Thursday, December 17, 2015

লাঞ্ছিত -কাজী নজরুল ইসলাম



মানুষ চিরকাল মানুষের উপর যে অত্যাচার করিয়া আসিতেছে, তাহা পশুদের পক্ষে অসম্ভব। কারণ মানুষ একটি চিন্তাশীল পশু। তাহার বুদ্ধি বৃত্তি এত প্রবল যে, ইচ্ছা করিলেই সে তাহার ভিতরকার পশুটিকে দুর্দান্ত এবং নির্মম করিয়া তুলিতে পারে। পশুর চেয়ে তার সুখ আরামের স্পৃহা একবিন্দু কম নয় এবং এই নিমিত্ত সে পৃথিবী কেন সৌরজগতটাকে ধরিয়া বাধিয়া তার আরামের যন্ত্রে পরিণত করিতে চেষ্টা করিয়া আসিতেছে। তাই রেল স্টিমার, বিদ্যু গাড়ি, কলকারখানা একটির পর একটি করিয়া মানুষের আরামের নিমিত্ত সৃষ্টি হইতে লাগিল এবং এই নিমিত্ত বায়ু, বিদ্যুৎ হইতে আরম্ভ করিয়া কোটি কোটি মনুষ্য পশুপক্ষী, অপেক্ষাকৃত মুষ্টিমেয় প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন মনুষ্য-পশুর দাসখৎ লিখিয়া দিতে বাধ্য হইতে লাগিল। কেহ ধর্মের নামে, কেহ বা সমাজ, শান্তি ও শৃঙ্খলার নামে কোটি কোটি জীবনকে দাসত্ব শৃঙ্খলে বদ্ধ করিতে লাগিল। ফলে আজ সাত সমুদ্র তের নদী পার হইয়া ইউরোপীয়গণ এশিয়া ও আফ্রিকার ধর্মও সমাজ শাসন করিতেছে, আবার আমাদের সমাজে কতকাল ধরিয়া মুষ্টিমেয় তথাকথিত উচ্চজাতীয় নিুজাতির ধর্ম ও সমাজ রক্ষা করিয়া তাহাদের পরলোকে সম্পত্তি করিতেছে। গৃহ শিল্প নষ্ট করিয়া ধনী কল স্থাপন করিলেন, অংশীদারেরা শতকরা পঞ্চাশ টাকা লাভ করিয়া স্বদেশীর কল্যাণ হউক বলিয়া আশীর্বাদ করিলেন। কিন্তু সহস্র সহস্র শিল্পী কলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করিতে না পারিয়া জাত ব্যবসায় ছাড়িয়া দিয়া স্ত্রী পুত্রের হাত ধরিয়া রাস্তায় দাঁড়াইল। তাই আজ শত সহস্র তাঁতী জোলা, কামার কুমার বৈরাগী হইয়াছে। সহস্র লোক স্ত্রীপুত্র লইয়া কুলির কাজ করিতেছে। দিন দিন চুরিডাকাতি বৃদ্ধি পাইতেছে। লক্ষ লোকের অন্ন সংস্থানের সর্বনাশ করিয়া চারি পাঁচশত লোক ধনী হইলেন এবং বিলাস ব্যসনে অর্থব্যয় করিলেন। উকিল দেখিতেছে মক্কেলের কত খাওয়া যায়। মহাজন দেখিতেছে দেনাদারের ভিটে মাটিটুকু কি করিয়া নেওয়া যাইতে পারে ভদ্রলোক ভাবিতেছে ঢং দেখাইয়া কত বোকা ঠকানো যাইতে পারা যায়। কেউ বা বুদ্ধি বিক্রয় করিতেছেন, কেউ বা দেশনীতির মেলা খুলিয়া বসিয়া আছেন। সবাই কে কার মাথা খাইবেন ভাবিয়া অস্থির। পরের ভাবনা ভাবিবার তিল মাত্র সময় নাই। এই যে সারাদিন এত ব্যস্ততা সে শুধু কি করিয়া দুর্বলকে পেষণ করিয়া আর একটু বড় সঞ্চয় করা যায় তাহার চেষ্টার নিমিত্ত।
ভারতভর্ষে শতকরা সত্তর জন চাষী। তারা আজ অহরহ পরিশ্রম করিযা দু’বেলা খাবার অন্ন যোগাড় করিতে পারে না। মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকেরা অসদুপায়েও স্ত্রী পুত্রের মুখে ভাত তুলিয়া দিতে পারে না। রোগ লইয়া দুর্ভিক্ষ ঘরে ঘরে মহাজনের মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে এদিকে উচ্চজাতি মৃত্যু কালেও নিুজাতিকে এক ধাপ উপরে উঠিতে দিবে না। জমিদারের জমি নিলামে, তবুও সে প্রজার হাত ধরিবে না। বাবুরা ছোটলোকদের এখনও দূরে রাখিতেছেন। এ দেশী বড়লোকেরা ধর্ম সমাজ এমনকি রাজনীতি ক্ষেত্রেও আভিজাত্য ও কালচারের গর্বটুকু ভুলিতে পারিতেছেন না। সমস্ত জাতিটা যেন মরণের দিকে ছুটিয়া চলিয়াছে। এমনি সময় যত দেশের যত লাঞ্ছিত, তাহাদের ব্যথা বুকে লইয়া মহাত্মা ভারতের শহরে শহরে ঘুরিতে লাগিলেন। আর বলিতে লাগিলেন, ‘কে আছো লাঞ্ছিত পতিত ! ওঠো ! জাগো! মুক্তি তোমার দুয়ারে। তুমি উঠিয়া তোমার প্রাপ্য বুঝিয়া লও।’
স্বরাজের আশায় নাকে রুমাল দিয়া বাবুর দল ন্যাংটা সন্ন্যাসীর কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। মহাত্মার কথায় সায় দিয়া যাইতে লাগিল। কিন্তু অস্পৃশ্যতা আর নিচু জাতির উন্নতির কথায় বিশেষ কান দিল না। এমনকি খদ্দর জিনিসটাকেও সুবিধা মত মিশ্র খদ্দর করিয়া লইতে দ্বিধা করিল না।
নিু জাতিÑজাতির অধিকাংশ লোখ Ñ যেখানে ছিল, বাবুর সমাজ তাহাদিগকে সেইখানেই চাপিয়া রাখিল। আর যেই আন্দোলনে মন্দা পড়িল অমনি বাবুর দল ক্ষেপিয়া উঠিল ‘খদ্দরে স্বরাজ হইবে না।’ নিু জাতির কথা বলাও যা, ভূতের কাচে রাম নাম করাও তাই। তাই মহত্মা জেলে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, লক্ষ্মী কেমন আছে ? লক্ষ্মী মহাত্মার পালিতা নীচ জাতীয়া কন্যা। তিনি লক্ষ্মীর নামে সকল নীচ জাতির কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন। কে আছো পতিত, লাঞ্ছিত, কে আছো দীন, হীন, ঘৃণিত, এসো ! যে শক্তি বলে তোমার ভাইরা ফরাসির হাজার বছরের অত্যাচার ও আভিজাত্য দুইদিনে লোপ করিয়া দিয়াছিল, যে অন্যায় সাইবেরিয়ার লক্ষ বন্দী সন্ত্রাসদাতা দুর্ধর্ষ সুপ্রতিষ্ঠিত শাসন ভাসিয়া গিয়াছিল, যে শক্তিময়ীর বিকট হাস্য সমস্ত জগতের অত্যাচারকে উপহাস করিয়া ধনগর্বিতদের গৃহে গৃহে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, সেই শক্তিময়ী সেই সর্বনাশের বন্যা লইয়া তোমার দুয়ারে উপস্থিত, ওঠো, ভাই, মাকে বরণ করিয়া লও।

No comments:

Post a Comment