Thursday, December 10, 2015

ওঁরা ভালো নেই’, আমরা ভালো আছি তো?

মোখলেছুর রহমান সুমন:
আমরা বর্তমানে যে পথে হাটছি তা আমাদের সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের অনৈক্য, হানাহানি, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, উগ্রপন্থা, ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের সুযোগে আজ দেশের সার্বভৌমত্বই প্রশ্নের মুখোমুখি।
গত সোমবার ৭ ডিসেম্বর দেশের বহুল প্রচলিত জাতীয় দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে চোখ পড়লো। ‘জঙ্গিবাদের হুমকিতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, প্রিয়জন ছেড়ে প্রবাসে একাকী জীবন, তবু অন্তরজুড়ে স্বদেশ/ ওঁরা ভালো নেই’ শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের অব্যাহত হুমকিকে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন এমন কয়েকজন ব্লগার, লেখকদের বর্তমান মানসিক দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরেছেন প্রতিবেদক। নিজের দেশ, পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, চিরচেনা শহর, সেই শহরের মানুষগুলোকে ফেলে রেখে বহুদূরের কোনো দেশের অচেনা কোনো শহরে পড়ে থাকা কতটা কষ্টের তা কেবল ভুক্তভোগীরাই উপলব্ধি করে থাকবেন। আর তাও যদি হতো দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে, পরিবারের দুঃখ মোচনের অভিপ্রায়ে, উন্নত জীবনের খোঁজে তবে কষ্টদায়ক হলেও বাস্তবতার খাতিরে তেমন জীবন মেনে নেওয়া সহজ হয়। কিন্তু প্রতিবেদনটি এমন কিছু ব্যক্তিকে নিয়ে যারা সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে দেশ ছেড়েছেন। ব্লগারদের হিটলিস্ট প্রকাশ করে একের পর খুন, হত্যার হুমকি দিয়ে অব্যাহত ম্যাসেজ, উড়োচিঠি, অজ্ঞাত সন্দেহভাজদের অনুসরণ, সবচেয়ে বড় কথা খুনী বা হুমকিদাতাদের চিহ্নিত করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা তাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ, যে দেশে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা রয়েছে, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিতে বিশ্বাসী দল ক্ষমতায় রয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী-গোয়েন্দা সংস্থা সবই রয়েছে, সেই দেশের কিছু নাগরিককে বিদেশে পাড়ি জমাতে হয়েছে কেবল উগ্রপন্থীদের চাপাতির কোপের আশঙ্কায়, মৃত্যুভয়ে, তাদের হৃদয়ের অবস্থাটা আসলেই শোচনীয়। তবে তাদেরকে এমন একটি নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখে ফেলে দেওয়ার দায় কেবল সরকার বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দেওয়াটা সম্ভবত সমীচিন হবে না। খোলা মন নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যাবে, এর পশ্চাতে আরো অনেকেই দায়ী। এমনকি এর জন্য ভুক্তভোগীরা নিজেরাও দায় এড়াতে পারবেন না। যা হোক সেটা পরে আলোচিত হবে। প্রথমে যে বিষয়টি ওঠে আসে সেটা হলো, দেশে বিরাজিত নিয়ন্ত্রণহীন অসহিষ্ণুতা। ধর্মীয় অহিষ্ণুতাই এখানে সব নয়, একটা দিক মাত্র। আমাদের পুরো জীবনযাত্রা, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র যেখানে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে, সেখানে কেবল ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের উপর দোষ দিয়ে লাভ নেই। তাতে বরং আমরা প্রকৃত বাস্তবতা থেকে সরে যাব এবং সমস্যার সমাধানেও ব্যর্থ হব। আমাদের রাজনীতির দিকে তাকান। সেখানে ভিন্ন দল-মতের উপর দমন, পীড়ন, জেল-জুলুম চলছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তানিরা এদেশের মানুষের উপর যে অন্যায় করেছিল, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত যারাই ক্ষমতায় গিয়েছেন তারা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ঠিক একই অন্যায় করেছেন। আর সেটা এখন লাগাম ছাড়িয়েছে। বিপরীতে যারা ক্ষমতার বাইরে ছিলেন বা আছেন তারাও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য হরতাল, অবরোধ, হামলা, গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি করে এসেছেন, এবং সাম্প্রতিক সময়ে তা মারাত্মক আকার ধারন করেছে। একটি দেশের রাজনীতিতে যখন অসহিষ্ণুতা চরম আকার ধারণ করে এবং রাষ্ট্র তা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় তখন তা খুব স্বাভাবিকভাবেই সমাজের প্রতি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। বর্তমানে তাই হয়েছে। আমাদের পরিবার, সমাজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাঙ্গন প্রতিটি জায়গায় এটা বিস্তার লাভ করেছে। এখন আমরা কেউ কারো সাথে কোনো ব্যাপারেই একমত হতে পারি না এবং অপরের মত ও বিশ্বাসের প্রতি এতটুকু শ্রদ্ধা-সমীহও দেখাতে পারি না। সামান্য ফুটবল খেলা, তাও সেই সুদূর ইউরোপ বা লাতিন আমেরিকার কোনো দেশে যে খেলায় আমাদের দেশ কোনো দিন অংশগ্রহণ করতে পারেনি আর পারবে কিনা তাতেও সন্দেহ রয়েছে, তা নিয়ে যেখানে আমরা মাথা ফাটাফাটি এমনকি খুনোখুনি করে ফেলি, সেখানে ধর্ম বিশ্বাসের ন্যায় একটি বৃহৎ জায়গায় যখন আঘাত লাগে তা মানুষকে কতটুকু উত্তেজিত করে তোলে তা খুব সহজেই অনুমেয়।
এই ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতাকে কেবল নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি তা নয়, একে রীতিমতো নানাভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে, এর পেছনে অনেক শ্রম, মেধা ও অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের সমাজবিজ্ঞানী, গবেষকরা একমত হবেন কি না জানি না, কারণ বর্তমানে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির যেমন অভাব, সত্যকে সত্য বলে স্বীকার করার লোকেরও খুব অভাব। আমাদের রাজনীতিবিদদের বক্তব্য শুনুন। স্থানীয় পর্যায়ে ছোট পরিসরে হোক আর জাতীয় পর্যায়ে বৃহৎ পরিসরে হোক, সেখানে শুনবেন প্রতিপক্ষের প্রতি বক্তাদের কি অপরিমেয় ঘৃণা আর ক্রোধ। মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা নেতার বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য শুনে উল্লাসে মেতে ওঠে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণেরা। এই বিদ্বেষ কি জনসভার সেই মাঠেই হারিয়ে যায়, নাকি সেটা রাজপথ পর্যন্ত গড়ায় সেটা কি আমাদের নেতৃবৃন্দ খেয়াল করেন না? অবশ্যই করেন। কিন্তু তাদের কাছে এটা ইতিবাচক, বলা চলে একটা অতিপ্রয়োজনীয় অস্ত্র। আপনার দলের কর্মী-সমর্থকদের মনে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যত ঘৃণার জন্ম দিতে পারবেন, তাদেরকে আপনি তত বেশি মারমুখী করে তুলতে পারবেন। আর আপনার চিন্তা যেহেতু রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা সুতরাং এই ঘৃণার বাণী ভেতরে ভেতরে জাতির কত বড় সর্বনাশ করে চলেছে সেটা আপনার কাছে মুখ্য নয়।
আমাদের সংস্কৃতির দিকে তাকান। আবহমান বাংলার যে গান, শিল্প-সাহিত্য মাটি ও মানুষকে ভালোবাসার কথা বলতো, দেশপ্রেম জাগ্রত করতো, মানুষ মানুষ হিসেবে ভালোবাসার প্রেরণা দিত সেগুলো হারিয়ে গেছে। তার স্থান করে নিয়েছে বিদেশি সংস্কৃতির অনুকরণে তৈরি নাটক, সিনেমা, গল্পের বইগুলো যেগুলোতে নগ্নতা, যৌনতা থেকে শুরু করে দাঙ্গা, মারামারি, সন্ত্রাস, উগ্রপন্থাকে উপস্থাপন করা হয় অত্যন্ত যতœ সহকারে। নির্মাতারা কোটি কোটি টাকা খরচ করে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই নেতিবাচক বিষয়গুলোকে এতটা আকর্ষণীয় করে তোলেন যে তা আমাদের আড়াই-তিন ঘণ্টা রীতিমতো সম্মোহিত করে রাখে। এই গল্প ও দৃশ্যগুলো কি সিনেমার হলেই সীমাবদ্ধ থাকে নাকি সমাজে এর প্রভাব রয়েছে সেটা কি বিবেচনার বিষয় নয়? নাকি ব্যবসাটাই সবচেয়ে বড়?
