Thursday, December 31, 2015

ধর্মীয় সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসুন

ধর্মীয় সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসুন


রাকীব আল হাসান
অন্ধত্ব বা দৃষ্টিহীনতা (Blindness) কী? অন্ধত্ব হলো না দেখা, না বোঝা, নির্দিষ্ট একটা গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা, এর বাইরে চিন্তা না করা, গবেষণা না করা। পৃথিবীতে শুধু আমিই ঠিক। কাজেই এর বাইরে আর কোনো কিছুই দেখবো না, জানবো না, শুনবো না। পৃথিবীতে শুধু ধর্মের জ্ঞানই প্রয়োজনীয়, আর আমার সে ব্যাপারে যথেষ্ট পাণ্ডিত্য আছে, কাজেই এর বাইরে অন্য কোনো জ্ঞানের দরকার নেই। আমি যা জানি তাই সত্য, পৃথিবীতে আর কোনো সত্য নেই। স্বর্গে শুধুমাত্র আমিই যাব, আর কেউ যাবে না- এসবই হলো অন্ধত্ব। প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরাই মনে করেন যে তাদের ধর্মই সঠিক, একমাত্র তারাই সঠিক পথে আছে। স্বর্গে, জান্নাতে, হ্যাভেনে যাবার পথ শুধু তাদেরই জানা, কাজেই মুক্তির জন্য সকলকেই তাদের স্মরণাগত হতে হবে। বাকি সকল ধর্মই ভ্রান্ত, অসত্য। সুতরাং যে যত ধর্মই পালন করুক অন্য ধর্মের অনুসারী মাত্রই বিধর্মী অর্থাৎ জাহান্নামী। বিকৃত ইসলামের মুসলিমরা মনে করছে জান্নাতে যাবার অধিকার একমাত্র তাদের। জান্নাতে যাবার পূর্ব শর্তই হলো বর্তমানে ইসলাম নামে যে ধর্মটি চালু আছে তা গ্রহণ করা। অন্য যেকোনো ধর্ম যত যতœসহকারেই পালন করা হোক তাকে অনন্তকাল জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে। আবার হিন্দুরা ভাবছেন হিন্দুধর্মই স্বর্গলাভের একমাত্র পথ। হিন্দুরা ছাড়া কেউই স্বর্গে পৌঁছতে পারবে না। খ্রিস্টানরা ভাবছে স্বর্গের ‘ঊঃবৎহধষ ষরভব’ এ শুধুই তাদেরই একচেটিয়া অধিকার। এই মানসিকতাগুলি নিছক ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছাড়া কিছু নয়। প্রত্যেক ধর্মেই নিজেদের স্বার্থে ধর্মের ধারক বাহক সেজে একটি ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি তাদের এই সংকীর্ণ মানসিকতা দিয়ে সাধরণ মানুষকে প্রভাবিত করে অব্যাহতভাবে জগৎসংসারের অকল্যাণ করে চলেছে। এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে ধর্মীয় বিভেদ, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, অশ্রদ্ধা, দাঙ্গা, জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ। ধর্ম এসেছে মানবতার কল্যাণের জন্য, মুক্তির জন্য। কিন্তু ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাকে বিকৃত করে তারা ধর্মকে বানিয়ে নিয়েছে বাণিজ্যের মূলধন, স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার। তারা নানা ইস্যুতে অন্য ধর্মকে কটাক্ষ করে কথা বলে, অন্য ধর্মের নবী-রসুল, অবতার, মহামানবদের ব্যাপারে অশ্লীল বাক্য ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ায়। সাধারণ মানুষ ধর্ম সম্পর্কে জানার জন্য, ধর্মীয় নানা কার্য সম্পাদনের জন্য এই শ্রেণিটির স্মরণাপন্ন হয়। এরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে নিজেদের মনগড়া কথা ধর্মের নামে চালিয়ে দেয়। সাধারণ মানুষ তাদের কথায় প্রভাবিত হয়। বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর পেছনে এরাই মূলত রসদ যুগিয়েছে। এদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অন্য ধর্মকে ভ্রান্ত, ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক জ্ঞান করে মহামানবদের ব্যাপারে যখন অসত্য, মন্দ বাক্য বিনিময় করে তখনই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সূত্রপাত ঘটে। আল্লাহ বলেছেন- ‘যাহারা মনোযোগ সহকারে কথা শুনে এবং উহার মধ্যে যাহা উত্তম তাহা গ্রহণ করে। উহাদিগকে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেন এবং উহারাই বোধশক্তি সম্পন্ন।’ (সুরা জুমার-১৮)। আল্লাহ মনোযোগ সহকারে সব বিষয় শুনতে বলেছেন, যাচাই করতে বলেছেন, অতঃপর যেটা উত্তম সেটা গ্রহণ করতে বলেছেন। কিন্ত এই ধর্ম ব্যবসায়ীগুলো আল্লাহর এই কেতাবগুলোকে সংকীর্ণ, কূপমণ্ডুক দৃষ্টিহীন করে ফেলেছে। আল্লাহ সকলকে জ্ঞান দিয়েছেন, বুদ্ধি দিয়েছেন, বিবেক দিয়েছেন তাই প্রতিটা বিষয় আমাদের পড়ে দেখা উচিত, যদি বিষয়টি উত্তম এবং যৌক্তিক মনে হয় তাহলে সেটা গ্রহণ করাই জ্ঞানীর কাজ হবে। সাধারণ মানুষকে আজ ধর্ম ব্যবসায়ীরা অন্ধ করে রেখেছে। ধর্মব্যবসায়ীরা কোনো কথা বললে সেটা সত্য কি মিথ্যা সাধারণ জনগণ তা যাচাই করে না। কিন্তু বিবেকবান ও দৃষ্টিসম্পন্ন প্রতিটি মানুষের অবশ্যই সেটা যাচাই করা উচিত। কারণ এটা স্রষ্টার নির্দেশ।
একটা বিষয় সকলকে অনুধাবন করতে হবে- এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা নিশ্চয় সংকীর্ণ নন। যাঁর সৃষ্টি এত অসীম, তাঁর নিজের বিরাটত্ব কতটা অসীম এবং নিখুঁত! কাজেই তাঁর নিকট থেকে আগত ধর্মও বিশাল, উদার, ত্র“টিমুক্ত। সকল ধর্মই সেই মহান স্রষ্টার নিকট থেকে আগত। সকল ধর্মের মূল বাক্য একই, মৌলিক শিক্ষাগুলি অভিন্ন। আপনি কোন ধর্মের অনুসারী এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, আপনি আপনার ধর্মের মূল বাক্যে, মৌলিক শিক্ষার মধ্যে আছেন কি না সেটাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি পৃথিবীতে শান্তিতে বসবাস করতে চান, পৃথিবীকে স্বর্গরাজ্য তথা কিংডম অব হ্যাভেন বানাতে চান, সত্যযুগ ফিরিয়ে আনতে চান, পৃথিবীকে জান্নাতে পরিণত করতে চান মৃত্যুর পরও যদি জান্নাত, স্বর্গ তথা হ্যাভেনে যেতে চান তবে আপনাদেরকে নিজ নিজ ধর্মের মৌলিক শিক্ষার দিকে ফিরে যেতে হবে। আপনাকে জানতে হবে সেই মৌলিক শিক্ষাগুলি কী? মূল বাক্য কোনটি? এক কথায় স্বর্গে, জান্নাতে তথা হ্যাভেনে যাবার প্রকৃত উপায় কী?
সকল ধর্মের মূল বাক্য হলো জীবনের সর্বক্ষেত্রে স্রষ্টা ঈশ্বর তথা আল্লাহর হুকুমের যথাযথ বাস্তবায়ন। মানবরচিত ভোগবাদী, জড় ও বস্তুবাদী, স্রষ্টাহীন সকল তন্ত্র-মন্ত্র প্রত্যাখ্যান করে স্রষ্টার দেওয়া বিধান সার্বিক জীবনে প্রতিষ্ঠা করাই হলো মুক্তির একমাত্র পথ। এটাই সকল ধর্মের মূল বাক্য। অর্থাৎ জান্নাতে যাবার পূর্ব শর্তই হলো জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে স্রষ্টার হুকুমের যথাযথো বাস্তবায়নের মাধ্যমে পৃথিবী থেকে সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, যুলুম, যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানি, রক্তপাত, অশান্তি দূর করে অনাবিল শান্তি ও পূর্ণ নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা। স্বর্গে কারা যাবে এর এক কথায় উত্তর হোল, যারা একমাত্র স্রষ্টার ইবাদত করবে। আর স্রষ্টার ইবাদত হচ্ছে মানবজাতির শান্তির জন্য সকল প্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এই কাজ না করে যত উপাসনার আনুষ্ঠানিকতা, পূজা, অর্চনা, নামাজ রোযাই করা হোক না কেন সেগুলি কোনটাই ইবাদত হিসাবে কবুল হবে না, মানুষকে স্বর্গে নিতে পারবে না।
আর সকল ধর্মের মৌলিক শিক্ষা হলো মানুষের অভ্যন্তরস্থ মানবীয় গুণাবলীকে জাগ্রত করা। দয়া, মায়া, ভালোবাসা, মনুষ্যত্ব, মানবতা, সৌহার্দ্যতা, বিবেক, সহমর্মিতা, ঐক্য, শৃঙ্খলা, অপরকে সহযোগিতা করা ইত্যাদি হলো মানবীয় গুণাবলি, এই বৈশিষ্ট্যগুলো যখন হারিয়ে যায় তখন সে আর মানুষ থাকে না। তার কোনো ধর্ম থাকে না। সে তখন ধর্মহীন হয়ে যায়। সে তখন পশুতে পরিণত হয়। সে যে ধর্মের ধ্বজাধারীই হোক না কেন এই গুণাবলি যদি তার মধ্যে না থাকে তবে সে মনুষ্য রূপধারী পশু।

No comments:

Post a Comment