Tuesday, December 8, 2015

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে দেশকে বাঁচানো এখনো সম্ভব

[দৈনিক বজ্রশক্তির দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে “বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার নানামুখি ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় জনসচেতনতার বিকল্প নেই” শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশেরপত্র.কম এর নির্বাহী সম্পাদক রিয়াদুল হাসান। তার বক্তব্যের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।]
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জনসম্পৃক্ততার প্রসঙ্গটি যখনই আসে তখনই জনগণকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে অনুপ্রাণিত করা, উদ্দীপ্ত করার জন্য একটি আদর্শের প্রয়োজন পড়ে। সাম্রাজ্যবাদী ও ধর্মব্যবসায়ীদের সম্মিলিত ষড়যন্ত্রেই আজকে সারা বিশ্বে জঙ্গিবাদের উৎপত্তি হয়েছে। এই সংকটের সূচনা আফগানিস্তান থেকেই। এভাবে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদকে ভিত্তি করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় শুরু হয়ে গেছে। যে কোন মুহূর্তে একটা কিছু হবে, পরিস্থিতি প্রতি মুহূর্তে অবনতির দিকে যাচ্ছে। ভারী ভারী মারণাস্ত্র নিয়ে আসা শুরু হয়েছে। পুতিনকে ইতোমধ্যেই অ্যাটম বম্ব নিক্ষেপ করার জন্য প্ররোচিত করা হচ্ছে। আজকে যে এই পর্যন্ত আসলো এটা তো এক দিনে হয় নাই। তাহলে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হলে জনগণের সামনে দুইটা জিনিস পরিষ্কার করতে হবে। একটা হলো এসব জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের উদগাতা কারা, এর উৎপত্তি কোত্থেকে। শুধু অন্ধের মত ধর্মকে দোষারোপ করে লাভ হবে না। কোন ধর্মই সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয় নাই। ধর্ম যখন ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে বন্দী হয়ে গেছে, তারা যখন বাণিজ্যিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে, ধর্মের অপব্যবহার করেছে, হারামকে হালাল, হালালকে হারাম বলা হয়েছে, জায়েজকে নাজায়েজ, নাজায়েজকে জায়েজ বলা হয়েছে। জাতির ক্ষতি, জনগণের ক্ষতি চিন্তা না করে ব্যক্তিস্বার্থে, গোষ্ঠী স্বার্থে তারা ধর্মকে ব্যবহার করেছে। এটাকে কাজে লাগিয়েছে সাম্রাজ্যবাদ। তাই আমি বলব বর্তমানের যে সন্ত্রাসবাদ তা ধর্মব্যবসায়ী আর সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রের সম্মিলিত রূপ। আমাদেরকে সমস্যার মূল গোড়া চিহ্নিত করতে হবে।