সমাজে এখনো অনেক ভাল কাজ হয়। মানুষকে উত্তম কাজে উৎসাহিত করবে এমন অনেক কিছু এখনো আমাদের চারপাশে ঘটে। কিন্তু আমাদের খবরের কাগজগুলোর দিকে তাকান। সেখানে কোনো ভাল সংবাদ পাওয়া যায় না। পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শুরু করে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত অধিকাংশ পাতাতেই খুন, ধর্ষণ, রাজনৈতিক কোন্দল, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দুর্নীতি, মামলা, হামলা ইত্যাদির ছড়াছড়ি। সেই ফাঁকে কাটতি বাড়ানোর জন্য প্রথম পাতার উপরের দিকে ডানে অথবা বামে আর ভেতরের যে কোনো একটা পুরো পৃষ্ঠায় অশ্লীল কিছু ছবি সংবলিত সংবাদ। এটা একটা প্রাকৃতিক নিয়ম যে, সুন্দর, ভালো কাজের প্রচার ভালো কাজকে উৎসাহিত ও প্রসারিত করে। বিপরীতে খারাপ কাজের প্রচার খারাপকে প্রসারিত করে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সচেতনভাবে হোক আর অবচেতনভাবে হোক আমাদের পত্রিকাওয়ালারা একে নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন যে, ‘যা কিছু মন্দ তাই সংবাদ হওয়ার যোগ্য’। তাদের এই নীতি সমাজে অপরাধের বিস্তার ঘটাচ্ছে। ‘ফিল্মি স্টাইলে’ খুন বা অপহরণ বা ধর্ষণের সবিস্তারিত বর্ণনাগুলো সমাজে এমন অপরাধকে উৎসাহিত করছে এটা কি কেউ মনে করেন না? কয়েক মাস আগে পত্রিকান্তরে জানা গেল, নাটোরে মাদ্রাসা পড়–য়া তিন শিক্ষার্থী তাদের এক বন্ধুকে গুম করে মুক্তিপণ দাবি করে না পেয়ে তাকে হত্যা করে। তারপর লাশ খুব কায়দা করে সেপ্টিক ট্যাংকের ভেতরে ফেলে দেয়। অপরাধীদের প্রত্যেকের বয়স ১৫ বা তার নিচে। কথা হচ্ছে এত অল্প বয়সে তারা এত বড় দুঃসাহসী পরিকল্পনা কিভাবে করলো। নিঃসন্দেহে আমাদের নাটক-সিনেমার গল্প কিংবা পত্রিকায় অপরাধের ‘ফিল্মি স্টাইল’ এর প্রতিবেদনগুলো তাদের প্রভাবিত করেছে।
শুরুতে ব্লগারদের ব্যাপারে আমরা কথা বলছিলাম। ব্লগাররা, বিশেষ করে উগ্রপন্থীদের হাতে যারা সম্প্রতি খুন হয়েছেন এবং যারা দেশের বাইরে অবস্থান করছেন তাদের মুটামুটি সবাই ধর্মের ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করেন যেটাকে ধর্মবিদ্বেষ বলা হয়ে থাকে। আজকের যুগে এটা খুব স্বাভাবিক। কারণ ধর্মের নামে সমাজে এমন অসংখ্য অধর্ম প্রচলিত আছে, এমন অনেক কূপমণ্ডূকসুলভ বিষয় চলছে যা ধর্মের প্রতি মানুষকে বিদ্বেষী করে তোলার জন্য যথেষ্ট। মানবতার কল্যাণে আগত ধর্মগুলো তাদের প্রকৃত রূপ হারিয়ে ফেলার কারণে এমনটা হয়েছে। এখন নাস্তিক বা ধর্মবিদ্বেষী যে নামেই সম্বোধন করি না কেন, ভিন্ন মতাবলম্বীদের একটা বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল যে, এদেশের ১৬ কোটি মানুষের মোটামুটি সবাই ধর্মে বিশ্বাসী। কেবল বিশ্বাসী নয়, ধর্ম তাদের নিকট অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার একটি বিষয়। প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীদের নিকট তাদের নিজ নিজ ধর্মের মহামানবদের স্থান খুবই স্পর্শকাতর একটি জায়গায়। আপনি যখন এমন একজন মহামানবের ব্যাপারে সমালোচনা করবেন, আপনার সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে আপনি তা করতে পারেন। কিন্তু আপনার সমালোচনা হতে হবে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত, অকাট্য দলিলসমৃদ্ধ, ভাষাগতভাবে মার্জিত। এক কথায় আপনার সমালোচনার ভাষা যেন বিশ্বাসী ব্যক্তিদের আহত না করে, তাদের সংক্ষুব্ধ না করে, তাদের মধ্যে ক্রোধের সঞ্চার না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারো ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়ার ক্ষমতা স্বয়ং সংবিধান দ্বারা রহিত করা হয়েছে। আপনি যদি এই বাস্তবতাকে স্বীকার না করেন তবে সেটা হবে আপনার ব্যর্থতা। সেক্ষেত্রে আপনি মানুষের হৃদয়কে বুঝতে অক্ষম। আপনি স্বয়ং মানুষের চিন্তা, চেতনা, বিশ্বাসের প্রতি অশ্রদ্ধাশীল। সুতরাং অপরের নিকট হতে আপনি শ্রদ্ধাপ্রাপ্তির প্রত্যাশা করতে পারেন না। ব্লগারদের ব্যর্থতা এখানেই যে তারা বিশ্বাসী মানুষদের হৃদয়ের এই স্পর্শকাতর জায়গাটিকে স্বীকার করেন না বা করতে চান না। সেটা সচেতনভাবে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নাকি নিজের অজ্ঞতাবশত তা কেবল তারাই বলতে পারবেন। কথা হচ্ছে, তারা দেশকে ভালোবাসেন, দেশের মাটিতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে চান, দেশের মানুষকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে দেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে, দেশের মানুষের মধ্যে ঘৃণার জন্ম নেয়, মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে, এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যে সরকার তা সামাল দিতে হিমশিম খায়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এমন পরিস্থিতির দিকে দেশকে ঠেলে দিয়ে তাদের স্বার্থ কি? তারা নিজেদের মুক্তমনা বলে বিশ্বাস করেন এবং সগর্বে তা প্রচার করেন। একজন মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ কেন এই সাধারণ সত্যটুকু বুঝতে পারে না, একটি দেশ যে দেশের প্রায় শতভাগ মানুষ ধর্মবিশ্বাসী সেখানে ধর্মের ব্যাপারে কথা বলতে গেলে অন্তত আর যাই হোক সেই ধর্মের মহামানবদের গালিগালাজ করাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। যারা জীবনে দুয়েকবার হলেও ব্লগে লেখালেখি পড়েছেন, তারাও জানেন কি বিশ্রী ভাষায় সেখানে ধর্মকে উপস্থাপন করা হয়। এটা কোনোভাবে মুক্তবুদ্ধির পরিচয় হতে পারে না। বিশেষ করে সমাজের সর্বত্র যখন অসহিষ্ণুতা, অস্থিরতা, উগ্রতা, ারড়ষবহপব মারাত্মক আকার ধারণ করেছে তখন মানুষের ধর্মবিশ্বাসের ন্যায় স্পর্শকাতর জায়গায় আঘাত মৃদু প্রতিক্রিয়া আশা করা নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। কিংবা নির্বুদ্ধিতা না বলে একেও এক ধরনের উগ্রপন্থা বলা যায়।
