা দেখেছি। ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার ঘটনা এ দেশে অহরহ ঘটে। এছাড়াও রয়েছে মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত অর্থোপার্জনের দৃষ্টান্ত। এক কথায় আমাদের দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের ঈমানকে হাইজ্যাক করে থাকে এক শ্রেণির স্বার্থবাদী। তার উপর এই জঙ্গিবাদের অশুভ ছায়া। ধর্মের বিবিধ অপব্যবহারের এই সংস্কৃতি এবং আন্তর্জাতিক গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এ কথা বলায় দোষের কিছু থাকে না যে, বাংলাদেশও এই সঙ্কটে পড়তে পারে বা পড়ার আশঙ্কার বাহিরে নয়।
এই আশঙ্কা থাকত না যদি আমরা অন্তত ১৬ কোটি মানুষ সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ থাকতাম। একজন সত্যনিষ্ঠ নেতার কথা মান্য করতাম। একটা আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হতাম, কিন্তু তা তো নয়। আমাদের দেশের ১৬ কোটি মানুষ আজ নানা দল-মত-পথে বিভক্ত। যখন-তখন যে কোনো ইস্যু নিয়ে শুরু হয় দাঙ্গা-হাঙ্গামা, রক্তপাত। একদল আরেকদলকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য এক পায়ে খাড়া। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য বৈদেশিক পরাশক্তিদের আহ্বান করা হয়ে থাকে। এমন পরিস্থিতি দেশের জন্য খুবই বিপজ্জনক।
আমাদের করণীয় কী?
এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় বুঝতে হলে কীভাবে সিরিয়া বা ইরাকের মতো সমৃদ্ধিশালী দেশগুলো ধ্বংস হলো সেটা পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। যেদিন প্রথম সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটে, কেউ কি ভেবেছিল তার পরিণতি এতদূর গড়াতে পারে? সিরিয়ানরা কি ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছিল অচীরেই তাদের জীবন-স¤পদ নিয়ে পরাশক্তিগুলো নোংরা খেলায় মেতে উঠবে? বস্তুত তারা ছিল নির্বিকার। সরকারবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রথমে জাতির মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি হলো, এখানে ওখানে বিচ্ছিন্ন কিছু সংঘর্ষ হলো, সরকার দমন-পীড়ন চালাতে থাকল, আন্দোলনকারীরা ক্রমেই সহিংসতার পথে ধাবিত হলো, আর দেশের প্রায় প্রধান যে জনসংখ্যাটি তারা এসব কিছুকে অবলীলায় এড়িয়ে যেতে থাকল। তারা খবর পড়েছে, প্রাত্যহিক আহত-নিহতের পরিসংখ্যান দেখেছে, কিন্তু দেশের অতবড় বিপর্যয়কর মুহূর্তে নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হয় নি, জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার হতে দেখেও সে দেশের সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, শিক্ষক, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও আপামর জনগণ মুখ বুঁজে বসে ছিল। হয়তো ভেবেছিল, এতে তাদের দায় নেই, সরকার ও সরকারবিরোধীদের বিবাদ তারাই মীমাংসা করুক। কিন্তু, তাদের সেই নি¯পৃহতা ও নির্লিপ্ততার পরিণতি তারা শেষাবধি এড়াতে পারল না। আজ যারা যুদ্ধবিধ্বস্ত মাতৃভূমি সিরিয়া ছেড়ে অচেনা-অজানা দেশগুলোতে আশ্রয়ের আশায় ছুটে চলছে তারা কারা? তারা কি কেবলই নিুবিত্ত শ্রেণি? না, শুধু নিুবিত্তরাই নয়, প্রাণ বাচাতে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে এককালের বাঘা বাঘা শিল্পপতিরাও। রয়েছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চাকরিজীবী, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক সকলেই। আজ তারা এক কাতারে এসে দাড়িয়েছেন। তাদের এক নামে ডাকা হচ্ছে। এক বিশেষণে বিশেষায়িত করা হচ্ছে, সেটা হলো রিফিউজি, তাদের কোথাও জায়গা নেই। অথচ এই মানুষগুলোই যদি কয়েক বছর পূর্বে যাবতীয় অন্যায়, অপশাসন, জঙ্গিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক কাতারে দাঁড়াতে পারত, আজকের সিরিয়াকে এমন দুর্ভাগ্য বরণ করতে হতো না।
বাংলাদেশকেও যদি আমরা তেমন পরিণতি ভোগ করা থেকে ফেরাতে চাই, তবে একমাত্র উপায় ধর্ম-বর্ণ-দল-মত নির্বিশেষে ১৬ কোটি বাঙালির ঐক্যবদ্ধ হওয়া। এ ক্ষেত্রে আমাদের ১৬ কোটি মানুষের ধর্মবিশ্বাসই বর্ম হয়ে যাবতীয় অপশক্তির কবল থেকে জাতিকে রক্ষা করতে পারে। আন্তর্জাতিক এই ক্রান্তিকালে সমস্ত মুসলিম দুনিয়া যখন আক্রান্ত হয়ে পড়েছে বা আক্রান্ত হবার পথে, চরম ঝুঁকির মুখে রয়েছে মাতৃভূমি বাংলাদেশ, তখন ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

No comments:

Post a Comment