Monday, November 30, 2015

বাঙালীর ব্যবসাদারী

বাঙালীর ব্যবসাদারী -কাজী নজরুল ইসলাম



“বাণিজ্যে বসতে লক্ষ¥ী” কথাটা যেমন দিনের মত সত্য, “বাণিজ্যে বসতে মিথ্যা” কথাটা তেমনি রাতের মতন অন্ধকার। শিল্প-বাণিজ্যের উন্নতি না করিতে পারিলে জাতির পতন যেমন অবশ্যম্ভাবী, সত্যের উপর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত না করিলে বাণিজ্যের পতনও আবার তেমনি অবশ্যম্ভাবী। মদকে মদ বলিয়া খাওয়ানো তত দোষের নয়, যত দোষ হয় মদকে দুধ বলিয়া খাওয়ানোতে। দুধের সঙ্গে জল মিশাইয়া বিক্রী করিলে লাভ হয় যত, প্রবঞ্চনা করার পাপটা হয় তার চেয়ে অনেক বেশী। একটা জাতি ব্যবসা-বাণিজ্য দ্বারা যত বড় হয় হউক, কিন্তু প্রবঞ্চনা বা মিথ্যার বিনিময়ে যেন তাহার জাতীয় বিশ্বস্ততা আর সুনাম বিক্রী করিয়া সে ছোট না হইয়া বসে। ভন্ড লক্ষপতি অপেক্ষা দরিদ্র তপস্বী ঢের ভালো। হাঁ, এখন কথা হইতেছে-বাণিজ্য দ্বারা আমরা স্বজাতির নাম করিব, স্বদেশের মুখ উজ্জ্বল করিব, না-অন্য বড় জাতির নাম দিয়া নিজের নাম ভাঁড়াইয়া বড় হইয়া সেই বড় জাতিরই তেলা মাথায় তেল ঢালিব? কথাটা খোলাসা করিয়া বলি।
আমাদের বাঙালীদের হিন্দু-মুসলমান অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে বেশ একটু ঝোঁক দিয়াছেন, সে খুব মঙ্গলের কথা। তবে ইহার মধ্যে অমঙ্গলের কথা হইতেছে এই যে, ইহাদের অনেকেই নিজের বা স্ব-জাতির নাম ভাঁড়াইয়া ইংরাজি নামে নিজের নূতন নামকরণ করিতেছেন! কি সুন্দর মৌলিকতা! যিনি অতটা না করেন, তিনি আবার নিজের পৈতৃক নামটাকে বিপুল গবেষণার সহিত বহু কসরৎ করিবার পর এমন একটি অস্বাভাবিক অশ্বডিম্বে পরিণত করিয়া বসেন, যাহা আমাদের পূর্বে বা পরপুরুষের কোন ব্যক্তিই বুঝিতে পারিবেন না, ইনি কিনি! এই রূপে কৃষ্ণকে ক্রিষ্টো রূপে বাজারে বসাইয়া কতকটা সুবিধা হয় জানি না, কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, ইহাতে অসুবিধাটাই হয় বেশী। শুনিয়াছি, এই রকম কালা চামড়ায় সাদা পালিশ বুলাইনে নাকি দুই একজন শ্বেতদ্বীপবাসী বা বাসিনী ভুলক্রমে ঐ দোকানে গিয়া উপস্থিত হন এবং তাঁহাদের মধ্যে যাঁহারা আসল ব্যাপার বুঝিতে পারেন না, তাঁহারা সন্তুষ্টচিত্তেই সওদা করিয়া চালিয়া যান; কিন্তু এই প্রতারণা ধরা পড়িলে যে আবার অনেকে মুখের উপরেই দোকানদারকে প্রবঞ্চক ভন্ড বলিয়া বধুর সভাষণে আপ্যায়িত করেন, এটাও সত্য! অনেকে ভদ্রতার খাতিরে বাহিরে কিছু না বলিলেও মনে মনে দেশীয় দোকানদারের এই ক্ষুদ্রত্বের নিন্দা না করিয়া পারেন না। আর নাম ভাঁড়াইয়া কোন কাজ করিবার পর আসল নামটা প্রকাশ হইয়া গেলে কেহ যদি মুখের উপরেও গালাগালি করে, তাহা নির্বিকার চিত্তে হজম করা ভিন্ন কোন উপায় থাকে না। কিন্তু, দ্বারে আসল নামটা লেখা থাকিলে অন্তরের বাহিরের এ-সব কোন বিড়ম্বনাই আর সহ্য করিতে হয় না। তা ছাড়া, এই রকম কালার গায়ে সাদার দাগ লাগাইয়া লাভও যে খুব বেশী হয় তাহা আমরা কিছুতেই বিশ্বাস করিতে পারি না। কারণ ইহাতে এই রকম দোকানদারগণ যেমন দু-একটি বিদেশী খরিদ্দার পান, তেমনি আবার অনেকগুলি স্বদেশী খরিদ্দারও হারান। কেননা আমাদের দেশের শহরের সোজা বা পাড়াগাঁয়ের ভদ্র মাঝারি লোকে সহজে সাহেবের দোকান মাড়াইতে চান না। ইঁহাদের কেহ বা ওসব বিজাতীয় হেঙ্গামের মধ্যে যাইতে চান না, কেহ বা স্বদেশী দোকানেই জিনিস কিনিতে ভালবাসেন, আবার কেহ বা নানান দিক দিয়া নিজের দীনতা ধরা পড়িবার ভয়ে ওসব দোকানে যান না।

No comments:

Post a Comment