এই লেখাটি পড়ে কেউ যদি মনে করেন আমি উগ্রপন্থীদের সাফাই গাইতে কলম ধরেছি সেটা অবিচার হবে। আমি কেবল সমাজে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার ব্যাপারে আমার আতঙ্কের কথাটা তুলে ধরেছি এবং বলতে চেয়েছি এই পরিস্থিতিতে মানুষের ধর্মপ্রসূত উগ্রপন্থাকে নির্মূল করতে হলে আগে মূলে নজর দিতে হবে। সমাজের বর্তমান অস্থিতিশীল, অসহিষ্ণু পরিস্থিতিতে কারো কাছ থেকে সহিষ্ণু আচরণ প্রত্যাশা করার আগে নিজের আচরণকে সংযত করতে হবে। পাশাপাশি সমাজকে গড়ে তুলতে হবে ন্যায়, সততা, সুবিচার, সাম্য আর ভ্রাতৃত্বের উপর। ঘৃণার বাণী ছড়ানো বন্ধ করতে হবে। আমাদের প্রেমের কথা, মানবের কল্যাণের কথা বলতে হবে, ধর্মের প্রকৃত শিক্ষার কথা মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। তখন দেখা যাবে অনেক বড় বড় সমস্যা আলাদাভাবে সমাধান করতে হচ্ছে না, আপনাতেই সেগুলো ঠিক হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতি, ব্যবসা, শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ইত্যাদিতে বিদ্বেষের চর্চা করে আমরা আমাদের বাস্তব জীবনকে প্রেমময় করে তুলতে পারব না। আমাদের এ কথা মনে রাখতে হবে, ঘৃণা ঘৃণারই বিস্তার ঘটায়, ক্রোধঘটিত কোনো কর্ম নতুন ক্রোধের জন্ম দেয়। বিপরীতে প্রীতির কথা, সমানুভূতির কথা সমাজকে সুন্দর করে তোলে। আমরা বর্তমানে যে পথে হাটছি তা আমাদের সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের অনৈক্য, হানাহানি, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, উগ্রপন্থা, ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের সুযোগে আজ দেশের সার্বভৌমত্বই প্রশ্নের মুখোমুখি। এই ভূ-খণ্ডকে নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রের আলামত পাচ্ছি আমরা। আজ তেমন কোনো বৃহৎ ঘটনা যদি ঘটে আমাদের কি পরিণতি হবে আমরা কি ভেবে দেখব না? যে ব্লগাররা দেশে নিজেদের নিরাপদ বোধ করেননি তারা পৃথিবীর বিভিন্ন সমৃদ্ধ দেশে আশ্রয় পেয়েছেন। আমাদের কে আশ্রয় দেবে? বেচারা ব্লগাররা আর যাই হোক আশ্রয়টুকু তো পেয়েছেন। সেখানে খেয়ে পড়ে একটা ছাদের নিজে ঘুমাতে তো অন্তত পারছেন। কিন্তু আমাদের সবার গায়ে তো ‘মুক্তমনা’ ট্যাগ নেই। দেশের বিরুদ্ধে চলমান ষড়যন্ত্র যদি বাস্তবায়িত হয় তবে আমাদের অবস্থা নিশ্চয়ই আজকের সিরীয়দের চেয়ে অধিক সুখকর হবে না।

No comments:

Post a Comment