ছি! লজ্জা এই মানবজাতির জন্য! ধিক্কার এই মানবজাতির জন্য! নিজেকে মানুষ বলে পরিচয় দিতেও আজ কুণ্ঠা হয়। সৃষ্টির সেরা জীবের পদবীধারী (?) এই মানবজাতি দিনদিন যে বীভৎসতার পরিচয় দিচ্ছে তা জন্তু জানোয়ারের হিংস্রতাকেও হার মানিয়েছে। নিকৃষ্টতা, বর্বরতা ও হিংস্রতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করছে মানুষ দাবিদার কিছু নরপশু।
অতি সাম্প্রতিক ঘটনা। ভোলা জেলার বোরহানউদ্দীন উপজেলার আব্দুল মান্নানের ছেলে শিপন। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও লাগামহীন সহিংসতার মধ্যেই পেটের দায়ে জীবন বাজি রেখে কাভার্ডভ্যান নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন চাপাইনবাবগঞ্জে মাল আনার উদ্দেশ্যে। সঙ্গে হেলপার হিসেবে ছিল ১৪ বছরের শিশু শাকিল। কিন্তু রাজনৈতিক সন্ত্রাসের ধারালো পথ অতিক্রম করে কেউই ফিরতে পারলেন না। গত মঙ্গলবার ভোরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে গণতান্ত্রিক সন্ত্রাসের বলি হতে হয় দু’জনকেই। গাড়ি থেকে নামার এতটুকু সুযোগ না দিয়ে একদল নরপিশাচ পেট্রল বোমা ছুঁড়ে গাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফলে কাভার্ডভ্যানের ভেতরেই পুড়তে থাকে চালক শিপন ও হেলপার শাকিল। বহু কষ্টে দগ্ধ শাকিল ভ্যান ছেড়ে বের হতে পারলেও, বের হতে পারেনি চালক শিপন। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনে ঝলসে যায় সে। আমৃত্যু আগুনের যন্ত্রণা ভোগ করে মৃতুর কোলে ঢলে পড়ার পরও জ্বলতে থাকে শিপনের প্রাণহীন দেহটি। হতভাগা এই মানুষটির গোস্ত-চামড়া লেপ্টে যায় পোড়া সিটের লোহার সাথে, মেঝের সাথে। কোনো অপরাধ নেই, কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতাও নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও অন্ধ রাজনীতি তাকে ক্ষমা করল না। এ কেমন বর্বরতা? এ কেমন হিংস্রতা? মানুষ কেন বন্য পশুর চেয়েও অধম জানোয়ারে পরিণত হলো? আরে তুমি যাকে পোড়ালে, তুমি যার পরিবারের মুখের অন্ন কেড়ে নিলে সে তো তোমাদেরই মুখের অন্ন সরবরাহ করছিল! এটাই কি তার অপরাধ? যে শরীরের ঘাম ঝরিয়ে, রক্ত পানি করা পরিশ্রম করে শিপনের দরিদ্র সংসার চলতো সেই দেহখানি পেট্রল বোমার আগুনে জ্বলে কয়লায় পরিণত হলো। যে বয়সে একটি শিশুর বাবা-মার পূর্ণ আদর-সোহাগ ভোগ করার কথা সেই বয়সে শাকিল কিনা মানুষরূপী বন্য হায়েনার লোলুপ শিকারে পরিণত হলো। দেহের ৪০ শতাংশ পোড়ার দগদগে ক্ষত শিশুটি কতক্ষণ বয়ে বেড়াবে? শিশুটির প্রতিটি আর্তনাদ কি আমাদের জীবনে অভিশাপ হিসেবে আবির্ভূত হবে না? রাজনীতিক অধঃপতনেরও তো শেষ বলে কথা আছে, মানসিক বিকারগ্রস্ততারও তো সীমা আছে। আমরা ভালোভাবেই জানি এরপরও রাজনীতিকদের লজ্জা হবে না, ক্ষমতার মোহ দূর হবে না, স্বার্থের জয়গীত বন্ধ হবে না। কারণ আমরা সাধারণ জনগণ ঐক্যবদ্ধ নই। আমরা সহিংসতা-সন্ত্রাসকারীদের স্বার্থের বলি হয়েও নিশ্চুপ, উদ্বেগহীন, প্রতিবাদহীন। এ বীভৎসতাও আমাদের গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে। আমরা একযোগে সকল অন্যায়, অবিচার, সন্ত্রাস, সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হই না। নিয়তির উপর দায় চাপিয়েই দায়িত্বের ইতি টানি, যেন নিয়তিই এ দুর্ভোগের কারণ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ পরিস্থিতি কি আমাদের কর্মফল নয়? মানুষের কর্মের উপর ভিত্তি করেই রচিত হয় মানুষের নিয়তি। তাই আর নিয়তির উপর অপবাদ নয়, আসুন এ অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার হই, সন্ত্রাসকে প্রতিহত করি; পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী এবং দেশ-মাটি ও মানুষের শান্তির কথা ভেবে, এমনকি শুধু নিজের অস্তিত্বের জন্য হলেও যাবতীয় অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ১৬ কোটি জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলি।