Untitled-55-300x226একটি সুশৃঙ্খল জাতি গঠনের জন্য কী কী চারিত্রিক গুণ প্রয়োজন তার উপর মাননীয় এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী হেযবুত তওহীদের সদস্য-সদস্যাদের উদ্দেশে একটি ভাষণ দান করেন যার উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে আসমাউ-ওয়া-আত্তাবেয়্যু নামে একটি পুস্তিকাও প্রকাশিত হয়। তার প্রথম অংশ আজ তুলে ধরছি।
হেযবুত তওহীদের প্রিয় মোজাহেদ ও মোজাহেদারা,
সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতাল্লাহে ওয়া বারাকাতাহ্। একটি সমাজ বা জাতি যখন বিপথে পরিচালিত হয় তখন সেটাকে সঠিক পথে (হেদায়াহ) ফিরিয়ে আনা কঠিন কাজ। এই কাজে যারা ব্রতী হবেন তাদের অবশ্যই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রয়োজন, যা ছাড়া ঐ কাজ সম্ভব নয়। সমাজ বা জাতি নয়, আজ সমস্ত মানবজাতি দাজ্জাল দ্বারা বিপথে পরিচালিত, আল্লাহর রসুলের ভবিষ্যদ্বাণী মোতাবেক আল্লাহকে ত্যাগ করে তারা দাজ্জালকেই প্রভু বলে স্বীকার করে নিয়েছে, দাজ্জালের নির্ধারিত, নির্দেশিত পথে মানবজাতি তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক জীবন পরিচালিত করছে। বিপথে পরিচালিত এই মানবজাতিকে আবার হেদায়াতের পথে ফিরিয়ে আনার মতো অতি, অতি কঠিন কাজে যারা নিজেদের নিয়োজিত করবে তাদের অবশ্যই নিজেদের চরিত্রকে অতি কঠিনভাবে গড়ে তুলতে হবে- এ কথা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়। এই কাজের জন্য যে কয়টি অত্যাবশ্যকীয় চারিত্রিক গুণ দরকার তা মহামহীম আল্লাহ আমাদের কর্মসূচির পাঁচ দফায় নিবদ্ধ করে দিয়েছেন যা তোমরা সবাই জানো। সমস্ত পৃথিবী যার করতলগত সেই মহাশক্তিধর দাজ্জালকে হটিয়ে দিয়ে প্রভুত্বের আসনে আল্লাহকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার মতো আপাতঃদৃষ্টিতে অসম্ভব কাজটি করার দায়িত্বে তোমরা নিজেদের নিয়োজিত করেছ। এই কাজ একমাত্র আল্লাহর সাহায্য ছাড়া করা সম্পূর্ণভাবে অসম্ভব এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু কর্মসূচির যে কয়টি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা আল্লাহ বলেছেন (হাদীস, আল হারেস আল আশ’য়ারী (রা.) থেকে তিরমিযী, আহমদ, বাব-উল এমারত, মেশকাত) তা অর্জন না করা গেলে আল্লাহর সেই সাহায্য আসবে না। আর তা না আসলে আমাদের এই সমস্ত প্রচেষ্টা, অপমান, অত্যাচার, নিপীড়ন, জীবন ও সম্পত্তির হানি, পরিশ্রম অর্থাৎ যা কিছু আমরা করছি তা সবই ব্যর্থ হবে। আমাদের সমস্ত কোরবানি বিফলে যাবে। শুধু তা-ই নয়, যাদের কারণে এই চরিত্র গঠনে ব্যর্থতা আসবে তারা আল্লাহর কাছ থেকে কঠিন শাস্তিপ্রাপ্ত হবে।
হেযবুত তওহীদের এখন ১৬ বছর চলছে। (এই ভাষণদানকালে ১৬ বছর চলছিল, এখন ২০ বছর চলছে)। সময় এসেছে একবার পেছনে চেয়ে দেখার এই চরিত্র গঠনে আমরা কতটুকু সাফল্য লাভ করেছি। আমি কোন নবী-রসুল নই, নব্যুয়ত, রেসালাত ১৪’শ বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। কাজেই আমি সঠিকভাবে বলতে পারব না এই অতি প্রয়োজনীয় চারিত্রিক গঠন হেযবুত তওহীদের মধ্যে কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একজন সাধারণ লোক হিসাবে আমার মনে হয় এত বছরে অতি অল্প সংখ্যক মোজাহেদ ও মোজাহেদার চরিত্রে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এসেছে। বাকিদের মধ্যে এমন কোন পরিবর্তন আসে নি যার কারণে আমরা আল্লাহর সাহায্য আশা করতে পারি এবং জেনে রাখো, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া এই ক্ষুদ্র দলটির পক্ষে সমস্ত পৃথিবীর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা দাজ্জালকে পরাজিত করে আল্লাহকে তাঁর যথাস্থানে পুনঃস্থাপিত করা অসম্ভব। এবং আল্লাহর বিরাট করুণা, ১৩’শ বছর পর তাঁর রসুলকে দেওয়া কর্মসূচি আবার আমাকে বুঝিয়ে দেওয়ার পর আমাদের ব্যর্থতার জন্য আমাদের কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। এই কর্মসূচিকে বাস্তবায়ন করার জন্য যে সমস্ত চারিত্রিক গুণ অত্যাবশ্যকীয় তা অর্জন করতে আমার কয়েকটি নির্দেশ নিচে দেওয়া গেল-
১. প্রথমটি ঐক্যবদ্ধ হওয়া:
কারণ ঐক্য ছাড়া কোন অভীষ্ট, কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। কোন কিছুই সেটা একটা পরিবার হোক, গোষ্ঠী হোক, দল হোক, জাতি হোক সেটার মধ্যে ঐক্য না থাকলে সেটা দুর্বল, অক্ষম হয়ে পড়ে। সেটা অন্য দিক দিয়ে, ধনবলে, লোকবলে, সামরিক বলে যতই শক্তিশালী হোক সেটা তার অভীষ্ট কাজে সক্ষম হবে না, তার চেয়ে অনেক দুর্বল শত্র“র কাছেও পরাজিত হবে। এ জন্যই আল্লাহ তাঁর কোর’আনে বারবার সুদৃঢ় ঐক্যের কথা বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সূরা আল এমরান-১০৩) আবার বলেছেন, ‘আল্লাহ তাদেরকে কতই ভালোবাসেন যারা গলিত সীসার প্রাচীরের মত ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে।’ (সূরা আস্ সাফ-৪)। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, আল্লাহ ইটের দেওয়াল, পাথরের দেওয়াল বা অন্য কোন জিনিসের দেওয়ালের কথা না বলে গলিত সীসার দেওয়ালের কথা কেন বলেছেন? সর্বরকম দেওয়ালের মধ্যেই কিছু না কিছু ফাঁক থাকতে পারে যেখান দিয়ে অন্ততঃপক্ষে সুঁই বা সুঁচ ঢোকানো যায় কিন্তু গলিত সীসার তৈরি দেওয়ালে কোন সুঁইও ঢোকানোর জায়গা থাকে না।
এই সুদৃঢ় ঐক্য ভেঙ্গে যাওয়ার প্রথম পদক্ষেপ কোন বিষয় নিয়ে মতভেদ। এই মতভেদ দিয়েই প্রথম ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়। এটাই ভাঙ্গনের প্রথম পদক্ষেপ, প্রথম সোপান। যতক্ষণ পর্যন্ত কোন বিষয়ে একটি দল, একটি পরিবার বা একটি জাতি একমত থাকে ততক্ষণ তারা ঐক্যবদ্ধ থাকে। যখনই কোন বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করা হয়, তখনই প্রথম ভাঙ্গন আরম্ভ হয়। এই জন্য আল্লাহ বলেছেন, এই দীনকে তোমরা কায়েম করো এবং এ ব্যাপারে মতভেদ কোর না (সূরা শুরা ১৪)। লক্ষ্য করো, এখানে আল্লাহ কী সম্পর্কে মতভেদ করতে নিষেধ করছেন। তিনি মতভেদ করতে নিষেধ করছেন দীন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে, কেননা এই বিষয়ে মতভেদ করলে তোমাদের দ্বারা দীন প্রতিষ্ঠা করাই সম্ভব হবে না অর্থাৎ হেযবুত তওহীদের যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তাই অর্জিত হবে না। আরও লক্ষণীয় যে এই আয়াতটি এসেছে সুরা ‘শুরা’য় যার অর্থ হলো পরামর্শ সভা, আলোচনা অর্থাৎ যেখানে মতভেদের সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে। এই ঐক্য যাতে না ভাঙ্গে সে জন্য আল্লাহর রসুল সদা শঙ্কিত ও জাগ্রত থেকেছেন এবং এমন কোন কাজ যখন কাউকে করতে দেখেছেন যাতে ঐক্য নষ্ট হবার সম্ভাবনা আছে তখন ভীষণ রেগে গেছেন। একদিন দুপুরে আব্দাল্লাহ বিন আমর (রা.) রসুলাল্লাহর ঘরে যেয়ে দেখেন তাঁর মুখ মোবারক ক্রোধে লাল হয়ে আছে। কারণ তিনি দু’জন আসহাবকে কোর’আনের একটি আয়াতের অর্থ নিয়ে মতবিরোধ করতে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি বললেন কোর’আনের আয়াতের অর্থ নিয়ে যে কোন রকম মতভেদ কুফর। নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহ (উম্মাহ) তাদের (ওপর অবতীর্ণ) কিতাবগুলির (আয়াতের) অর্থ নিয়ে মতবিরোধের জন্য ধ্বংস হয়ে গেছে। তারপর তিনি আরও বললেন (কোর’আনের) যে অংশ (পরিষ্কার) বোঝা যায় এবং ঐক্যমত আছে তা বল, যে গুলো বোঝা মুশকিল সেগুলোর অর্থ আল্লাহর কাছে ছেড়ে দাও (ওগুলোর অর্থ নিয়ে মতবিরোধ করো না)। (আব্দালাহ বিন আমর (রা.) থেকে মুসলিম, মেশকাত) বিশ্বনবী (সা.) রেগে লাল হয়েছিলেন কেন? কারণ তিনি পরিষ্কার বলেই দিলেন অর্থাৎ আয়াতের অর্থ নিয়ে মতবিরোধ হয়ে জাতির ঐক্য নষ্ট হওয়া ও পরিণামে যে জন্য জাতির সৃষ্টি সেই সংগ্রামে শত্র“র কাছে পরাজয় ও পৃথিবীতে এই দীনকে প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা। এই হাদীসটিতে রসুলাল্লাহ কেবল কোর’আনের আয়াত নিয়ে মতবিরোধ করতে নিষেধ করেছেন, যদিও এই নিষেধাজ্ঞা যে কোন মতবিরোধের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ যাই হোক মতভেদের ফল একই, বিভক্তি। এই ব্যাপারে আল্লাহর রসুল যে পরামর্শ দিয়েছেন তাও গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হচ্ছে মতভেদের প্রশ্ন উঠলেই সেই বিষয় আল্লাহর কাছে ছেড়ে দিয়ে চুপ হয়ে যাওয়া, কোন অবস্থাতেই জাতির মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি হতে না দেওয়া। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, তা হচ্ছে- যে কাজ অর্থাৎ মতানৈক্য, মতভেদ পরিণামে ভাঙ্গন সৃষ্টি করে তা কোন পর্যায়ের অপরাধ? আল্লাহর রসুল বলছেন, তা কুফর। অর্থাৎ এক কথায় মতভেদ, মতানৈক্য যে সৃষ্টি করে সে কুফরী করে, অর্থাৎ সে কাফের হয়। কাফের হলে আর রইল কী? তার সমস্ত আমল তো অর্থহীন এবং তার পরিণাম জাহান্নাম। কাজেই তোমরা হেযবুত তওহীদের মোজাহেদ মোজাহেদারা, যারা দীন প্রতিষ্ঠা করে আল্লাহকে বিজয়ী করতে চাও তারা কখনও কোন বিষয়ে মতভেদ করবে না। আন্দোলন যে বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট অভিমত দেবে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মতবিরোধ করবে না।
ঐক্য ভাঙ্গার দ্বিতীয় বৃহৎ কারণ হচ্ছে গীবত অর্থাৎ পরনিন্দা। হেযবুত তওহীদের মোজাহেদ মোজাহেদারা গীবত কী তা খুব ভালো করে বুঝে নাও। অন্যের সম্বন্ধে তার অনুপস্থিতিতে যে কোন বিরূপ অপবাদ বা কথা বা মতামত প্রকাশ করাই হচ্ছে গীবত, সেটা সত্য হলেও। গীবতের সংজ্ঞা দিতে যেয়ে বা ভালো করে বুঝিয়ে দিতে আল্লাহর রসুল বলেছেন, ‘তোমরা কি জানো গীবত কাকে বলে?’ সাহাবীগণ বলেলেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রসুলই ভালো জানেন।’ তিনি বললেন, ‘তোমার ভাইয়ের প্রসঙ্গে এমন আলোচনা করা, যা সে অপছন্দ করে।’ বলা হলো, ‘তার সম্বন্ধে আমি যা বলি তা যদি সত্যিই তার মধ্যে থেকে থাকে?’ তিনি বললেন, ‘যেসব দোষ তুমি বর্ণনা করছ তা যদি সত্যই তার মধ্যে থেকে থাকে, তবেই তো তুমি গীবত করলে। আর যদি তার মধ্যে সেই দোষ না থেকে থাকে, তবে তুমি তার প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করলে (তুমি মিথ্যাবাদী হলে)।’ (আবু হোরায়রা (রা.) থেকে মুসলিম)। অর্থাৎ কারও সম্বন্ধে বিরূপ সত্য কথা বলাও গীবত। আল্লাহর রসুল বলেছেন, ‘অনুপস্থিত লোক সম্পর্কে যদি তুমি কোন কথা বলতে চাও তবে তার ভালো কাজগুলি বা তার ভালো বিষয় সম্বন্ধে বলো, আর নইলে চুপ থাকো।’ (আবু হোরায়রা (রা.) থেকে মুসলিম)। আল্লাহ নিজে মো’মেনদের লক্ষ্য করে বলছেন, তোমরা অন্যের প্রতি কোন প্রকার সন্দেহ পোষণ করবে না, কারণ অতি সামান্য সন্দেহ করাও গোনাহ, অপরাধ। এবং একে অপরের পেছনে গোয়েন্দাগিরি করবে না, এবং গীবত করবে না। তোমাদের মধ্য কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? কিন্তু তোমরা তা ঘৃণা করো; তোমরা আল্লাহ সম্বন্ধে সতর্ক হও; আল্লাহ তওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু। (সূরা হুজরাত-১২) অর্থাৎ কখনও অসতর্কতায় গীবত করে ফেললে তৎক্ষণাৎ তওবা করবে। এই আয়াতটিতে গীবতকারীর আখেরাতের পরিণতি সম্বন্ধেও ইঙ্গিত করা হয়েছে। হাশরের দিন গীবতকারীদেরকে মৃত মানুষের গোশত ভক্ষণ করতে দেখা যাবে। আল্লাহর রসুল বলেছেন, “মেরাজের রাতে আমি কিছু জাহান্নামীকে দেখলাম যারা মৃত মানুষ ভক্ষণ করছে। আমি জিব্রাঈলকে (আ.) জিজ্ঞাসা করলাম, এই লোকগুলি কারা? তিনি উত্তর দিলেন, ‘তারা পৃথিবীতেও মানুষের গোশত ভক্ষণ করত অর্থাৎ গীবত করত।” (মুস্তাদরাক আল-ওয়াসীল) গীবতের এর চেয়েও ভয়াবহ পরিণাম আছে। সেটা হলো এই যে, যার গীবত করা হয় তার গোনাহÑ যে তার গীবত করে তার আমলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং গীবতকারীর ভালো কাজগুলি, সওয়াবগুলি যার গীবত করা হলো তার আমলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। (আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বোখারী)। আল্লাহর রসুল আরো বলেছেন, গীবত করা ব্যভিচার থেকেও জঘন্য। কারণ কোন ব্যক্তি যখন ব্যভিচার করে তওবা করে আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন। কিন্তু গীবতকারীকে আল্লাহ ক্ষমা করেন না, যে পর্যন্ত না যার গীবত করা হয়েছে সে তাকে ক্ষমা করে। অপর এক বর্ণনায় রসুল এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত বলেছেন যে, ব্যভিচারকারী তওবা করে কিন্তু গীবতকারী সাধারণত তওবাও করে না। (আবু সাঈদ, জাবের (রা:), আনাস (রা:) থেকে বায়হাকী)। কাজেই আমি মোজাহেদ মোজাহেদাদের সাবধান করে দিচ্ছি, তোমরা ঐক্য নষ্টকারী অর্থাৎ তোমাদের ধ্বংসকারী এই দুইটি বিষয় সম্বন্ধে অতি সতর্ক থাকবে। কারও সম্বন্ধে কোন কথা বলতে গেলেই এক মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করবে এবং চিন্তা করবে যদি ঐ মোজাহেদ বা মোজাহেদা এখানে উপস্থিত থাকত তবে তুমি এই কথাটি বলতে কি না। যদি দেখ যে বলতে না, তবে আর বলো না, বললে সেটা গীবত হবে।
হেযবুত তওহীদের সাধারণ মোখলেস অর্থাৎ অকপট, সরলহৃদয় মোজাহেদ মোজাহেদারা, তোমরা হেযবুত তওহীদে কেন এসেছ? অবশ্যই আল্লাহর সার্বভৌমত্ব আবার আল্লাহর হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার সংগ্রামের জন্য, তাই নয় কি? তোমরা কি কোন স্বার্থোদ্ধারের জন্য, পদের জন্য, যশ-সুনাম বৃদ্ধির জন্য আল্লাহর এই সংগঠনে এসেছ? অবশ্যই নয়। তোমরা কি তোমাদের অন্য ভাইবোনদের বা আমীরদের ভুল-ত্র“টি, দোষ ধরার জন্য এসেছ? অবশ্যই নয়। তোমাদের যদি কেউ গাল দেয়, মন্দ বলে বা তোমাদের প্রতি কোন অন্যায় অবিচার করে তাহলে তোমরা অবশ্যই সেটা গায়ে মাখবে না, কারণ তোমরা তো এসেছ শুধুমাত্র আল্লাহ, রসুল এবং দীনের জন্য। কাজেই যখনই তোমরা অন্য কাউকে মোজাহেদ মোজাহেদাদের বা আমীরের কোন সমালোচনা করতে দেখবে তখনই বুঝে যাবে যে সেই লোক আল্লাহ, রসুল এবং দীনের জন্য হেযবুত তওহীদে যোগ দেয় নাই, তার অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে। কোন স্বার্থ কিংবা নিজের নাম- যশ প্রকাশ বা কোন পদ ও কর্তৃত্বের জন্য সে এখানে এসেছে। সে মোখলেস মোজাহেদ নয়, সে মোনাফেক। মোনাফেকদের স্থান কাফের মোশরেকদের জন্য নির্ধারিত জাহান্নামের চেয়েও নিচে, জাহান্নামের সর্বনিু স্তরে (সূরা নেসা-১৪৪) এবং আল্লাহ বলেছেন, শুধু মোখলেসরাই জান্নাতে যাবে। (সূরা সাফ্ফাত ৪০-৪৩-সহ কোর’আনের বহুস্থানে)। কাজেই এই অবস্থায় তোমরা তৎক্ষণাৎ সেই লোকের সম্বন্ধে সাবধান হয়ে যাবে, হয় তার প্রতিবাদ করবে অথবা তাকে উপেক্ষা করবে। আল্লাহর রসুল বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এই উম্মতের ঐক্য ও সংহতির মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতে চায় তাদের ঐক্যের মধ্যে ফাটল ধরাতে চেষ্টা করে, তলোয়ার দ্বারা তোমরা তাকে শায়েস্তা করো, সে যেই হোক না কেন। (আরফাজা (রা.) থেকে মুসলিম) আমাদের বর্তমান অবস্থায় রসুলের আদেশ মত তলোয়ারের মাধ্যমে শায়েস্তা করা সম্ভব নয়, কাজেই আমাদের একমাত্র পথ হচ্ছে তাদের কার্যকলাপের প্রতিবাদ করা অথবা উপেক্ষা করা।
২. দ্বিতীয়টি শোনা অর্থাৎ শ্রবণ করা:
এর অর্থ কী? এটি একটি আরবী বাগধারা বা প্রকাশভঙ্গি। এর দ্বারা অতি সতর্কতার সাথে কোন বিষয়ে সদা, সর্বদা সচেতন হয়ে থাকা বোঝায়। এখানে এই সচেতনতা হচ্ছে দু’টি বিষয়ে। একটি নেতার আদেশ শোনার প্রতি সদা সর্বদা কান খাঁড়া করে রাখা, আমীরের কখন কি আদেশ হয় তা তৎক্ষণাৎ পালনের জন্য প্রস্তুত থাকা এবং অপরটি নিজেদের শৃঙ্খলা অটুট রাখা। লক্ষ্য করো, শৃঙ্খলা শব্দটি কোথা থেকে এসেছে। এটা এসেছে শৃংখল অর্থাৎ শেকল থেকে। শৃঙ্খলাবদ্ধ অর্থাৎ নিজেকে শেকল দিয়ে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধা। এই শেকল হচ্ছে কতগুলি নিয়মকানুন, নির্দেশ ইত্যাদি। শৃঙ্খলাবদ্ধ অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে উরংপরঢ়ষরহবফ হওয়া এবং সেইগুলি সতর্কভাবে যথারীতি পালন করা হচ্ছে শোনা, অর্থাৎ নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে শৃঙ্খলা অর্থাৎ নিয়ম নীতি পালন করার নির্দেশ থাকে সে সম্বন্ধে সদা সর্বদা সতর্ক ও সচেতন থাকা এবং সেই মোতাবেক কাজ করা। এ থেকে বিচ্যুতিকেই, এই সচেতনতার অভাবকেই কোর’আনে আল্লাহ গাফেলতি বলেছেন। তোমরা যখন যেখানে যে কাজেই থাকো সব সময় সতর্ক থাকবে, অতন্দ্র প্রহরীর মতো কান খাড়া করে রাখবে যে কখন তোমাদের উপরে কি আদেশ আসে। রসুলাল্লাহ মো’মেনের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের উপমা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘মো’মেন ব্যক্তির উপমা হচ্ছে নাকের ছিদ্রে রশি লাগানো উটের মত। যে দিকেই তাকে টানা হয় সেদিকে সে যেতে বাধ্য।’ (ইবনে মাজাহ, বাবু ইত্তিবাহ সুন্নাতে রসুলাল্লাহ)।
৩. তৃতীয়টি হচ্ছে আনুগত্য করা:
কর্মসূচির অন্যতম প্রধান গুরুত্ববহ বিষয় হচ্ছে আনুগত্য। এই দীনে আনুগত্য বলতে বোঝায় আদেশ শোনামাত্র বিন্দুমাত্র দেরি বা ইতঃস্তত বা দ্বিধা না করে সঙ্গে সঙ্গে সেই আদেশ পালন করা। এর গুরুত্ব অপরিসীম। কোন সন্দেহ নেই, কর্মসূচির প্রত্যেকটি বিষয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার মধ্যেও আনুগত্যের বিশেষ স্থান আছে। কারণ ইবলিস দ্বারা আল্লাহর আনুগত্যকে ভঙ্গ করা থেকেই শুরু হয়েছে এই সঠিক পথনির্দেশ (হেদায়াহ) ও বিপথের (দালালাত) দ্বন্দ্ব যা আজও চলছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত চলবে। ইবলিস আল্লাহর অস্তিত্ব বা একত্বকে অস্বীকার করে নাই, এবাদতে সে কারও চেয়ে কম ছিল না। সে আল্লাহর সঙ্গে মোনাফেকীও করে নাই, সে শেরকও করে নাই। শুধুমাত্র হুকুম অমান্য করার দরুণ অর্থাৎ আনুগত্য না করার দরুণ সে কাফের হয়েছে, রাজীম হয়েছে, ফাসেক হয়েছে, জালেম হয়েছে এবং মালাউন হয়েছে। এই দীনের একেবারে কালেমার সঙ্গেই অর্থাৎ তওহীদের সঙ্গেই আনুগত্য জড়িত। কারণ এলাহ হচ্ছেন সেই সত্ত্বা যার আদেশ ছাড়া অন্য কারও আদেশ মানা যাবে না, অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব। এই আনুগত্য হচ্ছে একটি সংগঠনের বা পরিবারের বা গোষ্ঠীর বা দলের বা জাতির মেরুদণ্ড। এটা যেখানেই দুর্বল সেখানেই অক্ষমতা এবং ব্যর্থতা। এজন্য এই দীনেও এর অপরিসীম মূল্য দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, হে মো’মেনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস করো (অর্থাৎ যদি তোমরা নিজেদেরকে মো’মেন বলে দাবি করো), তাহলে আল্লাহর আনুগত্য করো, রসুলের আনুগত্য করো এবং আনুগত্য করো তোমাদের আদেশদানের অধিকারী অর্থাৎ আমীরের। (সূরা নেসা-৫৯)। আমীর শব্দটি এসেছে আম্র থেকে, আম্র অর্থ আদেশ এবং আমীর অর্থ আদেশ দানকারী ইংরেজিতে Commander। দেখা যাচ্ছে, এটি একটি চেইন অফ কমান্ড (Chain of command), আল্লাহ, রসুল এবং আমীর। এই চেইন অফ কমান্ডটি একটি সূত্রে গাঁথা, এই চেইনের প্রত্যেকের আদেশের মূল্যই সমান। আল্লাহর এ কথার সূত্র ধরেই তাঁর রসুল বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি আমার হুকুম অমান্য করল সে আল্লাহরই হুকুম অমান্য করল। আর যে ব্যক্তি আমার নিযুক্ত আমীরের আনুগত্য করল, সে আমারই আনুগত্য করল, আর যে ব্যক্তি আমার নিযুক্ত আমীরের হুকুম অমান্য করল, সে আমারই হুকুম অমান্য করল।” (আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বোখারী ও মুসলিম)। এই আনুগত্যের গুরুত্ব এত বেশি যে এর গুরুত্বের গভীরতা বোঝাবার জন্য আল্লাহর রসুল বলেছেন, “যদি কিসমিসের ন্যায় ক্ষুদ্র মস্তকবিশিষ্ট কোন নাক বা কানকাটা (অর্থাৎ বিকলাঙ্গ) ক্রীতদাসকেও তোমাদের আমীর নিযুক্ত করা হয় তোমরা তার কথা শুনবে এবং মান্য করবে, অর্থাৎ বিনা বাক্যব্যয়ে তা আনুগত্য করবে” (উম্মুল হোসাইন (রা.) থেকে মোসলেম, আনাস (রা.) থেকে বোখারী )। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, কী রকম আমীর হলেও তার আদেশ বিনা দ্বিধায় সঙ্গে সঙ্গে পালন করতে হবে। প্রথমত, ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক। মস্তিষ্কের ক্ষুদ্রতার উপমা দিতে গিয়ে যে শব্দটি রসুল আরবীতে ব্যবহার করেছেন সেই শব্দটিকে অনুবাদকারীরা কেউ বাদাম, কেউ আঙ্গুর, কেউ কিসমিস হিসাবে অনুবাদ করেছেন। মস্তিষ্কের, বুদ্ধির কতখানি স্বল্পতা বোঝাবার জন্য আল্লাহর রসুল এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন, অর্থাৎ আমীর বুদ্ধিহীন, নির্বোধ হলেও। দ্বিতীয়ত, কানকাটা অর্থাৎ কোন অপরাধের জন্য তাকে শারীরিকভাবে বিকৃত করা হয়েছে। তৃতীয়ত, কালো মানুষ অর্থাৎ নিগ্রো যাদেরকে তৎকালীন যুগে অত্যন্ত নিচু শ্রেণি হিসাবে গণ্য করা হতো। চতুর্থত, ক্রীতদাস, অর্থাৎ কেনা গোলাম, যার কোন স্বাধীনতা নেই। মনে মনে চিন্তা করো, এর চেয়ে নিকৃষ্ট কোন মানুষ হতে পারে কি? এই রকম একটা আমীরের কথা বলে আল্লাহর রসুল আমাদের বোঝাচ্ছেন যে, এমন কোন আমীরই হতে পারে না যার কোন দোষ ত্র“টি বের করে সেই অজুহাতে তার আদেশ অমান্য করা যায়। অর্থাৎ আমীর যেই হোক, যেমনই হোক তার আদেশের সঙ্গে সঙ্গেই ‘আসমাউ ওয়া আত্তাবেয়্যু’ উচ্চারণ করে অর্থাৎ ‘শুনলাম এবং পালন করছি’ বলে সেই আদেশ যথাসাধ্য কার্যকরী করতে হবে। অর্থাৎ কোন কারণ দেখিয়ে আমীরের হুকুম অমান্য করার সমস্ত পথই আল্লাহর রসুল বন্ধ করে দিলেন। সুতরাং হেযবুত তওহীদে এমন কোন আমীর আছে কি যার কোন ত্র“টি দেখিয়ে কেউ তার অবাধ্যতা করতে পারো? কাজেই আমীরের অনুপযুক্ততার কারণ দেখিয়ে কোন আমীরের অবাধ্যতা অবৈধ, গ্রহণযোগ্য নয়। মোজাহেদ মোজাহেদারা মনে রাখবে, আমীরের কোন হুকুম যে ‘আসমাউ ওয়া আত্তাবেয়ূ’ উচ্চারণ করে সঙ্গে সঙ্গে তা পালন করল না সে আনুগত্যের ধারাবাহিকতা (Chain of command) ভেঙ্গে ফেলল অর্থাৎ সে জাতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে ফেলল। আল্লাহর রসুলের কথা অনুযায়ী আমীরের আনুগত্য করল না মানে রসুলের আনুগত্য করল না অর্থাৎ আল্লাহর আনুগত্য করল না। কাজেই সে ইবলিসের মত ফাসেক অর্থাৎ অবাধ্য এবং ফলে ইবলিসের মতই বিতাড়িত (রাজীম), কাফের, জালেম ও মালাউন হয়ে গেল এবং সে এই আন্দোলনের ধ্বংসের কারণ হয়ে গেল।
কাজেই আমি নির্দেশ দিচ্ছি, মোজাহেদ মোজাহেদারা, যারা সত্যই আল্লাহর জন্য, রসুলের জন্য এবং দীনের জন্য হেযবুত তওহীদে এসেছ তারা সর্বাবস্থায় আমীরের প্রতিটি হুকুম যথাসাধ্য পালন করবে, আনুগত্য করবে। কখনও যেন এর বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় না হয়। শুধু একটি মাত্র শর্ত আছে যেখানে এই আনুগত্য করবে না, সেটা হলো যদি কখনও আমীরের হুকুম আল্লাহর বা রসুলের হুকুমের বিরোধী হয়। ঐ রকম কোন হুকুম হলে তা অমান্য করবে এবং তার ঊর্ধতন আমীরকে জানাবে। এ ব্যাপারে এই হাদীসটি সতর্কভাবে লক্ষ্য করো। এবনুস সামিত (রা.) বলেছেন, “আমরা রসুলাল্লাহর নিকট বায়’আত করেছি, আমাদের আনন্দ-অসন্তুষ্টি, কঠিনতা, বিপদ, সুবিধা ও আমাদের স্বার্থ সর্বাবস্থায়ই আমরা আদেশ শুনবো ও মানবো অনুগত থাকব। আর আমীরের সহিত কোন ব্যাপার নিয়ে মতভেদ করব না। তবে এমন কোন কুফরী যদি দেখতে পাই যা স্পষ্ট ও প্রকাশ্য, সর্বজনবিদিত এবং যার কুফর হওয়ার অকাট্য দলিল আল্লাহর নিকট থেকে থাকবে, তাহলে শোনা ও মানা–আনুগত্যের উক্ত শপথ কার্যকর হবে না”। (এবনুস সামিত (রা.) থেকে মুসলিম)। এ বাদে আমীরের সমস্ত রকম হুকুম শুনতে ও মানতে হবে। যদি আমীরের কোন হুকুম ভুল বা সঠিক নয় মনে হয়, তাতেও আনুগত্য করতে কোন দ্বিধা করবে না। আদেশ ভুল হলে তার জবাবদিহিতা আমীর করবে, মোজাহেদকে করতে হবে না। মোজাহেদের দায়িত্ব শুধু কোন ইতঃস্তত না করে হুকুম পালন করা। আমীরের আদেশ যদি ভুল মনে হয় সেক্ষেত্রে মো’মেনদের করণীয় কি জানতে চাইলে রসুলাল্লাহ জবাব দেন, “তাদের কথা শুনবে ও আনুগত্য করবে, কেননা তাদের ভুলের জবাবদিহিতা বা দায় তাদের আর তোমার ভুলের জবাবদিহিতা বা দায় তোমারই”। (আল হাদরামী (রা.) থেকে মুসলিম) এই দীনে যে রকম শৃঙ্খলা ও আনুগত্য আল্লাহ দেখতে চান এবং তাঁর রসুল যা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ঠিক সেই রকম শৃঙ্খলা ও আনুগত্য হেযবুত তওহীদের মোজাহেদ মোজাহেদাদের মধ্যেও সৃষ্টি ও প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তা না হলে এর উদ্দেশ্য অর্জন ও সাফল্য লাভ হবে না। এ শৃঙ্খলা ও আনুগত্য তোমাদের চরিত্রের মধ্যে সৃষ্টি না হলে আল্লাহ তোমাদের ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নতুন মোজাহেদ মোজাহেদা নিয়ে এসে তাদের দিয়ে হেযবুত তওহীদের সাফল্য আনবেন। বিনা প্রশ্নে এবং সঙ্গে সঙ্গেই আমীরের আদেশের আনুগত্য করার ওপর আল্লাহ ও তাঁর রসুলের এত গুরুত্ব ও চাপ দেওয়ার ফল কী হয়েছিল তা তোমাদের বোঝাতে অসংখ্য উদাহরণের মধ্য থেকে আমি মাত্র দু’টি উদাহরণ দিচ্ছি। একটি উদাহরণ খোলাফায়ে রাশেদীনের সময় অর্থাৎ যখন ইসলাম প্রকৃত ইসলাম ছিল। অন্যটি অনেক পরের যখন ইসলামের বিকৃতি শুরু হয়ে গেছে এবং খলিফা নামধারী কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাজা-বাদশাহ উমাইয়া বংশের শাসন চলছে। আবু বকরের (রা.) পর উমর (রা.) বিন খাত্তাব খলিফা হলেন। তখন উম্মতে মোহাম্মদী তার নেতা আল্লাহর রসুলের উপর আল্লাহর অর্পিত দায়িত্ব আল্লাহর দীনকে পৃথিবীর সমস্ত দীনের (জীবনব্যবস্থা) ওপর বিজয়ী করার সংগ্রামে (লি ইউজহেরাহু আলা দীন-ই কুল্লি হি) মোজাহেদ বাহিনীর সেনাপতি হিসাবে খালেদ (রা.) বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে জেহাদে রত। ওমর (রা.) সেনাপতি খালেদকে (রা.) তার পদ থেকে অপসারণ করে একেবারে সাধারণ মোজাহেদের পদে নামিয়ে দিয়ে আবু ওবায়দাকে (রা.) সেনাপতি পদে নিযুক্ত করলেন। এই আদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোন কথা না বলে, কোন কারণ জিজ্ঞাসা না করে খালেদ (রা.) আবু ওবায়দার (রা.) হাতে সেনাপতির পদ অর্পণ করে নিজে একজন সাধারণ মোজাহেদ হয়ে গেলেন। তার পদচ্যুতির কারণ পর্যন্ত তিনি জিজ্ঞাসা করলেন না এবং কোন শৈথিল্য না করে একজন মোজাহেদ হিসাবে তিনি প্রাণপণ জেহাদ চালিয়ে গেলেন। খালেদ (রা.) মোজাহেদদের মধ্যে এত জনপ্রিয় ছিলেন যে তিনি যদি খলিফার এ আদেশ অমান্য করতেন, তবে ওমরের (রা.) পক্ষে তাঁর ঐ আদেশ কার্যকর করা কঠিন হয়ে পড়ত।
দ্বিতীয় উদাহরণটি হচ্ছে এই ঘটনার অনেক পরে যে সময়ের মধ্যে ইসলামের প্রকৃত আকীদার মধ্যে অনেক বিকৃতি চলে এসেছে এবং উমাইয়াদের হাতে পড়ে খেলাফতের প্রকৃত রূপ বদলে বাদশাহীতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। উমাইয়া বংশের খলিফা আল-ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালেকের সময় ১৭/১৮ বছর বয়সী মোহাম্মদ বিন কাসেম সেনাপতিরূপে ভারতের সিন্ধু প্রদেশে প্রেরিত হন, তিনি যুদ্ধ করে সিন্ধু জয় করেন এবং সমস্ত এলাকা ইসলামের অধীনে আনেন। এরপর তিনি এই অঞ্চলের প্রশাসক নিযুক্ত হন। এমন সময় আল-ওয়ালিদের ভাই সোলায়মান বিন আব্দুল মালেক খলিফা হন। পূর্বের খলিফা আল ওয়ালিদের সাথে নতুন খলিফা সোলায়মানের পারিবারিক শত্রুতা ছিল। খলিফা হয়েই তিনি মোহাম্মদ বিন কাসেমকে পদচ্যুত করে তাকে দামেস্কে ডেকে পাঠান। মোহাম্মদ বিন কাসেমের আমীরগণ অর্থাৎ অধীনস্থ সেনাপতিগণ এই পারিবারিক শত্র“তার কথা ভালোভাবেই জানতেন। তারা মোহাম্মদ বিন কাসেমকে খলিফার হুকুম প্রত্যাখ্যান করে সিন্ধুতেই থেকে যাবার পরামর্শ দিলেন এবং তাদের সবার পূর্ণ আনুগত্যের শপথ নেওয়ার অনুরোধ করলেন। তারা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আপনার ফিরে যাওয়ার অর্থ আপনার মৃত্যু।’ কিন্তু মোহাম্মদ বিন কাসেম এই কারণে তাদের সমর্থন অগ্রাহ্য করে খলিফার আদেশ পালন করে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দামেস্কে ফিরে গেলেন যে, খলিফার আনুগত্য না করলে চেইন অফ কমান্ড ভঙ্গ হবে এবং জাতির শৃঙ্খলা ও আনুগত্য ভঙ্গ হবে। এবং সত্য সত্যই তাকে হত্যা করা হয়।
শুধু আমাদের ক্ষেত্রেই নয়, যেসব জাতি পৃথিবীতে বড় হয়েছে তাদের প্রত্যেকের ভিতরেই এই রকম শৃঙ্খলা ও আনুগত্য ছিল। উদাহরণস্বরূপ ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। কিছুদিন আগেও আমরা যাদের দ্বারা সামরিকভাবে পরাজিত হয়ে দুইশ’ বছর যাদের গোলামি করেছি, সেই ব্রিটিশ জাতির ভিতরও এই শৃঙ্খলা ও আনুগত্যের বহু ঘটনা ইতিহাস হয়ে আছে। তার মধ্যে একটি ঘটনা নিয়ে বিশ্ব বিখ্যাত ইংরেজ কবি লর্ড টেনিসন একটি কবিতা লেখেন। কবিতাটির নাম ঞযব ঈযধৎমব ড়ভ ঃযব খরমযঃ ইৎরমধফব. কবিতাটি স্কুল কলেজের পাঠ্যসূচির মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ঘটনাটি ঘোটেছিল ভূ-মধ্যসাগর অঞ্চলে ক্রিমিয়ায় ১৮৫৪ সনের ২৫ অক্টোবর। সেখানে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী যুদ্ধরত অবস্থায় ছিল। হঠাৎ প্রধান কার্যালয় (Headquarters) থেকে ব্রিটিশ অশ্বারোহী বাহিনীর ওপর শত্র“কে সামনা সামনি আক্রমণ করার আদেশ এলো। আদেশ পেয়ে সেখানকার সেনাপতি হতবাক হয়ে গেলেন এবং সবাই বুঝলেন আদেশটি ভুলক্রমে এসেছে। কারণ শত্র“পক্ষ সেখানে সারি সারি কামান বসিয়ে অত্যন্ত সুরক্ষিত অবস্থান নিয়েছে। এই অবস্থায় সামনা সামনি আক্রমণের অর্থ আত্মহত্যা। কিন্তু আদেশ আদেশই, ভুলই হোক আর সঠিকই হোক, নইলে চেইন অফ কমান্ড ভঙ্গ করা হবে। অশ্বারোহী বাহিনীর সেনাপতি তার বাহিনীকে একত্র করে আদেশ অনুযায়ী সামনা সামনি আক্রমণ করলেন। সামনে, ডাইনে, বায়ে তিনদিক থেকে শত্র“র কামানের গোলা আক্রমণকারী অশ্বারোহী বাহিনীর উপর পড়তে লাগল এবং সেনাপতিসহ বাহিনীটি মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে প্রায় ধ্বংস হয়ে গেল। এই শৃঙ্খলা ও মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও এই আনুগত্য ছিল বলেই এই সাম্রাজ্য পৃথিবীতে এত বি¯তৃত হয়েছিল যে বলা হতো, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না।
আমি জানি না আল্লাহর দেওয়া কর্মসূচির এই শৃঙ্খলা ও আনুগত্যের গুরুত্বের গভীরতা তোমাদের বোঝাতে পারলাম কি না। তবে আমি চেষ্টা করছি। আল্লাহর রসুল ক্ষুদ্রবুদ্ধি, নির্বোধ, নাক কান কাটা, নিগ্রো ক্রীতদাস আমীরের আদেশ বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে পালন করার যে আদেশ দিয়েছেন তার ওপর ভিত্তি করে আমি নির্দেশ দিচ্ছি যে, প্রতিটি মোজাহেদ মোজাহেদা তাদের যার যার আমীরের প্রতিটি আদেশ তৎক্ষণাৎ দ্বিধাহীনভাবে পালন করবে। কারণ আল্লাহর রসুলের বর্ণিত ঐ নির্বোধ আমীরের চেয়ে নিকৃষ্ট কোন আমীর আমি তোমাদের উপর নিয়োগ করি নাই। এই চেইন অফ কমান্ড অর্থাৎ প্রত্যেক আমীরের আদেশমাত্র তার আনুগত্য হেযবুত তওহীদের সর্বত্র কার্যকরী করার নির্দেশ দিচ্ছি। যদি কারও এতে বিন্দুমাত্র আপত্তি থেকে থাকে তবে তার কাছে এবং তাদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, তিনি বা তারা হেযবুত তওহীদ ত্যাগ করে অন্য কোন আন্দোলন বা সংগঠনে যোগ দিন। পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রকার ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত ও প্রতিষ্ঠা করতে শত শত, হাজার হাজার দল, আন্দোলন, সংগঠন চেষ্টা করছে, তার যে কোন একটিতে গিয়ে তারা যোগ দিতে পারেন। এই আন্দোলনে তাদের উপস্থিতির ফলে আন্দোলনের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যাবার আশঙ্কা আছে। তারা হেযবুত তওহীদ ত্যাগ করে গেলে হেযবুত তওহীদ অনেকটা পবিত্র হবে।
সাধারণ মোজাহেদ মোজাহেদাগণের প্রতি আমার নির্দেশ এই যে, তোমরা সচেতন থাকবে যে, কেউ আমীরের আদেশ বিনা দ্বিধায় সঙ্গে সঙ্গে মানতে সঙ্কোচ করে কিনা বা আমীরের বিরুদ্ধে কোন প্রচার-প্ররোচনা করে কিনা। অমন কাউকে দেখতে পেলেই সকলকে আমার এই নির্দেশ মনে করিয়ে দেবে এবং তার সম্পর্কে সতর্ক থাকবে।