তারপর আরেকটা জিনিষ বুঝতে হবে যে আমাদের জনগণ ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। ধর্মকে তারা বিশ্বাস করে। অল্পসংখ্যক লোক আছে তারা ধর্মের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমাদের গণমাধ্যমগুলো ফোকাস করছে একেকজন একেক দিকে। মিডিয়ায় দেখা যায় অধিকাংশই ইসলামবিদ্বেষী কথা, ধর্মহীন কথা। কারণ আমাদের মিডিয়া তো পশ্চিমাদের অনুসারীমাত্র, পশ্চিমা বড় বড় গণমাধ্যমগুলো তাদের ইমাম, আর আমাদের মিডিয়াগুলো সেই ইমামের অনুসারী, মুসল্লী। ইমামরা যে দিকে সেজদা করে, মুসল্লি মিডিয়ারাও সেদিকেই সেজদা করে। এই মিডিয়ারা একচেটিয়াভাবে ধর্মবিরোধিতা করছে, মানুষের দৃষ্টিকে এদিক সেদিকে নিয়ে যাচ্ছে বিক্ষিপ্ত বিষয়ের উপর ফোকাস করার মাধ্যমে। জনগণ বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে, পথ দেখছে না। আমাদের জনগণকে বুঝাতে হবে যে জঙ্গিবাদের উৎপত্তি কোথা থেকে, কে তাকে বড় করছে।
দ্বিতীয় যেটা বুঝাতে হবে সেটা হচ্ছে, জনগণ, আপনারা যে নির্বিকার থাকেছেন, খাচ্ছেন-দাচ্ছেন, ঘুমাচ্ছেন, আপনারা ভাবছে এটা সরকারের দায়, পুলিশের মাথাব্যথা। কিন্তু এটা সরকারের মাথাব্যথা নয়। জনগণ হলো দেহ আর সরকার তার মাথা। সরকারের মাথাব্যথা হলে শরীরও সুস্থ থাকে না। তাই জনগণকেও ভূমিকা রাখতে হবে, তাকেও চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। তাকে শিক্ষা নিতে হবে যে, আপনারাই মরছেন সিরিয়াতে, আপনাদের বউ-বাচ্চা প্রাণ হারাচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে, আপনারই উদ্বাস্তু হবে, না খেয়ে মরবেন। রাজনীতি যারা করছে তারাও মরে, তবে দুই চারজন স্বার্থপর পালিয়ে গিয়ে রাজনীতিক আশ্রয় পায়। সুতরাং আমাদের দেশ আক্রান্ত হলে আমরা যারা সাধারণ জনতা, আমরাই মরব, আমাদেরই বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য যাবে, মান সম্মান সব যাবে, আমাদের মাথার উপরে ছাদ থাকবে না, পায়ের নিচে মাটি থাকবে না। আমাদের এক চিলতে দেশ সেটাও হারাবো। আমাদের বংশধর বড় হবে শরণার্থী শিবিরে। এটা বাস্তবতা। সুতরাং জনগণ কেন সংযুক্ত হবে এটা তাদেরকে বুঝাতে হবে।
জনগণকে ধর্ম দিয়ে বুঝাতে হবে। সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বোঝালে হবে না, কারণ জঙ্গিবাদ সেক্যুলার সমস্যা নয়, এটি ধর্মীয় অপব্যাখ্যা। এর সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরতে হবে। যেমন কোর’আনে কেতাল করতে বলা হয়েছে, রাসুল কেতাল করেছেন কিন্তু তিনি কখন করেছেন? তিনি যখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন তখন করেছেন। জঙ্গিরা এ বিষয়ে মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছে। আমাদের দেশে একটি জঙ্গিবাদী ব্যক্তি বা সংগঠন হঠাৎ একজন বিরুদ্ধমতের মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করছে। তার হাতে তো রাষ্ট্রশক্তি নেই, সুতরাং তার এই কাজ তো ইসলাম সমর্থনই করে না। জেহাদ মানে কী? জেহাদ মানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। যারা নিজেরাই অন্যায় করছে তারা আবার সেটাকে জেহাদ বলে প্রচার করছে। যারা এটা বোঝে না, তারা তাদের কথায় প্রভাবিতও হচ্ছে।
মানুষকে বোঝাতে হবে যে, আকীদা ঠিক না থাকলে তোমার ঈমানের মূল্য নাই। আকীদা হচ্ছে সামগ্রিক ধারণা। কোনটা আগে, কোনটা পরে, কোনটা এখন, কোনটা তখন, কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কোনটা কম, এই জিনিসটা আগে বুঝাতে হবে। তারপর হল জাতীয় ঐক্যের গুরুত্ব বোঝাতে হবে। মুসলিমরা নিজেরাই যখন শিয়া-সুন্নীতে মারামারি করছে সেখানে তারা অমুসলিমদেরকে হত্যা করতে যাচ্ছে। তাদেরকে বোঝাতে হবে যে আগে তোমরা মুসলিম দাবিদাররা এক হও, সকল অন্যায়- অবিচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হও। তাহলেই তোমরা শ্রেষ্ঠত্ব ফিরে পাবে। তোমাদের ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের সূত্র ধরেই মধ্যপ্রাচ্য গুড়িয়ে দিচ্ছে, তোমরা ১৬০ কোটি হয়েও ভেসে যাওয়া আবর্জনার মতো মূল্যহীন। তাদেরকে বোঝাতে হবে যে তোমরা সিরিয়া যাচ্ছ, আফগানিস্তান যাচ্ছ জেহাদ করতে? তোমার নিজের দেশকে আগে শান্তিমণ্ডিত করো, সত্যের পক্ষে আনো। সেটাই তোমার জেহাদ, সেটাই আসল এবাদত। এইভাবে মানুষকে ধর্মের প্রকৃত রূপ শিক্ষা দিতে হবে।
ইদানীং তো আমরা কথা বলায় বেশি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ২৬-২৭ টা চ্যানেলে সমানে চলে টকশো। রাজনৈতিক নেতারা পার্লমেন্টে দাঁড়িয়ে, মঞ্চে উঠে আহ্বান করতে থাকেন। কিন্তু আহ্বানই সার, কেউ এগোয় না। কারণ আহ্বান এক জিনিস, বাস্তবতা আরেক জিনিস। এগিয়ে আসবে কি করে? একটা কনসেপ্ট দ্বারা যে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা যাবে এটা তো তাদের ধারণাতেই নেই। সবাই তাদের পরিণতিকে নিয়তির উপর ছেড়ে দিচ্ছে। পুতিন আর ওবামা কি করে বসে বসে ঐ খেলা দেখছে। আমরা দর্শক আর তারা হলো বিশ্ব রঙ্গমঞ্চের বড় বড় একেকজন শিল্পি। আমরা টিভি দেখি আর স্বার্থপরের মতো আত্মকেন্দ্রিক জীবনযাপন করি, আর সবাইকে আহ্বান জানাই কিন্তু নিজেই যাই না।
জঙ্গি বিমান বানানো হয়েছে জঙ্গ মানে যুদ্ধ করার জন্য। যারা এসব জঙ্গি বিমান বানাচ্ছে তারাই যে বড় জঙ্গি তা কেউ খেয়াল করছে না। জনগণ বেখবর। কাজেই আমাদের কথা হলো এটাই যে ফোকাস অন্য দিকে নিবেন না। ফোকাস এক দিকে দিতে হবে। আমরা টিভিতে দেখেছি, পৌরসভার একটি নির্বাচনকে কয়েকদিন ধরে সব টিভিতে দিনরাত দেখিয়েছে। পুরো জাতির ফোকাস নিয়ে গেছে ঐদিকে। সেখানে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে মিডিয়াগুলা কারণ মানুষ কোটি কোটি টাকা খরচ করে নমিনেশন কিনেছে। সেখানে টাকার খেলা চলছে। তাই মিডিয়াগুলো সেদিকে দৌড়াচ্ছে। এটা ঠিক নয়। আমাদের ফোকাস ঠিক রাখতে হবে। আমাদের একটি স্বভাব হয়েছে যে রাষ্ট্রপ্রধান কোনো কথা বললেই সেটাকে তাচ্ছিল্য করতে হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, প্রধানমন্ত্রী তার অবস্থাগত কারণে যা জানেন তা আমরা জানতে পারি না। তাই তার কথার অন্ধের মত বিরোধিতা করলে হবে না। তিনি বলেছেন, দেশকে জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য ষড়যন্ত্র চলছে, চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে রীতিমত। স্বীকার করলেই পশ্চিমারা উড়ে আসবে, সহযোগিতার নাম করে দেশ দখল করে নেবে। এখন তো এ সংকট দৃশ্যমান। আমাদের জনগণ যত দ্রুত এই সংকটটি বুঝতে পেরে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবে ততই আমরা নিরাপদ হবো।

No comments:

Post a Comment