Thursday, November 26, 2015

ধর্ম কি কাঁচের ঠুনকো গ্লাস যে, এক্টুতেই ভেঙ্গে যাবে???

ধর্ম কি কাঁচের ঠুনকো গ্লাস যে, এক্টুতেই ভেঙ্গে যাবে??? -কাজী নজরুল ইসলাম


হ্যাঁ, ধর্ম সম্বন্ধে আমার আর একটু বলবার আছে। আমি তো পূর্বেই বলেছি যে, সব ধর্মেরই ভিত্তি চিরন্তন সত্যের উপর- যে সত্য সৃষ্টির আদিতে ছিল, এখনো রয়েছে, অনন্তেও থাকবে। এই সত্যটাকে যখন মানি, তখন আমাকে যে ধর্মে ইচ্ছা ফেলতে পারিস। আমি হিন্দু, আমি মুসলমান, আমি খ্রীস্টান, আমি বৌদ্ধ, আমি ব্রাহ্ম।
আমি তো কোনো ধর্মের বাইরের (সাময়িক সত্যরূপ) খোলসটাকে ধরে নেই। গোঁড়া ধার্মিকদের ভুল তো ঐখানেই। ধর্মের আদত সত্যটা না ধরে এরা ধরে আছেন যতসব নৈমিত্তিক বিধি-বিধান। এরা নিজের ধর্মের উপর এমনি অন্ধ অনুরক্ত যে, কেউ এতটুকু নাড়াচাড়া করতে গেলেও ফোঁস করে ছোবল মারতে ছুটেন। কিন্তু একটু বোঝেন না তারা যে, তাদের ‘ঈমান’ বা বিশ্বাস, তাদের ধর্ম কত ছোট কত নীচ কত হীন যে, তা একটা সামান্য লোকের এতটুকু আঁচড়ের ঘা সইতে পারে না।
ধর্ম কি কাঁচের ঠুনকো গ্লাস যে, এক্টুতেই ভেঙ্গে যাবে? ধর্ম যে বর্মেরই মতন সহ্যশীল, কিন্তু এসব বিড়াল তপস্বীদের কাণ্ড দেখে তো তা কিছুতেই মনে করতে পারিনে। তাদের বিশ্বাস তো ঐ এতটুকু বা সত্যের জোরও অমনি ক্ষুদ্র যে, তার সত্যাসত্য নিরূপনের জন্যে তোমায় আলাদা পথে যেতে দেওয়া তো দূরের কথা, তা নিয়ে একটা প্রশ্নও করতে দিবেন না।
… এইসব কারণেই ভাই, আমি এইরকম ভণ্ড আস্তিকদের চেয়ে নাস্তিকদের বেশি ভক্ত, বেশি পক্ষপাতী। তারা সত্যকে পায়নি বলে সোজা সেটা স্বীকার করে ফেলে বলে বেচারাদের হয়েছে ঘাট। অথচ তারা এই সত্যের স্বরূপ বুঝতে, এই সত্যকে চিনতে এবং সত্যকে পেতে দিবা-রাত্তির প্রাণপণ চেষ্টা করছে- এই তো সাধনা- এইতো পূজা, এই তো আরতি। এই জ্ঞান-পুষ্পের নৈবেদ্য চন্দন দিয়ে এরা পূজা করবে আর করছে, তবু দেবতাকে অন্তরে পায়নি বলে মুক্তকণ্ঠে আবার স্বীকারও করছে যে, কই দেবতা? কাকে পূজা করছি? আহা! কি সুন্দর সরল সহজ সত্য! এদের ওপর ভক্তিতে আপনিই যে মাথা নুয়ে পড়ে। এরা যাই হোক, এরা তো মিথ্যুক নয়, এরা বিবেকের বিরুদ্ধে কথা বলে না- এরা যে সত্যবাদী। অতএব এরা সত্যকে পাবেই পাবে; আজ না হয় কাল পাবে।
আর এই বেচারারা অন্ধ বিশ্বাসীর দল? বেচারারা কিছু না পেয়েই পাওয়ার ভাণ করে চোখ বুজে বসে আছে। অথচ এদের শুধোও, দেখবে দিব্যি নাকি-কান্না কেঁদে লোক-দেখানো ভক্তি-গদগদ কণ্ঠে বলবে, -“আঁহাঁ হাঁ! -মঁরিঁ মঁরিঁ! ঐঁ ঐঁ ঐঁ দেঁখঁ তিঁনিঁ!” মিথ্যার কি জঘন্য অভিনয় ধর্মের নামে- সত্যের নামে! ঘৃণায় আপনিই আমার নাক কুঁচকে আসে। তাই তো আমি বলি যে, এই পথ-হারানোটা পথ খুঁজে পাওয়ারই রূপান্তর। তবে যা কিছু বুঝবার ভুল। গুরুদেব সত্যি-সত্যিই গেয়েছেন,-
“ভাগ্যে আমি পথ হারালেম পথের মধ্যখানে!”
(নজরুলের বিখ্যাত পত্রোপন্যাস বাঁধন-হারাতে রাবেয়ার উদ্দেশে লেখা চিঠির অংশবিশেষ)

No comments:

Post a Comment